আমার নিজস্ব একটা পর্যবেক্ষণ আছে। পর্যবেক্ষণটা ভুলও হতে পারে। বর্তমান সময়ে ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে খুব বেশি আলোচনা-সমালোচনা, কাদা ছোড়াছুড়ি, পারস্পরিক দোষারোপ ইত্যাদির সমাহার চলছে। হলুদ মিডিয়াগুলোও ওয়াজ-মাহফিল নিয়ে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি হর্তাকর্তাদের মুখ থেকেও রকমারি মূল্যায়ন ভেসে আসছে। মাহফিলে মাহফিলে চলছে তাগুতের বন্দনা, চলছে বাকস্বাধীনতা হরণের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। ক্ষমতাসীনদেরকে বিশেষ সব পদ দিয়ে কোথাও-বা বক্তাদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে আলাদা চাপ। এগুলো সবকিছুর পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরানার বক্তাদেরকে পরস্পরের ওপর উসকে দেওয়া হচ্ছে। চলছে কাদা ছোড়াছুড়ি। প্রতিষ্ঠা লাভ করছে বক্তাদের নিত্যনতুন সংস্থা। বড়রা ছোটদেরকেও কখনো লেলিয়ে দিচ্ছে, কখনো তাড়িত করছে, আর কখনোবা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে অন্যদের বিরুদ্ধে বাকযুদ্ধে নামতে।

ফলাফল?

মানুষজন ধীরে ধীরে বিরক্ত হয়ে উঠছে। অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলছে। এর পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ক্রমেই সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন ও মিডিয়ার অবদানে তারা এই অঙ্গনের ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার পেয়ে যাচ্ছে। জনসাধারণও প্রচণ্ড বিরক্তির কারণে তাদের এই অধিকার প্রতিষ্ঠাকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করছে, তারা এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে। একদলকে দমাতে অন্যদলের পরোক্ষ সহযোগিতা নিচ্ছে। জনগণের মনমস্তিষ্কের ওপর ক্রমে ক্রমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বড় সুকৌশলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলছে। পরীক্ষামূলকভাবে আজ এই দলের, কাল ওই দলের বিভিন্ন জনের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে জনগণের মূল্যায়ণ ও অবস্থা বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে। কখনো-বা সব ঘরানা থেকে বিভিন্নজনের নামের সন্দেহভাজন বা কালো তালিকা প্রকাশ করে ভাতে টিপ দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে।

এ সবই কি কাকতালীয় ব্যাপার?

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের দিকে দৃষ্টি দিলে ভিন্ন ধরনের সন্দেহ অন্তরে দানা বাঁধে। যদিও এ জাতিকে এই ব্যাপারে আশ্বস্ত ও সজাগ করা বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপারই বটে। আমরা যদি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়নার বই ‘ইনসাইড র’ অধ্যয়ন করি, তাহলে এই সন্দেহের পক্ষে অনেক প্রমাণই উপস্থাপন করা যায়। যেমন, ভারত ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। কিন্তু চাইলেই তো আর সব কাজ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হয় না। তাই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য অতিরিক্ত দুই বছর সময় নেয় এবং সুকৌশলে প্ল্যানমাফিক কাজ করে যায়। এক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের স্থলে কৌশলী পদক্ষেপ ফেলার হেতু স্পষ্ট হয় ১৯৬০ সালে প্রকাশিত নেহেরুর এক সাক্ষাৎকারে নজর দিলে। সেই সাক্ষাৎকারে নেহেরু বলেছিল, “জোরপূর্বক সিকিম দখল করা হবে মশা মারতে কামান দাগানোর মতো ঘটনা।” এর দ্বারা প্রতিভাত হয়, এক ক্ষুদে সিকিমকে ‘বিরক্ত’ করে নেহেরু নিজের ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা’ অভিধার বারোটা বাজাতে চাননি। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ভারতের কাছে সিকিম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও ইন্ধিরা গান্ধী সিকিমকে দখলে নিতে তার বাবার কৌশলের কথা ভোলেননি।

সিকিমের ওপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সিকিমের ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে সেখানকার নেপালী হিন্দুদেরকে বৌদ্ধ চোগিয়ালদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে এবং গণতন্ত্রের ব্যানার ব্যবহার করে রাজতন্ত্রের অবসানের দাবি তোলে। এর পাশাপাশি নিজেদের চিরাচরতি অভ্যাসানুসারে আন্দোলন, খুন-জখম ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে তারা পরিস্থিতিকে এতটাই ঘোলাটে করে ফেলে যে, সিকিমের অভিজাত হিন্দু সমাজ ভাবতে শুরু করে, “এ বৌদ্ধ রাজাদের অধীনে থাকার চেয়ে আমাদের জন্য ভারতীয় হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে।” এছাড়াও তারা ডাবল গেইম খেলেছিল। একদিকে তারা পালডেনকে আশ্বস্ত করেছে, অন্যদিকে লেন্দুপ দর্জিকে কাজে লাগিয়েছে।

বর্তমান সময়ে ওয়াজ-মাহফিলের অঙ্গনের নির্মম পরিস্থিতি দেখে আমার কেন যেন মনে হয়, এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। পর্দার আড়াল থেকে কোনো শক্তি এর জন্য ইন্ধন জোগাচ্ছে। কিছু মানুষকে দাবার গুটি হিসেবেও ব্যবহার করছে। তারা ধর্মীয় বাকস্বাধীনতার কফিনে শেষ প্যারেকটুকুও ঠুঁকে দেওয়ার জন্য নিজেদের সবধরনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করছে। তবুও কি আমাদের হুঁশ ফিরবে না? তবুও কি আমাদের দিবানিদ্রা ভাঙবে না? নেপথ্যের নায়কদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। দাবার গুটিগুলোকে চূড়ান্তভাবে বয়কট করা প্রয়োজন। দীনদরদী সচেতন মানুষগুলো এখনই এগিয়ে না এলে, কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে এই অঙ্গনটার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে; ইমারাহ প্রতিষ্ঠা অবধি যে ক্ষতি আর কোনোভাবেই পোষানো যাবে না।

Share This