হাদিয়া (উপহার) নিয়ে কিছু কথা


রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وحقَّتْ مَحَبَّتِي لِلْمُتَباذِلِينَ فِيَّ
আমার ভালোবাসা অপরিহার্য হয়ে গিয়েছে সেসব বান্দার জন্য, যারা আমার জন্য একজন অপরজনের পেছনে ব্যয়/খরচ করে। [মুসনাদু আহমাদ : ২২০৬৪; সহিহুত তারগিব : ৩০২০। হাদিসটি সহিহ]

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

تَهَادُوا تَحَابُّوا
একজন আরেকজনকে হাদিয়া দাও; এতে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। [আল-আদাবুল মুফরাদ, বুখারি, পৃ. ৩০৭। হাদিসটি হাসান]

আল্লাহর জন্য একজন আরেকজনকে ভালোবাসা এবং তাঁরই জন্য কাউকে ঘৃণা করা আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম আমল। হাশরের দিন আল্লাহ যে সাত শ্রেণির মানুষকে বিশেষভাবে তাঁর ছায়ায় স্থান দেবেন, তন্মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যারা পরস্পর পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসত। কিয়ামতের দিন আল্লাহ আহ্বান করবেন, কোথায় সেসকল বান্দা, যারা একজন আরেকজনকে আমার জন্য ভালোবাসত? আজ আমি তাদেরকে আমার ছায়ায় স্থান দেবো, যে দিন আমার ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া নেই।

কীভাবে মুমিনদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে, এর বিভিন্ন পন্থা হাদিসে বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন, এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইমান আনা অবধি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসা অবধি ইমান আনতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন উপায় বলে দেবো না, যা দ্বারা নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারবে? (এর উপায় হলো,) তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের বিস্তার ঘটাও।’ সালামের মতো হাদিয়াও ভালোবাসা সৃষ্টির একটি উপায়, যেমনটা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

তবে হাদিয়ার ভিত্তি হতে হয় একমাত্র ভালোবাসা; অন্য কিছু নয়। মানুষ ভালোবাসাকে কোনো আমলই মনে করে না; অথচ এটা মস্ত বড় সুন্নাহ। এর গুরুত্বের কারণেই তো রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘কেউ যখন তার ভাইকে ভালোবাসে, সে যেন তাকে জানিয়ে দেয় যে, সে তাকে ভালোবাসে।’ কারণ, একাকী ভালোবাসার চাইতে পারস্পরিক ভালোবাসা উত্তম। এর দ্বারা সমাজে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সংহতিও সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা প্রকাশেরই একটা মাধ্যম যেমন মৌখিক স্বীকারোক্তি, এরই আরও দুটো মাধ্যম হচ্ছে সালাম এবং হাদিয়া। হাদিয়ার দ্বারা সুন্নাহ জিন্দা হয়, হাদিয়ার দ্বারা পারস্পরিক ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এর উদ্দেশ্য এগুলোই। কেউ যদি হাদিয়া দিয়ে কোনো কিছু দাবি করে, যেমন ‘আমার জন্য দুয়া করবেন’ অথবা ‘আমি যে বইটা দিলাম আপনার টাইমলাইনে এর বিজ্ঞাপন দেবেন’, তবে এটা তো এক ধরনের বিনিময় (উজরত) হয়ে যায়; উপহার (হাদিয়া) থাকে না। ভালোবাসা যদি সৃষ্টি হয়েই যায়, তাহলে দুয়া তো আর চেয়ে নিতে হবে না। একইভাবে হাদিয়ার মধ্যে আলাদাভাবে সওয়াব লাভের প্রত্যাশাও করা যায় না; অন্যথায় তা সদকা (দান) হয়ে যায়।

রাসুলুল্লাহ ﷺ সদকা গ্রহণ করতেন না; কিন্তু তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন। এমনকি তা সামান্য বস্তু হলেও তিনি সন্তুষ্টচিত্তেই তা গ্রহণ করতেন। তিনি বলেন,

لَوْ دُعِيتُ إِلٰى كُرَاعٍ لأجَبْتُ وَلَوْ أُهْدِيَ إِلَيَّ كُرَاعٌ لَقَبِلْتُ.
আমাকে পায়া খেতে দাওয়াত দেওয়া হলে আমি তা কবুল করব এবং আমাকে যদি কেউ পায়া হাদিয়া দেয়, তবে আমি তা অবশ্যই গ্রহন করব। [সহিহ বুখারি : ৫১৭৮]

হাদিয়ার ভিত্তি যেহেতু ভালোবাসা, তাই তা সামান্য বস্তু হলেও রাসুলুল্লাহ ﷺ তা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

يَا نِسَاءَ الْمُسْلِمَاتِ، لاَ تَحْقِرَنَّ جَارَةٌ لِجَارَتِهَا وَلَوْ فِرْسِنَ شَاةٍ
হে মুসলিম নারীরা, কোনো প্রতিবেশিনী যেন অপর প্রতিবেশিনীর হাদিয়া তুচ্ছ মনে না করে, এমনকি তা ছাগলের সামান্য গোশতযুক্ত হাড় হলেও। [সহিহ বুখারি : ২৫৬৬]

তবে অন্যের জন্য অর্থ বা সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে কেউ যদি নিজের পছন্দনীয় বস্তু খরচ করে, তবে সে পরিপূর্ণ প্রতিদান পায়। এ জন্যই তো আনসার সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদেরকে প্রস্তাব দেন, তারা যেন তাদের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে কাকে সবচে বেশি পছন্দ হয়, এ কথা নির্দ্বিধায় জানান। তাহলে আনসারিরা মুহাজিরদের জন্য নিজেদের স্ত্রীদেরকে পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে রাজি ছিলেন। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে খরচ না করা পর্যন্ত কিছুতেই পুণ্য লাভ করতে পারবে না। [সুরা আলে ইমরান : ৯২]

وَآتَى الْمَال عَلَى حُبِّهِ
সম্পদের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তা ব্যয় করে…। [সুরা বাকারাহ : ১৭৭]

রাসুলুল্লাহ ﷺ মুসলিম-অমুসলিম সকলের উপহার গ্রহণ করতেন। তাই তিনি কাফির মুকাওকিসের উপহারও গ্রহণ করেছিলেন (দালায়িলুন নুবুওয়াত, বায়হাকি : ৪/৩৯৫-৩৯৬), আবার মুসলিম বাদশাহ নাজাশির উপহারও নিয়েছিলেন (আখলাকুন নবি, ইসপাহানি : ১৬২)।

সুতরাং কাফিরদের উপহার গ্রহণ করাও জায়িয। সেই উপহার যদি যুদ্ধের ময়দানে হয়, তাহলে তা গনিমত বলে সাব্যস্ত হবে। আর যুদ্ধ ছাড়া হলে সাধারণ উপহার বলে বিবেচিত হবে এবং যাকে উপহার দেওয়া হয়েছে, একমাত্র সেই এর মালিক হবে। [ফাতাওয়া শামি : ৩/২২৮]

তবে কারও কাছে মনে হতে পারে, হাদিয়ার ভিত্তি তো ভালোবাসা; অথচ কাফিরদেরকে তো ভালোবাসা বৈধ নয়। তাহলে তাদের হাদিয়া গ্রহণ করা বৈধ কেন? এর উত্তর হলো, হাদিয়ার ক্ষেত্রে মূলত যাকে হাদিয়া দেওয়া হচ্ছে, তার প্রতি হাদিয়াদাতার অন্তরে নিখাদ ভালোবাসা থাকে। এখন কথা হলো, কাফিরের অন্তরে মুমিনদের প্রতি ভালোবাসা থাকা তো নিষিদ্ধ নয়; বরং তা আরও উত্তম। হ্যাঁ, হাদিয়ার একটা ফলাফল হচ্ছে, হাদিয়াগ্রহীতার অন্তরেও হাদিয়াদাতার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। এখন হাদিয়াদাতা যদি কাফির হয়, তাহলে হাদিয়াগ্রহীতা ইসলামি আকিদা এবং কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ ও নির্দেশনার আলোকে তার এই ভালোবাসা ঠেকাবে। তবে সে চাইলে হাদিয়াদাতার সঙ্গে দাওয়াতি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং হিকমাহ ও উত্তম উপদেশের সঙ্গে তাকে ইসলামের পথে নিয়ে আসতে পারে। ইসলামের সূচনালগ্নে জাকাতের একটা খাতই তো ছিল ‘মুয়াল্লাফাত কুলুবুহুম’; অর্থাৎ কাফিরদের অন্তর দীনের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তাদেরকে জাকাত দেওয়া। এখন এই বিধানের ব্যাপকতা রহিত হয়ে গেলেও এ নিয়তে তাদেরকে উপহার দিতে দোষের কিছু নেই। নিষেধ হলো আন্তরিক ভালোবাসা ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়া।

মুফতি, বক্তা এবং কুরআন ও ইলম শিক্ষাদানকারীদের হাদিয়া গ্রহণের কী বিধান? চার মাজহাবের ঐকমত্য হলো, তাদের জন্য হাদিয়া গ্রহণ করা জায়িয। {উল্লেখ্য, এটা নিখাদ হাদিয়ার ব্যাপারে কথা। তাদের বেতন ও ভাতা (উজরত)-এর মাসআলা আমাদের এই রচনার আলোচ্য বিষয় নয়। তাই সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।} তবে তাদের জন্য কর্তব্য হলো, প্রদেয় হাদিয়া যদি তাদের ফাতওয়া, বয়ান এবং শিক্ষাদানের বিনিময়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা গ্রহণ না করা; যাতে আমল একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ থাকে। আর হাদিয়া যদি হয় তাদের ইলম ও সততার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ও আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ, তাহলে অম্লানবদনে তা গ্রহণ করে নেওয়াই উত্তম। [আল-মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যাহ : ৪২/২৬০-২৬১] তবে এক্ষেত্রে মুফতি ও বক্তাদের জন্য অধিক সতর্কতা কাম্য। কারণ, তারা যদি হাদিয়া গ্রহণ করে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী মনগড়া ফাতওয়া প্রদান করে বা বাতিলের পক্ষে বয়ান করে, তবে এর কারণে তারা ফাসিক বলে গণ্য হবে, যারা পার্থিব স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে দীনকে বিকিয়ে দিয়েছে।

আমাদের সমাজে স্রেফ ভালোবাসার ভিত্তিতে প্রিয় বস্তু উপহারের প্রচলন নেই বললেই চলে। অধিকাংশ জায়গায় উপহার প্রদানের পেছনে পার্থিব লক্ষ্য থাকে। যেমন, ব্যবসার প্রচারণা, দুয়া আদায়, দুনিয়াবি কোনো মাকসাদ পূরণ ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে তা হাদিয়া না হয়ে কখনো হয় বিনিময়; আর ক্ষেত্রবিশেষ চেতনে বা অবচেতনে উপহারের নামে চলে ঘুষের আদান-প্রদান।

Share This