একটা গজল শুনলাম, ‘তুমি আসমানে আছ প্রভু, আমি যমিনে।’ ইদানীং অনেক বক্তাও তাদের ওয়াজে এই গজল গাওয়া শুরু করেছে। আমাদের অনেক তথাকথিত সহিহ আকিদার দাবিদার ভাইয়েরা হয়তো এই গজল শুনে খুব খুশিও হন। সে যাহোক, কিন্তু এই গজল শুনে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত।


এখানে দুটো বিষয় :

(ক) আল্লাহর জন্য কোনো জায়গা সাব্যস্ত করা; সেটা আসমানই হোক কিংবা হোক সব জায়গা।

(খ) কুরআন ও সুন্নাহয় যে শব্দ ও বাক্য এসেছে, সেগুলো জাস্ট বর্ণনা করা।


দ্বিতীয় বিষয়টা নিয়ে তো কোনো কথা নেই। কুরআন ও সুন্নাহয় আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে যা কিছু এসেছে, সেগুলো তো মুমিন পাঠ করবে, বর্ণনা করবে – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এগুলোর গলদ অর্থ নেওয়া কারও জন্যই জায়িয নয়। কুরআনে এসেছে, ‘রহমান আরশে ইসতিওয়া করেছেন’। এখন এর ভিত্তিতে কেউ যদি বলে, আরশ আল্লাহর চেয়ার, আসন বা আধার; তাহলে সে ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। অথবা কুরআনে আছে, ‘আসমানে যিনি রয়েছেন’। এখন এর ভিত্তিতে কেউ যদি বলে বসে, আসমান আল্লাহর অবস্থানস্থল, তিনি তার সত্তা নিয়ে আসমানে থাকেন আর আমরা মানবজাতি থাকি পৃথিবীতে; তাহলে সে ধোঁকার মধ্যে রয়েছে।

ফাতাওয়া তাতারখানিয়া, ফাতাওয়া হিন্দিয়া, মাজমাউল আনহুর এবং আল-বাহরুর রায়িকের মতো কালজয়ী জগদ্বিখ্যাত ফিকহের গ্রন্থসমূহে মুরতাদ অধ্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সূত্রে হানাফি মাজহাবের অন্যান্য গ্রন্থেও এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সবগুলো গ্রন্থের বক্তব্য এক, ইবারতও কাছাকাছি। যেমন, আল-বাহরুর রায়িক গ্রন্থে এসেছে :

وَيَكْفُرُ بِإِثْبَاتِ الْمَكَانِ لِلَّهِ تَعَالَى فَإِنْ قَالَ اللَّهُ فِي السَّمَاءِ فَإِنْ قَصَدَ حِكَايَةَ مَا جَاءَ فِي ظَاهِرِ الْأَخْبَارِ لَا يَكْفُرُ وَإِنْ أَرَادَ الْمَكَانَ كَفَرَ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ نِيَّةٌ كَفَرَ عِنْدَ الْأَكْثَرِ وَهُوَ الْأَصَحُّ وَعَلَيْهِ الْفَتْوَى

আল্লাহর জন্য জায়গা সাব্যস্ত করার দ্বারা ব্যক্তি কাফির হয়ে যায়। কেউ যদি বলে, আল্লাহ আকাশে রয়েছেন, এর দ্বারা যদি তার উদ্দেশ্য হয় কুরআন ও হাদিসের বাহ্যিক বর্ণনায় যা এসেছে তা উদ্ধৃত করা, তাহলে কাফির হবে না। আর যদি সে জায়গা উদ্দেশ্য নেয়, তাহলে কাফির হয়ে যাবে। যদি তার কোনো নিয়তই না থাকে, তাহলেও অধিকাংশের দৃষ্টিতে কাফির হয়ে যাবে। এটাই সবচে বিশুদ্ধ মত। এর ওপরই ফাতওয়া। [আল-বাহরুর রায়িক, মুরতাদদের বিধান-সংক্রান্ত অধ্যায়, ৫ম খণ্ড, ১২৯ নম্বর পৃষ্ঠা, দারুল কিতাবিল ইসলামি প্রকাশনী]

কিছু লোক তো আরও অগ্রসর হয়ে বলে, আল্লাহ আরশে উপবিষ্ট হয়েছেন, সমাসীন হয়েছেন বা বসেছেন। এদের অবস্থাও ইমামগণের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। যারা আল্লাহর ব্যাপারে ‘বসা’ শব্দ প্রয়োগ করে, তারা যে বাতিলপন্থী মুজাসসিমাদের ভাষায় কথা বলে, এতে অস্পষ্টতার কিছু নেই।

لِأَنَّهُ وَصَفَ اللَّهَ تَعَالَى بِمَا هُوَ بَاطِلٌ، وَهُوَ الْقُعُودُ، وَهُوَ التَّمَكُّنُ عَلَى الْعَرْشِ، وَذَلِكَ قَوْلُ الْمُجَسِّمَةِ، وَهُوَ قَوْلٌ بَاطِلٌ.

কারণ, সে আল্লাহকে এমন গুণে গুণান্বিত করেছে, যা বাতিল। আর তা হচ্ছে ‘বসা’। বসা হলো আরশের ওপর স্থান গ্রহণ করা। এটা মুজাসসিমাদের বক্তব্য। আর তা বাতিল কথা। [তাবয়িনুল হাকায়িক, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩১ নম্বর পৃষ্ঠা, আল-মাতবাআতুল কুবরা আল-আমিরিয়্যাহ কায়রো প্রকাশনী]

অনুরূপ বক্তব্য ইমাম ইবনু মাযা বুখারি আল-মুহিতুল বুরহানি গ্রন্থে (৫/৩১২) এবং ইমাম বদরুদ্দীন আইনি আল-বিনায়া গ্রন্থেও (১২/২৪৬) প্রদান করেছেন। শুধু তা-ই নয়; ইমাম মুহাম্মাদ রহ. তার আল-জামিউস সগির গ্রন্থেও একই কথা এনেছেন এবং ইমাম আবদুল হাই লাখনবি রহ. আন-নাফিউল কাবির গ্রন্থে সেই কথার একই ব্যাখ্যা করেছেন। [আল-জামিউস সাগির মাআন নাফিইল কাবির, ১ম খণ্ড, ৪৮২ নম্বর পৃষ্ঠা, আলামুল কুতুব বায়রুত প্রকাশনী]

ফাতওয়া শামির বক্তব্যও এক্ষেত্রে স্পষ্ট :

(قَوْلُهُ: كَالْكَرَّامِيَّةِ) بِالْفَتْحِ وَالتَّشْدِيدِ وَقِيلَ بِالتَّخْفِيفِ وَالْأَوَّلُ الصَّحِيحُ الْمَشْهُورُ فِرْقَةٌ مِنْ الْمُشَبِّهَةِ نُسِبَتْ إلَى عَبْدِ اللَّهِ مُحَمَّدِ بْنِ كَرَّامٍ وَهُوَ الَّذِي نَصَّ عَلَى أَنَّ مَعْبُودَهُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتِقْرَارٌ.

অর্থাৎ কাররামিয়া মুশাববিহাদের একটি দল। মুহাম্মাদ ইবনু কাররামের দিকে এর নিসবত। সে হলো ওই ব্যক্তি যে স্পষ্ট বলেছে, তার মাবুদ আরশের ওপর স্থিতি গ্রহণ করেছেন। [রাদ্দুল মুহতার, ২য় খণ্ড, ৩৫৪ নম্বর পৃষ্ঠা, দারুল ফিকর বায়রুত প্রকাশনী]


আজকের লেখায় যে রেফারেন্সগুলো উল্লেখ করেছি, এর একটাও আকিদার গ্রন্থ নয়; সবগুলোই ফিকহ ও ফাতওয়ার গ্রন্থ। তা-ও কোনো বিরল বা অপ্রচলিত গ্রন্থ নয়; বরং এগুলোর ওপরই হানাফি মাজহাবের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এগুলোকে আমার বিচ্ছিন্ন মত বা আশআরি-মাতুরিদিদের মনগড়া উক্তি বলে চালিয়ে দেওয়ার বৃথা অপচেষ্টা করার দরকার নেই। প্রতিটা উক্তির পক্ষে আরও কয়েকটা করে রেফারেন্স দেওয়া যাবে। এই আর্টিকেলটাকে দীর্ঘ করে কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী চালানো যাবে। কিন্তু লাভ কী! হ্যাঁ, আমাকে সেই মিথ্যাবাদী গ্রুপের গল্প শুনিয়ে লাভ নেই, যারা অবিরলভাবে আমার ব্যাপারেই মিথ্যাচার করতে ও অপবাদ দিতে দ্বিধা করে না। খবর আমাদের কানে আসবে জেনেও আমাদের নামেই যেখানে মনগড়া অপপ্রচার চালাতে দ্বিধা করে না যারা, তারা কবরে চলে যাওয়া পূর্ববর্তী মনীষীদের ব্যাপারে তো এক্ষেত্রে আরও অগ্রগামীই হওয়ার কথা। এ জন্যই তো এরা মৃত ইমামগণকেও রেহাই দেয় না। কখনো গালি দেয় আর কখনো-বা নিজেদের মনগড়া মিথ্যাচার তাদের নামে অবলীলায় চালায়। অহংকারী মূর্খদের থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।

Share This