প্রশ্ন:
১- লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আপনার সাফল্যের ভিত্তি কী?
২- এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করে আপনি কী হতে চান, আপনার ভবিষ্যত স্বপ্ন কী? কীভাবে জাতির সেবা করতে চান?
৩- ছাত্রদের জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যকিছু পড়ার প্রয়োজন মনে করেন কিনা? এবং সেটা কী ধরনের বই?
৪- কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত সিলেবাসের মাঝে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজন এবং সংস্কারের প্রয়োজন মনে করেন কিনা? আর সেই সংস্কারের রূপরেখা কেমন হবে?
৫- এমন কি কোনো বিষয় আছে যেটার প্রয়োজন অনেক, সিলেবাসেও বিদ্যমান, তদুপরি আপনার চোখে উক্ত বিষয়ে ছাত্রদের মাঝে ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে? আর এই সমস্যা থেকে উত্তরনের পথ কী?
৬- সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা তথা বিতর্ক-বাহাস, বক্তৃতা, আবৃত্তি, হামদ-নাত, প্রবন্ধ-রচনা এবং আর্ট ও ক্যালিগ্রাফিসহ এ জাতীয় প্রোগ্রামের প্রয়োজন কতটুকু? এর কোনো উপকারিতা আছে, নাকি অযথা সময় নষ্ট?
৭- একজন কওমি শিক্ষার্থী হিসেবে আপনার প্রতি প্রশ্ন, কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সনদের সনদের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি?
৮- আচ্ছা, ছাত্রদের জন্য বর্তমানে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি কিংবা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার যৌক্তিকতা কতটুকু? এর উপকারি এবং ক্ষতিকর দিক কী কী?
৯- একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমাদের সকল শিক্ষার্থী বন্ধুর উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ জানতে চাচ্ছি।
উত্তর:
১- লেখাপড়ার ক্ষেত্রে আপনার সাফল্যের ভিত্তি কী?
ইলমের প্রকৃত সাফল্য তো যোজন যোজন দূরে৷ প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ মাওলানা আবদুল মালেক দা. বা. ইলমের লক্ষ্য ও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, ইলমের লক্ষ্য ও মাকসাদ হচ্ছে, تفقه في الدين (দীনের সমঝ-বুৎপত্তি), رسوخ في العلم (ইলমের দৃঢ়তা-গভীরতা) , ও হাদীসের এই বাণী يحمل هذا العلم من كل خلف عدول ينفون عنه تحريف الغالين و انتحال مبطلين و تأويل الجاهلين অর্থাৎ পরবর্তীদের মধ্যে প্রতি যুগে এই ইলমের ধারক হবে ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, যারা তার থেকে নিরোধ করবে সীমালঙ্ঘনকাকারীদের বিকৃতি, বাতিলপন্থীদের বর্ণচুরি এবং অর্বাচীনদের অপব্যখ্যা ৷
তো ইলমের এই স্তর যখন অর্জিত হবে তখনই বলা যায় যে, সাফল্যের কিছুটা ধরাছোঁয়া পাওয়া গেছে৷ আজ সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাহ্যিক যে সাফল্য, তার কারণ তো স্রেফ আল্লাহই অনুগ্রহ। এরপর বাহ্যিক কারণ হিসেবে যদি কিছু চিণ্হিত করতে বলেন, তবে আমি যা বলবো, তা হলো-
১. আমার সকল উসতাদ, বাবা-মা এবং মুরুব্বীদের দোয়া৷
২. আত্মবিশ্বাস। অনেক সময়ই এমন হয়েছে, পরীক্ষার পূর্বে অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তেমন প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সেসময়ও হৃদয়ে ছিলো দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আর নিবিড় প্রেরণা৷ পরিণামে তা-ই সব বাধা ছাপিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে শক্তি যুগিয়েছে। যেমন দাওরায়ে হাদিসের বেফাক পরীক্ষার আগে দীর্ঘ একমাস সবক-বিরতির পুরো সময়টা টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করেই কেটেছে। তবুও আশাহত হইনি। পরীক্ষার দু’দিন আগে মাদরাসায় ফিরতে পেরেছি। এরপরও আল্লাহ তাআলা বোর্ডে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করার তাওফিক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।
৩. সৃজনশীলতা। দিনমান বই নিয়ে পড়ে থেকেছি, পড়ার পেছনে খুব বেশি সময় দিয়েছি বা শতভাগ রুটিনমাফিক চলা হয়েছে এমন নয়, কিন্তু যদ্দুর পড়েছি মনোযোগ দিয়েই পড়েছি৷ পরীক্ষাপূর্ব মুহূর্তগুলোতে সারাবছরের কিতাব অধ্যয়নের সারনির্যাস হিসেবে কিতাবের একটা আন্দায বোঝার চেষ্টা করেছি। প্রতিটা আলোচনার সারকথা হৃদয়ঙ্গম করেছি। গ্রন্থকারের বক্তব্য গভীরভাবে উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছি৷ ইবারতের ওপরে বিশেষ নজর ছিলো। একেক কিতাব একেক আন্দাযে হল করেছি। কিন্তু কখনো এমন হয়নি, না বুঝে কোনো একটা লাইন শুধু পড়ে গেছি।
৪. সাথিদের মধ্যে যারা তুলনামূলক দুর্বল, তাদের প্রতি সবিশেষ লক্ষ রেখেছি। বিশেষত যাদের সাথে তাকরার করতাম, তারা কীভাবে আরো ভালো থেকে ভালো করতে পারে সে চেষ্টাই করেছি। তাদের উৎসাহ-প্রেরণা জাগানোর প্রয়াস পেয়েছি। কেউ পড়া জিজ্ঞেস করলে, যতো ব্যস্তই থাকি না কেনো, বুঝিয়ে দিয়েছি। তাঁদের অন্তরপ্রসূত দোয়ার বড় অবদান আছে আমার এই ক্ষুদ্র সাফল্যের পেছনে।
২- এই শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করে আপনি কী হতে চান, আপনার ভবিষ্যত স্বপ্ন কী? কীভাবে জাতির সেবা করতে চান?
মূল স্বপ্ন তো, ইলমের মূল মাকসাদ- তাফাক্কুহ ফিদ্দীন, রুসূখ ফিল ইলম অর্জন করা, যার জন্য শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়৷ তদুপরি যে বিষয়গুলো নিয়ে জীবনে কাজ করার রঙ্গিন স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করি, তার কয়েকটি সংক্ষিপ্তাসারে উল্লেখ করছি,
* এখন তো তাখাছছুছ ফিল ইফতা নিয়ে পড়ছি। স্বপ্ন আছে, ফিকহ ও ফতওয়ার সাথে সারাজীবন লেগে থাকা ৷ এক্ষেত্রে অর্থনীতি, রাজনীতি ও চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে সবিশেষ ইলমি কাজ করার ইচ্ছা আছে ৷
* তাদরীস-শিক্ষকতা। এক্ষেত্রে সৃজনশীলতার সাথে এই মহান খেদমত আঞ্জাম দেয়ার স্বপ্ন লালন করি। আমার ছাত্ররা যেনো ইলমে, আমলে, আখলাক এবং আফকারে অনুসৃত আকাবিরিনের মতো গড়ে ওঠে। খেজুরের চাটাইয়ে বসেও তারা যেনো ময়ুরসিংহাসনের ধারকের মতো বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দিতে পারে। যেমন ধরুন শাইখুল হিন্দ রহ.। তো তার একেকজন ছাত্র কিন্তু একেকটি বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু বলা যায় ৷ বর্তমানে আমাদের আদীব হুজুরের ছাত্রদের দেখুন, তারা কিন্তু মৌলিক যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি পৃথিবীকে উপহার দেবার মতো সম্ভাবনাময় অসংখ্য যোগ্যতা ও প্রতিভা নিয়েই বেড়ে ওঠছে ৷ আমি সেই মহান মানুষদের মতক না হতে পারলেও, আমার সাধ্যে যতোটুকু আছে, তার পুরোটাই উজাড় করে আমার প্রতিটি ছাত্রকে গড়ে তুলতে চাই একেকটি নক্ষত্ররূপে।
* লেখনী ও বক্তৃতার অঙ্গনে সৃজনশীল কাজ করার ইচ্ছা আছে৷ এখনতো জুম’আর মিম্বারের আলোচনাও মুসতাহাব্বাত, হুসনে আখলাক তথা নফল বিষয়াদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ মূল ও অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে আলোচনা একেবারে হচ্ছে না বললেই চলে৷ যার ফলে প্রতিনিয়ত মানুষ ফেতনাবাজদের বিছানো জালে পা দিয়ে নিজের দীন ও আখেরাত ধ্বংস করে বসছে। যেমন, আকীদার বিষয়ে সাধারণ মানুষরা নিরেট অজ্ঞই থেকে যাচ্ছে। প্রাচ্যবিদদের ফেতনার টোপ তারা কিন্তু সহজেই গিলছে। বিভিন্ন কারণে মানুষ তো এখন ইসলাম সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে পড়ছে। তো বাতিল আকিদাসমূহ খণ্ডণ করে মানুষের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা, ইসলামের ওপর আপতিত অভিযোগ-আপত্তির সমুচিত জবাব দেয়া, প্রজ্ঞার সাথে শালীন ও মার্জিত ভাষায়। এগুলো এখন সময়ের দাবি। তো এসব অঙ্গনে দৃপ্তপদচারণা আমার স্বপ্ন। সর্বসাকুল্যে লেখনী ও বক্তৃতার ক্ষেত্রে এই আন্দাযকে অবলম্বন করে মানুষের ফিকির সুসংহত করা ৷
* সম্ভাবনাময় প্রতিভাগুলো বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারনে ঝরে যাচ্ছে। তো তাদের পতন রোধ করা, প্রতিভা বিকাশে সহযোগিতা করা৷
* নওমুসলিমরা যথেষ্ঠ অবমূল্যায়নের স্বীকার। দেখা যাচ্ছে, একজন মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে খ্রিস্টান এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে অনেক সুবিধা পাচ্ছে; কিন্তু কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে পথে বসে যেতে হচ্ছে, পুরোপুরি অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে৷ অর্থনৈতিক মন্দার ভয়ে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকে ইসলাম গ্রহণ করছে না। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার কারণে তারা ঠিকমত ইসলামকে জানতে ও মানতে পারছেনা৷ তো এই ননওমুসলিমদের জন্য কিছু গঠনমূলক কাজ করারও স্বপ্ন আছে।
* ইন্টারনেটের বিস্তৃত জগতেও কিছু কাজ করা। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যারা নতুনভাবে ইসলাম গ্রহণ করছে তাদের ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে আগ্রহী।,কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে যথারীতি আলেমদের কাছে গিয়ে দীন শেখার তেমন একটা সুযোগ তাদের মিলে না। অনেকটা ইন্টারনেটকে অবলম্বন করেই তারা ইসলামকে জানার প্রয়াস পাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে ইন্টারনেটে আমাদের গঠনকমূলক খেদমত না থাকায় তারা কিন্তু বেশিরভাগই আহলে হাদীস, প্রাচ্যবিদ ইত্যাদি হয়ে যাচ্ছে৷ তো তাদের কাছে ইসলামের শ্বাশ্বত বার্তাকে যথার্থভাবে পৌঁছে দেয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা ৷
* বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান— যেখানে এখনো ভালোভাবে ইলমের আলো পৌঁছেনি, বিশেষত উত্তরাঞ্চল ৷ দেখা যাচ্ছে তারা কাদীয়ানী, খ্রিস্টান-মিশনারিসহ বিভিন্ন বাতিল ফের্কার আক্রমণের স্বীকার ৷ আর এটাই স্বাভাবিক। আলো না থাকলে অন্ধকার তো ছেঁয়ে নিবেই। তো সে সকল অঞ্চলে ইলমের আলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা ৷
* দুস্থ মানবতার সেবা ৷ এটাতো মুসলমানদের ঐতিহ্যের স্মারক ৷ এক্ষেত্রে কাজ করে কিন্তু মাদার তেরেসাসহ অনেকে বিধর্মীই ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে আছে ৷ আমরা কেনো এ থেকে পিছিয়ে থাকবো ? আমাদেরও উচিত দৃপ্তপদবিক্ষেপে এ অঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়া।
* জাতি আজকে বিভিন্ন কারণে আলিমদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ৷ এর কারন তো অজস্র ৷ যেমন, তারা কিন্তু প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে ৷ তাত্ত্বিক ও রসহীন সুদীর্ঘ আলোচনা কেউ এখন শোনতে চায় না বা শোনতেও বিরক্ত লাগে ৷ সবাই এখন যুক্তি ও রেফারেন্স পছন্দ করে ৷ দেখুন মানুষ কিন্তু এখন ড. জাকির নায়েকসহ এ জাতীয় লোকদেরই ভক্ত ৷ কারণ তারা কথায় অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন যুক্তি ও রেফারেন্স উল্লেখ করছে৷ নোমান আলীর ভক্ত-অনুরক্তের অভাব নেই। কারণ তার আলোচনা বেশ যুক্তিপূর্ণ ও ভাষা মার্জিত, শৈলী হৃদয়গ্রাহী। আমরা এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়েই আছি বলা যায়। তাছাড়া অনেক মৌলিক বিষয়েও এখন বিলকুল আলোচনাই হচ্ছে না ৷ তো এসকল বিষয়ে গঠনকমূলক কাজ করার ইচ্ছে আছে ৷
আরো বিশেষ দুটো স্বপ্ন:
ক. একটি মাদরাসা হবে, যেখানে পড়াশোনা-পাঠদান হবে শাস্ত্রভিত্তিক। ঠিক আগের যুগের মতো। যে পদ্ধতিতে লেখাপড়া ও ইলম অর্জন করে সারাবিশ্ব কাঁপিয়েছেন সে-যুগের বিদগ্ধ আলিমগণ। কই, এখন তো আর তাদের মতো কাউকে খুব একটা দেখা যায় না! তেমন বিদগ্ধ অনেক তৈরি হচ্ছে না বা হতে পারছে না। একজন তালিবুল ইলম প্রথমে ভাষা, ব্যাকরণ ও সাহিত্য, এরপর ফিকহ, উসুলুল ফিকহ, তারপর কোরআন, উলুমুল কোরআন ও তাফসির এবং সর্বশেষে হাদিস, উলুমুল হাদিস বিষয়ে পড়াশোনা-জ্ঞানার্জন করবে। সহায়ক অন্যান্য বিষয়, যেমন ফেরাকে বাতেলা ও সমকালীন ফেতনা (প্রাচ্যবিদদের ফেতনা ও দেশী-বিদেশী সকল ফেতনা), সিরাত-ইতিহাস, মানতিক প্রভৃতি বিষয় উপরিউক্ত চার বিভাগের অধীনেই পরিপূরক শাস্ত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর বিস্তারিত রূপরেখা, নেছাব, পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষক নির্বাচন সবকিছু নিয়ে ভাবনা-গবেষণা দীর্ঘ সময়ের দাবি রাখে। আপাতত তাই খসড়াটাই উল্লেখ করলাম।
খ. একটি বিভাগ হবে- হিফযুল হাদীস বিভাগ। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক আগে থেকেই তা আছে। আমাদের দেশে কোথাও এখনও চালু হয়নি। কোমলমতি শিশুরা হিফযুল কোরআন শেষ করে প্রিয়নবীর বিশুদ্ধ হাদীসের ভাণ্ডার থেকে পুনরুক্তি বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় হাদিসগুলো নির্বাচিত পাঠ্য থেকে মুখস্থ করবে, ঠিক কোরআন যেমন মুখস্থ করেছে। হাফিযুল হাদীস তৈরির প্রাণকেন্দ্ররূপে গড়ে ওঠবে সে-প্রতিষ্ঠান। এর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা যে কতো, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতে হলেও প্রয়োজন সুদীর্ঘ নিবন্ধ।
৩- ছাত্রদের জন্য পাঠ্যবইয়ের বাহিরে অন্যকিছু পড়ার প্রয়োজন মনে করেন কিনা? এবং সেটা কোন ধরনের বই?
আসলে দুনিয়ার সব শাস্ত্র-জ্ঞান কিন্তু পাঠ্যসূচির মধ্যে যুক্ত করা সম্ভব নয় ৷ পাঠ্যসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মূলত প্রত্যেক বিষয়ের মৌলিক কিতাবগুলোই নির্বাচন করা হয়, যেগুলো তুলনামূলক সহজ ও তালিবানে ইলমের শাস্ত্রীয় যওক সৃষ্টিতে সহায়ক ৷ তাই দরসি কিতাবের বাইরে অতিরিক্ত অধ্যয়নের প্রয়োজন এককথায় অনস্বীকার্য ৷ আর তা হতে হবে শিক্ষার্থীর প্রতিভা ও যোগ্যতা অনুসারে ৷ প্রতিটি শাস্ত্রে পূর্ণ ব্যুৎপত্তি না হোক, মৌলিক ধারণা অর্জনের জন্যও বিস্তর অধ্যয়নের প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে সবার অধ্যয়ন যে অভিন্ন হবে এমন নয় ৷ যোগ্যতা অনুসারে এবং মুরুব্বির রাহনুমায়িতে এ বিষয়ের অধ্যয়ন ও কিতাব নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে একটা বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করার জন্য সবার প্রতি আন্তরিক অনুরোধ থাকবে। আমাদের নেছাবে ফেরাকে বাতেলা নিয়ে শুধু মিশকাতের বছরই নামেমাত্র নাড়াচাড়া হয়, যা মোটেও যথেষ্ট নয়। সমকালীন ফিতনাগুলো কী কী, তার প্রত্যেকটি সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রত্যেক আলিমের কর্তব্য। প্রতিটি বাতিল ফেরকা নিয়েই অল্পস্বল্প হলেও আমাদের পড়াশোনা থাকা উচিত, তাদের যুক্তি-শুবহার খণ্ডণগুলো সর্বদা মাথায় হাজির থাকা উচিত, যেনো নিজেরাও নিরাপদ থাকতে পারি আর জাতিকেও নিরাপদ রাখতে পারি। “ওয়ালিইউনযিরু কাওমাহুম ইযা রাজাঊ ইলাইহিম” এটা সেই ইনযারেরই অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়টা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তালিবে ইলমদের জানা থাকে, এটা হক আর এটা বাতিল। কিন্তু কেনো বাতিল? কী কী সমস্যা তাদের? বিস্তারিতভাবে জানাশোনাই থাকে না। খণ্ডণের জ্ঞান তো দূরের কথা।
৪- কউমী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত সিলেবাসের মাঝে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজন এবং সংস্কারের প্রয়োজন মনে করেন কিনা ? আর সেই সংস্কারের রূপরেখা কেমন হবে?
শিক্ষাসিলেবাস— এটা এমন বিষয়, যা প্রত্যেক যুগেই সংস্কারের দাবি রাখে ৷ কারণ প্রতিমুহূর্তেই পৃথিবীর প্রেক্ষাপট, মানুষের চিন্তা-চেতনা সবকিছুতেই পরিবর্তন ও নতুনত্ব আসছে ৷ আপনি লক্ষ করুন, সাহাবাযুগ এবং পরবর্তীযুগের সিলেবাস ও পাঠদানপদ্ধতি কিন্তু এক নয়৷ আবার দেওবন্দের প্রাচীন নেসাব আর বর্তমান নেসাবের মাঝেও রাতদিন তফাত ৷ এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশের বেফাকবোর্ড প্রণীত নেসাব আর দেওবন্দের নেসাবের দিকে তাকান ৷ দেওবন্দে যেখানে একজন তালিবে ইলম মাত্র আট বছরেই দাওরায়ে হাদিস সমাপন করতে পারছে, সেখানে আমাদের দেশের বেফাক বোর্ডের নেসাবে তা সমাপন করতে প্রয়োজন হচ্ছে আরো দীর্ঘ সময়। যাহোক, আমাদের বর্তমানের সিলেবাসের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া সময়ের অনিবার্য দাবি৷ অনেক বিষয় আছে যা কেবল নামেমাত্র পড়ানো হচ্ছে ৷ যেমন, সীরাত, তাফসীর, উসুলুত তাফসীর, তারীখ, আকীদা, উলূমুল হাদীস, ফেরাকে বাতেলা ইত্যাদি৷ তাছাড়া নিচের দিকের ক্লাসগুলোর সিলেবাস সম্পূর্ণ নতুনভাবে ঢেলে সাজানো উচিত, যেনো প্রতিটি ছাত্র সহায়ক ইলম, যেমন আরবি-উর্দু-বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং তার শাখা ইলমগুলোতে পূর্ণ দক্ষতা নিয়ে পরবর্তী জামাতে উঠতে পারে। সিলেবাসের পাশাপাশি পাঠদান-পদ্ধতিতেও বৈচিত্র্য আসা উচিত, যুগের প্রবণতা ও ছাত্রদের মেধা-মনন অনুসারে।
৫- এমন কি কোনো বিষয় আছে যেটার প্রয়োজন অনেক, সিলেবাসেও বিদ্যমান, তদুপরি আপনার চোখে উক্ত বিষয়ে ছাত্রদের মাঝে ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে ? তো এই সমস্যা থেকে উত্তরনের পথ কী ?
নেসাবে আছে তদুপরি শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এমন বিষয়ের একটা ইঙ্গিত তো আমি আগের প্রশ্নের উত্তরেই দিয়েছি ৷ তবুও এক-দুটি বিষয় যা বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয়৷ যেমন আকীদা— এক্ষেত্রে বাতিলপন্থিরা কতো যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে ৷ যেমন অধুনা আহলে হাদিস ভাইয়েরা আল্লাহ কোথায় আছেন, তিনি আকার না নিরাকার ইত্যাদি ও এ জাতীয় বহু বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমান যুগেও নতুন নতুন বহু আকিদাগত ফেতনার উদ্ভব হচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়ে বর্তমানের ছাত্ররা বেখবর৷ আবার তাফসীরের ওপর তো বলতে গেলে শুধু একটি কিতাব— জালালাইনই পড়ানো হচ্ছে, বাইযাবি পড়ে তাফসিরের যওক হাসিলের তো আর প্রশ্নই আসে না। ফিকহের অবস্থা দেখুন, আমাদের নেসাবে এই বিষয়ের কিতাব সবচে বেশি পড়নো হয়৷ ফিকহে মুজাররাদ এর কিছু কিতাবের পাঠদান হচ্ছে, যেমন, মালাবুদ্দা, কুদূরী ইত্যাদি৷ আবার ফিকহে মুকারানার ক্ষেত্রে হিদায়া আছে ৷ কিন্তু ফিকহে মুদাল্লালের ওপর কিন্তু আমাদের নেসাবে একটি কিতাবও নেই ৷ আহলে হাদীস এবং সালাফী আলেমগণ যেভাবে কথায় কথায় দলিল পেশ করেন তাতে আমরা ভাবছি হানাফী মাযহাব দুর্বল ৷ আমাদের মাযহাবের শক্তিশালি দলিলগুলো সম্পর্কে জানাশোনা না থাকায় আমাদের অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগছে৷ এজন্য আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. “শরহে বেকায়া” কিতাবের পরিবর্তে মোল্লা আলী কারী রহ. রচিত “ফাতহু বাবিল ইনায়াহ” পড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন৷ আবার দেখা যাচ্ছে ইমামগণের ইখতেলাফ পড়ে পড়ে পুরো নেসাব পার করে আসছে কিন্তু “মুফতাবিহি কওল”ই জানেনা৷ এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে নতুন সিলেবাস প্রণীত হলে তো আলহামদুলিল্লাহ৷ তার আগ পর্যন্ত অন্তত ছাত্ররা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো উস্তাদের তত্বাবধানে থেকে প্রতিটি বিষয়কে ফন্নি আন্দাযে মুতালাআ করলে এই ঘাটতি কিছুটা দূর হতে পারে ৷ এখানে একটি বিষয়ের প্রতি আমি সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করবো, একজন আলিম-তালিবে ইলম জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তিনটি জিনিসের মুখাপেক্ষী- তাফসির, হাদিস ও ফিকহ। আমাদের নেছাবে তিন বিষয়ের কিতাবই পড়ানো হয়। কিন্তু যে জিনিসটা হয় না, সেটা হচ্ছে, ছাত্রদেরকে দরসি কিতাবের বাইরে এ তিন বিষয়ের অন্যান্য কিতাবাদির সাথে পরিচিত করে তোলা ও সেগুলো থেকে ইস্তেফাদার তরিকা শিখিয়ে দেয়া। ফলে অধিকাংশই এমন থেকে যায়, যারা প্রয়োজনের মুহূর্তে দরসিভাবে যে হাদিসের কিতাবগুলো পড়া হয়েছে, এর বাইরের অন্যান্য কিতাব, যেমন- মুসনাদে আহমদ ইত্যাদি থেকে হাদিস বের করতে পারে না। কোন হাদিসের কী মান, সেই হাদিসের হুকুমের ক্ষেত্রে ইমামগণের বক্তব্য কী , তা কোথায় পাওয়া যাবে, এসবও অনেকেরই জানা থাকে না। ফিকহি মাস’আলাগুলোর দলিলের জন্য হাদিসের কোন ধরনের কিতাবগুলো মুরাজা’আত করা হবে তাও থেকে যায় অজানা। মুস্তাখরাজ, আতরাফ, ইলাল, মাশিখা, মু’জাম প্রভৃতি- এসব বিষয়ের কিতাবাদির পরিচয় তো অনেক দূরের বিষয়। তেমনিভাবে কোনো আয়াতের তাফসির জানার জন্য কোন কিতাবগুলোর মুরাজা’আত করবে। দু’কিতাবের বক্তব্যে তা’আরুজ দেখা দিলে কীভাবে তা হল করবে। মুফাসসিরিনের যাল্লাত-বিচ্যুতি থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে। ইসরায়িলি ও মাওযু-জাল রেওয়ায়াত থেকে কীভাবে বাঁচবে। তেমনই ফন্নিভাবে মুতালা’আ করতে চাইলে কোন কিতাবগুলো পড়বে। হানাফী ফিকহে মজবুতি হাসিলের জন্য কোন ধরনের কিতাব সহায়ক হবে ইত্যাদি বিষয় জানা দাওরা হাদিস সম্পন্ন করার আগে বা পরে অনেকের জন্যই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। সাধারণ থেকে সাধারণ মাস’আলার ব্যাপারেও মুফতা বিহি কাওল কোনটা তা বের করার যোগ্যতাও, তুখোড় মেধা-প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও অর্জন হয় নানা। বিষয়গুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করলেও পরিবেশ না পাওয়ার কারণে তা অনেকেরই অজানা থেকে যায়।
এ তো মাত্র কয়েকটা দিক তুলে ধরলাম। তা’আররুফ না থাকার কারণে কতো যে ভোগান্তি পোহাতে হয়, আলিম হয়েও কতো যে দুর্বল থেকে যেতে হয়, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানে। যেমন, একটা উদাহরণ দেই, আশরাতুছ ছা’আহ (কেয়ামতের আলামত) বিষয়ে একজন ছাত্র অধ্যয়ন করতে চায়। এখন সে কীভাবে তা করবে। কোন কিতাবগুলো মুতালা’আ করবে। কাদের বক্তব্যের ওপরে নির্ভর করবে। এসব বিষয়ে কার থেকে সে পথনির্দেশনা পাবে।
হ্যাঁ, এটা ঠিক, নেছাবের সীমিত সময়ে এর সব কিছুই শিখিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তবে কিছুটা ধারণা দেয়া, মা’খাযগুলো (তথ্যসূত্র) বলে দেয়া, পথ দেখিয়ে দেয়া ও সঠিক কর্মপন্থা নির্দেশ করাও কি সম্ভব নয়!
৬- সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা তথা বিতর্ক-বাহাস, বক্তৃতা, আবৃত্তি, হামদ-নাত, প্রবন্ধ-রচনা এবং আর্ট ও ক্যালিগ্রাফিসহ এ জাতীয় প্রোগ্রামের প্রয়োজন কতটুকু ? এর কোনো উপকারিতা আছে, নাকি অযথা সময় নষ্ট?
এ জাতীয় প্রোগ্রামের প্রয়োজন অনেক বেশি ৷ এই ইলমকে জাতির সামনে পেশ করার জন্য বাহনের প্রয়োজন আছে ৷ তো এগুলোর মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যবান-ভাষা৷ অনেক শিক্ষার্থী চিন্তা করে, আমিতো আর বক্তা হবোনা, তাহলে আর কষ্ট করে বক্তৃতা শেখার, চর্চা করার প্রয়োজন কী ৷ বক্তৃতা শেখার উদ্দেশ্য কি শুধু বক্তা হওয়া ? একজন শিক্ষক হিসেবেও তো ক্লাসের পড়াকে ছাত্রদের সামনে গুছিয়ে পেশ করতে হবে৷ তাছাড়া আলিম যখন হচ্ছি, তখন মানুষ আমাকে কোথাও না কোথাও বসিয়েই দিবে, দু’চার কথা আমাকে বলতেই হবে, তখন দেখা যাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা না বলা রয়ে যাবে ৷ আবার নিজের অজান্তেই অনেক কথাই বলা হয়ে যাবে, যেগুলো হয়তো বলা উচিত নয় ৷ যার কারণে ফিতনারও সৃষ্টি হতে পারে ৷
লেখালেখির অঙ্গনে আলিমগণ এখন বেশ এগোচ্ছেন। একসময়তো খুব খারাপ অবস্থা ছিলো৷ তবুও প্রতিপক্ষের সাথে মোকাবেলা করার শক্তি এখনো আমাদের অর্জিত হয়নি৷ আবার দেখুন, শিক্ষিত সমাজের ব্যপারটা ৷ তারা কিন্তু আপনার মাহফিলে আসবে না ৷ তো তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে আপনার মানসম্মত লেখনির মাধ্যমেই ৷ যাহোক এ বিষয়গুলো খুবই দরকার ৷ আর সবাই যে এসব ক্ষেত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করবে— এটা সম্ভবও নয়৷ অন্তত সাধারণ যোগ্যতাটুকু তো সবাইকেই অর্জন করতে হবে ৷
৭- একজন কউমী শিক্ষার্থী হিসেবে আপনার প্রতি প্রশ্ন, কওমী শিক্ষাব্যবস্থার সনদের সনদের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি ?
স্বীকৃতি প্রসঙ্গে বেফাকের বক্তব্যই আমাদের বক্তব্য; অর্থাৎ সরকারি প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে কওমি মাদরাসাকে শতভাগ মুক্ত রেখে শিক্ষার মান দিলে আমাদের আপত্তি নেই৷ এ ক্ষেত্রে হতে পারে আমাদের কাজের পরিধিও বাড়বে৷ কিন্তু যে স্বীকৃতি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও স্বকীয় মূল্যবোধকে বিনষ্ট করবে, আমরা কিছুতেই সেই স্বীকৃতির দাবি জানাতে পারি না৷ কারণ এভাবে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারি না!
৮- আচ্ছা, ছাত্রদের জন্য বর্তমানে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি কিংবা বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার যৌক্তিকতা কতটুকু ? এর উপকারি এবং ক্ষতিকর দিক কী কী ?
ছাত্ররাজনীতি বা যেকোনো ছাত্র সংগঠন— এটাকে আমি ইলমের পথে বড় একটি বাধা মনে করি ৷ কারণ ইলম শেখার জন্য সবচে বেশি যেটা দরকার- একাগ্রতা, এটা বিনষ্ট হয় ৷ একাগ্রতা নষ্ট করার জন্য শুধু রাজনীতিই নয়, পারিবারিক দুশ্চিন্তা বা অন্য কিছুও কারণ হতে পারে ৷ কিন্তু সর্বাবস্থায়ই তা ক্ষতিকর। রাজনীতি করে দেখা যায় দুয়েকজন হয়তো তুখোড় মেধাবী হওয়ায় পার পেয়ে যায়। পার পায় মানে, ক্লাসে ভালো ফলাফল করতে সমর্থ হয়। শাস্ত্রীয় যোগ্যতা তাদের কখনোই অর্জিত হয় না। আর অধিকাংশই লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তেমন সুবিধাজনক কোনো ফলাফল বয়ে আনতে পারে না ৷ তাই ছাত্রদের জন্য লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যস্ততা রাখা কিছুতেই কাম্য নয় ৷
— তাহলে যারা বলে, এখানে রাজনীতি ও সংগঠন পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, যেনো ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে হোঁচট না খায় ৷ তো এর উত্তরে আপনি কি বলবেন ?
— আপনি যত যুক্তিই দেখান আমি কিছুতেই এর সাপোর্ট দিতে পারি না ৷ প্রথমত গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ। আর অনেক আকাবির সুস্পষ্টভাবে ছাত্ররাজনীতির ক্ষতির কারণ বলে গেছেন ৷ মুফতি শফি রহ. এর মাসলাকের বর্ণনা পাবেন আপনি “মেরে ওয়ালেদ মেরে শায়েখ” কিতাবে ৷ তাছাড়া শাইখুল হিন্দ রহ. এবং মাদানী রহ.সহ যারাই রাজনীতি করেছেন এবং যাদের হাতেই আমাদের হিন্দুস্তানের স্বাধীনতার গোড়াপত্তন হয়েছে, তাদের কেউই কিন্তু ছাত্রাবস্থায় অন্য কোনো ব্যস্ততায় জড়িত ছিলেন না। অথচ পরবর্তী জীবনে উম্মাহর ক্রান্তিলগ্নে তারাই সফলভাবে রাজনীতি করেছেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছেন৷ এখন তাদের মত রাজনীতিবীদ ক’জন আছেন ৷ আর এখন তো রাজনীতির অর্থই হলো সেই ঘৃণ্য জঘন্য গণতন্ত্র, যার বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ। কথা হলো যার ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা ও যোগ্যতা আছে কোনো না কোনো সময় তা প্রকাশিত হবেই ৷ আমাদের রাজনীতি তো আল্লাহকে খুশি করার জন্যই। সময়মতো আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন৷ ইলম অর্জনের সোনালি জীবন ধ্বংস করে তার পেছনে ছোটার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
৯- একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমাদের সকল শিক্ষার্থী বন্ধুর উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ জানতে চাচ্ছি
আমার প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুদের প্রতি পরামর্শ হলো,
* হৃদয়ে প্রচুর আত্মবিশ্বাস রাখবে। কখনোই হীনমন্যতায় ভুগবে না৷ পারবে। তুমিই পারবে। পারতে তোমাকে হবেই। মনে রাখবে, আত্মবিশ্বাসই সাফল্যের চাবিকাঠি৷
* কাম্মিয়াতের ওপর কাইফিয়্যাত অর্থাৎ পরিমাণের উপর পদ্ধতিকে প্রাধান্য দিবে ৷ যতটুকু পড়বে পড়াটা যেনো মনোযোগের সাথে সৃজনশীলতা বজায় রেখেই হয় ৷
* জীবনে একটি সুনিদৃষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে হবে ৷ এর মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত মানযিলে পৌঁছা সম্ভব ৷ তখন তোমার প্রতিটি কাজ হবে গতিময়, উদ্যমপূর্ণ।
* আমাদের প্রচুর পরিমাণে ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করতে হবে ৷ মাদরাসার শিক্ষার্থী হিসেবে তো কমপক্ষে বাংলা, আরবি, উর্দু এই তিন ভাষায় অবশ্যই পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হবে ৷ পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায়ও মৌলিক যোগ্যতা অর্জন করা উচিত।
* ইলমের গভীরতা অর্জন করতে হবে৷ সাহাবায়ে কেরাম রাযি.দের হয়তো জানার পরিধি অনেক বিস্তৃত ছিলো না, কিন্তু গভীরতা ছিলো প্রচুর ৷ তাদের সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, “আ’মাকুহুম ইলমা” ৷ কিন্তু আমরা অনেক কিছু শিখে ফেললেও গভীরতা কম থাকায় অনেক সময় নিজের জানা বিষয়েও সন্দেহে পড়ে ভ্রষ্টতার স্বীকার হই ৷
* সময়ের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করতে হবে ৷ এটা বলছি না যে, দিনমান দরসি কিতাবাদি নিয়েই পড়ে থাকতে হবে। আরো কতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন ও কাজই তো আছে, যা তুমি মুরুব্বির রাহনুমায়িতে যোগ্যতানুসারে অর্জন করবে ৷ গল্পগুজব, ফেইসবুক ইত্যাদি কাজে সময় কম দিয়ে সেসময়গুলোতে মানসম্মত গল্প-উপন্যাস পড়ার অভ্যাস গড়লেও মন্দ নয়। আরবী বা উর্দূ উপন্যাস পড়তে পারো। এতে ভাষাগত দক্ষতাও অর্জন হবে৷ বাংলা বা অন্য ভাষার সাহিত্যচর্চা করতে পারো৷ আর্ট, ক্যালিগ্রাফি ও গ্রাফিক্সের প্রতি ঝোঁক থাকলে একাজেও সময় ব্যয় করতে পারো। এটাও জীবনে কাজে দিবে ৷ মোটকথা যেভাবেই সম্ভব সময়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে৷ অযথা নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।
* সর্বশেষে যে কথাটা বলবো, ছাত্রদের সর্বদা গতি অব্যাহত রাখতে হবে। পুরো ছাত্রজীবনে অন্তত গতি স্তিমিত হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। একটু ভালো করলেই আত্মপ্রসাদে ভুগে গতি থামাবে না।
ভালো থেকে ভালো করে যাওয়ার চেষ্টা করে যেতে হবে। শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ সাহেবের ভাষায়-
“খুবতর কি জুসতুজু মেঁ রাওয়াঁ”
মানে, ভালো থেকে ভালো, আরো ভালো করে যাওয়ার প্রচেষ্টায় সদা উদগ্রীব। আজ পাঁচশ ছাত্রের মধ্যে ভালো করেই যদি থেমে যাও, তবে ভবিষ্যতে পাঁচ লক্ষ আর পাঁচ কোটি যোগ্য মানুষের ময়দানে কীভাবে লড়বে! অমরত্বই বা কীভাবে অর্জন করবে! এবার ভাবো, কতো বেশি যোগ্যতা অর্জন করা দরকার।
যার খোলাছা আত্মপ্রসাদ ও অহংবোধে কখনো না ভোগা ৷
{মাসিক কিশোর বন্ধুঃ ডিসেম্বর-২০১৬}