মুসলিমমাত্রই সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। নামধারী মুসলিমরা একান্ত না দেখলেও ইমান যাদের অন্তরে প্রবেশ করেছে, তারা অবশ্যই দেখে। সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখলেই শুধু হয় না, কিছু নিয়মনীতি ও ধারা-উপধারা মেনে এগোতে হয়। অন্যথায় হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। সুতরাং সমাজবিপ্লবের ধারা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এর রূপরেখা প্রণয়ণ ও আদর্শ উপস্থাপনের প্রয়োজন। কিন্তু এই কাজটা করবে কারা?
কিছু মানুষের তো স্টান্ডার্ডই নেই। উদাহরণস্বরূপ ননসেন্স পিকেটারদের কথা ধরা যায়। যারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে পেট্রোলবোমা মেরে, গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দিনেদুপুরে মুসলিম হত্যা করে উল্লাস করে। আবার তারাই কাফিরদের মৃত্যুতে লম্বা লম্বা পোস্ট করে শোক প্রকাশ করে। ইয়া বড় বড় বিবৃতি দিয়ে উদার সাজার অপচেষ্টা করে।
বলছিলাম সমাজবিপ্লবের কথা। এ অঞ্চলে দীনের ঠিকাদারদের মধ্য থেকে যারা সমাজবিপ্লবের কথা বলে, তারা প্রায় সবাই-ই পশ্চিমা গণতন্ত্রের পথে হাঁটে ও নির্বাচনের ভোটজিহাদ করে। তারা রাসুলুল্লাহ সা. ও সাহাবিগণের জীবনীতে একালের জন্য কোনো আদর্শ খুঁজে পায় না। কারণ, তাদের ধারণা, এ যুগে ওসব অচল ও সেকেলে। তাই এখন প্রয়োজন নিত্যনতুন হিকমাহ, সালাফের পথ ছেড়ে নতুন পথ ধরা, নিজেদের মনমতো ইসলামি ফিকহ নিয়ে খেলা করা এবং শরিয়াহকে নিজেদের খেয়ালখুশির অনুগামী বানিয়ে ফেলা।
এর বাইরে বড় বড় পণ্ডিত যারা রয়েছেন, তারা সমাজবিপ্লব নিয়ে না নিজেরা আলোচনা করেন, আর তাদের দৃষ্টিতে তারা ছাড়া যেহেতু অন্য কেউ গবেষণা করার উপযুক্ত নয়, তাই অন্য কারও আলোচনাকেও সহ্য করেন না। ফলে যুগের পর যুগ ধরে এ বিষয়টা শুধু অবহেলিতই হচ্ছে না; বরং রীতিমতো অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্ম এ সম্পর্কে কিছু অলীক ধারণা ব্যতিরেকে কোনো জ্ঞানই রাখে না।
সমাজবিপ্লব নিয়ে যারা আলোচনা করেছেন, তারা সেই সকল আলিমের অল্পস্বল্প ভুলের কারণে তাদের ব্যাপারে নতুন প্রজন্মকে এমনভাবে সতর্কবার্তা দিয়ে ভয় ধরিয়ে দেন যে, নতুন প্রজন্ম সেকুলার লেখকদের লেখা দিনরাত পড়ে বেড়ালেও তাদের কোনো বই ছুঁয়ে দেখাকেও পাপ মনে করে; পাছে না আবার বিভ্রান্ত কিংবা উদ্ভ্রান্ত হয়ে যায়।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া, হাফিজ ইবনুল কায়্যিম, শহিদ হাসান আল-বান্না, সায়্যিদ কুতুব শহিদ, আবু মুসআব সুরি-সহ যাদের প্রসঙ্গই টানা হবে, তাদের ব্যাপারেই কিছু ট্যাগ লাগিয়ে অস্পৃশ্য হিসেবে চিহ্নিত করে রেখে দেওয়া হবে। মুফতির কাজ কোনো কিছুকে হারাম বলেই ক্ষান্তি দেওয়া নয়; বরং উম্মাহকে তার একাধিক বিকল্পের সন্ধান দেওয়া। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তারা ফাতওয়ার এ নীতি মানলেও ইসলামি সমাজবিপ্লবের ব্যাপারে মানেন না। উপরিউক্ত ব্যক্তিবর্গের বই যদি পড়া না যায় তাহলে এ ব্যাপারে কাদের বই আদ্যোপান্ত পড়া যাবে, এ সমাধানটি কেন যেন তারা বলেন না। একইভাবে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের বইয়ে মৌলিক কী কী সমস্যা রয়েছে, যেগুলো এড়িয়ে বইগুলো থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব, এ বিষয়টিও তারা সাধারণত জানান না। অবশ্য অধিকাংশের বিরোধিতা যেহেতু কেবল লোকমুখের শ্রুতির ভিত্তিতে, তাই এরা যথার্থ উত্তর তাদের অধিকাংশের কাছে আদতে নেইও। অন্যথায় কয়জন জ্ঞানী এমন আছেন, যারা উপরিউক্ত ব্যক্তিবর্গসহ এই ধারার আলিমগণের সব বই পড়ে এরপর বিরোধিতায় নেমেছেন। অধিকাংশজন তো তাদের বইপত্র জনমে ছুঁয়েও দেখেননি।
সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলে এককথায় ‘মুকাদ্দিমা ইবনে খালদুন’-এর নাম সবাই বলে দেন; কিন্তু ইসলামি সমাজবিপ্লব নিয়ে পড়তে চাইলে কোনো সাজেশনই পাওয়া যায় না। বরং সর্বদা একই উত্তর, এখনো এগুলো নিয়ে পড়ার সময় হয়নি। এগুলো নিয়ে বড়রা পড়বে এবং তারাই কথা বলবে। তোমরা পড়তে গেলে বিভ্রান্ত হবে। তাই আপাতত বসে বসে আঙুল চোষো আর এই একটা বিষয় বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুর ব্যবচ্ছেদ করতে থাকো। শুধু এই অস্পৃশ্য বিষয়টির ধারেকাছেও যেয়ো না। আর একান্ত যদি যেতেই চাও, তবে সবাই আপসকামিতার যে পথে হাঁটছে, তোমরাও সেই পথে হাঁটো। আব্রাহাম লিংকনের দেখানো পথে ইহকাল ও পরকালের মুক্তি জ্ঞান করো। আর বুড়োদের মুখ থেকে যা কিছু শোনো, সেগুলোকে মুরুব্বিদের ওসিয়ত ভেবে আজীবন ওহির মতো আঁকড়ে রেখো। নিজে পড়ারও প্রয়োজন নেই, আলাদা কিছু বলারও প্রয়োজন নেই। কারণ, তারা সবকিছু করে গেছেন। তোমরা শুধু তাদের নাম উচ্চকিত রেখো আর তাদের হাওয়ালা দিয়ে অন্ধভাবে সব আওড়াতে থেকো।
আমরা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, পৃথিবীর মধ্যে আলিম দুধরনের : (ক) কিতালি আলিম, (খ) নন-কিতালি আলিম। আমরা কিতালি আলিমদের সঙ্গে আছি। আর তোমরা নন-কিতালি আলিমদের সঙ্গে আছ। তোমরা নন-কিতালি আলিমদের সঙ্গে থেকে যদি অপরাধী না হও তাহলে আমরাও কোনোভাবে কিতালি আলিমদের সঙ্গে থেকে অপরাধী নই। তোমরা কিতালি আলিমদের প্রতি শত্রুতা প্রকাশ করেও যদি আলিমবিদ্বেষী না হও তাহলে আমরাও তোমাদের আলিমদের প্রতি বিদ্বেষের পরিবর্তে উল্টো বরং সৌহার্দ্য প্রকাশ করে এবং দলিলের আলোকে ভিন্নমত লালন করে আলিমবিদ্বেষী হতে পারি না। তোমরা আমাদের আলিমদের ব্যাপারে স্পষ্ট বেয়াদবি করেও যদি হক হতে পারো তাহলে আমরা তোমাদের সঙ্গে কেবল দালিলিক মতবিরোধ রাখার কারণেই বাতিল হতে পারি না।
পুরো পৃথিবী উল্টে গেলেও সরাসরি নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তোমরা যেমন যেকোনো ক্ষেত্রে নন-কিতালি আলিমদের আঁচল ছাড়তে প্রস্তুত হও না, একইভাবে আমরাও পুরো পৃথিবীর মোকাবেলায় কোনো মূল্যেই কিতালি আলিমদের সঙ্গ ছাড়তে প্রস্তুত হই না। মেরুদণ্ডে লাথি পড়ার আগ পর্যন্ত তোমাদের জন্য যেমন নন-কিতালি আলিমদের ফাতওয়া আত্মপ্রশান্তির কারণ, সর্বাবস্থায় আমাদের জন্যও তেমনি কিতালি আলিমদের ফাতওয়া আত্মপ্রশান্তির কারণ। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনো লড়াই নেই। আর যদি লড়াই হিসেবে কিছু দেখাতেই চাও তবে তা দলিলের লড়াই। কিন্তু তোমরা দালিলিকভাবে লড়াইয়ের ময়দানে না নেমে গালাগালি আর ট্যাগাট্যাগির বস্তা নিয়ে ময়দানে নামো। কিতালি আলিমদেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদেরকেই একমাত্র হকের ঠিকাদার হিসেবে ধরে আলোচনা করতে বসো। সব দিন কিন্তু সমান যায় না। আজ তুমি চার দেয়ালের রাজা বলে উচ্চবাচ্য ভালোই করছ। কিন্তু যেদিন কিতালি আলিমদের বিজয় হবে, সেদিন তুমি কী করবে? কোন মুখ নিয়ে সামনে আসবে? নাকি আস্ত পল্টি মেরে সাধুবাবা সেজে বসবে? যেমনিভাবে সরকারের পালাবদল তোমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে না। কারণ, তোমরা বিশেষ কোনো সরকারের সমর্থক নও। বরং তোমরা ক্ষমতার গোলাম। যখন যে আসে, তার বন্দনা ও স্তুতি বর্ণনার মধ্যেই খুঁজে পাও স্বস্তি। ক্ষমতাধারীদের দালালির মধ্যে খুঁজে পাও আত্মার পরম প্রশান্তি।
শোনো ভাই, অযথা অন্যদের নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বসে বসে নিজের চরকায় তেল দাও। কারণ, বাতিল ফেনার মতো শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় আর যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিনে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। নিজেদের রাজত্ব নিয়ে খুব পেরেশান হয়ে গেছ বুঝি! মানুষ দলে দলে কিতালিদের দিকে ছুটছে বলে অন্তর্জ্বালা খুব বেড়ে গেছে বুঝি! কাজ করে যাও। যদি তুমি হক হও, তাহলে আল্লাহ তোমাকে উচ্চমর্যাদা দান করবেন। আর যদি কিতালিরা হক হয়, তাহলে শীঘ্রই তিনি তোমাদের চোখ থেকে পর্দা সরিয়ে দেবেন। বোঝে তো সবাইই। কিন্তু কেউ বোঝে বোখারা-সমরকন্দ বা আরাকানের পরিস্থিতির শিকার হওয়ার পর। আর কেউ-বা বোঝে আগেভাগেই। হ্যাঁ, কিছু অথর্ব সব অঞ্চলেই এমন থাকে, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত যাদের হেকমতি ফাতওয়া আর শেয়ালিপনা দূর হয় না। যাদের কাছে দীন রক্ষার চাইতে মসনদ রক্ষাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ, যারা হিকমাহর দোহাই দিয়ে সত্যকে আড়াল করে জাতির ইমান রক্ষার ঠিকাদার সাজে, যারা চেঁচামেচি করে ময়দান কাঁপালেও প্রায়োগিক ময়দানে কোনো রোডম্যাপ বা রোলমডেল কস্মিনকালেও প্রদর্শন করতে পারে না, তাদের স্বরূপ সচেতন ব্যক্তিদের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়বে এবং মানুষ তাদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাবে – এটাই তো অমোঘ বাস্তবতা; যা আজ হোক বা কাল একান্ত হওয়ারই ছিল।