ইমান ও আকিদার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়; বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে একটা তিক্ত সত্য তুলে ধরি।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সিস্টেম হলো, এখানকার জনগণ রাষ্ট্রকে সচল রাখার জন্য কর দেবে আর রাষ্ট্রের আইনকানুন মেনে চলবে। বিনিময়ে রাষ্ট্র জনগণের নিরাপত্তা দেবে এবং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করবে। কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কিংবা কেউ রাষ্ট্রীয় বিধান লঙ্ঘন করলে এর সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং স্বীকৃত আইন অনুসারে এর বিচার হবে। এটাই নিয়ম, এটাই রীতি। গণতন্ত্র উদ্ভাবকদের দাবিমতে সভ্য গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যই এটা।

সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত ব্যক্তিরা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। তারা ‘লর্ড অব পাবলিক নয়’। একজন পুলিশ অফিসার জনগণের সেবক। কারণ, সে রাষ্ট্রের চাকর। আর গণনান্ত্রিক রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রভু জনগণ। এমনকি গণতন্ত্র বিশ্বাস করে, সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তিই হলো জনগণের প্রদত্ত কর। আর এই করের টাকা খেয়েই পুলিশ অফিসার তার জীবন বাঁচায়, ফ্যামিলি চালায়। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক সাংবিধানিকভাবে কোনো পুলিশ অফিসারকে, সে যত বড় পদেই আসীন থাকুক না কেন, ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য নয়। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে পুলিশ রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের সঙ্গেই সম্মানজনক আচরণ করতে বাধ্য। এই কথা শুধু পুলিশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; এটা জাস্ট উদাহরণ মাত্র। সকল ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’র ক্ষেত্রেই এই কথা।

কিন্তু সিস্টেমটা উলটে গেল কেন? ভৃত্য কেন প্রভু হলো আর প্রভুকে কীভাবে ভৃত্য বানিয়ে ফেলা হলো? দুই পয়সার এসি ল্যান্ড ইতর মহিলা চারজন ষাটোর্ধ্ব মুরুব্বিকে কীভাবে কানে ধরায়? মানবসেবায় নিয়োজিত একজন মেডিক্যাল অফিসারের গায়ে কীভাবে ঘুষখোর সার্ভেন্ট হাত তোলে? একজন সেবক প্রভুকে কেবল অনুরোধ করতে পারে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে অসভ্য আচরণ করার অধিকার এই হুকুমের গোলামদের কে দিয়েছে?

যাহোক, কথা এগুলো না। আমাদের লোকেরা এখনো পড়ে আছে গণতন্ত্রের বৈধতা-অবৈধতার ফিকহি আলাপ নিয়ে। কিন্তু গণতন্ত্র আছে কোথায়? কিসের গণতন্ত্রের কথা এরা বলে! গণতন্ত্রের প্রাণ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন। সেই নির্বাচনই তো বহু আগে বিলুপ্ত। এখন জাস্ট ফর্মালিটিটা বাকি রয়ে গেছে। হয়তো কোনো একসময় এটাও লুপ্ত হয়ে যাবে। এখন আর কেউ জনপ্রতিনিধি হয় না; সবাই হয় সরকারপ্রতিনিধি। পুরো সিস্টেমটাই উলটে গেছে। তাইতো গুম, খুন, রিমান্ডের নামে বর্বর নির্যাতন, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু – এসবই এখন ওপেন সিক্রেটের মতো হয়ে গেছে। ভয়ে এগুলো নিয়ে কেউ প্রতিবাদই করে না। দেশের মাথা মাথা ধর্মীয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে শাপলার শহিদদের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে পুরো হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করা হলেও এখন কেউ আর প্রতিবাদ করার সাংবিধানিক অধিকার প্রদর্শন করার হিম্মতটুকুও করে না।

বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। সাধারণত রাজশক্তি-বিহীন রাষ্ট্রকেই প্রজাতন্ত্র বলা হয়। প্রজাতন্ত্র হলো এমন একটি সরকারব্যবস্থা, যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রের আইনকানুন ও বিধান-সংবিধান নিয়েও স্বাধীন মতামত জানাতে পারে। যেকোনো গঠনমূলক বিশ্লেষণ জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারে। পারে যেকোনো অন্যায় ও বেইনসাফির প্রতিবাদ করতে। কিন্তু এই সৎসাহস জেনারেলদের মধ্যে অনেকে করে থাকলেও আমাদের ধর্মীয় নেতৃত্বধারীদের কয়জন করে থাকে! অথচ এক্ষেত্রে জেনারেল আইন বিশেষজ্ঞদের তুলনায় ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞরা অধিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ছিল; অন্যথায় তাদের নামের সার্থকতাই আর থাকল কোথায়। উপরন্তু কোনো আলিম এসব বিষয় নিয়ে শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করলে উলটো তার পেছনে অধিকাংশজন লেগে যায়। অথচ দেশ পালটানো যায়, নাগরিকত্ব পালটানো যায়, আইন পালটানো যায়, সংবিধান পালটানো যায়; কিন্তু কোনো অবস্থায়ই ধর্ম ছাড়াও যায় না, পালটানোও যায় না। এমনকি তাতে পরিমার্জনও করা যায় না, নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় বা শিথিলতাও ঘোষণা করা যায় না। এরপরও ধর্ম নিয়ে ভয় নেই; সব ভয় কোনো অজানা শক্তির।

না, এভাবে চলে না, চলতে পারে না। এভাবে কোনো পরিবর্তন আসে না, আসতে পারে না। আদর্শের ব্যাপারে যারা আপসকামিতায় বিশ্বাসী, তারা মূলত আদর্শহীন। এসব ব্যক্তি যত জ্ঞানী ও গুণীই হন না কেন, কখনোই নেতৃত্বের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন না। পৃথিবীর সবার পা পিছলে গেলেও নেতা হবেন অবিচল, আদর্শের ওপর অটল, আপসকামিতা শব্দটি তার অভিধানেই থাকবে না। এ জন্যই তো হুনায়নের ময়দানে প্রায় সবাই সরে গেলেও একজন মানুষকে অটল, অবিচল, দৃপ্ত, সাহসী ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি আর কেউ নন; সায়্যিদুল কাওনাইন, ইমামুস সাকালাইন, নাবিয়্যুর রহমাতি ওয়াল মালহামা মুহাম্মাদ ﷺ। পৃথিবী ক্রমশ তার উত্তরাধিকারীশূন্য হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই নেতৃত্বহীন অবস্থার অবসান ঘটাতেই আবির্ভাব ঘটবে খলিফা মাহদির। তিনি এসে নতুন কোনো মিশন স্টার্ট করবেন না; বরং নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করার জন্যই ঘটবে তার প্রত্যাশিত আগমন।

Share This