কিছু মানুষ এ কথা বলে বেড়ায় যে, শাসক ছাড়া কোনো জিহাদ নেই। শাসকের অনুপস্থিতিতে যেসব লড়াই সংঘটিত হয়, তা সবই ফিতনার লড়াই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সালাফে সালেহিন ও উম্মাহর ইমামগণের ইজমা অনুযায়ী এ মতের কোনো ভিত্তি নেই। এটি একটি স্পষ্ট ভ্রান্ত মত, যা সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদিস এবং শরয়ি নীতি ও ফিকহি মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ যেমন :

১. কুরআনের যে সমস্ত আয়াত ও রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যে সকল হাদিসে আল্লাহর পথে জিহাদের নির্দেশ করা হয়েছে, সেগুলোতে এ ধরনের কোনো শর্তারোপ করা হয়নি; বরং এ আয়াত ও হাদিসগুলো ব্যাপক ও শর্তমুক্ত। আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহয় একযোগে সমস্ত মুমিন-মুসলমানকে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ইরশাদ হয়েছে :

وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ

তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো তাদের সাথে, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে।[1]

انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ

(জিহাদের জন্য) বের হয়ে পড়ো হালকা অবস্থায় থাকো বা ভারী অবস্থায় এবং নিজেদের প্রাণ ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে যাও।[2]

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন :

جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ

তোমরা মুশরিকদের সাথে জিহাদ করো তোমাদের সম্পদ, জীবন এবং জিহ্বার দ্বারা।[3]

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :

فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا

সুতরাং তুমি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। তোমার ওপর তোমার নিজের ছাড়া অন্য কারও দায়ভার নেই। অবশ্য মুমিনদের উৎসাহ দিতে থাকো। অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ কাফিরদের যুদ্ধ-ক্ষমতা চূর্ণ করে দেবেন। আল্লাহর শক্তি সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড এবং তার শাস্তি অতি কঠোর।[4]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু হাজম রহ. বলেন,

وهذا خطاب متوجه إلى كل مسلم، فكل أحد مأمور بالجهاد وإن لم يكن معه أحد

এটা প্রতিটি মুসলমানের প্রতি আল্লাহ তাআলার সম্বোধন৷ সুতরাং প্রত্যেকেই জিহাদের ব্যাপারে আদিষ্ট, যদিও-বা তার সাথে আর কেউ না থাকে৷[5]

ইমাম ইবনু কুদামা রহ. বলেন,

الجهاد فرض على الكفاية…. الخطاب في ابتدائه يتناول الجميع كفرض الأعيان، ثم يختلفان أن فرض الكفاية يسقط بفعل بعض الناس له، وفرض الأعيان لا يسقط عن أحد بفعل غيره

জিহাদ সাধারণ অবস্থায় ফরজে কেফায়া। …আয়াতের শুরুতে এমনভাবে সম্বোধন করেছে, যা সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে—যেমনটা ফরজে আইনের ক্ষেত্রে করা হয়। সম্বোধন একই রকমের হলেও বিধানের বিবেচনায় দুটোতে ভিন্নতা চলে আসে৷ আর তা হলো, ফরজে কেফায়া আমল কতক মানুষের সম্পাদন করার দ্বারা আদায় হয়ে যায়৷ আর ফরজে আইন আমল একজন সম্পাদন করার দ্বারা অন্যজন থেকে রহিত হয় না৷[6]

শাইখ আবদুর রহমান বিন হাসান রহ. বলেন,

ولا ريب أن فرض الجهاد باق إلى يوم القيامة، والمخاطب به المؤمنون، فإذا كانت هناك طائفة مجتمعة لها منعة وجب عليها أن تجاهد في سبيل الله بما تقدر عليه، لا يسقط عنها فرضه بحال ولا عن جميع الطوائف

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জিহাদের ফরজিয়্যাত (আবশ্যকতা) কিয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে এবং সকল মুমিনকেই সে ব্যাপারে সম্বোধিত থাকবে৷ সুতরাং যদি কোথাও এমন কোনো সংঘবদ্ধ দল থাকে, যাদের প্রতিরক্ষা শক্তি রয়েছে তাহলে তাদের জন্য নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহর পথে জিহাদ করা ওয়াজিব৷ এ ফরজিয়্যাত না তাদের থেকে কখনো রহিত হবে আর না অন্যান্য দলসমূহ থেকে রহিত হবে৷[7]

২. জিহাদ দুই প্রকার : (ক) প্রথম প্রকার হলো, আক্রমণাত্মক জিহাদ৷ অর্থাৎ শত্রুভূমিতে গিয়ে শত্রু তালাশ করা৷ এ প্রকারের জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্যও ইমাম বিদ্যমান থাকা শর্ত নয়৷ হ্যাঁ, যখন ইমাম নিজ দায়িত্বে জিহাদ সম্পাদন করতে থাকবে, তখন তার অনুমতি ও সিদ্ধান্ত ব্যতীত জিহাদে নেমে পড়া ও স্বেচ্ছাচারিতা করা যাবে না। কারণ, এ বিষয়টির দায়িত্ব মূলত তাকে দেওয়া হয়েছে৷ তাই তার থেকে অনুমতি গ্রহণ করা ওয়াজিব হবে৷ তবে তা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়৷ সুতরাং এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি ইমামের অনুমতি ছাড়া জিহাদ করবে, সে গোনাহগার হবে ঠিকই; কিন্তু তার জিহাদ শুদ্ধ হয়ে যাবে৷ আর যদি ইমাম না-ই থাকে বা হারিয়ে গিয়ে থাকে কিংবা নিহত হয়ে যায় তাহলে জিহাদ বন্ধ করে থাকবে না৷

ইমাম ইবনু কুদামা রহ. বলেন :

فإن عدم الإمام لم يؤخر الجهاد؛ لأن مصلحته تفوت بتأخيره، وإن حصلت غنيمة قسمها أهلها على موجب أحكام الشرع

যদি খলিফা বিদ্যমান না থাকে তাহলে জিহাদ বিলম্বিত করা হবে না। কারণ, বিলম্ব করার দ্বারা জিহাদের কল্যাণ হাতছাড়া হয়ে যাবে৷ সেক্ষেত্রে যদি কোন গনিমত অর্জিত হয়, তাহলে তা শরিয়তের বিধান অনুসারে গনিমতের হকদাররা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেবে।[8]

সুতরাং যদি ইমাম বিদ্যমান থাকা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তই হতো, তাহলে ইমামের অনুপস্থিতিতে জিহাদ স্থগিত রাখা এবং ইমাম পাওয়া যাওয়া পর্যন্ত তা বিলম্বিত করা ওয়াজিব হতো৷ তখন কোনোভাবেই মুসলমানদের কল্যাণের স্বার্থে তা চালিয়ে নেওয়ার অবকাশ থাকত না এবং গনিমত ভক্ষণও বৈধ হতো না৷

এ ছাড়াও ইমামের বিদ্যমান থাকা যদি আবশ্যকই হতো, তাহলে যে ক্ষেত্রে মুজাহিদদের জন্যে তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করা সম্ভাবিত না হবে, যুক্তির দাবি অনুযায়ী সে ক্ষেত্রেও জিহাদ বিলম্বিত করা ওয়াজিব হতো৷ অথচ প্রয়োজনের তাগিদে ইমাম বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার অনুমতি ছাড়াই মুজাহিদদের জন্য জিহাদ পরিচালনা করা বৈধ৷ এর সবচে প্রকৃষ্ট উদাহরণ রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর জীবনীতেই পাওয়া যায়। সালামা ইবনুল আকওয়া রা. বলেন :

‘…তারপর যখন আমরা ও মক্কাবাসীরা সন্ধিতে আবদ্ধ হলাম এবং আমাদের একপক্ষ অপর পক্ষের সাথে মেলামেশা করতে লাগলাম, তখন আমি একটি গাছতলায় গিয়ে তাঁর নিচের কাঁটা প্রভৃতি পরিষ্কার করে তাঁর গোঁড়ায় একটু শুয়ে পড়ি। এমনসময় মক্কাবাসী চারজন মুশরিক এসে রাসুলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে অপ্রীতিকর কথা বলতে লাগল।

আমার কাছে ওদের কথাবার্তা অত্যন্ত খারাপ লাগল এবং আমি স্থান পরিবর্তন করে আর একটি গাছের তলায় চলে গেলাম। তারা তাদের অস্ত্র গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল। এমন সময় প্রান্তরের নিম্নাঞ্চল থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল :

يَا لَلْمُهَاجِرِينَ، قُتِلَ ابْنُ زُنَيْمٍ

হে মুহাজিরগণ, সাহায্য! ইবনু যুনায়ম নিহত হয়েছে।

আমি তৎক্ষণাৎ আমার তরবারি উঠিয়ে ধরলাম এবং ওই চারজনের উপর আক্রমণ চালালাম। তখন তারা ঘুমিয়ে ছিল। আমি তাদের অস্ত্রগুলো হস্তগত করলাম এবং তা আটি বেঁধে আমার হাতে নিলাম। এরপর আমি বললাম, যে মহান সত্তা মুহাম্মদ ﷺ-কে সম্মানিত করেছেন তাঁর কসম, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি মাথা তোলে, তবে তাঁর সেই অঙ্গে আঘাত (করে বিচ্ছিন্ন) করব যেখানে তাঁর চোখ দুটো রয়েছে (অর্থাৎ ঘাড়ে)।

তারপর তাদেরকে আমি হাঁকিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। এমন সময় আমার চাচা আমির ‘আবালাত’ গোত্রের একজনকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট নিয়ে এসেছেন। তাকে বলা হত মিকরায। সে ছিল আঘাত নিরোধক বস্ত্রাকৃত একটি ঘোড়ায় আসীন। আর তাঁর সাথে ছিল ৭০ জন মুশরিক। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের দিকে তাকালেন এবং বললেন, “ওদেরকে ছেড়ে দাও, যাতে অপকর্মের সূচনা ওদের পক্ষ থেকেই হয় এবং পুনরাবৃত্তিও ওরাই করে”। এ কথা বলে রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের ক্ষমা করে দিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাজিল করলেন—

وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ

সেই পবিত্র সত্তা যিনি মক্কা প্রান্তরে তাদের হাতকে তোমাদের উপর থেকে এবং তোমাদের হাতকে তাদের উপর থেকে বিরত রেখেছেন তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর।[9]

তারপর আমরা মদিনায় প্রত্যাবর্তনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। পথে এমন একটি মনজিলে আমরা অবতরণ করলাম, যেখানে আমাদের ও লিহয়ান গোত্রের মধ্যে কেবল একটি পাহাড়ের ব্যবধান ছিল। আর তারা ছিল মুশরিক। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দুয়া করলেন, যে ব্যক্তি রাতে নবি ﷺ ও তাঁর সাহাবিদের পক্ষ থেকে খবরদারির জন্য পাহাড়ের ওপর আরোহণ করবে। সালামা বলেন, সে রাতে আমি দুই কি তিনবার ওই পাহাড়ে আরোহণ করেছিলাম। তারপর আমরা মদিনায় এলাম। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর গোলাম রাবাহকে দিয়ে তাঁর উটগুলো পাঠালেন। আর আমিও তালহা রা.-এর ঘোড়ায় চলে তাঁর সাথে সাথে ঘাস-পানি খাওয়ানোর জন্য উটগুলো চারভূমির দিকে নিয়ে গেলাম। যখন আমাদের ভোর হলো, আবদুর রহমান ফাজারি চড়াও হয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর (বিচরণকৃত) সমস্ত উট ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং তাঁর রাখালকে হত্যা করল। আমি তখন রাবাহকে বললাম, হে রাবাহ, নাও, এই ঘোড়া নিয়ে তুমি তালহা ইবনু উবায়দুল্লাহকে পৌঁছে দিয়ো আর রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে সংবাদ দাও যে, মুশরিকেরা তাঁর চারণভূমির উটগুলো লুটে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তখন আমি একটি টিলার ওপর দাঁড়ালাম। তারপর মদিনার দিকে মুখ করে তিনবার হাক দিলাম, ইয়া সাবাহা! (ভোরের আক্রমণ)

তারপর আমি লুটেরাদের পিছু ধাওয়া করলাম এবং তাদের ওপর তির নিক্ষেপ করতে লাগলাম। আর আমি মুখে এই চরণ উচ্চারন করছিলাম—

وَأَنَا ابْنُ الْأَكْوَعِ وَالْيَوْمُ يَوْمُ الرُّضَّعِ

“আমি আকওয়ার পুত্র, আজ সেই দিন, আজ ইতরকে (শায়েস্তা করার) দিন। আজকে কেমন মায়ের দুধ (খেয়েছ তা স্মরণের দিন)।”

তখন আমি তাদের যে কাউকে পেয়েছি, তাঁর ওপর এরকমভাবে তির নিক্ষেপ করেছি যে, তিরের অগ্রভাগ তার কাঁধের কোমল হাড় ছেদ করে বেরিয়েছে। আমি বলতে লাগলাম, এ আঘাত নাও, আমি আকওয়ার পুত্র, আজ ইতরকে (শায়েস্তা করার) দিন। আজকে কেমন মায়ের দুধ (খেয়েছ তা স্মরণের দিন)। আল্লাহর কসম, আমি তির নিক্ষেপ করতে থাকলাম এবং ঘায়েল করতে লাগলাম এবং যখনই কোনো ঘোড়সওয়ার আমার দিকে ফিরত তখনই আমি গাছের আড়ালে এসে তার গোঁড়ায় বসে তার প্রতি তির নিক্ষেপ করতাম আর তাকে জখম করে ফেলতাম।

অবশেষে যখন তারা পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে আসে এবং তারা সে সংকীর্ণ পথে ঢোকে আমি তখন পাহাড়ের উপর উঠে সেখান থেকে (অবিরাম) তাদের উপর পাথর গড়িয়ে দিতে থাকলাম। এভাবে আমি তাদের পশ্চাদ্ধবন করতে থাকলাম যে পর্যন্ত না আল্লাহর সৃষ্ট উটগুলোর প্রতিটি উট যা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ভারবাহীরূপে ছিল তা আমার পেছনে রেখে না যাই। তারা এগুলি আমার আওতায় ফেলে চলে গেল। তারপরও আমি তাদের অনুসরণ করে তাদের দিকে তির নিক্ষেপ করতে থাকলাম। এমনকি তারা ৩০টির বেশি চাঁদর এবং ৩০টি বল্লম নিজেদের বোঝা হালকা করার উদ্দেশ্য ফেলে গেল। তারা যে সব বস্তু ফেলে যাচ্ছিল আমি তাঁর প্রত্যেকটিকে পাথর দিয়ে চিহ্নিত করে যাচ্ছিলাম, যাতে রাসুলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবিগণ তা চিনতে পারেন।

অবশেষে তারা পাহাড়ের একটি সংকীর্ণ স্থানে গিয়ে পৌঁছাল। এমন সময় বদর ফাজারির অমুক পুত্র এসে তাদের সাথে মিলিত হল। এবার তারা সকলে মিলে সকালের খাবার খেতে বসল। আমি পাহাড়ের একটি শৃঙ্গে বসে পড়লাম। তখন সে ফাজারি বলল, ঐ যে লোকটাকে দেখছি সে কে? তারা বলল, লোকটির হাতে আমরা অনেক দুর্ভোগ পোহায়েছি। আল্লাহর কসম! সেই রাতের আধার থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত লোকটা আমাদের পিছন থেকে সরছে না, সে আমাদের প্রতি (অবিরাম) তীর নিক্ষেপ করেছে, এমনকি আমাদের যথাসর্বস্ব সে কেড়ে নিয়েছে। তখন সে বলল, তোমাদের মধ্যকার চারজন উঠে গিয়ে তাঁর উপর চড়াও হও। তখন তাদের চার ব্যাক্তি পাহাড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। তারপর তারা যখন আমার কথা শোনার মত নিকটবর্তী স্থানে এসে পৌঁছল, তিনি বলেন, তখন আমি বললাম, তোমরা কি আমাকে চেন? তারা বলল, না। তিনি বলেন, আমি বললাম, আমি সালামা ইবনু আকওয়া। কসম সেই পবিত্র সত্তার, যিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সম্মানিত করেছেন। আমি তোমাদের যাকেই পেতে চাইব (লক্ষ্য বানাব) তাকে ধরে ফেলব। কিন্তু তোমাদের কেউ চাইলেই আমাকে ধরতে পারবে না।

তখন তাদের একজন বলল, আমিও তাই মনে করি। তিনি বলেন, তারপর তারা ফিরে গেল। আর আমি সেই স্থানেই বসে রইলাম। অবশেষে আমি গাছ গাছালির মাঝ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অশ্বারোহীদের অগ্রসর হতে দেখলাম। তিনি বলেন, তাদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন আখারাম আসা’দী। তাঁর পিছনে আবূ কাতাদা আনসারী। তাঁর পিছনে মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ কিন্দী। তিনি বলেন, আমি তখন আখরামের ঘোড়ার লাগাম ধরলাম। তিনি বলেন, তখন তারা (শত্রুরা) পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে গেল। আমি বললাম, হে আখরাম! ওদের থেকে সতর্ক থাকবে। তারা যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ এসে মিলিত হওয়ার পূর্বেই তোমাদের বিচ্ছিন্ন করে না ফেলে। আখারাম বললেন, যে সালামা! তুমি যদি আল্লাহ্‌ ও কিয়ামত দিনের প্রতি বিশ্বাসী হও এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে সত্য মনে কর তবে আমার এবং শাহাদতের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করো না। সালামা বলেন, তখন আমি তাঁর পথ ছেড়ে দিলাম।

তখন তিনি আবদুর রহমানের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হলেন। আখরাম আবদুর রহমানের ঘোড়াকে আহত করলেন, আর আব্দুর রহমান বর্শার আঘাতে তাকে কতল করে দিল এবং আখরামের ঘোড়ার উপর চড়ে বসল। ইতিমধ্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘোড় সাওয়ার আবূ কাতাদা (রাঃ) এসে পৌঁছলেন। তিনি আবদুর রহমানকে বর্শার আঘাতে হত্যা করলেন। সেই পবিত্র সত্তার কসম! যিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মর্যাদা মণ্ডিত করেছেন, আমি তখন এতই দ্রুতগতিতে তাদের পিছু ধাওয়া করে যাচ্ছিলাম যে, আর পিছনে (অনেক দূর পর্যন্ত) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন সাহাবীকেই দেখতে পেলাম না, এমনকি তাদের ঘোড়ার খুরের ধুলিও আমার দৃষ্টিগোচর হোল না। এভাবে চলতে চলতে সূর্যাস্তের প্রাক্কালে তারা এমন একটি গিরি পথে উপনীত হল যেখানে যু-কারাদ নামক একটি প্রস্রবণ রয়েছে। অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তারা পানি পান করতে অবতরন করল। তখন তারা আমাকে তাদের পিছু ধাওয়া করে দৌড়ে আসতে দেখতে পেল। এক জায়গায় পানি পান করার পূর্বেই আমি সেখান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিলাম। তখন তারা পাহাড়ের একটি ঢালু উপত্যকার দিকে দৌড়াতে লাগলো আর আমিও তাদের পিছু ধাওয়া করতে লাগলাম।

আমি তাদের যে কোন একজনের নিকটবর্তী হলে তাঁর কাঁধের অস্তিতে তীর নিক্ষেপ করে বললাম, আমি আকওয়ার পুত্র, ইতরদের (বোঝাবার) দিন আজ (দুধপান স্মরণের দিন)। সে তখন বলল, তাঁর মা (পুত্র হারা হয়ে) তাঁর জন্য কাদুক তুমি কি সে আকওয়া যে আমাদের সেই ভোর থেকে অতিষ্ঠ করে রেখেছ? আমি বললাম হ্যাঁ, তোমার জানের দুশমন, (আমি) সেই তোমার ভোরবেলার আকওয়াই। তিনি বলেন, অতঃপর তারা দুটি ক্লান্ত ঘোড়া উপত্যকায় ছেড়ে চলে গেল। তিনি বলেন, তখন আমি ঐ দুটোকে হাকিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট নিয়ে এলাম। তিনি বলেন, সেখানে একটি অল্প দুধভর্তি ‘সাতীহা’ (চামড়ার তৈরি পাত্র) এবং একটি পানিভর্তি সাতীহা নিয়ে এসে আমির আমার সাথে মিলিত হলেন। আমি তখন উযূ (ওজু/অজু/অযু) করলাম এবং (দুধ) পান করলাম। তারপর এমন অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এলাম যখন তিনি ঐ পানির কাছে ছিলেন, যা থেকে আমি ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

এদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সমস্ত উট ও মুশরিকদের নিকট থেকে আমার ছিনিয়ে আনা সব কিছু বর্শা ও চাঁদর প্রভৃতি হস্তগত করেছেন। তখন বিলাল, লোকদের কাছে থেকে আমার উদ্ধারকৃত একটি উট জবাই করেছেন এবং তাঁর কলিজা ও কুজ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য ভুনছিলেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে সুযোগ দিন, আমি আমাদের লোকদের থেকে একশ জনকে বাছাই করে নিয়ে সেই দুশমনদের পিছু ধাওয়া করি যাতে তাদের সকলকে এমনিভাবে হত্যা করব যে, তাদের খবর বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত একটি লোকও অবশিষ্ট থাকবেনা। তিনি বলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে হাসলেন যে, চুলার আগুনের আভায় তাঁর চোয়ালের দাঁতগুলি প্রকাশ পেল। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে সালামা! তুমি কি মনে কর যে, তুমি তা-ই করবে? আমি বললাম হ্যাঁ, সেই পবিত্র সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, এতক্ষণে তো তারা গাতফান পল্লিতে আতিথ্য ভোগ করছে।

তিনি বলেন, পরে গাতফান গোত্রের একটি লোক এল, সে বলল, অমুক তাদের জন্য একটি উট জবেহ করেছে। তারা যখন তাঁর চামড়া ছড়াচ্ছিল তখন তারা ধুলোরাশি উড়তে দেখতে পায়। তখন তারা বলে উঠল ওরা (আকওয়া ও তাঁর বাহিনী) তোমাদের নিকট এসে পড়েছে। তখন তারা পালিয়ে যায়। এরপর আমাদের ভোর হল। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন :

كَانَ خَيْرَ فُرْسَانِنَا الْيَوْمَ أَبُو قَتَادَةَ، وَخَيْرَ رَجَّالَتِنَا سَلَمَةُ

আমাদের আজকের সেরা অশ্বারোহী হচ্ছে আবূ কাতাদা আর আমাদের সেরা পদাতিক হচ্ছে সালামা। তিনি বলেন, তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে অশ্বারোহী ও পদাতিক হিসাবে গণিমতের দুই অংশ দিলেন। আমাকে তিনি একত্রে দুই অংশ দিলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মদিনায় প্রত্যাবর্তন কালে আমাকে তাঁর সাথে তাঁর উটনী ‘আদবার’ পিছনে বসিয়ে নিলেন।[10]

ইমাম ইবনু কুদামা রহ. বলেন,

لا يخرجون إلا بإذن الأمير؛ لأن أمر الحرب موكول إليه، إلا أن يتعذر استئذانه لمفاجأة عدوهم لهم، فلا يجب استئذانه حينئذ؛ لأن المصلحة تتعين في قتالهم والخروج إليهم لتعين الفساد في تركهم

তারা খলিফার অনুমতি ছাড়া বের হবে না৷ কেননা যুদ্ধের বিষয়টি তার দায়িত্বে ন্যস্ত করা হয়েছে৷ তবে যদি শত্রুর আকস্মিক হামলার কারণে তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করা দুষ্কর হয়ে যায়, তাহলে তখন অনুমতি গ্রহণ ওয়াজিব থাকবে না৷ কারণ, এক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা ও তাদের উদ্দেশে জিহাদে বের হওয়ার মধ্যে কল্যাণ সুনির্ধারিত, যেমনিভাবে তাদের সঙ্গে জিহাদ পরিত্যাগ করলে ক্ষতিও নির্দিষ্ট।[11]

সুতরাং যদি ইমাম বিদ্যমান থাকা ও তার অনুমতি গ্রহণ আক্রমণাত্মক জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তই হতো তাহলে যখন ইমাম বিদ্যমান না থাকবে কিংবা বিদ্যমান থাকলেও প্রয়োজনের খাতিরে তার অনুমতি ছাড়াই জিহাদ পরিচালিত হবে, তখন জিহাদ শুদ্ধ না-হওয়াই ছিল যুক্তির দাবি৷ কারণ, ‘শর্ত’ বলা হয় ওই বিষয়কে, যার অনস্তিত্বে যার জন্য তাকে শর্ত করা হয়েছে তার অনস্তিত্বও আবশ্যক হয়৷ অথচ এখানে এই দুই প্রকারের আক্রমণাত্মক জিহাদকে ফকিহগণ নাকচ করেননি৷ এ দ্বারা বোঝা গেল, ইমাম বিদ্যমান থাকা এ প্রকারের জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়৷ বরং উভয় অবস্থাতেই বিবেচ্য বিষয় হলো, মুসলমানদের কল্যাণ নিশ্চিত করা ও ক্ষতি বিদূরীত করা—যেমনটি ইমাম ইবনু কুদামা রহ. জিহাদের কারণ চিহ্নিত করেছেন৷

(খ) দ্বিতীয় প্রকার হলো শত্রুদের থেকে মুসলিমভূমির প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ৷ এ প্রকারে ইমামের উপস্থিতি শর্ত না হওয়ার বিষয়টি তো আরও অধিকতর স্পষ্ট ও পরিষ্কার৷ কেননা এ প্রকার জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার জন্য কোনোই শর্ত নেই; বরং প্রত্যেকের ওপরই ওয়াজিব তার সাধ্যমতো প্রতিরোধ করা৷ সুতরাং সন্তান তার বাবার কাছে, স্ত্রী তার স্বামীর কাছে, ঋণগ্রহীতা তার ঋণদাতার কাছে অনুমতি চাইবে না৷ অথচ এরা সকলেই অনুমতি ও আনুগত্যে আমিরের তুলনায় বেশি হকদার ছিল৷ তা সত্ত্বেও এমতাবস্থায় তাদের হক বাতিল হয়ে গেছে৷ কেননা, জিহাদ এখন সকলের ওপরই ফরজে আইন৷

তাই এখন ইমামের বিদ্যমানতা শর্ত হওয়া তো দূরের কথা, বরং ইমাম বিদ্যমান থাকলেও তার থেকে অনুমতি গ্রহণ করা শর্ত নয়৷

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন,

أما قتال الدفع عن الحرمة والدين فواجب إجماعاً، فالعدو الصائل الذي يفسد الدين والدنيا لا شيء أوجب بعد الإيمان من دفعه، فلا يشترط له شرط، بل يدفع بحسب الإمكان

আর ইজ্জত-আবরু ও দ্বীন প্রতিরক্ষায় লড়াই করা সকলের ঐকমত্যে ওয়াজিব৷ কারণ, যেই আক্রমণকারী শত্রু মুসলমানদের দীন ও দুনিয়া উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত করে, ইমান আনার পর তাকে প্রতিহত করার চেয়ে বড় কোনো ওয়াজিব নেই৷ তাই তা ওয়াজিব হওয়ার জন্য কোনো শর্ত নেই; বরং সাধ্যমতো তাদের প্রতিহত করা হবে৷[12]

তিনি আরও বলেন :

وإذا دخل العدو بلاد الإسلام فلا ريب أنه يجب دفعه على الأقرب فالأقرب، إذ بلاد الإسلام بمنزلة البلدة الواحدة، وأنه يجب النفير إليها بلا إذن والد ولا غريم

শত্রুরা যখন মুসলিম শহরে অনুপ্রবেশ করে, তখন এতে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, তাদেরকে প্রতিহত করা প্রথমে তাদের সবচে নিকটবর্তী লোকদের ওপর, তারপর যারা তাদের বেশি নিকটবর্তী তাদের ওপর… এইভাবে সকল মুসলিমদের ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়৷ কারণ, সকল ইসলামি শহর একটি শহরের মতো৷ আর তখন প্রতিরোধের লক্ষ্যে যুদ্ধযাত্রা করা পিতা ও ঋণদাতার অনুমতি ব্যতীতই ওয়াজিব হয়ে যায়৷[13]

ইমাম ইবনু হাজম রহ. বলেন :

إلا أن ينزل العدو بقوم من المسلمين ففرض على كل من يمكنه إعانتهم أن يقصدهم مغيثاً لهم

তবে যদি শত্রুরা মুসলমানদের কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করে বসে, তাহলে তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম এমন প্রত্যেকের ওপর ফরজ হয়ে যায় তাদের সাহায্যার্থে তাদের উদ্দেশে যুদ্ধযাত্রা করা৷[14]

ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. বলেন :

معلوم في اعتقاد جميع المسلمين أنه إذا خاف أهل الثغور من العدو، ولم تكن فيهم مقاومة فخافوا على بلادهم وأنفسهم وذراريهم، أن الفرض على كافة الأمة أن ينفر إليهم من يكف عاديتهم عن المسلمين، وهذا لا خلاف فيه بين الأمة

সকল মুসলিমের সুদৃঢ় বিশ্বাসে এই ইলম রয়েছে যে, যখন সীমান্তবাসীরা শত্রুর আশঙ্কা করে এবং তাদের কাছে প্রতিরোধক্ষমতা না থাকার ফলে তারা নিজেদের প্রাণ, সন্তান এবং শহর নিয়ে শঙ্কাবোধ করে তখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরজ হয়ে যায় শত্রু অভিমুখে যুদ্ধযাত্রা করে মুসলমানদের থেকে তাদের জুলুমকে প্রতিহত করা৷ এবং এ ব্যাপারে উম্মাহর কারও মাঝে কোনো দ্বিমত নেই৷[15]

এটাই হচ্ছে জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার মর্মকথা৷ (অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবে বেরিয়ে পড়তে হবে)৷ সুতরাং যদি তা শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোনো শর্ত থাকত—যেমন, খলিফা বিদ্যমান থাকা বা তার অনুমতি গ্রহণ করা—তাহলে শত্রুরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করার সময় কখনোই তা ফরজে আইন হতো না৷ অথচ উম্মাহর কোনো আলিমই এ কথার প্রবক্তা নয়৷[16] এ কারণেই ইমাম মাওয়ারদি রহ. বলেছেন :

فرض الجهاد على الكفاية يتولاه الإمام ما لم يتعين

ফরজে কেফায়া জিহাদ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন ইমাম—যাবত্‌ না তা ফরজে আইন হয়ে যায়৷ (অর্থাৎ ফরজে আইন হয়ে গেলে তা আর ইমামের একক দায়িত্ব নয়; বরং প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।)

৩. ফিকহের কিতাবসমূহে জিহাদ অধ্যায়ে জিহাদ ওয়াজিব হওয়ার শর্ত, জিহাদ কার ওপর ওয়াজিব হবে এবং কখন ওয়াজিব হবে ইত্যাদি সবকিছু লেখা রয়েছে; কিন্তু সেখানে খলিফা বা ঝাণ্ডা বিদ্যমান থাকার শর্তারোপ করা হয়নি৷ অথচ সহিহ হাদিসে এসেছে :

مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَشْتَرِطُونَ شُرُوطًا لَيْسَتْ فِي كِتَابِ اللَّهِ، مَنِ اشْتَرَطَ شَرْطًا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ فَلَيْسَ لَهُ، وَإِنِ اشْتَرَطَ مِائَةَ شَرْطٍ

লোকদের কী হলো যে, তারা আল্লাহর কিতাব-বহির্ভূত বিষয়সমূহকে শর্তারোপ করছে? যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব-বহির্ভূত কোনো বিষয়কে শর্তারোপ করবে, তা অকার্যকর হবে; যদিও সে শত শর্ত আরোপ করে৷[17]

শাইখ আবদুর রহমান বিন হাসান রহ. জিহাদের জন্য ইমাম প্রয়োজন—এই শর্তটির অসারতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন :

بأي كتاب أم بأي حجة أن الجهاد لا يجب إلا مع إمام متبع ؟ هذا من الفرية في الدين والعدول عن سبيل المؤمنين، والأدلة على بطلان هذا القول أشهر من أن تذكر، من ذلك عموم الأمر بالجهاد والترغيب فيه والوعيد في تركه

কোন কিতাব বা কোন দলিল দ্বারা এটা প্রমানিত হল যে, অনুসৃত ইমাম না থাকলে জিহাদ ওয়াজিব হয় না? এটা দীনের ব্যাপারে কুৎসা রটানো ও মুসলমানদের পথ পরিহারের নামান্তর৷ এ বক্তব্যটির অসারতা প্রমাণিত করার জন্যে দলিলের অপেক্ষা রাখে না৷ তন্মধ্যে একটি হলো, জিহাদের আদেশ ও উৎসাহমূলক আয়াত-হাদিসসমূহ এবং জিহাদ ত্যাগের নিষেধ ও হুঁশিয়ারিমূলক বাণীসমূহ ব্যাপক ও উল্লেখিত শর্ত থেকে মুক্ত৷[18] (আদ্ দুরারুস্ সুন্নিয়্যাহ: ৭/৯৭)

শাইখ সিদ্দিক হাসান খান রহ. জিহাদের ব্যাপারে বলেন :

هذه فريضة من فرائض الدين، أوجبها الله على عباده من المسلمين، من غير تقيد بزمان أو مكان أو شخص أو عدل أو جور

এটা দ্বীনের ফরজসমূহের মধ্য থেকে একটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা যা তাঁর মুসলমান বান্দাদের ওপর ফরজ করেছেন কোনো কাল, স্থান, ব্যক্তি, ইনসাফ বা জুলুমের সঙ্গে সীমাবদ্ধ করা ব্যতীত৷[19]

সুতরাং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে; চাই ইমাম বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক এবং চাই সেখানে ঝাণ্ডা বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক৷

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এবং ইবনুল কায়্যিম রহ.-সহ অনেক ইমাম এক্ষেত্রে আবু বাসির রা.-এর জিহাদ দ্বারা দলিল দিয়ে থাকেন।[20] আহকামুল মুজাহিদ বিন-নাফস গ্রন্থে লেখা হয়েছে :

وجه الدلالة: أن النبي – صلى الله عليه وسلم – لم ينكر على أبي بصير قتله للرجل، ولا أمر فيه بقود ولا دية (فتح الباري (5/439)) فدل على أنه ما فعله أبو بصير جائز

যেভাবে এটা প্রমাণ হলো—নবি ﷺ আবু বাসির রা.-এর মানবহত্যার ওপর কোনো আপত্তি করেননি এবং এ ব্যাপারে কিসাস বা দিয়াতের নির্দেশ জারি করেননি।[21] সুতরাং এটা প্রমাণ করল যে, আবু বাসির রা. যা করেছেন, তা জায়িয।

তার ঘটনাটি নিম্নরূপ :

(হুদাইবিয়া সন্ধি হওয়ার পর) আবু বাসির রা. নামক কুরাইশ গোত্রের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এলেন। মক্কার কুরাইশরা তাঁর তালাশে দুজন লোক পাঠাল। তারা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে বলল, আপনি আমাদের সাথে যে চুক্তি করেছেন, (তা পূর্ণ করুন)। তিনি তাকে ওই দুই ব্যাক্তির হাওয়ালা করে দিলেন। তাঁরা তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং যুল-হুলায়ফায় পৌঁছে অবতরণ করল আর তাদের সাথে যে খেজুর ছিল তা খেতে লাগল।

আবু বাসির রা. তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম, হে অমুক, তোমার তরবারিটি খুবই চমৎকার দেখছি। সে লোকটি তরবারিটি বের করে বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! এটি একটি উৎকৃষ্ট তরবারি। আমি একাধিক বার তা পরীক্ষা করেছি। আবু বাসির রা.  বললেন, তলোয়ারটি আমি দেখতে চাই। তা আমাকে দেখাও। তারপর লোকটি আবু বাসির রা.-কে তলোয়ারটি দিল। আবু বাসির রা. সেটি দ্বারা তাকে এমন আঘাত করলেন যে, তাতে সে মরে গেল। তার অপর সঙ্গী পালিয়ে মদিনায় এসে পৌঁছাল এবং দাঁড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে দেখে বললেন, এই লোকটি ভীতিজনক কিছু দেখে এসেছে।

ইতিমধ্যে লোকটি নবি ﷺ-এর কাছে পৌঁছে বলল, আল্লাহর কসম! আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে, আমিও নিহত হতাম। এমন সময় আবু বাসির রা.-ও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর নবি, আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাকে তার কাছে ফেরত দিয়েছেন; এ ব্যাপারে আল্লাহ আমাকে তাদের কবল থেকে নাজাত দিয়েছেন। নবি ﷺ বললেন, সর্বনাশ তার মা’র![22] সে তো যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনকারী। কেউ যদি তার সাথে থাকত![23] আবু বাসির রা. যখন এ কথা শুনলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে আবারও কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠাবেন।[24] তাই তিনি বেরিয়ে নদীর তীরে এসে পড়লেন।

বর্ণনাকারী বলেন, এ দিকে আবু জানদাল ইবনু সুহায়ল কাফিরদের কবল থেকে পালিয়ে এসে আবু বাসিরের সঙ্গে মিলিত হলেন। এরপর থেকে কুরাইশ গোত্রের যে-ই ইসলাম গ্রহণ করত, সে-ই আবু বাসিরের সঙ্গে এসে মিলিত হতো। এভাবে তাদের একটি দল হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তারা যখনই শুনতেন যে, কুরাইশদের কোনো বানিজ্য কাফিলা সিরিয়া যাবে, তখনই তারা তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন আর তাদের হত্যা করতেন ও তাদের মাল-সামান কেড়ে নিতেন। তখন কুরাইশরা নবি ﷺ-এর কাছে লোক পাঠাল। আল্লাহ ও আত্মীয়তার ওসিলা দিয়ে আবেদন করল যে, আপনি আবু বাসিরের কাছে এর থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ পাঠান। এখন থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কেউ এলে সে নিরাপদ থাকবে। (হুদাইবিয়া সন্ধির দাবি অনুসারে কুরাইশদের কাছে আর ফেরত পাঠাতে হবে না)।

তারপর নবি ﷺ তাদের কাছে নির্দেশ পাঠালেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা নিচের আয়াতসমূহ নাজিল করেন—

وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا (24) هُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْهَدْيَ مَعْكُوفًا أَنْ يَبْلُغَ مَحِلَّهُ وَلَوْلَا رِجَالٌ مُؤْمِنُونَ وَنِسَاءٌ مُؤْمِنَاتٌ لَمْ تَعْلَمُوهُمْ أَنْ تَطَئُوهُمْ فَتُصِيبَكُمْ مِنْهُمْ مَعَرَّةٌ بِغَيْرِ عِلْمٍ لِيُدْخِلَ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ لَوْ تَزَيَّلُوا لَعَذَّبْنَا الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا (25) إِذْ جَعَلَ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ فَأَنْزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوَى وَكَانُوا أَحَقَّ بِهَا وَأَهْلَهَا وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمً

আল্লাহই মক্কা উপত্যকায় তাদের হাতকে তোমাদের পর্যন্ত পৌঁছা হতে এবং তোমাদের হাতকে তাদের পর্যন্ত পৌঁছা হতে নিবৃত্ত রেখেছেন তাদের ওপর তোমাদের ক্ষমতা দান করার পর।[25] তোমরা যা কিছু করছিলে, আল্লাহ তা দেখছিলেন। এরাই তো তারা, যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তোমাদেরকে মসজিদে হারাম থেকে নিবৃত্ত করেছে এবং আবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো কুরবানির পশুগুলোকেও যথাস্থানে পৌঁছতে বাধা দিয়েছে। যদি (মক্কায়) কিছু মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী না থাকত, যাদের সম্পর্কে তোমরা জানো না যে, তোমরা তাদেরকে অজ্ঞাতসারে পিষে ফেলতে[26], ফলে তাদের কারণে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে (তবে আমি ওই কাফিরদের সাথে সন্ধির পরিবর্তে তোমাদেরকে যুদ্ধে লিপ্ত করতাম। কিন্তু আমি যুদ্ধ রোধ করেছি) এ জন্য যে, আল্লাহ যাকে চান নিজ রহমতের ভেতর দাখিল করেন।[27] (অবশ্য) সেই মুসলিমরা যদি সেখান থেকে সরে যেত, তবে আমি মক্কাবাসীদের মধ্যে যারা কাফির, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তি দিতাম। কাফিররা যখন তাদের অন্তরে অহমিকাকে স্থান দিলো—যা ছিল জাহিলি যুগের অহমিকা—তখন আল্লাহ নিজের পক্ষ হতে তাঁর রাসুল ও মুসলিমদের ওপর বর্ষণ করলেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে তাকওয়ার বিষয়ে স্থিত করে রাখলেন[28] আর তারা তো এরই বেশি হকদার ও এর উপযুক্ত ছিল। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।[29]

তাদের অহমিকা এই ছিল যে, তারা মুহাম্মদ ﷺ-কে আল্লাহর নবি বলে স্বীকার করেনি এবং মেনে নেয়নি; এ ছাড়াও বাইতুল্লাহ ও মুসলিমদের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।[30]

এই হাদিসে আমরা লক্ষ করলাম, আবু বাসির রা. ও তার সঙ্গীরা ইমাম বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার নির্দেশ, এমনকি বগতি ছাড়াই জিহাদ করেছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে অপরাধী হিসেবে দেখা তো দূরের কথা, উল্টো তার জিহাদের প্রতি মৌন সম্মতি জানিয়েছেন। আর হুদাইবিয়ার সন্ধি বাহ্যদৃষ্টিতে পরাজয় মনে হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা যে তাকে সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করেছিলেন, আবু বাসির রা.-এর এই সফলতার মাধ্যমে তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে সকলের চোখে ধরা দিলো। কাফিররা নিজেরাই তাদের বিছানো ফাঁদে আটকে গেল। বাধ্য হয়ে তারাই সন্ধির ধারা রহিত করার দাবি নিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সামনে হাজির হলো।

আবু বাসির রা. স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে যে সময়ে জিহাদ করেছিলেন, তখন তিনি রাসুল ﷺ-এর অধীনেও ছিলেন না এবং তিনি কোনো দারুল ইসলামেও বসবাসরত ছিলেন না, এমনকি তিনি নিজেও কোনো ইমাম ছিলেন না এবং তার সাথে কোন ঝাণ্ডাও ছিল না; বরং তিনি মুশরিকদের ওপর আক্রমণ করে তাদের সাথে লড়াই করে গনিমত আহরণ করতেন এবং তা দ্বারা স্বনির্ভরতা অর্জন করতেন৷ কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও রাসুল ﷺ তাকে মৌন সমর্থন দিয়েছেন ও তার প্রশংসা করেছেন৷

শাইখ আবদুর রহমান বিন হাসান রহ. এ  ঘটনা দ্বারা দলিল পেশ করে বলেন,

هل قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أخطأتم في قتال قريش؛ لأنكم لستم مع إمام؟ سبحان الله ما أعظم مضرة الجهل على أهله!

রাসুল ﷺ কি তাদেরকে বলেছেন যে, কুরাইশদের সাথে লড়াই করে তোমরা ভুল করেছ, কেননা তোমরা তো কোনো ইমামের সঙ্গে ছিলে না? আশ্চর্য, মূর্খতা মূর্খদের জন্য কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে![31]

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. আস-সিয়ারুল কাবির গ্রন্থে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেন :

أَنَّ رَجُلًا مِنْ أَشْجَعَ جَاءَ إلَى النَّبِيِّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ -، فَشَكَا إلَيْهِ الْحَاجَةَ فَقَالَ: اصْبِرْ، ثُمَّ ذَهَبَ فَأَصَابَ مِنْ الْعَدُوِّ غَنِيمَةً، وَأَتَى بِهَا النَّبِيَّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ -، فَطَيَّبَهَا لَهُ، فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى: {وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لا يَحْتَسِبُ} [الطلاق: 3-2] » الْآيَةُ.

আশজা গোত্রের জনৈক ব্যক্তি নবি ﷺ-এর কাছে এসে অভাবের অভিযোগ করে। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে বলেন, তুমি সবর করো। এরপর সে চলে গেল এবং শত্রুর ওপর আক্রমণ করে গনিমত লাভ করে তা নিয়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এল। রাসুলুল্লাহ ﷺ তার জন্য সেগুলোকে উত্তম বলে আখ্যা দিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ তৈরি করে দেন এবং তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক দান করেন, যা তার ধারণার বাইরে।’[32]

ইমাম সারাখসি রহ. এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেখেন :

فَهَذَا أَصْلُ عُلَمَائِنَا فِيمَا يُصِيبُهُ الْوَاحِدُ وَالْمَثْنَى مِنْ دَارِ الْحَرْبِ إذَا دَخَلُوا عَلَى وَجْهِ التَّلَصُّصِ، بِغَيْرِ إذْنِ الْإِمَامِ

এক-দুজন ব্যক্তি ইমামের অনুমতি ব্যতিরেকে গোপনে দারুল হারবে প্রবেশ করে যা কিছু অর্জন করে নিয়ে আসে, সে ক্ষেত্রে এটা হলো আমাদের আলিমগণের মূল দলিল।[33]

৪. জিহাদ কায়েম করা যেমন ওয়াজিব, ইমাম নিযুক্ত করাও তেমনই ওয়াজিব৷ তাই মুজাহিদদের জন্যে আবশ্যক হলো, পূর্ব থেকে সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় ইমাম না থাকলে নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে ইমাম বানিয়ে নেওয়া৷ কারণ, ইমাম বিদ্যমান থাকা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত নয়, বরং ইমামের বিদ্যমানতার জন্য (অর্থাৎ ইমাম ইমাম হিসেবে বাকি থাকার জন্য) জিহাদ কায়েম করা শর্ত৷ কারণ, ইমামের রাষ্ট্র পরিচালনা শুদ্ধ হওয়ার জন্য জিহাদ কায়েম করা শর্ত৷

সুতরাং সঠিক ফাতওয়া হলো, জিহাদ ছাড়া কোনো ইমাম থাকতে পারে না। এটা নয় যে, ইমাম ছাড়া কোনো জিহাদ থাকে না৷

শাইখ আবদুর রহমান বিন হাসান রহ. বলেছেন :

كل من قام بالجهاد في سبيل الله فقد أطاع الله، وأدى ما فرضه الله، ولا يكون الإمام إماماً إلا بالجهاد، لا أنه لا يكون جهاد إلا بإمام

যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করল, তারা সকলে আল্লাহর আনুগত্য করল ও আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি যা ফরজ করেছিলেন তা আদায় করল৷ আর কোনো ইমাম ইমাম থাকতে পারে না জিহাদ ছাড়া৷ এমন নয় যে, ইমাম ছাড়া কোনো জিহাদ থাকে না৷[34]

এটা তো সকলেরই জানা যে, ইমামের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণকে রক্ষা করা এবং শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করা৷ সুতরাং তিনি যদি জিহাদ ও জনগণকে রক্ষা করতে অক্ষম হন তাহলে তিনি খেলাফত পরিচালনার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যান৷ বরং তখন তার বিদ্যমান থাকা ও না-থাকা বরাবর হয়ে যায়৷ আর যদি তিনি মুসলমানদের প্রাণ, সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রু রক্ষায় অন্তরায় হয়ে যান, তাহলে তার বিদ্যমান থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো৷ উপরন্তু শরিয়তগতভাবে তখন তার খেলাফত বাতিল হয়ে যায়৷ কেননা তার খলিফা থাকার উদ্দেশ্য এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না৷ হাদিস শরিফে এসেছে,

إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ، يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ، وَيُتَّقَى بِهِ

ইমাম হচ্ছে ঢালস্বরূপ, যার অধীনে থেকে যুদ্ধ করা হয় এবং যার দ্বারা শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়৷[35]

তাই ইমাম নিযুক্ত করা ওয়াজিব—যাতে তিনি ঢাল ও প্রতিবন্ধক হয়ে জনগণকে রক্ষা করতে পারেন এবং জনগণ তার অধীনে থেকে লড়াই করতে পারে৷ পক্ষান্তরে তিনি যদি মুসলিমদের বদলে শত্রুদের ঢাল হন তাহলে তো তিনি জাগতিককভাবে মুসলমানদের ইমাম হিসেবে বাকি থাকলেও শরিয়তগতভাবে কিছুতেই ইমাম থাকতে পারেন না৷

আমির যদি ইমারাহ্‌র উপযুক্ত না হয়, তাহলে মুসলমানদের কী করণীয়—এক হাদিসে বিষয়টি সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়েছে :

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَرِيَّةً، فَسَلَّحْتُ رَجُلًا مِنْهُمْ سَيْفًا فَلَمَّا رَجَعْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَامَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَعَجَزْتُمْ إِذَا بَعَثْتُ رَجُلًا، فَلَمْ يَمْضِ لِأَمْرِي أَنْ تَجْعَلُوا مَكَانَهُ مَنْ يَمْضِي لِأَمْرِي»

উকবা ইবনু মালিক রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন। আমি তাদের একজন ব্যক্তিকে অস্ত্র হিসেবে একটি তরবারি দান করলাম। আমরা যখন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে ফিরে এলাম, রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে নিন্দা করে বললেন, আমি যখন কোনো ব্যক্তিকে পাঠালাম আর সে আমার নির্দেশ কার্যকর করল না, তখন তোমরা কি অক্ষম হয়ে গিয়েছিলে যে, তার স্থলে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে, যে আমার নির্দেশ কার্যকর করত।[36]

আল্লামা শাওকানি রহ. ওয়াবলুল গমাম গ্রন্থে লেখেন :

ملاك أمر الإمامة وأعظم شروطها وأجل أركانها، أن يكون قادراً على تأمين السبل وإنصاف المظلومين من الظالمين، ومتمكناً من الدفع عن المسلمين إذا دهمهم أمر يخافونه، كجيش كافر أو باغ، فإذا كان السلطان بهذه المثابة فهو السلطان الذي أوجب الله طاعته وحرم مخالفته، بل هذا الأمر هو الذي شرع الله له نصب الأئمة، وجعل ذلك من أعظم مهمات الدين

খেলাফতের  মূলভিত্তি, প্রধান শর্ত ও সবচে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জালিমের জুলুম থেকে বাঁচিয়ে মাজলুমের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং মুসলমানরা যদি কোন ভীতিকর অবস্থা— যেমন, কাফের বা বিদ্রোহী সেনাদল—এর সম্মুখীন হয় তাহলে তা প্রতিহত করতে সমর্থ হওয়া৷ যে শাসক এই অবস্থানে থাকে, মূলত তার ব্যাপারেই বর্ণিত হয়েছে যে, তার আনুগত্য ওয়াজিব এবং তার বিরুদ্ধাচরণ হারাম৷ বরং এ কাজগুলোর জন্যেই আল্লাহ তাআলা ইমাম নিযুক্ত করাকে বিধিবদ্ধ করেছেন এবং তাকে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলির অন্তর্ভুক্ত করেছেন৷[37]

আমিরের অনুপস্থিতিতে যে জিহাদ পরিচালনা করার জন্য মুজাহিদরা নিজেদের পক্ষ থেকেই আমির নির্ধারণ করে নিতে পারে, এর সবচে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো মুতা যুদ্ধের ঘটনা।

عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَعَى زَيْدًا، وَجَعْفَرًا، وَابْنَ رَوَاحَةَ لِلنَّاسِ قَبْلَ أَنْ يَأْتِيَهُمْ خَبَرُهُمْ، فَقَالَ: «أَخَذَ الرَّايَةَ زَيْدٌ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَ جَعْفَرٌ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَ ابْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيبَ» وَعَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ: «حَتَّى أَخَذَ الرَّايَةَ سَيْفٌ مِنْ سُيُوفِ اللَّهِ، حَتَّى فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ»

আনাস রা. থেকে বর্ণিত। নবি ﷺ-এর নিকট (মুতার) যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খবর এসে পৌঁছার পূর্বেই তিনি উপস্থিত মুসলমানদেরকে যায়দ, জাফর ও ইবনু রাওয়াহা রা.-এর শাহাদতের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যায়দ রা. পতাকা হাতে অগ্রসর হলে তাঁকে শহিদ করা হয়। তখন জাফর রা. পতাকা হাতে অগ্রসর হলো, তাকেও শহিদ করে ফেলা হয়। তারপর ইবনু রাওয়াহা রা. পতাকা হাতে নিল। এবার তাকেও শহিদ করে দেওয়া হল। এ সময়ে তার দু-চোখ থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হচ্ছিল। (তারপর তিনি বললেন,) অবশেষে সাইফুল্লাহদের মধ্যে এক সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি) হাতে পতাকা ধারণ করেছে। ফলত আল্লাহ তাদের ওপর (আমাদের) বিজয় দান করেছেন।[38]

আল্লাহ তাআলা সেই যুদ্ধে মুসলমানদেরকে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিপ্রাপ্ত মহান সেনাপতি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা.-এর হাতে মুসলমানদের বিজয় দান করেছিলেন। কিন্তু তাকে রাসুলুল্লাহ ﷺ আমির হিসেবে মনোনীত করে পাঠাননি। তিনি সর্বমোট তিনজনকে আমির বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাদের সবার শাহাদাতের পর মুসলমানরা সাবিত ইবনু আকরাম রা.-এর আহ্বানে নিজেরা পরামর্শক্রমে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা.-কে নিজেদের আমির হিসেবে মনোনীত করে নেন।

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ أَمَّرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي غَزْوَةِ مُوتَةَ زَيْدَ بْنَ حَارِثَةَ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ إِنْ قُتِلَ زَيْدٌ فَجَعْفَرٌ، وَإِنْ قُتِلَ جَعْفَرٌ فَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ ‏”‏‏.‏ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ كُنْتُ فِيهِمْ فِي تِلْكَ الْغَزْوَةِ فَالْتَمَسْنَا جَعْفَرَ بْنَ أَبِي طَالِبٍ، فَوَجَدْنَاهُ فِي الْقَتْلَى، وَوَجَدْنَا مَا فِي جَسَدِهِ بِضْعًا وَتِسْعِينَ مِنْ طَعْنَةٍ وَرَمْيَةٍ‏.‏

আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুতার যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ ﷺ যায়দ ইবনু হারিসা রা.-কে সেনাপতি নিযুক্ত করে বলেছিলেন, যদি যায়দ রা. শহিদ হয়ে যায় তাহলে জাফর ইবনু আবু তালিব রা. সেনাপতি হবে। যদি জাফর রা.-ও শহিদ হয়ে যায় তাহলে আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা রা. সেনাপতি হবে। আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা. বলেন, ওই যুদ্ধে তাদের সাথে আমিও ছিলাম। যুদ্ধ শেষে আমরা জাফর ইবনু আবু তালিব রা.-কে তালাশ করলে তাকে শহিদগণের মধ্যে পেলাম। তখন আমরা তার দেহে তরবারি ও বর্শার ৯০টিরও অধিক আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি।[39]

উপরিউক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ফাতহুল বারি গ্রন্থে লেখেন :

قال الطحاوي: هذا الأصل يؤخذ منه أن على المسلمين أن يقدموا رجلاً إذا غاب الإمام يقوم مقامة إلى أن يحضر .وكذا قال الخطابي وعنه البغوي.

ইমাম তহাবি রহ. বলেন, এই মূলনীতি থেকে উদ্ঘাটিত হয় যে, ইমাম যখন অনুপস্থিত থাকবেন, তখন মুসলমানদের ওপর অন্য কোনো ব্যক্তিকে অগ্রসর করা অপরিহার্য হবে, যে ইমামের স্থলাভিষিক্ত হবে—যতক্ষণ না ইমাম উপস্থিত হয়। ইমাম খাত্তাবি রহ.-ও অনুরূপ বলেছেন এবং তার সূত্রে বাগাবি রহ. এই কথা বর্ণনা করেছেন।

ইমাম নববি রহ. আল-মিনহাজ গ্রন্থে লেখেন :

يكره غزو بغير إذن الإمام أو نائبه .

ইমাম বা তার প্রতিনিধির অনুমতি ছাড়া যুদ্ধ করা অপছন্দনীয় হবে।

এর ব্যাখ্যায় আল্লামা শিরবিনি রহ. লেখেন :

استثنى البلقيني من الكراهة صوراً             

أحدهما: أن يفوت المقصود بذهابه للاستئذان .                            

ثانيهما: إذا عطل الإمام الغزو وأقبل وجنوده على أمور الدنيا كما يشاهد .

ثالثهما: إذا غلب على ظنه أنه لو استأذن لم يأذن له

আল্লামা বালকিনি রহ. অপছন্দনীয়তা থেকে কিছু ক্ষেত্রকে আলাদা করেছেন :

ক. অনুমতির জন্য যেতে হলে লক্ষ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে।

খ. ইমাম যখন জিহাদকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবে এবং তিনি ও তার সেনাবাহিনী পার্থিব বিষয়াদি নিয়ে মেতে থাকবে, যেমনটা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।

গ. যখন এই ধারণা প্রবল হবে যে, অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেবেন না।[40]

ইমাম জুওয়ায়নি রহ. গিয়াসুল উমাম গ্রন্থে লেখেন :

فإذا شغر الزمان عن الإمام وخلا عن سلطان ذي خبرة وكفاية ودراية فالأمور موكولة إلى العلماء فحق على الخلائق على اختلاف طبقاتهم أن يرجعوا إلى علمائهم ويصدروا في جميع قضايا الولايات عن رأيهم.

সময় যখন ইমামের উপস্থিতি থেকে শূন্য হবে এবং অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও জ্ঞানসম্পন্ন শাসক থেকে মুক্ত হবে তখন সব বিষয় আলিমদের দিকে ন্যস্ত হবে। সর্বস্তরের মানুষের ওপর অপরিহার্য হবে আলিমগণের কাছে প্রত্যাবর্তন করা এবং শাসনক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত জারি করা।

৫. মুসলমান ও তাদের শত্রুদের মাঝে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধকেই জিহাদ বলা হয়; তা আক্রমণাত্মক হোক কিংবা হোক প্রতিরক্ষামূলক৷

শাইখ আবদুর রহমান বিন হাসান রহ. বলেছেন :

كل من قام إزاء العدو وعاده واجتهد في دفعه فقد جاهد، ولا بد وكل طائفة تصادم عدو الله فلا بد أن يكون لها أئمة ترجع إلى أقوالهم وتدبيرهم، وأحق الناس بالإمامة من أقام الدين الأمثل فالأمثل، فإن تابعه الناس أدوا الواجب، وإن لم يتابعوه أثموا إثماً كبيراً بخذلانهم الإسلام، وأما القائم به كلما قلت أعوانه وأنصاره صار أعظم لأجره، كما دل على ذلك الكتاب والسنة والإجماع

যে ব্যক্তি শত্রুর মুখোমুখী দাঁড়াবে এবং তার প্রতিরোধে পূর্ণ প্রচেষ্টার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, নিঃসন্দেহে সে মুজাহিদ৷ আর যে দলই আল্লাহর শত্রুদের মোকাবিলা করবে, তাদের জন্য এমন কিছু নেতৃস্থানীয় লোকদের প্রয়োজন যাদের মন্তব্য ও পরিকল্পনাকে তারা পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করবে৷ আর লোকদের মধ্যে ইমাম হবার অধিকতর যোগ্য ওই ব্যক্তি, যে পরিপূর্ণভাবে শরীয়ত প্রতিষ্ঠা করতে পারবে৷ তারপর যে বেশি শ্রেষ্ঠতর, তারপর যে বেশি শ্রেষ্ঠতর৷ এরপর যদি লোকেরা তাকে মান্য করে, তাহলে তো তারা ওয়াজিব আদায় করে নিল। অন্যথায় তারা শক্ত গোনাহগার হবে ইসলামের এই মহান বিধানটি পরিত্যাগ করার কারণে৷ আর যারা এ গুরুদায়িত্ব সম্পাদন করবেন (অর্থাৎ তার সাহায্যকারী ও সহকারিবৃন্দ) তারা বিরাট সওয়াবের অংশীদার হবেন৷ কুরআন সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা এমনটিই প্রতিভাত হয়।[41]

মোটকথা, প্রকৃতপক্ষে জিহাদ হচ্ছে, আল্লাহর শত্রু ও আল্লাহর বন্ধুদের শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য শক্তি ব্যয় করা৷ আর কিতাল তথা রক্তক্ষয়ী লড়াই হচ্ছে তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রকার৷

সুতরাং যে-কেউই শত্রুর  সাথে আক্রমণাত্মক বা প্রতিরক্ষামূলক লড়াই করবে, সেই মুজাহিদ ও তার এ লড়াই জিহাদ বলে গণ্য হবে৷ এবং এ লড়াইয়ে যে-কেউই মারা যাবে, সে-ই শহিদ ও দুনিয়াতে তার সাথে শহিদেরই আচরণ করা হবে; চাই সে পুরুষ হোক বা নারী, বড় হোক বা ছোট, সুন্নি হোক বা বেদআতি, নেককার হোক বা বদকার৷

যেমন, হাফেজ ইবনু হাজার আসকালানি রাহিমাহুল্লাহ “শহিদের জানাযার নামাজ” অধ্যায়ে লেখেন :

قال الزين بن المنير: “والمراد بالشهيد قتيل المعركة – أي من المسلمين – في حرب الكفار” قال الحافظ : ولا فرق في ذلك بين المرأة والرجل صغيراً أو كبيراً حراً أو عبداً صالحاً أو غير صالح

যাইন ইবনুল মুনির রহ. বলেছেনে, ‘শহিদ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রণাঙ্গনের নিহত ব্যক্তি। অর্থাৎ কাফেরদের বিরুদ্ধে সংঘটি লড়াইয়ে মুসলমানদের (নিহত ব্যক্তি)৷’ এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-দাস, নেককার ও বদকারের মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই৷[42]

সুতরাং এ নিয়ে আলিমগণের মাঝে কোনো দ্বিমত নেই যে, যে মুসলমানই কাফিরদের সাথে সংঘটিত লড়াইয়ে মারা যাবে, দুনিয়ার বিচারে সে-ই শহিদ৷ এ জন্যই তারা এ নিয়ে মতবিরোধ করেছেন যে, তার জানাযার নামাজ কি পড়া হবে নাকি হবে না? তাকে কি গোসল দেওয়া হবে নাকি হবে না? অধিকাংশ ফকিহ এ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন যে, তাকে গোসলও দিতে হবে না এবং তার জানাযার নামাজও পড়া হবে না। তবে তারা তার শহিদ হওয়া বা না-হওয়া নিয়ে কোনো দ্বিমত করেননি৷ কেননা, তার গোসল ও নামাজ নিয়ে তাদের মতবিরোধের কারণ হলো, তারা সবাই এতে একমত যে, সে এমন শহিদ—শরিয়তে অন্যান্য মৃত মুসলমানদের তুলনায় যার আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ তবে এর অর্থ এটা নয় যে, তার জান্নাতে প্রবেশ করা ও আল্লাহর দরবারে তার শাহাদত কবুল হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলা হচ্ছে৷ কেননা, তা আল্লাহ তাআলা ছাড়া কেউ জানেন না৷

হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানি রহ. (لا يقال فلان شهيد) ‘অমুক শহিদ—এভাবে বলা যাবে না’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখেন :

أي على سبيل القطع بذلك إلا إن كان بالوحي…. وإن كان مع ذلك يعطى أحكام الشهداء في الأحكام الظاهرة، ولذلك أطبق السلف على تسمية المقتولين ببدر وأحد وغيرهما شهداء، والمراد بذلك الحكم الظاهر المبني على الظن الغالب

ওহির সূত্র ছাড়া কারো ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, অমুক শহিদ। যদিও-বা তা সত্ত্বেও বাহ্যিকভাবে তাদেরকে শহিদের হুকুম প্রদান করা হবে৷ এ কারণেই সালাফে সালেহিনগণ বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধের মৃতদেরকে শহিদ আখ্যাদানে একমত পোষণ করেছেন৷ এবং এ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রবল ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাহ্যিক হুকুম আরোপ করা।[43]

আর ফিতনার লড়াই হচ্ছে ওই লড়াই, যা মুসলমানদের মাঝে জাহিলি সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায় পক্ষবাতিত্ব বা দেশ ও রাজত্ব দখল ইত্যাদি অভিলাসের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়ে থাকে৷ এগুলোই হচ্ছে সেই ফিতনার লড়াই, যাতে অংশগ্রহণ করা হারাম; বরং এক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো, মুসলমানদের উভয় পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা৷ এতে যদি একদল ফিরে আসে তাহলে যে দল ফিরে আসবে না তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ওয়াজিব হবে, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে৷

আর কাফির শত্রু যখন কোনো মুসলিম ভূমিতে আক্রমণ করে বসে তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা কোনো ফিতনার লড়াই হতে পারে না৷ এমন কথা উম্মাহর বিগত আলিমগণের মধ্যে কেউই বলেননি৷ বরং ফিতনা তো হচ্ছে সে সময় লড়াই পরিত্যাগ করা এবং কাফির শত্রুদের প্রতিরোধ না করার মধ্যে৷ উপরন্তু সে সময় যুদ্ধ পরিত্যাগ করা আল্লাহর সাথে শিরিক করার পর সবচেয়ে বড় গুনাহ৷

ইমাম ইবনু হাজম রহ. বলেন :

ولا إثم بعد الكفر أعظم من إثم من نهى عن جهاد الكفار، وأمر بإسلام حريم المسلمين إليهم

যে ব্যক্তি কাফেরদের সাথে জিহাদ করতে নিষেধ করে এবং মুসলমানদের পবিত্র স্থানসমূহকে তাদের নিকট অর্পণ করার জন্যে আদেশ করে, কুফরের পর এই ব্যক্তির গোনাহের চেয়ে বড় আর কোন গোনাহ নেই৷[44]

এ ছাড়াও ওপরে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ.-এর ফাতওয়া বিবৃত হয়েছে—ইমান আনার পর মুসলিম ভূমি থেকে শত্রুদের প্রতিহত করার চেয়ে বড় আর কোনো ওয়াজিব নেই৷

৬. বিভিন্ন বর্ণনাসূত্রে রাসুল ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন :

منْ قُتِل دُونَ مالِهِ فهُو شَهيدٌ، ومنْ قُتلَ دُونَ دمِهِ فهُو شهيدٌ، وَمَنْ قُتِل دُونَ دِينِهِ فَهو شهيدٌ، ومنْ قُتِل دُونَ أهْلِهِ فهُو شهيدٌ

যে ব্যক্তি সম্পদ রক্ষায় মারা যাবে, সে শহিদ। যে ব্যক্তি প্রাণ রক্ষায় মারা যাবে, সে শহিদ। যে ব্যক্তি দীন রক্ষায় মারা যাবে, সে শহিদ। যে ব্যক্তি পরিবার রক্ষায় মারা যাবে, সে শহিদ৷[45]

আর এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, এ হাদিসটি সকলের ক্ষেত্রেই ব্যাপক৷ বরং এ হাদিসটি একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই এবং প্রতিটি মুসলমানের জন্যে বৈধ আছে যে, সে নিজের ইজ্জত-সম্মান, সম্পদ ও দীন প্রতিরক্ষার জন্যে লড়াই করবে—যদিও সে একা হয়। এমনকি আগ্রাসী ব্যক্তি যদি তার মতো একজন মুসলিমও হয় তবুও। এবং এক্ষেত্রে যদি সে মারা যায় তাহলে সে শহিদ হবে৷

আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন :

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَرَأَيْتَ إِنْ جَاءَ رَجُلٌ يُرِيدُ أَخْذَ مَالِي؟ قَالَ: «فَلَا تُعْطِهِ مَالَكَ» قَالَ: أَرَأَيْتَ إِنْ قَاتَلَنِي؟ قَالَ: «قَاتِلْهُ» قَالَ: أَرَأَيْتَ إِنْ قَتَلَنِي؟ قَالَ: «فَأَنْتَ شَهِيدٌ»، قَالَ: أَرَأَيْتَ إِنْ قَتَلْتُهُ؟ قَالَ: «هُوَ فِي النَّارِ»

জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, কোনো ব্যক্তি যদি আমার সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চায়, তবে এ ব্যাপারে আপনার কী অভিমত? তিনি বললেন, তুমি তাকে তোমার সম্পদ দেবে না। সে বলল, আচ্ছা, সে যদি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, তুমিও তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। সে বলল, আচ্ছা, সে যদি আমাকে হত্যা করে ফেলে? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, তাহলে তুমি একজন শহিদ। সে বলল, আচ্ছা, যদি আমি তাকে হত্যা করে ফেলি? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, তাহলে সে জাহান্নামে যাবে।[46]

সুতরাং যে ব্যক্তি জিহাদের জন্য ইমাম বিদ্যমান থাকা বা তার অনুমতি গ্রহণ করাকে শর্ত হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, সে তো এ হাদিসের নির্দেশনাকেই অকেজো করে দেয়৷ উপরন্তু সহিহ মুসলিম দ্বারা প্রমাণিত যে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. এ হাদিস দ্বারা মুসলিমের জন্য নিজেদের প্রাণ, সম্পদ ও ইজ্জত-সম্মানের প্রতিরক্ষায় লড়াই করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে দলিল প্রদান করেছেন৷ এমনকি আগ্রাসী ব্যক্তি যদি স্বয়ং খলিফা হয় তবুও৷ বাদশাহ যখন আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা.-এর জমি নিয়ে যেতে মনস্থ করে, তখন তিনি এই হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করে বাদশাহর সাথে লড়াই করার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন৷[47]

সুতরাং এ-জাতীয় লড়াইয়ে যেহেতু খলিফার অনুমতি গ্রহণ এবং ঝাণ্ডা বিদ্যমান থাকা শর্ত নয়, তাহলে কাফির শত্রু থেকে নিজের প্রাণ, সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, ভূমি ও দীন প্রতিরক্ষায় কী করে তা শর্ত হতে পারে? বরং নিঃসন্দেহে সেক্ষেত্রে এ হুকুম আরও ভালোভাবে প্রযোজ্য হবে৷ তখন সন্দেহাতীতভাবে ইমামের অনুমতি গ্রহণ এবং ঝাণ্ডা বিদ্যমান থাকা শর্ত থাকবে না৷

৭. সহিহ হাদিসের গ্রন্থাদিতে ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’-সংক্রান্ত হাদিসসমূহও এ বিষয়টিকে সুদৃঢ় করে। যেমন :

لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ، حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ

আমার উম্মাহর একটি দল সর্বদা হকের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকবে, যারা তাদের অসহযোগিতা করবে, তারা তাদের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না—যাবত্‌ না আল্লাহর নির্দেশ আসে এবং তারা সেই অবস্থায় থাকে৷[48]

সহিহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে :

لَا تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى أَمْرِ اللهِ، قَاهِرِينَ لِعَدُوِّهِمْ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ، حَتَّى تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ وَهُمْ عَلَى ذَلِكَ

আমার উম্মাহর একটি দল অব্যাহতভাবে আল্লাহর দীনের ওপর যুদ্ধ করবে। তারা তাদের শত্রুকে পরাস্ত করবে। যারা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না; যতক্ষণ না তাদের কাছে কিয়ামত আসে এবং তারা সেই অবস্থায় থাকে।[49]

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. তার সময়ে এর ব্যাখ্যা করেছিলেন, শামে জিহাদরত জামাআতই হাদিসে বর্ণিত সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত। আর শুধু ইবনু তাইমিয়া রহ.-ই নন; বরং তার অনেক পূর্বে সাহাবি আমিরুল মুমিনিন মুআবিয়া রা.-ও একই কথা বলে গেছেন।[50]

সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হাদিসে বর্ণিত সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো উম্মাহর অমিততেজা শার্দূল সম্মানিত মুজাহিদগণ৷

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহ.-এর নিকট সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন :

هم الذين يقاتلون الروم، كل من قاتل المشركين فهو على الحق

এরা হচ্ছে ওই সমস্ত লোক যারা রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে৷ যারাই মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তারা হকের ওপর রয়েছ৷[51]

এটা সবাই জানে যে, একটি দল জাতির কতিপয় লোকই হবে; পুরো জাতি হবে না। আর তাদের জিহাদ ও বিজয়ও সেক্ষেত্রে জাতি ও ইমাম ব্যতীতই হয়ে থাকবে৷ কারণ, ইমাম যদি তাদের সাথে থাকতই, তাহলে তো ইমামের অনুগামী হয়ে পুরো জাতিই তাদের সাথে থাকত৷ আর সেক্ষেত্রে তো জাতির তুলনায় এই দলটির আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য রইল না৷ সুতরাং উপরিউক্ত হাদিসটি ইঙ্গিতাকারে এ কথারই জানান দিচ্ছে যে, মুসলমানদের একটি দল এককভাবে মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারবে, যদিও বা পুরো জাতিই তাদেরকে পরিত্যাগ করে এবং ইমামও তাদেরকে সাহায্য না করে৷ আর যদি জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইমাম বিদ্যমান থাকা বা তার অনুমতি গ্রহণ করা শর্তই হতো, তাহলে হাদিসে বর্ণিত সেই দলটির জন্য জিহাদ করাও শুদ্ধ হতো না এবং আল্লাহ তাআলাও সমগ্র জাতিকে ছেড়ে তাদেরকে এই মহান শ্রেষ্ঠত্বে ভূষিত করতেন না৷

৮. কর্মভিত্তিক ইজমা উক্তিমূলক ইজমাকে আরও বেশি জোরদার করেছে৷ কেননা এ যুগে যেখানেই শত্রুরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করেছে, সেখানেই ইমাম অবিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের মোকাবিলা করে উম্মাহর প্রতিরক্ষা করেছে৷ যেমনটি ঘটেছে পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের অধীনে ইসলামী বিশ্বের পতনের পর এবং উসমানি সালতানাতের ধ্বংসের পর৷ তখন আলজেরিয়া লিবিয়া মিসর সিরিয়া ইরাক ও ভারতবর্ষসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর আলিম, ফকিহ ও মুজাহিদগণ তাদের ভূমি ও ইজ্জত-সম্মান রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন৷ এমনকি শত্রুদের বিরুদ্ধে যারা জিহাদ করছে, তাদের জিহাদ বৈধ হওয়ার ব্যাপারে ও তাদেরকে সাহায্য করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারেও আলিমগণ তখন ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন৷ অথচ তখন মুসলমানদের না ছিল কোনো সাধারণ খলিফা, না ছিল সে অঞ্চলগুলোর জন্যে কোনো বিশেষ আমির, আর না ছিল তাদের নিকট পর্যাপ্ত শক্তি; বরং এগুলো ছিল আবু বাসির রা. ও তার সঙ্গীদের মতো কেবলই একটি গোষ্ঠীকেন্দ্রীক যুদ্ধ, যা তারা চালিয়ে গিয়েছেন স্বদেশ স্বাধীন হওয়া ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের বেরিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত৷

সুতরাং যারা জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইমাম বা ঝাণ্ডা বিদ্যমান থাকাকে শর্ত করে থাকে, তারা বিদেশী ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত আলিম ও নেতৃস্থানীয় মুসলমানরা জিহাদ করেছেন এবং নারী, শিশু ও ভূমি রক্ষায় শত্রুদের সাথে লড়াই করে যত লক্ষ মুসলমান শহিদ হয়েছেন, তাদের সকলের জিহাদকে নাকচ করে দিচ্ছে৷

৯. জিহাদ এমন একটি ইবাদত, যার তত্ত্ব, মর্মার্থ ও তাৎপর্য বোধগম্য৷[52] জিহাদ ইসলামি শরিয়তে বিধিবদ্ধ করার উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানদের রক্ষা করা, তাদের শত্রুদের প্রতিহত করা, শত্রুরা আমাদের ওপর আক্রমণ করার পূর্বেই তাদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করা বা আক্রমণ করার পর তাদেরকে বিতাড়িত করা৷ সুতরাং তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব—এমন সকল পদ্ধতি বা উপায়ই অবলম্বন করা বৈধ; তা কোনো শান্তিপূর্ণ যুদ্ধ হোক বা হোক স্বশস্ত্র যুদ্ধ, তা প্রকাশ্য যুদ্ধ হোক বা হোক স্নায়ুযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধ এক কর্তৃপক্ষ ও ঝাণ্ডার অধীনে হোক বা তা ব্যতীত হোক৷ কেননা শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী এ ব্যাপারে ফকিহগণের কিতাবে কোনো শর্তারোপ করা হয়নি৷ বিশেষত প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের ক্ষেত্রে৷ বরং সামর্থ্যবান প্রতিটি ছোট-বড়, ধনী-গরীব পুরুষ-নারীর ওপর দায়িত্ব হলো সাধ্যমতো প্রতিরোধ গড়ে তোলা, এমনকি পাথর দিয়ে হলেও—যেমনটি ফকিহগণ বর্ণনা করেছেন৷

হাশিয়ায়ে বাইজুরিতে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে  :

أن يدخل الكفار بلدة من بلاد المسلمين أو ينزل قريباً منها، فالجهاد حينئذ فرض عين عليهم، فيلزم أهل ذلك البلد حتى الصبيان والنساء والعبيد والمدين ولو بلا إذن من الأولياء والأزواج، والسادة ورب المال، الدفع للكفار بما يمكن منهم ولو بضرب بأحجار ونحوها

যদি কাফিররা মুসলমানদের কোনো শহরে অনুপ্রবেশ করে বা শহরের কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করে, তাহলে তখন তাদের ওপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে সেই শহরবাসীদের জন্য, এমনকি তাদের নারী শিশু দাস ও ঋণগ্রস্তদের জন্যও জরুরি হয়ে পড়ে তাদের সাধ্যে আছে এমন সব উপকরণ দ্বারা কাফিরদের প্রতিহত করা। এমনকি পাথর দ্বারা হলেও তাদের জন্য তা করা উচিত।[53] যদিও বা তাদের স্বামী অভিভাবক মনিব ও ঋণদাতাগণ তাদেরকে অনুমতি না দেয়৷

একইভাবে জিহাদের জন্যে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ বা পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকা কিংবা বিজয়ের সম্ভাবনা থাকাও শর্ত নয়৷

খতিব আশ-শিরবিনি রহ. বলেন :

الحال الثاني من حال الكفار أن يدخلوا بلدة لنا فيلزم أهلها الدفع بالممكن منهم، ويكون الجهاد حينئذ فرض عين سواء أمكن تأهيلهم لقتال أم لم يمكن، ومن هو دون مسافة القصر من البلدة التي دخلها الكفار حكمه كأهلها، وإن كان في أهلها كفاية؛ لأنه كالحاضر معهم، فيجب على كل من ذكر حتى على فقير وولد ومدين ورقيق بلا إذن، ويلزم الذين على مسافة القصر المضي إليهم عند الحاجة بقدر الكفاية دفعا لهم، فيصير فرض عين في حق من قرب وفرض كفاية في حق من بعد

কাফিরদের দ্বিতীয় অবস্থা হলো, তারা আমাদের কোনো শহরে ঢুকে পড়বে৷ সেক্ষেত্রে শহরবাসীর ওপর আবশ্যক হলো তাদেরকে যথাসাধ্য প্রতিহত করা। আর জিহাদ তখন ফরজে আইন হয়ে যায়; যুদ্ধের জন্যে তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সম্ভাবপর হোক বা না হোক৷ আর যারা কাফিরদের অনুপ্রবেশকৃত শহর থেকে সফরসীমার মধ্যে অবস্থান করবে, শহরবাসীর মাঝে লড়াইয়ের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিধানও হবে শহরবাসীর বিধানের মতো৷ কেননা কাছাকাছি থাকার কারণে তারা যেন তাদের সাথে একই শহরে বসবাস করছে৷ তাই উল্লিখিত সকলের ওপর, এমনকি তাদের গরীব-অসহায়, সন্তান, ঋণগ্রস্ত ও দাসদের ওপরও অনুমতি গ্রহণ ছাড়াই জিহাদ করা ওয়াজিব হয়ে যাবে৷ আর যারা সফরসীমার বাইরে থাকে, তাদের জন্যে আবশ্যক হলো প্রয়োজনের সময় সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে রক্ষার জন্য তাদের নিকট গমন করা৷ সুতরাং নিকটবর্তীদের জন্যে তা ফরজে আইন হয়ে গেল এবং দূরবর্তীদের জন্য হয়ে গেল ফরজে কেফায়া৷[54]

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন :

قتال الدفع مثل أن يكون العدو كثيراً ولا طاقة للمسلمين به، لكن يخافون إن انصرفوا عن عدوهم عطف العدو على من يخلفون من المسلمين، فهنا صرَّح أصحابنا بأنه يجب أن يبذلوا مهجهم ومهج من يخاف عليهم في الدفع حتى يسلموا، ونظيره أن يهجم العدو على بلاد المسلمين وتكون المقاتلة أقل من النصف، فإن انصرفوا استولوا على الحريم، فهذا وأمثاله قتال دفع لا قتال طلب لا يجوز الانصراف فيه بحال

প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ—যেমন, কোনো জায়গায় শত্রুদের এত বেশি উপস্থিতি ঘটল যে, তাদের সাথে লড়াই করার মতো সামর্থ্য মুসলমানদের নেই; কিন্তু মুসলমানরা এই আশঙ্কাবোধ করছে যে, তারা শত্রুদের সাথে লড়াই করা থেকে বিরত থেকে চলে গেলে তাদের পেছনে রয়ে যাওয়া মুসলমানদেরকে শত্রুরা কাবু করে ফেলবে—এক্ষেত্রে আমাদের আলিমগণ স্পষ্ট ফাতওয়া দিয়েছেন যে, তখন তাদের কর্তব্য, তারা নিজেদের জীবন ও যাদের নিয়ে তারা আশঙ্কাবোধ করছে তাদের সকলের জীবন বাজি রেখে শত্রুরা আত্নসমর্পণ করার আগ পর্যন্ত লড়ে যাবে৷

উদাহরণস্বরূপ, শত্রুরা কোনো মুসলিম শহরে আক্রমণ করল। অপরদিকে দেখা গেল, মুসলমানদের যোদ্ধারা সংখ্যার বিবেচনায় তাদের তুলনায় অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্তু তখন অবস্থা এমন যে, যদি তারা লড়াই করা থেকে বিরত থাকে তাহলে শত্রুরা পবিত্র ভূমিকে জবরদখল করে নেবে। এমতাবস্থায় ও এ-জাতীয় সকল অবস্থায় যুদ্ধগুলো হবে প্রতিরক্ষামূলক; আক্রমণাত্মক নয়। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা কোনোক্রমেই জায়েয নয়।[55]

এ সবগুলো বিষয়েই উম্মাহর আলিম ও ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন৷ তাই প্রতিরক্ষামূলক জিহাদে মুসলমানদের শক্তি-সক্ষমতা এবং বিজয়ের সম্ভাবনা প্রবল থাকা বা না-থাকা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে কোনোপ্রকার ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না৷ বরং মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষায় নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জানা থাকা সত্ত্বেও শরীরে রক্তের শেষ বিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত আমরণ লড়ে যেতে হবে৷

ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন :

ولا أرى ضيقاً على الرجل أن يحمل على الجماعة حاسراً أو يبادر الرجل، وإن كان الأغلب أنه مقتول

আমি নিহত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তির জন্যে কোনো দলের ওপর খালি হাতে আক্রমণ করা বা আকস্মিকভাবে হামলা করার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখি না৷[56]

ইমাম শাফেয়ি রহ. এ ফাতওয়া দিয়েছেন আক্রমণাত্মক জিহাদের ব্যাপারে। সুতরাং স্পষ্ট যে, প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের ক্ষেত্রে তা আরও ভালোভাবে প্রযোজ্য হওয়ার দাবি রাখে৷

প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য এটাও শর্ত নয় যে, তা আল্লাহর দীনকে বুলন্দ করার জন্য সম্পাদন করতে হবে৷ তবে হ্যাঁ, জিহাদের সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট প্রকার সেটাই, যা হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত :

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ الرَّجُلُ: يُقَاتِلُ لِلْمَغْنَمِ، وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِلذِّكْرِ، وَالرَّجُلُ يُقَاتِلُ لِيُرَى مَكَانُهُ، فَمَنْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: «مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ العُلْيَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّه»

এক ব্যক্তি নবি ﷺ-এর নিকট এসে বলল, এক ব্যক্তি গনিমতের জন্য, এক ব্যক্তি প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য এবং এক ব্যক্তি বীরত্ব দেখানোর জন্য জিহাদে শরিক হলো। তাদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করল? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কলিমা বুলন্দ থাকার উদ্দেশে যুদ্ধ করল, সে-ই আল্লাহর পথে জিহাদ করল।’[57]

অপর বর্ণনায় হাদিসের শব্দগুলো এভাবে বিবৃত হয়েছে :

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا القِتَالُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ فَإِنَّ أَحَدَنَا يُقَاتِلُ غَضَبًا، وَيُقَاتِلُ حَمِيَّةً، فَرَفَعَ إِلَيْهِ رَأْسَهُ، قَالَ: وَمَا رَفَعَ إِلَيْهِ رَأْسَهُ إِلَّا أَنَّهُ كَانَ قَائِمًا، فَقَالَ: «مَنْ قَاتَلَ لِتَكُونَ كَلِمَةُ اللَّهِ هِيَ العُلْيَا، فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ»

এক ব্যক্তি নবি ﷺ-এর নিকট এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহর পথে যুদ্ধ কোনটি? কেননা আমাদের কেউ লড়াই করে রাগের বশবর্তী হয়ে, আবার কেউ লড়াই করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। তিনি তার দিকে মাথা তুলে তাকালেন। বর্ণনাকারী বলেন, তাঁর মাথা তোলার কারণ ছিল যে, প্রশ্নকারী ছিল দাঁড়ানো। তারপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর বাণী বিজয়ী করার জন্য যে যুদ্ধ করে তার লড়াই আল্লাহর পথে হয়।’[58]

হাদিসটি দ্বারা প্রকৃত মুজাহিদের পরিচয় ফুটে উঠেছে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, যার উদ্দেশ্য আল্লাহর কালিমা সমুন্নত করা না হয়ে অন্য কিছু হবে, তার জিহাদ শুদ্ধই হবে না। বরং তা শুদ্ধ হবে; কিন্তু নিয়তের পরিশুদ্ধি না থাকার কারণে যে কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা তার লাভ করার কথা ছিল, সে তা লাভ করতে সমর্থ হবে না। কারণ, যারা ইজ্জত-সম্মান, সম্পদ ও প্রাণ রক্ষার লড়াইয়ে মারা যাবে, হাদিসের ঘোষণানুযায়ী তারাও শহিদ হবে৷[59] সুতরাং প্রতিরক্ষামূলক জিহাদকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে একাকী বা দলবদ্ধভাবে প্রাণ, সম্পদ, সম্ভ্রম ও ভূমি প্রতিরক্ষার জন্য৷ বিভিন্ন শ্রেণির মুসলমানদের সহায়তা নিয়ে তা সম্পাদিত হয়। এমনকি দেশ রক্ষার্থে চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমদের সঙ্গে মিলেও এই প্রকারের যুদ্ধ সম্পাদিত হতে পারে।

একইভাবে কাফির শত্রুদের থেকে মুসলমানদের প্রাণ, সম্পদ, সম্ভ্রম ও ভূমি রক্ষায় অমুসলিম জনগণ ও অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ থেকেও সাহায্য গ্রহণ করা যাবে৷ রাসুল ﷺ-ও মদিনার ইহুদিদের সাথে চুক্তিবদ্ধ  হয়েছিলেন শত্রু কর্তৃক মদিনা আক্রমণকালে মদিনা প্রতিরক্ষার জন্যে৷ একইভাবে শাম ও ইরাকে অবস্থানকারী সাহাবিগণও শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালিত করার জন্য আরব খ্রিষ্টানদের থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রহ. তার সাথে বের হওয়া শামের নাগরিকদের নিয়ে তাতারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, অথচ সে সময় তাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার বেদআতি ছিল। এ ছাড়াও তিনি চুক্তিবদ্ধ ইহুদি-খ্রিষ্টান বন্দিদেরকে তাতারিদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন। তাতারিদের সাথে শান্তি আলোচনা করার পর তারা যখন শুধু মুসলমানদের মুক্তি দিতে চাচ্ছিল, তখন তিনি এতে সম্মত হননি। বাধ্য হয়ে তারা মুসলমানদের পাশাপাশি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম বন্দিদেরও মুক্ত করে দিয়েছিল।

মোটকথা, প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ শুদ্ধ হওয়ার জন্য কোনো কিছুই শর্ত নয়৷ ইমাম বিদ্যমান থাকাও শর্ত নয়, ঝাণ্ডা বিদ্যমান থাকাও শর্ত নয়, আল্লাহর দীন বুলন্দ করার ইচ্ছা করাও শর্ত নয়, কোনো আলিমের ফতোয়াও শর্ত নয়, কাতার এক হওয়াও শর্ত নয়, পর্যাপ্ত শক্তি থাকাও শর্ত নয়, বিজয়ের সম্ভাবনা থাকাও শর্ত নয়৷ তবে এর অর্থ এটা নয় যে, মুজাহিদদের জন্য এক কাতারে এক আমিরের অধীনে থেকে জিহাদ করা ওয়াজিব নয়। এটা ওয়াজিব বটে; কিন্তু তা জিহাদের শুদ্ধতার জন্য শর্ত নয়। তাই যেক্ষেত্রে অসম্ভব হবে, সেক্ষেত্রে এই অজুহাত দেখিয়ে কিছুতেই জিহাদ পরিত্যাগ করা যাবে না৷ বরং কিয়ামত পর্যন্ত অবিরল জিহাদ চলবে।[60]



[1] সুরা বাকারা : ১৯০

[2] সুরা তাওবা : ৪১

[3] সুনানু আবি দাউদ : ২৫০৪

[4] সুরা নিসা : ৮৪

[5] আল-মুহাল্লা : ৭/৩৫১

[6] আল-মুগনি : ১০/৩৬৪

[7] আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ : ৭/৯৮

[8] আল-মুগনি : ১০/৩৭৫

[9] সুরা ফাতহ : ২৪

[10] সেদপগপ মুসলিম : ১৮০৭

[11] আল-মুগনি : ১০/৩৯০

[12] আল-ফাতাওয়াল মিসরিয়্যাহ : ৪/৫০৮

[13] প্রাগুক্ত

[14] আল-মুহাল্লা : ৭/২৯২

[15] আহকামুল কুরআন : ৪/৩১২

[16] আল্লামা ইবনু আবেদিন শামি রহ. বলেন, ‘যদি শত্রুরা মুসলিমদের কোনো সীমান্তে আক্রমণ চালায়, তাহলে তার নিকটবর্তী যুদ্ধে সক্ষম মুসলিমদের ওপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। যদি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হয়, তাহলে আক্রান্ত এলাকা থেকে যারা দূরে অবস্থান করছে তাদের ওপর জিহাদ ফরজে কেফায়া। তবে শত্রুর নিকটে যারা রয়েছে তারা যদি শত্রুকে প্রতিরোধ করতে অপারগ হয়, অথবা অপারগ না হলেও অলসতাবশত জিহাদ ত্যাগ করে, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের ওপর নামাজ ও রোজার মতো জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়, যা ছেড়ে দেওয়া বৈধ নয়। এভাবে ক্রমানুসারে পূর্ব-পশ্চিমের সকল মুসলিমের ওপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়।’ (ফাতাওয়া শামি : ৩/২৩৮)

আল্লামা ইবনু নুজাইম রহ. বলেন, ‘এখানে উদ্দেশ্য হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট মুসলিম ভূখন্ডে (কাফিরদের) আক্রমণ হওয়া। তাহলেই সে দেশের সকল মানুষের ওপর (জিহাদ) ওয়াজিব হয়ে যাবে। যদি তারা যথেষ্ট না হয়, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের ওপর একই হুকুম বর্তাবে। যদি তাদের পার্শ্ববর্তী মুসলিমরাও যথেষ্ট না হয় অথবা অলসতাবশত অল্লাহর অবাধ্যতা করে, তাহলে তাদের পার্শ্ববর্তীদের ওপর এই হুকুম বর্তাবে। ক্রমানুসারে পূর্ব-পশ্চিমের সকল মুসলিমের ওপর এই ওয়াজিব ব্যাপকতা লাভ করবে।’ (আল-বাহরুর রায়েক : ১৩/২৮৯)

[17] সহিহ বুখারি : ২৭৩৫  

[18] আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ : ৭/৯৭

[19] আর-রওজাতুন নাদিয়্যাহ : ৩৩৩

[20] যাদুল মাআদ : ৩/৩০৯

[21] ফাতহুল বারি : ৫/৪৩৯

[22] আল্লামা শাওকানি রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন :

قَوْلُهُ: (وَيْلُ امِّهِ) بِضَمِّ اللَّامِ وَوَصْلِ الْهَمْزَةِ وَكَسْرِ الْمِيمِ الْمُشَدَّدَةِ: وَهِيَ كَلِمَةُ ذَمٍّ تَقُولُهَا الْعَرَبُ فِي الْمَدْحِ وَلَا يَقْصِدُونَ مَعْنَى مَا فِيهَا مِنْ الذَّمِّ

সর্বনাশ তার মা’র— বাক্যটি নিন্দার বাক্য, তবে আরবরা এটাকে প্রশংসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে এবং তারা এর মধ্যে যে নিন্দার ভাব রয়েছে তা উদ্দেশ্য নেয় না। আল্লামা আইনি রহ. বলেন :

وَهِي كلمة: أَصْلهَا دُعَاء عَلَيْهِ، وَاسْتعْمل هُنَا للتعجب من إقدامه فِي الْحَرْب، والإيقاد لنارها وَسُرْعَة النهوض لَهَا

এই বাক্যটি মূলত বদদুয়ার বাক্য। এখানে তা ব্যবহৃত হয়েছে বিস্ময় প্রকাশের জন্য। বিস্ময়ের কারণ হলো আবু বাসির রা.-এর যুদ্ধের ব্যাপারে অগ্রসরমানতা, যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলন করা এবং খুব দ্রুত এর জন্য উদ্যোগী হওয়া।

আল্লামা কাসতাল্লানি রহ.-সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও এর এই অর্থই করেছেন। যেমন, মোল্লা আলি কারি রহ. বলেন :

فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَيْلَ أُمِّهِ) : بِالنَّصْبِ عَلَى الْمَصْدَرِ وَفِي نُسْخَةٍ بِالرَّفْعِ عَلَى الِابْتِدَاءِ وَالْخَبَرُ مَحْذُوفٌ، وَمَعْنَاهُ الْحُزْنُ وَالْمَشَقَّةُ وَالْهَلَاكُ وَقَدْ يَرِدُ بِمَعْنَى التَّعَجُّبِ وَهُوَ الْمُرَادُ هُنَا عَلَى مَا فِي النِّهَايَةِ فَإِنَّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَعَجَّبَ مِنْ حُسْنِ نَهْضَتِهِ لِلْحَرْبِ وَجَوْدَةِ مُعَالَجَتِهِ لَهَا مَعَ مَا فِيهِ خُلَاصَةً مِنْ أَيْدِي الْعَدُوِّ

[23] এর ব্যাখ্যায় মোল্লা আলি কারি রহ. বলেন  :

(لَوْ كَانَ لَهُ) أَيْ: لِأَبِي بَصِيرٍ (أَحَدٌ) . أَيْ: صَاحِبٌ يَنْصُرُهُ وَيُعِينُهُ، وَقِيلَ مَعْنَاهُ لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ يعرفُهُ أَنَّهُ لَا يَرْجِعُ إِلَيَّ حَتَّى لَا أَرُدَّهُ إِلَيْهِمْ وَهَذَا أَنْسَبُ بِسِيَاقِ الْحَدِيثِ

যদি তার এমন কেউ থাকত, যে তাকে সাহায্য এবং সহযোগিতা করত! বলা হয়েছে, এর অর্থ হলো, যদি তার এমন কেউ থাকত, যে তাকে জানিয়ে দেবে, সে যেন আমার কাছে আর ফিরে না আসে—যাতে তাকে মক্কাবাসীর কাছে ফিরিয়ে দিতে না হয়। এই ব্যাখ্যাটিই হাদিসের পূর্বাপরের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।

[24] মোল্লা আলি কারি রহ. বলেন –

(عَرَفَ أَنَّهُ سَيَرُدُّهُ إِلَيْهِمْ) ، قَالَ الْقَاضِي: إِنَّمَا عَرَفَ ذَلِكَ مِنْ قَوْلِهِ: مِسْعَرَ حَرْبٍ لَوْ كَانَ مَعَهُ أَحَدٌ، فَإِنَّهُ شَعَرَ بِأَنَّهُ لَا يُؤْوِيهِ وَلَا يُعِينُهُ، وَإِنَّمَا خَلَاصُهُ عَنْهُمْ بِأَنْ يَسْتَظْهِرَ بِمَنْ يُعِينُهُ عَلَى مُحَارَبَتِهِمْ

আবু বাসির রা. বুঝতে পারলেন যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ তাকে আবারও কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠাবেন। তিনি এটা বুঝেছেন ‘সে তো যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিতকারী। যদি কেউ তাকে সাহায্য করত!’ কথা থেকে। কেননা, তিনি আঁচ করেছেন যে, রাসুল ﷺ তাকে আশ্রয় দেবেন না, সহযোগিতাও করবেন না। আর তার মুক্তির একমাত্র পথ হলো, তার সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নিয়ে মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।

উল্লেখ্য, এখানে সাহায্য করার দ্বারা যুদ্ধের আগুন উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য উদ্দেশ্য। সুতরাং আবু বাসির রা. মদিনার বাইরে গিয়ে কী উদ্যোগ নিতে পারেন, সে ব্যাপারে ছোট্ট একটি ইঙ্গিত এই কথার মধ্যে রয়েছে।

[25] হজরত উসমান রা. যখন মক্কায় গিয়ে কুরাইশদেরকে সন্ধির প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, তখন মক্কার কাফিররা একটি দূরভিসন্ধি এঁটেছিল। তারা গোপনে তাদের ৫০ জন লোককে এই মতলবে পাঠিয়েছিল যে, তারা গুপ্ত আক্রমণ চালিয়ে মহানবি ﷺ-কে শহিদ করে ফেলবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের সে দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। তিনি সে দলটিকে মুসলিমদের হাতে গ্রেফতার করিয়ে দেন। কুরাইশরা যখন তাদের গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার খবর শুনল, তারা হজরত উসমান রা. ও তার সঙ্গীদেরকে মক্কায় আটকে ফেলল। মুসলমানরা তখন সেই ৫০ জনকে হত্যা করলে পালটা জবাবে কুরাইশরাও উসমান রা. ও তার সঙ্গীদেরকে হত্যা করত। আর তার ফল হতো অনিবার্য যুদ্ধ।

সুতরাং আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের মনোভাবকে বন্দি হত্যা না করার অনুকূল করে দিলেন এবং তাদের হাতকে বন্দিদের হত্যা করা থেকে নিবৃত্ত রাখলেন। অথচ বন্দিরা তাদের আয়ত্তাধীন ছিল এবং মুসলিমরা তাদেরকে হত্যা করতে পরিপূর্ণ সক্ষম ছিল। অপরদিকে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করা হতে কুরাইশদের হাতকে আল্লাহ তাআলা এভাবে রুখে দিলেন যে, তিনি তাদের অন্তরে মুসলিমদের প্রতি ভীতি সঞ্চার করলেন। ফলে তারা যুদ্ধের পরিবর্তে সন্ধিতেই রাজি হয়ে গেল, অথচ তারা হজরত উসমান রা.-কে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে, তারা কিছুতেই সন্ধি করবে না।

[26] মুসলিমদের যে সকল হিত বিবেচনায় তখন যুদ্ধকে সমীচীন মনে করা হয়নি, আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে তার একটা বর্ণনা করেছেন। বলা হচ্ছে যে, তখন মক্কায় বহু মুসলিম অবস্থান করছিল। সবশেষে উসমান রা. ও তার সঙ্গীগণও সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ হলে তো পুরোপুরিভাবেই হতো এবং সেই ঘোরতর লড়াইয়ের ভেতর মক্কায় অবস্থিত মুসলিমদের খোদ মুসলিমদেরই হাতে তাদের অজ্ঞাতসারে কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারত, যদ্দরুণ পরবর্তীতে খোদ মুসলিমদেরই অনুশোচনা করতে হতো। মুসলিমদের যেন এহেন ক্ষতির শিকার হতে না হয় এবং সেই ক্ষতির জন্য পরবর্তীতে গ্লানিবোধ করতে না হয়, তাই আল্লাহ তাআলা যুদ্ধ রুখে দেন ও সন্ধি স্থাপিত করেন।

[27] আল্লাহ তাআলা মক্কার মুসলিমদের প্রতি রহমত করেন যে, তাদেরকে হতাহতের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করলেন আর মদিনার মুসলিমদের প্রতিও রহমত করেন যে, তাদের হাতকে দীনি ভাইদের রক্তে রঞ্চজিত হওয়া থেকে মুক্ত রাখলেন।

[28] ‘তাকওয়ার বিষয়’ ছিল এতাই যে, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল ﷺ-এর আনুগত্য করা হবে—আনুগত্যের বিষয়টি যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন। সাহাবিগণ তা-ই করেছিলেন।

[29] সুরা ফাতহ : ২৪-২৬

[30] সহিহ বুখারি : ২৭৩২

[31] আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ : ৭/৯৭

[32] সুরা তালাক : ২-৩; শারহুস সিয়ারিল কাবির : ৪/১২৬০-১২৬১

[33] প্রাগুক্ত।

[34] আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ : ৭/৯৭

[35] সহিহ মুসলিম : ১৮৪১; সুনানু আবি দাউদ : ২৭৫৭ 

[36] আল-মুসতাদরাক, ইমাম হাকিম : ২৫৩৯। ইমাম হাকিম রহ. বলেন,هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحٌ عَلَى شَرْطِ مُسْلِمٍ وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ । ইমাম জাহাবি রহ.-ও তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেননি।

[37] ইকলিলুল কারামাহ, সিদ্দিক হাসান খান : ১১৪-১১৫

[38] সহিহ বুখারি : ৪২৬২

[39] সহিহ বুখারি : ৪২৬১

[40] মুগনিল মুহতাজ : ৪/২২০

[41] আদ-দুরারুস সুন্নিয়্যাহ : ৭/৯৮

[42] ফাতহুল বারি : ৩/৩০৯

[43] ফাতহুল বারি : ৬/৯০

[44] আল-মুহাল্লা : ৭/৩০০

[45] সুনানুত তিরমিজি : ১৪২১; সুনানু আবি দাউদ : ৪৭৭২; সহিহ বুখারি : ২৪৮০; সহিহ মুসলিম : ১৪১

[46] সহিহ মুসলিম : ১৪০

[47] দ্রষ্টব্য—সহিহ মুসলিম : ১৪১। বর্ণনাটি নিম্নরূপ :

لَمَّا كَانَ بَيْنَ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو وَبَيْنَ عَنْبَسَةَ بْنِ أَبِي سُفْيَانَ مَا كَانَ تَيَسَّرُوا لِلْقِتَالِ، فَرَكِبَ خَالِدُ بْنُ الْعَاصِ إِلَى عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو فَوَعَظَهُ خَالِدٌ، فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ عَمْرٍو: أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ».

[48] সহিহ মুসলিম : ১৯২০; সহিহ বুখারি : ৭৩১১

[49] সহিহ মুসলিম : ১৯২৪, ১৯২৪, ১৫৬

[50] মুসনাদু আবি দাউদ তায়ালিসি গ্রন্থে (২/৬৮) বর্ণনা এসেছে :

عَنْ أَبِي عَبْدِ اللَّهِ الشَّامِيِّ، قَالَ: سَمِعْتُ مُعَاوِيَةَ، يَخْطُبُ وَهُوَ يَقُولُ: يَا أَهْلَ الشَّامِ حَدَّثَنِي الْأَنْصَارِيُّ يَعْنِي زَيْدَ بْنَ أَرْقَمَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ» وَإِنِّي أَرَاكُمُوهُمْ يَا أَهْلَ الشَّامِ

[51] মাসায়িলু ইবনি হানি : ২/১৯২

[52] الجهاد عبادة وفريضة معقولة المعنى، وليست حكما تعبدياً محضاً غير معقول معناه

[53] হাশিয়ায়ে বাইজুরি : ২/৪৯১

[54] আল-ইকনা : ২/৫১০

[55] আল-ফাতাওয়াল মিসরিয়্যাহ : ৪/৫০৯

[56] কিতাবুল উম্ম : ৪/১৭৮

[57] সহিহ বুখারি : ২৮১০

[58] সহিহ বুখারি : ১২৩

[59] সহিহ বুখারি : ২৪৮০; সহিহ মুসলিম : ১৪১; সুনানুত তিরমিজি : ১৪২১; সুনানু আবি দাউদ : ৪৭৭২

[60] শাইখ ড. হাকিম আল মুতাইরি, শাইখ ড. মুহাম্মাদ খাইর হাইকাল এবং শাইখ ড. ইয়াসির বারহামির ফাতওয়া অবলম্বনে রচিত।

Share This