প্রাচ্যের কবি ড. ইকবালের কবিতা রোমন্থন করে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিই, সাহস জোগাই :


তোমার আকাঙ্ক্ষা বিরাট হবে
এবং তুমি সামনের দিকে অগ্রসর হবে।
অগ্রসর হয়ে তুমি যদি পথের মধ্যে ঝড় পাও
তাহলে ঝড়ে বিতাড়িত হয়ে তুমি চলে যেয়ো না,
ঝড়ের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে ঝড়কে অতিক্রম করো।
যদি বিরাট প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে যাও
তবে ঝড় হয়ে প্রান্তরকে অতিক্রম করো।

অ্যায় রাহবারে ফারযানা,
রাস্তে মেঁ তেরে
গুলশান হ্যায় তো শবনম হো
সাহরা হ্যায় তো তুফান হো।

হে পথচারী পথিক
তোমার পথে যদি পুষ্পনিকুঞ্জ পড়ে
তবে বসন্তের মলয় হয়ে তার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করো।
আর যদি প্রান্তর পড়ে
তাহলে ঝড় হয়ে তার সঙ্গে সংগতি রক্ষা করো।


ছোট থাকলে কত সুবিধা। ফাইয়াজ কাঁদলে আমরা দৌড়ে যাই। ওকে কোলে তুলে নিই। কিন্তু আমরা দুঃখ পেলে কাঁদারও সুযোগ নেই, কারও কোলে চড়ারও বয়স নেই, সবক্ষেত্রে কারও থেকে সান্ত্বনার বাণীও প্রত্যাশা করার জো নেই। ছোট থাকলে যেকোনো শায়খের কাছে নিজেকে ওয়াকফ করে দেওয়া যায়। তার সান্নিধ্যে থেকে উপকৃত হওয়া যায়। তার তত্ত্বাবধানে থেকে জ্ঞান অর্জন করা যায়। বড় হয়ে গেলে সে সুযোগও থাকে না। চাইলেও কোনো শাইখের সান্নিধ্য অবলম্বন করে দিনমান কিতাব নিয়ে পড়ে থাকা যায় না। হাজারো দায়িত্ব ও ঝামেলা সর্বদা জড়িয়ে রাখে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়াতে হয় দিগ্বিদিকে। এখানে কোনো ফুরসত নেই। কোনো অবসর নেই। ঘরেও কাজ, বাইরেও কাজ। অফিসের কাজ, ফ্যামিলির কাজ, শখের কাজ, দায়িত্বের কাজ। শুধু কাজ আর কাজ।

সবাই যখন রাতে ঘুমায়, আমাদের তখন নির্ঘুম রাত কাটে পিসির সামনে কিবোর্ড চেপে। সবাই যখন স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করে বেড়ায় মনের সুখে, আমাদের তখন সময় কাটে সামনের গাড়ি ও পথের দু-ধারের ল্যাম্পপোস্ট দেখে। ভোরবেলা সবাই যখন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ব্যক্তিগত কিছু কাজ করে, আমাদের তখন থাকতে হয় কিতাব সামনে নিয়ে দরসের মসনদে। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজনের পর সবাই যখন একটু গল্পসল্প করে বা দেহটা এলিয়ে দেয় সুখশয্যায়, আমাদের তখন বসতে হয় জরুরি কোনো তাহকিক নিয়ে। আসরের পর বাচ্চারা যখন খেলার মাঠে ছুটে বেড়ায়, সাক্ষাৎকারীদের সঙ্গে কথার ছলে আমাদের বিকেল তখন কেটে যায় কোনো বদ্ধ রুমে।

মাসশেষে সবাই যখন ভাবে নিজেকে নিয়ে ও পরিবারকে নিয়ে, আমাদের তখন ভাবতে হয় আরও কয়েকশ তালিবুল ইলমের খোরপোষ নিয়ে। সবাই যখন ব্যস্ত নিজের ক্যারিয়ার গঠনে, আমাদের তখন প্ল্যান সাজাতে হয় অন্যের ক্যারিয়ার গড়া বা কোনো দীনি প্রোজেক্ট সম্পন্ন করা নিয়ে।

সাধারণভাবে এগুলো একজন আলিমের নিত্যদিনের চিত্র। একজন মুজাহিদের জীবনের চিত্র তো এরচেও অনেক জটিল, অনেক কঠিন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, মুজাহিদ বারুদের গন্ধে মিশকে আম্বরের সুঘ্রাণ পায়। আলিম কিতাব নিয়ে যাপিত বিনিদ্র রজনীতে ময়ূরসিংহাসনের সুখ পায়। দীর্ঘদিন অধ্যবসায়ের পর কোনো অমীমাংসিত বিষয়ের ইলমি সমাধান বের করার যে আনন্দ, সাম্রাজ্যবাদী রাজার রাজ্যজয় বা মর্তলোকের কোনো অপ্সরীর আবরণহীন বাহুবন্ধনেও সে আনন্দ খুঁজে পাওয়া দায়।

আবিদের ইবাদত, আলিমের ইলমচর্চা ও মুজাহিদের জিহাদের ব্যাপারেই কেবল এই উক্তি প্রযোজ্য : ‘আইনা আবনাউল মুলুকি মিন হাযিহিল লাযযাত!’ নগ্ন তরবারি হাতে ঘোড়ার পিঠে দুর্বার ছুটে চলা কিংবা প্রয়োজনীয় রেফারেন্সধর্মী গ্রন্থাদি নিয়ে কোনো পাহাড়ের গুহায় আসহাবে কাহফের মতো জীবন কাটিয়ে দেওয়া অথবা সিদ্দিকের মতো সার্বক্ষণিক ইবাদতে রত থাকা – এগুলোই তো কামিয়াব জীবনের উদাহরণ। তবে যা-ই করা হোক, বাধা আসবেই, প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। তখন নিজেকে নিজেই শোনাতে হবে সান্ত্বনার বাণী : ‘অবিচলতা হাজারো কারামত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’

Share This