অতীতের সেই যুগের কথা না হয় বাদই দিলাম, যখন বাঙালিরা প্রাণ রক্ষার্থে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। রোহিঙ্গারা বারবার প্রতারিত হয়েছে। তাদেরকে একের পর এক ধোঁকায় ফেলা হয়েছে। তারা যোগ্য নেতৃত্ব পায়নি। তাদের ভেতরেও চেতনা ছিল। তারাও গুরাবা ও সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। আরাকান আর্মি অমুসলিম হয়েও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধ্যমতো প্রতিশোধ নিচ্ছে। সেখানে কীভাবে ভাবা যায়, এই বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী কেউ রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার অভিপ্রায় লালন করেনি!

রোহিঙ্গারা ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মতো যথার্থভাবে আকিদার শিক্ষা পায়নি। তারা তাগুত চেনেনি। তাগুতের বাহিনীর সঙ্গে আল-বারা স্থাপন করতে পারেনি। যার কারণে তারা সময়ে সময়ে শত্রুকে ভেবেছে বন্ধু। তারা যাদেরকে মাসিহা, মুক্তিদাতা ও ত্রাতা মনে করেছে, দিনশেষে তারাই তাদের পায়ে কুড়াল চালিয়েছে। মহাজোট সরকার, বিএনপি ও জামাআতের ভক্ত ও আশিকানের অভাব নেই দেশে; কিন্তু তাদের খুব কম লোকই জানে, কীভাবে এসব জালিমরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গাদ্দারি করেছে। তাদের বিপ্লবকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছে। কিন্তু আল্লাহ কখনো জালিমকে ক্ষমা করেন না। যেই লেফটেনেন্ট কর্নেল হাসিন সাহেব আরাকানিদের ওপর অবর্ণনীয় পীড়ন চালিয়েছিল। সময়ের আবর্তন সেই জালিম ও মাজলুমকে একই সেলে একত্র করেছে। জীবন তাদেরকে চরম শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। সেই বিএনপি ও জামাআতের নেতারাও বা আজ কোথায় আছে!

RSO এর কথা বলি কিংবা বলি ARIF এর কথা। RSO কা মতলব কিয়া, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। একসময় এ স্লোগানগুলো ঠিকই উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কালিমার প্রকৃত মর্ম তাদের শেখানো হয়নি। তাদের কনসেপ্ট ক্লিয়ার করা হয়নি। যার কারণে তাদের লড়াই মূলত শরিয়াহ কায়েমের জন্য ছিল না; তাদের লড়াই ছিল জুলুম প্রতিরোধের জন্য, রক্তের প্রতিশোধের জন্য এবং আরাকানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, সচেতন আরাকানিরা ভুলে যায়নি, দীর্ঘ ৪০০ বছর পর্যন্ত আরাকান ইসলামি রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু এ ইতিহাস ও ঐতিহ্য তাদের সবার অন্তরে রেখাপাত করতে পারেনি। মাওলানা সাইফুর রহমান RSO কে ইসলামি আঙ্গিকে সাজাতে চেয়েছিলেন। তার যতটুকু জ্ঞান ও বুঝ ছিল, তা তিনি ঠিকই প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু দলে ড. ইউনুসের মতো ক্ষমতালিপ্সু দুষ্ট লোক থাকলে এত সহজেই কি আর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা যায়! বেচারা মাওলানা সাহেবকে নামিয়ে নিজে RSO এর প্রেসিডেন্ট হয়েছিল কেবলই এই অজুহাতে যে, সে একজন ডক্টর হয়ে কীভাবে একজন মাওলানার অধীনে কাজ করবে! সে বিপ্লবীদেরকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ময়দানে ফেলে রেখে নিজের ছেলেদেরকে নিরাপদ জীবনের সন্ধানে, উচ্চশিক্ষা প্রদানের স্বপ্নে পাঠিয়ে দিয়েছে বিদেশে।

ARIF এর উত্থানও তো হয়েছে ইসলামের প্রতি অপছন্দনীয়তা থেকে। RSO এর ইসলামি ঢঙের দস্তুর আর মাওলানার নেতৃত্ব, কোনোটাই তাদের জন্য প্রীতিকর ছিল না। তারা কমান্ডারদের হাত করে, তাদেরকে দুনিয়ার লোভ দেখিয়ে RSO এর নেতাদেরকে বন্দুকের মুখে ক্যাম্পছাড়া করেছে। পরবর্তীতে OIC এর হস্তক্ষেপে ১২ জন নেতার মধ্যে ৯ জন ইসলামের পক্ষে থাকায় মূল RSO তাদেরই থেকে যায় আর ARIF নামে নতুন দল গঠন করে বামপন্থীরা। তারা মদ খেয়ে, গান গেয়ে, নৃত্য করে আর নারী নিয়ে ময়দান জয় করতে চেয়েছিল। বংশ পরিচয়ে মুসলমান হলেও তাদের মধ্যে আর বর্তমান আরাকান আর্মির মধ্যে খুব বেশি তফাৎ ছিল না। তারা মগদের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যয় না করে RSO কে বরবাদ করাদ জন্যই অধিক শক্তি ব্যয় করেছে। অবশেষে RSO কে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেরাই ধ্বংস হয়েছে।

রোহিঙ্গারা মুক্তি চায়। স্থায়ী সমাধান চায়। ইজ্জত ও সম্মানের জীবন চায়। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তারা এর কোনোটিই পায়নি। কিন্তু তাদের বিশ্বাস, আল্লাহ তাআলা অবশ্যই এমন কাউকে পাঠাবেন, যে তাদের ওয়ালি ও সাহায্যকারী হবে। আজও যদি মালয়েশিয়া প্রবাসী দাগাবাজ নেতা ড. ইউনুস এসে রোহিঙ্গাদেরকে সংগ্রামের দিকে ডাক দেয়, তাহলে হাজার হাজার যুবক তার এত এত দাগাবাজি দুচোখে দেখা সত্ত্বেও তার ডাকে সাড়া দেবে। আকিদার অপরিশুদ্ধি, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আর মোনাফেকি যদিও রোহিঙ্গাদের ব্যর্থতার মূল কারণ; এরপরও তাদের ভেতর এখনো লুকিয়ে আছে সমূহ সম্ভাবনা। আফসোসের কথা হলো, বৈশ্বিক কিতালপন্থীরা হাজারো ব্যস্ততার ভিড়ে অমুসলিমদের ভাষায়ই বর্তমান সময়ে সবচে মাজলুম জনপদ হিসেবে খ্যাত রোহিঙ্গাদের দিকে নজর দেওয়ার সময় পায়নি। তাদের জন্য যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়ানোর দরকার ছিল, সেভাবে কেউই বাড়ায়নি। উপরন্তু বিভিন্ন সময়ে অনেক হিকমাহর দোহাই দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে দলের নেতাকর্মীদের অনুৎসাহিত করা হয়েছে। এখানে কাউকে দোষারোপ করা উদ্দেশ্য নয়। উপরন্তু লেখাটা আত্মসমালোচনাও বটে। আর এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও অবশ্যই তাদের আছে। ইমারাহর নির্দেশের বাইরে তারা কাজ করতে চাননি। কিন্তু ইতিহাস হয়তো স্মরণ রাখবে, রোহিঙ্গারাই একমাত্র জাতি; যাদের দুর্দিনে পার্শ্ববর্তী কিতালপন্থীরাও তাদের ডুবুডুবু তরীর হাল ধরেনি।

এসব কিছুর পরও এটা মোটেও অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ পুনরায় তাদেরকে তাদের হারানো মর্যাদা ও গৌরব ফিরিয়ে দেবেন। অতীতের চার শতাব্দীর মতো পুনরায় আরাকান হবে ইসলামি ভূমি। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শরিয়াহ সেখানে কায়েম হবে। ইসলামি ইমারাহ আরাকানের বিজয়নিশান পতপত করে আকাশে উড়বে। আর সে সময় এ অঞ্চলের মুসলিমরা দাদা ও দিদিদের হাতে চরম মার খেয়ে আরাকান রাজার কাছে আশ্রয়প্রার্থী হবে। আচ্ছা, আমরা তাদের প্রতি যে বিরূপ ধারণা পোষণ করি ও তাদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ ও বাজে মন্তব্য করি, এগুলো কি তারা স্মরণ রাখবে? আশা করি, রাখবে না। তারা তাদের সঙ্গে কৃত মন্দ আচরণগুলো ভুলে গিয়ে মুসলিম ভাইদের বুকে আগলে নেবে। আগের মতো মুহাজিরদের খেদমতে নিজেদের নুসরত ব্যয় করবে।

Share This