করোনা মোটাদাগে কিছু পরিবর্তন এনে দিচ্ছে গোলার্ধজুড়ে। স্প্যানিশ ফ্লু’র সঙ্গে এর কিছুটা মিল পাওয়া যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে সেই ফ্লু’র প্রভাবে অস্ট্রিয়া ও জার্মানি নিজেদের শক্তিমত্তা হারিয়ে উত্থান ঘটেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের। এবারও করোনার থাবায় কারা অধিক আক্রান্ত—তা কিন্তু সবার চোখের সামনে। যুগের হোবল যারা, নব্য ক্রুসেডার যারা, ইউরোপ ও আমেরিকার বড় বড় ফিরআউনরূপী দেশ, পাশাপাশি হিংস্র চীন ও জিন্দিক ইরান—করোনার থাবায় এরাই অধিক পর্যুদস্ত হচ্ছে। নিরীহ সিরিয়ান শরণার্থী, অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মতো মাজলুম মুসলমানদেরকে আল্লাহ এখনো অনেক নিরাপদ রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বিশ্বের মুরব্বি দেশগুলোর নেতারা করোনাকালে বিশ্বকে মোটেই নেতৃত্ব দিতে পারেনি। তাদের তরফ থেকে এমন একটি বাক্যও পাওয়া যায়নি, যা বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করতে পারে। অপরদিকে আফগানি পাহাড়ি যোদ্ধাদের অবস্থা ও অবস্থান সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের তাগিদ দিচ্ছে ভবিষ্যৎকে। অতীত মহামারির ইতিহাসেও এমন দৃষ্টান্ত আছে—অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে বহু রাজত্ব নুয়ে পড়েছিল।
যুগের হোবল যুক্তরাষ্ট্রের ডাকে ইউরোপ যুগের পর যুগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডযুদ্ধে শরিক হয়েছে। অথচ ভাইরাস হানা দেওয়ামাত্র ওয়াশিংটন কোনো ধরনের মতবিনিময় ছাড়াই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাকি বিশ্বের জন্যও কোনো দায় বোধ করতে দেখা যায়নি দেশটির প্রেসিডেন্টকে। শুধু দেশই নয়; ব্যক্তিগত পর্যায়েও মানুষকে এমন স্বার্থপর ভূমিকায়ই দেখা গেছে। বস্তুবাদ ও মানসিক অসহায়ত্বই মানুষকে এমন আচরণ করিয়ে নেয়। অনেক বাড়িই করোনাকালে টিনের খাবার আর টিস্যু পেপারের ছোটখাটো গুদামঘরের রূপ নিয়েছে। এটা শুধু যে এই দেশে হয়েছে, এমন নয়; করোনাক্রান্ত অনেক দেশের চিত্র এমনই। শিগগিরই এই প্রবণতা কমবে না। কমার সুযোগ নেই। ‘সিস্টেম’ মানুষকে আশা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
করোনা অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের গলায়ও লাগাম টানতে যাচ্ছে হয়তো। আজ নয়া দিগন্ত পত্রিকার রিপোর্ট এসেছে : ‘ডলার সঙ্কটে আমদানি বিল শোধ করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রভাবে রেমিটেন্স আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে আসছে না রফতানি বিল। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহে ইতিমধ্যে টান ধরেছে ব্যাংকিং খাতে। যার ফলে আমদানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না বসায়ীরা। রফতানির বিপরীতে যে ব্যাক টু ব্যাক এলসি করা হয়, রফতানি আদেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায়ও পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকেই।’
এর আগে প্রথম আলোর এক নিবন্ধে এসেছিল : ‘ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে পণ্য না পাওয়ার অভিজ্ঞতা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক নাগরিকের জন্য জীবনে এই প্রথম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ এবং জরুরি অবস্থার মতো ঘটনা। বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। অর্থনৈতিক গোলকায়নের জন্য এ রকম অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে বিপর্যয়কর। বড় ধরনের মন্দার মুখে পড়েছে সমগ্র বিশ্ব। সব দেশেই ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রণোদনার জন্য মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। কেউ চাইছেন নগদ সহায়তা, কেউ কর মওকুফ। পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। রাষ্ট্রগুলো মদদ চাইছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কাছে। এত দিনকার ‘সিস্টেম’-এর ত্রুটির দিকে কেউই অঙ্গুলি নির্দেশ করতে চাইছে না। কেন কথিত মধ্যম আয়ের একটা দেশ তার প্রধান সরকারি হাসপাতালেও পর্যাপ্ত মাস্ক দিতে পারেনি, সে নিয়ে ইতিমধ্যে গভীর প্রশ্ন উঠছে। এটা একটা কাঠামোগত সংকটই বটে।’
করোনা জাতীয়তাবাদ নিয়েও অনেক প্রশ্ন রেখে যাবে। গোটা দুনিয়ায় এখন যে গ্লোবালাইজেশন ও বিশ্বায়নের কথা শোনা যায়, এই বিশ্বায়নের কেন্দ্রে ছিল বাণিজ্যিক স্বার্থ; রাজনৈতিক যৌথতা নয়। আলতাফ পারভেজ লেখেন : ‘করোনার সংক্রমণে রাষ্ট্রগুলো যেভাবে নিজ নিজ সীমান্ত নিয়ে সচেতন হয়ে গেল, তাতে স্পষ্ট, রাষ্ট্র উবে যাওয়ার প্রচারণা আর এগোবে না। খোদ ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ও এককভাবে এবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি; বরং ইউনিয়নভুক্তরা একে অপরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার চেষ্টায় ছিল কঠোরভাবে। ইতিমধ্যে এই প্রবণতাকে ‘করোনা-জাতীয়তাবাদ’ বলা শুরু হয়েছে। এর আরও গোছানো রূপ দেখতে শুরু করব আমরা শিগগিরই। করোনাকালে আশপাশের দেশ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিস ইউরোপীয় ঐক্যের ধারণাকে একটা ‘রূপকথা’ বলে অভিহিত করে শোরগোল তুলেছেন। ইতালিও এবারের দুর্যোগে ইইউ সদস্যদেশগুলো থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা পায়নি। এর একটা প্রতিক্রিয়া অনিবার্য ও আসন্ন। মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্বের কাঠামোগত ওলট–পালট ঘটতে চলেছে। যার ফলে আঞ্চলিক মেরুকরণ বাড়বে। যেসব দেশে ফেডারেল ব্যবস্থা ছিল, সেখানেও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বাড়ার তাগিদ তৈরি হবে। আন্তর্দেশীয় খোলামেলা সীমান্তগুলো আর আগের মতো থাকবে না। এসব প্রবণতা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধেই যায়।’
করোনা রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ার ইঙ্গিতও দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র শুধু বায়োমেট্রিক কলাকৌশলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; মানুষের হাত ধোয়ার মতো ব্যক্তিগত বিষয়ের দিকে পর্যন্ত নজর রাখবে ‘রাষ্ট্র’। চলাচল ও সমাবেশে স্বাধীনতার ধারণা আগের মতো আর শর্তহীন থাকবে না। মানুষের নিরাপত্তা এবং ‘নিরাপদ সমাজ’ গড়ার কথা বলেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বিশেষত তাগুতি রাষ্ট্রের জন্য যেসব বিষয় হুমকি, সেগুলোকে আরও শক্তহাতে দমন করা হবে। এতে গোলার্ধের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ‘সমাজ’-এর ভূমিকা এবং ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা’ হ্রাসের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
আশঙ্কা আছে, ইতিমধ্যে শক্তিশালী হয়ে থাকা ‘রাষ্ট্র’ আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে। চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসন মডেল করোনা প্রতিরোধে কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় উদারনৈতিক বা ইসলামি আকিদা ও মানহাজকেন্দ্রিক ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য সামনের সময়টা হবে কঠিন। রক্ষণশীল ও ফিকহবিরোধী নতুন অনেক আইনের মুখে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি। নিরেট ধর্মীয় বিষয়াদির ওপরও রাষ্ট্রের অবাধ কর্তৃত্ব জারি হবে। তখন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও কাঠামোগত পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালানো হবে। ধর্মীয় জমায়েতও নিয়ন্ত্রণ করবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। ‘গুজব’ ও ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী প্রচারণা নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে কত নির্যাতনের পথ সুগম হবে, আল্লাহই ভালো জানেন।
ইতিমধ্যে মসজিদের নিরীহ ইমামকে মুসল্লি সংখ্যা পাঁচজনের অধিক হওয়ার অমার্জনীয় অপরাধে (?) গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সেখানে তাকে কড়াভাবে শাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন তিনি গত মে মাসে লাগাতার দুই সপ্তাহব্যাপী কড়া বয়ান দিয়েছেন, কেন বয়ানে তাগুতের বিরুদ্ধে হুংকার ছুড়েছেন, এ জন্য তাকে উত্তম আদব শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাননীয়ার আনুগত্যের স্বীকারোক্তিও জোরপূর্বক আদায় করা হয়েছে। এ হয়রানিমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে মূলধারার আলিমদের নেতৃত্ব থেকে সরকারকে হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে, এমনও কিন্তু নয়। সামনে হয়তো ইমাম ও খতিবদের মুখে লাগাম লাগানোর চিন্তাও বাস্তবে রূপ দেওয়ার সাহস করতেও এদের খুব দ্বিধা হবে না। যদিও এটা আগে থেকেই চলে আসছে; সামনে হয়তো আরও কঠোর হস্তক্ষেপ প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
এখনই শ্রেষ্ঠ সময় হিজরতের