জ্ঞানী আর অভিজ্ঞ এক কথা নয়। আরবিতে একটা প্রবাদবাক্য রয়েছে :
سل المجرب، رلا تسأل الحكيم
অভিজ্ঞকে জিজ্ঞেস করো; প্রাজ্ঞকে জিজ্ঞেস করো না।
জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। যারা অভিজ্ঞ, তারা যে সমাধান দিতে পারবে; সাধারণ জ্ঞানীরা তা কখনোই পারবে না। হ্যাঁ, জ্ঞানের সঙ্গে যখন অভিজ্ঞতা মিশ্রিত হয়, তখন তা হয় এক অনন্যসাধারণ শক্তি। অজ্ঞতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার চাইতে জ্ঞানের সঙ্গে অভিজ্ঞতার মর্যাদা ঢের বেশি।
জ্ঞানের ভেতর এক ধরনের অহংকার থাকে; যদিও অজ্ঞতার অহংকার তারচেও বেশি। আল্লাহ যাকে সুরক্ষিত রাখেন, সে ছাড়া অন্যরা সেই অহংকারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে নিজেকেই তখন মনে হতে থাকে সবচে উপযুক্ত ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্তির যোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ মনে করেন, আপনার সাঁতার শেখা দরকার। আপনি এবার কার কাছে যাবেন? আপনার সামনে তিনটি অপশন আছে : (ক) একজন সাঁতার বিষয়ে লেখাপড়া করেছে, কিন্তু তার প্রাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা নেই। (খ) আরেকজনের সাঁতার বিষয়ক লেখাপড়ার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতাও আছে। (গ) তৃতীয় আরেকজনের লেখাপড়া নেই; কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। এবার এদের মধ্যে কাকে আপনি বেছে নেবেন?
মানহাজ নিয়ে যার পড়াশোনা আছে, সে হয়তো আপনার সামনে মানহাজ নিয়ে কিছু জ্ঞান বিতরণ করতে পারবে। যদিও আজকাল এ নিয়ে স্বতন্ত্র পড়াশোনা আছে, এমন ছেলেপেলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অধিকাংশই এসব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখে না। এক চিমটি অধ্যয়ন, দু-চিমটি বিক্ষিপ্ত আলোচনা শ্রবণ, তিন চিমটি উড়ো উড়ো কথা আর কয়েক টেবিল চামুচ ব্যক্তিগত অভিরুচি/ধারণার আলোকে আজকাল শুরু হয় মানহাজি তত্ত্ব কপচানোর ফেসবুকীয় দরস। কিন্তু এসব আত্মপ্রবঞ্চিত মানুষের কাছে আপনি উপস্থিত সমস্যার কার্যকর সমাধান পাবেন না। কারণ, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। সে এখনো রয়ে গেছে তত্ত্বের মধ্যে। তত্ত্বকে এখনো জীবনে আনতে পারেনি। সুতরাং তাকে শ্রদ্ধা করুন, ভালোবাসুন; কিন্তু তাকে নিজের জীবনতরীর নায়ে বানানোর বোকামি করতে যাবেন না। মিষ্টি মিষ্টি কথার ফাঁদে পড়ে তার হাতে জীবনের বৈঠা তুলে দেবেন না। অন্যথায় সে নিজে তো ডুববেই, আপনাকে সঙ্গে নিয়ে ডুববে।
ফেসবুকের বিভিন্ন অজ্ঞাত অনির্ভরযোগ্য প্রোফাইল থেকে যারা মানহাজ শেখে, তারা সাধারণত এ-জাতীয় অভিজ্ঞতাহীন জ্ঞানী/অর্ধজ্ঞানীদেরই মানহাজের মুখপাত্র ভেবে বসে। কিন্তু বাস্তবতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরূপ নয়। তারা হয়তো সর্বোচ্চ সমর্থক পর্যায়ের মানুষ। এরচে বেশি কিছু নয়। সুতরাং তাদের কোনো কিছুর দায়ভার মানহাজ বহন করবে না। তাদের যা কিছু ভালো ও মন্দ, সবই তাদের নিজস্ব। এর সবকিছুর দায় একান্ত তাদের।
আপনি যখন মানহাজ নিয়ে ঢালাও গালমন্দ করছেন, তখন একটু ভেবে দেখবেন, কার দোষ কার কাঁধে চাপাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মিডিয়া স্টারকে ভালোবাসে – এরকম কারও ব্যক্তিগত দোষত্রুটির দায় কি সেই মিডিয়া স্টারের কাঁধে চাপানো আদৌ সমীচীন? হ্যাঁ, মানহাজের ধারক বা মুখপাত্র কারও এমন আচরণ দেখলে সেক্ষেত্রে দোষ চাপানো যৌক্তিক। যদিও এক্ষেত্রে ইনসাফের দাবি হলো, অধিকাংশের অবস্থা দেখা। কারণ, কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সব জায়গায়ই থাকে। এ জন্য প্রথমে তাদের আচরণবিধি দেখা দরকার। এরপর সেই আচরণবিধির আলোকে পর্যালোচনা করা দরকার তাদের নেতাদের অবস্থা। তৃতীয় ধাপে অধিকাংশ অনুসারী ও কার্যত সহযোগীদের অবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে। এ সবকিছুর আগে তাদের সমর্থক বা অনুরক্ত কারও ব্যক্তিগত মন্দ আচরণের দায় তাদের কাঁধে চাপানো জুলুম বৈ কিছু নয়। আর সমর্থক ও অনুরক্তদের যেহেতু সোহবত নেই, কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, নেই স্পেসিফিক দিকনির্দেশনা; তাই তাদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা ও সীমালঙ্ঘন দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
শাইখ আওলাকি কিন্তু যথেষ্ট জ্ঞানী ছিলেন। এরপরও অনেকের প্রস্তাব উপস্থাপিত হওয়া সত্ত্বেও শাইখ আবু হামজা রহ. কিন্তু তাকে আমির হিসেবে মনোনীত করেননি। এই ঘটনার মধ্যে আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। বাস্তব ময়দানে বাস্তবিক অভিজ্ঞতার মূল্য সবচে বেশি। অভিজ্ঞতাশূন্য তত্ত্বের বুলি ইলমের ময়দানে চলতে পারে; সেখানে নয়। উপরন্তু ইলমের ময়দানেও তা চলে না। যে কারণে যে ব্যক্তি কোনো যোগ্য মুফতির তত্ত্বাবধানে কিছুকাল হলেও ফাতওয়া লেখার অনুশীলন করেনি; তার ফাতওয়ার ওপর কখনোই আস্থা ও নির্ভরতা রাখা যায় না এবং তা গ্রহণের উপযুক্ত হিসেবেও বিবেচিত হয় না। হ্যাঁ, এর অর্থ এটা নয় যে, কিছুকাল সোহবতে থেকে অনুশীলন করলেই সে বড় মুফতি হয়ে যাবে। বস্তুত এটা একটা পন্থা। দাতা তো প্রকৃতপক্ষে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা।
ইমাম শাফেয়ি রহ. তার জীবনের শেষ দুবছর কাটিয়েছেন মিশরে। সে সময় পূর্বের অনেক মত তিনি পরিবর্তন করেছেন। হানাফি মাজহাবের কোনো কোনো ইমামের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। আজকাল এসি রুমে বা ছাত্রবেষ্টিত দরসগাহে বসে যারা একরকম ফাতওয়া দিচ্ছেন, তাদেরকে ময়দানে নিয়ে গেলে এবং কিছুকাল তারা সেখানে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা অর্জন করলে অনেকের ফাতওয়ার ভাষ্যই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। কারণ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আলাদা। কল্পনা ও বাস্তবতাও এক নয়।