মুরতাদ ও জিন্দিকের মধ্যে যারা গুলিয়ে ফেলেন, তাদের জন্য এই হাদিসটি শিক্ষণীয় :

মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক রহ. বর্ণনা করেন :

كَانَ مُسَيْلِمَةُ كَتَبَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏.‏ قَالَ وَقَدْ حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ عَنْ شَيْخٍ مِنْ أَشْجَعَ يُقَالُ لَهُ سَعْدُ بْنُ طَارِقٍ عَنْ سَلَمَةَ بْنِ نُعَيْمِ بْنِ مَسْعُودٍ الأَشْجَعِيِّ عَنْ أَبِيهِ نُعَيْمٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لَهُمَا حِينَ قَرَآ كِتَابَ مُسَيْلِمَةَ ‏”‏ مَا تَقُولاَنِ أَنْتُمَا ‏”‏ قَالاَ نَقُولُ كَمَا قَالَ ‏.‏ قَالَ ‏”‏ أَمَا وَاللَّهِ لَوْلاَ أَنَّ الرُّسُلَ لاَ تُقْتَلُ لَضَرَبْتُ أَعْنَاقَكُمَا ‏”‏ ‏.‏

একদা রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে মুসাইলামা (ভণ্ডনবি) চিঠি লেখে। রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন তার চিঠি পড়েন, তখন তার উভয় দূতকে লক্ষ করে বলেন, এ লোক সম্পর্কে তোমরা কী বলো? তারা বলল, আমরা তা-ই বলি, যা তিনি বলেছেন। (অর্থাৎ তার নবুওয়াতের দাবি মানি)। নবি ﷺ বললেন, আল্লাহর শপথ, দূত হত্যা করা নিষিদ্ধ না হলে আমি তোমাদের উভয়ের গর্দান উড়িয়ে দিতাম। [সুনানু আবি দাউদ : ২৭৬১]


এখানে লক্ষণীয়, মুসায়লামার দুই দূত আগে মুসলিম ছিল, পরে মুরতাদ হয়েছে—এমন কোনো প্রমাণ নেই। তারা যে রাসুল ﷺ-এর পূর্বপরিচিত—তা-ও কিন্তু নয়। এতদ্‌সত্ত্বেও তার কথায় কেন প্রকাশ পেল যে, এরা হত্যাযোগ্য। এদের প্রাপ্য মৃত্যুদণ্ড। অর্থাৎ তারা মুবাহুদ দাম। তাদের রক্ত হালাল। এরপরও রাসুলুল্লাহ ﷺ তাদের রক্তপাত করেননি। কারণ, দূত হত্যা ইসলাম অনুমোদন করে না। মৌলিকভাবে তাদের রক্ত হালাল হওয়া সত্ত্বেও এই পারিপার্শ্বিক কারণে রাসুল ﷺ এই হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকলেন।

তারা মুরতাদ নয়, তাহলে তারা কী? যদি বলি, সাধারণ কাফির; তাহলে সাধারণ কাফির হলেই তাকে ধরে হত্যা করতে হবে কেন? কুরআনে এসেছে :


لا يَنْهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمْ يُقَٰتِلُوكُمْ فِى ٱلدِّينِ وَلَمْ يُخْرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمْ أَن تَبَرُّوهُمْ وَتُقْسِطُوٓا۟ إِلَيْهِمْۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلْمُقْسِطِينَ

দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন। [সুরা মুমতাহিনা : ৮]

এই দুই ব্যক্তি উপরিউক্ত কোনো গুণে গুণান্বিত নয়, যার কারণে তারা সাধারণ চুক্তিহীন কাফির হলেও তাদের একমাত্র প্রাপ্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হওয়ার কারণ নেই। তবু কেন এই কঠোরতা?

এর জবাব হচ্ছে, তারা ছিল মুলহিদ ও জিন্দিক। মুলহিদ ও জিন্দিক বলা হয় এমন ব্যক্তিকে, যে ইসলামের কোনো শাশ্বত অকাট্য বিধানের অপব্যাখ্যা করে বা এর অপব্যাখ্যায় বিশ্বাস করে; কিন্তু নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। যেমন, তারা ‘নবুওয়াত’ বা ‘খতমে নবুওয়াত’-এর আকিদার অপব্যাখ্যায় বিশ্বাসী ছিল; কিন্তু নিজেদেরকে মুসলিম বলত। আর জিন্দিকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। জিন্দিক গ্রেফতার হওয়ার আগে তওবা করলে তার তওবা গৃহীত হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে কোনো তওবার সুযোগও দেওয়া হয় না, স্বেচ্ছায় তওবা করলেও তা গ্রহণ করা যায় না। তার জন্য মৃত্যুদণ্ড অপরিহার্য হয়ে যায়। অর্থাৎ মুরতাদের চেয়েও তার শাস্তি কঠিন। কারণ, মুরতাদকে তিন দিনের অবকাশ দেওয়া হয়। তার সংশয় নিরসন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

মুরতাদ হওয়ার জন্য পূর্বে মুসলিম থাকা শর্ত; কিন্তু জিন্দিক হওয়ার জন্য এমন কোনো শর্ত নেই। যে ব্যক্তি আজন্ম ইলহাদ ও জানদাকার ওপর বেড়ে উঠেছে, সে-ও জিন্দিক। কিন্তু তাকে মুরতাদ বলার কোনো সুযোগ নেই।

খতমে নবুওয়াতের আকিদার ক্ষেত্রে যারা মুলহিদ ও জিন্দিক, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবিদের বিশ্বাস তা-ই ছিল, যা উপর্যুক্ত সহিহ হাদিসে বিবৃত হয়েছে। যেমন, হারিসা ইবনু মুদাররিব রহ. বর্ণনা করেন :

أَنَّهُ أَتَى عَبْدَ اللَّهِ فَقَالَ مَا بَيْنِي وَبَيْنَ أَحَدٍ مِنَ الْعَرَبِ حِنَةٌ وَإِنِّي مَرَرْتُ بِمَسْجِدٍ لِبَنِي حَنِيفَةَ فَإِذَا هُمْ يُؤْمِنُونَ بِمُسَيْلِمَةَ ‏.‏ فَأَرْسَلَ إِلَيْهِمْ عَبْدُ اللَّهِ فَجِيءَ بِهِمْ فَاسْتَتَابَهُمْ غَيْرَ ابْنِ النَّوَّاحَةِ قَالَ لَهُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ “‏ لَوْلاَ أَنَّكَ رَسُولٌ لَضَرَبْتُ عُنُقَكَ ‏”‏ ‏.‏ فَأَنْتَ الْيَوْمَ لَسْتَ بِرَسُولٍ فَأَمَرَ قَرَظَةَ بْنَ كَعْبٍ فَضَرَبَ عُنُقَهُ فِي السُّوقِ ثُمَّ قَالَ مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى ابْنِ النَّوَّاحَةِ قَتِيلاً بِالسُّوقِ ‏.‏

তিনি আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা.-এর কাছে এসে বললেন, আরববাসী কারও সাথেই আমার কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু আমি বনু হানিফার মসজ়িদে যাওয়ার সময় দেখলাম, এ গোত্রের লোকেরা (ভণ্ডনবি) মুসাইলামার প্রতি ইমান এনেছে। তখন আবদুল্লাহ রা. তাদেরকে ডেকে আনতে লোক পাঠালেন। সে তাদেরকে নিয়ে আসলে ইবনুন নাওয়াহা ব্যতীত সকলকে তিনি তওবা করতে বললেন। তিনি তাদের বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, তুমি দূত না হলে আমি তোমার গর্দান বিচ্ছিন্ন করে দিতাম। (আবদুল্লাহ রা. বলেন,) তুমি তো আজ দূত নও। তারপর তিনি তাকে হত্যা করতে কারাজা ইবনু কাবকে নির্দেশ দেন। তিনি তাকে বাজারে নিয়ে গিয়ে (জনসম্মুখে) হত্যা করেন। এরপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইবনুন নাওয়াহাকে দেখতে চায়, সে যেন বাজারে এসে তার লাশ দেখে যায়। [সুনানু আবি দাউদ : ২৭৬২]

হ্যাঁ, এই যুগে তথাকথিত কিছু জ্ঞানী তাদেরকে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের সমমর্যাদার মনে করে। অনেকে তো আবার আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে তাদেরকে জিম্মি বা মুআহিদ তথা চুক্তিবদ্ধ কাফির হিসেবে প্রচার করে এবং এ-সংক্রান্ত হাদিসগুলো তাদের ব্যাপারে প্রয়োগ করে। আল্লাহর লানত হোক মিথ্যাবাদী ও মিথ্যাচারীদের ওপর।

উল্লেখ্য, প্রশ্ন আসতে পারে, ইবনুন নওয়াহা ছাড়া বাকিদের তাওবা কেন করতে বললেন? তাদেরকেও হত্যা করতে বলেননি কেন? তাদেরকে তাওবা করার সুযোগ দিয়েছে কেন?

এর কারণ শুরুহুল হাদিসে এসেছে, তারা প্রকাশ্য কাফির ছিল। নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিত না। পক্ষান্তরে ইবনুন নাওয়াহা জিন্দিক ছিল। নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিত; কিন্তু আদতে জানদাকায় লিপ্ত ছিল।

Share This