প্রখ্যাত মিশরবিজয়ী সাহাবি আমর ইবনুল আস রা. যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত তখন তার ছেলে আবদুল্লাহ বলল, বাবা, আপনি আমার সামনে মৃত্যুর গুণ বর্ণনা করুন। কারণ, আপনিই সবচে যথার্থভাবে এর বিবরণ তুলে ধরতে পারবেন। তখন আমর ইবনুল আস রা. বললেন,

يا بني، والله كأن جبال الدنيا على صدري، وكأني أتنفس من ثقب الإبرة.

পুত্র আমার, আল্লাহর কসম করে বলছি, মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সব পর্বত যেন আমার বুকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আর আমি যেন সুঁইয়ের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।

আল্লাহ বলেন,

وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ

মৃত্যু যন্ত্রণা সত্যিই আসবে। হে মানুষ, এটাই সেই জিনিস, যা থেকে তুমি পালাতে চাইতে। [সুরা কাফ : ১৯]

উমর রা. মুখাজরাম কাব আহবার রহ.-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি আমার সামনে মৃত্যুর বিবরণ তুলে ধরো। তখন কাব বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন,

ما مثل الموت إلا كرجل ضرب بغصن من شوك من سدر أو طلح، فوقعت كل شوكة في عرق، فسحب الغصن فانسحب معها كل عرق في الجسم.

মৃত্যুর দৃষ্টান্ত তো হলো এমন ব্যক্তির মতো, যাকে কাঁটাদার কোনো গাছের কাঁটাযুক্ত ডাল দ্বারা প্রহার করা হয়েছে। তখন প্রতিটা কাঁটা রগের মধ্যে গেঁথে গেছে। এরপর যখন ডাল টেনে আনা হয়েছে, তখন এর সঙ্গে শরীরের প্রতিটা রগ বের হয়ে এসেছে।

আল্লাহ বলেন,

فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84) وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لَا تُبْصِرُونَ (85) فَلَوْلَا إِنْ كُنْتُمْ غَيْرَ مَدِينِينَ (86) تَرْجِعُونَهَا إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (87) فَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنَ الْمُقَرَّبِينَ (88) فَرَوْحٌ وَرَيْحَانٌ وَجَنَّتُ نَعِيمٍ (89) وَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ الْيَمِينِ (90) فَسَلَامٌ لَكَ مِنْ أَصْحَابِ الْيَمِينِ (91) وَأَمَّا إِنْ كَانَ مِنَ الْمُكَذِّبِينَ الضَّالِّينَ (92) فَنُزُلٌ مِنْ حَمِيمٍ (93) وَتَصْلِيَةُ جَحِيمٍ (94) إِنَّ هَذَا لَهُوَ حَقُّ الْيَقِينِ

এরপর এমন কেন হয় না যে, যখন (কারও) প্রাণ কণ্ঠাগত হয় এবং তোমরা বিমর্ষ মনে তার দিকে তাকিয়ে থাকো আর তোমাদের চেয়ে আমিই তার বেশি কাছে থাকি, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না; যদি তোমাদের হিসাব-নিকাশ হওয়ার না-ই থাকে, তাহলে তোমরা সেই প্রাণকে ফেরাও না কেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও! এরপর সে মৃত ব্যক্তি যদি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তার জন্য শুধু আরাম, সুরভি ও নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত রয়েছে। আর যদি হয় ডান হাতবিশিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত, তবে তাকে বলা হবে, তোমার জন্য রয়েছে শান্তি, যেহেতু তুমি ডান হাতবিশিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছ। আর যদি সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়, যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করত, তবে তার জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানির আপ্যায়ন আর জাহান্নামে প্রবেশ। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটাই যথার্থরূপে সুনিশ্চিত বিষয়। [সুরা ওয়াকিআ : ৮৩-৯৫]

হাসান বসরি রহ. বলতেন,

فضح الموت الدنيا، فلم يدع لذي لب فرحا.

মৃত্যু পৃথিবীকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। অনন্তর বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য আনন্দের কোনো বিষয় রাখেনি।

জনৈক সালাফ বলেন,

أعيا الأطباء علاج الموت.

মৃত্যুর চিকিৎসার ব্যাপারে সকল চিকিৎসক অপারগ হয়ে পড়েছে।

অন্য কেউ বলেন,

أتى العواد يعودون المرضى، فمات العواد ومات المعودون.

রোগী দেখতে কত মানুষই আসল। একসময় শুশ্রূষাকারীরাও মরে গেল, রোগীরাও পরপারে হারিয়ে গেল।

প্রখ্যাত বুজুর্গ রবি রহ.-এর জীবনীতে এসেছে, তার একবার রোগ হলো। জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা কি আপনার জন্য চিকিৎসক ডাকব না? তিনি বললেন,

فكرت وأردت أن أدعو طبيبا، فإذا بالطبيب والمطبوب يموتان.

আমি ভেবেচিন্তে একজন চিকিৎসক ডাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তখন হঠাৎ ভাবনায় আসল, চিকিৎসক ও রোগী সবাই-ই তো মারা যায়।

আদ জাতি ও সামুদ জাতির মধ্যেও তো চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল। কিন্তু মৃত্যু তো তাদের কাউকেই ছাড়েনি।

আবু বকর রা. যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত, তখন মানুষজন উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা, আমরা কি আপনার জন্য একজন চিকিৎসক ডাকব না? তিনি বললেন,

الطبيب قد رآني.
চিকিৎসক আমাকে দেখে গেছে।

তারা জিজ্ঞেস করল, কী বলে গেছে? তিনি বললেন,

إنه يقول: إني فعال لما أريد.
বলেছে, ‘আমি যা চাই, তা-ই করি’।


كيف أشكو لطبيبي ما بي + والذي أصابني من طبيبي.

চিকিৎসককে আর কোন রোগের কথা বলব আমি! আমাকে যে রোগ আক্রান্ত করেছে, তা তো আমার চিকিৎসকের পক্ষ থেকেই এসেছে।

আল্লাহ বলেন,

حَتَّى إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا وَهُمْ لَا يُفَرِّطُونَ (61) ثُمَّ رُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ أَلَا لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ

অবশেষে যখন তোমাদের কারও মৃত্যুকাল এসে পড়ে, তখন আমার প্রেরিত ফেরেশতা তার মৃত্যু ঘটায় এবং তারা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে না। এরপর তাদের সকলকে আসল প্রতিপালকের দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। স্মরণ রেখো, বিধান কেবল তারই চলে। তিনি সর্বাপেক্ষা দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। [সুরা আনআম : ৬১-৬২]

আল্লাহ আমাদের অবস্থা যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন,

لَقَدْ كُنْتَ فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنْكَ غِطَاءَكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيدٌ

প্রকৃতপক্ষে তুমি এ ব্যাপারে উদাসীন ছিলে। এখন আমি তোমার সম্মুখ থেকে পর্দা উন্মোচন করেছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর। [সুরা কাফ : ২২]

এ জন্যই রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন,

«أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ» يَعْنِي الْمَوْتَ

তোমরা সব স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে অত্যধিক পরিমাণ স্মরণ করো। [সুনানুত তিরমিজি : ২৩০৭]

মালিক ইবনু দিনার রহ. তার এক কবিতায় বলেন,

أتيتُ القـبورَ فناديتُها … أينَ المعظَّـم والمُحْتَقَـرْ
تَفانَوا جميعـاً فما مُخبـرٌ … وماتوا جميعاً وماتَ الخَبَـرْ
فيا سائلي عن أُناسٍ مَضَوْا … أما لَكَ فيما ترى مُعتَبَـرْ
تروحُ وتغدو بناتُ الثَّرى … فَتَمْحُوا محاسنَ تلك الصُّوَرْ

আমি কবরগুলোর কাছে এসে ডাক দিলাম, কোথায় মহান লোকেরা আর কোথায় তুচ্ছ ব্যক্তিরা? তারা সবাই কাফনের কাপড় পরিধান করেছে। এখন আর তাদের সংবাদদাতা কেউ নেই। তারা সকলে মৃত্যুবরণ করেছে আর তাদের খবরও মরে গেছে। অতীতে বিগত হওয়া মানুষ সম্পর্কে আমাকে প্রশ্নকারী ওহে, তুমি যা কিছু দেখছ, এতে তোমার জন্য শিক্ষণীয় কিছু কি নেই? মৃত্তিকার পোকামাকড় সকাল-সন্ধ্যা তাদের রূপের শোভা মুছে দিয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো যদি কেউ থাকত, তাহলে সুনিশ্চিতভাবে এর সবচে উপযুক্ত মুহাম্মাদ ﷺ-ই ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ বলেন,

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ

মুহাম্মাদ ﷺ তো একজন রাসুল ছাড়া কিছু নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসুল বিগত হয়েছে। তাঁর যদি মৃত্যু হয়ে যায় কিংবা তাঁকে হত্যা করে ফেলা হয়, তবে কি তোমরা উলটো দিকে ফিরে যাবে? যে-কেউ উলটো দিকে ফিরে যাবে, সে কখনোই আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ বান্দা, আল্লাহ তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। [সুরা আলে ইমরান : ১৪৪]

‘মুহাম্মাদ ﷺ তো একজন রাসুল ছাড়া কিছু নন’। অর্থাৎ রিসালাতের গুণে গুণান্বিত হওয়াই তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি মানবগুণের ঊর্ধ্বে নন এবং এমনও নন যে, তিনি আল্লাহ তাআলার গুণাবলির কিছু প্রাপ্ত হয়েছেন, ফলে তাকে মৃত্যু গ্রাস করবে না।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ এটাও ছিল যে, কাফিররা এই সংবাদ রটিয়ে দিয়েছিল, মুহাম্মাদ ﷺ-কে শহিদ করে দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছালে তাদের অনেকের মনোবল দমে যায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়ায়। ফলে এই আয়াতে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়, রাসুলুল্লাহ ﷺ একদিন না একদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। তারপরও মুসলমানদের দীনের ওপর অটল থাকতে হবে।

এতে আরও বোঝা যায়, সাময়িক বিপর্যয়ের সময় রাসুল ﷺ-এর আহত হওয়া এবং তার মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ার পেছনে যে রহস্য ছিল, তা হলো তাঁর জীবদ্দশাতেই তার মৃত্যু-পরবর্তী সাহাবায়ে-কেরামের সম্ভাব্য অবস্থার একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা; যাতে তাদের মধ্যে কোন ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে রাসুল সাঃ স্বয়ং তা সংশোধন করে দেন এবং পরে সত্যসত্যই যখন তার মৃত্যু হবে, তখন যেন তারা সম্বিত হারিয়ে না ফেলে। বাস্তবে তা-ই হয়েছে। রাসুল ﷺ-এর ওফাতের সময় যখন প্রধান প্রধান সাহাবিরাও শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন, তখন আবু বকর সিদ্দিক রা. এ আয়াত তেলাওয়াত করেই তাদের সান্ত্বনা দেন। [দেখুন—বুখারি : ১২৪১, ১২৪২, ৪৪৫৩, ৪৪৫৪]

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন,

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ
নিশ্চয়ই আপনিও মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। [সুরা জুমার : ৩০]

وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُونَ ۞ كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
আমি আপনার আগে কোনো মানুষের জন্য চিরদিন বেঁচে থাকার ফায়সালা করিনি। সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবী হয়ে থাকবে? জীবমাত্রকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি পরীক্ষা করার জন্য তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো অবস্থাসম্পন্ন করি এবং তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরিয়ে আনা হবে। [সুরা আম্বিয়া : ৩৪-৩৫]

এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ সুরা তুরে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

فَذَكِّرْ فَمَا أَنْتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَلَا مَجْنُونٍ ۞ أَمْ يَقُولُونَ شَاعِرٌ نَتَرَبَّصُ بِهِ رَيْبَ الْمَنُونِ ۞ قُلْ تَرَبَّصُوا فَإِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُتَرَبِّصِينَ
কাজেই আপনি উপদেশ দিতে থাকুন। আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে আপনিও গণকও নন, পাগলও নন; নাকি তারা বলে, ‘সে একজন কবি আর আমরা তার মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি’? আপনি বলুন, তোমরা প্রতীক্ষা করো, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষাকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকছি। (এরপর উভয় পক্ষই দেখতে পাবে, কার পরিণতি কী হয়।) [সুরা তুর : ২৯-৩১]

তারা চেয়েছিল, মুহাম্মাদ ﷺ-এর মৃত্যুতে আনন্দ উদযাপন করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বোক্ত আয়াতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মরণ সকলেরই হবে। যারা আনন্দ উদযাপন করার জন্য মুখিয়ে আছে, তারা নিজেরা কি মৃত্যু এড়াতে পারবে?

রাসুলুল্লাহ ﷺ শেষজীবনে মৃত্যুর ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছিলেন। সহিহ বুখারির এক হাদিসে এসেছে, আয়িশা রা. বর্ণনা করেন,

إِنَّا كُنَّا أَزْوَاجَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم عِنْدَهُ جَمِيعًا، لَمْ تُغَادَرْ مِنَّا وَاحِدَةٌ، فَأَقْبَلَتْ فَاطِمَةُ ـ عَلَيْهَا السَّلاَمُ ـ تَمْشِي، لاَ وَاللَّهِ مَا تَخْفَى مِشْيَتُهَا مِنْ مِشْيَةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا رَآهَا رَحَّبَ قَالَ ‏”‏ مَرْحَبًا بِابْنَتِي ‏”‏‏.‏ ثُمَّ أَجْلَسَهَا عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ، ثُمَّ سَارَّهَا فَبَكَتْ بُكَاءً شَدِيدًا، فَلَمَّا رَأَى حُزْنَهَا سَارَّهَا الثَّانِيَةَ إِذَا هِيَ تَضْحَكُ‏.‏ فَقُلْتُ لَهَا أَنَا مِنْ بَيْنِ نِسَائِهِ خَصَّكِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِالسِّرِّ مِنْ بَيْنِنَا، ثُمَّ أَنْتِ تَبْكِينَ، فَلَمَّا قَامَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سَأَلْتُهَا عَمَّا سَارَّكِ قَالَتْ مَا كُنْتُ لأُفْشِيَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سِرَّهُ‏.‏ فَلَمَّا تُوُفِّيَ قُلْتُ لَهَا عَزَمْتُ عَلَيْكِ بِمَا لِي عَلَيْكِ مِنَ الْحَقِّ لَمَّا أَخْبَرْتِنِي‏.‏ قَالَتْ أَمَّا الآنَ فَنَعَمْ‏.‏ فَأَخْبَرَتْنِي قَالَتْ أَمَّا حِينَ سَارَّنِي فِي الأَمْرِ الأَوَّلِ، فَإِنَّهُ أَخْبَرَنِي أَنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يُعَارِضُهُ بِالْقُرْآنِ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً ‏”‏ وَإِنَّهُ قَدْ عَارَضَنِي بِهِ الْعَامَ مَرَّتَيْنِ، وَلاَ أَرَى الأَجَلَ إِلاَّ قَدِ اقْتَرَبَ، فَاتَّقِي اللَّهَ وَاصْبِرِي، فَإِنِّي نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكَ ‏”‏‏.‏ قَالَتْ فَبَكَيْتُ بُكَائِي الَّذِي رَأَيْتِ، فَلَمَّا رَأَى جَزَعِي سَارَّنِي الثَّانِيَةَ قَالَ ‏”‏ يَا فَاطِمَةُ أَلاَ تَرْضَيْنَ أَنْ تَكُونِي سَيِّدَةَ نِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ ـ أَوْ ـ سَيِّدَةَ نِسَاءِ هَذِهِ الأُمَّةِ ‏”‏‏.

একবার আমরা নবি ﷺ-এর সব স্ত্রী তাঁর নিকট জমায়েত হয়েছিলাম। আমাদের একজনও অনুপস্থিত ছিলাম না। এমন সময় ফাতিমা রা. পায়ে হেঁটে আসছিলেন। আল্লাহর কসম, তাঁর হাঁটা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর হাঁটার মতোই ছিল। রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন তাকে দেখলেন, তখন তিনি ‘আমার মেয়ের আগমন শুভ হোক’ বলে সংবর্ধনা জানালেন। এরপর তাকে নিজের ডান পাশে অথবা (বর্ণনাকারী বলেন) বাম পাশে বসালেন। তখন তিনি তার সঙ্গে চুপিচুপি কিছু কথা বললেন, যা শুনে ফাতিমা রা. অত্যধিক কেঁদে ফেললেন। তাকে উদ্বিগ্ন দেখে রাসুলুল্লাহ ﷺ দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে চুপিচুপি আরও কিছু কথা বললেন। তখন ফাতিমা রা. হাসতে লাগলেন।
এ অবস্থা দেখে নবি ﷺ-এর স্ত্রীগণের মধ্য থেকে আমি বললাম, আমাদের উপস্থিতিতে রাসুলুল্লাহ ﷺ বিশেষ করে আপনার সঙ্গে কোনো গোপনীয় কথা কানে-কানে বললেন; এরপর আপনি কিনা কাঁদছেন!

তারপর যখন নবি ﷺ উঠে চলে গেলেন, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আপনাকে চুপিচুপি কী কথা বলেছেন? তিনি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাঃ-এর গোপনীয় কথা ফাঁস করব না। এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মৃত্যু হলো। তখন আমি তাকে বললাম, আপনার ওপর আমার যে দাবি আছে, আপনাকে এর কসম দিয়ে বলছি, আপনি কি গোপনীয় কথাটি আমাকে জানাবেন না? তখন ফাতিমা রা. বললেন, হ্যাঁ, এখন আপনাকে জানাব। সে সময় তিনি আমাকে জানাতে গিয়ে বললেন, প্রথমবার রাসুলুল্লাহ ﷺ আমার নিকট যে গোপন কথা বলেছেন, তা হলো, তিনি আমার নিকট বর্ণনা করেন, জিবরিল আ. প্রতিবছর একবার পূর্ণ কুরআন আমার নিকট পেশ করতেন। কিন্তু এ বছর তিনি এসে আমার কাছে দুবার তা পেশ করেছেন। এতে আমি ধারণা করছি, আমার চির বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং (মেয়ে আমার) তুমি আল্লাহকে ভয় করে চলবে এবং বিপদে ধৈর্যধারণ করবে। নিশ্চয়ই আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রগমনকারী। তখন আমি কাঁদলাম, যা নিজেই দেখলেন। তারপর যখন আমার উদ্বিগ্নতা দেখলেন, তখন দ্বিতীয়বার আমাকে চুপিচুপি বললেন, তুমি কি জান্নাতের মুসলিম নারীদের অথবা (বলেছেন) এ উম্মাহর নারীদের নেত্রী হওয়াতে সন্তুষ্ট হবে না? (আমি তখন হাসলাম)। [সহিহ বুখারি : ৬২৮৫, ৬২৮৬]

আবু সাইদ খুদরি রা. বর্ণনা করেন,

خَطَبَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم النَّاسَ وَقَالَ إِنَّ اللهَ خَيَّرَ عَبْدًا بَيْنَ الدُّنْيَا وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ فَاخْتَارَ ذَلِكَ الْعَبْدُ مَا عِنْدَ اللهِ قَالَ فَبَكَى أَبُوْ بَكْرٍ فَعَجِبْنَا لِبُكَائِهِ أَنْ يُخْبِرَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ عَبْدٍ خُيِّرَ فَكَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم هُوَ الْمُخَيَّرُ وَكَانَ أَبُوْ بَكْرٍ أَعْلَمَنَا فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ مِنْ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِيْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبَا بَكْرٍ وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيْلًا غَيْرَ رَبِّيْ لَاتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ وَلَكِنْ أُخُوَّةُ الْإِسْلَامِ وَمَوَدَّتُهُ لَا يَبْقَيَنَّ فِي الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلَّا سُدَّ إِلَّا بَابَ أَبِيْ بَكْرٍ

নবি ﷺ একদা সাহাবিদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিতে গিয়ে বললেন, আল্লাহ তার এক প্রিয় বান্দাকে পার্থিব জীবন এবং তাঁর নিকট রক্ষিত নিয়ামতসমূহ—এ দুয়ের মধ্যে যেকোন একটি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দান করেছেন আর সেই বান্দা আল্লাহর নিকট রক্ষিত নিয়ামতসমূহ বেছে নিয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আবু বকর রা. কাঁদতে লাগলেন। তার কান্না দেখে আমরা আশ্চর্যান্বিত হলাম। নবি ﷺ এক বান্দার খবর দিচ্ছেন, যাকে এভাবে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, (এতে কান্নার কী কারণ থাকতে পারে?) কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পারলাম, ওই বান্দা স্বয়ং আল্লাহর রাসুল ﷺ-ই ছিলেন আর আবু বকর রা. আমাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ছিলেন। নবি ﷺ বললেন, যে ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ দিয়ে, তার সঙ্গ দিয়ে আমার ওপর সর্বাধিক অনুগ্রহ করেছে সে ব্যক্তি হলো আবু বকর রা.। আমি যদি আমার রব ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তাহলে অবশ্যই আবু বকরকে গ্রহণ করতাম; তবে তার সঙ্গে আমার দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিক ভালোবাসা আছে। মসজিদের দিকে আবু বকরের দরজা ছাড়া অন্য কোনো দরজা খোলা রাখা যাবে না।

রাসুলুল্লাহ ﷺ মুয়াজ রা.-কে ইয়ামানের গভর্নর করে পাঠানোর সময় তাকে বলেছিলেন,

يا معاذُ إنَّك عسى ألَّا تلقاني بعدَ عامي هذا ولعلَّك أن تمُرَّ بمسجدي هذا وقبري فبكى معاذٌ جشعًا لفراقِ رسولِ اللهِ صلَّى اللَّهُ عليه وسلَّم ثُمَّ التفَتَ فأقبَل بوجهِه نحوَ المدينةِ فقال إنَّ أَوْلى النَّاسِ بي المتَّقونَ مَن كانوا وحيثُ كانوا

ইয়া মুয়াজ, এ বছরের পর তুমি হয়তো আর আমাকে পাবে না। তখন হয়তো তুমি আমার এই মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে। তখন মুয়াজ রা. রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বিচ্ছেদের কথা স্মরণ করে কেঁদে ফেললেন। তারপর রাসুলুল্লাহ ﷺ মুখ ঘুরিয়ে তার চেহারা মদিনা অভিমুখী করে বললেন, নিশ্চয়ই আমার সবচে ঘনিষ্ঠতম হলো মুত্তাকিরা, তারা যে-ই হোক আর যেখানেই তাদের বসবাস থাকুক। [মাজমাউয যাওয়ায়িদ : ২৪৯৭, হাদিসটি সহিহ]


মৃত্যু-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার মতো যদি কেউ থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ ﷺ-ই এর জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত ছিলেন। কিন্তু কেমন ছিল তাঁর অন্তিম অবস্থা? আয়িশা রা. বলেন,

لَمَّا ثَقُلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَاشْتَدَّ بِهِ وَجَعُهُ، اسْتَأْذَنَ أَزْوَاجَهُ فِي أَنْ يُمَرَّضَ فِي بَيْتِي، فَأَذِنَّ لَهُ، فَخَرَجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ رَجُلَيْنِ تَخُطُّ رِجْلاَهُ فِي الأَرْضِ بَيْنَ عَبَّاسٍ وَرَجُلٍ آخَرَ‏.‏ قَالَ عُبَيْدُ اللَّهِ فَأَخْبَرْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَبَّاسٍ فَقَالَ أَتَدْرِي مَنِ الرَّجُلُ الآخَرُ قُلْتُ لاَ‏.‏ قَالَ هُوَ عَلِيٌّ‏.‏ وَكَانَتْ عَائِشَةُ ـ رضى الله عنها ـ تُحَدِّثُ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ بَعْدَ مَا دَخَلَ بَيْتَهُ وَاشْتَدَّ وَجَعُهُ ‏ “‏ هَرِيقُوا عَلَىَّ مِنْ سَبْعِ قِرَبٍ، لَمْ تُحْلَلْ أَوْكِيَتُهُنَّ، لَعَلِّي أَعْهَدُ إِلَى النَّاسِ ‏”‏‏.‏ وَأُجْلِسَ فِي مِخْضَبٍ لِحَفْصَةَ زَوْجِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، ثُمَّ طَفِقْنَا نَصُبُّ عَلَيْهِ تِلْكَ حَتَّى طَفِقَ يُشِيرُ إِلَيْنَا أَنْ قَدْ فَعَلْتُنَّ، ثُمَّ خَرَجَ إِلَى النَّاسِ‏.

নবি সাঃ-এর অসুস্থতা বেড়ে গেলে তিনি আমার ঘরে শুশ্রূষার জন্য তাঁর স্ত্রীদের নিকট অনুমতি চাইলে তারা অনুমতি দিলেন। নবি সাঃ (আমার ঘরে আসার জন্য) দুব্যক্তির ওপর ভর করে বের হলেন। আর তাঁর পা দুখানি তখন মাটিতে চিহ্ন রেখে যাচ্ছিল। তিনি আব্বাস রা. ও অন্য এক ব্যক্তির মাঝখানে ছিলেন। উবায়দুল্লাহ রহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইব্‌নু আব্বাস রা.-কে এ কথা জানালাম। তিনি বললেন, সেই অন্য ব্যক্তিটি কে তা কি তুমি জানো? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তিনি হলেন আলি ইবনু আবি তালিব রা.। আয়িশা রা. বর্ণনা করেন, নবি সাঃ তার ঘরে আসলে অসুস্থতা আরও বৃদ্ধি পেল। তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার ওপর মুখের বাঁধন খোলা হয়নি এমন সাতটি মশকের পানি ঢেলে দাও, তাহলে হয়তো আমি মানুষকে কিছু উপদেশ দিতে পারব।’ তাঁকে তাঁর স্ত্রী হাফসা রা.-এর একটি বড় পাত্রে বসিয়ে দেওয়া হলো। তারপর আমরা তাঁর উপর সেই সাত মশক পানি ঢালতে লাগলাম। এভাবে ঢালার পর একসময় তিনি আমাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন, (এখন থামো)। তোমরা তোমাদের কাজ করেছ। তারপর তিনি বের হয়ে জনসম্মুখে গেলেন। [সহিহ বুখারি : ১৯৮]

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বর্ণনা করেন,

أَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِي مَرَضِه وَهُوَ يُوعَكُ وَعْكًا شَدِيدًا وَقُلْتُ إِنَّكَ لَتُوعَكُ وَعْكًا شَدِيدًا قُلْتُ إِنَّ ذَاكَ بِأَنَّ لَكَ أَجْرَيْنِ قَالَ أَجَلْ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيبُه أَذًى إِلاَّ حَاتَّ اللهُ عَنْه خَطَايَاه كَمَا تَحَاتُّ وَرَقُ الشَّجَرِ.

আমি নবি সাঃ-এর অসুস্থ অবস্থায় তাঁর কাছে গেলাম। এ সময় তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি বললাম, নিশ্চয়ই আপনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। আমি এ-ও বললাম, এটা নিশ্চয়ই এ জন্য যে, আপনার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ প্রতিদান। তিনি বললেন, হ্যাঁ। যে-কেউ রোগাক্রান্ত হয়, তার থেকে গুনাহসমূহ এভাবে ঝরে যায়, যেভাবে গাছ থেকে তার পাতাগুলো ঝরে যায়। [সহিহ বুখারি : ৫৬৪৭]

উবায়দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উতবা রহ. বর্ণনা করেন,

دَخَلْتُ عَلَى عَائِشَةَ فَقُلْتُ أَلاَ تُحَدِّثِينِي عَنْ مَرَضِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ بَلَى، ثَقُلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏”‏ أَصَلَّى النَّاسُ ‏”‏‏.‏ قُلْنَا لاَ، هُمْ يَنْتَظِرُونَكَ‏.‏ قَالَ ‏”‏ ضَعُوا لِي مَاءً فِي الْمِخْضَبِ ‏”‏‏.‏ قَالَتْ فَفَعَلْنَا فَاغْتَسَلَ فَذَهَبَ لِيَنُوءَ فَأُغْمِيَ عَلَيْهِ، ثُمَّ أَفَاقَ فَقَالَ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ أَصَلَّى النَّاسُ ‏”‏‏.‏ قُلْنَا لاَ، هُمْ يَنْتَظِرُونَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ‏.‏ قَالَ ‏”‏ ضَعُوا لِي مَاءً فِي الْمِخْضَبِ ‏”‏‏.‏ قَالَتْ فَقَعَدَ فَاغْتَسَلَ، ثُمَّ ذَهَبَ لِيَنُوءَ فَأُغْمِيَ عَلَيْهِ، ثُمَّ أَفَاقَ فَقَالَ ‏”‏ أَصَلَّى النَّاسُ ‏”‏‏.‏ قُلْنَا لاَ، هُمْ يَنْتَظِرُونَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ‏.‏ فَقَالَ ‏”‏ ضَعُوا لِي مَاءً فِي الْمِخْضَبِ ‏”‏، فَقَعَدَ فَاغْتَسَلَ، ثُمَّ ذَهَبَ لِيَنُوءَ فَأُغْمِيَ عَلَيْهِ، ثُمَّ أَفَاقَ فَقَالَ ‏”‏ أَصَلَّى النَّاسُ ‏”‏‏.‏ فَقُلْنَا لاَ، هُمْ يَنْتَظِرُونَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ـ وَالنَّاسُ عُكُوفٌ فِي الْمَسْجِدِ يَنْتَظِرُونَ النَّبِيَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ لِصَلاَةِ الْعِشَاءِ الآخِرَةِ ـ فَأَرْسَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِلَى أَبِي بَكْرٍ بِأَنْ يُصَلِّيَ بِالنَّاسِ، فَأَتَاهُ الرَّسُولُ فَقَالَ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَأْمُرُكَ أَنْ تُصَلِّيَ بِالنَّاسِ‏.‏ فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ ـ وَكَانَ رَجُلاً رَقِيقًا ـ يَا عُمَرُ صَلِّ بِالنَّاسِ‏.‏ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ أَنْتَ أَحَقُّ بِذَلِكَ‏.‏ فَصَلَّى أَبُو بَكْرٍ تِلْكَ الأَيَّامَ‏.‏

আমি আয়িশা রা.-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললাম, আল্লাহর রাসুল ﷺ-এর (অন্তিম কালের) অসুস্থতা সম্পর্কে কি আপনি আমাকে কিছু শোনাবেন? তিনি বললেন, অবশ্যই। নবি ﷺ মারাত্মকভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। আল্লাহর রাসুল ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, হে আল্লাহর রাসুল, তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি বললেন, আমার জন্য গোসলের পানি দাও। আয়িশা রা. বলেন, আমরা তা-ই করলাম। তিনি গোসল করলেন। তারপর একটু উঠতে চাইলেন; কিন্তু বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর একটু হুঁশ ফিরে পেলে আবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, হে আল্লাহর রাসুল। তাঁরা আপনার অপেক্ষায় আছেন। তিনি বললেন, আমার জন্য গোসলের পাত্রে পানি রাখো। আয়িশা রা. বলেন, আমরা তা-ই করলাম। তিনি গোসল করলেন। আবার উঠতে চাইলেন; কিন্তু বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর আবার হুঁশ ফিরে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, হে আল্লাহর রাসুল। তাঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বললেন, আমার জন্য গোসলের পাত্রে পানি রাখো। তারপর তিনি উঠে বসলেন এবং গোসল করলেন। এরপর উঠতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর আবার হুঁশ ফিরে পেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি সালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, হে আল্লাহর রাসুল। তারা আপনার জন্য অপেক্ষারত। ওদিকে সাহাবিরা ইশার সালাতের জন্য নবি ﷺ-এর অপেক্ষায় মাসজিদে বসে ছিলেন।

নবি ﷺ আবু বকর রা.-এর নিকট এ মর্মে লোক পাঠালেন যে, তিনি যেন লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করে নেন। সংবাদবাহক আবু বকর রা.-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন যে, আল্লাহর রাসুল ﷺ আপনাকে লোকদের নিয়ে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। আবু বকর রা. অত্যন্ত কোমল মনের লোক ছিলেন। তাই তিনি উমর রা.-কে বললেন, হে উমর, আপনি সাহাবিদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করে নিন। উমর রা. বললেন, আপনিই এর অধিক যোগ্য। তখন আবু বকর রা. সে কয়দিন সালাত আদায় করলেন। [সুনানুন নাসায়ি : ৮৩৪]

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বর্ণনা করেন,

كَشَفَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم السِّتْرَ وَرَأْسُهُ مَعْصُوبٌ فِي مَرَضِهِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ فَقَالَ ‏”‏ اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ ‏”‏ ‏.‏ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ‏”‏ إِنَّهُ لَمْ يَبْقَ مِنْ مُبَشِّرَاتِ النُّبُوَّةِ إِلاَّ الرُّؤْيَا يَرَاهَا الْعَبْدُ الصَّالِحُ أَوْ تُرَى لَهُ ‏”‏ ‏.

রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজ কক্ষের পর্দা সরিয়ে দিলেন। এ সময় তিনি মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। তাঁর মাথা (কাপড় দিয়ে) বাঁধা ছিল। তিনি বললেন, হে আল্লাহ, আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছি? এ কথা তিনি তিনবার বলেলেন। নবুওয়াতের সুসংবাদ (ধারা) আর অবশিষ্ট থাকবে না। তবে ভালো স্বপ্ন অবশিষ্ট থাকবে। নেক বান্দারা তা দেখবে অথবা তাদেরকে দেখানো হবে। [সহিহ মুসলিম : ২০৭]

আয়িশা রা. প্রায়ই বলতেন,

إِنَّ مِنْ نِعَمِ اللهِ عَلَيَّ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم تُوُفِّيَ فِيْ بَيْتِيْ وَفِيْ يَوْمِيْ وَبَيْنَ سَحْرِيْ وَنَحْرِيْ وَأَنَّ اللهَ جَمَعَ بَيْنَ رِيْقِيْ وَرِيْقِهِ عِنْدَ مَوْتِهِ دَخَلَ عَلَيَّ عَبْدُ الرَّحْمَنِ وَبِيَدِهِ السِّوَاكُ وَأَنَا مُسْنِدَةٌ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَرَأَيْتُهُ يَنْظُرُ إِلَيْهِ وَعَرَفْتُ أَنَّهُ يُحِبُّ السِّوَاكَ فَقُلْتُ آخُذُهُ لَكَ فَأَشَارَ بِرَأْسِهِ أَنْ نَعَمْ فَتَنَاوَلْتُهُ فَاشْتَدَّ عَلَيْهِ وَقُلْتُ أُلَيِّنُهُ لَكَ فَأَشَارَ بِرَأْسِهِ أَنْ نَعَمْ فَلَيَّنْتُهُ فَأَمَرَّهُ وَبَيْنَ يَدَيْهِ رَكْوَةٌ أَوْ عُلْبَةٌ يَشُكُّ عُمَرُ فِيْهَا مَاءٌ فَجَعَلَ يُدْخِلُ يَدَيْهِ فِي الْمَاءِ فَيَمْسَحُ بِهِمَا وَجْهَهُ يَقُوْلُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ثُمَّ نَصَبَ يَدَهُ فَجَعَلَ يَقُوْلُ فِي الرَّفِيْقِ الْأَعْلَى حَتَّى قُبِضَ وَمَالَتْ يَدُهُ

আমার প্রতি আল্লাহর নিয়ামত যে, আমার ঘরে, আমার পালার দিনে এবং আমার গলা ও সিনার মাঝে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তিকাল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাঁর ইন্তিকালের সময় আমার থুথু তাঁর থুথুর সঙ্গে মিশ্রিত করে দেন।
রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুর রহমান রা. আমার ঘরে প্রবেশ করে। তখন তার হাতে মিসওয়াক ছিল। আমি রাসুলুল্লাহ -কে (আমার বুকে) হেলান দেওয়া অবস্থায় রেখেছিলাম। আমি লক্ষ করলাম, রাসুলুল্লাহ ﷺ আবদুর রহমানের দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বুঝলাম, তিনি মিসওয়াক চাচ্ছেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি আপনার জন্য মিসওয়াক নেব? তিনি মাথা নাড়িয়ে জানালেন, হ্যাঁ। তখন আমি মিসওয়াকটি নিলাম। কিন্তু মিসওয়াক ছিল তাঁর জন্য শক্ত। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি এটি আপনার জন্য নরম করে দেবো? তখন তিনি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললেন। তখন আমি তা চিবিয়ে নরম করে দিলাম। এরপর তিনি ভালোভাবে মিসওয়াক করলেন। তাঁর সম্মুখে পাত্র অথবা পেয়ালা ছিল (বর্ণনাকারী ‘উমারের সন্দেহ); তাতে পানি ছিল। নবি ﷺ নিজের দু-হাত পানির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে তা দ্বারা তাঁর চেহারা মুছতে লাগলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। সত্যিই মৃত্যু-যন্ত্রণা কঠিন।’ তারপর দু-হাত ওপরের দিকে উঠিয়ে বলছিলেন, আমি সর্বোচ্চ বন্ধুর সঙ্গে (মিলিত হতে চাই)। এ অবস্থায় তাঁর ইন্তিকাল হলো আর হাত শিথিল হয়ে গেল। [সহিহ বুখারি : ৪৪৪৯]

আয়িশা রা. বর্ণনা করেন,

رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ بِالْمَوْتِ وَعِنْدَهُ قَدَحٌ فِيهِ مَاءٌ وَهُوَ يُدْخِلُ يَدَهُ فِي الْقَدَحِ ثُمَّ يَمْسَحُ وَجْهَهُ بِالْمَاءِ ثُمَّ يَقُولُ ‏”‏ اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى غَمَرَاتِ الْمَوْتِ ‏”‏ ‏.‏ أَوْ ‏”‏ سَكَرَاتِ الْمَوْتِ ‏”‏ ‏.
আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছি একটি পানিভর্তি বাটি তার সামনে রাখা ছিল। তিনি সেই বাটিতে তার হাত প্রবেশ করাচ্ছিলেন এবং পানি দিয়ে তার মুখমণ্ডল মুছছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমাকে সহায়তা করুন।’ [সুনানুত তিরমিজি : ৯৭৮]

তিনি আরও বর্ণনা করেন,

وَأَصْغَتْ إِلَيْهِ قَبْلَ أَنْ يَمُوْتَ وَهُوَ مُسْنِدٌ إِلَيَّ ظَهْرَهُ يَقُوْلُ اللهُمَّ اغْفِرْ لِيْ وَارْحَمْنِيْ وَأَلْحِقْنِيْ بِالرَّفِيْقِ.
নবি করিম ﷺ-এর ইন্তিকালের পূর্বে যখন তাঁর পিঠ আমার ওপর হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিল, তখন আমি কান ঝুঁকিয়ে দিয়ে নবি ﷺ-কে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার ওপর রহম করুন এবং সবচে মহান বন্ধুর সঙ্গে আমাকে মিলিত করুন। [সহিহ বুখারি : ৪৪৪০]

আয়িশা রা. বর্ণনা করেন,

كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ فِي مَرَضِهِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ : ” يَا عَائِشَةُ، مَا أَزَالُ أَجِدُ أَلَمَ الطَّعَامِ الَّذِي أَكَلْتُ بِخَيْبَرَ فَهَذَا أَوَانُ وَجَدْتُ انْقِطَاعَ أَبْهَرِي مِنْ ذَلِكَ السُّمِّ “.

নবি ﷺ যে রোগে ইন্তিকাল করেন সে সময় তিনি বলতেন, হে আয়িশা, আমি খায়বারে (বিষযুক্ত) যে খাদ্য ভক্ষণ করেছিলাম, আমি সর্বদা তার যন্ত্রণা অনুভব করছি। আর এখন সেই সময় আগত, যখন সে বিষক্রিয়ার প্রভাবে আমার প্রাণবায়ু বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। [সহিহ বুখারি : ৪৪২৮]

আনাস রা. বর্ণনা করেন,

لَمَّا ثَقُلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم جَعَلَ يَتَغَشَّاهُ فَقَالَتْ فَاطِمَةُ عَلَيْهَا السَّلَام وَا كَرْبَ أَبَاهُ فَقَالَ لَهَا لَيْسَ عَلَى أَبِيْكِ كَرْبٌ بَعْدَ الْيَوْمِ فَلَمَّا مَاتَ قَالَتْ يَا أَبَتَاهُ أَجَابَ رَبًّا دَعَاهُ يَا أَبَتَاهْ مَنْ جَنَّةُ الْفِرْدَوْسِ مَأْوَاهْ يَا أَبَتَاهْ إِلَى جِبْرِيْلَ نَنْعَاهْ فَلَمَّا دُفِنَ قَالَتْ فَاطِمَةُ عَلَيْهَا السَّلَام يَا أَنَسُ أَطَابَتْ أَنْفُسُكُمْ أَنْ تَحْثُوْا عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم التُّرَابَ.

যখন নবি ﷺ-এর রোগ প্রকটরূপ ধারণ করল, তখন তিনি বেঁহুশ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ফাতিমা রা. বললেন, আহ! আমার বাবার ওপর কত কষ্ট! তখন নবি ﷺ তাকে বললেন, আজকের পরে তোমার বাবার ওপর আর কোনো কষ্ট নেই। যখন তিনি ইন্তিকাল করলেন, তখন ফাতিমা রা. বললেন, হায় আমার বাবা! তিনি রবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আমার বাবা! জান্নাতুল ফিরদাউস হবে তাঁর বাসস্থান। হায় আমার বাবা! জিবরিল আ.-কে আমরা তাঁর ইন্তিকালের খবর শোনাই। যখন নবি ﷺ-কে সমাহিত করা হলো, তখন ফাতিমা রা. বললেন, হে আনাস, রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে মাটি চাপা দিয়ে আসা তোমরা কীভাবে বরদাশত করলে! [সহিহ বুখারি : ৪৪৬২]

Share This