দুটো লেখার মধ্যে বৈপরীত্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনারা সম্পাদনা পরিষদ যথাযথ উদ্যোগ নেবেন বলে আশা করছি।

পত্রিকার বর্ষ : ১০, সংখ্যা : ০৯-এ প্রকাশিত ‘ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব’ শীর্ষক নিবন্ধে রয়েছে—

//কেউ কেউ তাঁর আরশকে রাজা-বাদশাহর সিংহাসনের মত মনে করে এবং বলে থাকে, রাজা-বাদশাহ যেমন সিংহাসনে সমাসীন হয়, তিনিও সেইরকম আরশে আসন গ্রহণ করে আছেন (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ এর ফলে আল্লাহ তাআলার অসীম সত্তাকে স্থান-কালে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় এবং তাঁর জন্য দেহত্ব, অনিত্যতা প্রভৃতি মানবীয় গুণ অনিবার্য হয়, যা থেকে আল্লাহ সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এ জাতীয় বিশ্বাস তাঁর মহামর্যাদার সাথে বিলকুল সংগতিপূর্ণ নয়। এতে তো আল্লাহকে মাখলূকের সাথে তুলনা করা হয়ে যায়।

কুরআন-সুন্নাহয় আরশের কথা এসেছে এবং তার বিশালত্বের বিবরণ এসেছে। আরশ আল্লাহ তাআলার মাখলূক। আল্লাহর সৃষ্টির দ্বারাই তা অস্তিত্বে এসেছে। আল্লাহ আরশের খালিক এবং রব। আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে ‘রববুল আরশিল আযীম’ গুণটি কুরআন -সুন্নাহয় অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। এই আরশের সাথেই সম্পৃক্ত আল্লাহ তাআলার একটি ক্রিয়া ইসতিওয়া (استواء) -এর কথা কুরআন মজীদের একাধিক আয়াতে উলেস্নখিত হয়েছে। যেমন সূরা ইউনুসের ৩ নং আয়াতে এসেছে,

إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

(তরজমা) নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেন। তিনি সকল কিছু পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ (তাঁর কাছে) কারও পক্ষে সুপারিশ করার নেই। তিনিই আল্লাহ- তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তাঁর ইবাদত কর। তবুও কি তোমরা অনুধ্যান করবে না?

হযরত মাওলানা তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম এই আয়াতের অনুবাদের টীকায় লেখেন,

‘ইসতিওয়া’ استواء -এর শাব্দিক অর্থ সোজা হওয়া, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সমাসীন হওয়া ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি-সদৃশ নন। কাজেই তাঁর ‘ইসতিওয়া’ ও সৃষ্টির ইসতিওয়ার মত নয়। এর স্বরূপ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এ কারণেই আমরা কোনও তরজমা না করে হুবহু শব্দটিকেই রেখে দিয়েছি। কেননা আমাদের জন্য এতটুকু বিশ্বাস রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা নিজ শান মোতাবেক আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে এর বেশি আলোচনা-পর্যালোচনার দরকার নেই। কেননা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা এর সবটা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১)

কেউ কেউ আল্লাহ তাআলার ‘ইসতিওয়া’ ক্রিয়াটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে ফেলে যাতে মনে হয় তারা (استوى) ‘ইসতাওয়া’কে সরাসরি جلس (বসা) -এর অর্থে মনে করে। এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য- কুরআন মজীদে ‘ইসতিওয়া’কে আল্লাহর فعل (ক্রিয়া) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কথা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা এটিকে ‘সিফাতে যাতে’র মত মনে করে। এ সব কিছুই সালাফের অনুসৃত ‘মানহাজের’ পরিপন্থী।

এ ব্যাপারে মধ্যপন্থা হল আরশের অসিত্মত্বকে অবশ্যই স্বীকার করা এবং ‘ইসতিওয়া’রও আকিদা রাখা। কিন্তু ‘ইসতিওয়া’র বিষয়টাকে অব্যাখ্যাত রাখা। অর্থাৎ ‘ইসতিওয়া’ তো অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু সে ‘ইসতিওয়া’ কী রকম তা আমাদের বোধ-বুদ্ধির অতীত। অমত্মত ইহজগতে বসে তা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যা হোক আল্লাহ তাআলার সত্তা ছাড়া আর কেউ সীমার উর্ধ্বে নয়।//


উপরিউক্ত নিবন্ধে সুন্দর উপস্থাপনায় সহিহ আকিদার বিবরণ উঠে এসেছে। ‘ইসতিওয়া’ মানে যে বসা নয়, তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একই পত্রিকার বর্ষ : ১০, সংখ্যা : ০২-এ এসেছে—


//কুরআন মাজীদের কয়েক স্থানে এসেছে, (তরজমা) ‘‘অতপর তিনি ‘আরশে’ আসীন হয়েছেন।’’//


আসীন হওয়া অর্থ কী? আসীন মানেই তো বসে আছে এমন, উপবিষ্ট ও অধিষ্ঠিত। একই বর্ষের দুটো সংখ্যায় স্ববিরোধিতা। এক জায়গায় যেই অর্থকে নাকচ করা হলো, আরেক জায়গায় ঠিক সেই অর্থটাই করা হলো। কথা এখানেই শেষ নয়; এরপর লেখা হয়েছে—


//তো আয়াতগুলি থেকে পরিষ্কার যে, আল্লাহ পাকের সত্ত্বার সঙ্গে আকাশের একটি বিশেষ স্থানিক সম্বন্ধ রয়েছে। (যার প্রকৃত অবস্থা আমাদের অজানা)।//


এই স্থানিক সম্বন্ধটা আবার কী জিনিস? এমন পরিভাষা কি ইতিপূর্বে ইমামগণ ও সালাফে সালেহিনগণ ব্যবহার করেছেন? আকাশের সঙ্গে আল্লাহর সম্বন্ধটা কি স্থানিক সম্বন্ধ? দলিল দেওয়া হয়েছে সুরা মুলকের আয়াত আর দাসীর হাদিস দ্বারা। কথা হলো, এ দুই নসে আরবি ‘আস-সামা’ শব্দ দ্বারা কি আকাশ নামক বস্তু উদ্দেশ্য নাকি উচ্চ বোঝানো উদ্দেশ্য? যদি প্রথমটা হয়, তাহলে তো সাব্যস্ত হয়, আল্লাহ আকাশে থাকেন। অথচ এ লেখায়ই বলা হয়েছে, //মাখলূকের ন্যায় আল্লাহ তাআলা বিশেষ কোনো স্থানের গন্ডিতে অবস্থানকারী নন।//

আর যদি দ্বিতীয়টা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এর দ্বারা আকাশের সঙ্গে তার স্থানিক সম্বন্ধ কীভাবে প্রমাণিত হচ্ছে? উপরন্তু দেহবাদীরাও বলে না যে, আল্লাহ আকাশে থাকেন; বরং তারা বলে, আল্লাহ আকাশের উপরে আরশে থাকেন। বলাবাহুল্য, আরশ আকাশ ও পৃথিবী সবকিছুরই ওপরে। তাহলে আকাশের সঙ্গে তার স্থানিক সম্বন্ধ কায়েম করলে জমিনের সঙ্গেও তা করার সুযোগ রয়েছে। কারণ কুরআনে জমিনের ক্ষেত্রেও তার অবস্থানকে সম্বন্ধিত করা হয়েছে। আর যদি বলা হয়, জমিনের তুলনায় আকাশ তার নিকটবর্তী। এ কারণে আকাশের দিকে বিশেষ সম্বন্ধ করা হয়েছে। তাহলে বলব, এটা নিখাদ দেহবাদ। কারণ, আল্লাহর দৈহিক অস্তিত্ব যদি প্রমাণিত না হয়, তাহলে কোনো স্থানকে তার নিকটবর্তী আর অপর কোনো স্থানকে তার দূরবর্তী বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অসার। ইমাম আবু হানিফা রহ.-ও তার আলোচনায় এ বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন।

যাহোক, বিষয়টা আপনারা আরও ভালো বুঝবেন। আমি চেয়েছি শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। যদি বাস্তবেই দুই বক্তব্যের মধ্যে বৈপরীত্য ও অসংগতি থাকে, তাহলে বিষয়টা শুধরে নিতে পারেন। ঘোষণা দিয়ে শুধরে না নিলেও অন্তত পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে এডিট করে দিতে পারেন। আল্লাহ আপনাদের খেদমত কবুল করুন এবং এর বিনিময়ে উত্তম প্রতিদান দান করুন। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।

Share This