উম্মাহর ঐক্য এবং আকিদার ক্ষেত্রে সালাফ-খালাফের মাযহাব ও আমার মানহাজ

ড. ইউসুফ কারযাবি

 

শাইখ হাসান আল-বান্না তার পুস্তিকা ‘আল-আকায়িদে’ লেখেন, ‘অবশ্যই তুমি জেনেছো যে, আল্লাহ তাআলার সিফাত (গুণ ও বিশেষণ)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আয়াত এবং হাদিসের ক্ষেত্রে সালাফের মাযহাব হলো, তা যেমনভাবে এসেছে তেমনই রেখে দেয়া। তার তাফসির এবং তাবিল (ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) থেকে নীরব থাকা। আর খালাফের মাযহাব হলো, এগুলোকে এমনভাবে তাবিল করা, যা আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়—এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তুমি আরও জেনেছো যে, দুই দলের মাঝে বিরোধ প্রচণ্ড, এমনকি পরিণামে যার ফলাফল একদল অপরদলকে হেয়-প্রতিপন্ন করা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তবে উভয় দল আবার কিছু বিষয়ে একমত। যেমন:

ক. উভয় দলই এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টজীবের সাদৃশ্য থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।
খ. উভয় দলই অকাট্যভাবে দাবি করে যে, আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে এ সকল নুসুসে ব্যবহৃত শব্দের উদ্দেশ্য তা নয়, যা সেগুলোর বাহ্যিক অর্থ, অর্থাৎ এই শব্দগুলো মাখলুকের ক্ষেত্রে যে অর্থের জন্য গঠিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলার থেকে সৃষ্টজীবের সাদৃশ্য নিরোধ করার আকিদা থেকেই মূলত তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
গ. উভয় দলই অকাট্যভাবে দাবি করেছে যে, শব্দকে গঠন করা হয়েছে অন্তরের মর্ম বা অনুভব-অনুভূতি প্রকাশের জন্য, যা ভাষাব্যবহারকারী এবং ভাষাবিদদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভাষা যতই ব্যাপক হোক, তা এমন কোনো বিষয়কে পরিব্যাপ্ত করতে পারে না, যে বিষয়ের বাস্তব অবস্থার জ্ঞান ভাষা-ব্যবহারকারীর নেই। আল্লাহ তাআলার যাত (সত্তা)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর হাকিকতও এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। ভাষা এ ক্ষমতা রাখে না যে, তা আমাদের সামনে এ সকল শব্দের হাকিকতকে তুলে ধরবে। সুতরাং এ সকল শব্দের অর্থ নির্ধারণের জন্য প্রভাব খাটানো নিরেট আত্মপ্রবঞ্চনা।

যখন এ বিষয়টি স্থির হলো, তখন বলা যায় যে, মূল তাবিলের ব্যাপারে সালাফ এবং খালাফ একমত। তাদের মতবিরোধ সীমাবদ্ধ এর মাঝে যে, খালাফ এ সকল নুসুসে ব্যবহৃত শব্দাবলির অর্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ অগ্রে অগ্রসর হয়ে গেছেন, যখন জরুরত তাদের এ ব্যাপারে বাধ্য করেছে। তারা এমনটা করেছেন, জনসাধারণকে তাশবিহ (মাখলুকের সঙ্গে খালিকের সাদৃশ্য)-এর সংশয় থেকে রক্ষা করার জন্য। এটা এমন মতবিরোধ, যা নিন্দা-ভৎসনা শোনার হকদার নয়।

আমরা বিশ্বাস করি, সালাফের সিদ্ধান্ত—অর্থাৎ তাবিল এবং তাতিল (কর্মহীনকরণ)-এর সমাপ্তি ঘটিয়ে এসব ব্যাপারে নীরব থাকা এবং এর অর্থ আল্লাহ তাআলার ইলমের দিকে ন্যস্ত করাই অধিক নিরাপদ এবং অনুসরণের অধিক উপযুক্ত। যদি তুমি সেসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত কেউ হও, আল্লাহ তাআলা ইমানের প্রশান্তি দ্বারা যাদের সৌভাগ্যবান করেছেন, বিশ্বাসের শীতলতা দ্বারা যাদের বক্ষ শীতল করেছেন, তবে আর এর বিকল্প কোনো পথে তোমার পা বাড়িয়ো না। {আল-আকায়িদ, মাজমুউয়াতু রাসায়িল ইমামিশ শাহিদ হাসান আল-বান্না: ৪০৮-৪১৮}

আকিদা বিষয়ক যত কিতাব আমি আল-আযহারে পড়েছি, তা সবগুলোই একটা সর্বসম্মত বিষয়কে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করছিলো—সিফাতের মাসআলায় দুটোর যে-কোনো একটি পথ গ্রহণ করতে হবে। সালাফের মাযহাব হলো, আল্লাহ তাআলার সিফাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত আয়াত এবং হাদিসের ক্ষেত্রে নীরব থাকা এবং তার ইলম আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা। আর খালাফের মাযহাব হলো, এগুলোকে এমনভাবে তাবিল করা, যা এসবের সঙ্গে মুনাসিব হবে এবং যা আরবি ভাষার দাবি অনুযায়ী হবে।

আমার শিক্ষকগণ এসব আলোচনার পরে সাধারণত বলতেন, ‘সালাফের মাযহাব অধিক নিরাপদ এবং খালাফের মাযহাব অধিক জ্ঞানগর্ভ’। তাদের উদ্দেশ্য এ ছিলো না যে, খালাফ সালাফের থেকে অধিক জ্ঞানী। বরং উদ্দেশ্য হলো, সময় ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং মাযহাব ও পন্থার বিচারে তাদের মাযহাব অধিক জ্ঞানগর্ভ। কারণ হলো, তা সংশয় দূর করে এবং প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করে, তেমনি তা জ্ঞানের বিবেচনায় আকলকে পরিতৃপ্ত করে। সব ধরনের আকলকে সর্বাবস্থায় নির্দ্বিধ সমর্পণ পরিতৃপ্ত করে না। তা ছাড়া যারা অস্বীকারকারী এবং যারা সংশয়গ্রস্থ—যেমন বিদআতিরা—, তাফবিয (আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করা)-তাসলিম (নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া) যাদের পরিতৃপ্ত করে না, তাদের জন্য এ পন্থাই অধিক উপযুক্ত।

পরবর্তীতে আমি আরেক নতুন ধারার সাথে পরিচিত হই। এক্ষেত্রে ইবনু তাইমিয়া স্পষ্টভাবে সালাফের স্বতঃসিদ্ধ মাযহাবকে অস্বীকার করে আলাদা চিন্তাধারার গোড়াপত্তন করেছেন। ইবনু তাইমিয়া সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এটা (তাফবিয) সালাফের মাযহাব নয়। সালাফের মাযহাব শুধু হলো, ইসবাত (সাব্যস্তকরণ)। অর্থাৎ আল্লাহ নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, আমরা তার জন্য তা সাব্যস্ত করবো এবং তিনি নিজের থেকে যা নিরোধ করেছেন, আমরা তার থেকে তা নিরোধ করবো। …তাফবিয (আল্লাহর ইলমের দিকে ন্যস্ত করা)-এর অভিমত, যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে, তা সালাফের মত নয়; বরং তা এক বিদআতি মাযহাব।’

এই মাসআলার ব্যাপারে সালাফি এবং খালাফি, কিংবা বলা যায়, ইবনু তাইমিয়ার অনুসারী এবং তার প্রতিপক্ষের মাঝে দীর্ঘ বিরোধের ধারা চলেছে। আল-আযহারের একজন বিশিষ্ট আলিম—শাইখ মানসুর মুহাম্মাদ উয়াইস এ ব্যাপারে একটি কিতাব লিখেছেন, যার নাম ‘ইবনু তাইমিয়া সালাফি নন’। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়েছেন, ইবনু তাইমিয়া সালাফের মাযহাব অস্বীকার করেছেন। কিতাবে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করে এ বিষয়টি প্রমাণিত করেছেন। তিনি তার কিতাবে শেষাবধি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সালাফের মধ্যে এমনও ছিলেন, যারা ইসবাত করেছেন; এমনও ছিলেন, যারা তাফবিয করেছেন এবং এমনও ছিলেন, যারা তাবিল করেছেন। অর্থাৎ তাবিলও সালাফের থেকে প্রমাণিত। এবং এটাই সত্য। আমি আমার কিতাব ‘ফুসুলুন ফিল আকিদাহ বাইনাস সালাফ ওয়াল খালাফ’-এও বিস্তর পরিসরে এ বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করেছি।

এসব ব্যাপারে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, ‘আল্লাহ তাআলার সেসকল সিফাত, মানুষের ক্ষেত্রে যা আবেগ-প্রতিক্রিয়া, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমি সালাফের মাযহাবকে গ্রহণ করি। যেমন: দয়া, রাগ, ভালোবাসা, অপছন্দ, খুশি, আত্মমর্যাদা, বিস্ময় ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা যেভাবে এগুলোকে নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন, আমিও তার জন্য সেভাবেই এগুলোকে সাব্যস্ত করি। এগুলো তাবিল করার কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। বরং আমি বলি, আল্লাহ তাআলার জন্য রয়েছে রহমত (দয়া), তবে তা আমাদের রহমত (দয়া)-এর মতো নয়। তার রয়েছে ক্রোধ, তবে তা আমাদের ক্রোধের মতো নয়। রয়েছে খুশি, তবে তা আমাদের খুশির মতো নয়। যেমন আমরা বলি যে, তার ইলম আমাদের ইলমের মতো নয়, তার শোনা আমাদের শোনার মতো নয়। তার দেখা আমাদের দেখার মতো নয়।

আর যে-সকল নুসুস আল্লাহ তাআলার জন্য ওপরে হওয়া ইত্যাদি সাব্যস্ত করে, এগুলোকে আমিও আল্লাহ তাআলার জন্য সাব্যস্ত করি এবং এগুলোর এমন তাফসির (ব্যাখ্যা) করি যা সালাফি মানহাজের মুহাক্কিক ইমামগণের ব্যাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর সবচে প্রোজ্জ্বল নমুনা হলেন আল্লামা ওয়াসিতি, তার কিতাব ‘আন-নাসিহাহ’-য়।

আর যে-সকল নুসুসের বাহিক অর্থ দৈহিক গঠন এবং মানুষ ও অন্যান্য মাখলুকের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট হওয়া বোঝায়, এসব ক্ষেত্রে আমি তাবিলকে প্রাধান্য দিই, যখন তাবিল কাছাকাছি ধরনের হয় এবং গ্রহণীয় পর্যায়ে হয়, অর্থাৎ তাবিল দূরবর্তী না হয় এবং কষ্টমষ্ট করে চাপিয়ে দেয়া না হয়; যেমনটি মহান দুই ইমাম ইবনু আবদিস সালাম এবং ইবনু দাকিক আল-ইদের মাযহাব। {বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন—ফুসুলুন ফিল-আকিদাহ, সিফাতের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান সংক্রান্ত অধ্যায়: ১১৮-১৩২}

এসব ক্ষেত্রে ঐক্য কীভাবে সম্ভব? শহিদ হাসান আল-বান্না নিজেদের (ইখওয়ানের) মানহাজ বয়ান করার পর সে পথনির্দেশনাই দিয়েছেন।
‘সিফাত সংশ্লিষ্ট আয়াত এবং সহিহ হাদিস এবং তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মুতাশাবিহের ক্ষেত্রে আমরা এগুলোর প্রতি ইমান রাখবো, যেভাবে তা এসেছে সেভাবেই, এর কোনো তাবিল-তাতিল ছাড়া। এসব ব্যাপারে আলিমগণের থেকে যে মতবিরোধ এসেছে আমরা তা আলোচনায় আনবো না। আমাদের জন্য তা-ই যথেষ্ট, যা যথেষ্ট হয়েছে রাসুলুল্লাহ সা. এবং তার সাহাবিগণের জন্য। “আর সুগভীর জ্ঞানের অধিকারীরা বলে, আমরা এসবের প্রতি ইমান এনেছি। সবই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।” (সুরা আলে ইমরান: ৭)’

{সংক্ষেপিত ও বিন্যাসিত}

Share This