আমাদের সংবিধানের চারটি মূল ধারার মধ্যে অন্যতম হলো জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে লেখা হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ সংবিধানের নয় নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মূলভিত্তি ও চেতনা ছিল জাতিসত্তাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীটি নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এ লড়াই শুরু হয়েছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ব বাংলা জুড়ে ধ্বনিত হয়েছিল : ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

জাতীয়তাবাদ বলা হয় এমন আদর্শকে, যেখানে জাতিকে মানবসমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শকে জাতিগত আদর্শের পরে স্থান দেওয়া হয়।[1] অন্যভাবে বললে, ‘জাতীয়তাবাদ (nationalism) হচ্ছে কোনো জাতির জোরালো জাতীয়তাবোধ, যা তাদের স্বাধিকার বা স্বায়ত্বশাসন অর্জনে, এমনকি নিজেদের জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র গঠনে ঐক্যবদ্ধ করে। উনিশ ও বিশ শতকে বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলে বড় বড় সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ ভেঙে বহু জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়। জাতীয়তাবাদ ধারণাটি একদিকে যেমন একটি জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জাতিসত্তাবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠতে পারে (জাতিসত্তাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বা Ethnic Nationalism), অন্যদিকে তেমনি একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসীদের রাষ্ট্রভিত্তিক সম্মিলিত মূল্যবোধের ওপরও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে (উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ বা Liberal Nationalism)। যেকোনো ধরনের জাতীয়তাবাদই অন্য জাতি কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো জাতি কিংবা রাষ্ট্রের প্রাধান্য; এমনকি আগ্রাসন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করে থাকে।’

এখানে প্রসঙ্গক্রমে আরও তিনটি পরিভাষা জেনে রাখা যেতে পারে :

  1. জাতিসত্তা (Ethnicity) হচ্ছে জাতি বা গোষ্ঠীগত পরিচয়, জাতীয়তা নয়। এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের সীমানা দ্বারা সীমাবদ্ধও নয়। একাধিক জাতিসত্তার মানুষ যেমন একই রাষ্ট্রে বসবাস করে থাকে, একই জাতিসত্তার মানুষ তেমনি একাধিক রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকতে পারে। ঢাকা, লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা দুনিয়ার অন্য যেকোনো স্থানে বসবাসকারী বাঙালিদের জাতিসত্তাগত যে পরিচয়, তা এক ও অভিন্ন। বিশ্বে কুর্দি কিংবা তামিলদের মতো নিজস্ব জাতিরাষ্ট্রবিহীন অনেক জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা আছে, কিন্তু সার্বভৌম জাতীয়তা নেই।
  2. জাতীয়তা (Nationality) হচ্ছে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়, জাতিসত্তা নয়। এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং বলা যায়, রাষ্ট্রই জাতীয়তা নির্ধারণ করে। সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের একক রাষ্ট্রীয় পরিচিতির ক্ষেত্রে তাই আন্তর্জাতিকভাবে পাসপোর্ট, ভিসা, জাতীয়তা-সনদ, পরিচয়পত্র, ইত্যদিতে ‘জাতীয়তা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় এবং সেটি জাতিসত্তা নয়, বরং নাগরিকত্ব বোঝায়। ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আরব দেশগুলোর দৃষ্টান্ত এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ভারতে বহু জাতিসত্তার মানুষের বসবাস হলেও তাদের সবার রাষ্ট্রীয় পরিচয় বা জাতীয়তা হচ্ছে ভারতীয়।
  3. নাগরিকত্ব (Citizenship) হচ্ছে আইনের ভিত্তিতে নির্ধারিত রাষ্ট্র ও ব্যক্তির পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্পর্ক। নাগরিকত্বের মাধ্যমে একদিকে যেমন ব্যক্তি তার রাষ্ট্র থেকে নির্দিষ্ট কিছু অধিকার লাভ করে, অন্যদিকে তেমনি তার ওপর রাষ্ট্রের প্রতি নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব বর্তায়। নাগরিকত্বের সঙ্গে জাতীয়তার মূল পার্থক্য হচ্ছে, জাতীয়তা থাকলেই বা রাষ্ট্রের সদস্য হলেই সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন নাগরিক অধিকার—যেমন : ভোটাধিকার—অর্জিত হয় না। তবে সাধারণভাবে জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত চিত্র উঠে এসেছে ড. মখদুম মাশরাফীর কলমে :

‘একটা সময় গেছে যখন জাতীয়তাবাদ গণমুক্তির উদ্দীপনার একটি তাৎপর্যপূর্ণ রূপক হয়ে উঠেছিল, যখন মধ্যযুগীয় ইউরোপে চার্চের অত্যাচারে সমাজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। চার্চের নৈরাজ্যকর ফতোয়া জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল সে সময়। মানুষের মুক্তির অন্বীষ্ট হয়েছিল তখন জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ তখন আবির্ভূত হয়েছিল একটি সেক্যুলার ইউনিট হিসেবে। জাতীয়তাবাদ ছিল নৈরাজ্যকর ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে একটি প্রায়োগিক সমাধান, যা জীবনকে জীবনযোগ্য করে তুলতে পারে। জাতীয়তাবাদ সেদিন একটি দর্শনকে ধারণ করেছিল। সেটি ছিল এই যে, মানুষের জীবন মানুষী সিদ্ধান্তের বিষয়। প্রাত্যহিকের যা কিছু, তা মানুষ তার প্রসঙ্গে নিজেরাই যেমন বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করবে, তেমনি স্থির করবে কোনটা কখন কেন করণীয়। পার্থিব জীবন এবং অপার্থিব বোধের মধ্যে একটি নির্দিষ্টতার রেখাচিহ্ন সর্বোতভাবে অঙ্কিত ও গৃহীত হয়েছিল। এইভাবে জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছিল একান্তভাবেই মানুষী মুক্তির বিষয়। জাতীয়তাবাদ তখন এক বিবেচনায় ছিল ইতিবাচক ও গণউত্তরণমুখী। গণউত্তরণমুখী এই জন্য যে, তা গণজীবনে মানুষী প্রশাসনের সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু তখনো গণতন্ত্রের ভোর ফোটেনি। মানুষের প্রশাসন-প্রতিনিধি হয়ে ছিল রাজা। যেহেতু মানুষ তিনি, তাকে গ্রহণ করা হয়েছিল শাসক হিসেবে। দৈবের বিপরীতে রাজাকে গ্রহণ করা হয়েছিল সাধারণ্যে। এটি ছিল পরিপ্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিগত সাধারণ বাধ্যতা। কারণ, তখন সামাজিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো এলাকায় গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দ্বৈত স্পষ্ট ছিল না। এ দ্বৈত স্পষ্ট হবার জন্য পৃথিবীকে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

যাই হোক, ওই ইতিবাচক গণউদ্ধার ধারার পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্যে বিধাতার বিকল্প একটি শক্তির সন্ধান চলেছে কয়েক শতক ধরে, যার নাম সার্বভৌমত্ব। একটি কল্পিত সর্বেসর্বা। একটি প্রশ্নাতীত কর্তৃপক্ষ, যা অদৃশ্য হয়েও প্রায়োগিক বলে স্বীকৃত। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতক অবধি চলেছে এর সন্ধান। দার্শনিক হবস থেকে জিন বডিন পর্যন্ত চলেছে এর তাত্ত্বিক নির্মাণ প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে। এটি ছিল রাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদের আদর্শায়নের একটি কাল। এই ব্যস্ততায় ও নিবেদিতপ্রাণতায় এমনটা ভাবার অবসরই হয়নি যে, এর বাইরে বিস্তৃততর আরও কোন আয়তন ও আয়োজন মানুষের পক্ষে অর্জন ও নির্মাণ করা সম্ভব। ভাবনার ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের এই সর্বৈবতা গণমানুষকে তথা মানুষকে জাতীয়তাবাদ সর্বস্ব ও সার্বভৌমত্ব সর্বস্ব মাত্রায় অবরুদ্ধ করেছে। মানুষের আত্মআবিষ্কার এর বাইরে বিস্তৃত হতে পারেনি। এ সময়টায় সমষ্টি মানুষের মুক্তির সমস্ত আয়োজন ও সংগ্রামে জাতীয়তাবাদের পতাকাই হয়েছে ওই আয়োজন ও সংগ্রামের একক রূপক, মোক্ষ রূপক। সেই সঙ্গে ভাবা হয়েছে, মানুষের জন্যে শেষ এবং একান্ত আশ্রয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তার জন্যে জীবন বাজি রাখার সংকল্প। তার রক্ষা ও প্রতিরক্ষার জন্যে নির্মিত হয়েছে সেনাবাহিনী। যেন অন্যেরা বন্য। যেন আমার জাতিই প্রথম এবং আমার জাতিই শেষ কথা। যেন অন্যেরা অবান্তর। ত্যাগযোগ্য। পরিত্যাজ্য। দমনযোগ্য। এলিয়েন। এভাবে এক সময় জাতীয়তাবাদ ভুল হাতে পড়ে হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদ। মুসোলিনীদের উত্থান হয়েছে। মানুষ তার আত্মআবিষ্কারের প্রসঙ্গকে ঘিরে বিপর্যস্ত ও নিগৃহীত হয়েছে জাতীয়তাবাদের ঘূর্ণচক্রে। জাতিতে জাতিতে সংঘাত হয়েছে ঘুরে ফিরে বারবার। বোঝাই যায়নি, এর ভেতরে ভুল কিছু আছে কি না। এর বাইরে বিকল্প কিছু আছে কি না। অস্ত্র প্রতিযোগিতার অজস্রতার সমাহার এনেছে দেশে দেশে। রাষ্ট্রকে ঘিরে শক্তি ও মর্যাদা সমার্থক বিবেচিত হয়েছে। যে মুক্তিঅর্চনা থেকে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের আদর্শায়ন হয়েছে এক দিন তাই হয়ে উঠেছে শক্তি ও মর্যাদার অহঙ্কারের উজ্জ্বলতম মঞ্চ। তাই হয়ে উঠেছে মানুষ দমনের ও মানুষ নিপীড়নের হাতিয়ার। বর্তমানের আমেরিকান রিপাবলিকানরা তা জোরেশোরে বলছেও। তারা বলছে, আমেরিকার মর্যাদা তার যুদ্ধ ক্ষমতায়। যুদ্ধক্ষমতা ছাড়া আমেরিকার রাষ্ট্র অস্তিত্ব অর্থহীন। এভাবে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে যুদ্ধ-বিষয়ক বাস্তব। সংঘাত-বিষয়ক বাস্তব। অন্যকে দমন-বিষয়ক বাস্তব। ভয় দেখানোর ও ভয় পাবার বাস্তব। একটি ভয়ঙ্কর বাস্তব।

বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বেও উপনিবেশে উপনিবেশে জাতীয়তাবাদই হয়েছে স্বাধীনতার রূপক। সাম্রাজ্যবাদের বিপরীত বাস্তব; যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা পেয়ে উপনিবেশগুলো হয়েছে একেকটি জাতি রাষ্ট্র। ভাবা হয়েছে এই-ই স্বাধীনতা। সাম্রাজ্যবাদীরাও নতুন প্রেক্ষিতে ইন্ধন জুগিয়েছে জাতীয়তাবাদী ধারণার সমর্থনে। পুঁজিবাদী/সাম্রাজ্যবাদী বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে লিখিয়েছে অনেক তত্ত্ব কথা। তারা জওহর লাল নেহেরুকে দিয়ে তৈরি করেছে ন্যাম-ননঅ্যালাইন মুভমেন্টের মতো আন্দোলন, যা জাতীয়তাবাদকে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো বিশ্বমুখী আন্দোলনকে প্রতিহত করবে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনই প্রথম, যা বিশ্বে জাতীয়তাবাদ-উত্তর একটি স্বপ্ন দেখিয়েছিল পৃথিবীকে। এটি অতিকাল্পনিক হয়েছিল যদিও-বা। তার কারণ এটি সমাজের সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির আগেই আদর্শকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিল। মানুষের চেতনার দুয়ার দিয়ে প্রবেশ না করে এটি রাজনীতির দুয়ার দিয়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজেছিল। সমাজতন্ত্রীরা বুঝতে পারেনি যে, সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির বাইরে সমাজ পরিবর্তনের কোনো শর্টকার্ট নেই। যাই হোক, বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ধারণা-রাজনীতিরও স্বীকার হয়েছে জাতীয়তাবাদ। এই ধারণা-রাজনীতির ইন্ধন এসেছে পুঁজিবাদীদের কাছ থেকে। একটি বড়মাপের রাজনৈতিক সাহিত্য সম্ভার এসেছে এর মাধ্যমে, যার প্রভাব দেশে দেশে এখনো গভীরভাবে বিরাজিত।

তারপর এসেছে ইতিহাসের আর এক অনন্য সাধারণ ঘটনা—আরব বসন্ত, যা প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রকে প্রতিপন্ন করেছে গণকারাগারে। রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ—যার দায় গণমানুষের পাশে দাঁড়ানো—সেই কর্তৃপক্ষ গণমানুষের ওপরে বোমাবর্ষণ করেছে। লিবিয়ায়, মিশরে এমন ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রের গণকারাগার হবার সবচেয়ে শেষ এবং সবচেয়ে বর্বর উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে সিরিয়ায় আল আসাদের নিষ্ঠুর নেতৃত্বে, যেখানে রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ নাগরিকের মৃত্যু ঘটছে সরকারের নৃশংস আঘাতে। একই পৃথিবীতে একই সঙ্গে মুক্তির রূপক হয়ে আছে জাতীয়তাবাদ। যেমন ফিলিস্তিনে। যেমন কাশ্মীরে। জাতীয়তাবাদের এ পাশব্যাপী, জাতীয়তাবাদের ভেতর-বাহিরব্যাপী কেবল রক্তক্ষরণের ইতিহাস প্রবাহিত হয়ে চলেছে। জাতীয়তাবাদকে ঘিরে ঘটমান রয়েছে অন্তর্যুদ্ধ ও বহির্যুদ্ধ। পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয়তাবাদেও সবচেয়ে ভয়াবহ, বিস্তৃত ও বিশ্ব নাড়ানো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ইউরোপকে কেন্দ্র করে, যা বিশ্বযুদ্ধ বলে পরিচিত হয়ে আছে আজও। আজ এটি স্পষ্টভাবে বিদিত যে, দুটো বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কার্যকারণ ছিল জাতীয়তাবাদ—এর অর্থনৈতিক বা দার্শনিক ব্যাখ্যা যাই থাক। যুদ্ধের প্রায় সর্বৈব ও বিশাল ক্ষতির রূপ ইউরোপে এই জাগৃতি সৃষ্টি করেছিল যে, জাতীয়তাবাদের অন্য নাম যুদ্ধ ও শেষ বিশ্লেষণে ধ্বংস। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বর্তমান ইউরোপই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তির অধিষ্ঠান ক্ষেত্র মহাদেশ। ইউরোপই প্রথম উপলদ্ধি করেছিল, যুদ্ধ নয়, আলোচনা দিয়েই কেবল মানুষী জীবনের সকল সঙ্কট উৎরানো যায়। অষ্টাদশ শতকে ওয়েস্ট ফালিয়া চুক্তির ভেতর দিয়েই ইউরোপীয় এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছিল। অথচ বিস্ময়কর যে, ইউরোপই দুটো বিশ্বযুদ্ধ করেছে ওয়েস্ট ফালিয়া চুক্তির কাল পেরিয়ে আর একটি নতুন কালে।

আরও একটি বড় বিস্ময় যে বিশ্বের জন্যে অপেক্ষা করবে, তা ভাবা যায়নি। সে-ও এই জাতীয়তাবাদ নিয়ে। বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে ইউরোপে এই উপলব্ধি বিস্তার লাভ করেছিল যে, জাতীয়তাবাদ মানে যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের সম্ভাব্যতা। ১৯৫২ সালে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউরোপে জাতীয়তাবাদের সমাধি রচনা করে পুরো ইউরোপজুড়ে একটি প্রস্তাব সারা ইউরোপে ফেরি করেছিলেন আর একই উপলব্ধিতে আলোড়িত সারা ইউরোপ সে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল গভীর উদ্দীপনার সাথে। তাদের সবার কাছে এটি প্রতিপন্ন হয়েছিল যে, জাতীয়তাবাদ শেষ বিশ্লেষণে যুদ্ধ বৈ কিছু নয়। আর যুদ্ধ মানে ধ্বংস। কোনো মুক্তি ও উত্তরণের সম্ভাবনা যুদ্ধে থাকে না। এই উপলব্ধির ফলশ্রুতি হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন উত্তরোত্তর বিকশিত হয়েছে। পৌঁছে গেছে ইউরোর মতো ইউরোপের জন্যে একটি মুদ্রা প্রচলন পর্যন্ত। এই উপমহাদেশীয় সংগঠনের সংহতি রূপকে আদৃত ও পুরস্কৃত করেছে নোবেল কমিটি নোবেল পুরস্কার দিয়ে।’

জাতীয়তাবাদ মানে মানবতাকে কাঁটাতারের বেড়ায় আবদ্ধ করে ফেলা। জাতীয়তাবাদ মানে সীমানার এপারের মাটি ‘সোনা’, আর ওপারের মাটি কেবলই মাটি—এই চেতনা। জাতীয়তাবাদ মানে বৃটিশদের তৈরি করে দেওয়া সীমানা নিয়ে গৌরব করা।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে একটা মন্দির ভাঙ্গা হলে আমাদের কিবোর্ডে ঝড় ওঠে— সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। অপরদিকে বর্ডারের ওপারে মায়ানমারে মুসলিমদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তাদের রক্ত দিয়ে স্নান করছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, আরাকানে মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চলছে, কাশ্মীরে পুলিশ পাখির মতো গুলি করে মারছে মুসলিমদের, পাকিস্তানে আমেরিকা ড্রোন হামলা করে নিরীহ নারী-শিশুদের মারছে, চীনের কয়েকটা প্রদেশে মুসলিমরা প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবন যাপন করছে, আর আবু গারিব কিংবা গুয়ান্তামোর জলজ্যান্ত নরক তো রয়েছেই, এসব ক্ষেত্রে আমাদের মুখে ফেভিকলের কুলুপ। কারণ নির্যাতিতরা ‘বার্মিজ’, ‘ভারতীয়’, ‘পাকিস্তানি’। আমার মানবতা বর্ডারের এপারের জন্য, ওপারের লোককে মানুষ হিসেবে গণনাই করি না। এটাই জাতীয়তাবাদ।

জাতীয়তাবাদ মানে স্বজাতির প্রতি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। নিজের জাতি অন্যায় করলেও তা না দেখার ভান করা—সে আমার ‘দেশী’ বলে। জাতীয়তাবাদ মানে সত্যের ওপর সীমানার সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া।

ফেলানি নামের একটা মেয়ে সীমান্তে নিহত হলো। তাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল। কয়েক বছর পর ২০১৩-তে হত্যার বিচার বসল। প্রহসনের রায়ে হত্যাকারী ভারতীয় সেনা বেকসুর খালাস পেল। আমরা নিন্দা জানালাম। আর ভারতীয়রা বলল, ন্যায়বিচার হয়েছে।

এটাই জাতীয়তাবাদ। ভারতীয়রা ভারতের সেনার দোষ দেখবে না। সে ভারতীয়। অতএব সাত খুন মাফ। ভারতের জায়গায় আমরা থাকলে হয়তো একই কাজ করতাম। মনে আছে, ২০১১ সালে সৌদি আরবে খুনের দায়ে ৮ বাংলাদেশীর শিরচ্ছেদ হওয়ার ঘটনা? সে কী ঝড় এ দেশে! স্পষ্ট অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিয়ে সৌদি আরবের মুণ্ডুপাত করা হলো। এমনকি আসামীদের কাজকে জাস্টিফাই করতেও কত লেখালেখি হয়েছে। কেন? কারণ, আসামীরা বাংলাদেশী। তারা খুন করুক আর যা-ই করুক, অন্য দেশ তাদের বিচার করতে পারবে না—এই মনোভাবটাই জাতীয়তাবাদ।

জাতীয়তাবাদ একপাক্ষিক না। পাকিস্তানের ইতিহাসের বইগুলোতে তাদের আর্মিকে বীর হিসেবে তুলে ধরা হয়। তাদের দোষকে, গণহত্যাকে উপেক্ষা করা হয়। বাঙালিদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ দেশের লোককে ‘বিদ্রোহী’, ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আমরা বড় হই পাকিস্তানীদের ঘৃণার চোখে দেখে, ওরা বড় হয় আমাদের ঘৃণার চোখে দেখে। আমরা পাকিস্তানকে ‘Fuckistan’ বলতে পেরে সুখলাভ করি, ওরাও আমাদের গালি দিয়ে পরম আনন্দ লাভ করে। এটাই জাতীয়তাবাদের স্বরূপ।

একাত্তরের যুদ্ধকে আমরা দেখি স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে, পাকিস্তানিরা দেখে দেশদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনীর অভিযান হিসেবে, আর ভারতীয়রা দেখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের জয় হিসেবে। জাতীয়তাবাদ আমাদের ন্যায়, চিন্তাশক্তি আর বিবেককে ধ্বংস করে দেয়। পক্ষপাত আর ঘৃণাই হলো জাতীয়াতাবাদের আউটপুট। এ সেই পচনধরা মতবাদ যা প্রত্যেককে ভাবতে শেখায়—তার নিজের দেশ, নিজের জাতিই শ্রেষ্ঠ। তার জাতির ইতিহাস সবচেয়ে গৌরবান্বিত, সবচেয়ে নিষ্কলঙ্ক। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা বিচারের ভার বিবেক থেকে এমনিতেই চলে যায় জাতীয়তাবাদের হাতে।

এই সেই জাতীয়তাবাদ, যার কারণে মানুষ নিজেকে কেবল বিশেষ জাতিতে জন্মবলে দম্ভ করতে শেখায়। এক ব্যক্তি এশিয়ার অধিবাসী বলে ইউরোপ বা আমেরিকাবাসীদের নিকট ঘৃণিত, অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত ও অধিকার বঞ্চিত হতে একান্তভাবে বাধ্য। এক ব্যক্তি শুধু কৃষ্ণাঙ্গ হওয়াই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির দৃষ্টিতে তার ঘৃণিত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সাদা-কালোর প্রভেদের মূলে এই জাত্যাভিমান, জাতীয়তার দম্ভ। নিগ্রোদেরকে জীবন্ত দগ্ধীভূত করা আমেরিকার সভ্য নাগরিকদের পক্ষে কিছুমাত্র অপরাধের কাজ নয়, কারণ তারা নিগ্রো। জার্মান জাতি এবং ফরাসি জাতি পরস্পরকে ঘৃণা করতে পারে। কারণ, তারা দুটো স্বতন্ত্র জাতিতে বিভক্ত। এদের একজনের গুণাবলি অন্যের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ দোষ ও ত্রুটি বলে নিরূপিত হয়। সীমান্তের স্বাধীন আফগানিদের আফগানি হওয়া এবং দামেশকের অধিবাসীদের আরবজাতির অন্তর্ভূক্ত হওয়া এমন একটা অপরাধ যে, কেবল এ কারণেই তাদের মাথার ওপর বোমারু বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা এবং সে দেশের জনগণকে পাইকারিহারে হত্যা করা ইংরেজ ও ফরাসিদের পক্ষে একেবারে ন্যায়সংগত। কিন্তু ইউরোপের সুসভ্য (?) অধিবাসীদের ওপর এরূপ বোমা নিক্ষেপ করাকে বর্বরতামূলক কাজ বলে তারা মনে করে।

হিটলার-মুসোলিনিরা জাতীয়তাবাদের গর্বে অন্ধ হয়ে মানুষ হত্যাকে জায়িয করেছিল। আমাদের দু শ বছরের প্রভুরা নীলচাষীদের পেটে লাথি মেরে হত্যাকে বৈধ ভাবত। কারণ, নীলচাষীরা ‘নিচুজাতি’, আর বৃটিশরা ‘উঁচু জাতি’। এই জাতীয়তাবাদ এনেছে যুদ্ধ, এনেছে অনর্থ, কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ, বয়ে এনেছে দাম্ভিকতা, ঘৃণা আর মজলুমের কান্না।

এই নোংরা বিষাক্ত বস্তুকে না ছাড়তে পারলে আত্মার মৃত্যু সুনিশ্চিত। ইসলাম জাতীয়তাবাদের মতো নোংরা মতবাদকে সমূলে প্রত্যাখ্যান করে।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন :

‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়্যাহর (জাতীয়তাবাদ) দিকে ডাক দেয়, বা আসাবিয়্যাহর কারণে লড়াই করে কিংবা আসাবিয়্যাহর কারণে মৃত্যুবরণ করে।’[2]

তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, ‘আসাবিয়্যাহ কী’? তিনি উত্তরে বললেন, ‘আসাবিয়্যাহ হলো অন্যায়-অবিচার ও জুলুমের ক্ষেত্রে তুমি তোমার সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করবে।’[3]

এখানে উল্লেখ্য, স্বহস্তে সহযোগিতা না করে সমর্থন দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত।

অপর এক হাদিসে রাসুল ﷺ বলেন :

‘যে জাতীয়তাবাদ তথা আসাবিয়্যাহর জাহেলি আহ্বানের দিকে মানুষকে ডাকে, সে যেন তার পিতার লজ্জাস্থান কামড়ে ধরে পড়ে আছে (তাকে ছাড়তে চাচ্ছে না)।’

এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন :

‘এবং এ কথাটি লুকিয়ে রেখো না (অর্থাৎ বলার ক্ষেত্রে কোনো লজ্জা বা অস্বস্তিবোধ করো না)।’[4]

একটু চিন্তা করুন, রাসুলুল্লাহ ﷺ তার কথার মাধুর্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার বক্তব্য শ্রোতাদের মোহিত করে ফেলত, যা শুনে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এই মানুষটি কোনোদিন কাউকে গালি দেবেন বা খারাপ ভাষা ব্যবহার করবেন, এমনটা ভাবা যায়? অথচ তিনি এখানে তুলনা দিলেন ‘পিতার লজ্জাস্থান কামড়ে ধরা’র সঙ্গে। এটুকুতেই স্পষ্ট, কত বড় নোংরা জিনিস এই জাতীয়তাবাদ, যার তুলনা দিতে আল্লাহর রাসুল ﷺ পর্যন্ত এর চেয়ে ভালো শব্দ খুঁজে পাননি।

এ ছাড়াও জাতীয়তাবাদের কারণে ইসলামের একটি মূলনীতি ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়। ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’ অর্থ আল্লাহর জন্যই হৃদ্যতা স্থাপন করা আর আল্লাহর জন্যই সম্পর্ক ছিন্ন করা। একজন মুসলিমের প্রতি আরেকজন মুসলিমের বন্ধুত্ব থাকবে। যে কালিমা পড়েছে, সে মুসলিম, সে আমার ভাই, পৃথিবীর যে প্রান্তেরই হোক না কেন। আমার ওপর তার হক আছে। আর যারা ইসলামের সঙ্গে দুশমনি করে, তারা যত কাছের লোকই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহর কোনো শত্রু আমার বন্ধু হতে পারে না। একইভাবে আল্লাহর কোনো বন্ধু আমার শত্রু হতে পারে না। এটাই ‘আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’। কিন্তু জাতীয়তাবাদ মুসলিমদের এই সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল গড়ে দেয়। ভিনদেশের মুসলিমকে তখন আপন ভাবা যায় না, আবার নিজ দেশের কাফিরদের সঙ্গেও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে নিতে হয়।

একজন মুসলিম, সে বিশ্বের যে প্রান্তেরই হোক, আমার ভাই। একজন বাংলাদেশি মুসলিম আমার ভাই, তদ্রুপ একজন পাকিস্তানি, ভারতীয়, আফ্রিকান, সিরিয়ান, আরব বা আমেরিকান মুসলিমও আমার ভাই। কিন্তু জাতীয়তাবাদ এই ভ্রাতৃত্বকে অস্বীকার করে। সে শেখায়, পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের অত্যাচার করেছে, অতএব পাকিস্তানের সব মানুষ আমাদের শত্রু। তাদের ঘৃণা করতে হবে। অথচ বৃটিশরা দু শ বছর অত্যাচার করলেও তাদের গোলামি করতে আমাদের বাঁধে না। তাদের পোশাক, ভাষা ব্যবহার করলে ভাবি জাতে উঠে গেছি। জাতীয়তাবাদ এমনই অন্ধ, এমনই বিকৃত।

আজকে একটু চিন্তা করলেই দেখি, কত মুসলিমের কান্নার দায় আমরা বহন করছি। আমরা সাক্ষী হয়েছি বসনিয়ার গণহত্যায় নিহত হাজার হাজার মুসলিমের, ধর্ষিতা মা-বোনের। আমরা সাক্ষী হয়েছি গুজরাটের গণহত্যায় নিহত তিন হাজার মুসলিমের লাশের। আমরা সাক্ষী আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া আর মিশরের লক্ষ মুসলিমের কান্না আর লক্ষ শিশুর আর্তনাদের। আমরা সাক্ষী হয়েছি পাকিস্তানের ড্রোন হামলায় বিধ্বস্ত মুসলিম জনপদের। কী ভাবছেন? তাদের ব্যাপারে আমরা জিজ্ঞাসিত হব না? তাদের জন্য আমরা কী করেছি, এটা আমাদের জবাব দিতে হবে না? আমরা কী জবাব দেবো, সেদিন যখন আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে সেব্রেনিকায় ধর্ষিতা হয়ে মারা যাওয়া একটি বোন? কী জবাব দেবো, যখন আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে ইরাকের একটি শিশু? সে যদি এই কাপুরুষ মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে, আমাদের কোনো উপায় থাকবে কি?

না, থাকবে না। জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে সেদিন রেহাই পাওয়া যাবে না। ‘ও তো ভিনদেশের লোক’ বলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে সেদিন নিস্তার নেই।

জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে অন্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘লোকদের উচিত হলো, তারা যেন তাদের জাতি নিয়ে গর্ব করা ত্যাগ করে। কারণ তা জাহান্নামের আগুনের কয়লাগুলোর মধ্যে একটি কয়লা। যদি তারা তা পরিত্যাগ না করে, তবে আল্লাহ্ তাদেরকে সেই নিচু কীটগুলো থেকেও নীচ করে দেবেন যারা মল-বর্জ্যের মধ্যে নিজেরাই নিজেদের ঠেলে দেয়।’

ইসলামে জাত্যাভিমান বা বংশমর্যাদার গৌরব চরম নিন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ এই ব্যাপারগুলোকে জাহেলি যুগের কর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। ইসলামে মানুষের সম্মানের মানদণ্ড তার খোদাভীতি। এখানে গায়ের রং, বংশ, জাতি, ভাষা—এ সবই মূল্যহীন। নিগ্রো কৃতদাস বিলাল রা.-এর সম্মান কত বেশি, সে কথা আমরা জানি। তার জাতি ছিল সমাজে একেবারেই নিম্নশ্রেণি। আবার তৎকালীন আরবের উচ্চবংশ বলে পরিচিত কুরাইশ বংশের আবু জাহিল, আবু লাহাবরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তাদের জাতি তাদের মর্যাদাবান করতে পারেনি।

‘হে মানব, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক মর্যাদাবান, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।’[5]

অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সম্মানের মাপকাঠি কোনো জাতীয়তা নয়; বরং তাকওয়া এবং সৎকর্ম। কে কোথায় জন্মেছে, সেটার কোন দাম নেই এখানে। আমাদের কোনো দেশে জন্ম নেওয়াটা তো সম্পূর্ণ কাকতালীয় ব্যাপার। এর পেছনে আমাদের কোনোই অবদান নেই। সুতরাং কাকতালীয় ব্যাপার নিয়ে গর্ব-অহংকার করা তো নিতান্ত হাস্যকর ব্যাপার। পুরো পৃথিবী আল্লাহর তাআলার সৃষ্টি। কোনো মাটিকে ঘৃণা করার অবকাশ নেই। আমি জন্মেছি বলে সে মাটি পাক, আর আমার শত্রু জন্মেছে বলে সে মাটি নাপাক, এমনটা মনে করার কোনো অবকাশ ইসলাম দেয়নি।

রাসুল ﷺ বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন :

তাকওয়া ছাড়া আরবের ওপর অনারবের কিংবা অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

এই একটা বাক্য দিয়েই জাতীয়তাবাদের গর্বকে ধুলিসাৎ করে ফেলা হলো। অথচ আমাদের মাথায় ছেলেবেলা থেকে গেঁথে দেওয়া হয়, নিজের ভূমি, নিজের দেশ, নিজের ভাষা আর নিজের জাতি পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। জর্জ বার্নার্ড শ ব্যাপারটিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন এভাবে :

‘দেশপ্রেম হলো এমন একটা বিশ্বাস বা ধারণা যে, তোমার দেশ পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ, তুমি সেখানে জন্মেছ।’ 

এখানে ‘দেশপ্রেম’ বলতে তিনি জাতীয়তাবাদকেই বুঝিয়েছেন। কথাটির যথার্থতা সহজেই বোঝা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত এমনভাবে লেখা হয়, যেন সে দেশটিই জগতের সেরা। আমরা যেমন আমাদের দেশকে ‘সকল দেশের রাণী’ ভাবতে শিখি। অথচ এ দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক এতটুকুই যে, আমরা এখানে জন্মেছি। আমরা মিশরে জন্মালে মিশরকে সকল দেশের সেরা বলতাম, আমেরিকায় জন্মালে সেটা হতো সেরা দেশ, ফিলিপাইনে জন্মালে বলতাম এটাই সকল দেশের রাণী।

আজকাল তো অবস্থা এমন হয়েছে যে, জাতীয়তাবাদ যে কুফর, এই জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত ছোবলেই যে মুসলমানদের খিলাফতব্যবস্থার পতন ঘটেছে, মুসলমানরা তা রীতিমতো ভুলেই গেছে। এ কারণে কেউ গলায় কিংবা বাড়িতে ক্রুশ ঝুলালে আমরা সেটাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে হারাম বলে ঘোষণা করি। এমনকি গলায় টাই পরার বিপক্ষেও আমরা সরব। শার্ট-প্যান্টের বিরুদ্ধে বলতেও কম বলি না। কিন্তু জাতীয়তাবাদের মতো এক ভয়াবহ কুফরি মতবাদের ব্যাপারে এবং তার প্রতীকসমূহের ব্যাপারে আমরা বরাবরই শিথিল আচরণ করি। এ জন্যই আজকাল মাদরাসাগুলোর ওপরও পতপত করে জাতীয়াতাবাদের প্রতীক পতাকা উড়তে দেখা যায়। কোনো কোনো মাদরাসায় দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতও গাওয়া হয়। এগুলোকে কোনো গুনাহই মনে করা হয় না কিংবা সরকারি চাপের ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে এসবকে অঘোষিত বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন-প্রতিবাদেরও কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় না। কিন্তু এর জায়গায় শূল স্থাপন কিংবা খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় সঙ্গীত গাওয়ার আইন জারি করা হলে তা নিয়ে ঠিকই আন্দোলন-প্রতিবাদ হতো। এর অর্থ হচ্ছে, জাতীয়তাবাদের কুফরকে আমাদের সমাজের রন্ধে রন্ধে; বরং দেহের শিরা-উপশিরায় এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এখন তার বোধ-উপলব্ধিও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তা যে কোনো কুফরি মতবাদ, তা-ই পুরোদমে ভুলে গেছি।

অথচ আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের বিজয় রেখেছেন জাতীয় ঐক্যের মধ্যে। কুরআন বলছে : ‘তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিভক্ত হোয়ো না।’[6] সহিহ হাদিসে এসেছে : ‘আল্লাহর সাহায্য জামাআতের ওপর।’ ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে কোনো বিভক্তি থাকতে পারে না। বিভক্তি থাকবে কেবল মুমিন এবং কাফিরদের মধ্যে। কারণ, আল্লাহ বলেন : তিনি ওই সত্তা, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফির, আর কেউ মুমিন।’[7] কাফিররা শুরু থেকেই মুসলমানদের থেকে আলাদা। আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ ﷺ এবং সাহাবিদের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : ‘তারা কাফিরদের ওপর প্রচণ্ড কঠোর এবং পরস্পরের ক্ষেত্রে দয়ালু।’[8] আল্লাহ যাদের ভালোবাসেন, তাদের গুণ হিসেবেও এটাই উল্লেখ করেছেন : ‘তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর।’[9] কিন্তু জাতীয়তাবাদ এই মূলনীতিকে একেবারেই বরবাদ করে দিয়েছে।

জাতীয়তাবাদ আমাদের শেখায়, এ মাটিতে যারা জন্মেছে, তারা মুমিনই হোক আর কাফিরই হোক, তারা আমাদের ভাই ও বন্ধু। অপরদিকে এই মাটির শত্রু যারা, তারা যত ভালো মুমিনই হোক না কেন, তারা আজন্ম আমাদের শত্রু। এ কারণে বাঙালিরা পাকিস্তানিদের আজন্ম ঘৃণা করে। কারণ, সে মানুষগুলোর অপরাধ হলো, তারা এ মাটিতে না জন্মে ও মাটিতে জন্মেছে। এ পাপ চিরকাল তারা বয়ে বেড়াবে।

এ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করেই রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন : ‘তোমরা বন্যার খড়কুটোর মতো নিরেট খড়কুটোতে পরিণত হবে। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের প্রতি ভয় উঠিয়ে নেবেন এবং তিনি তোমাদের অন্তরে আল-ওয়াহান ছুড়ে দেবেন।’[10]

জাতীয়তাবাদের সবকিছু ইসলাম থেকে আলাদা। জাতীয়তাবাদ এক স্বতন্ত্র ধর্ম। এর রয়েছে আলাদা আচার-প্রথা, আলাদা সভ্যতা-সংস্কৃতি। এমনকি জাতীয়তাবাদ আমাদের শেখায়, এ জাতির পিতা অমুক; যেখানে ইসলাম শেখায়, মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ.। কবি ইকবাল রহ. বলেন :

ইন তাজা খোদাওউ মেঁ বড়া সব সে ওয়াতান হ্যায়,

জো পয়রহন উস কা হ্যায়, ও মিল্লাত কা কাফন হ্যায়।

‘এই তাজা মূর্তগুলোর মধ্যে সবচে বড় হলো দেশ।

তার বসন হলো ওই বস্ত্রখণ্ড, যা ধর্মের কাফনের কাপড়।’

শেষ জামানায় সংঘটিত গাজওয়াতুল হিন্দের সৈনিক হবে তারাই, যারা থাকবে এই জাতীয়তাবাদের বন্ধন থেকে মুক্ত, ইসলামের জন্য উৎসর্গিত।


[1] Nairn, Tom; James, Paul (২০০৫)। Global Matrix: Nationalism, Globalism and State-Terrorism। London and New York: Pluto Press।; and James, Paul (২০০৬)। Globalism, Nationalism, Tribalism: Bringing Theory Back In – Volume 2 of Towards a Theory of Abstract Community। London: Sage Publications।

العناصر الأساسية في تكوين القومية هي وحدة اللغة ووحدة التاريخ، وما ينتج عن ذلك من مشاركة في المشاعر والمنازع، وفي الآلام والآمال… (الفكر القومي العربي)

[2] আবু দাউদ : ৫১২১

[3] আবু দাউদ : ৫১১৯

[4] মুসনাদু আহমাদ : ২১২৩৬

[5] সুরা হুজুরাত : ১৩

[6] সুরা আলে ইমরান : ১০৩

[7] সুরা তাগাবুন : ২

[8] সুরা ফাতহ : ২৯

[9] সুরা মায়িদা : ৫৪

[10] সুনানু আবি দাউদ : ৪২৯৭

Share This