রুশদের বিরুদ্ধে এশিয়া মাইনরে ইমাম গাজি ও ইমাম শামিল রহ. প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আফ্রিকায় সানুসিরা এবং উপমহাদেশে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি রহ.-এর সন্তানরাও ময়দানে নেমে এসেছিলেন। সায়্যিদ আহমদ শহিদ বেরেলবি রহ. থেকে সূচিত হয়ে কাসিম নানুতবি রহ.-এর দেওবন্দি মাকতাবায়ে ফিকির অথবা মাওলানা জাফর থানেশ্বরি রহ.-এর আহলে হাদিস মাকতাবায়ে ফিকির সবই সূচনালগ্নে সেই মহান লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার পথেই হেঁটেছে। এমনকি যে মিথ্যা মোকাদ্দিমা দায়ের করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে মাজলুম ফরজপন্থী আলিমগণকে কালাপানির শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তাতে হিন্দুস্তান আহলে হাদিস জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা নজির হোসাইনও শামিল ছিলেন, যিনি মাওলানা জাফর থানেশ্বরি ও আল্লামা শাহ ইসহাক রহ.-এর শাগরিদ ছিলেন।

দীর্ঘকাল আলো বিকিরণ করার পর একসময় উপরিউক্ত সবগুলো প্রদীপই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। সময়ের ব্যবধানে স্থানীয় গাদ্দার ও মুরতাদদের ষড়যন্ত্রের ফলে সবগুলো আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলের ওপর পশ্চিমা আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তখন জি হা দি আন্দোলনের তুলনায় দাওয়াতের প্রতিই তৎকালীন আলিমরা অধিক মনোনিবেশ করেন। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় পশ্চিমা আগ্রাসন রুখে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এর পাশাপাশি জি হা দের সঠিক তত্ত্বকেও তারা পুনর্জীবিত রাখেন; তবে কার্যত পরিস্থিতির তাকাজায় দাওয়াতের মানহাজের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে মিশরে হাসান আল-বান্না ও সায়্যিদ কুতুবের ইখওয়ানুল মুসলিমিন, আলজেরিয়ায় আবদুল হামিদ ইবনু বাদিসের জমিয়তু উলামায়িল জাযায়িরিন, ভারতীয় উপমহাদেশে উলামায়ে দেওবন্দের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এবং মাওলানা মওদুদির জামাআতে ইসলামি প্রতিষ্ঠিত হয়। এসকল আন্দোলন মুসলিম দেশগুলোতে ইসলাম বাস্তবায়নের দাবি তোলে আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাশ্চাত্যের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলে।

মুসলিম জনসাধারণের আবেগকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনগুলো অল্প সময়েই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এসব বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনকেও খুব বেশি ইতিবাচকভাবে নিতে পারেনি। এ কারণে তারা সুকৌশলে এই আন্দোলনগুলোকেও রুখে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিমা বিশ্ব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির স্বপ্ন দেখিয়ে মুসলিম দেশগুলোকে নিজেদের অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করে। প্রতিটা দেশে পুতুল শাসকদের ক্ষমতায় বসিয়ে পর্দার ওপার থেকে আমেরিকা তার স্বার্থ পূরণ করতে থাকে।

এক্ষেত্রে ইসলামি আন্দোলনগুলো বড় একটি সরলতা বা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে তারা জাতীয়তাবাদীদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে। তারা দিবাস্বপ্ন দেখেছিল, জাতীয়তাবাদীদের হাতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানে তারা খুব সহজেই ইসলাম বাস্তবায়ন করতে পারবে। জাতীয়তাবাদীরাও তাদের এই সরলতা বা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে নেয়। কিন্তু এসব ইসলামপন্থীরা বুঝতে পারেনি, জাতীয়তাবাদীরা কখনো ইসলামের কল্যাণকামী হতে পারে না। কুফরি মতবাদের ধ্বজাধারী কেন ইসলামের নিঃস্বার্থ সেবকে পরিণত হবে? একমাত্র রাজনৈতিক ধান্ধা ছাড়া এর পেছনে আর কী যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে!

প্রতিটি দেশে জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের শিকড় মজবুত করার পর শক্ত হাতে সহিহ ধারার ইসলামি আন্দোলন নির্মূল করতে লাগল। মিশরে জামাল আবদুন নাসের ক্ষমতায় এসে সায়্যিদ কুতুব, আবদুল কাদির আওদাহ ও অন্য অনেক ইখওয়ান নেতাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলায়। শামে হাফিজ আসাদ ক্ষমতা লাভ করে ইখওয়ান নেতাদেরকে গ্রেফতার করে আর যখন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয় তখন শায়খ মারওয়ান-সহ ইসলামি আন্দোলনের হাজারো কর্মীকে নির্মমভাবে শহিদ করে দেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেখানকার নামধারী মুসলিম শাসকরা যখন ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের আসল রূপ প্রকাশ করে, তখন আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানি রহ. আকাবিরে দেওবন্দের চেতনা বুকে ধারণ করে বিপ্লবের সূচনা করার মনস্থ করেন এবং স্বল্প পরিসরে তার সূচনাও করে ফেলেন। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাকে বিষ প্রয়োগ করে শহিদ করে দেওয়া হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র দু-বছর পর খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের সময় হাজার হাজার আলিম-তালিবুল ইলমকে শহিদ করা হয় এবং শীর্ষস্থানীয় অসংখ্য আলিমকে জিন্দানখানায় ফেলে রাখা হয়।

ইসলামি আন্দোলনগুলো শুরুতে জাতীয়তাবাদীদের স্পষ্ট সমর্থন দিয়েছে এবং তাদের থেকে ইসলাম বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়েছে। কিন্তু এই মুরতাদরা ক্ষমতায় যাওয়ার পর কোনো অঙ্গীকারের কথা স্মরণ রাখেনি; বরং তারা গাদ্দারি করেছে এবং পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। তখন তাদের বিরুদ্ধে যারাই মাঠে নেমে এসেছে বা বিপ্লবের সূচনা করতে চেয়েছে, তারা তাদের সবাইকে টার্গেট করেছে। কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে বন্দী করেছে আর কাউকে নিজেদের তাবেদারে পরিণত করেছে। এর পরবর্তী ধাপে এসে ইসলামি আন্দোলনগুলো দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে এবং তারা সিস্টেমের ভেতর ঢুকে সিস্টেম পরিবর্তন করতে চায়। আরেকদল অরাজনীতিক থেকে দাওয়াতি পন্থায় সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং যুগের কোনো সালাহুদ্দীনের আগমনের জন্য নীরবে প্রতীক্ষা করে যাচ্ছে।

সূচনাটা এমনই ছিল। বর্তমান তো আমাদের সামনেই আছে। পূর্ববর্তীদের ভুল পরবর্তীদের জন্য অনুসরণীয় হয় না; বরং সেই ভুল থেকে সতর্কতার সবক নিতে হয়। কারণ মুমিন এক গর্তে দুবার দংশিত হয় না। আজ যারা বর্তমান, পরবর্তী প্রজন্মের নিকট তারাই কিন্তু পূর্বসূরি। আচ্ছা, এই পূর্বসূরিরা পরবর্তী উত্তরসূরিদের জন্য কী আদর্শ রেখে যাচ্ছে? ইতিহাস তো অনেক কিছুই সংরক্ষণ করবে। ডিজিএফআই ও বিডিআর’র ওপর রোহিঙ্গা মু জা হি দ বাহিনী আরসা’র আস্থা রাখা ও নির্ভর করা, তারেক রহমানের আশ্বাসে মুফতি হান্নানের বোমা বিস্ফোরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া, বিরোধী দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ৫ই মে শাপলাচত্ত্বরে হেফাজতের রাত্রিযাপন করা, পার্থিব উন্নতির স্বপ্নে হাইয়া’র উদ্যোগে দেশের সব আলিমদের নিয়ে শুকরানা মাহফিলের আয়োজন করা, অবশেষে গহরপুরি, জাহানাবাদি ও বরিশালি হজরতদের রক্ত-ঘাম নিঃশেষ করে তিলে তিলে গড়ে তোলা বেফাক নিয়ে নির্লজ্জ সিন্ডিকেট করা। ইতিহাস মীর জাফরকে ক্ষমা করেনি; এখনকার হাজারো মুরিদের এসব অপরাধী পির ও কুতুবদেরও ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করবে না তাদেরও, যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে কুফরি ইজমকেই নিজেদের মানহাজ বানিয়ে নিয়েছে এবং প্রস্রাব দিয়ে ধুয়ে দুধকে পবিত্র করতে চাচ্ছে।

Share This