একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হলো, এই জগতে এমন বহু বিষয় আছে, যা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব তো এমন সত্য, যা প্রতিটি মানুষ নিজ জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে; কিন্তু তাঁর সত্তা ও গুণাবলি সম্পর্কিত বিস্তারিত জ্ঞান মানুষের সীমিত বুদ্ধি দ্বারা আহরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, তা এর বহু ঊর্ধ্বের বিষয়। কুরআন মাজিদ যেখানে আল্লাহ তাআলার সে সকল গুণের উল্লেখ করেছে, সেখানে তা দ্বারা তাঁর অপার শক্তি ও মহা প্রজ্ঞাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি সে সকল গুণের হাকিকত ও সত্তাসারের দার্শনিক অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়, তবে তার হয়রানি ও গোমরাহি ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হবে না। কারণ, সে তার সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহ তাআলার অসীম গুণাবলির রহস্য আয়ত্ত করতে চাচ্ছে, যা তার উপলব্ধির বহু ঊর্ধ্বের।

উদাহরণত, কুরআন মাজিদের কয়েক জায়গায় ইরশাদ হয়েছে—আল্লাহ তাআলার একটি আরশ আছে এবং তিনি সেই আরশে ইসতিওয়া করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আরশ কেমন? আর তাতে তার ইসতিওয়া করার দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? এসব এমন প্রশ্ন, যার উত্তর মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির বাইরের জিনিস। তাছাড়া মানবজীবনের কোনো কর্মগত মাসআলা এর ওপর নির্ভরশীলও নয়। এজাতীয় বিষয় যেসব আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলোকে ‘মুতাশাবিহ’ আয়াত বলে। এমনিভাবে বিভিন্ন সুরার শুরুয়ে যে পৃথক পৃথক হরফ (অক্ষর) নাজিল করা হয়েছে, (যেমন : ‘আলিফ লাম মিম’, ‘হা-মিম’, ‘তোয়াহা’, ‘সোয়াদ’, ‘ইয়াসিন’ ইত্যাদি) যাকে আল-হুরুফুল মুকাত্তাআত বলা হয়, তা-ও মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত। মুতাশাবিহাত সম্পর্কে কুরআন মাজিদ নির্দেশনা দিয়েছে যে, এর তত্ত্ব-তালাশের পেছনে না পড়ে, বরং সংক্ষিপ্তভাবে এর প্রতি ইমান আনতে হবে। আর এর প্রকৃত মর্ম কী, তা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এর বিপরীতে কুরআন মাজিদের অন্যান্য যে আয়াতসমূহ আছে, তার মর্ম সুস্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে সে সকল আয়াতই মানুষের সামনে কর্মগত পথনির্দেশ পেশ করে। এরকম আয়াতকে মুহকাম আয়াত বলে। একজন মুমিনের কর্তব্য বিশেষভাবে এজাতীয় আয়াতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা।[1]

ইসতিওয়া আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ : সোজা হওয়া, কায়েম হওয়া, আয়ত্তাধীন করা ইত্যাদি। কখনো এ শব্দটি বসা ও সমাসীন হওয়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা যেহেতু শরীর ও স্থান থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তাই তাঁর ক্ষেত্রে শব্দটি দ্বারা এরূপ অর্থ গ্রহণ করা সঠিক নয় যে, মানুষ যেভাবে কোনো আসনে সমাসীন হয়, তেমনিভাবে (নাউজুবিল্লাহ) আল্লাহ তাআলাও আরশে উপবিষ্ট ও সমাসীন হন। প্রকৃতপক্ষে ‘ইসতিওয়া’ আল্লাহ তাআলার একটি গুণ। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কিরামের মতে এর প্রকৃত ধরন-ধারণ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তাদের মতে এটা মুতাশাবিহাত (দ্ব্যর্থবোধক) বিষয়াবলির অন্তর্ভুক্ত, যার খোঁড়াখুঁড়িতে লিপ্ত হওয়া ঠিক নয়। সুরা আলে ইমরানের শুরুভাগে আল্লাহ তাআলা এরূপ মুতাশাবিহ বিষয়ের অনুসন্ধানে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। সে হিসেবে এর কোনো তরজমা করাও সমীচীন মনে হয় না। কেননা, এর যেকোনো তরজমাতেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ আছে। তাই আমরা এর তরজমা করি না। তাছাড়া এর ওপর কর্মগত কোনো মাসআলাও নির্ভরশীল নয়। এতটুকু বিশ্বাস রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা নিজ শান অনুযায়ী ‘ইসতিওয়া’ করেছেন, যার স্বরূপ ও প্রকৃতি উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি মানুষের নেই।[2]

‘ইসতিওয়া’র শাব্দিক অর্থ : সোজা হওয়া, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সমাসীন হওয়া ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিসদৃশ নন। তিনি কোনো সৃষ্টির মতোই নন। কাজেই তার ‘ইসতিওয়া’র সৃষ্টির ইসতিওয়ার মতো নয়। এর স্বরূপ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এ কারণেই আমরা কোনো তরজমা না করে হুবহু শব্দটিকেই রেখে দিয়েছি। কারণ, আমাদের জন্য এতটুকু বিশ্বাস রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা নিজ শান মোতাবেক আরশে ইসতিওয়া করেছেন। এ বিষয়ে এরচে বেশি আলোচনা-পর্যালোচনার দরকার নেই। কেননা, আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা এর সবটা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।[3]


[1] তাফসিরে তাওজিহুল কুরআন থেকে সুরা আলে ইমরানের ৭ম আয়াতের টীকা থেকে গৃহীত।

[2] তাফসিরে তাওজিহুল কুরআন থেকে সুরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াতের টীকা থেকে গৃহীত।

[3] তাফসিরে তাওজিহুল কুরআন থেকে সুরা ইউনুসের তৃতীয় এবং সুরা রাদের দ্বিতীয় আয়াতের টীকা থেকে গৃহীত।

Share This