মিডিয়ার কল্যাণে বা অকল্যাণে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য হলো, “ইসলাম সাম্যের ধর্ম”।  কেউ আবার এভাবেও বলে, “ইসলামই একমাত্র সাম্যের শিক্ষা দিয়েছে”।  আরো দশটি কথার মতো এটা শুধু একটা কথাই নয়। বরং এটাকে একটা সর্বব্যাপী মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের আরো কিছু মূলনীতি প্রচলিত, যেমন “ইসলাম শান্তির ধর্ম”। প্রথমে এভাবে মূলনীতি গঠন করা হয়। এরপর মূলনীতির আলোকে শত শত বিধান উদ্ঘাটন করা হয়। কারা করেন? আমাদের মুফতি সাহেবরা? না, তা নয়। বরং করে কুফফার গোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা। অবশ্য তাদের পাতানো ফাঁদে দু-একজন মৌলবি সাহেবও পা দেন। যেমন, শেষোক্ত মূলনীতির প্রয়োগ এভাবে করা হয়— “যেহেতু ইসলাম শান্তির ধর্ম। সুতরাং ইসলামে কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ নেই। কোরআন-হাদিসে যে জিহাদের কথা এসেছে, তা প্রথমত নফসের সাথে জিহাদ। কেননা নফসের জিহাদকেই হাদিসে বড় জিহাদ বলা হয়েছে। আর ছোট জিহাদ হলো, ইসলামি বা মুসলিমপ্রধান সেকুল্যার রাষ্ট্রের (মুসলিম বা অমুসলিম) সরকারের নির্দেশে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত যুদ্ধ। বাকি সব সন্ত্রাস।” এটা একটা সাধারণ উদাহরণ মাত্র। অন্যথায় এই মূলনীতিকে কেন্দ্র করে শত শত বিধান বর্ণনা করা হয়।

ঠিক তেমনই দ্বিতীয় মূলনীতির ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, “যেহেতু ইসলাম সাম্যের ধর্ম, তাই নারী-পুরুষের অধিকারও সমান হওয়া উচিত। ভাই-বোন মৃত বাবার সম্পদ থেকে সমবণ্টনে উত্তরাধিকার লাভ করা উচিত। দেশীয় নাগরিক হিসেবে সকল ধর্মের অনুসারীরা সমমর্যাদা লাভ করা উচিত। অমুসলিমদের আলোচনা এলে সকল অমুসলিমকে সাম্যের ভিত্তিতে এককাতারে দাঁড় করিয়ে বিধান বর্ণনা করা উচিত।” এটাও সাধারণ উদাহরণ মাত্র। এই মূলনীতির থেকে উদ্ঘাটিত বিধানের সংখ্যাও কম নয়।

এই মূলনীতিগুলোকে তারা নিজেদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে না। তারা কোনো পথ দিয়ে গেলেও যাতায়াতের পূর্বাপর মিলিয়ে কয়েক ঘন্টা সেই পথে সাধারণ জনগণের যানবাহন চলাচল করতে পারে না। সাধারণ জনগণ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং তাদেরকে সমর্থনকারী বিভিন্ন গ্রুপের মতো সুবিধাদি পায় না। গ্রামবাসীরা শহরবাসীদের মতো বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য সুবিধাদি পায় না। কোথাও অপচয়কৃত বিদ্যুতের পরিমাণই থাকে কয়েক লাখ ইউনিট আর কোথাও সারাদিন মিলিয়ে পাঁচ ঘন্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। কখনো তো দু-তিনদিনেও বিদ্যুতের দেখা মিলে না। রাষ্ট্রের কোটিপতি যে হারে পণ্যের ভ্যাট প্রদান করে, এক বুড়ি ভিখারীকে সারাদিন ভিক্ষা করে ওষুধপত্র বা সাধারণ যেকোনো পণ্য কিনতে হলেও সমহারেই ভ্যাট প্রদান করতে হয়। সমতার দাবি দুনিয়াবি কোনোক্ষেত্রেই তারা প্রয়োগ করে না। অথচ এর প্রয়োগক্ষেত্র ছিলোই এগুলো। মানুষ হিসেবে সকলেই সমান। যে কাতারে রাষ্ট্রপ্রধান দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে, একই কাতারে তারই পাশে এক ভিক্ষুকও দাঁড়াতে পারে। আমাদের দেশে পারে না। আমাদের দেশে মসজিদে থাকাবস্থায় অফিসার এলেও আর্মি সদস্যরা দাঁড়িয়ে স্যালুট দেয়। জায়নামাজ বিছিয়ে সামনের কাতার ভিআইপি পার্সনদের জন্য বুক করে রাখা হয়। তবে মূলবিধান এক্ষেত্রে সমতাই ছিলো। যার কারণেই তো ইমামের সোজা পেছনে মুআজ্জিন সাহেবের স্থায়ীভাবে জায়গা দখল নিয়েও ফিকহি আলোচনার অবতারণা হয়েছে। দুনিয়াবি ক্ষেত্রে সকলেই নিজ স্বার্থ রক্ষার মূলনীতি মেনে চলে আর যতো আঘাত-প্রতিঘাত সব পড়ে দীন-ধর্মের ওপর। আরে সাম্যই যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে মনে করুন, দু’বন্ধুর অধিকারও সমান হওয়ার কথা। পুলিশ জনগণের বন্ধু, তার মানে জনগণও পুলিশের বন্ধু। তাহলে বন্ধু পুলিশ যেভাবে দিনরাত খোল্লমখোলা জুলুম করে আর জনগণের পকেটের টাকা নিয়ে পেট ফোলায়, বন্ধু জনগণেরও তো সেই অধিকার লাভ করা উচিত। বিচারবিভাগে রাষ্ট্রপক্ষ যেভাবে সুবিধাদি পায়, বিপরীত পক্ষেরও পাওয়া উচিত। সরকার পক্ষের মন্ত্রী সচিব এমপি আমলাদেরও মাঝে মাঝে লাল গুদামের ভাত খাওয়া উচিত। এ ধরনের উচিতের ফিরিস্তি দীর্ঘ। আরে, উচিত তো পরে, ওরা সাম্যেই যদি বিশ্বাসী হতো, তাহলে হিন্দু বাবুকে দেখে সশ্রদ্ধ সালাম আর হুজুরকে দেখলে নাক ছিটকানি উপহার দিতো না, ইসলামি আচাররীতিকে সেকেলেপনা আর হিন্দুয়ানি অসার সংস্কৃতিকে আধুনিকতা ও দেশপ্রেম বলে অভিহিত করতো না।

যারা বলে “ইসলাম সাম্যের ধর্ম”, তারা দুই শ্রেণী— একশ্রেণী হলো নির্বোধ শ্রেণী, যারা সামনে কলা ঝুলতে দেখলেই স্বাগ্রহে কামড় বসিয়ে দেয়, কলায় কোনো বিষক্রিয়া আছে কিনা, তা যাচাই করার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হলো স্বার্থপর শ্রেণী, যারা পর্দার আড়ালে থেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এসব প্রচারণা করে এবং ইসলামের বারোটা বাজানোর জন্য সুকৌশলে এমন সব মনোরম ফাঁদ বিছিয়ে রাখে, স্বল্প সংখ্যক সচেতন লোক ছাড়া সকলেই প্রায় তাতে পা দিয়ে বসে।

ইসলাম ইনসাফের ধর্ম। ইসলাম ইনসাফে বিশ্বাসী, সাম্যে নয়। এখন কোনোক্ষেত্রে সাম্যটাই যদি ইনসাফ হয়, তাহলে ইসলাম সেক্ষেত্রে সাম্যের কথা বলে। আর যেখানে সাম্য জুলুম হয়, সেখানে ইসলাম সাম্যকে প্রত্যাখ্যান করে। কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাম্যকে অস্বীকার করেছেন। উদাহরণস্বরূপ দেখুন—

قل هل يستوي الذين يعلمون والذين لا يعلمون

هل يستوي الأعمى والبصير أم هل تستوي الظلمات والنور

لا يستوي منكم من أنفق من قبل الفتح وقاتل أولئك أعظم درجة من الذين أنفقوا من بعدُ وقاتلوا

لا يستوي القاعدون من المؤمنين غير أولي الضرر والمجاهدون في سبيل الله

এরকম আয়াতের অভাব নেই। মর্যাদার ক্ষেত্রেও ইসলাম যেমন সাম্যের কথা বলেনি, অধিকারের ক্ষেত্রেও ইসলাম সাম্যের কথা বলেনি। ইসলাম ইনসাফের শিক্ষা দিয়েছে। সবক্ষেত্রে ইনসাফকে আঁকড়ে ধরতে বলেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে আলিম-অআলিম সমান হতে পারে না, মুজাহিদ-অমুজাহিদ সমান হতে পারে না, শহিদ-অশহিদ সমান হতে পারে না। কোনো পীর যতোবড়ই হোক, কখনোই তিনি একজন শহিদের সমপর্যায়ের নন। এজন্যই তো নবি হওয়া সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ সা. শাহাদাত লাভের জন্য কী পরিমাণ আকুতি-প্রার্থনা করেছেন, সাহাবারাও করেছেন, আকাবিররাও করেছেন। একজন তাবলিগের সাথির মর্যাদা আর একজন মুজাহিদের মর্যাদা কস্মিনকালেও সমান তো দূরের কথা, কাছাকাছিও হতে পারে না। তেমনই অধিকারের ক্ষেত্রেও দু’জন ব্যক্তি সমান হতে পারে না। রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নারীর হাতে যেতে পারে না, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ভাই-বোন সমান অংশ পেতে পারে না, চুক্তিকারী কাফির আর চুক্তিহীন কাফিরের অধিকার-বিধান এক হতে পারে না।

সাম্যের স্লোগান আদতে ইসলামের স্লোগান নয়, বরং গণতন্ত্রের স্লোগান, ব্যক্তিস্বাধীনতা তথাকথিত মানবাধিকার এবং জাতীয়তাবাদের স্লোগান। কোরআন সুন্নাহ থেকে কেউ ইসলামকে সাম্যের ধর্ম প্রমাণ করতে পারবে না। ইসলাম ভারসাম্যের ধর্ম, ইনসাফের ধর্ম। যেক্ষেত্রে ইনসাফ সাম্যে সেক্ষেত্রে সাম্য, যেক্ষেত্রে ইনসাফ অসাম্যে সেক্ষেত্রে অসাম্য। এ ধরনের সারহীন মূলনীতি আদতে চকচকে মনে হলেও এগুলো একেকটা জিকা ভাইরাসের থেকেও ভয়ংকর।

 

Share This