ইলম দু-প্রকার : (ক) ইলম বিল্লাহ, (খ) ইলম বি আমরিল্লাহ। ইলম বিল্লাহ অর্থ হলো আল্লাহ সম্পর্কিত ইলম। ইলম বি আমরিল্লাহ অর্থ আল্লাহর বিধিবিধান-সংক্রান্ত ইলম। দ্বিতীয় প্রকার ইলমের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। মুফতি, মুহাদ্দিস, ফকিহ, আলিম, তালিবুল ইলম—তারা সকলেই আল্লাহর বিধিবিধানের জ্ঞান অর্জন করে থাকে। কিন্তু এটা হলো ইলমের দ্বিতীয় প্রকার। ইলমের প্রথম প্রকার হচ্ছে আল্লাহ সম্পর্কিত ইলম। আল্লাহ তাআলা গোটা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, জিন ও ইনসান পয়দা করেছেন এবং তাদের ওপর বিধিবিধান অবতীর্ণ করেছেন; যেন তারা ইলম বিল্লাহ অর্জন করে। কুরআনে এসেছে :

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا

আল্লাহ সেই সত্তা, যিনি সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং তার অনুরূপ পৃথিবী। এসবের মধ্যে বিধান অবতীর্ণ হয়; যেন তোমরা জানতে পারো যে, আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম এবং তিনি সবকিছু জ্ঞান দ্বারা পরিবেষ্টিত করে রেখেছেন। {সুরা তালাক : ১২}

এই আয়াতের আলোকে প্রতিভাত হয়, ইলম বি আমরিল্লাহ’র মূল লক্ষ্যও হলো ইলম বিল্লাহ অর্জন করা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার সত্তা, নাম ও গুণাবলির ইলম অর্জন করা; পরিভাষায় যেটাকে আমরা তাওহিদ বলে থাকি। তাওহিদুয যাত এবং তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাতের ইলম বান্দার যত বেশি অর্জন হবে, তার ইমান তত দুরস্ত হবে। কারণ, ইমানের প্রথম ধাপই হলো তাওহিদ; যার মধ্যে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ, উলুহিয়্যাহ, হাকিমিয়্যাহ, আসমা ওয়াস সিফাত সবই শামিল। আর এটা তো স্পষ্ট যে, বান্দার ইমানের গুণগত মান যত বৃদ্ধি পাবে, তার ভেতরে আল্লাহ তাআলার ভয়ও তত বেশি সৃষ্টি হবে। এ জন্যই ইরশাদ হয়েছে :

إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ

আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ভয় করে আলিমরা। {সুরা ফাতির : ২৮}

এখানে আলিম শব্দ দেখে অনেকে ভাবে, এর দ্বারা বোধ হয় আলিম বি আমরিল্লাহ উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। বরং আয়াতে আলিম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আলিম বিল্লাহ; তথা যারা আল্লাহ তাআলার মারিফাত অর্জন করেছে, তাঁর তাওহিদের ইলম হাসিল করেছে। আমরা আয়াতের যথাযথ অর্থ বুঝিনি দেখেই এ নিয়ে অন্তরে বিভিন্ন সংশয় জাগ্রত হয়। অন্যথায় আয়াতের সহিহ তাফসির হৃদয়ঙ্গম করে নিলে এ ব্যাপারে কোনো সংশয় জাগ্রত হওয়ার কথা নয়; বরং প্রশান্তচিত্তে মুমিন ব্যক্তি এর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করবে।

পৃথিবীতে সবাই মুফতি-মুহাদ্দিস ও পূর্ণাঙ্গ আলিম বি আমরিল্লাহ হবে না (ফরজে আইন পরিমাণ বিধিবিধানের জ্ঞান তো অবশ্যই লাগবে); কিন্তু প্রত্যেক মুমিনকেই আলিম বিল্লাহ হতে হবে। অন্যথায় তার ইমান কখনোই পরিপূর্ণ হবে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন :

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

আর আমি জিন ও মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছি শুধুই আমার ইবাদত করার জন্য। {সুরা যারিয়াত : ৫৬}

ইবাদতের প্রথম ধাপও হলো তাওহিদ বিশুদ্ধ করা। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বিরচিত ও আমাদের অনূদিত ‘দাসত্বের মহিমা’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা এসেছে। উপরন্তু সালাফদের একদল মুফাসসির উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যেন তারা আমার মারিফাত অর্জন করে’। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বান্দা কখনোই আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে পরিপূর্ণ ইলম ও মারিফাত অর্জন করতে পারবে না। কারণ, নশ্বর সৃষ্টি অবিনশ্বর স্রষ্টাকে এবং সসীম মানুষ অসীম রবকে কখনো তার জ্ঞান দ্বারা পরিব্যাপ্ত করতে পারে না। বান্দা আল্লাহর ব্যাপারে ততটুকুই জানতে পারে, যতটুকু আল্লাহ জানিয়েছেন। এ জন্যই তিনি বান্দাকে শুধু বিবেক দিয়েই উন্মুক্ত প্রান্তরে ছেড়ে দেননি; বরং কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, কিতাবের ব্যাখ্যাকারী নবি পাঠিয়েছেন, নবির হাতে এক মডেল প্রজন্ম গড়ে তুলেছেন, এরপর তাদের দ্বারা সারা পৃথিবীতে সেই জ্ঞান বিস্তৃত ও প্রসারিত করেছেন।

সুতরাং আল্লাহর মারিফাত অর্জন করতে চাইলে শুধু বিবেকের ঘোড়া দৌড়ানোই যথেষ্ট নয়; বরং সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে হবে, পথ ধরে গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে। হ্যাঁ, বিবেককেও অকার্যকর ফেলে রাখার সুযোগ নেই। একমাত্র গুটিকয়েক মুতাশাবিহ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে বিবেকবুদ্ধির ঢের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ জন্যই তো কুরআনে আল্লাহ জায়গায় জায়গায় মানুষের বিবেককে আকর্ষণ করেছেন, আকলবুদ্ধিকে জাগ্রত করেছেন। যারা এই বিবেককে মোটেও কাজে লাগায় না, অন্ধত্ব তাদেরকে একসময় অন্ধকারের অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে মারে। সহিহ আকলের সঙ্গে সহিহ নকলের কোনো সংঘর্ষ নেই। বিবেকের সঠিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে ওহির শিক্ষার কোনো বিরোধ নেই। হ্যাঁ, বিবেকের ফায়সালা সঠিক কি না, তা যাচাই করার মানদণ্ডও আল্লাহ বানিয়েছেন কুরআন-সুন্নাহকে। সুতরাং মুমিন মুতাজিলাদের মতো বিবেকপূজারীও হয় না, আবার মুশাববিহা-মুজাসসিমাদের মতো বিবেককে বন্ধকও দিয়ে রাখে না। বরং সে দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য করে। প্রান্তিকতামুক্ত অবস্থানে থাকে। আর এর নামই হচ্ছে সিরাতে মুসতাকিম।

Share This