কিছু সাদামাটা কথা বলি। কার পছন্দ হলো আর কার আঁতে ঘা লাগল, বরাবরের মতোই তা দেখার বিষয় নয়।

আমাদেরকে শরিয়াহ অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শরিয়াহর আলোকে জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান করার আদেশ করা হয়েছে। আলিমগণও শরিয়াহর আলোকেই ফাতওয়া দিয়ে থাকেন। ফাতওয়া এবং বিচার পরিচালনা করার জন্য সবার থেকে আড়াল করা গোপন কোনো বিধান, সংবিধান, আইন ও মাপকাঠি নেই। সুফিদের পরিভাষার তরিকত, মারেফত, হাকিকত দিয়ে তাসাওউফ চললেও এগুলোর দ্বারা ফাতওয়া ও বিচার চলে না।

হুসাইন ইবনু মানসুর হাল্লাজকে তার হুলুলি আকিদার কারণে মুরতাদ ফাতওয়া দেওয়া হয়েছিল। এই ফাতওয়া সালাফের মহান ইমামগণই দিয়েছিলেন। এরপর সেই ফাতওয়ার আলোকে তাকে হত্যাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। এবং এই ফায়সালা তারা শরিয়াহর আলোকেই দিয়েছিলেন।

এবার যে বিষয়টার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি, সালাফগণ কি তাকফিরের মূলনীতি জানতেন না? নিশ্চয়ই জানতেন। আমাদের চেয়ে অনেক ভালো জানতেন। আমরা তো জানিই না। তাকফিরের মূলনীতি নিয়ে আমাদের মাদরাসাগুলোতে বা ফাতওয়া বিভাগগুলোতে তো কোনো পড়াশোনাই নেই। তো তাকফিরের একটা মূলনীতি হলো, যে বিষয়কে কেন্দ্র করে তাকফিরের ফাতওয়া প্রদান করা হবে, সে বিষয়টা শতভাগ সুনিশ্চিত হতে হবে। তাতে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ থাকতে পারবে না। যদি কোনো বিষয় এমন হয় যে, তাতে ৯৯% কুফরের সম্ভাবনা আছে আর মাত্র এক ভাগ ভিন্ন ব্যাখ্যার অবকাশ আছে তাহলে এর ভিত্তিতে কাউকে তাকফির করা যায় না।

হুসাইন হাল্লাজ সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানছি, এগুলো হলো বর্ণনানির্ভর। অপরদিকে তারা তার ব্যাপারে যে ফাতওয়া প্রদান করেছিলেন, তার ভিত্তি বর্ণনা বা শ্রুতিনির্ভর ছিল না; বরং হুসাইনের জীবনাচার তাদের চোখের সামনেই ছিল। তারা স্বচক্ষে তার অবস্থা দেখেছেন, সরাসরি তার হালতের তাহকিক করেছেন। এখন যদি বলা হয়, তারা তাকফিরের মূলনীতি জানতেন, তাহলে কীভাবে ভাবা যায়, তারা জেনেবুঝে তার ব্যাপারে তাকফিরের মূলনীতি লঙ্ঘন করেছেন এবং পরবর্তী যুগের যুগশ্রেষ্ঠ অনেক ইমামও তাদের সেই ফাতওয়ার সমর্থন করেছেন। আর যদি বলা হয়, তারা তাকফিরের মূলনীতি জানতেন না, তাহলে এটা তো অযৌক্তিক ও অবাস্তব প্রলাপ এবং তাদের ব্যাপারে অবান্তর ধারণা ছাড়া আর কিছু হবে না।

এ গেল একদিক। এবার আরেকদিক থেকে বিষয়টা দেখি। শরিয়াহর দণ্ডবিধি তিন ধরনের : (ক) কিসাস, (খ) হুদুদ এবং (গ) তাজির। হুসাইন হাল্লাজের ওপর কিসাস বা তাজির প্রয়োগ করা হয়নি। বরং তার ওপর রিদ্দাহর হদ প্রয়োগ করা হয়েছিল। হুদুদের ব্যাপারে স্বীকৃত মূলনীতি হলো, যেকোনো সংশয়ের দ্বারা হদ রহিত হয়ে যায়। সামান্য সংশয় থাকলেও হদের পরিবর্তে তাজির প্রয়োগ করা হয়। কারণ, একজন মানুষকে ভুলে হত্যা করার চাইতে তাকে ভুলে বাঁচিয়ে রাখা ঢের উত্তম। তো সেই যুগে তার ওপর হদ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তৎকালীন সালাফ ইমামগণ তা মেনেও নিয়েছিলেন, বরং তাদের ফাতওয়ায়ই তা কার্যকর হয়েছিল; এর সরল অর্থ তো এটাই যে, তাদের দৃষ্টিতে তার ওপর হদ প্রয়োগ করা যথাযথ ছিল। শরিয়াহর দৃষ্টিতে তা ভুল ছিল না। অন্যথায় এটা কীভাবে ভাবা যায় যে, তারা সকলে মিলে অসৎকাজের প্রতিবাদ করা ও তা থেকে নিষেধ করার সুন্নাহ পরিত্যাগ করেছেন বা তা বিস্মৃত হয়েছেন।

এবার আসি আরেক দিকে। ধরে নিলাম, হুসাইন হাল্লাজ আল্লাহর বড় ওলি ছিল। তার ওপর তাকফিরের যে ফাতওয়া প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা উসুলের স্পষ্ট লঙ্ঘন ছিল। এমনকি তার ওপর প্রয়োগকৃত হদও সম্পূর্ণ ভুল, ইনসাফ-বহির্ভূত আচরণ ও জুলুম ছিল। এতদসত্ত্বেও দুনিয়ার গোটা তাসাওউফপন্থীরা এ কথা মানতে বাধ্য যে, সে একজন মাজযুব ছিল। মাজযুবকে যদি স্বীকৃত উসুল অনুসারে মাজুর হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে মাজুর তো কারও জন্য আদর্শ হয় না। তাহলে অযথাই কেন এই হাল্লাজকে আদর্শপুরুষ হিসেবে প্রচার করা হয়? দুনিয়ায় হাল্লাজকে ভাইরাল করেছে তো তাকফিরিরা নয়; বরং একদল সুফিবাদী। এত এত কামেল শায়খ থাকতে তারা কেন এক মাজযুবকে প্রমোট করেছে? কেন মুরিদানকে মাজযুবের মতো হতে উৎসাহিত করেছে। অথচ মাজযুব হওয়া ইখতিয়ারি (ঐচ্ছিক) বিষয় নয়; এটা সম্পূর্ণ গাইরে ইখতিয়ারি বিষয়। গাইরে ইখতিয়ারি জিনিসকে তো কখনো প্রমোট করা যায় না। তা তো আল্লাহর ইচ্ছা; আল্লাহ যাকে চান, দান করেন। উপরন্তু তাসাওউফের দৃষ্টিতেই মাজযুবের হালত হওয়া কোনো কামাল নয়; বরং এটা দুর্বলতা। যাদের ভেতর মজবুত, তারা এর শিকার হন না। এ জন্য সাহাবিরা মাজযুব ছিলেন না। মাজযুব একে তো মাজুর, অপরদিকে সে হলো দুর্বল। সুতরাং এর ওপর এত ফোকাস করার তো কোনো যুক্তি হয় না

জিকির করতে করতে কেউ কেউ ওয়াজদের শিকার হতে পারেন। এটা অসম্ভব কিছু নয়; তবে অস্বাভাবিক তো বটে। কুরআনে কোথাও ওয়াজদ সৃষ্টি করার নির্দেশ বা উৎসাহ দেওয়া হয়নি। কেউ যদি কুরআনের কোনো আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যা করে, তাহলে সে একজন মূর্খ বা অপব্যাখ্যাকারী বৈ কিছু নয়। রাসুলুল্লাহ সা. ও তার সাহাবিরা ওয়াজদের রোগী ছিলেন না। ওয়াজদ গাইরে ইখতিয়ারি। ওয়াজদ ওজর। ওয়াজদ দুর্বলতা। কিন্তু আজকাল কিছু মানুষ মেহনত করে, নিজের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ওয়াজদ সৃষ্টি করতে চায়। ওয়াজদের রোগীকে বড় আল্লাহওয়ালা ও ‘মাওলার প্রেমের আশেক’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ সবই অজ্ঞতার প্রভাব।

আজকাল যেসব বক্তা ওয়াজদে আক্রান্ত রোগী বা মাজযুবদেরকে আল্লাহর বড় ‘আশেক’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়, যারা জিকিরের প্রভাবে পাগলামি শুরু করাকে কামাল হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের ফাতওয়ায় তারা নিজেরাই প্রথমে আটকে যাবে। এটা যদি কামালই হয়, তাহলে বক্তার নিজের এই অবস্থা সৃষ্টি হয় না কেন? নাকি সে শুধুই টাকার জন্য ওয়াজ করে আর মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলা করে, তাই তার নিজের এই অবস্থা হয় না?

উপরন্তু এটাকে যদি ওয়াজদ বলিও, তাহলে এটা যতটা না জিকিরের প্রভাব; তারচে বেশি হলো হৃদয়স্পর্শী সুর ও নৈরাশ্যের প্রভাব। সুরের প্রভাব অনস্বীকার্য। মাইকেল জ্যাকসনের গানের সুর ও মিউজিক শুনেও শ্রোতাদের ‘ওয়াজদ’ সৃষ্টি হতে পারে। আত্মভোলা হয়ে তারা উন্মাদনা শুরু করতে পারে। এবং এটা হয়ও। যে সকল বক্তার ওয়াজে শ্রোতাদের ওয়াজদ সৃষ্টি হয়, তাদেরকে যদি সুর ছাড়া মাওলানা ওলিপুরি হজরতের স্টাইলে বয়ান করতে বলা হয় এবং প্রচণ্ড নৈরাশ্যমূলক কথা বলা যদি সাময়িককালের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে কয়জনকে বাঁশের আগায় লাফাতে বা মাঠে বসে পাগলামি করতে দেখা যায়। তাদের সুরের প্রভাব এত বেশি যে, আমি নিজ কানে সেই সুরে কোনো কোনো বিদআতি বক্তার আলোচনা শুনে দেখেছি, তা শ্রোতাদের ওপর একই প্রভাব সৃষ্টি করে। আর তারা নৈরাশ্য সৃষ্টি করে শ্রোতাদের যে ওয়াজদ সৃষ্টি করে, হাদিসের নির্দেশনা অনুসারে তারা জান্নাতের প্রত্যাশা জাগিয়ে সেই অবস্থা কখনোই সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না।

আবেগের প্রভাব সাময়িক। বিবেকের প্রভাব স্থায়ী। আবেগনির্ভর ইসলাম পালন টেকসই হয় না। বিবেকনির্ভর ইসলাম পালন টেকসই হয়। হ্যাঁ, আমরা দার্শনিকদের মতো একেবারে আবেগমুক্ত বিবেকের কথা বলছি না; কারণ, বিবেকআশ্রিত আবেগ দূষণীয় নয়। তবে আবেগ সর্বদা বিবেকের অনুগামী থাকবে। আবেগের আতিশয্য বিবেকের সীমানা লঙ্ঘন করবে না। কিছু মানুষ জিকির-আজকার করে আবেগের সাগরে এত বেশি হাবুডুবু খেতে শুরু করে, তারা আর বিবেককে মোটেও কাজে লাগায় না। আল্লাহপ্রদত্ত এই যোগ্যতা অকার্যকর করে ফেলে। যার কারণে তাদেরকে ইমোশনাল এটাক দিয়ে পাগলামিতে লাগিয়ে দেওয়া সহজ হলেও তাদের বিবেককে আকর্ষণ করে তাদেরকে শরিয়াহর শাশ্বত অনেক নির্দেশের দিকে তাড়িত করা যায় না। তারা এতটাই অন্ধ হয়ে যায় যে, শত বোঝানোর পরও ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন নিয়ে আজীবন আলেয়ার আলো ও ধু ধু মরীচিকার পেছনেই ছুটতে থাকে। দিবাস্বপ্নকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে। তারা মাওলার প্রেমে আশেক হয় কথিত বড় জিহাদে জীবন উৎসর্গ করতে পারলেও প্রকৃত জিহাদের ময়দানে তাদের অংশগ্রহণ কখনোই চোখে পড়ে না। অথচ তারা জানে না, বড় আব্বা যেমন আব্বা নয়, কথিত বড় জিহাদও আদতে কোনো জিহাদই নয়।

যে সকল বক্তা কথায় কথায় বিপরীত পক্ষকে গালি দেয়, যে সকল গেঁয়ো, স্বল্পশিক্ষিত, কর্কশভাষী, আত্মমুগ্ধ ও অহংকারী বক্তা মাইক পেয়ে তাল হারিয়ে ‘বেঈমান’ ‘মুনাফিক’ ‘বেয়াদব’ ‘বদমাইশ’ ‘মূর্খ’ ‘আহাম্মক’ শব্দ ছাড়া মুসলমান ভাইকে উপহার দেওয়ার মতো আর কিছু পায় না, তারা তাসাওউফজীবী হতে পারে, তারা পির-মুরিদির সাইনবোর্ড লাগিয়ে ধর্মব্যবসা করতে পারে, তারা নবির সুন্নাহর স্বঘোষিত ঠিকাদার হতে পারে; কিন্তু তাদের মধ্যে নববি আদর্শের ছিটেফোঁটাও নেই। তাদের মানহাজ পরিশুদ্ধ নয়। আর যে ফরজ ছেড়ে নফল নিয়ে পড়ে থাকে, এমনিও তার দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির মতো, যে গাছের শিকড় কেটে গাছের আগায় পানি ঢালতে থাকে।

‘নিশ্চয়ই চোখ অন্ধ হয় না; বরং অন্ধ হয় বক্ষঃস্থিত অন্তর।’ আল্লাহ সবাইকে হক গ্রহণ করার যোগ্যতা দেন না। যুগ যুগ ধরে এত আলিমের স্পষ্ট বিবৃতি শুনেও যারা নিজেদের সংগঠনের বাতিল নাম পরিবর্তনের উদারতাটুকুই দেখাতে পারে না, মানুষ কীভাবে যে তাদেরকে ত্রস্ত যুগের ত্রাতা ভাবে, তা আমার কিছুতেই বুঝে আসে না।

Share This