- ফিতনার বজ্রধ্বনি—২
দাজ্জালের পরিচয়
দাজ্জাল আদম আ. এর সন্তানদের মধ্য থেকে একজন সন্তান। দাজ্জাল একজন মানুষ। মহান আল্লাহ তাকে এমন সব ক্ষমতা দান করেছেন, যা অন্য কোনো মানুষকে দান করেন নি। আল্লাহ তাআলা তাকে মুমিনদের ইমানের পরীক্ষার জন্য সবিশেষ শক্তি ও ক্ষমতা দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জোরপূর্বক মুমিনদের ইমান কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা দেন নি, বরং তাকে দান করেছেন অমানবিক শক্তি ও ক্ষমতা। সে তার সেসকল শক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, চিত্ত প্রলুব্ধ করবে এবং সাধারণ ইমানবিশিষ্ট মুমিনদেরকে গোলকধাঁধা এবং সংশয়ে ফেলে কুফরে লিপ্ত করবে। ফলে মানুষ জ্ঞাতসারে কিবা অজ্ঞাতসারে প্রবৃত্তির তাড়নায় কিবা সংশয়গ্রস্ত হয়ে তার বিছানো জালে পা দিয়ে ফেঁসে যাবে। তার ফিতনা ইবলিসের ফিতনা সদৃশ। আর আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন—
“আমার (প্রকৃত) বান্দাদের ওপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব-ক্ষমতা নেই। (তাদের) তত্ত্বাবধান-রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।”[1]
নবিজি সা. আমাদেরকে দাজ্জালের আকৃতি-প্রকৃতি, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য-গুণাবলি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। তিনি আমাদেরকে দাজ্জালের অনুসরণ করা থেকে বারণ করেছেন। কারণ যারা তার অনুসারী হবে, তারা গলা থেকে ইসলামের রশিকে খুলে ফেলবে এবং উম্মাতে মুহাম্মাদির তালিকা থেকে নিজেদের নাম মুছে ফেলবে। তাই আমরা যখন দাজ্জালকে চিনবো এবং তার সম্পর্কে সবিস্তারে জানবো, তখন প্রত্যাশা রয়েছে যে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার অনিষ্ট থেকে হেফাজত করবেন।
দাজ্জালের নাম
দাজ্জালকে ‘আল-মাসিহুদ দাজ্জাল’ বলা হয়ে থাকে। ইসা আ.কেও মাসিহ বলা হয়। হাদিসের শব্দানুসারে দাজ্জাল হলো ‘মাসিহুদ দালালাহ’ তথা গোমরাহির মাসিহ। এর থেকে অনুমেয় যে, ইসা আ. হলেন ‘মাসিহুল হুদা’ তথা হিদায়াতের মাসিহ।[2] দু’জনকে দু’বিবেচনায় ‘মাসিহ’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। শুধু ‘মাসিহ’ শব্দ বলা হলে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, ইসা আ.। আর যখন এর দ্বারা দাজ্জাল উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তখন এর সাথে দাজ্জাল শব্দ যুক্ত করে ‘আলমাসিহুদ দাজ্জাল’ বলা হয়ে থাকে।
মাসিহ শব্দটি ‘আলমাসহু’ ক্রিয়ামূল থেকে উৎসারিত; যার অর্থ হলো, ‘মুছে দেয়া’। ইসা আ.কে মাসিহ বলা হয়, কারণ তিনি যখন ব্যাধিগ্রস্তদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন, তাদেরকে নিজ হাত দ্বারা মুছে দিতেন, তখন মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহে তারা সুস্থ হয়ে উঠতো। কিবা এর কারণ হলো, তিনি তার পা দিয়ে সারা পৃথিবী মাড়াতেন, অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ছিলো তার বিচরণ।
দাজ্জালকে মাসিহ বলা হয়, যেহেতু তার বাম চোখটি থাকবে মোছা। অর্থাৎ বাম চোখের জায়গাটিতে কোনো চোখই থাকবে না, চেহারার বাম পাশটি থাকবে চোখ এবং ভ্রু মুক্ত, যেনো সেখান থেকে চোখ এবং ভ্রুকে মুছে দেয়া হয়েছে। ফলে সে হবে কানা, যে শুধু তার এক চোখ—ডান চোখ দ্বারাই দেখে। ঠিক তেমনি তার ডান চোখটিও হবে ত্রুটিপূর্ণ। দেখতে মনে হবে আঙ্গুরের মতো, যেনো তা কোঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
দাজ্জাল শব্দটি এসেছে ‘আদ্দাজলু’ ক্রিয়ামূল থেকে। এর শাব্দিক অর্থ হলো—
ক. ঢেকে দেয়া, যেহেতু সে মিথ্যার দ্বারা সত্যকে ঢেকে দেবে
খ. ধোঁকা দেয়া ও বিভ্রান্ত করা, যেহেতু সে মানবজাতিকে ধোঁকা দেবে এবং বিভ্রান্ত করবে;
গ. ফন্দি করা, যেহেতু সে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে রকমারি ফন্দি করবে।
মিথ্যার চূড়ান্ত স্তরকে ‘আদ্দাজলু’ শব্দে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ দাজ্জাল হবে চরম ধোঁকাবাজ, ডাহা মিথ্যুক এবং কৌশলী ফন্দিবাজ। দাগাবাজি এবং ফেরেববাজিতে তার তুলনা শুধু সে-ই।
দাজ্জাল শব্দটির বহুবচন হলো ‘দাজ্জালুনা’ এবং ‘দাজাজিলা’। এর বহুবচনের প্রয়োজন এজন্য যে, দাজ্জাল সে একাই নয়; বরং দাজ্জাল রয়েছে আরো অনেক। তবে সে হলো, সবচে বড় এবং সর্বশেষ দাজ্জাল।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“কিয়ামাত সংঘটিত হবে না, যাবত্ না ত্রিশজন চরম মিথ্যুক দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তার রাসুলের ওপর মিথ্যাচার করবে।”[3]
এ পর্যন্ত অসংখ্য দাজ্জালেরই আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, যারা আল্লাহ এবং তার রাসুলের ওপর মিথ্যাচার করেছে, যারা মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি করেছে; যেমন মুসায়লামা কাযযাব, আসওয়াদ ‘আনসি, তালিহা আলআসাদি, মুখতার আস্সাকাফি, সাজ্জাহ, গোলাম আহমাদ কাদিয়ানি (লাআনাহুমুল্লাহ)। ‘আলমাসিহুদ দাজ্জাল’ সে শুধু মিথ্যা নবুওয়াতেরই দাবি করবে না, বরং সে নিজেকে ‘রাব্বুল আলামিন’ বলে ঘোষণা দেবে। স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ।
কিয়ামাতের বড় আলামতগুলোর মধ্যে দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ সর্বপ্রথম প্রকাশিত আলামত
কিয়ামাতের আলামতগুলো মোট তিন ধরনের—ছোট, মাঝারি এবং বড়। কিয়ামাতের বড় আলামত হলো দশটি; এর মধ্য থেকে দাজ্জালের বহিঃপ্রকাশ হলো সর্বপ্রথম আলামত।
একদল বিদগ্ধ আলিমের ভাষ্য হলো, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের আলামতটি হলো বড় দশটি আলামতের মধ্যে সর্বপ্রথম। এক্ষেত্রে তাদের দলিল হলো আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস রা. সূত্রে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত হাদিস—
“নিঃসন্দেহে প্রকাশিত হবার দিক থেকে প্রথম আলামত হলো, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া এবং মানবজাতির ওপর পূর্বাহ্নে ‘দাব্বাতুল আর্দ’ নামক একটি জন্তুর আত্মপ্রকাশ ঘটা। এই দু’টির যে কোনো একটি আগে এবং অপরটি এর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হবে।
আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আর আমার মনে হয়, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়টাই প্রথমে প্রকাশিত হবার কথা ছিলো।”[4]
কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বরং বাস্তবতা হলো, পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে আরো তিনটি বড় আলামত প্রকাশিত হবে—দাজ্জালের আবির্ভাব, ইসা আ. এর অবতরণ এবং ইয়াজুজ-মাজুজের বহিঃপ্রকাশ।
এর কতক কারণ নিম্নরূপ—
১. যখন পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবে, তখন তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন—
“যে দিন তোমার রবের কতক নিদর্শন এসে যাবে, সে দিন এমন ব্যক্তির ইমান তার কোনো কাজে আসবে না, যে পূর্বে ইমান আনে নি কিংবা নিজ ইমানের সাথে কোনো সৎকর্ম অর্জন করে নি।”
রাসুলুল্লাহ সা. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন—
“পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত কিয়ামাত অনুষ্ঠিত হবে না। লোকেরা যখন তা দেখবে, তখন পৃথিবীর সকলে ইমান আনবে। আর সেটি হচ্ছে এমন সময়, যখন “পূর্বে ইমান আনে নি এমন ব্যক্তির ইমান তার কোনো কাজে আসবে না।”[5]
অথচ সর্বজনস্বীকৃত যে, ইসা আ. উর্ধ্বাকাশ থেকে অবতরণের পর মানুষদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করবেন এবং খ্রিস্টানদের অনেকে তার দাওয়াতে ইমান আনয়ন করবে। আল্লাহ বলেন—
“কিতাবিদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে নিজ মৃত্যুর আগে ইসার প্রতি ইমান আনবে না। আর কিয়ামাতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে।”[6]
অথচ এই ঘটনা যদি সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবার পরে হয়ে থাকে, তাহলে তো কারো ইমান তার কোনোই কাজে আসবে না। এজন্যই হাফিজ ইবনু হাজার রহ. বলেন—
“দাজ্জালের অবস্থানের সময়কাল ইসা আ. তাকে হত্যা করা পর্যন্ত, এরপর ইসা আ. এর অবস্থানের সময়কাল এবং ইয়াজুজ-মাজুজের আত্মপ্রকাশ—এ সবগুলোই পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের ওপর অগ্রবর্তী হবে। সকল বর্ণনা একত্রিত করলে যে অভিমত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়, তা হলো, দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ সেসকল বড় আলামতসমূহের মধ্যে প্রথম, যা পৃথিবীর বড় অংশে সার্বিক অবস্থা পরিবর্তনের নির্দেশক। আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া সেসকল বড় আলামতসমূহের মধ্যে প্রথম, যা উপরস্থ পৃথিবীর বিবর্তনের নির্দেশক। কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটবে।”[7]
ইমাম বায়হাকি তার ‘আলবা‘ছু ওয়ান নুশুর’ গ্রন্থে বলেন—
“হালিমি রহ. উল্লেখ করেছেন, সর্বপ্রথম আলামত হলো দাজ্জাল, এরপর ইসা ইবনু মারয়াম আ. এর অবতরণ। কেননা পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় যদি ইসা আ. এর অবতরণের পূর্বে হয়, তাহলে তার সময়কালে ইমান আনয়ন করা আর কুফফার গোষ্ঠীর কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেসময় ইমান আনয়ন তাদের উপকারে আসবে। কারণ ইমান আনয়ন করা যদি তাদের কোনো কাজে না আসে, তাহলে তাদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে, তাদের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে দ্বীন এক দ্বীনে পরিণত হবে না।”[8]
হাফিজ ইবনু কাসির রহ. বলেন—
“নিঃসন্দেহে প্রকাশিত হবার দিক থেকে প্রথম আলামত হলো, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়া”—এর অর্থ হলো, যে সকল আলামত স্বাভাবিক নয়, তার মধ্য থেকে প্রকাশিত প্রথম আলামত হলো এটা; যদিও দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ, উর্ধ্বাকাশ থেকে ইসা আ. এর অবতরণ এবং ইয়াজুজ-মাজুজের বহিঃপ্রকাশ এর পূর্বেই সংঘটিত হবে। এ সবগুলোই হলো পরিচিত বিষয়। কেননা তারা সকলেই মানুষ। তাদের অনুরূপ আকৃতিবিশিষ্ট জিনিসকে মানবচক্ষু পূর্ব থেকেই দেখে আসছে। …আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্যের উদয় তার স্বাভাবিক রীতি এবং আকাশের নিদর্শনসমূহের সম্পূর্ণ খেলাফ।”[9]
২. দাজ্জাল এবং ইয়াজুজ-মাজুজের আত্মপ্রকাশ এবং উর্ধ্বাকাশ থেকে ইসা আ. এর অবতরণের ঘটনা আবশ্যিকভাবেই সূর্য পশ্চিমাকাশ থেকে উদিত হবার পূর্বেই সংঘটিত হতে হবে। কারণ দাজ্জালের হত্যা এবং ইয়াজুজ-মাজুজের ধ্বংসের পরও ইসা আ. পৃথিবীতে সাত বছর জীবন যাপন করবেন, যেমনটি সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে; কিবা চল্লিশ বছর জীবন যাপন করবেন, যেমনটি সুনানে আবি দাউদ গ্রন্থে সহিহ সনদে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। এসবের পর প্রথম সেই আলামত প্রকাশ পাবে, যার প্রকাশের অব্যবহিত পরেই পর্যায়ক্রমে অন্য সকল আলামত প্রকাশ পাবে এবং কিছুকালের মাঝেই কিয়ামাত অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“নিদর্শনসমূহ যেনো একটি সুতায় বিন্যস্ত দানা; যদি দানা ছিড়ে ফেলা হয়, তাহলে একটি দানা অপর দানার অনুগামী হয় (এবং দ্রুতই পতিত হয়)।”[10]
আবু ‘আলিয়া রহ. এর ‘আলমুসনাদ’ গ্রন্থে মুরসাল বর্ণনায় এসেছে—
“এসকল নিদর্শনগুলি ছয় মাসে প্রকাশিত হবে।” আর আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “আট মাসে।”
সুতরাং এই দুই ধরনের বর্ণনার মাঝে সমন্বয়ের পন্থাই হলো, এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে, দাজ্জালের নিহত হওয়া এবং ইয়াজুজ-মাজুজের ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর ইসা আ. সুদীর্ঘ সময় মুসলমানদের মাঝে অবস্থান করবেন। এ সময় তিনি কী কী মহান ব্রত পালন করবেন, তা স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ। তার তিরোধানের পর কোনো এক সময়ে পশ্চিমাকাশ থেকে সূর্য উদিত হবে এবং এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সুতার দানা ঝরার মতো সবগুলো আলামত প্রকাশিত হবে। এই ব্যাখ্যা ছাড়া এসকল বিপরীতমুখী বর্ণনার মাঝে সমন্বয় সাধন করা দুরূহ।
দাজ্জালের আকৃতি-প্রকৃতি
আবু বাকরা রা. রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন—
“দাজ্জালের বাবা-মা’র ত্রিশ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে না। এরপর একটি কানা ছেলে জন্মগ্রহণ করবে। সে হবে খুবই ক্ষতিকর এবং অত্যন্ত অনুপকারী। তার দু’চোখ ঘুমাবে; কিন্তু অন্তর ঘুমাবে না।”
এরপর রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের সামনে তার বাবা-মা’র বিবরণ উল্লেখ করলেন।
তিনি বলেন, “দাজ্জালের বাবা দৈহিক আকৃতির দিক থেকে হবে লম্বাটে, হালকা-পাতলা গড়নের এবং তার নাক হবে পাখির ঠোঁটের মতো লম্বা। আর তা মা হবে স্থূলকায়, সুউচ্চ স্তনবিশিষ্টা।”[11]
দাজ্জালের আকৃতি হবে এরূপ—
“খাটো, তবে অতিকায় স্থূল এবং দানবাকৃতির বিশাল দেহবিশিষ্ট; উভয় চোখই ত্রুটিযুক্ত—বাম চোখটি ভ্রুসহ চামড়ার আবরণে লুকায়িত, যেনো তা মুছে দেয়া হয়েছে, আর ডান চোখটি ভাসমান আঙ্গুর সদৃশ, যেনো তা কোঠর থেকে বেরিয়ে এসেছে; অস্বাভাবিক রকমের ঘন কোঁকড়া ও অগোছালো চুল, দেখলে বোধ হবে, যেনো গাছের কতোগুলো ডাল; কপাল অতি প্রশস্ত এবং মাথা স্বাভাবিকের থেকেও বড়; শ্বেত-শুভ্র চামড়ার দেহ; দু’পায়ের গোছার মাঝে মাত্রাতিরিক্ত দূরত্ব, ফলে চলন ত্রুটিযুক্ত; দু’চোখের মাঝামাঝিতে ‘কাফির’ লেখা থাকবে, যা সকল মুসলিম—শিক্ষিত হোক কিবা অশিক্ষিত—সকলেই পড়তে পারবে, তবে কোনো কাফির যতো বড় শিক্ষিতই হোক না কেনো, তা পড়তে পারবে না; সে হবে আঁটকুড়ে, নিঃসন্তান।[12]
দাজ্জাল কোথায়
ফাতিমা বিনতু কায়স রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
“আমি রাসুলুল্লাহ সা. এর মুয়াজ্জিনকে বলতে শুনলাম যে, সালাতের সময় আসন্ন। তখন আমি মসজিদের উদ্দেশে বের হলাম এবং রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে সালাত আদায় করলাম। আমি পুরুষদের পেছনে মহিলাদারে কাতারে দাঁড়িয়েছিলাম। রাসুলুল্লাহ সা. সালাত শেষে মিম্বারে আরোহণ করলেন, তার ঠোঁটে তখন ছিলো শুভ্র হাসির রেখা। অনন্তর তিনি বললেন, “সকলে যেনো ঠিক সেখানে বসে যায়, যেখানে সালাত আদায় করেছে।”
এরপর তিনি বললেন, “তোমরা জানো কি, কেনো আমি তোমাদেরকে একত্রিত করেছি?”
তারা বললো, “আল্লাহ এবং তার রাসুল সম্যক অবগত।”
তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কোনো উৎসাহ বা ভীতি প্রদর্শনের জন্য একত্রিত করি নি। আমি তোমাদেরকে একত্রিত করেছি—কারণ তামিম দারি খ্রিস্টান ছিলো। সে এখানে এসে বাইয়াত দিয়েছে এবং ইসলাম গ্রহণ করেছে। সে আমাকে এমন উপাখ্যান শুনিয়েছে, যা আমি তোমাদেরকে ‘আলমাসিহুদ দাজ্জাল’ সম্পর্কে যা-কিছু বলতাম—তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সে আমাকে জানালো যে, লাখ্ম এবং জুযাম গোত্রের ত্রিশজন লোকের সাথে সে একবার সামুদ্রিক জাহাজে আরোহণ করে। এরপর ঢেউ একমাস তাদেরকে নিয়ে সমুদ্রে খেলা করে। একদিন সূর্যাস্তের পূর্বমুহূর্তে তাদের জাহাজ সমুদ্রের মাঝে এক দ্বীপে গিয়ে ভিড়ে। এরপর তারা ছোট ছোট নৌকায় বসে ওই দ্বীপে প্রবেশ করে। জাহাজ থেকে অবতরণ করা মাত্রই অধিক লোমযুক্ত কেশাচ্ছাদিত এক অদ্ভুত প্রাণীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটে—অত্যাধিক চুল দিয়ে সারা গা ঢাকা আথাক্য প্রাণীটির সম্মুখপশ্চাৎ ঠাহর করা যাচ্ছিলো না।
সাথিরা বললো, “হতভাগা, কে তুই?”
প্রাণীটি বললো, “আমি গুপ্তচর (জাস্সাসা)।”
তারা বললো, “গুপ্তচর মানে? ”
প্রাণীটি বললো, হে লোকেরা, তোমরা আশ্রমে এই ব্যক্তিটির কাছে চলো। কারণ তিনি তোমাদের সংবাদ জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত।”
তার মুখে এক লোকের কথা শুনে আমরা শঙ্কিত হলাম যে, সে আবার শয়তান না তো! তাই দ্রুত তার থেকে সরে পড়লাম। আমরা আশ্রমে ঢুকে এক অতিশয় দীর্ঘাকৃতির লোককে দেখতে পেলাম, যার দু’হাঁটুর মধ্য দিয়ে উভয় হাত ঘাড়ের সাথে একত্রিত করে লোহার শেকলে বাঁধা।
আমরা তাকে বললাম, “তোর সর্বনাশ হোক, তুই কে?”
সে বললো, “তোমরা আমার সন্ধান কিছু না কিছু পেয়েই গেছো। এখন তোমরা বলো, তোমাদের পরিচয় কী? ”
সাথিরা বললো, “আমরা আরবের বাসিন্দা। আমরা সমুদ্রে নৌকায় চড়ে ভ্রমণ করছিলাম। অনন্তর আমরা সমুদ্রকে উত্তাল তরঙ্গে উদ্বেলিত অবস্থায় পেয়েছি। এক মাস পর্যন্ত ঝড়ের কবলে থেকে অবশেষে আমরা তোমার এ দ্বীপে এসে পৌঁছেছি। এরপর ছোট ছোট নৌকায় আরোহণ করে আমরা এ দ্বীপে প্রবেশ করেছি। এখানে আমরা একটি সর্বাঙ্গ পশমে আবৃত জন্তুকে দেখতে পেয়েছি। পশমের আধিক্যের কারণে আমরা তার আগা-পাছা চিনতে পারছিলাম না। আমরা তাকে বলেছি, হতভাগা, তুই কে? সে বলেছে, সে নাকি গুপ্তচর। আমরা বললাম, গুপ্তচর আবার কী? তখন সে বললো, ওই যে আশ্রম দেখা যায়, তোমরা দেখানে চলো। সেখানে এক লোক গভীর আগ্রহে তোমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। তাই আমরা দ্রুত তোর কাছে এসে পড়েছি। আমরা তার কথা শুনে এ আশঙ্কা করেছি যে, সে আবার শয়তান নয় তো! ”
এরপর সে বললো, “তোমরা আমাকে বাইসানের খেজুর বাগানের সংবাদ বলো।”
আমরা বললাম, “এর কোন বিষয়ের সংবাদ জানতে চাচ্ছিস?”
সে বললো, “বাইসানের খেজুর বাগানে ফল আসে কি না—এ সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করছি।”
তাকে আমরা বললাম, “হ্যাঁ, ফল আসে।”
সে বললো, “সেদিন নিকটে, যেদিন এগুলোতে কোনো ফল ধরবে না।”
এরপর সে বললো, “আচ্ছা, তাবারিয়্যা সাগরের ব্যাপারে আমাকে অবগত করো।”
আমরা বললাম, “এর কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিস? ”
সে বললো, “তাতে পানি আছে কি? ”
আমরা বললাম, “হাঁ, আছে।”
সে বললো, “সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এ সাগরে কোনো পানি থাকবে না।”
সে আবার বললো, “‘যুগার’ এর ঝর্ণার ব্যাপারে তোমরা আমাকে অবহিত করো।”
আমরা বললাম, “তুই এর কোন সংবাদ জানতে চাচ্ছিস?”
সে বললো, “এর ঝর্ণাতে পানি আছে কি?”
আমরা বললাম, “হাঁ, এতে অনেক পানি আছে এবং এ জনপদের লোকেরা এই পানির মাধ্যমেই তাদের ক্ষেত আবাদ করে।”
সে বললো, “তোমরা আমাকে উম্মিদের নবির ব্যাপারে খবর জানাও। সে এখন কী করছে?”
আমরা বললাম, “তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে এসেছেন।”
সে জিজ্ঞেস করলো, “আরবের লোকেরা কি তার সাথে যুদ্ধ করেছে?”
আমরা বললাম, “হাঁ, করেছে।”
সে বললো, “সে তাদের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করেছে?”
আমরা তাকে জানালাম যে, “তিনি আরবের পার্শ্ববর্তী এলাকার ওপর জয়ী হয়েছেনে এবং তারা তার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে।”
সে বললো, “এটা কি হয়েই গেছে?”
আমরা বললাম, “হাঁ।”
সে বললো, “বশ্যতা স্বীকার করে নেয়াই জনগণের জন্য কল্যাণকর ছিলো। এখন আমি নিজের ব্যাপারে তোমাদেরকে বলছি—আমিই ‘আলমাসিহুদ দাজ্জাল’ অতিসত্ত্বর আমি এখান থেকে বের হবার অনুমতিপ্রাপ্ত হবো। এখান থেকে বেরিয়ে আমি সমগ্র পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবো। চল্লিশ দিনের মধ্যে এমন কোনো জনপদ থাকবে না, যেখানে আমি প্রবেশ করবো না। তবে মক্কা ও তাইবা—এ দুই স্থানে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। যখন আমি এ-দু’টির কোনোটিতে প্রবেশ করতে চাইবো, তখন এক ফেরেশতা উন্মুক্ত তরবারি হাতে সামনে এসে আমাকে বাধা দেবে। এ দুটি স্থানের সকল রাস্তায় ফেরেশতাদের পাহারা থাকবে।”
বর্ণনাকারী বলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সা. তার ছড়ি দ্বারা মিম্বারে আঘাত করে বললেন, এ হচ্ছে তাইবা। সাবধান! আমি কি এ কথাটিই ইতোপূর্বে তোমাদেরকে বলি নি?
তখন লোকেরা বললো, “হাঁ, আপনি বলেছেন।”
রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, “তামিম দারির কথাট আমার খুবই ভালো লেগেছে। যেহেতু তা আমি তোমাদেরকে দাজ্জাল মদিনা এবং মক্কা সম্পর্কে ইতোপূর্বে যা-কিছু বলেছি, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জেনে রেখো, উল্লিখিত দ্বীপটি সিরিয়া সাগরে অথবা ইয়ামান সাগরের পার্শ্বস্থ সাগরের মাঝে অবস্থিত; যা পৃথিবীর পূর্বদিকে অবস্থিত, পৃথিবীর পূর্বদিকে অবস্থিত, পৃথিবীর পূর্বদিকে অবস্থিত।”
এ সময় তিনি নিজ হাত দ্বারা পূর্ব দিকে ইশারাও করলেন।”[13]
আবু বকর রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
“প্রাচ্যের খোরাসান থেকে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। এমন কতক জাতি তার অনুসরণ করবে, যাদের মুখমণ্ডল হবে স্তর বিশিষ্ট চওড়া ঢালের মতো।”[14]
নাওয়াস ইবনু সাম‘আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“নিশ্চয়ই দাজ্জাল শাম এবং ইরাকের মধ্যবর্তী একটি সড়ক থেকে আত্মপ্রকাশ করবে।”[15]
আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“আসবাহান-এর সত্তর হাজার ইহুদি দাজ্জালের অনুসারী হবে, তাদের শরীরে থাকবে ‘তাইলাসান’।
উম্মুল মুমিনিন হাফসা রা. বলেন—
“কারো প্রতি ভীষণ রাগই সর্বপ্রথম দাজ্জালকে মানুষের সামনে প্রকাশ ঘটাবে।”
উপরিউক্ত বর্ণনাসমূহের আলোকে কয়েকটি বিষয় অনুমিত হয়—
১. দাজ্জালের জন্ম হয়ে গেছে। রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগেই তার অস্তিত্ব ছিলো। সে এখন প্রাচ্যের কোনো এক দ্বীপে শেকলে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ যখন তাকে অনুমতি দেবেন, তখনই তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
২. কেউ কেউ বলতে চান যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলই হলো দাজ্জালের আবাসস্থল। এটা নিশ্চিত করে বলার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের অবস্থানস্থল গোপন রেখেছেন। হাঁ, খোরাসান থেকে, শাম এবং ইরাকের মধ্যবর্তী কোনো সড়কে দাজ্জালের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটবে এবং এরপর সে মক্কা ও মদিনা ছাড়া সারা পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়াবে—এ বিষয়টি হাদিসের আলোকে প্রমাণিত।
৩. দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের ক্ষণ এসেছে কি না—তা সে কিছু আলামতের মাধ্যমে বুঝতে পারবে; যেমন তাবারিয়্যা সাগর শুকিয়ে যাবে, বাইসানের খেজুর গাছগুলোতে আর খেজুর ধরবে না ইত্যাদি।
৪. দাজ্জালের প্রকাশ ঘটবে রাগ থেকে। এই রাগের প্রকৃতি, হেতু ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায় না। আল্লাহ তাআলা তার আত্মপ্রকাশে উপলক্ষ্য বানিয়েছেন এক প্রচণ্ড রাগকে, যেমন ইয়াজুজ-মাজুজের আত্মপ্রকাশের উপলক্ষ্য বানিয়েছেন ইন শা আল্লাহ বলাকে। তার রাগের একটা কারণ এটাও হতে পারে যে (হাকিকত আল্লাহই ভালো জানেন), যখন মহাযুদ্ধের কারণে কুফরি শক্তির পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, তখন তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে এবং নেতিয়ে পড়া পরাজিত কুফরি শক্তিগুলো তার নেতৃত্বে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে।
ইবনু সায়্যাদই[16] কি দাজ্জাল
কারো কারো ধারণা হলো, ইবনু সায়্যাদই বোধহয় দাজ্জাল। কিন্তু এটি একটি গলদ ধারণা। এর ভ্রান্তির স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ আছে। বিশুদ্ধ মত এটাই যে, দাজ্জাল এবং ইবনু সায়্যাদ সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তি। হাঁ, ইবনু সায়্যাদের সাথে দাজ্জালের কিছু বাহ্যিক মিল রয়েছে। ‘আলমাসিহুদ দাজ্জাল’ ছাড়াও যে আরো অসংখ্য ছোট দাজ্জালের আবির্ভাবের কথা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, তার আলোকে কেউ কেউ ইবনু সায়্যাদকেও ছোট দাজ্জালের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে সহিহ মুসলিমের একটি বর্ণনা থেকে অনুমিত হয় যে, ইবনু সায়্যাদ একপর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলো এবং সে হিদায়াতের পথে এসেছিলো। একান্ত সে যদি ইসলাম গ্রহণ নাও করে থাকে, তবুও তার ‘আলমাসিহুদ দাজ্জাল’ না হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত।
আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
“একদিন ইবনু সায়্যাদ আমার সঙ্গে কিছু কথা বললো, যার কারণে আমার ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো। ইবনু সায়্যাদ বললো—
“আমি মানুষদেরকে এ বলে ওযর পেশ করছি যে, হে মুহাম্মাদ সা. এর সঙ্গী-সাথিগণ, আমার ব্যাপারে তোমাদের কী হলো?
আল্লাহর নবি কি এ কথা বলেন নি যে, দাজ্জাল ইহুদি হবে? অথচ আমি তো মুসলিম!
তিনি বলেছেন, দাজ্জালের কোনো সন্তান হবে না, অথচ আমার তো সন্তানাদি রয়েছে।
তিনি তো এও বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের ওপর মক্কায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন। অথচ আমি হজও করেছি।”
(এই অংশটি অন্য বর্ণনায় এভাবে রয়েছে—আপনি কি রাসুলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেন নি যে,দাজ্জাল মক্কা ও মদিনায় ঢুকতে পারবে না? আমি বললাম, হাঁ, শুনেছি। সে বললো, মনে রাখুন, আমি তো মদিনায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং এখন মক্কা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি।)
আবু সাইদ রা. বলেন, “সে অনর্গল এমনভাবে বলে যেতে লাগলো, যার ফলে আমি তাকে সত্যবাদী মনে করার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।”
এরপর সে বললো, “আল্লাহ্র কসম, অবশ্যই আমি দাজ্জালের অবস্থান সম্পর্কে জানি। আমি তার পিতামাতাকেও চিনি।”
লোকেরা ইবনু সায়্যাদকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি যদি দাজ্জাল হও, তাহলে তুমি কি আনন্দিত হবে?”
সে বললো, “আমার সামনে যদি বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়, তাহলে আমি অপছন্দ করবো না।”
(অন্য বর্ণনায় এরপর রয়েছে—আবু সাইদ রা. বলেন, শেষ কথাটি বলে সে আমাকে দ্বিধা ও সংশয়ে ফেলে দিলো।)[17]
দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের আলামতসমূহ
১. দাজ্জালের ফিতনা পৃথিবীর সবচে বড় ফিতনা। ইমরান ইবনু হাসিন রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
“আদম আ. এর সৃষ্টি থেকে কিয়ামাত পর্যন্ত দাজ্জালের থেকে বড় কোনো বিষয় সংঘটিত হওয়ার নেই।”[18]
আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
“রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন। এরপর তিনি আল্লাহ তাআলার যথাযথ প্রশংসা করলেন। এরপর দাজ্জালের কথা উল্লেখ করে বললেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্ক করছি। এমন কোনো নবি ছিলেন না, যিনি তার উম্মাহকে সতর্ক করেন নি। তবে আমি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বলে দিচ্ছি, যা অন্য কোনো নবি তার সম্প্রদায়কে বলেন নি। নিশ্চয়ই দাজ্জাল হবে কানা। আর তোমাদের রব কানা নন।”[19]
নাওয়াস ইবনু সাম‘আন রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
“আমার কাছে দাজ্জালই তোমাদের জন্য অধিক ভয়ংকর বিপদ। সে যদি আমার জীবদ্দশায় তোমাদের মাঝে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে আমিই তোমাদের পক্ষে তার প্রতিপক্ষ হবো। আর আমার অবর্তমানে যদি সে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিই হবে তার প্রতিপক্ষ। আর প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আল্লাহই আমার স্থলে সহায় হবেন।”[20]
দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের সময় ঘনিয়ে আসার একটি আলামত হলো, দাজ্জালের ফিতনা এতো ভয়ানক এবং গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মানুষেরা তার আলোচনা পরিহার করবে এবং এই ফিতনার ব্যাপারে গাফিল হয়ে যাবে। বর্ণিত হয়েছে—
“দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে না, যাবত্ না মানুষেরা তার আলোচনা বিস্মৃত হয়ে যাবে এবং ইমামগণ মিম্বারে তার আলোচনা পরিহার করবে।”[21]
উপরিউক্ত বর্ণনার আলোকে প্রতিভাত হয় যে, দাজ্জালের আলোচনা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এবং আলিমদের মুখ থেকেও তার আলোচনা উবে যাওয়া দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের সময় ঘনিয়ে আসার আলামত।
২. কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়। মুআজ ইবনু জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“বাইতুল মুকাদ্দাস আবাদ হওয়া মদিনা বিরান হওয়ার নিদর্শন। আর মদিনা বিরান হওয়া তীব্র লড়াইয়ের সূচনা। তীব্র লড়াইয়ের সূচনা হলো কনস্ট্যান্টিনোপল বজয়। আর কনস্ট্যান্টিনোপল বিজিত হওয়া দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ।”[22]
উল্লেখ্য, এই যুদ্ধ ইমাম মাহদির অধীনে হবে। আর তার অব্যবহিত পরেই দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। এই বিজয়ের কথা সবিস্তারে সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
“তোমরা কি ওই শহরের কথা শুনেছো, যার একদিকে স্থলভাগ এবং একদিকে জলভাগ?
উত্তরে সাহাবিগণ বললেন, হাঁ, হে আল্লাহ্র রাসুল, আমরা শুনেছি।
এরপর তিনি বললেন, কিয়ামাত সংঘটিত হবে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত ইসহাক আ. এর সন্তানদের সত্তর হাজার লোক এ শহরের লোকদের সঙ্গে লড়াই করবে। তারা শহরের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছাবে। তারা কোনো অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধ করবে না এবং কোনো তীরও চালাবে না। বরং তারা একবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ বলবে, সাথে সাথে এর এক প্রান্ত ধ্বসে যাবে। বর্ণনাকারী সাওর রহ. বলেন, আমার যতোদূর মনে পড়ে, আমার কাছে বর্ণনাকারী ব্যক্তি সমুদ্রস্থিত প্রান্তের কথা বলেছিলেন। এরপর দ্বিতীয়বার তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ বলবে। এতে শহরের অপ্র প্রান্ত ধ্বসে যাবে। এরপর তারা তৃতীয়বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ বলবে। তখন তাদের জন্য পথ প্রশস্ত করে দেয়া হবে। তারা যখন শহরে প্রবেশ করে গনিমতের সম্পদ ভাগাভাগিতে ব্যতিব্যস্ত থাকবে, তখন কেউ উচ্চঃস্বরে বলে উঠবে, দাজ্জালের আগমন ঘটেছে। এ কথা শোনামাত্রই তারা সবকিছু ফেলে রেখে ফিরে যাবে।”[23]
৩. হারমাজিদুনের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া, এর অব্যবহিত পরেই যুগারের ঝর্ণা, ফুরাত নদি এবং তাবারিয়্যা সাগর শুকিয়ে যাওয়া, বাইসানের খেজুরের গাছগুলোতে খেজুর না ধরা ইত্যাদি। যখন হারমাজিদুনের বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হবে, তখন দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের সময় একেবারে ঘনিয়ে আসবে।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“অচিরেই তোমরা রোমানদের সঙ্গে সন্ধি করবে। এরপর তোমরা এবং তারা একত্রিত হয়ে তোমাদের পশ্চাদবর্তী একদল একদল শত্রুর মোকাবেলা করবে। তোমরা বিজয়ী হবে, গনিমত অর্জন করবে এবং নিরাপদে ফিরে আসবে। শেষে তোমরা টিলাবিশিষ্ট একটি মাঠে যাত্রাবিরতি করবে। এরপর খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি ক্রুশ উত্তোলন করে বলবে, শোনো শোনো, ক্রুশ বিজয়ী হয়েছে। এতে মুসলিমদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে তাকে হত্যা করবে। তখন রোমানরা চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং যুদ্ধের জন্য একত্রে সারিবদ্ধ হবে। তারা আশিটি পতাকার অধীনে তোমাদের সামনে উপস্থিত হবে। প্রত্যেক পতাকার সাথে থাকবে দশহাজার করে সৈন্যবাহিনী। অনন্তর মুসলিমরাও অস্ত্র হাতে জ্বলে উঠবে এবং লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। তখন আল্লাহ তাআলা সেই কাফেলাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করার মাধ্যমে সম্মানিত করবেন।”[24]
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
“কিয়ামাত সংঘটিত হবে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না রোমীয় (সিরিয়ার অন্তর্গত) সেনাবাহিনী আ‘মাক অথবা দাবিক নহরের কাছে অবতীর্ণ হবে। তখন তাদের মুকাবিলায় মদিনা থেকে এ দুনিয়ার সর্বোত্তম মানুষের এক দল সৈন্য বের হয়ে আসবে। তারপর উভয় দল সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হবার পর রোমীয় সৈন্যরা বলবে, তোমরা আমাদের সেসকল সাথিদের থেকে পৃথক হয়ে যাও, যারা আমাদের মধ্য থেকেই বন্দি হয়েছিলো। (কিবা তোমরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাও, যারা আমাদের ভাইদেরকে বন্দি করেছে।) আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো।
তখন মুসলিমরা বলবে, আল্লাহ্র কসম, আমরা আমাদের ভাইদের সাথে কখনো সম্পর্কচ্ছেদ করবো না।
পরিশেষে তাদের পরস্পর যুদ্ধ হবে। এ যুদ্ধে মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশ সৈন্য পলায়নপর হবে। আল্লাহ তাআলা কখনো তাদের তাওবা গ্রহণ করবেন না। সৈন্যদের এক তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং তারা হবে আল্লাহ্র কাছে সর্বোত্তম শহিদ। আর সৈন্যদের অপর তৃতীয়াংশ বিজয়ী হবে। যিন্দেগিতে আর কখনো তারা ফিতনায় আক্রান্ত হবে না। তারাই কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় করবে।
তারা নিজেদের তরবারি যাইতুন বৃক্ষে লটকিয়ে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগ করতে থাকবে। ইত্যবসরে তাদের মাঝে শয়তান উচ্চঃস্বরে বলতে থাকবে, দাজ্জাল তোমাদের পেছনে তোমাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে চলে এসেছে। এ কথা শুনে মুসলিমরা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়বে। অথচ তা ছিলো মিথ্যা সংবাদ। তারা যখন শামে পৌঁছবে, তখন দাজ্জালের আগমন ঘটবে।
যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করবে, তখন সালাতের সময় হবে। এরপর ইসা আ. অবতরণ করবেন এবং সালাতে তাদের ইমামতি করবেন। আল্লাহ্র দুশমন তাকে দেখামাত্রই বিচলিত হয়ে পড়বে, যেমন লবণ মিশে যায় পানিতে। যদি ইসা আ. তাকে এমনিই ছেড়ে দেন, তবে সে নিজে নিজেই বিগলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য আল্লাহ তাআলা ইসা আ. এর হাতে তাকে হত্যা করাবেন এবং তিনি ইসা আ. বর্শায় করে তার রক্ত তার বাহিনীকে দেখিয়ে দেবেন।”[25]
আরো বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—
“অচিরেই তোমরা আরব উপদ্বীপে যুদ্ধ করবে, অনন্তর আল্লাহ তা বিজিত করবেন। এরপর পারস্যে যুদ্ধ করবে, অনন্তর আল্লাহ তা বিজিত করবেন। এরপর রোমে যুদ্ধ করবে, অনন্তর আল্লাহ তা বিজিত করবেন। এরপর দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে, অনন্তর আল্লাহ তাতেও বিজয় দান করবেন।” বর্ণনাকারী নাফে‘ রহ. বলেন, হে জাবির, আমরা মনে করি না যে, রোম বিজয় হওয়া পর্যন্ত দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে।[26]
কিতাবিদের ধর্মগ্রন্থেও বিভিন্ন প্রসঙ্গে হারমাজিদুনের যুদ্ধের কথা আলোচিত হয়েছে। যেমন ইনজিলের ২৭শ সিপারা—‘প্রকাশিত কালামে’ এসেছে—
“হিব্রু ভাষায় যে জায়গার নাম হরমাগিদোন, ভূতেরা সেই বাদশাহ্দের সেখানে জড়ো করল। পরে সপ্তম ফেরেশতা তাঁর পেয়ালাটা বাতাসে উবুড় করলেন। তখন ইবাদতখানার সিংহাসন থেকে জোরে এই কথাগুলো বলা হল, “যা হবার তা হয়ে গেছে।” তখন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, ভয়ংকার আওয়াজ হতে ও বাজ পড়তে লাগল এবং এমন ভীষণ ভূমিকম্প হল যা দুনিয়াতে মানুষ সৃষ্টির পর থেকে আর কখনও দেখা যায় নি। সেই ভূমিকম্প খুবই সাংঘাতিক ছিল। সেই নাম-করা শহরটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং বিভিন্ন জাতির শহরগুলো ভেংগে পড়ে গেল। পরে সেই নাম-করা ব্যাবিলনের কথা আল্লাহ্র মনে পড়ল, আর তিনি তাঁর গজবের ভয়ংকর মদে পেয়ালা পূর্ণ করে ব্যাবিলনকে খেতে দিলেন। তখন প্রত্যেকটা দ্বীপ পালিয়ে গেল এবং পাহাড়গুলো আর দেখা গেল না। আসমান থেকে মানুষের উপর বড় বড় পাথরের মত শিল পড়তে লাগল। তার প্রত্যেকটার ওজন ছিল ছত্রিশ কেজি। এতে লোকে শিলের আঘাতের জন্য আল্লাহ্র বিরুদ্ধে কুফরী করতে লাগল, কারণ সেই শিলের আঘাত ছিল ভয়ংকর।”[27]
৪. উনত্রিশজন চরম মিথ্যুক দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ হবে ‘আলমাসিহুদ দাজ্জালে’র আত্মপ্রকাশের ভূমিকা।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“আল্লাহ্র কসম, কিয়ামাত অনুষ্ঠিত হবে না, যাবত্ না ত্রিশজন মিথ্যুকের আত্মপ্রকাশ ঘটে; যাদের শেষজন হবে কানা দাজ্জাল।”[28]
ইমাম নববি রহ. বলেন—
“বিভিন্ন যুগে এসকল মিথ্যুক দাজ্জালের মধ্য থেকে অসংখ্যজনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ধ্বংস করেছেন, তাদের প্রভাব সমূলে উৎপাটন করেছেন। যারা অবশিষত রয়েছে, তাদের সাথেও তিনি একই আচরণ করবেন।”[29]
৪. চরম দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব। আবু উমামা আলবাহেলি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“সারা পৃথিবীতে কৃষিকাজ সম্প্রসারিত হবে। দাজ্জালের আবির্ভাবের তিন বহচর পূর্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। তখন মানুষ চরমভাবে অন্নকষ্ট ভোগ করবে। প্রথম বছর আল্লাহ তাআলা আসমানকে তিন ভাগের এক ভাগ বৃষ্টি আটকে রাখার নির্দেশ দেবেন এবং যমিনকে নির্দেশ দেবেন, ফলে তা এক-তৃতীয়াংশ ফসল কম উৎপন্ন করবে। এরপর দ্বিতীয় বছর তিনি আসমানকে নির্দেশ দেবেন, ফলে তা দু’-তৃতীয়াংশ কম বৃষ্টি বর্ষণ করবে এবং যমিনকে হুকুম দেবেন, ফলে তাও দু’-তৃতীয়াংশ কম ফসল উৎপন্ন করবে। এরপর আল্লাহ তাআলা তৃতীয় বছর আসমানকে নির্দেশ দেবেন, ফলে তা সম্পূর্ণভাবে বৃষ্টিপাত বন্ধ করে দেবে। তখন এক ফোঁটা বৃষ্টিও বর্ষিত হবে না। আর তিনি যমিনকে নির্দেশ দেবেন, ফলে শস্য উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখবে। তখন মাটিতে কোনো ঘাস জন্মাবে না, কোনো সবজি অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে আল্লাহ যা চাইবেন—শুধু তা ছাড়া সকল তৃণভোজী প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে।[30]
৫. ভয়াবহ ফিতনা এবং বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ। রাসুলুল্লাহ সা. অনেকগুলো ফিতনার কথা আলোচনা করে বলেন—
“এরপর ভয়াবহ ফিতনার আগমন ঘটবে। যা এই উম্মাহ্র এমন কাউকে ছাড়বে না, যার গালে তা সজোরে চপেটাঘাত করবে না। যখন মন্তব্য করা হবে যে, তার বোধহয় পরিসমাপ্তি ঘটেছে, তখন তা বিস্তৃত হবে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। সেসময়ে ব্যক্তি সকাল যাপন করবে মুমিন অবস্থায় আর সন্ধ্যা যাপন করবে কাফির অবস্থায়। অবশেষে সকল মানুষ দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে—ইমানের দল, যাদের ভেতর নিফাক নেই এবং নিফাকের দল, যাদের ভেতর ইমান নেই। যখন অবস্থা এমন হবে, তখন তোমরা সেদিনই বা তার পরবর্তী দিনই দাজ্জালের প্রতীক্ষায় থাকো।”[31]
৬. আধুনিক সমরাস্ত্রের পরিসমাপ্তি এবং প্রাচীন ধারার পুনরাবৃত্তি; দাজ্জালের আবির্ভাবের পূর্বে সংঘটিত যুদ্ধের বর্ণনা সম্বলিত হাদিসগুলো থেকে যা সুস্পষ্টভাবে অনুমিত হয়। যেমন—
“তারা এমতাবস্থায় থাকবে, ইত্যবসরে তারা মহাযুদ্ধের কথা শুনতে পাবে। কোত্থেকে এক ধ্বনি ভেসে আসবে—“দাজ্জাল তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের কাছে আগমন করেছে।” এ-কথা শোনামাত্রই তারা হাতে থাকা সবকিছু ফেলে স্বদেশ অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করবে। অনন্তর তারা পরিস্থিতি যাচাই করার উদ্দেশ্যে দশজন ঘোড়সওয়ারকে অগ্রে প্রেরণ করবে।” রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “আমি ওই দশজনকে তাদের নাম, পিতার নাম এবং অশ্বের ধরন সহ চিনি। তারাই সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী বা সর্বশ্রেষ্ঠ অশ্বারোহীদের অন্যতম।”[32]
[1] সুরা বানি ইসরাইল: ৬৫
[2] ফাতহুল বারি, ফিতান অধ্যায়, দাজ্জালের আলোচনা সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ
[3] সুনানে আবি দাউদ: ৪৩৩৪; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৯৮১৮
[4] সহিহ মুসলিম: ২৯৪১; সুনানু আবি দাউদ: ৪৩১০; সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪০৬৯; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৬৮৮১
[5] সহিহ বুখারি: ৪৬৩৫, ৪৬৩৬, ৬৫০৫, ৭১২১; সহিহ মুসলিম: ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯; সুনানু আবি দাউদ: ৪৩১২; জামিউত তিরমিযি: ৩০৭২, ৩৫৩৬; সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪০৬৮; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৬৮৮১, ৭১৬১, ৮১৩৮, ৮৫৯৯, ৮৮৫০, ৯১৭২, ১০৮৫৯, ১১২৬৬, ১১৯৩৮, ১৮১০০, ২১৪৫৯
[6] সুরা নিসা: ১৫৯
[7] ফাতহুল বারি, রিকাক অধ্যায়, সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ। ইমাম তাবারি রহ. এর অভিমতও এটা।
[8] প্রাগুক্ত
[9] আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, আলফিতান ওয়াল মালাহিম অধ্যায়, ভূমি থেকে দাব্বাতুল আরদের আত্মপ্রকাশ এবং মানুষদের সাথে তার কথোপকথন সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ
[10] আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৭০৪০
[11] জামিউত তিরমিযি: ২২৪৮
[12] দাজ্জালের দৈহিক গুণবিশিষ্ট হাদিসসমূহ জানার জন্য দ্রষ্টব্য—সহিহ বুখারি: ১৫৫৫, ৫৯১৩, ৭৪০৮; সহিহ মুসলিম: ১৬৬, ১৬৯, ২৯৩৩, ২৯৩৪; জামিউত তিরমিযি: ২২৩৫, ২২৪৫; সুনানু ইবনি মাজাহ: ২৬২০, ৪০৭৭; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ২৫০১, ২৫০২, ১২০০৪, ১২১৪৫, ১২৭৭০, ১৩০৮১, ১৩১৪৫, ১৩২০৬, ১৩৩৮৫, ১৩৫৯৯, ১৩৬২১, ১৩৯২৫, ১৪০৯৪, ১৪৯৫৪, ২১৯২৯, ২৩২৭৯, ২৩৪৩৯, ২৩৬৭২, ২৫০৮৯। আরো দেখুন—সহিহ বুখারি: ৭১২৮। আরো দেখুন—সুনানু আবি দাউদ: ৪৩২০; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ২২৭৬৪। আরো দেখুন—আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১৬২৬০, ১৩০৮১, ২০১৭৮, ২৩২৭৯, ২৩৪৩৯, ২৩৬৮৫। আরো দেখুন—সহিহ বুখারি: ৩৪৩৯, ৩৪৪০, ৫৯০২, ৬৯৯৯, ৭০২৬, ৭৪০৭; সহিহ মুসলিম: ১৬৯; আলমুয়াত্তা, ইমাম মালিক: ২৬৬৬; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৬৩১২। আরো দেখুন—সহিহ বুখারি: ৪৪০২, ৪৪০৩, ৭১৩১, ৭৪০৮; সহিহ মুসলিম: ২৯৩৩; সুনানু আবি দাউদ: ৪৩১৬, ৪৩১৭, ৪৩২০; জামিউত তিরমিযি: ২২৪১, ২২৪৫; সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪০৭৭; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৬১৮৫, ১১৭৫২, ১২০০৪, ১২৭৭০, ১৩৩৮৫, ১৩৪৩৮, ১৩৬২১, ১৩৯২৫, ১৪০৯৪, ১৪৯৫৪, ২২৭৬৪, ২৩৬৮৫
[13] সহিহ মুসলিম: ৭২৭৬
[14] জামিউত তিরমিযি: ২২৩৭; সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪০৭২; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১২, ৩৩
[15] সহিহ মুসলিম: ২৯৩৭
[16] ইবনু সায়্যাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দ্রষ্টব্য—সহিহ বুখারি: ১৩৫৪, ১৩৫৫,২৬৩৮, ৩০৩৩, ৩০৫৫-৩০৫৭, ৬১৭৪-৬১৭৫, ৬৬১৮; সহিহ মুসলিম: ২৯২৪, ২৯২৮, ২৯৩০-২৯৩২; সুনানু আবি দাউদ: ৪৩২৫-৪৩৩০, ৪৩৩২; সুনানুত তিরমিযি: ২২৪৯; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৩৬১০, ৪৩৭১, ৬৩৬০-৬৩৬৪, ১১৭৫৩, ১১৭৭৬, ২০৪১৮, ২০৫০২,
[17] সহিহ মুসলিম: ৭২৩৯, ৭২৩৮
[18] সহিহ মুসলিম: ২৯৪৬; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১৬২৫৩, ১৬২৬৭
[19] সহিহ বুখারি: ৩০৫৭, ৩৩৩৭, ৩৩৩৮, ৪৪০২, ৬১৭৫, ৭১২৭, ৭১৩১, ৭৪০৮; সহিহ মুসলিম: ১৬৯, ২৯৩৩, ২৯৩৬
[20] সহিহ মুসলিম: ২৯৩৭; সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪০৭৫; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ২১২৯৬
[21] মাজমাউয যাওয়ায়িদ: ৭/৩৩৫
[22] সুনানু আবি দাউদ: ৪২৯৪; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ২২০২৩, ২২১২১
[23] সহিহ মুসলিম: ৭২২৩
[24] সুনানু আবি দাউদ: ২৭৬৭, ৪২৯২, ৪২৯৩; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১৬৮২৬
[25] সহিহ মুসলিম: ৭১৭০
[26] সহিহ মুসলিম: ২৯০০; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ১৫৪১, ১৮৯৭৩
[27] ইনজিল, ২৭শ সিপারা—প্রকাশিত কালাম: পৃ. ৪২০, ১৬/১৬-২১
[28] আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ২০১৭৮
[29] আওনুল মা‘বুদ শারহু সুনানি আবি দাউদ, কিতাবুল মালাহিম, বাবু ইবনি সায়্যাদ, হাদিস: ৪৩৩৪-৪৩৩৫
[30] সুনানু ইবনি মাজাহ: ৪০৭৭
[31] সুনানু আবি দাউদ: ৪২৪২; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৬১৬৮
[32] সহিহ মুসলিম: ২৮৯৯; আলমুসনাদ, ইমাম আহমাদ: ৩৬৪৩, ৪১৪৬