ফিতনার বজ্রধ্বনি—৪
রাসুলুল্লাহ সা. আমাদেরকে অবগত করে গেছেন যে, শেষ যামানায় খারেজিদের পুনরুত্থান হবে এবং হকপন্থীদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা অনিবার্য হবে। খারেজিদের মিশনকে বরবাদ করার জন্য যারা শ্রম-সাধনা ব্যয় করবে, তারা মহান আল্লাহ্র কাছে প্রতিদানপ্রাপ্ত হবে।
হাদিসে এসেছে—
“শেষ যামানায় এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যারা হবে অল্পবয়স্ক যুবক, নির্বোধ। তারা সৃষ্টির সবচে শ্রেষ্ঠতম কথা থেকে আবৃত্তি করবে; অথচ ইমান তাদের গলা অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমন তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়। তাদেরকে যেখানেই তোমরা পাবে, হত্যা করবে। কেননা তাদেরকে হত্যা করলে হত্যাকারীর জন্য কিয়ামাতের দিনে বিরাট প্রতিদান রয়েছে।”[1]
হাফিজ ইবনু হাজার রহ. হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন—
“তারা সৃষ্টির সবচে শ্রেষ্ঠতম কথা থেকে আবৃত্তি করবে”—এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তারা কুরআন পাঠ করবে। সর্বপ্রথম যে দাবি নিয়ে তাদের উত্থান হবে, তা হলো—“আল্লাহ ছাড়া কারো বিচার মানি না”। (উল্লেখ্য, বাক্যটিতে তো বাহ্যত সমস্যা মনে হয় না; কিন্তু এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য অতি নিকৃষ্ট ও মন্দ।)
এখানে আমরা খারেজিদের পুনরুত্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার প্রয়াস পাবো। খারেজিদের বিস্তারিত পরিচয়, ইতিহাস, দৃষ্টিভঙ্গি-আকিদা ইত্যাদি আমাদের এই নিবন্ধের আলোচ্যবিষয় নয়। এখানে আমাদের মৌলিক আলোচ্যবিষয়— ‘খারেজিদের পুনরুত্থান’ প্রসঙ্গ। হাঁ, প্রসঙ্গক্রমে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর দু-চার কথাও এসে যেতে পারে।
নব্য খারেজিদের প্রকার
নব্য খারেজিদেরকে প্রথমে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি—
১. যারা আদি ও আসল খারেজিদের মূলনীতি ধারা এবং আদর্শে একই নীতি অনুসরণ করে। যাদেরকে আমরা ‘জামাআতুত তাকফির ওয়াল হিজরাহ’ নামে নামকরণ করতে পারি; যদিও তারা নিজেদেরকে ‘জামাআতুল মুসলিমিন’ নামে অভিহিত করে থাকে।
২. যাদের মধ্যে খারেজিদের এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য —আকিদা, আদর্শ, অবস্থান, ধারা কিবা নিদর্শন— প্রকাশিত রয়েছে। তাদেরকে পূর্ণ খারেজিদের সারিতে গণ্য করার মতো শর্তাবলি পূর্ণ হয় নি।
ব্যক্তি এবং দলগুলোর মাঝে এই দ্বিতীয় প্রকার আধিক্যের সাথে প্রসার লাভ করেছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায়ই এদের ব্যাধির চিকিৎসা না করা হলে একপর্যায়ে তা প্রকৃত খারেজি-মতবাদে যুক্ত হওয়ার সোপান হয়। সাধারণত দুই শ্রেণির মাঝে এই মতবাদের দ্রুত প্রসার ঘটে—
ক. অল্পবয়স্ক যুবক, যাদের মাঝে বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা—উভয়টির স্বল্পতা রয়েছে। তবে দ্বীনের জন্য প্রাণোৎর্গ করা এবং নিজেকে উজাড় করার জযবা-মানসিকতা রয়েছে।
খ. শিক্ষিত শ্রেণি, যারা অনলাইনে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের মেহনতে রত। এমনকি তাদের অনেকে দ্বীনের পথে এসেছে এবং ইলম হাসিল করেছে এই অনলাইনের মাধ্যমেই। তবে ইসলামি ফিকহের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক-সংযোগ নেই। অন্যান্য বিষয়ে তারা বেশ পাণ্ডিত্য রাখলেও ফিকহের ব্যাপারে তাদের ঝুলি নিতান্তই শূন্য।
ভ্রান্তির উৎস এবং কারণ
যেসব কারণে খারেজি মতবাদের প্রসার ঘটে, তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ—
- ‘আলফিকহু ফিদ-দ্বীনে’র অভাব অথবা অনিরাপদ কোনো মাধ্যম থেকে জ্ঞানার্জন।
- দ্বীনদারির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি এবং সীমালঙ্ঘন।
- ভারসাম্যহীন আত্মমর্যাদাবোধ এবং ইলম এবং হিকমাহশূন্য আবেগ।
- প্রকৃত হকপন্থী আলিমগণের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্নতা, তাদের থেকে দূরে দূরে থাকা, তাদের নির্দেশিত পথ এড়িয়ে চলা এবং তাদের অনুসরণ করার মানসিকতা না থাকা, এমনকি তাদের মানহানি করার জন্য চেষ্টা-শ্রম ব্যয় করা, তাদের গিবত-চোগলখুরি করে অন্তকরণকে বিষাক্ত করে ফেলা।
- লৌকিকতার উদ্দেশ্যে এবং বাহ্বা কুড়ানোর নিমিত্তে ইলম শেখা, অহংবোধে ভোগা, প্রকৃত হকপন্থী আলিমগণকে তাচ্ছিল্য করে নিজেকে শ্রেষ্ঠতর জ্ঞান করা ও মানুষদেরকে আলিমগণের থেকে ফিরিয়ে নিজের অভিমুখী করা এবং মূর্খদের বাহ্বাকে কেন্দ্র করে নিজের ব্যাপারে ‘নিষ্পাপ’ হওয়ার ধারণা রাখা।
- অল্পবয়স্ক, অনভিজ্ঞ এবং স্বল্প বোধ-বুদ্ধির অধিকারী হওয়া।
- সমাজে অত্যাচার অনাচার বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের ধারা একেবারে বন্ধ বা ত্রুটিযুক্ত হয়ে যাওয়া।
- পরিবার, সমাজ কিবা রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর ক্ষোভ থেকে প্রতিশোধপরায়ণ হওয়া।
- অসাধু বিপরীতপক্ষের চক্রান্তে ফেঁসে যাওয়া, অযথা উত্তেজিত হয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত—এমন লোকদের সঙ্গ-সাহচর্য গ্রহণ করা।
- ধৈর্যহীনতা ও দাওয়াহ্র ক্ষেত্রে হিকমাহ্র অভাব।
নব্য খারেজিদের উত্থানের কারণসমূহ
এগুলো তো সাধারণভাবে আহলুস সুন্নাহ্র আদর্শিক পথ থেকে সরে যাওয়ার কতক কারণ। খুরুজ স্বাভাবিকভাবে ক্রিয়া নয়, বরং প্রতিক্রিয়া। হাঁ, প্রতিক্রিয়াটি গলদ। তবে কোনো ক্রিয়ার ফলাফল হিসেবেই তা অস্তিত্ব লাভ করেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নব্য খারেজিরা তাদের সেই মতবাদের সাথে যুক্ত হওয়ার মৌলিক কারণগুলো হলো—
- অধিকাংশ মুসলমান তাদের দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়া—আকিদা, শরিয়াহ, চরিত্র সবদিক থেকে মুসলমানদের চরম অবক্ষয়, ইতিহাস ইতোপূর্বে যার নজির প্রত্যক্ষ করে নি। এসব কারণে তাদের ওপর আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চেপে বসেছে শাস্তি—
“আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, নিশ্চয় তার হবে সংকীর্ণ জীবন আর আমি তাকে কিয়ামাত দিবসে ওঠাবো অন্ধ অবস্থায়।”[2]
বর্তমানকালে দ্বীন থেকে বিমুখতা তো সর্বত্র প্রসার লাভ করেছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিসর—সর্বত্র এই ব্যাধি বিস্তৃতি লাভ করেছে। এর কয়েকটি ক্ষেত্র নিম্নরূপ—
- বিদআত এবং বাতিল আকিদার প্রসার। ফেরকাবাজি, বিচ্ছিন্নতা, প্রবৃত্তিপূজা, দ্বীন নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ ইত্যাদি তো এখন সাধারণ ও নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
- সালাফে সালেহিনের মানহাজ থেকে বিমুখ হওয়া, এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অজ্ঞতা প্রসার লাভ করা কিবা এ ব্যাপারে খোল্লমখোলা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা।
- ধর্মনিরপেক্ষতার অবাধ বিস্তার। যার ফলে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রণীত শরিয়াহব্যবস্থা থেকে বিমুখ হওয়া, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন—তা পরিহার করে ভিন্ন পন্থায় শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করা, নাস্তিকতা এবং পথভ্রষ্ট দল-উপদল অস্তিত্ব লাভ করা, দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি স্পষ্ট অস্বীকৃতি জ্ঞাপন।
- একশ্রেণির আলিম কর্তৃক নিজেদের দ্বীনকে বিকিয়ে, ইলমের সঙ্গে খেয়ানত করে, শাসকদের মনোতুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে শরিয়াহ্য় বিকৃতি সাধন।
- জলে-স্থলে অত্যাচার অনাচার ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়া, অশ্লীলতা এবং বেহায়াপনা বিস্তৃতি লাভ করা এবং এসবের সুরক্ষায় একশ্রেণির মুসলিমদের অসাধারণ শ্রম-সাধনা ও আত্মত্যাগ, আর এর ফলস্বরূপ তারা তাগুতের টার্গেটে পরিণত হওয়া।
- কুফফার গোষ্ঠীর অনুকরণে তাদের কৃষ্টি-কালচার, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আদর্শ-দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি ধারণ করা।
উপরিউক্ত সবগুলো বিষয়ই আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মুসলিম যুবকের রক্তে ঢেউ তোলে। তখন সে এই জাহেলি সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। জাহেলি সমাজব্যবস্থাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার অদম্য তামান্না তার রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে খেলা করে। আর তখনই সঠিক গাইডলাইন না পেলে সে পা বাড়ায় এই ভুল পথে।
- মুসলমানদের থেকে ইসলামি ভাবধারার মৃত্যু ঘটা। আল্লাহ তাআলার হক আদায়ে সামগ্রিক গাফিলতি প্রদর্শন করা। গুনাহ এবং পাপ অবাধ বিস্তৃতি লাভ করা। আল্লাহ্র ভয়, ইসলামি আত্মমর্যাদাবোধ উবে যাওয়া।
- সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধের ধারা বন্ধ বা ত্রুটিযুক্ত হয়ে যাওয়া।
- জুলুমের অবাধ প্রসার ঘটা। সবখানে জুলুম, সবার ওপর জুলুম। কারণ একটাই—মুখে ইসলামের কথা বলা, অন্তরে ইসলামকে ধারণা করা, মুখে আল্লাহ্র তাওহিদের স্বীকৃতি দেয়া, অন্তরে ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠার তামান্না লালন করা।
- কাফিরদের সঙ্গে সখ্যতা প্রতিষ্ঠা করা। তাদেরকে বন্ধু, বরং প্রভু হিসেবে মেনে নেয়া। তাদের মিশন ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। তাদের ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করা। মুসলিমদের বিষয়াদিতে এসকল কাফিরদের অবাধ হস্তক্ষেপ। বুদ্ধিবৃত্তিক, মিডিয়াভিত্তিক এবং অর্থনীতিভিত্তিক যুদ্ধ ও সংঘাত। মুখে সুন্দর সুন্দর বুলি আওড়িয়ে ইসলামের বিনাশ সাধনের ঘৃণ্য প্রয়াস।
- দ্বীন পালনে, সুন্নাহ বাস্তবায়নে নিষিদ্ধতা-কঠোরতা আরোপ এবং বাধাপ্রদান। আলিমগণের ওপর জুলুম। দায়ীদের কার্যক্রমে বাধারোপ। নাস্তিকশ্রেণিকে প্রাধান্যদান, পাপিষ্ঠদের হাতে নেতৃত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ।
- শরয়ি ইলমের ব্যাপারে অজ্ঞতা এবং দ্বীনের ফিকহের স্বল্পতা। নব্য খারেজিদের বাস্তব হালতের ওপর দৃষ্টিপাত করলে এ বিষয়টি প্রোজ্জ্বলভাবে চোখে পড়ে। অজ্ঞতাই তাদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে ভুল পথে নিয়ে পরিচালিত করে।
- উলামাশ্রেণি এবং যুবশ্রেণির মাঝে দূরত্ব। পুরো পৃথিবীর অবস্থাটাই এখন এমন। যুবকরা ব্যাপকভাবে আলিমদের থেকে দূরে দূরে থাকে। কতক দরবারি আলিমদের কারণে, বা বলা যায় সমকালীন গুরত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে অধিকাংশ আলিমদের অপ্রত্যাশিত নীরবতার কারণে, আর জনসম্মুখে কখনো ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার কারণে ব্যাপকভাবে এখন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকরা আলিমদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। হাঁ, ব্যতিক্রমের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। তাছাড়া নিজেদের ইলম ফিকহ এবং হিকমাহ নিয়ে আলিমরাও সচরাচর তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলেই দিনাতিপাত করে। ফলে এই সমস্যা সমাধান হওয়া তো দূরের কথা, ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করেই চলছে।
- দাওয়াহ্র ক্ষেত্রে ভুল পদ্ধতির অনুসরণ। অনেক দাওয়াহপন্থী ব্যক্তি বা সংগঠন শুধু মানুষদের মাঝে জযবা এবং উত্তেজনার আগুনই জাগিয়ে দেয়। এরপর এই জযবাকে কোন ক্ষেত্রে ব্যয় করা হবে, সুনির্দিষ্টভাবে এই পথ আর দেখায় না। ফলে এই জযবাই একসময় তাকে নিয়ে যায় ভুল পথে। আর অনভিজ্ঞ ব্যক্তি একাকী পথচলা শুরু করলে বিচ্যুতি ঘটবে—এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানকালে অনেক দায়ীই শুধু মানুষের আবেগকে জাগিয়ে গায়েব হয়ে যায়। অনেকে তো আবার মানুষের আবেগকে নিয়ে খেলা করে। জিহাদের আবেগ জাগিয়ে তা দিয়ে অর্থ কালেকশন করে, বা তাগুতের দরবারে তাগুতের বিরুদ্ধে বিচার দায়ের করে আসমান থেকে সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশা করে। কিন্তু এই আবেগগুলো হলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো। তাকে সঠিকভাবে কাজে না লাগালে একপর্যায়ে তা হয়ে দাঁড়ায় ধ্বংসের কারণ।
- দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা, সবরের স্বল্পতা এবং হিকমাহ্র অপ্রতুলতা। বাংলায় একটি কথা প্রচলিত রয়েছে—“জোশের সঙ্গে হুঁশ লাগে”। হুঁশহীন জোশ ডেকে আনে বঞ্চনা।
- শরিয়াহ্র জ্ঞানহীন অল্পবয়স্ক নির্বোধশ্রেণির সেলিব্রেটি হয়ে যাওয়া। তারা যখন ইলম ও ফিকহ ছাড়া যুবকদের মাঝে দাওয়াহ্র কাজ করতে থাকে, সুনিশ্চিতভাবে না জানা সত্ত্বেও শরয়ি সমাধানের ফুলঝুরি নিয়ে বসে পড়ে, বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়া এবং আহলুল ইলমের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে যখন সেনসিটিভ বিষয়গুলোতে অবাধে নিজের মত ব্যক্ত করতে শুরু করে, তখনই এই ফিতনা দাঁত মেলে উচ্চকণ্ঠে হেসে ওঠে। সাধারণ মানুষদেরকে প্রকৃত হকপন্থী আলিমদের থেকে দূরে সরানোর ক্ষেত্রেও এদের জুড়ি নেই। তাদের প্রবৃত্তিপ্রসূত বা অবুঝ মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত মতের খেলাফ কোনো মত যদি যেকোনো আলিম কখনো প্রদান করেন, তাহলে এরা তার বিরুদ্ধে যবানদারাযি শুরু করে, তাকে গালমন্দ করতে থাকে, তাগুতের দোসর অভিধায় অভিহিত করে বসে। এরা আদতে দ্বীনের কল্যাণকামিতা থেকেই এরূপ করে। কিন্তু এই গলদ মানহাজের কারণে তা ফিতনা ছড়ায় এবং একপর্যায়ে তা বিরাট হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- ব্যক্তিগত অধ্যয়নের মাধ্যমে ইলমের প্রাথমিক বিষয়াদি জানার পূর্বেই নিজেকে শায়খ ভাবতে শুরু করা। এতোটুকুতেই তুষ্ট হয়ে অহংবোধে ভোগা। আহলুল ইলমকে তাচ্ছিল্য করা এবং তাদের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান করা। দু-চারটি বিষয়ে দু-চার লাইন জেনে গোটা শরিয়াহ্র ব্যাপারে নিজেকে ইমাম মনে করা এবং যারা শরিয়াহ্র ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে, কিন্তু স্পেসিফিক সেই ক’টি বিষয়ে জানার স্বল্পতা রয়েছে, তাদের শানে বেয়াদবিমূলক আচরণ করা।
প্রথম যুগের খারেজিরা নিজেদেরকে মুজতাহিদ ভাবতো, ইলমের নাম নিয়ে তারা বিদগ্ধ আলিমগণের ওপর বড়াই করতো, অথচ সে যুগে তারা ছিলো চরম মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত; যারা তৎকালীন মুজতাহিদ ইমামগণের ছাত্র হওয়ারও যোগ্যতা রাখতো না।
- দ্বীনদারির ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন এবং দ্বীন পালনের ব্যাপারে ই‘তিদাল বর্জন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে, দ্বীন তার ওপর প্রবল হয়ে যায়। কাজেই তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং (মধ্যপন্থার) নিকট থাকো। আশান্বিত থাকো এবং সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতের কিছু অংশে সাহায্যপ্রার্থনা করো।”[3]
অবশ্য দ্বীনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন সাধারণত ‘আলফিকহু ফিদ-দ্বীনে’র অভাবেই হয়ে থাকে। আর এর প্রভাবেই একপর্যায়ে সৃষ্টি হয় খুরুজ।
- আর সর্বোপরি মিডিয়ার কারসাজি এবং অবদান তো রয়েছেই।
নব্য খারেজিদের দৃষ্টিভঙ্গি
- কবিরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি ইসলাম থেকে খারিজ। সে চিরকাল জাহান্নামে বাস করবে। ঠিক যেমন প্রথম যুগের খারেজিরা বলতো।
- তাদের বিরুদ্ধাচারণ যারা যারা করবে —আলিম হোক কিবা সাধারণ ব্যক্তি— তাদেরকে কাফির আখ্যা দেয়া। সুনির্দিষ্ট তাকফিরের ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত সীমালঙ্ঘন করা।
- তাদের দলভুক্ত যারা তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে, কিবা তাদের দলে থেকেও তাদের কোনো উসুলের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে, তাদেরকে কাফির আখ্যা দেয়া।
- তাদের সমাজ ছাড়া মুসলমানদের অন্য সকল সমাজকে কুফরি সমাজ বলে অভিহিত করা এবং তাদের সমাজব্যবস্থাকে জাহেলি সমাজব্যবস্থা বলে আখ্যায়িত করা।
- যারাই আল্লাহ্র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না—তাদের সবাইকে ঢালাও এবং পাইকারিভাবে কাফির ফতোয়া দেয়া। এক্ষেত্রে কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না যাওয়া।
- যারা নিজেদের সমাজ ছেড়ে তাদের অঞ্চলে হিজরত করবে না, তাদের সবাইকে কাফির ফতোয়া দেয়া। তেমনি যারা অন্য কোনো দল বা সংগঠনের সাথে জড়িত, আর তারা সেগুলো ত্যাগ করে তাদের সাথে যুক্ত হয় নি, তাদেরকেও কাফির বলে অভিহিত করা।
- তাদের দৃষ্টিতে যারা কাফির, তাদেরকে যারা কাফির মনে করে না, তাদেরকেও ঢালাওভাবে কাফির বলা।
- তাদের মসজিদগুলো ছাড়া অন্য সকল মসজিদ পরিত্যাগ করা, সেগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এমনকি জুমআও আদায় না করা।
- তাদের আশপাশের সকল মুসলিম সমাজকে বর্জন।
- শিক্ষাদীক্ষা পরিহার করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত বর্জন করা।
- তারা ছাড়া যেকোনো সরকারের অধীনে চাকরি-বাকরি না করা। সামাজিক সংগঠন পরিহার করা। নিজেদের সমাজ ছাড়া অন্য সকল সমাজকেই যেহেতু তারা জাহেলি সমাজ মনে করে, তাই যেকোনোভাবে তার সাথে সম্পৃক্ত হওয়াকে তারা হারাম মনে করে।
- উম্মি হওয়ার দিকে আহ্বান করা। রাসুলুল্লাহ সা. এবং তার অনেক সাহাবি উম্মি ছিলেন। তাই তারা সকল মানুষকে জেনারেল শিক্ষাদীক্ষা পরিহার করার আহ্বান জানায়।
- তারা সাধারণ মুসলমানদের ব্যাপারে ‘তাওয়াককুফ’ করে। অর্থাৎ যতোক্ষণ না তাদের মধ্যে ইসলামের আলামত পাওয়া যায়, ততোক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদেরকে মুসলিম বলা থেকে বিরত থাকা। এক্ষেত্রে আলামত হলো, তাদের জামাআতের সাথে যুক্ত হওয়া এবগ তাদের ঘোষিত ইমামের হাতে বাইয়াত দেয়া।
- তাদের জামাআতই একমাত্র শেষ যামানার জিহাদি জামাআত, যাদের মাঝেই ইমাম মাহদি আবির্ভূত হবেন এবং যারা ইসা আ. এর সাথে দাজ্জালের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে।
- কোনো গুরুত্বপূর্ণ ফরজের স্বার্থে তারচে কম গুরুত্বপূর্ণ ফরজগুলো তরক করা যায়। এজন্যই তারা জুমআ পরিত্যাগ করে এবং দাঁড়ি ছাটাকে বৈধ মনে করে।
- বিদআতি নীতি এবং ধারাকে আঁকড়ে ধরা। যেমন—
- তারা বিশেষ স্বার্থে অনেক ফরজ তরককে বৈধ মনে করে। যেমন জুমআ ও ইদের সালাত। তেমনি অনেক গুনাহে লিপ্ত হওয়াকেও বিশেষ কারণে বৈধ মনে করে। যেমন কাফির নারীকে বিয়ে, দাঁড়ি শেইভ করা ও কাফিরদের জবাইকৃত পশু খাওয়া ইত্যাদি।
- শরিয়াহ্র নতুন ধারা উদ্ভাবন করা, যা সালাফের ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইজমাকে অস্বীকার করা। তাকলিদ এবং অনুসরণকে ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ অভিহিত করা। সকল মানুষের ওপর ইজতিহাদ আঁকড়ে ধরার বাধ্যবাধকতা আরোপ।
- সাহাবা, তাবেয়িন এবং ইমামগণের বুঝের ওপর নির্ভরতা না রাখা।
- ইসলামের ইতিহাসের খিলাফাহব্যবস্থাকে অস্বীকার করা এবং সেই যুগকেও কুফরের যুগ বলে অভিহিত করা।
- মাত্রাতিরিক্ত কঠোর আচরণ।
- তাদের দলভুক্ত নয়, এমন সকল মুসলমানের জান-মালকে হালাল মনে করা, তাদের ওপর আক্রমণকে বৈধ মনে করা এবং তাদেরকে মুরতাদ বলে ফতোয়া দেয়া।
- ‘আলওয়ালা ওয়াল বারা’র আকিদা প্রসঙ্গে অস্বাভাবিক সীমালঙ্ঘন।
- অপরাপর মুসলমানদের সাথে ইসলামের ‘শাআয়ির’ পালন না করা, বরং আলাদাভাবে পালন করা।
- কখনো-কখনো শিয়াদের মতো ‘তাকিয়্যা’র আশ্রয় নেয়া।
- ‘জাহালাত’কে কোনো অবস্থায়ই ওযর হিসেবে গ্রহণ না করা।
[1] সহিহ বুখারি: ৬৯৩০, ৩৬১১, ৫০৫৭; সহিহ মুসলিম: ১০৬৬
[2] সুরা তহা: ১২৪
[3] সহিহ বুখারি: ৩৯