ফিকহুস সিরাত – ৮ 

 

নবুওয়াতের তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন কিছু মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে তখন আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় রাসুল সা.কে প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রদানের জন্য নির্দেশ দেন। সে সময়ে কুরআনের এই আয়াত দুটি অবতীর্ণ হয়—

অতএব আপনাকে যা আদেশ করা হয় আপনি তা প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন এবং মুশরিকদের উপেক্ষা করুন।[1]

এবং আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন।[2]

তবে রাসুলুল্লাহ সা. এ সময়ও ইতিপূর্বে ইমান-আনয়নকারী সাহাবিদের নাম প্রকাশ করেননি। তারা কখন ইমান এনেছে, কীভাবে ইমান এনেছে এবং ইমান আনার পরে কী কী করেছে এসব বিষয় তিনি সম্পূর্ণই গোপন রেখেছিলেন; যাতে করে তারা বর্বর মুশরিকদের তাদের নির্যাতিত হতে না হয়। রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবিদেরও ইমানের ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দেননি। তাই তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াত সূচনা করার পরও সাহাবিদের ইসলামিক গোপন কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। এ কারণেই সে সময়েও সাহাবি আরকাম ইবনু আবিল আরকাম রা.’র বাসভবনে পূর্বের মতোই ইমানের মেহনতের কার্যক্রম জারি ছিল। রাসুলুল্লাহ সা.ও তাদের সঙ্গে সেখানে মিলিত হতেন।

নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছরে যখন উমর রা. ইসলামগ্রহণ করেন তখনও তিনি তার আপন বোন ফাতিমা এবং ভগ্নিপতি সাইদ ইবনু যায়দ রা.’র ইসলামগ্রহণ সম্পর্কে জানতেন না, অথচ তারা উভয়ে গোপন দাওয়াতের সময়েই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসেছিলেন। এবং তিনি তার ভগ্নিপতির থেকে বিস্তারিত জেনে সাহাবি আরকাম রা.’র বাড়িতেই রাসুলুল্লাহ সা.’র সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, যেখানে সে সময়ে তিনি তার সাহাবিদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন।[3]

রাসুলুল্লাহ সা. যখন প্রকাশ্য দাওয়াতের জন্য আদিষ্ট হন তখন তিনি কুরাইশের মাঝে প্রকাশ্য দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। কখনো একেক গোত্রকে আলাদা করে আর কখনো তাদের সবাইকে একত্রিত করে দাওয়াতপ্রদানের ধারা অব্যাহত রাখেন।[4] পরিবারের প্রতিটি সদস্যকেও আলাদা আলাদাভেব সম্বোধন করে তাদের সামনে ইসলামের বাণী তুলে ধরেন। হাদিসে এসেছে, একদা তিনি বলেন—

‘হে মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমা, হে আব্দুল মুত্তালিবের কন্যা সাফিয়্যা, হে আব্দুল মুত্তালিব, আল্লাহর সামনে আমি তোমাদের ব্যাপারে কোনো কিছুরই কর্তৃত্ব রাখি না। হাঁ, আমার ধন-সম্পদের যা ইচ্ছা তোমরা চেয়ে নিতে পারো। (কিন্তু আল্লাহর আজাব থেকে নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করো। কারণ, আমি তোমাদের আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচাতে পারব না।)[5]

প্রথমদিকে তারা রাসুলুল্লাহ সা.’র দাওয়াত গ্রহণ না করলেও কঠোরভাবে তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেনি, তার ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়নি। হয়তো তারা সে সময়ে রাসুলুল্লাহ সা.কে একজন ‘হানিফ’ই ভেবেছিল। জাহেলি যুগেও মিল্লাতে ইবরাহিমের[6] অনুসারী আল্লাহ তাআলার জন্য একনিষ্ঠ কিছু বান্দা ছিল, যারা কখনো শিরকে লিপ্ত হয়নি, তারা তাওহিদে বিশ্বাসী ছিল এবং ইবরাহিম আ.’র আদর্শকে আঁকড়ে থেকে জাহিলিয়াত থেকে নিজেদের দূরে রাখত। এ ধরনের বান্দাদের একেকজনকে ‘হানিফ’ এবং সম্মিলিত সবাইকে ‘হুনাফা’ বলা হয়ে থাকে। আসমা বিনতু আবি বকর রা. বলেন—

আমি যায়দ ইবনু আমর ইবনু নুফায়লকে দেখেছি অতিবৃদ্ধ অবস্থায়, তিনি কা‘বার দেয়ালে তার পিঠ দিয়ে হেলান দিয়ে বলছিলেন, ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়, ওই সত্তার শপথ যার হাতে যায়দ ইবনু আমরের প্রাণ। আমি ছাড়া তোমাদের আর কেউই ইবরাহিম আ.’র দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত নেই।’ এরপর তিনি বলতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ, যদি আমি জানতাম কোন পন্থায় ইবাদত করা তোমার নিকট অধিক পছন্দনীয় তাহলে আমি অবশ্যই সে পন্থায় তোমার ইবাদত করতাম। কিন্তু আমি যে জানি না।’ এরপর তিনি তার হাতের তালুর ওপর সিজদা করেন।[7]

যতক্ষণ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সা. তাদের সামনে মূর্তিপূজার অসারতা বয়ান করেননি, তাদের তাগুতকে অস্বীকার করার প্রতি আহ্বান জানাননি ততদিন পরিস্থিতি এমন শান্তই ছিল। কিন্তু নবুওয়াতের চতুর্থ বছর যেইমাত্র রাসুলুল্লাহ সা. তাগুতের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, প্রকাশ্যে তাগুতের সমালোচনা করলেন ঠিক সে মুহূর্ত থেকেই মক্কাবাসীরা রাসুলুল্লাহ সা.’র বিরোধিতায় কোমর বেঁধে নেম পড়ল।

 

ফিকহ

 

১. হক এবং বাতিলের মাঝে দ্বন্দ্ব চিরন্তন। তবে এই দ্বন্দ্ব তখনই সংঘাতের রূপ নেয় যখন হকপন্থীরা বাতিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করে। মক্কায় রাসুলুল্লাহ সা. যদি শুধু তাওহিদের ইতিবাচক দাওয়াতের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতেন, তিনি যদি তাগুতের বিরুদ্ধে আর কিছুকাল নীরব অবস্থানে থাকতেন তাহলে তাকে এই প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে পড়তে হতো না। হাজার হাজার সাহাবি দলে ভেরার অপেক্ষাও তিনি করেননি। যখন হকপন্থীদের ছোট্ট একটি জামাআত প্রস্তুত হলো এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নির্দেশ আসল তখন তিনি কালবিলম্ব না করে তাগুতের বিরুদ্ধে দৃপ্তকণ্ঠে অবস্থান গ্রহণ করলেন। হক কখনো বাতিলের সঙ্গে আপোষ করে চলেনি। হক যতদিন মাথা উঁচে করে বেঁচেছিল ততদিন নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব তাদেরই ছিল। পক্ষান্তরে হক যখন বাতিলের সঙ্গে আপোষ করেছে কিংবা বাতিলের ভয়ে তার বিরোধিতার ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেছে তখনই তার অনুসারীদের ভাগ্যে নেমে এসেছে লাঞ্ছনা এবং বঞ্চনা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

‘তোমাদের জন্য ইবরাহিম এবং তার সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, যখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বললেন, “তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর যা-কিছুর উপাসনা করছ, এসব কিছুর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের অস্বীকার করলাম। আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেছে—যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনয়ন করবে।”’[8]

আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি রহ. তার সিরাতে মুস্তফা গ্রন্থে বলেন—

নবিজি সা. প্রকাশ্যে কুফর এবং শিরকের বিরোধিতা করেছেন। মূর্তি ও মূর্তিপূজার নিন্দা করেছেন। আল্লাহর শত্রুদের (ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি) বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে বৈরিতা রেখেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। তার এবং তার সাহাবিদের অবিচলতা এ কথার স্পষ্ট দলিল যে, ইমান এবং ইসলামের জন্য শুধু অন্তর এবং মুখের স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়, বরং কুফর এবং কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি, শিরক এবং শিরকের সঙ্গে অপরিহার্যভাবে সম্পৃক্ত কার্যাবলির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং এর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা একান্ত অপরিহার্য এবং আবশ্যকীয় একটি বিষয়। (এরপর তিনি উপরিউক্ত আয়াতটি উল্লেখ করেন। তারপর বলেন,) এই আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, যেমনিভাবে ইমানদারদের জন্য আল্লাহ তাআলা এবং তার রাসুল সা.’র প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের ঘোষণা প্রদান করা জরুরি, একইভাবে আল্লাহর দুশমনদের সঙ্গে বিদ্বেষ এবং শত্রুতার ঘোষণা দেওয়া জরুরি। রাসুলুল্লাহ সা. আলি রা.কে নবম হিজরিতে শুধু এ কারণে হজে পাঠিয়েছেন যে, যাতে করে তিনি হজের মৌসুমে (কুফফার গোষ্ঠীর সঙ্গে) সম্পর্ক ছিন্নের কথা ঘোষণা করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সুরা তাওবার প্রথম দিকের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছিল। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ রাখে, সে তার ইমানকে পূর্ণ করেছে।”[9] আল্লাহর ভালোবাসা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হতে পারে না, যতক্ষণ না আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে বিদ্বেষ এবং শত্রুতা পরিপূর্ণ না হয়। অন্তরে আল্লাহর শত্রুদের জন্য যে পরিমাণ দুর্বলতা রয়েছে, অন্তর আল্লাহর ভালোবাসা থেকে সে পরিমাণ শূন্য। “আল্লাহ কারও অভ্যন্তরে দুটো অন্তর সৃষ্টি করেননি।”[10] এ কারণে একটা অন্তরে পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটো জিনিস কীভাবে অবস্থান করতে পারে? প্রকৃত মুমিন তো সেই ব্যক্তি, যে এক আল্লাহর খুশি এবং সন্তুষ্টির জন্য সমগ্র বিশ্বের অসন্তুষ্টিকে দানা পরিমাণও পরোয়া করে না। কবি বলেন, “আমি তো আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সকল মানুষকে অসন্তুষ্ট করেছি।” নবিগণের সুন্নাহই এটা, তারা যেমনিভাবে মহান প্রতিপালকের প্রতি ইমান এবং বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিতেন, একইভাবে কুফর, শিরক এবং তাগুতের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের জন্যও দাওয়াত দিতেন। আল্লাহ বলেন, “তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদের তাগুতকে অস্বীকারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”[11] বিস্তারিত জানতে চাইলে ইমাম মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ.’র মাকতুবাত (১/৩২৫, মাকতুব : ২৬৬) অধ্যয়ন করুন।’[12]

 

২. রাসুলুল্লাহ সা. এই পুরো সময়টাতে এবং এর পরেও মাক্কিজীবনের বাকি অংশে মানুষদের তাওহিদের দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। এটা শুধু তার একারই নয়, বরং সকল নবিরই দাওয়াত ছিল।[13] দায়িদের জন্যও তাওহিদের দাওয়াত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাওহিদ বাদ দিয়ে শুধু আমলের দাওয়াত কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনে না। তাওহিদ যখন শুধু হয়ে যায় তখন অন্যান্য আমলও ঠিক হয়ে যায়, এমনকি যে আমলগুলো করার হিম্মতও সচরাচর হয়ে ওঠে না, তা সুনিপুণভাবে আঞ্জাম দেওয়ার তাওফিকও পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে তাওহিদ যদি ঠিক না হয় তাহলে অন্য সকল আমল ক্ষেত্রবিশেষ মরীচিকায় পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন—

‘আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি অভিমুখ করে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় (নিষ্ফল) পরিণত করব।’[14]

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন—

‘বান্দার তাওহিদ যতটা মজবুত হয় তার জন্য আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ততটা পরিপূর্ণ হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে এ অবস্থায় মিলিত হবে যে, সে কোনো অবস্থায়ই আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করেনি, আল্লাহ তার পাপরাশিকে ক্ষমা করে দেবেন—তা যত বেশিই হোক না কেন; তিনি এর কারণে তাকে শাস্তি দেবেন না।’[15]

তিনি আরও বলেন—

যেহেতু মুশরিক ব্যক্তির মৌলিক উপাদান এবং সত্তা পুরোটাই দূষণীয়, তাই জাহান্নামের আগুন তার দূষণ পবিত্র করবে না। বরং সে যদি জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে আসে তাহলে সে যেমন ছিল তেমন রূপেই ফিরবে; যেমনিভাবে কুকুর যদি সমুদ্রে ঢুকে পড়ে এবং এরপর বেরিয়ে আসে। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা মুশরিকের ওপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন।[16]

এ কারণেই আল্লাহর পথের দায়ীদের জন্য তাওহিদের দাওয়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যে দাওয়াত দিয়েছেন প্রিয়নবি সা. তার মাক্কি জীবনের পুরো তেরোটি বছর এবং যা জারি ছিলো মাদানি জীবনেও।

 

২. রাসুলুল্লাহ সা. গোটা জগতবাসীর জন্য প্রেরিত নবি। এরপরও তিনি প্রথমে দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আত্মীয়-পরিজনদেরই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। এর দ্বারা নিজের পরিবার-পরিজনের মাঝে দীনের দাওয়াতের গুরুত্ব অনুমিত হয়।[17] কিয়ামাতের দিন এ ব্যাপারে মানুষ বিশেষভাবে জিজ্ঞেসিত হবে। তাই অন্যদের থেকে তারাই এর বেশি হকদার। এরপর পর্যায়ক্রমে তার ধারা প্রলম্বিত হতে থাকবে। এক্ষেত্রে বাধা আসলেও মনোবল হারানোর কিছুই নেই। কারণ, এটা কল্পনাই করা যায় না যে, কোনো ব্যক্তি মিল্লাতে ইবরাহিমের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে আর তার বিরুদ্ধাচারণ করা হবে না। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাইখ আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির রহ. সুন্দর বলেছেন—

‘জেনে রেখো, আলিমগণের কর্তব্য, নির্ভয়ে দৃপ্তকণ্ঠে সত্য উচ্চারণ করা। তাদের কর্তব্য, তারা যা-কিছু পৌঁছানোর ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছে কোনো ধরনের শিথিলতা কিংবা অবহেলা ব্যতীত তার সবটুকুই পৌঁছে দেওয়া। আমার ব্যাপারে এই নব্য ‘ইয়াসিক’পূজারীরা এবং এর মদদদাতারা মন্তব্য করবে যে, আমি ধর্মান্ধ, আমি পশ্চাদপরায়ণ এবং এ ধরনের আরও অনেক বাজে মন্তব্য তারা করবে। আরে, তারা যা ইচ্ছা বলুক। আমি কোনোদিনই এর পরোয়া করিনি যে, আমার ব্যাপারে কী বলা হচ্ছে। তবে আমি সর্বদা তা-ই বলেছি, যা বলা আমার ওপর অপরিহার্য।’[18]

 

৩. পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ সত্য গ্রহণের পথে অনেক বড় বাধা। রাসুলুল্লাহ সা. যখন মক্কার মুশরিকদের ইমানের দাওয়াত দেন তখন তারা এই অজুহাত দেখিয়েই ইমান আনয়ন থেকে বিরত থেকেছিল। কুরআনের ভাষায়—

‘আর যখন তাদের বলা হয়, “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কোরো তখন তারা বলে, (না,) বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যার ওপর (যে মতবাদ-মতাদর্শের ওপর) পেয়েছি তার অনুসরণ করব; যদিও তাদের পিতৃপুরুষেরা কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎপথপ্রাপ্তও ছিল না।’[19]

ধার্মিক কিংবা অধার্মিক, জীবনের কোনো ক্ষেত্রে যারাই কুরআন-সুন্নাহর ওপর নিজেদের পূর্বপুরুষদের রীতি-নীতি ভাবনা-চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছে তারাই সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা.’র দাওয়াতের প্রেক্ষিতে আবু লাহাব তার কাওমের লোকদের বলল, ‘হে মানুষসকল, এই ছেলে তো তোমাদের পিতৃপুরুষের দীন ত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছে।’[20] এমনকি কেউ যদি ইমানকে অনুধাবন না করে, অন্তরে ইয়াকিন এবং স্বাধীন চিন্তা ব্যতিরেকে স্রেফ বড়দের অনুকরণে তাওহিদের কালিমা ঘোষণা করে তাহলে তার ইমানও পূর্ণতা লাভ করে না এবং সে প্রতিনিয়ত সন্দেহ-সংশয়ের ভেলায় ভাসতে থাকে, যেকোনো সময় তার পদস্খলনের সমূহ শঙ্কা থেকেই যায়। জাওহারাতু তাওহিদীর গ্রন্থকার বলেন—

‘তাওহিদের ক্ষেত্রে যারা অন্ধ অনুকরণ করে তাদের ইমান দোদুল্যমানতা থেকে মুক্ত হতে পারে না।’[21]

 

৪.  আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সা.কে নির্দেশ দিচ্ছেন—

অতএব আপনাকে যা আদেশ করা হয় আপনি তা প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন এবং মুশরিকদের উপেক্ষা করুন।[22]

আমাদের সমাজে অনেক দীনদার যুবক এমন রয়েছে, যারা প্রকাশ্যে দীনের কথা বলতে লজ্জাবোধ করে। পরিবারে কিংবা বন্ধুদের মজলিসে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহতব নিয়ে আলোচনা করতে ইতস্তত করে। এমনকি চক্ষুলজ্জার কারণে প্রিয়নবি সা.’র ওপর দুরুদ পাঠ থেকেও বিরত থাকে। মসজিদে আজান হয়, কিন্তু সে যে উপস্থিত মানুষদের নামাজে পড়ে আসতে বলবে এই সৎসাহসটুকু তার হয়ে ওঠে না। এ সকল যুবকদের জন্য উপরিউক্ত আয়াতে উত্তম পথনির্দেশনা রয়েছে। ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন—

যে নির্জনতায় এবং মানুষের উপস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে সে-ই প্রকৃত আল্লাহপ্রেমিক। যে মানুষের উপস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে আর নির্জনতায় তা হারিয়ে ফেলে সে রোগী। যে মানুষের উপস্থিতিতে এবং একাকী নির্জনতায় (উভয় অবস্থায়) আল্লাহর প্রতি ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে সে মৃত, বিতাড়িত। যে মানুষের উপস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি ঘনিষ্ঠতাবোধ হারিয়ে ফেলে, তবে একাকী নির্জনতায় তা অনুভব করে সে দুর্বল সত্যবাদী (প্রেমিক)।[23]

 

৫. বিধর্মীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতির কতটুকু গ্রহণ করা যাবে রাসুলুল্লাহ সা.’র দাওয়ায়তের ঘটনায় এই শিক্ষাও পাওয়া যায়। তিনি যখন কুরাইশদের সকল গোত্রকে সম্মিলিতভাবে দাওয়াত দিতে চাইলেন তখন তিনি সাফা পর্বতে উঠে উচ্চস্বরে ‘ওয়া সাবাহাহ’ বললেন। সে সুয়ে আরবের রীতি ছিল, ভয়াল কোনো বিপদ যদি হঠাৎ উপস্থিত হতো আর কোনো ব্যক্তি সবাইকে সতর্ক করতে চাইত, সে নিজের কাপড় খুলে ফেলত, চেহারায় মাটি মাখত আর জোরে জোরে ‘ওয়া সাবাহাহ’ বলে চিৎকার করত। এটা তাদের চিরাচরিত প্রথা ছিল। কাউকে এমনটা করতে দেখল সকলে সবকিছু ফেলে তার সামনে উপস্থিত হতো। এরপর সে সকলকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করত। রাসুলুল্লাহ সা.ও তাদের সেই প্রচলিত পন্থাকে কাজে লাগিয়ে সকলের সামনে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরেছেন। তবে তিনি প্রচলিত পন্থাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি। তিনি এর যতটুকু শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করেছেন। তিনি তাদের মতোই ‘ওয়া সাবাহাহ’ বলে সকলকে একত্রিত করেছেন; কিন্তু তিনি নিজের কাপড় খুলেননি এবং চেহারায় মাটি মাখেননি। কারণ, ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো জাহিলিয়াত। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিধর্মীদের জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতির শুধু সেই অংশটুকুই গ্রহণ করা যাবে, যা কোনোভাবেই ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। সুতরাং অন্যদের থেকে কোনোকিছুই গ্রহণ করা যাবে না এটা যেমনিভাবে ঠিক নয়, একইভাবে চোখ বন্ধ করে তাদের সবকিছু গ্রহণ করে নেওয়া হবে এটাও ঠিক নয়; বরং ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা হলো, তাদের বিষয়-আশয়কে ইসলামি শরিয়াহর কষ্টিপাথরে যাচাই করা হবে। এরপর যা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, তা-ই শুধু গ্রহণ করা যাবে। আর যা উত্তীর্ণ হবে না, নিঃসঙ্কোচে তা বর্জন করা হবে।

 

৬. রাসুলুল্লাহ সা. যখন দীনের দাওয়াত তুলে ধরেন, তখন আবু লাহাব অলে ওঠে, ‘ধ্বংস হও। এ জন্য কি আমাদের একত্রিত করেছ?’ ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরার সাথে সাথেই বাতিলের পক্ষ থেকে তীর্যক কথা উচ্চারিত হয়েছে। তবে এতে কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা. দমে যাননি বা তার মনোবল হারাননি। হকের বাণী উচ্চারিত হবে আর বাতিল তার বিরুদ্ধাচারণ করবে না এটা তো ভাবাই যায় না। বাতিলের বিরুদ্ধাচারণ তো এক চিরাচরিত ব্যাপার। কুরআনের ভাষায়—

‘তারা নিজেদের মুখের ফুৎকারে আলালহর নুরকে নিভিয়ে দিতে চায়। আর আল্লাহ তার নুরকে পূর্ণতা দান করবেন; যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।’[24]

আপনিও যদি দীনের বার্তা তুলে ধরেন, ইসলামের বাণী প্রচার করেন তাহলে বাতিল আপনার বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। সৎকাজের নির্দেশের ক্ষেত্রে এই বিরোধিতার পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকবে। তবে যখনই আপনি অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবেন তখনই আলোর শত্রুরা তেড়ে আসবে। মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নতার দোহাই দিয়ে তারা আপনাকে একঘরে করে ফেলবে। এটা যে শুধু কাফিরদের থেকে হবে তা-ই নয়; বরং ইসলামের মাজলুম কোনো বিধানের পক্ষে কথা বলার কারণে একদল মুসলিমের পক্ষ থেকেও আপনি প্রচণ্ড বিরুদ্ধাচারণের সম্মুখীন হতে পারেন। এ সকল ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা.’র মতো দৃঢ় মনোবল রাখুন। আল্লাহর ওয়াদার ওপর বিশ্বাস রাখুন; তিনি তো তার দীনকে বিজয়ী করবেনই। বিরুদ্ধাচারণকারীদের তীর্যক কথায় আশাহত হবেন না। কারণ, তাদের এ বিরোধিতা আপনার ত্রুটির কারণে নয়, বরং তাদের অভ্যন্তরীণ ভয়ানক ব্যাধির কারণেই হয়ে থাকে। তাই সবর করুন। নামাজ এবং সবরের মাধ্যমে সাহায্যপ্রার্থনা করুন। জেনে রাখবেন, আল্লাহ সবরকারীর সঙ্গে রয়েছেন।[25]

 

৭. আবু লাহাব রাসুলুল্লাহ সা.’র শানে বেয়াদবিমূলক কথা বলার পর পবিত্র কুরআনের সুরা লাহাব অবতীর্ণ হয়, যাতে আবু লাহাবের জাহান্নামি হওয়ার ঘোষণা রয়েছে। এটা পবিত্র কুরআনের অন্যত্ম মু‘জিযারই অন্তর্ভুক্ত। কারণ, আবু লাহাব তখনও মৃত্যুবরণ করেনি। মক্কায় মুশরিক তো কতই ছিল, এমনকি রাসুলুল্লাহ সা.’র বিরুদ্ধাচারণকারী মুশরিকদের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। তাদের অনেকে তো এমনও ছিল যে, প্রথম দিকে বিরোধিতা করলেও শেষাবধি তারা ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিল। কিন্তু আলোচ্য সুরায় জীবিত আবু লাহাব এবং তার স্ত্রীর ব্যাপারে জাহান্নামের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, অন্য কারও ব্যাপারে দেওয়া হচ্ছে না। এবং পরিণতিতেও দেখা গেছে, অন্যরা ইমান আনলেও আবু লাহাব এবং তার স্ত্রীর মৃত্যু কুফরের হালতেই হয়েছে। এ থেকে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, এই কুরআন কখনোই মুহাম্মাদ সা.’র রচনা নয়; কারণ, তার রচনা হলে কিছুতেই তিনি একজন জীবিত ব্যক্তির ব্যাপারে এই নিশ্চয়তা দিতে পারতেন না। বরং এই কুরআন মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ; যিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত।

 

৮. মুশরিকদের এ সকল তীর্যক কথাবার্তায় যে রাসুলুল্লাহ সা.’র অন্তর সংকুচিত হয়ে যেত। আল্লাহ বলেন—

আমি তো জানি যে, তারা বলে তাতে আপনার অন্তর সংকুচিত হয়। সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাসবিহ পাঠ করুন এবং আপনি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হোন। আর মৃত্যু আসা পর্যন্ত আপন প্রতিপালকের ইবাদতে রত থাকুন।[26]

আলোচ্য আয়াতে কিয়ামাত পর্যন্ত আগত সকল দায়ীর করণীয় নির্দেশ করা হয়েছে। এ পথে যখনই যেকোনো কারণে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে এবং অন্তর সংকুচিত হয়ে যাবে তখন করণীয় হবে, আল্লাহ তাআলার প্রতি অভিমুখী হওয়া এবং তার প্রশংসাসহ তাসবিহ পাঠ করা এবং নিজের আমল-ইবাদত নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া; যাবত্‌ না মৃত্যু আসে। আল্লাহ বলেন—

বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমিই তোমার জন্য যথেষ্ট।[27]

 

টীকা 

 

[1] সুরা হিজর (১৫) : ৯৪

[2] সুরা শুআরা (২৬) : ২১৪

[3] মিন মায়িনিস সিরাত : ৪৮

[4] সহিহ বুখারি : ৪৭৭০; সহিহ মুসলিম : ২০৪, ২০৮

[5] সহিহ বুখারি : ৩৫২৭; সহিহ মুসলিম : ২০৪, ২০৫

[6] মিল্লাতে ইবরাহিম সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে পড়ুন—মিল্লাতে ইবরাহিমের জাগরণ এবং ইবরাহিম আ.’র আদর্শ

[7] সিরাতু ইবনি হিশাম : ১/২২৫

[8] সুরা মুমতাহিনা : ৪

[9] সুনানু আবি দাউদ : ৪৬৮১; মুসনাদু আহমাদ : ৩/৪৩৮

[10] সুরা আহযাব (৩৩) : ৪

[11] সুরা নিসা (৪) : ৬০

[12] সিরাতে মুস্তফা : ১/১৯৮-১৯৯

[13] সুরা আম্বিয়া : ২৫

[14] সুরা ফুরকান (২৫) : ২৩

[15] তাহযিবু মাদারিজুস সালিকিন লি-ইবনিল কায়্যিম, শাইখ আব্দুল মুনইম ইবনু সালিহ : ১৮৬

[16] যাদুল মাআদ : ১/১৬৮

[17] আরও দেখুন—সুরা তাহরিম : ৬

[18] হুকমুল জাহিলিয়্যাহ :

[19] সুরা বাকারা (২) : ১৭০

[20] উয়ুনুল আসার, ইবনু সায়্যিদিন নাস : ১/১০১

[21] ফিকহুস সিরাত, সাইদ রামাদান বুতি : ১১৫

[22] সুরা হিজর (১৫) : ৯৪

[23] আলফাওয়ায়িদ, ইবনুল কায়্যিম : ৪৩

[24] সুরা সফ (৬১) : ৮

[25] সুরা বাকারা (২) : ১৫২-১৫৩

[26] সুরা হিজর (১৫) : ৯৭-৯৯

[27] সুরা হিজর (১৫) : ৯৫

Share This