হেরা গুহায় জাগরণের অবস্থায় প্রথম ওহিস্বরূপ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত আর কোনো ওহি অবতীর্ণ হয়নি।[1] এ সময়টা রাসুলুল্লাহ সা.-এর জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় ছিলো। সহিহ বুখারির সূত্রে ওপরে ওয়ারাকা রা.-এর কথা উল্লেখিত হয়েছে। সেই বর্ণনায় উপরিউক্ত অংশের শেষে রয়েছে, ‘এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা রা. ইন্তেকাল করেন। আর ওহি স্থগিত থাকে।’[2]
সহিহ বুখারির অপর এক বর্ণনায় এসেছে, ‘এরপর কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ারাকা রা.-এর ইন্তেকাল হয়। আর কিছুদিনের জন্য ওহিও বন্ধ থাকে। এমনকি রাসুলুল্লাহ সা. এ অবস্থার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এমনকি আমরা এ সম্পর্কে তার থেকে জানতে পেরেছি যে, তিনি পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে লাফ দেয়ার উদ্দেশ্যে (আত্মহত্যা করার জন্য) একাধিকবার দ্রুত সেখানে গমন করেছেন। যখন নিজেকে নিক্ষেপ করার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতেন, তখনই জিবরিল আ. তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে বলতেন, ‘হে মুহাম্মাদ, নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসুল।’ এতে তাঁর অস্থিরতা প্রশমিত হতো এবং তিনি শান্তিবোধ করতেন। তাই সেখান থেকে ফিরে আসতেন। ওহি বন্ধ অবস্থা যখন তাঁর ওপর দীর্ঘায়িত হতো, তখনই তিনি অনুরূপ উদ্দেশ্যে সেখানে দ্রুত চলে যেতেন। যখনই তিনি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতেন, তখনই জিবরিল আ. তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে পূর্বের মতো বলতেন।’[3]
এখানে একটি বিষয় সবিশেষ লক্ষণীয়। উপরিউক্ত বর্ণনায় লক্ষ করা যাচ্ছে যে, ওহি স্থগিত থাকার এই সময়কালে রাসুলুল্লাহ সা. একাধিকবার পাহাড় থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্যে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করেছেন এবং প্রত্যেকবার জিবরিল আ. এসে রাসুলুল্লাহ সা.-কে সান্ত্বনা দিয়ে থামিয়েছেন। এটা সে সময়ে ঘটেছে, যখন পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সা. নবুওয়াত লাভ করলেও রিসালাত লাভ করেননি, স্বতন্ত্র কোনো শরিয়াহ যখন পর্যন্ত তিনি প্রাপ্ত হননি। আত্মহত্যা হারাম হওয়ার বিধান নাজিল হয়েছে এরও অনেক পরে। তাই এই হাদিসের ওপর এ কথা বলে আপত্তি করার সুযোগ নেই যে, ‘তবে কি রাসুল সা. নিজেই শরিয়াহ-পরিপন্থী কাজ করেছেন?’ সিরাতের কোনো কোনো গ্রন্থে দেখা গেছে, উপরিউক্ত সংশয়ে আক্রান্ত হয়ে গ্রন্থকাররা সহিহ বুখারির উল্লিখিত বর্ণনাটিকেই অস্বীকার করে বসেছেন। এমনকি ড. আলি সাল্লাবি পর্যন্ত বর্ণনাটিকে মুরসাল এবং দুর্বল বলার পাশাপাশি এ দাবিও করেছেন যে, এ বিষয়টি নাকি ‘ইসমাতে আম্বিয়া’ তথা নবিগণের নিষ্পাপ হওয়ার আকিদার সঙ্গেই বিরোধপূর্ণ। তার পূর্বে বিস্তারিত পরিসরে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন শাইখ মুস্তাফা উরজুন। অথচ এ আপত্তিই এখানে ধোপে টিকে না। যার কারণে বর্ণনা অস্বীকারের মতো উদ্যোগের কোনো প্রয়োজন আছে বলেও মনে হয় না।[4]
মোট কতদিন ওহি অবতরণের ধারা স্থগিত ছিলো, তা উপরিউক্ত বর্ণনায় উল্লেখিত হয়নি। ওহি স্থগিত থাকার এই সময়কালটা ছিলো রাসুলুল্লাহ সা.-এর নবুওয়াতকাল। এর পরবর্তী ওহির মাধ্যমে তাঁকে প্রদান করা হয় আরেকটি গুরুদায়িত্ব এবং নবুওয়াতের থেকেও সুউচ্চ মর্যাদাপূর্ণ যিম্মাদারি—রিসালাত। পরবর্তী অধ্যায়ে নবুওয়াত এবং রিসালাত ও নবি এবং রাসুলের পারস্পরিক পার্থক্য সম্পর্কে আমরা সবিস্তারে আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ।
ওহি স্থগিত থাকার সময়কালের ব্যাপারে আলিমগণের থেকে একাধিক রকমের মত বর্ণিত হয়েছে। সবচে প্রসিদ্ধ মত হলো, আড়াই বছর বা তিন বছর কিংবা এরচেয়েও কিছুকাল বেশি ওহি স্থগিত ছিলো। দ্বিতীয় প্রসিদ্ধ মত হলো, ওহি স্থগিত থাকার মোট সময়সীমা মাত্র তিন দিন।
নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে উপরিউক্ত উভয় মতই এক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য হয়। কারণ, এটা সকলেরই জানা যে, সুরা মুদ্দাসসিরের প্রথম দিকের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত সময়টি ছিলো রাসুলুল্লাহ সা.-এর গোপন দাওয়াতের সময়কাল। এ বিষয়টি কীভাবে মেনে নেয়া যেতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ সা. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহি মারফত আদেশপ্রাপ্ত না হয়েই এই দীর্ঘ সময় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এটা তো রাসুলুল্লাহ সা.-এর রিসালাতি এবং নবুওয়াতি শানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী একটি কাজ। তাঁর বৈশিষ্ট্য তো হলো, তিনি প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে কোনো কাজ করেন না এবং কোনো কিছু বলেন না, তিনি যা-কিছু করেন এবং যা-কিছু বলেন সবই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহি মারফত নির্দেশিত হওয়ার পরই করেন এবং বলেন; যেমনটি আল-কুরআনে বিবৃত হয়েছে।[5]
এ তো গেলো প্রথম মত সংক্রান্ত কথা। ঠিক তেমনি দ্বিতীয় মতটিও গ্রহণ করার মতো নয়। কারণ, তিন দিন বা তারচেয়ে সামান্য কিছু বেশি সময় এমন কোনো দীর্ঘ সময় নয় যে, এতে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও ব্যথিত হয়ে কেউ আত্মহত্যা করার জন্য পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে বসবে।
মোটকথা, সার্বিক বিচারে এটাই প্রতিভাত হয় যে, ওহি স্থগিত থাকার সময়কালের ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত অভিমতকেই বাস্তবতার সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়। তিনি বলেন, ওহি স্থগিত থাকার সময়কাল হলো চল্লিশ দিন।[6]
এই সময়টা ওহি স্থগিত থাকার রহস্য হলো, রাসুলুল্লাহ সা.কে ধাপে ধাপে এক মহান গুরুদায়িত্বের জন্য অভ্যস্ত করে তোলা। এজন্য সর্বপ্রথম স্বপ্নের মাধ্যমে এর ধারাপাত হয়েছে। দীর্ঘ ছয় মাস তাঁকে শুধু স্বপ্নই দেখানো হয়েছে। এরপর জাগরণের অবস্থায় প্রথম ওহি অবতীর্ণ হলে তাঁর ওপর বিষয়টি কতটা কষ্টকর ছিলো, ইতোপূর্বে আমরা তা লক্ষ করেছি। তাই পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ তাআলা কিছুটা সময় বিরাম দিয়ে পুনরায় ওহি অবতীর্ন করেন, রাসুলুল্লাহ সা.-এর জন্য যেন বিষয়টি তুলনামূলক হালকা এবং সহজ হয়।[7]
এর পাশাপাশি এ থেকে আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হচ্ছে যে, ওহি একমাত্র আল্লাহ তাআলাই অবতীর্ণ করেন—যখন ইচ্ছা করেন এবং যেভাবে ইচ্ছা করেন। এক্ষেত্রে অন্য কারও কোনো অবদান নেই। রাসুলুল্লাহ সা. চাইলেও তা অগ্রপশ্চাৎ করতে পারেন না। সে ক্ষমতা তার নেই।
এখান থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়। আর তা হলো, ধাপে ধাপে এবং পর্যায়ক্রমে উদ্দেশ্য হাসিলের পথে এগোনো। হুট করেই কঠিন কিছু চাপিয়ে না দেয়া। বরং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময় নেয়া এবং কৌশলের সাথে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলা। রাসুলুল্লাহ সা.-এর এ বিষয়টির সূচনা হয়েছিলো গুহার নিমগ্নতার মাধ্যমে, এরপর আসলো স্বপ্নের ধারা, তারপর জাগ্রত অবস্থায় প্রথম ওহি প্রদানের মাধ্যমে নবুওয়াত প্রদান, এরপর কিছুদিন ওহি স্থগিত থাকা এবং এসব কিছুর পর রিসালাতপ্রাপ্ত হওয়া—এগুলোর মাঝে রয়েছে উম্মাহর জন্য বিরাট শিক্ষা। যারা ইলম শিক্ষা করে, শিক্ষা দেয় কিংবা মানুষদের আল্লাহ তাআলার দিকে দাওয়াত দেয় সবারই উচিত সম্বোধিত ব্যক্তির ওপর ধীরে ধীরে মাত্রা প্রয়োগ করা। প্রথমেই সর্বোচ্চ মাত্রা প্রয়োগ করে বিষয়টিকে কঠিন বা অসম্ভবপ্রায় বানিয়ে উপস্থাপন করার মাঝে কোনো উপকারিতা নেই।
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. যখন মুয়াজ রা.কে ইয়ামানের গভর্নর বানিয়ে পাঠাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাকে নসিহত করে দিয়েছিলেন, ‘তুমি আহলে কিতাব লোকদের নিকট যাচ্ছো। সেহেতু প্রথমে তাদের আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দেবে। যখন তারা আল্লাহর পরিচয় লাভ করবে, তখন তাদের তুমি বলবে যে, আল্লাহ দিন-রাতে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করে দিয়েছেন। যখন তারা তা আদায় করতে থাকবে, তখন তাদের জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন, যা তাদের ধনসম্পদ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। যখন তারা এগুলো মান্য করবে, তখন তাদের থেকে তা গ্রহণ করবে এবং মানুষের উত্তম সম্পদ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে।’ (অর্থাৎ মধ্যম মানের সম্পদগুলো গ্রহণ করবে; উত্তমগুলো নয়, আবার একেবারে নিম্নমানেরগুলোও নয়।)[8]
ঠিক তেমনি আয়িশা রা.-এর নিম্নলিখিত হাদিসটিও এ কথাই প্রমাণ করে। তিনি বলেন, ‘মুফাস্সাল সুরাহসমূহের মাঝে প্রথমত ঐ সুরাগুলো অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে জান্নাত ও জাহান্নামের উল্লেখ রয়েছে। তারপর যখন লোকেরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগলো, তখন হালাল-হারামের বিধানসংবলিত সুরাগুলো অবতীর্ণ হলো। যদি প্রথমেই এ আয়াত অবতীর্ণ হতো যে, ‘তোমরা মদ পান কোরো না’, তাহলে লোকেরা বলতো, ‘আমরা কখনো মদপান ত্যাগ করবো না’। যদি শুরুতে অবতীর্ণ হতো, ‘তোমার ব্যভিচার কোরো না’, তাহলে তারা বলতো, ‘আমরা কখনো অবৈধ যৌনাচার ত্যাগ করবো না’।[9]
এ থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুমিত হয়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে বা ব্যথিত হলে মানুষের জন্য সান্ত্বনার প্রয়োজন হয়। নিজের থেকে নিম্নমর্যাদার কারও সান্ত্বনার একটুখানি পরশও এসব ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখে, মনোবল জাগায় এবং শক্তি জোগায়। নবিজি সা. সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। এরপরও জিবরিল আ. তাঁকে বারবার সান্ত্বনা দিয়েছেন। ইতোপূর্বে খাদিজা রা., ওয়ারাকা রা. এবং অন্যান্যরাও তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। এসব সান্ত্বনায় তিনি আশ্বস্ত হয়েছেন এবং শক্তি ফিরে পেয়েছেন। প্রিয়নবি সা.-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির বিষয়ে ন্যূনতম সন্দেহ-সংশয়ও ছিলো না। কিন্তু মানবীয় সত্তার জন্য নবুওয়াতের এ মহান গুরুদায়িত্ব সহজে সয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন কিছুটা সময়ের এবং প্রিয়জনের সঙ্গ এবং সান্ত্বনার।
উম্মাহর জন্য যারা নিবেদিতপ্রাণ, তাদের সাথি-সঙ্গীরাও যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং নিজ পরিসরে থেকে সাধ্যমতো তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যান, তবে এতে দীনের গতি বেগবান হয় এবং দীনের খাদিম (সেবক) ভেতরে উৎসাহ-উদ্দীপনা পায়। অনেক সময় সরাসরি কোনো দীনি কাজে নিজেদের অংশগ্রহণ সম্ভবপর না হলেও যারা সে কাজে চেষ্টা-শ্রম ব্যয় করে অবদান রাখে, তাদের সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে, তেমনি তাদের বাহ্যিক এবং মানসিক শক্তি জোগানোর মাধ্যমেও সেই কাজে নিজের কিছুটা অবদানের স্বাক্ষর রাখা সম্ভব। কাজের মানুষদের বাধা আসে পদে পদে। সব বাধা হয়তো সকলে সহজেই সয়ে নিতে পারে না। তাই এসব ক্ষেত্রে মনোবল চাঙা রাখার জন্য এবং উদ্যম ধরে রাখার জন্য এমন একঝাঁক আন্তরিক সাথি-সঙ্গীর অনেক-ই প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা গাইবিভাবেই রাসুলুল্লাহ সা.-এর জন্য এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
টীকা
[1] সহিহ বুখারি : ৩, ৪৯৫৩, ৬৯৮২; সহিহ মুসলিম : ১৬১
[2] প্রাগুক্ত
[3] সহিহ বুখারি : ৬৯৮২
[4] দ্রষ্টব্য—মিন মায়িনিশ শামায়িলের টীকা, পৃ. ৩২
[5] উদাহরণস্বরূপ দ্রষ্টব্য—সুরা নাজম : ৩-৪
[6] শারহুয যুরকানি : ১/২৩৬; মিন মায়িনিস সিরাত : ৩২; আররাহিকুল মাখতুম : ৭৯-৮০; আসসিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, আলি সাল্লাবি : ৮৪
[7] ফাতহুল বারি : ১/২৭
[8] সহিহ বুখারি : ১৪৫৮
[9] সহিহ বুখারি : ৪৯৯৩