ফিকহ
১. আল্লাহ তাআলা যাকে সামাজিক সংস্কার এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপের জন্য কবুল করেন, তার অন্তরে সমাজে ছেয়ে যাওয়া গোমরাহি এবং ভ্রষ্টতার ব্যাপারে ঘৃণা সৃষ্টি করে দেন। সমাজে প্রচলিত ধারার প্রতি অনীহা এবং আক্রোশ থেকেই মূলত সে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্যোগী হয়। আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সা.-এর অন্তরে পৌত্তলিকতা-মূর্তিপূজার প্রতি চূড়ান্ত পর্যায়ের ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও জাহেলি সমাজের সব ধরনের জাহিলিয়াতকে তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতেন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
‘যখন আমি বেড়ে উঠতে শুরু করি, তখন থেকেই মূর্তির প্রতি দ্বেষ ও ঘৃণা আমার অন্তরে গেঁথে দেয়া হয় এবং কাব্যের প্রতিও আমার অন্তরে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে দেয়া হয়।’[1]
তিনি আরও বলেন—
‘হে খাদিজা, আল্লাহর কসম, এই মূর্তিগুলোর প্রতি আমার অন্তরে যে পরিমাণ ঘৃণা, কখনও অন্য কোনো কিছুর প্রতি আমার অন্তরে এ পরিমাণ ঘৃণা ছিলো না।’[2]
বুহাইরা রাহিম যখন কুরাইশদের অনুকরণে লাত-উযযার (আরবের মুশরিকদের পূজিত দুটি মূর্তির নাম) দোহাই দিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলো, তখন তিনি বলেছিলেন—
‘আমাকে লাত-উযযার দোহাই দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন না। কারণ, আল্লাহর কসম, আমি এই দুটিকে যতটুকু ঘৃণা করি, আর কোনো কিছুকে ততটা ঘৃণা করি না।’[3]
এটা সব যুগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি বাস্তব সত্য। যারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়, তাদের দ্বারা কখনো সংস্কারমূলক কাজ হয় না। সংস্কারমূলক কাজ শুধু তাদের দ্বারাই হয়, যারা স্রোতের বিপরীতে চলতে ভাসে। জাহিলিয়াতও যুগে যুগে তার রূপ বদলায়। এককালের সাম্প্রদায়িকতা এখন রূপ নিয়েছে জাতীয়তাবাদে, এককালের ‘জয় হোবল’ এখন রূপ নিয়েছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’তে। এককালে পূজিত হতো পাথরের মূর্তি, এখন পূজিত হয় নেতা দল দেশ ইত্যাদি। জাহিলিয়াত প্রতি যুগে রূপ বদলালেও তার মৌলিক কাঠামো একই ধরনের বা কাছাকাছি ধরনেরই থাকে। কখনো তা আসে মূর্তির রূপে, কখনো প্রতিমার রূপে, কখনো জাতীয়তাবাদ বা গণতন্ত্রের রূপে। আল্লামা ইকবাল বলেন—
‘ইন তাজাহ খোদাওউ মেঁ বড়া সব সে ওয়াতান হ্যায়
জো পয়রহন উস কা হ্যায়, ওহ মাজহাব কা কাফন হ্যায়।’
(এই তাজা খোদাগুলোর মধ্যে সবচে বড় হলো দেশ,
এর বসন সেই টুকরো কাপড়, যা দীন-ধর্মের কাফন।)
যাদের ভেতর সামাজিক রীতিনীতি এবং পূর্বপুরুষের পথ ও পন্থার ওপর সত্যকে প্রাধান্য দেয়ার যোগ্যতা নেই, তারা নিজেদেরকে রাসুলের উত্তরাধিকারী দাবি করারও যোগ্যতা রাখে না, ফিতনার যুগে তাদের দ্বারা সমাজ এবং মানবতার ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না; অধিকন্তু তারাই অনেকের জন্য ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২. দীনি কাজে বের হওয়ার পূর্বেও পাথেয় সংগ্রহ করা জরুরি। পাথেয়হীন অবস্থায় বেরিয়ে দুদিন পর অন্যদের কাছে হাত পাতা, দীনের দোহাই দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করা নববি আদর্শ নয়। রাসুলুল্লাহ সা. হেরা গুহায় নির্জনে ইবাদতের জন্য যেতেন, সেখানেও তিনি সর্বদা পাথেয় নিয়ে গমন করতেন। এমনকি বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি তাঁর কাছে যে-সকল মিসকিনরা যেতো, তাদেরকেও আহার করাতেন। পাথেয় সংগ্রহ করা তাওয়াক্কুলের (আল্লাহর ওপর ভরসা) খেলাফ নয়, বরং এটাই তাওয়াক্কুল। আসবাব (উপকরণ) গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল-পরিপন্থী নয়, বরং আসবাব গ্রহণ করে আসবাবের ওপর একিন (বিশ্বাস) না রেখে মহান প্রতিপালকের ওপর বিশ্বাস রাখার নাম তাওয়াক্কুল। ভরসা এবং নির্ভরতা আল্লাহর ওপর। আর আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হিসেবেই আসবাব গ্রহণ করা। তবে সকল ক্ষমতার আধার একমাত্র আল্লাহকেই মনে করা। ইবনু বাত্তাল রহ. বলেন, ‘আসবাব গ্রহণ করা যদি তাওয়াক্কুল-পরিপন্থীই হতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ সা. কিছুতেই তা গ্রহণ করতেন না, কারণ তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তাঁর গুরুত্বের সঙ্গে আসবাব গ্রহণ করাই এ কথার প্রমাণ যে, আসবাব গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল-পরিপন্থী নয়।’[4]
৩. যারা ইবাদত বা অন্য কোনো কাজের জন্য নির্জনে অবস্থান করতে চায়, তাদের জন্য জরুরি হলো, মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে পরিবারকে সময় দেয়া। কারণ পরিবারের হক আদায় করা ফরজ। পক্ষান্তরে নির্জনে অবস্থান করে আধ্যাত্মিক শক্তিকে বৃদ্ধি করা মুস্তাহাব পর্যায়ের। আর নিশ্চয় মুস্তাহাবের তুলনায় ফরজের মর্যাদা ঢের গুণ বেশি। তাছাড়া ইসলামে সন্যাসবাদের কোনো স্থান নেই। রাসুলুল্লাহ সা. নিয়মিত গুরুত্বের সঙ্গে এই কাজটি করতেন। অনেকে দীনি বা দুনিয়াবি কাজে এত বেশি মাশগুল হয়ে পড়েন যে, কয়েক মাস পেরিয়ে যায়, কিন্তু পরিবারকে একেবারেই সময় দিতে পারেন না। এটা নববি আদর্শের খেলাফ। আর এমন পরিবারে যে-কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ আশঙ্কা থেকেই যায়।[5]
৪. ইবনু বাত্তাল রহ. মুহাল্লাব রহ. থেকে বর্ণনা করেন, ‘প্রথম ওহির হাদিস দ্বারা এ ফিকহ প্রমাণিত হয় যে, কোনো ব্যক্তির জন্য যদি উত্তম কোনো কাজ কষ্টকরও হয়, তবুও তাকে সেই কাজের নির্দেশ দেয়া হবে, তা-র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং তার সামনে সেই বিষয়ের আলোচনা করা হবে।’[6] বর্তমান দুনিয়ায় মুসলমানদের জন্য সবচে কষ্টকর বিষয় হলো কিতাল (লড়াই)। রাসুলুল্লাহ সা.-এর জন্য নবুওয়াতের গুরুদায়িত্ব বহন করা যত কষ্টকর হয়েছিলো, বর্তমানকালের অনেক মুসলিমের জন্য কিতালের বিধান তারচেয়েও বেশি কষ্টের এবং যন্ত্রণার। মুসলমানরা নিজেদের অক্ষমতা অসহায়তার কথা বলে কিতালের আলোচনাও বন্ধ করে দিয়েছে। মসজিদের মিম্বার, মাহফিলের মঞ্চ কিংবা দরসের মসনদ—সব জায়গায়ই মানুষেরা যে বিষয়টিকে সবচে বেশি ভয় পায়, তা হলো কিতাল। অথচ আলিমদের জন্য উচিত হলো, ইসলামের বিধানগুলোকে নির্দ্বিধায় তুলে ধরা। জাতির জন্য তা পালন করা বর্তমানে কষ্টকর বা অসম্ভবপ্রায়—এই অজুহাত দিয়ে আলোচনাকে ছেড়ে না দেয়া। কারণ নবির উত্তরাধিকারীগণের কাজ হলো শুধু পৌঁছে দেয়া। কে মানলো আর কে মানলো না—এর তত্ত্বাবধায়ক তারা নন। তাদের হিসাব তো আল্লাহর যিম্মায়।
৫. ইলম হলো দীনের শিরোনাম। প্রথম ওহি, যা রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর নাজিল করা হয়েছে, তা-ই ছিলো: ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে…’। ইসলামে তাই ইলমের অনেক গুরুত্ব। ইলম ছাড়া ইমানও হয় না। ঠিক তেমনি যথাযথ ইলম মানুষকে ইমান গ্রহণে গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। যেসব বিষয়ের প্রতি ইমান আনা অপরিহার্য, প্রথমে সেই বিষয়গুলোর ইলম অর্জন করাও অপরিহার্য। তাওহিদের যথাযথ ইলম ছাড়া কেউ যদি দিনরাত কালিমাও পড়তে থাকে, রিসালাত সম্পর্কে না জেনে কেউ যদি দুরুদ শরিফ জপতে থাকে তবুও সে মুমিন হিসেবে ধর্তব্য হবে না। এজন্যই তো ইসলামি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কেউ যদি আল্লাহ কী তা জানেই না, রাসুল কেন তা বোঝেই না সে তার পারিবারিক বন্ধনের কারণে কিংবা ইসলামি নাম ধারণের কারণেই মুসলিম বলে গণ্য হবে না। তেমনি সে যদি আল্লাহকে আল্লাহ বলে স্বীকার করেও নেয়, কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে না জেনে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে তাকে মুমিন বয়, বরং মুশরিক হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। এ কারণেই তাওহিদের ইলম সবচে গুরুত্বপূর্ণ ইলম। তেমনি আকিদার অন্যান্য বিষয়ের ইলমও, একজন মুমিনের জন্য যেসব বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা অপরিহার্য। কারণ ইলম ছাড়া ইমান কখনোই যথাযথ হতে পারে না। প্রথম ধাপ হলো যথাযথভাবে জানা, এর পরের ধাপ হলো জ্ঞাত বিষয়ের প্রতি যথাযথভাবে ইমান আনা।
আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই সুরার সূচনা হয়েছে পড়ার নির্দেশ দিয়ে আর এর সমাপ্তি হয়েছে সিজদার নির্দেশ দিয়ে। মুমিনের নামাজকেও এই ধাচে সাজানো হয়েছে। প্রতি রাকাত নামাজ সূচিত হয় কেরাতের (পড়া) মাধ্যমে আর সমাপ্ত হয় সিজদার মাধ্যমে। হাফিজ ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, ‘নামাজের সবচে মর্যাদাপূর্ণ কাজ হলো সিজদা। আর তার সর্বাপেক্ষা উত্তম যিকির হলো কেরাত। প্রথম যে সুরা নবি সা.-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে, তা সূচিত হয়েছে কেরাতের মাধ্যমে এবং সমাপ্ত হয়েছে সিজদার মাধ্যমে। রাকাতকেও এভাবেই গঠন করা হয়েছে। প্রথম ভাগ হলো কেরাত আর সর্বশেষ ধাপ হলো সিজদা।’[7]
৬. ইবনু বাত্তাল রহ. বলেন, ‘এই হাদিসে এ দিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ভীতসন্ত্রস্ত ব্যক্তিকে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা সঙ্গত নয়, যাবত না তার ভীতিভাব দূর হয়ে সে স্বাভাবিক হয়।’ আল্লামা আইনি রহ.ও একই কথা বলেছেন।[8]
৭. কেউ যদি এমন কোনো অবস্থার সম্মুখীন হয়, যা তাকে আতঙ্কিত করে বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে, তা হলে তার জন্য তা গোপন করে রাখা উচিত নয়। বরং মুস্তাহাব হলো বিশ্বস্ত কাউকে এ ব্যাপারে অবগত করা—এমন কাউকে যার নাসিহাহ এবং শুদ্ধ চিন্তার প্রতি সে আস্থা রাখে।[9] এতে দুটি উপকারিতা—প্রথম উপকারিতা হলো, তার দুশ্চিন্তা হালকা হবে এবং অন্তর প্রশান্ত হবে। আর দ্বিতীয় উপকারিতা হলো, সে অন্যের নাসিহাহ এবং উত্তম পরামর্শের মাঝে ভালো কোনো দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে, যা তাকে সঠিক এবং যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সহায়তা করবে। এজন্যই এমন ব্যক্তির কাছেই তা বলা উচিত, যার নাসিহাহ এবং বিশুদ্ধ চিন্তাধারা প্রতি সে আস্থা রাখে। নইলে বরং হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।[10] আমরা খাদিজা রা.-এর সান্ত্বনাবাণী এবং মুসা আ.-এর উদ্দেশে বলা শুয়াইব আ.-এর আশ্বাসবাণী থেকে বিষয়টি সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে পারি।
৮. সবিশেষ কল্যাণার্থে কারও সামনাসামনি প্রশংসা করা বৈধ। বরং ক্ষেত্রবিশেষ তা উত্তম। হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা তোষামোদকারীকে দেখলে তার মুখে মাটি নিক্ষেপ করবে।’[11] আমাদের উপরিউক্ত বক্তব্য এই হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ, এই হাদিসে উদ্দেশ্য হলো, কারও বাতিল প্রশংসা করা কিংবা এমন প্রশংসা করা, যা বাতিলের দিকে নিয়ে যায়—তা নিষিদ্ধ। যে-কোনো প্রশংসাই নিষিদ্ধ নয়।[12] ইমাম নববি রহ. বলেন, ‘ইমাম মুসলিম এই অধ্যায়ে প্রশংসা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত অনেক হাদিস বয়ান করেছেন। অথচ সহিহ বুখারি এবং সহিহ মুসলিমে সামনাসামনি প্রশংসার বিধান-সংবলিত অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আলিমগণ বলেছেন, “এর মাঝে সমন্বয়ের পন্থা হলো, নিষিদ্ধতা এসেছে অনুমানভিত্তিক প্রশংসা বা বাড়াবাড়িমূলক প্রশংসার ব্যাপারে, তেমনি এমন ব্যক্তির প্রশংসার ব্যাপারে, যার ব্যাপারে এই আশঙ্কা রয়েছে যে, প্রশংসা শুনলে সে অহমিকায় আক্রান্ত হতে পারে। পক্ষান্তরে তাকওয়ার পরিপূর্ণতা, বিবেক এবং জ্ঞানের পরিপক্কতার কারণে যার ব্যাপারে এই আশঙ্কা নেই, সামনাসামনি তার প্রশংসা করার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই—যদি না তা অনুমানভিত্তিক হয়। বরং যদি এর দ্বারা কোনো কল্যাণ অর্জিত হয়, যেমন ভালো কাজে তার আগ্রহ বৃদ্ধি হয়, কাজে গতি এবং স্থায়িত্ব লাভ হয় এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত হয় তা হলে তা হবে মুস্তাহাব।’[13] হাফিজ ইবনু হাজার রহ. বলেন, ‘সামনাসামনি প্রশংসার নিষিদ্ধতা সে অবস্থার সঙ্গে বিশেষিত যখন তা হবে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে কিংবা প্রকাশ্য মিথ্যা।’[14]
৯. ‘ওয়ারাকা ইবনু নাওফাল রাসুলুল্লাহ সা.-কে বললেন, ‘ইনি সেই দূত যাঁকে আল্লাহ মুসা আ.-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। হায়, আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম! হায়, আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে।’ রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘তারা কি আমাকে বের করে দেবে?’ তিনি বলেন, ‘হাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মতো কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে। সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করবো।’[15] এর থেকে প্রতিভাত হয় যে, যুগে যুগে যারা ইসলামের দাওয়াতের মহান খেদমত পালন করেছে, তাদের সকলকেই অনেক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হয়েছে। হক এবং বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। যখনই হক সমাজে তার স্থান করে নিতে চেয়েছে, তখনই বাতিল তেড়ে এসেছে এবং মুখের ফুৎকারে হকের প্রদীপ নিভিয়ে দিতে চেয়েছে। ‘অতীতে যিনিই তোমার মতো কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে।’ (অন্য বর্ণনায় এসেছে, তাঁকেই কষ্ট দেয়া হয়েছে।) আল্লাহ বলেন, ‘এভাবেই আমি প্রত্যেক নবির শত্রু বানিয়েছি অপরাধীদেরকে। পথনির্দেশক এবং সাহায্যকারী হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।’[16] ‘এভাবেই প্রত্যেক নবির জন্য শত্রু বানিয়েছি মানব ও জিনদের মধ্য থেকে শয়তান কিসিমের লোকদেরকে, যারা ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে বড় চমৎকার কথা শেখাতো।’[17]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘দায়িকে সহনশীল এবং কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। কারণ সে অবধারিতভাবেই কষ্টের সম্মুখীন হবে।’[18] শাইখ আব্দুর রহমান ইবনু কাসিম রহ. বলেন, ‘যে দীন ইসলাম নিয়ে দাঁড়ালো এবং মানুষদেরকে এর দিকে দাওয়াত দিলো, সে তার গুরুদায়িত্ব বহন করলো, দাওয়াতের ক্ষেত্রে সে রাসুলগণের স্থলাভিষিক্ত হলো এবং সে মানুষদের মাঝে এবং তাদের কামনা প্রবৃত্তি এবং বাতিল আকিদার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে প্রয়াসী হলো, এমতাবস্থায় এর কোনো বিকল্প নেই যে, তারা তাকে কষ্ট দেবে। সুতরাং তার উচিত হবে সবর করা এবং সাওয়াবের প্রত্যাশা রাখা।’[19]
পবিত্র কুরআনে ইবাদুর রহমান (রাহমানের বান্দা)-এর বর্ণনাপ্রসঙ্গে আল্লাহ তাদের একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন, ‘মূর্খরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে কিছু বলে…।’[20] আল্লাহ তাআলা এখানে ‘ইযা’ শব্দ ব্যবহার করেন। বালাগাতশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে যা এ কথা প্রমাণ করে যে, যারা প্রকৃত অর্থে রাহমানের বান্দা হবে, তারা মূর্খদের তীর্যক বাণের লক্ষ্যবস্তু হবে—এটা একটা সুনিশ্চিত বিষয়।[21]
সুতরাং ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরার অপরিহার্য পরিণতি হলো তাগুত এবং তাগুতের দোসরদের রোষানলে পড়া, দমন-পীড়নের শিকার হওয়া। সে অবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে, জান্নাত এবং তার নেয়ামতের কথা স্মরণ করে সবর করা। আর এটাই নবিগণের আদর্শ। হাঁ, যারা পূর্ণ ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরবে না, বরং ইসলামের শুধু সেসব অংশ তুলে ধরবে, যা বাতিলের প্রবৃত্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, তার অবস্থা এরূপ হবে না। বরং সে ফেরাউন ও আবু জাহিলের মানসপুত্রদের সঙ্গে নির্দ্বিধায় সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পারবে, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িতে যিন্দেগি গুযরান করতে পারবে।
১০. খাদিজা রা. রাসুলুল্লাহ সা.-কে ওয়ারাকা ইবনু নাওফালের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন সে যুগের বিদগ্ধ জ্ঞানী এবং সবচে বড় আলিম। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যে-কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে হকপন্থী বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ আলিমগণের শরণাপন্ন হওয়া উচিত; যাতে সে বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান পাওয়া যায়। তেমনি তাদের সাথে পূর্বপরিচয় না থাকলে তাদের কাছে গমনের ক্ষেত্রে সরাসরি একাকী গমন না করা, বরং পূর্ব থেকে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে—এমন কাউকে সাথে নিয়ে নেয়া; যেমনটি এই ঘটনায় দেখা যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ওয়ারাকা ইবনু নাওফাল পূর্ব থেকেই তাওহিদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ইসা আ.-এর ধর্মের অনুসারী এবং সেই ধর্মের একজন বিদগ্ধ আলিম ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সা.-এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির খবর জেনে তিনি তাঁর নবুওয়াতকেও স্বীকার করেছেন। তাই তিনি একজন মুসলিম। রাসুলুল্লাহ সা. তার ব্যাপারে জান্নাতের সাক্ষ্য দিয়েছেন। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
‘তোমরা ওয়ারাকাকে গালি দিয়ো না। কারণ, আমি তার জন্য দেখেছি একটি জান্নাত বা দুটি জান্নাত।[22] (বর্ণনার পার্থক্য)
একদা ওয়ারাকা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে দেখেছি জান্নাতের মধ্যভাগে। তার পরিধানে ছিলো পাতলা রেশমি কাপড়।’[23]
আরও পড়ুন—
প্রথম ওহি-১
প্রথম ওহি-২
টীকা
[1] আলমাতালিবুল আলিয়াহ : ৪২০৩; ইতহাফুল খিয়ারাহ : ৭/১৬; আলমুসতাদরাক, ইমাম হাকিম : ৭৯৬৩; কানযুল উম্মাল : ৬/৩০৫
[2] আসসিরাতুল হালাবিয়্যাহ : ১/১৮৩; ইমতাউল আসমা‘ : ২/৩৪৯; তাবাকাতু ইবনি সা‘দ : ১/১৫৩
[3] সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৮৩; আসসিরাতুল হালাবিয়্যাহ : ১/১৮৩
[4] শারহু ইবনি বাত্তাল লি সাহিহিল বুখারি : ১/৩৭
[5] সিরাতে মুস্তফা : ১/১৬৯
[6] প্রাগুক্ত
[7] আলকালাম আলা মাসআলাতিস সামা‘: ২০৪। একই কিতাবের ২১৯ পৃষ্ঠায় ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. থেকেও অনুরূপ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।
[8] শারহু ইবনি বাত্তাল : ১/৩৮; উমদাতুল কারি : ১/৬৩
[9] ফাতহুল বারি : ১/২৫; উমদাতুল কারি : ১/৬৩
[10] ফিকহুস সিরাত, আবদুল কারিম যায়দ : ১২৫-১২৭
[11] সহিহ মুসলিম : ৩০০২; সুনানু আবি দাউদ : ৪৮০৪
[12] উমদাতুল কারি : ১/৬৩
[13] শারহু সাহিহিল ইমাম মুসলিম : ১৮/৪১৭
[14] ফাতহুল বারি : ৭/৬৯
[15] সহিহ বুখারি : ৩
[16] সুরা ফুরকান : ৩১
[17] সুরা আনআম : ১১২
[18] মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৮/১৩৬
[19] শারহুল উসুলিস সালাসাহ : হাশিয়াতুল উসুলিস সালাসাহ
[20] সুরা ফুরকান : ৬৩
[21] তাফসিরু ইবনি বাদিস : ১৯৪
[22] আলমুসতাদরাক, ইমাম হাকিম : ২/৬০৯। তিনি বলেন, ‘হাদিসটি ইমাম বুখারি এবং ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ।’ ইমাম যাহাবিও তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেননি।
[23] মুসনাদু আবি ইয়া‘লা : ৪/৪১, ২০৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়িদ : ৯/৪১৬। হাইসামি বলেন, এর সনদ হাসান।