হাফিজ মুরসির মৃত্যুতে যারা অশ্রু ঝরায়নি, তাদেরকে অনেকেই একহাত ধুয়ে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে হাফিজ মুরসি মাজলুম। আর তার মানহাজ ভুল হলেও লক্ষ্য অবশ্যই ভালো ছিল। আমি শুরু থেকেই তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছি। এখনো করি। কিন্তু হাফিজ মুরসির চাইতে ইসলামের জন্য যারা অনেক বেশি কুরবানি করেছে, তাদের জন্য আসলে আমরা কী করেছি? এখন যারা মুরসিকেন্দ্রিক আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা গড়ে তুলেছে, পূর্বে তাদের আচরণ ও অবস্থান কী ছিল?

কই, আমি তো শহিদ আমিরুল মুমিনিন উমরে সালিসের জন্য এদের কাউকে মায়াকান্না করতে দেখিনি। শহিদ আমিরুল মুমিনিন মোল্লা আখতার মানসুরের শাহাদাতের খবরটুকুও হয়তো এরা রাখেনি। উম্মাহর অমিততেজা শার্দূলরা যখন ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছে বা কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে, কই তখনো তো এদের কোনো আবেগের প্রকাশ দেখিনি। হ্যাঁ, তারা ছিল এদের চোখে অপরাধী (!)। তাই তাদের শাহাদাতে অশ্রু ঝরানোকে এরা সমর্থন করতে পারেনি। যার কারণে সে সকল শহিদের স্মরণকারীদের এই আবেগকেও এরা উগ্রবাদ ও সহিংসা মানসিকতার নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

পাকিস্তানে রয়েছে কত বড় বড় আলিম। যাদের অনেকে আবার আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। সারা দুনিয়া নিয়ে তারা ফিকির করেন। সমগ্র পৃথিবীর বেদনায় ব্যথিত হয়ে বিবৃতি ঝাড়েন। কিন্তু পরমতসহিষ্ণু মানসিকতার অধিকারী এ সকল ব্যক্তিবর্গকে জামিয়া হাফসা ও লাল মসজিদ প্রসঙ্গে দেখা গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রে। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর এখনো যখন জামিয়া হাফসা অবরুদ্ধ, তখনো তাদের মুখও পূর্বের মতো পুরোদস্তুর অবরুদ্ধ। ভাবটা এমন, দারুল ইসলামের খলিফাতুল মুসলিমিনের বিরুদ্ধে গিবত-শেকায়েত করে পাছে না তাদের ইমানের ক্ষতি হয়! দুনিয়া কা ওয়াহেদ মুলকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তারা না বাগি ও খারেজি হয়ে যান! আবার তাদের অনেকেই তো আমিরুল মুমিনিন উমরে সালিসের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তিনি যেন মূর্তি ভাঙার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন। তিনি যেন মুহাজির উসামাকে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করেন।

এই যে এত বড় বড় শাইখুল ইসলাম, মুফতিয়ে আজম, জমিয়ত প্রধান, বেফাক সভাপতি হজরতগণ—ওয়াজিরিস্তানের রক্তের দরিয়া বা লাল মসজিদের খুনরাঙা প্রান্তর নিয়ে তাদেরকে কেন উম্মাহর কাণ্ডারির ভূমিকায় দেখা যায় না! কারণ কি শুধু এই নয় যে, এ সকল অতি জযবাতিদের জন্য কোনো দয়া-মায়া থাকতে নেই। কারণ, তারা তো এসব পরিণতি নিজেরাই নিজেদের কর্মের দ্বারা ডেকে এনেছে। তাদের জিহাদি জযবার কারণে গোটা উম্মাহর শান্তিময় জীবনে ছেঁদ পড়েছে। যদিও অনেক সাহাবি রাসুলের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ইমানের ঘোষণা দিয়ে নির্যাতিত হলেও রাসুল সা. তাদের সঙ্গে এরূপ রূঢ় ও নির্দয় আচরণ করেননি; বরং ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। তাদের আবেগের মূল্যায়ন করেছেন।

জাইশে মুহাম্মাদের আমিরুল মুজাহিদিন কাশ্মীর নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থিত বাবরি মসজিদ নিয়ে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু নিজের দেশের প্রকাশ্য তাগুতদের বর্জন করার ডাক কি তিনি কখনো দিয়েছেন? অনেক আগেই শহিদ হওয়া বাবরি মসজিদ নিয়ে এখনো যার আন্দোলন চলমান, ২০০৭-এ সদ্য শাহাদাত বরণ করা শুহাদায়ে লাল মসজিদ নিয়ে তাকে কি আদৌ কোনো প্রতিশোধপরায়ণ ভূমিকায় দেখা গেছে? অথবা সেখানকার মর্দে মুজাহিদদের মদদে বা সমর্থনে তার কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েছে? ওয়াজিরিস্তানের মাজলুম মুসলমান ও সেখানকার রক্তাক্ত প্রান্তর বা পাকিস্তানের নাপাক আর্মি কিংবা আইএসআই’র মতো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর ব্যাপারেই বা তিনি কী অবদান রেখেছেন? আফগানে জিহাদ যখন রাশিয়ার সঙ্গে সমাপ্ত হয়ে আমেরিকার সঙ্গে সূচিত হয়েছে, পাক সরকার আমেরিকাকে যে খোল্লমখোলা মদদ দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ইমান ভঙ্গ ও কুফরের ফাতওয়াও কি আদৌ তার মুখ থেকে শোনা গেছে?

যাহোক, সব কথা বলতে নেই। তবুও বলা হয়ে যায়। এখন সময় এসেছে উভয় তাঁবু পৃথক হয়ে যাওয়ার। কী হবে এত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে, যদি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যই অর্জিত না হয়! হ্যাঁ, এর কারণে যদি সমাজে স্থান না মেলে তাতেই বা কী সমস্যা! ঘোড়ার লাগাম ধরে ময়দানে চলে যাওয়া কিংবা ছাগল একটা সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান শুরু করার তো এখনই সময়।

Share This