ঈদ মানে হাসি। ঈদ মানে খুশি। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের দিন বছরে দুটোই— ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। রাসুলুল্লাহ সা. মদিনায় হিজরত করার পর দেখতে পান যে, মদিনাবাসীরা বছরে দু’দিন উৎসব-আনন্দে মেতে ওঠে, তখন রাসুলুল্লাহ সা. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে মুসলমানদের মধ্যে ঘোষণা করেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এ-দুটি দিবসের পরিবর্তে এরচে আরো উত্তম দুটি উৎসবের দিবস দান করেছেন— ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। {সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ি}
ঈদের দিন আনন্দ-খুশি প্রকাশ করা শাআয়িরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ সা. ও ঈদের দিন আনন্দ-খুশি প্রকাশ করতেন। আয়িশা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. আমার কামরায় প্রবেশ করলেন। আমার সামনে তখন দুই বালিকা গান করছিলো, তারা গায়িকা ছিলো না, সেদিন শখ করে বুআসের দিন আনসারি সাহাবিরা যে কাওয়ালি করেছিলো, তা গাচ্ছিলো। রাসুলুল্লাহ সা. বিছানায় শুয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। তখন আবু বকর রা. কামরায় প্রবেশ করে আমাকে ধমকাতে লাগলেন। তিনি বললেন, আল্লাহর রাসুলের ঘরে শয়তানের বাঁশি! তখন রাসুলুল্লাহ সা. আব্বাজানের উদ্দেশে বললেন, হে আবু বকর, ওদেরকে গাইতে দাও। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের উৎসবের দিন থাকে। এটা হলো আমাদের উৎসবের দিন। {বুখারি, মুসলিম}
আল্লাহ তাআলা বলেন, প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি উৎসবের দিন নির্ধারণ করে দিয়েছি। {সুরা হজ, তাফসিরে তাবারি}। মুসলিম উম্মাহর জন্য সেই দুই উৎসবের দিন হলো— দুই ঈদ। এজন্য রাসুলুল্লাহ সা. ঈদের দিনে উপবাস যাপন-সিয়াম পালনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। {বুখারি, মুসলিম}
আল্লামা ইবনে হাজার রহ. বলেন, হাদিস থেকে প্রতিভাত হয় যে, মুসলমানদের জন্য বিজাতীয়দের উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা এবং তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করাকে ইসলাম পছন্দ করে না। উমর রা. বলেন, তোমরা মুশরিকদের উৎসবে তাদের উপাসনালয়ে যাবে না। কেননা তাদের ওপর আল্লাহর গযব নাযিল হয়। {বায়হাকি}
ঈদ ধনী-গরিব পুরুষ-নারী শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সকলের জন্য। সকল মুসলমান এ-দিনে ঈদগাহে একত্রিত হয়ে আল্লাহ তাআলার তাওহিদ এবং তার বড়ত্ব ও মহত্ব ঘোষণা করতে থাকে, শিরকের বিরুদ্ধে খোলা কণ্ঠে তাকবিরধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকে। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু …।
মুসলমানদের দুটো ঈদই নির্ধারিত ইবাদত পালনের পর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনুগত বান্দাদের জন্য বিশেষ উপহার হিসেবে আবির্ভূত হয়। দীর্ঘ একমাস সওম সাধনা পালনের পর আসে ঈদুল ফিতর। আর ঈদুল আযহা আসে হজের অন্যতম রোকন উকুফে আরাফার পর। আর যারা হজে যায়নি, তাদের জন্যও এ উৎসব থাকে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে। এটা হলো দুনিয়ার উপহার। আর আখিরাতে তো আল্লাহ তাআলা অনুগত বান্দাদের জন্য এমন নয়নাভিরাম জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে নহরনালা প্রবাহিত থাকবে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, রোযাদারের জন্য দুটো খুশির বিষয় রয়েছে। একটি তার ফিতরের সময়, আরেকটি তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়। {বুখারি, মুসলিম}
ঈদ মানুষের হৃদয়ের ক্লেদ মুছে দেয়। সকল হিংসা বিদ্বেষ শত্রুতা দূর করে দেয়। সকল মুসলমানকে একই সূত্রে গাঁথে। পরিজন এবং প্রিয়জনদের মধ্যে যাদের সঙ্গে কোনো কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, ঈদ তাদের মধ্য থেকে দূরত্ব-দ্বেষ ঘুচিয়ে সম্প্রীতির নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি করে। সকলে আবার পেছনের সব ভুলে নতুন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, ঐক্যবদ্ধভাবে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করতে প্রয়াসী হয়। এর মাধ্যমে ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরের মতো, যার একাংশ অপরাংশকে শক্তি যোগায়। এ কথা বলার পরে রাসুলুল্লাহ সা. হাতের আঙ্গুলগুলোকে জড়ো করে দেখান। {বুখারি, মুসলিম}
ঈদের আনন্দ শুধু ধনীদের জন্য নয়। গরিবরাও সমানভাবে এই আনন্দে অংশগ্রহণ করে। ইসলাম ধনীদেরকে নির্দেশ দিয়েছে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার জন্য। গরিবদের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার জন্য। তেমনিভাবে কোরবানির সময় জবাইকৃত পশুর গোশত গরিবদের মাঝেও বন্টন করার জন্য। এ খুশির দিনেও যেনো তাদেরকে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে নত হতে না হয়, এজন্য ঈদের আগেই সাদাকাতুল ফিতর পরিশোধ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. সাদাকাতুল ফিতরকে অপরিহার্য ঘোষণা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, তোমরা এ দিনে গরিবদেরকে সচ্ছল বানিয়ে দাও। {তাবারানি}
যারা নাগরিক জীবনের চাপে শত ব্যস্ততায় জড়িয়ে থাকে, ঈদের দিন তারাও যেনো পরিবারের সাথে আনন্দ-উল্লাস করে, ইসলাম এ ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব পালনে সর্বদা কী পরিমাণ ব্যস্ত থাকতেন! এরপরও তিনি ঈদের দিনে পরিবারের সাথে অনেক ঘনিষ্ট হতেন, তাদের সাথে আনন্দ-উল্লাস করতেন। আয়িশা রা. বলেন, ঈদের দিন আমি রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে হাবশিদের কুচকাওয়াজ দেখার জন্য বায়না ধরলাম। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, হুমায়রা, তোমার হাবশিদের বল্লম খেলা দেখতে ইচ্ছে করছে? আমি বললাম, জি হাঁ। তখন রাসুলুল্লাহ সা. আমাকে মসজিদ চত্ত্বরে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে তার পেছনে দাঁড় করালেন। আমি তার কাঁধে মাথা রাখলাম। আমার গাল তার গালের সঙ্গে লেগেছিলো। আমি প্রাণভরে কুচকাওয়াজ উপভোগ করছিলাম। রাসুলুল্লাহ সা. হাবশিদের উদ্দেশে বললেন, বনি আরফাদা, চালিয়ে যাও। একপর্যায়ে দেখতে দেখতে যখন আমার ক্লান্তি চলে আসলো, তখন রাসুলুল্লাহ সা. আমাকে বললেন, যথেষ্ট হয়ে গেছে? আমি বললাম, জি হাঁ। তিনি বললেন, আচ্ছা, চলো তবে। {বুখারি, মুসলিম, নাসায়ি}
তবে স্মতর্ব্য যে, মুসলমান সবক্ষেত্রেই শরিয়তের গণ্ডির ভেতরে থাকে। সে কখনোই শরিয়তের সীমা অতিক্রম করে না। এজন্য ঈদের এই অবাধ আনন্দ-উল্লাসের ভেতরেও এ কথা সর্বদাই গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কোনোভাবেই যেনো শরিয়তের বিধান লঙ্ঘিত না হয়। ঈদ তো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। এটাকে গুনাহের মাধ্যমে ওয়িদে পরিণত করলে তার পরিণতি শুভ হবে না। ঈদের সময়ে গুনাহের অনেক উপকরণ সহজ হয়ে যায়, চারদিকে গুনাহের সয়লাব বয়ে যায়, এ পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলে, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে নফস ও শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচলে তার প্রতিদান হবে অনেক বড় ও মহান। আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করে নফসকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিরত রাখে, নিঃসন্দেহে জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল। {সুরা নাযিআত}। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঈদের পরিপূর্ণ কল্যাণ ও বরকত লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মাশাআল্লাহ
লেখাটা
অনেক ভালো লেগেছে।