মাওলানা ফউমা’র প্রতি সবার এত আক্রোশ কেন? কিছু মানুষের আক্রোশ দীনের কারণে আর কিছু মানুষের আক্রোশ দল ও ঘরানার কারণে। কারও বা বিরোধিতা নিরেট হুজুগেপনা বৈ কিছু নয়। তবে অনলাইনে বিচরণকারী অধিকাংশের বিরোধিতার মূল সূত্র হলো কিতাল ও বরেণ্য কিতালিদের ব্যাপারে মাওলানা ফউমা’র অবস্থান। এটা একটা প্রকাশ্য ও স্পষ্ট বিষয়। নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই।
কিন্তু কথা হলো, এই একই রোগে অন্য যারা দোষী, তাদের প্রতি আমাদের আচরণ কি সমান? যদি হয় তাহলে ঠিক আছে। আর যদি না হয় তাহলে ইনসাফ আর থাকল কোথায়?
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, মাওলানা ফয়জুল করিম, ড. আবু বকর যাকারিয়া, মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন আবদুর রাজ্জাক, মাওলানা ইমাম হুসাইন, মাওলানা মতিউর রহমান মাদানি, ড. সাইফুল্লাহ মাদানি প্রমুখও কি একই অপরাধ করেনি? যদি করে থাকে তাহলে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ কেন’? উল্লেখিতরা সবাই-ই তো সেলিব্রেটি আলিম। যাদের নাম উল্লেখিত হয়নি, তাদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। আর নন-সেলিব্রেটিদের তো পরিসংখ্যান করা পুরোদস্তুর দুরূহ।
যেই মাওলানা আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ শুদ্ধ করে কুরআন পড়তে জানে না, আরবি বা উর্দু কিছুই ভালোরকম পারে না, যে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ভুল ও বাজে কথা বলে, প্রায়ই ভুল ফাতওয়া প্রদান করে, উম্মাহর অনেক বিশিষ্ট আলিমকেও জঘন্য খারাপ ভাষায় তাচ্ছিল্য করে, কিতাল ও কিতালিদের কটুক্তি করে, তাকেই আবার শাইখ হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়, আলিম হিসেবে পরিচিত করা হয়। কারণ, তার সবচে বড় যোগ্যতা হলো, সে একজন লা মাযহাবি আহলে হাদিস। তাই তার সব দোষ মাফ।
একই কাজ কওমিদের মধ্যেও হয়। তাবলিগের অনেক সাথিও একই আচরণ করে। খানকাহের অনেক মুরিদানও এ থেকে মুক্ত নয়। এ দেশে কোনো কোনো পির খোল্লমখোলা কিতাল ও কিতালিদের বিরুদ্ধাচারণ করে, কোনো কোনো তাবলিগিও একই কাজ করে; তাদের এসব আচরণ দেখেও অনেকে তাদের পক্ষাবলম্বন করে। এমনকি এসব জঘন্য কাজের পক্ষেও প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করে। এসবই তো হাদিসে নিষিদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায় পক্ষপাতিত্ব বৈ কিছু নয়।
আজকাল মুরজিয়া ঢুকেছে সব জায়গায়। মুরজিয়া আহলে হাদিস। মুরজিয়া কওমি। মুরজিয়া তাবলিগি। মুরজিয়া পিরপন্থী। সবাই যে এমন, তা তো কখনোই নয়। অধিকাংশকে খারাপ বলারও জো নেই। কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুরজিয়া বা ইরজাক্রান্ত সব ঘরানায়ই নজরে পড়ে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সবাই খুব সহজেই সেগুলোকে পাশ কেটে যায়।
কেউ মাওলানা ফরাজির পক্ষ নিতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে আর কেউ-বা বাড়াবাড়ি করে মাওলানা আবদুর রাজ্জাকের পক্ষ নিতে গিয়ে। দিনশেষে কেউই তার নীতিতে অটল নয়। একই কাজ অন্য ঘরানার কেউ করলে হারাম। আর নিজের লোক করলে আরাম। মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারি রাসুলের শানে ‘সিক্সপ্যাক’ শব্দপ্রয়োগের কারণে কাফির (!), অপরদিকে মাওলানা নোমান কাসেমি কুরআনের আয়াত বানিয়ে পড়ে, কুরআনের শব্দে বিকৃতি সাধন করে এবং আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করেও সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিরপরাধ! মাওলানা কাজি ইবরাহিম ভালো কথা বললেও তা প্রত্যাখ্যাত হবে আর মাওলানা মতিউর রহমান মাদানি জঘন্য কথা বললেও তা নির্দ্বিধ গ্রহণীয় হবে! মাওলানা রুহুল আমিন কওমির আদর্শ পরিপন্থী কাজ করেও সম্মানিত থাকবে আর বিপরীত ঘরানার কারও পান থেকে চুন খসলেও ময়দান গরম করে ফেলা হবে! এগুলো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয়তো কী! ডাবল স্টান্ডার্ডকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা জরুরি হয়ে গেছে।
কোনো কওমি আলিমের ভুলের প্রামাণিক বিশ্লেষণ করলে আপনি হয়ে যাবেন আকাবিরবিরোধী। কোনো কিতালি শাইখের ভুল ফাতওয়া নিয়ে বললে আপনি হয়ে যাবেন কিতালবিরোধী। কোনো তাবলিগওয়ালার ভুল ধরিয়ে দিলে আপনি হয়ে যাবেন দাওয়াতবিরোধী। কোনো পিরের অপব্যাখ্যা বা ভুলব্যাখ্যা নিয়ে কথা বললে আপনি হয়ে যাবেন দীনবিরোধী। কোনো ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অন্যায় কার্যকলাপের ব্যবচ্ছেদ করলে আপনি হয়ে যাবেন ইসলামি রাজনীতি/আন্দোলনবিরোধী। এসবই আজকালকার নিয়মিত চিত্র। কথায় কথায় ‘ইহুদি-খ্রিষ্টানের দালাল’ ট্যাগ দেওয়া কিংবা ‘মাওলানা’ থেকে ‘মিস্টারে’ নেমে আসা যেন পুরোই পানিভাত। ভাবসাবে মনে হয়, এ দেশে কোনো ইসলামপন্থী দল যদি ভুলেও ক্ষমতায় যায় আর আপনি তাদের যৌক্তিক/প্রামাণিক বিরোধিতাও করেন তাহলেও আপনাকে ইসলামের দুশমন/আকাবিরবিরোধী/বিদআতি/লা মাযহাবি ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে প্রকাশ্যে হয়রানি করা হবে বা লালগুদামের মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
মাওলানা ওলিপুরি বা ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গির সাহেবের কোনো ইলমি বিচ্যুতি নিয়ে যদি আলোচনা করেন কিংবা আরেকটু উপরে গিয়ে শাইখ মাকদিসি বা শাইখ আহমাদ মুসা জিবরিলের কোনো ভুল ফাতওয়া আদবের সঙ্গে চিহ্নিত করেন তাহলে দেখবেন, কীভাবে মুহূর্তেই আপনাকে ইসলামের দুশমন ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়। অথচ যারা এসব ট্যাগ লাগাবে, দিনশেষে তারাও অন্য কারও ইলমি বিচ্যুতির ব্যবচ্ছেদ করতে বসবে। তখন আর মনে থাকবে না এই ট্যাগ আরোপের কথা। তখন আর অনুসৃত হবে না একই নীতি।
উল্লেখ্য, এখন চলছে ২০১৯। ফউমাকে নিয়ে আমি সর্বপ্রথম পোস্ট করেছিলাম আরও ৩ বছর আগে। অর্থাৎ ২০১৬ তে। ফউমা’র সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব ধর্মীয়। তাই তখন থেকেই আমরা তার বিরোধিতা করি। আর যাদের দ্বন্দ্ব দলীয়, তারা ইদানীং এসে তার বিরোধিতা শুরু করেছে। এই দলান্ধদের ফাতওয়ায় আমরা সে সময় ছিলাম আকাবিরবিরোধী। মজার বিষয় হলো, তারা নিজেরাই এখন তাদের সেই নীতি মেনে নিলে হয়ে যাবে আকাবিরবিরোধী।
ফউমা যখন কিতালকে গলা টিপে মেরে ফেলে তখন এই দলান্ধগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফউমা যখন ইসলামের বিভিন্ন বিধানের অপব্যাখ্যা করে প্রকাশ্য নিফাকে লিপ্ত হয় তখন এই দলান্ধরা কোম্বল মুড়ি দিয়ে থাকে। ফউমা যখন আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা’র জানাযা ওঠায় তখনো তারা উদারতা ও ভালোবাসার চর্চা করে। তবে একই ফউমা যখন তাদের কোনো উস্তাদ, মান্যবর মুরুব্বি অথবা তাদের কোনো দল বা আন্দোলন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে তখন তারা রবি’র মতো আপন শক্তিতে জ্বলে ওঠে। যত্তসব দলপূজারী ও গুরুপূজারী!
ইসলামের ক্ষতিতে এদের ভেতর আন্দোলিত হয় না। নিজ স্বার্থে আঘাত লাগলে তবেই এরা জেগে ওঠে। এমনি সাধুবাবা সেজে থাকলেও সময়ে সময়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
ফউমা-পূজারীদের কাছে ইসলামের চাইতে ফউমা’র পশ্চিমা আদর্শভিত্তিক ধর্মই অধিক পছন্দনীয়। কারণ তা কথিত হিকমাহর সারে পরিপুষ্ট।
অতীতের দিনগুলোর কথা ভাবি। বসে বসে স্মৃতি রোমন্থন করি। মনে পড়ে অনেক কিছুই। তবে সবকিছু প্রকাশ না করাই সমীচীন। অন্যথায় কিছু মুখোশ হয়তো আরও খুলে যাবে। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে এবং স্মৃতি তাজা রাখলে জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে আত্মজীবনী রচনাকালে বাতিলের পক্ষে আস্কারা ও ইন্ধনদাতা এবং মুলহিদদের পরোক্ষ মদোদদাতাদের নিয়ে কিছু লিখব।
মাশাআল্লাহ৷ সুন্দর হয়েছে শায়েখ৷
একদম মনের কথা বলেছেন। আল্লাহ আপনাকে সুস্থ শরীরে হাইয়াতে তাইয়্যেবা দান করুন। যেন আরো বহুকাল উম্মতের খেদমতে কাজ করে যেতে পারেন। আমিন।