করোনা প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন্দিমুক্তির ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ইরান প্রায় লাখখানেক বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে, যা দেশটির পুরো বন্দিসংখ্যার ৪০ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া মুক্তি দিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার বন্দীকে। এ ধরনের বিভিন্ন রিপোর্ট আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পাতায় আমরা দেখতে পাই। অপরদিকে বাংলাদেশে কারাবন্দীর সংখ্যা প্রায় ৮৯ হাজার; যা স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণের কাছাকাছি।
অবশ্য এটা হলো পূর্বের হিসাব। চলতি মাসে আদালত বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন অপরাধে ও অপবাদে গ্রেফতারি তো আর থেমে থাকেনি। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অনেকজনকে গ্রেফতার করার কথা তো গণমাধ্যমেই উঠে এসেছে। সবমিলিয়ে ৯০ হাজারের সংখ্যাটা হয়তো-বা এতদিনে পূরণ হয়ে গেছে বা অন্তত কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় এক মাসব্যাপী সামাজিক দূরত্বের ঘোষণা আসলেও কারাবন্দীদের জন্য পারস্পরিক দূরত্ব গ্রহণ করার কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কারাগারের প্রায় ৮১ শতাংশ বন্দী দণ্ডিত নয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিচারের রায় হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে তারা বিচারাধীনই রয়ে গেছে। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কারাগারের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা অন্য সবার মতোই নিরপরাধ। অথচ আইনমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযুক্তদের মধ্যে দণ্ডিত হওয়ার হার হচ্ছে প্রতি এক শ–জনে মাত্র তিনজন। এই হলো আইনের শাসনের অনন্য দৃষ্টান্ত!
গত সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে লঘু অপরাধে দণ্ডিত আসামীদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। লঘু অপরাধে দণ্ডিত ৩ হাজার ৭০০ জনের একটি তালিকাও তৈরি হয়েছে। যদিও এই তালিকার মানুষগুলো কোন দলের সমার্থক, তা আমরা জনসাধারণ এখনো জানতে পারিনি। হয়তো-বা কোনোদিনই জানতে পারব না। সে যাহোক, পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও এখনো কারও মুক্তির খবর পাওয়া যায়নি। এর এক কারণ হতে পারে জাতিগত ঢিলেমি, আরেক কারণ হতে পারে আর্থিক লেনদেনের গোপনীয় ব্যাপারস্যাপার।
উপরিউক্ত ৩৭০০ জন ছাড়াও ৫৬৯ ধারা অনুসারে যেসব কারাবন্দী ২০ বছর সাজাভোগ ইতিমধ্যে সমাপ্ত করেছে, এমন ১ হাজার ৪২০ জনের নামও মুক্তির জন্য প্রস্তাবাধীন রয়েছে। এছাড়াও ৫৯৪ ধারা অনুসারে ২১ জন মাজুর বন্দীর মুক্তির কথা রয়েছে। এর আগে জামিনযোগ্য ধারায় ৩ হাজার ৯২ জনের নামও বিবেচনার জন্য আদালতে প্রস্তাব করা হয়েছিল।
২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১ হাজারেরও অধিক মামলা হয়েছে। অভিযুক্তদের সংখ্যা তাহলে নিশ্চয়ই এরচেও বেশি হবে। এই আইন সম্ভবত গত দু-বছর যাবৎ সবচে অধিক বিতর্কিত আইন। এর যথেচ্ছা অপপ্রয়োগের কথা কার অজানা! এর পাশাপাশি মিথ্যা মামলা, হয়রানিমূলক মামলা, ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে মামলা ও জামিনযোগ্য মামলার আসামীদের সংখ্যাটাও একেবারে কম নয়। আর ওপরে আমরা বলেছি, এ দেশে দণ্ডিত হওয়ার হার হচ্ছে প্রতি এক শ–জনে মাত্র তিনজন। তার মানে বাকিরা আইনত নিরপরাধ; যদিও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বাস্তবিক বা বানোয়াট অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব কিছুর পরও কারাবন্দীদের বিষয়টা নিয়ে কেউই যেন ততবেশি উদ্বিগ্ন নয়। মসজিদ বন্ধ করতেও যারা রীতিমতো পাগলপারা, এক্ষেত্রে তাদের কেন যেন কোনো সাড়াই মেলে না।
অথচ খুনী ধর্ষক ও গুরুতর অর্থনৈতিক অপরাধের আসামীরা বাদে অন্য সবাই অন্তত এ সময়ে মুক্তি পাওয়া দরকার ছিল। কারণ, কারাগারে যদি কোনোভাবে করোনা ছড়িয়ে যায়, তাহলে এর অবস্থা হবে সবচে ভয়াবহ। ভ্যাটিকান সিটির মতো রক্ষিত জায়গায়ই যদি করোনা ছড়াতে পারে, ব্যাংকের মতো প্রয়োজনীয় জায়গাও যদি করোনার হটস্পট হতে পারে; তাহলে সে তুলনায় কারাগারে তো এ ঝুঁকি হাজারগুণ বেশি। এতদ্সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ তো দূরের কথা; উদ্বেগই নেই। বাইরের মানুষদের যেন কোনো দরদও নেই। খবরে জানা যায়, শিয়ারাষ্ট্র ইরান কিছু বন্দীকে মহামারির পর কারাগারে ফিরে আসার শর্তেও সাময়িক মুক্তি দিয়েছে। এই পন্থাটা অন্তত আমাদের এখানে অ্যাপ্লাই করা যেত বা এর দাবি জানানো যেত।
কিন্তু না, এখানে কেউ কারও মুক্তি চায় না। এই অমানবিক জীবন যাপনের ব্যাপারে তারা বেশ সন্তুষ্ট। হ্যাঁ, তারা নিজেদের জন্য এটা কামনা করে না; তবে অন্যদের জন্য এর ব্যতিক্রম কিছুও ভাবতে পারে না। আর তাইতো মাওলানা মামুনুল হক মাওলানা সাঈদীর মুক্তি চাইলে দেশ গরম হয়ে যায়। মাওলানা মামুনুল হক যদি রাষ্ট্রপ্রধান হতেন আর বাস্তবে তিনি মাওলানা সাঈদীকে মুক্তি দিয়েই দিতেন, তাহলে তো মনে হয় আন্দোলন-গণজাগরণে পুরো দেশ উত্তাল হয়ে উঠত। করোনাকে কেন্দ্র করেও যদি ভিন্নমতের কারও মুক্তি চাওয়া হয় এই মাটিতে, মনে হয় সেই একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এখানে। আমাদের মধ্যেই যদি অবস্থা এই হয়, তাহলে দুনিয়াদারদের অবস্থা আর কী হবে – তা তো সহজেই অনুমেয়। এ কারণে এসব সমীকরণ আলোচনা-পর্যালোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে আর এর কোনো প্রতিফল ঘটবে বলে আশা করা যায় না। সমস্যা নিয়ে যখন উদ্বেগ ও উদ্বিগ্নতা থাকে না, সমাধানও তখন আর সহজে আসে না।