বিয়ে সফলতার সোপান

বিয়ে মানবজীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মানব প্রজন্মের সুরক্ষা, সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবার গঠন এবং সামাজিক শান্তি-শৃংখলার জন্য বিয়ে এক নির্বিকল্প ব্যবস্থা। এর উপকার বহুমাত্রিক। ব্যক্তিজীবনের শৃংখলা, ব্যক্তির মানসিক ও দৈহিক সুস্থতা এবং ধৈর্য, সাহসিকতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণাবলিসহ তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশসাধনে বিবাহের ভূমিকা অভাবনীয়। বিবাহই জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মিতব্যয় ও মিতাচারের প্রধান চালিকাশক্তি। এটা স্বভাবগত কাম-চাহিদার নিষ্কলুষ সমাধান, মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও শ্রান্তিমোচন এবং দেহে সজীবতা ও মনে শান্তি সঞ্চারের মোক্ষম দাওয়াই। পরিবারে-পরিবারে, খান্দানে-খান্দানে ও বংশ-গোত্রে প্রীতিবন্ধনের এক চমৎকার ব্যবস্থা নর-নারীর এই শরিয়তি সম্মিলন। সর্বোপরি এটা আখিরাতের কল্যাণ লাভেরও এক উৎকৃষ্ট অবলম্বন। সুতরাং বিবাহ ইসলামের অন্যতম প্রধান সামাজিক বিধান এবং মহানবি ﷺ-এর এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।

বিয়ে করা শুধু মহানবি মুহাম্মাদ ﷺ-এর সুন্নাহই নয়; বরং তা অন্যান্য নবিগণেরও সুন্নাহ। আল্লাহ তাআলা বলেন :

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلاً مِنْ قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجاً وَذُرِّيَّةً

আমি আপনার পূর্বে অনেক রাসুল প্রেরণ করেছি এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তান দিয়েছি।[1]

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন :

إني أتزوج النساء فمن رغب عن سنتي فليس مني

নিশ্চয়ই আমি নারীদের বিয়ে করি। সুতরাং যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ হবে, সে আমার (উম্মাহর) অন্তর্ভুক্ত নয়।[2]

বিয়ে সাধারণভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ এটা অপরিহার্য হয়ে যায়, যখন কোনো ব্যক্তি বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণ না করলে গোনাহে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা করে। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন :

يا معشر الشباب من استطاع منكم الباءة فليتزوج فانه أغض للبصر وأحصن للفرج ومن لم يستطع فعليه بالصوم فانه له وجاء

হে যুবক সম্প্রদায়,[3] তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে। কারণ, বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করে এবং যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন সাওম পালন করে। কেননা, সাওম তার যৌনতাকে দমন করবে।[4]

ঘটনা ঘটার আগে ভাবতে হয়; ঘটার পরে নয়। দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নিতে হয়; পড়ে যাওয়ার পরে নয়। যে বয়সে ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ এবং প্রেমানুভূতি সৃষ্টি হয় তখনই তাদের বৈধ সঙ্গী-সঙ্গিনীর ব্যবস্থা না করে দিলে এর ক্ষতি যে কী হয়, সেই ফলাফল তো এখন আমাদের চোখের সামনে। পানি গড়াবেই। পানি—সে তো বয়ে যাওয়ার জন্যই। পানি প্রবাহিত হওয়ার জন্য যদি সুষ্ঠু পথ খুঁজে পায় তাহলে পানি সে পথেই প্রবাহিত হবে। আর যদি পথ খুঁজে না পায় তবুও সে কুপথে নিজের মতো করে পথ করে নেবে। তবে সর্বাবস্থায় সে প্রবাহিত হবেই; প্রবাহিত যে তাকে হতেই হবে। এটাই যে তার সৃষ্টিগত স্বভাব, তার প্রকৃতি। এটাকে রোধ করা যাবে না সহজে। রোধ করার চেষ্টা করা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কম নয়।

রাসুল সা. বলেছেন :

لم تر للمتحابين مثل النكاح

বিয়ের মতো অনুরূপ ভালোবাসা লালনকারী যুগল তুমি দেখবে না।

কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থা এ প্রাকৃতিক বিধানকে কঠিন করে ফেলেছে বেশ। যার ফলে পুরুষকে জীবনের অর্ধেকপ্রায়, বরং অর্ধেকেরও বেশি কাল থাকতে হয় নিঃসঙ্গ, একাকী। যৌবনের দীপ্ত সে দিনগুলোতে কেউ তো যৌবনের তাড়নায় হারিয়ে ফেলে নিজেকে, ঠেলে দেয় জেনেবুঝেই নিজেকে অন্ধকার জগতে। চাহিদা মেটায় অবৈধ প্রক্রিয়ায়। জানি না, এর পুরো দায়ভার তার কাঁধে চাপানো কতটা ন্যায়সঙ্গত? প্রাকৃতিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করার পেছনে সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে শত বাধা, সহস্র প্রতিবান্ধকতা। কী করবে এখন টগবগে যুবক?

বিয়ের ব্যবস্থাকে যদি সহজ করা হয়, যেমন দীনী অনেক পরিবারের সচেতন অভিভাবকগণ করছেন, তবে রোধ হবে অনেক অপরাধ-প্রবণতা। নারীর সঙ্গ বদলে দিবে পুরুষের অন্তর্জগত, সততা-সাফল্যের আলোকিত সরোবরে প্রশান্তবদনে অবগাহন করবে তখন তরুণ-যুবারা।

এ জন্যই ইসলাম বিয়ের প্রতি এত বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। ইমাম আবু বকর জাসসাস আহকামুল কুরআন গ্রন্থে সুরা নুরের তাফসিরপ্রসঙ্গে এই বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন।

عَنْ شَدَّادِ بْنِ أَوْسٍ أَنَّهُ قَالَ لِأَهْلِهِ زَوِّجُونِي فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْصَانِي أَنْ لَا أَلْقَى اللَّهَ أَعْزَبَ

শাদদাদ ইবনু আওস রা. তার পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা আমাকে বিয়ে করিয়ে দাও। কেননা নবিজি সা. আমাকে ওসিয়ত করেছেন, আমি যেনো কুমার অবস্থায় আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করি’।

ما أخرجه عبد الرزاق في مصنفه عن طريق عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنه قال لرجل: “ما يمنعك من النكاح إلا عجز أو فجور

উমর রা. এক ব্যক্তি বললেন, নিশ্চিত তোমাকে বিয়ে থেকে ফিরিয়ে রাখছে হয়তো অক্ষমতা কিংবা পাপাচার।[5]

ما أخرج عبد الرزاق أيضاً من طريق عبد الله بن مسعود رضي الله عنه أنه قال: “لو لم يبق من الدنيا إلا يوم واحد أحببت أن يكون لي فيه زوجة

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, পৃথিবীর আয়ু যদি আর একদিন বাকি থাকে, তবুও আমি পছন্দ করব যে, সে দিনটিতে আমার একজন স্ত্রী থাকুক।[6]

আদি পিতা আদম আ. জান্নাতে সব নেয়ামতের মধ্যে থেকেও অন্তরে শূন্যতা অনুভব করলেন। কী নেই জান্নাতে! তবুও সব প্রাপ্তির মধ্যে থেকেও অন্তরে কেমন যেনো অপ্রশান্তি অনুভূত হচ্ছিলো। কিসের যেনো বাসনা পুরো হৃদয়জুড়ে। অনন্তর আল্লাহ তাআলা হাওয়া আ.কে সৃষ্টি করলেন। অন্তর প্রশান্ত হলো। হৃদয়ে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে লাগলো।

শরিয়ত নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যম করেছে বিবাহ-বন্ধনকে। বিবাহের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে “লি ইয়াসকুনা ইলাইহা” বলে; “লি ইয়াসকুনা মাআহা” নয়। অর্থাৎ আত্মিক প্রশান্তি অনুভবই এর অন্যতম লক্ষ্য। বিয়ে মানে শুধু যৌন সম্পর্কের বৈধতা প্রাপ্তি নয়। বরং বিয়ে তো এক মুকাদদাস-পবিত্র বন্ধন। যে সংসারে “লি ইয়াসকুনা মাআহা” অর্থাৎ শুধু যৌনতাকেন্দ্রিকই সম্পর্ক হয়, হৃদয়ের নিবিড় বন্ধন নয়, তা সাধারণত টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিবা হলেও দু’জনই ধীরে ধীরে অন্য প্রেয়সীর প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। আর পরিণামে তা সংসারকে বিস্বাদে, কখনো জ্বলন্ত নরকে পরিণত করে।

প্রেমের বিয়েও সাধারণত টেকসই হয় না। প্রখ্যাত আলিম ও সাহিত্যিক আলী তানতাবী বড় সুন্দর বলেছেন :

‘প্রেম হলো আত্মার ক্ষুধা। ক্ষুধার্তরা কি খাবারের ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করতে পারে? ক্ষুধা কি তার সামনে গুটি বসন্তে আক্রান্তকেও সুসজ্জিত করে তোলে না? ফলে গুটি বসন্তে আক্রান্তকেই মুখে দিয়ে খাসা বকরির স্বাদ পায়। যখন ক্ষুধার তাড়না শেষ হয়, তখন গুটি বসন্ত ফিরে আসে গুটি বসন্ত হয়ে। সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়— সে তো ছিল ক্ষুধার কল্পনায় সৃষ্ট খাসা বকরি। প্রেমিকার বিষয়টিও এমনই। প্রেমের দরুন প্রেয়সীর গায়ে সে চড়ায় ঝলমলে পোশাক। ফলে প্রেয়সীকে দেখে সবচেয়ে সুন্দরী মানবীরূপে, (মর্তের মানবী তো নয়, যেনো স্বর্গের অপ্সরী)। প্রলুব্ধ করা সেই পোশাকের মেয়েটিকে বিয়ে করার পর একপর্যায়ে পোশাকটি যখন খুলে যায় তখন আর বিবাহ বন্ধন থাকে না। কারণ, সে তো মেয়েটিকে বিয়ে করেনি। বিয়ে করেছে পোশাকটিকে, তার কল্পনা যে পোশাক মেয়েটির গায়ে পরিয়েছিল।

বাস্তবে প্রেম হলো, যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা শেষ হলে শেষ হয়ে যায় প্রেমও। এবং মজনুর হুঁশ ফিরে আসে, লায়লা তার চোখে অন্যান্য নারীর মতোই ধরা দেয়, তখন আর কোনো আগ্রহ থাকে না। যেমন পেট ভরে গেলে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাবারের প্রতি আগ্রহ থাকে না। এ এক সাময়িক বন্ধন, প্রথম স্পর্শেই ছিন্ন হয়ে যায়। স্পর্শ বলে কী বুঝাচ্ছি আশা করি বুঝতে পারছ! বিবাহ হলো স্থায়ী সম্পর্ক, এর জন্য প্রয়োজন স্থায়ী বন্ধনের, যা স্পর্শের চেয়ে শক্ত ও দৃঢ়, দিন দিন তা আরও সুদৃঢ় ও মজবুত হবে।

আমি সব দেশের সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি। ‘প্রেমনির্ভর বিবাহ’ বিষয়ে বড় বড় সাহিত্যিকের অসংখ্য গল্প পড়েছি। এর সবগুলোর পরিণতি হলো, বিবাদ ও বিচ্ছেদ। ওয়ার্দার, রাফায়েল, মাজদুলীন, বোল, ফারজিনী, ক্রাজিলা, জোসলান ও ভাঙ্গা ডানাদের বিরহ বেদনায় প্রতারিত হোয়ো না। এসবই পূর্বে আলোচনা করা আগ্রহের একটি পর্যায়ের চিত্র। এসবের নায়করা যদি প্রেয়সীকে শুধু প্রেমের কারণে বিয়ে করত, তাহলে গল্পের সমাপ্তি ঘটত তালাক দিয়ে।

না। বিয়ের ভিত্তি শুধু প্রেমের ওপর হতে পারে না। হ্যাঁ, হতে পারে। যদি বিশাল প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করা যায় পানির প্রবাহে লবণের ওপর।

বিবাহের ভিত্তি হলো, ভাবনা ও আচরণের মিলন এবং সামাজিক নিয়ম ও আর্থিক অবস্থার ওপর। এসবের পরে আসে আবেগ। বর কনে দেখবে, কনে বর দেখবে। অর্থাৎ মেয়ের অভিভাবক বা মাহরামের উপস্থিতিতে ছেলে শুধু মেয়ের চেহারা আর হাত দেখবে। তালগোল পাকিয়ে ফেলা শায়খ বাকুরীর ফতোয়ার মতো নয়। এরপর যদি আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে দেন তাহলে বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে এ আকর্ষণ পরিণত হয় স্থির ও স্থায়ী ভালোবাসায়। যদি তাদের মাঝে অনাগ্রহ ও অনিচ্ছা জন্ম নেয় তাহলে পরিণামে একজনের কাছে অপরজনের প্রয়োজন আর থাকবে না।’

মাওলানা আ ব ম সাইফুল ইসলাম (হাফিজাহুল্লাহ) লেখেন :

‘মানবসভ্যতার জন্য অপরিহার্য ও অতি কল্যাণময় এ ব্যবস্থাটিকে (বিয়েকে) স্বভাবধর্ম ইসলাম খুবই সহজসাধ্য করেছে, যাতে এর কল্যাণ থেকে কেউ বঞ্চিত না হয় এবং সর্বস্তরের মানুষই এর সুফল ভোগের সুযোগ পায়। সুতরাং এর জন্য খুব বেশি আচার-বিচার, উদ্যোগ-আয়োজন ও জাঁকজমকের দরকার হয় না। নেই কঠিন কোন শর্ত ও দুর্ভর ব্যয়ের ঝক্কি। খরচ বলতে কেবল স্ত্রীর মাহ্র। আর আচার-অনুষ্ঠান বলতে কেবল সাক্ষীদের সামনে বর-কনের পক্ষ হতে ইজাব-কবূল। ব্যস এতটুকুতেই বিবাহ হয়ে যায়। অতপর ওলীমা করা সুন্নত ও পুণ্যের কাজ বটে, কিন্তু বিবাহ সিদ্ধ হওয়ার জন্য তা শর্ত নয়। এছাড়া প্রচলিত কিছু কাজ কেবলই জায়েয পর্যায়ের। তা করা না করা সমান। করলেও কোন অসুবিধা নেই, না করলেও দোষ নেই। কেননা বিবাহ শুদ্ধ হওয়া-না হওয়া কিংবা উত্তম-অনুত্তম হওয়ার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

কিন্তু আফসোস, মানুষ এমন কল্যাণকর অথচ সহজসাধ্য একটা বিষয়কে চিন্তা- চেতনা ও ব্যবহারিক বাড়াবাড়ির কঠিন গেড়াকলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। যদ্দরুন সাধের বিবাহ আজ রীতিমত আতঙ্কের যূপকাষ্ঠ। বিবাহের নামোচ্চারণ মাত্র পাত্রপক্ষের চোখে ভেসে ওঠে এলোমেলো অর্থশ্রাদ্ধের মহামচ্ছব আর কন্যাপক্ষের তো নামই পড়ে গেছে কন্যাদায়গ্রস্ত।

মূল সমস্যা চিন্তা-চেতনাগত। মানুষ বিবাহকে দেখছে কেবলই পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে। আরও সত্যি করে বলতে গেলে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। অথচ ইসলামী বিবাহ পার্থিব বিষয়মাত্র নয়। এর সাথে আখিরাতের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এর আছে ইবাদতের মহিমা, যে কারণে এ প্রশ্নও উঠেছে যে, বিবাহ করে সাংসারিক জীবন-যাপন উত্তম, না সংসারবিমুখ হয়ে নামায-রোযা-যিকর ইত্যাদির জন্য নিজেকে উৎসর্গিত রাখা উত্তম। অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে সাংসারিক জীবন যাপনই উত্তম। তার ফলে প্রত্যক্ষ ইবাদতের মাহাত্ম্য অনেক বেড়ে যায়। এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি বিবাহ করল সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে ফেলল, এখন বাকি অর্ধেকের জন্য সে আল্লাহকে ভয় করুক।[7]

বিবাহের ফজিলত সম্পর্কে আরও অনেক হাদিস আছে। এটা সমস্ত নবীর আদর্শ। এরই মাধ্যমে মানব প্রজন্মের সূচনা ও বিস্তার ঘটেছে। এটা সদাকায়ে জারিয়ার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন ছওয়াব লাভের প্রকৃষ্ট মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান সমাজ বিবাহকে তার এ মহিমা থেকে অনেক নিচে নামিয়ে ফেলেছে। বিবাহের ব্যাপারে চিন্তা-চেতনার ঘটেছে দারুণ অবক্ষয়। মানুষ শিকার হয়ে পড়েছে শৈথিল্যমূলক প্রান্তিক ভাবনার। তারা এর পারলৌকিক যোগসূত্রকে ছিন্ন করে ফেলেছে। এর দ্বারা পুণ্যার্জনের কোন চেতনা তারা পোষণ করছে না। এক্ষেত্রে দুনিয়াই তাদের মুখ্য। বরং কেবল দুনিয়াবী লাভ-লোকসানেই নজর রাখা হচ্ছে। মেয়েপক্ষ দেখছে কেবলই ছেলের বা তার বাবার অর্থকড়ি, তার অবর্তমানে বড় চাকরি, তাও না থাকলে এমন কোন যোগ্যতা যার দৌলতে আশুদিনে অনেক কামাতে পারবে। ছেলেপক্ষের কাছেও বিচার্য মেয়ের বাবার অর্থ-সম্পদ বা কী মেয়ের নিজের উপার্জন-ক্ষমতা। যৌতুকের বহর কি হবে সেদিকে তো নজর থাকছেই। এসব বৈষয়িক ও অনৈতিক ভাবনার উৎপত্তি হয়েছে বিবাহ সম্পর্কে চিন্তাগত অবক্ষয় থেকেই এবং এ অবক্ষয় থেকেই বিবাহের সাথে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক উপসর্গ। তা না হবে কেন? যে কাজের সাথে পারলৌকিক কোন সম্বন্ধ চিন্তা করা হয় না, তার সাথে বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে ভোগবাদিতার সব উপাদান যুক্ত হতে বাধ্য। সুতরাং বর্তমান সমাজের বিবাহগুলো তার সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত বিচিত্র ভোগলোলুপতায় ঠাসা। কারও বিবাহ যেন আর সকলের অবাধ-উদ্দাম-উৎকর্ষই ফূর্তির উপলক্ষ। চোখের হোক আদেখ দেখার বাহারী আয়োজন। কানে হোক বর্জ্য-অশ্রাব্যের ধারাবরিষণ। বল্গাহারা আনন্দে-নৃত্যে দেহমনের মৌজ-মৌতাতে সব একশা-একাকার হয়ে যাক, তবেই না এটা বিবাহ। এভাবেই ভাবনার দৈন্যে মুসলিম-জীবনের এক পবিত্র সূচনা আজ রকমারি পাপের মচ্ছবে পর্যবসিত।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী-পুরুষের অবাধ আলাপন

১.

আমাদের এই নিবন্ধের উদ্দেশিত পাঠক তারা, যারা দ্বীনের ওপর চলতে চান, ব্যক্তিজীবনে শরিয়াহর অনুশাসন মানতে চান। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেহেতু বর্তমানে সকল শ্রেণির মানুষের সরব উপস্থিতি, তাই বিভিন্ন প্রয়োজনে দ্বীনদার নারী-পুরুষের মধ্যে আলাপন হয়। কখনো তা হয় কমেন্টে, কখনো তা এই সীমানা অতিক্রম করে ইনবক্স পর্যন্ত গড়ায়। এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য খারাপ থাকে না। দ্বীনি কোনো জরুরতে বা দুনিয়াবি কোনো প্রয়োজনেই এই আলোচনার সূত্রপাত হয়। তবে কখনো কখনো এবং কারো কারো ক্ষেত্রে (বরং অনেকের ক্ষেত্রেই) একপর্যায়ে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিঃস্বার্থ সম্পর্ককে কোনো স্বার্থ— কামনা-প্রত্যাশা দখলে নিয়ে নেয়। এ পর্যায়ে এসেও সাধারণত তারা নিবৃত্ত হন না, বরং ভালো কোনো উদ্দেশ্যের কথা নিয়তে এনে —যেমন বিয়ে— এই ধারা অব্যাহত রাখেন। একসময় যা সূচিত হয়েছিলো স্রেফ প্রয়োজনের ভিত্তিতে বা অন্য কোনো ভালো নিয়তে, পরিশেষে তাই রূপ নিচ্ছে ভালোবাসা এবং প্রেমে। হাঁ, এভাবে চলতে চলতে ছবি দেয়া-নেয়া, স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচার-কথাবার্তার ধারাও কখনো এই যুগলের মধ্যে অস্তিত্ব লাভ করে। কখনোবা এই সম্পর্কের সূত্র ধরে বাস্তবিক জীবনেও দু’জন পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়। তবে এর দৃষ্টান্ত বোধহয় খুব বেশি নয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরিয়াহর এমন সীমালঙ্ঘন এবং হালাল প্রেমের ব্যানারে হারাম কর্মকাণ্ডের পরিণতি সুখকর হয় না, বরং তা ডেকে আনা হতাশা ও প্রচণ্ড নৈরাশ্য; আখের যা কাউকে কাউকে শরিয়াহর আলোকে আলোকিত জীবনের চৌহদ্দি থেকে বের করে নিয়ে যায় অন্ধকার জগতের দিকে, বা শরিয়াহর পথে থাকলেও ভেতরটা ছেয়ে যায় আঁধারে।

২.

আল্লামা বাহুতি রহ. তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘কাশশাফুল কিনা’তে বলেন—

وإن سلَّم الرجل عليها -أي على الشابَّة- لم تردَّه؛ دفعاً للمفسدة

কোনো পুরুষ যদি যুবতী নারীকে সালাম দেয়, তাহলে সে সালামের জবাব দেবে না— অনিষ্ট প্রতিরোধের স্বার্থে।

আল্লামা খাদিমি হানাফি রহ. ‘বারিকাতুন মাহমুদিয়াহ’ গ্রন্থে বলেন—

التكلم مع الشابة الأجنبية لا يجوز بلا حاجة؛ لأنه مظنة الفتنة

একান্ত কোনো প্রয়োজন ছাড়া গাইরে মাহরাম তরুণীর সাথে কথা বলা জায়িয নেই; কারণ, তা ফিতনার ক্ষেত্র।

শুধু এ-দু’জনই নন। অসংখ্য ইমাম এবং ফকিহের বক্তব্যে এ কথা পাওয়া যায় যে, তারা পরনারীর সাথে একান্ত কোনো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা, এমনকি সালাম আদান-প্রদানকেও বৈধতার দৃষ্টিতে দেখতেন না। কারণ, এই ক্ষেত্রটি ফিতনার ক্ষেত্র। কুরআনে অনেক গুনাহের ব্যাপারেই আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা সেগুলোতে লিপ্ত হয়ো না। কিন্তু শুধু একমাত্র ব্যভিচারের ব্যাপারে বলেছেন যে, “তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না”। কারণ, মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে দুর্বলরূপে। পুরুষমাত্রই নারীর প্রতি দুর্বল। তাই এক্ষেত্রে পদস্খলনের শঙ্কা অনেক বেশি। কতো বড় বড় আল্লাহওয়ালা বুযুর্গেরও এখানে এসে অজান্তে পদস্খলন ঘটে গেছে। মহান আল্লাহ যেহেতু বান্দার এই দুর্বলতার কথা জানেন, তাই তিনি এই কঠোর নির্দেশ জারি করেছেন। অর্থাৎ, ব্যভিচার করার তো প্রশ্নই আসে না, বরং তার সীমানার আশপাশেও এসো না, তোমাকে কোনো একসময়ে ব্যভিচারে লিপ্ত করতে পারে—এমন সম্ভাবনার ক্ষেত্র থেকেও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখো। “তোমরা গুনাহের পথ ছেড়ে আল্লাহ তাআলার দিকে পলায়ন করো। আমি তো এ ব্যাপারে তোমাদেরকে সুস্পষ্ট সতর্ককারী।”

৩.

ইসলামি শরিয়াহ এবং ফিকহের কিছু সর্বব্যাপী মূলনীতি রয়েছে, যা সর্বযুগে সর্বস্থানে প্রযোজ্য। এই মূলনীতিগুলো কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা ও বিধিবিধান থেকেই আহরিত। শরিয়াহর এমন বিশেষ তিনটি মূলনীতি হলো—

ক. سـدّ الذرائع তথা উপায়-উপলক্ষ্যকে বন্ধ করা বা গুনাহে লিপ্ত করার আশঙ্কা রয়েছে—এমন সকল দুয়ারকে রুদ্ধ করা।

খ. درء المفاسد مُقدّم على جلب المصالح তথা অনিষ্ট রোধ করা উপকার অর্জন করার ওপর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। অর্থাৎ কোনো কাজ এমন যে, যদি তা করা হয়, তাহলে তাতে ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। ভালো দিকটির দাবি হলো, সেই কাজটি করা হবে। আর মন্দ দিকটির দাবি হলো, সেই কাজটি পরিহার করা হবে। এখন এক্ষেত্রে মন্দ দিকটিকেই প্রাধান্য দিয়ে বলা হবে, এই কাজ করো না, নিজেই নিজের ক্ষতি ডেকে এনো না।

গ. ما أفضى إلى مُحرّم فهو مُحرّم তথা যা-কিছু হারামের দিকে পৌঁছায়, তাও হারাম। অর্থাৎ, কোনো কাজ যদি এমন হয় যে, যদি তাতে কেউ লিপ্ত হয়, তাহলে একপর্যায়ে সে হারামে লিপ্ত হবে, তাহলে তার প্রথম কাজটিকেও হারাম বলা হবে।

উপরিউক্ত মূলনীতিগুলোর দাবি হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নারী-পুরুষের পারস্পরিক আলাপনকে অবৈধ বলা হবে, যেহেতু তাতে তিনওটি মূলনীতি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। শরিয়াহর অনেক বিধানের ক্ষেত্রেই এই মূলনীতিগুলোর বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন কুরআনে বলা হচ্ছে—

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَآ أَكْبَرُ مِن نَّفْعِهِمَا

তারা আপনাকে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি বলুন, এ-দু’টিতে রয়েছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু উপকার। আর এ-দু’টোর পাপ তার উপকার অপেক্ষা গুরুতর।

অর্থাৎ যদিও তাতে উপকারি দিক রয়েছে, কিন্তু উপরিউক্ত দ্বিতীয় মূলনীতির আলোকে এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং উপকার থাকা সত্ত্বেও তার বৈধতার অনুমোদন দেয়া হয় নি।

তেমনি আল্লাহ বলছেন—

و لا تسبوا الذين يدعون من دون الله فيسبوا الله عدواً بغير علم

“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে-সকল উপাস্যকে ডাকে, তোমরা সেই উপাস্যদেরকে গালমন্দ করো না। নইলে তারা প্রতিশোধবশত না জেনে আল্লাহকেও গালমন্দ করবে।” অর্থাৎ উপলক্ষ্য থেকেও সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত, যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটে যায়।

যেহেতু এসব যোগাযোগমাধ্যমে পারস্পরিক আলাপন মানুষকে গুনাহে লিপ্ত করার এবং এর মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি শরিয়াহর সীমানা অতিক্রম করার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে, তাই ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে এ কাজের সাধারণ অনুমতি প্রদান করার অবকাশ নেই।

এখন কেউ যদি ভবিষ্যতে বিয়ের বন্ধনে জড়াবে—এমন নিয়তের ভিত্তিতে এমনটা করে থাকে, তাহলে তাকে বলা হবে, বিয়ের বিষয়টি তো সুনিশ্চিত কিছু নয়, স্রেফ ধারণা ও নিরেট সম্ভাবনা। যা হতেও পারে, নাও হতে পারে। এমন সম্ভাবনার কারণে এ ধরনের বিষয় বৈধ হয়ে যায় না। এক্ষেত্রে অবৈধতার বিষয়টি সুদৃঢ় ও তার প্রামাণিকতা সুনিশ্চিত, পক্ষান্তরে বিয়ের বিষয়টি নিতান্ত দুর্বল এবং স্রেফ ধারণা ও অনুমান। আর শরিয়াহর মূলনীতি হলো, “যা সুনিশ্চিত, তা ধারণার কারণে দূর হয়ে যায় না।” اليقين لا يزول بالشك

৪.

কেউ নিজের ব্যাপারে সুধারণা রেখে এ কথা বলতে পারে যে, আমার ইমান আলহামদুলিল্লাহ এতোটা দুর্বল নয়, তাছাড়া নারীদের প্রতিও আমার এতো উপচে পড়া আকর্ষণ নেই যে, একজনের সাথে স্রেফ দু-চার কথা বললেই আমার মন তার দিকে ঝুঁকে যাবে এবং আমি রীতিমতো তার প্রেমে জড়িয়ে যাবো। এই ব্যক্তির উচিত রাসুলুল্লাহ সা. এর হাদিসকে স্মরণ করা, তিনি বলছেন—

من سمع منكم بخروج الدجال فلينأ عنه ما استطاع ، فإن الرجل يأتيه وهو يحسب أنه مؤمن ، فما يزال به حتى يتبعه مما يرى من الشبهات

“তোমাদের কেউ দাজ্জালের আবির্ভাবের সংবাদ শুনতে পেলে সে যেনো যথাসম্ভব দাজ্জালের থেকে দূরে থাকে। কারণ, কোনো লোক দাজ্জালের কাছে এমতাবস্থায় আসবে যে, তার ধারণা থাকবে যে, সে তো ভালো মুমিন। অনন্তর দাজ্জালের সৃষ্ট সংশয়সমূহ প্রত্যক্ষ করে সে তার অনুসরণ করে বসবে।”

এজন্য শরিয়াহর শিক্ষা হলো, ফিতনার ক্ষেত্র থেকে দূরে থাকা। কারণ, ফিতনা মানে হলো পরীক্ষা। আর পরীক্ষায় অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও মানুষ ব্যর্থ হয়ে যায়। মুমিনের জন্য নিজ ইমানকে জেনেবুঝে ফিতনায় ফেলা কোনোভাবেই উচিত নয়। কারণ, ফিতনা হলো পদস্খলনের জায়গা, এতে রয়েছে বিচ্যুতি এবং ভ্রষ্টতার সমূহ শঙ্কা। তাই ফিতনার ব্যাপারে প্রয়োজন চূড়ান্ত সতর্কতা। আর রাসুলুল্লাহ সা. তো বলেছেনই—

“আমি আমার পরে পুরুষের জন্য নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকারক কোনো ফিতনা রেখে যাই নি।”

৫.

এরপরও একান্ত যদি নারী-পুরুষের আলাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়, যেক্ষেত্রে একজন আরেকজনকে নক করা ছাড়া কোনো বিকল্পই নেই (এমন অবস্থা বাস্তবে বিরল। অন্তরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা থাকলে বিকল্প একটা না একটা বের হয়ই। আর অন্তর এবং মানসিকতা যদি প্রস্তুত না হয়, তাহলে তো কতো অজুহাতই তৈরি হয়। শয়তানও এসকল অজুহাতকে দৃষ্টিপটে সুশোভিত করে উপস্থাপন করে, যেমনটা সুরা আলে ইমরানে আল্লাহ বলেছেন।), সেক্ষেত্রেও উভয়ের জন্য শরিয়াহর চারিত্রিক শিক্ষা এবং শিষ্টাচার-সংক্রান্ত নির্দেশনার প্রতি পূর্ণরূপে লক্ষ রাখা জরুরি। যেমন আল্লাহ বলেছেন—

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ

যদি তাদের কাছে তোমরা কোনো সামগ্রী চাও, তাহলে অবশ্যই পর্দার আড়াল থেকে চাবে। এ পন্থা তোমাদের অন্তর এবং তাদের অন্তর অধিকতর পবিত্র রাখার পক্ষে সহায়ক হবে।

إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلاً مَعْرُوفًا

যদি তোমরা তাকওয়া ধারণ করে থাকো, তাহলে কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, পাছে অন্তরে ব্যাধি আছে—এমন ব্যক্তি লালায়িত হয়ে পড়ে। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে।

এ বিষয়গুলো বাস্তবিক কথাবার্তার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, অনলাইন আলাপচারিতার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা প্রয়োজন পরিমাণই হওয়া উচিত, আর এক্ষেত্রেও প্রয়োজনের সীমারেখা রক্ষা করে তা হওয়া উচিত। শরিয়াহর মূলনীতি হলো, “জরুরত নিষিদ্ধ কাজকেও বৈধতা দেয়, আর জরুরতের কারণে বৈধতা লাভ করে—এমন বিষয় জরুরত পরিমাণই বৈধ থাকে।”

الضرورة تبيح المحظورات، الضرورة تتقدر بقدر الضرورة.

তাই প্রয়োজন পরিমাণ কথাবার্তার ক্ষেত্রেও সতর্কতার সাথে এমন সকল উপায়-উপকরণ পরিহার করা উচিত, যাতে একজনের অন্তর অপরজনের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, অজান্তে বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেউ কারো দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। এক্ষেত্রেও সবিশেষ লক্ষ্যণীয় যে বিষয়টি তা হলো, এমন প্রয়োজনীয় আলাপনের বিষয়টিও পাবলিক প্লেসে হওয়া উচিত, যেমন কমেন্টবক্সেই প্রয়োজনীয় আলাপচারিতা সেরে নেয়া উচিত; এমন কোথাও না হওয়াটাই কাম্য, যেখানে বিষয়টি শুধু দু’জনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে, তৃতীয় কেউ তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর থাকে, যেমন ইনবক্স। কারণ, নারী-পুরুষ দু’জন কোথাও একান্ত হলে, তাদের মাঝে তৃতীয় আরেকজনের আগমন ঘটে, আর সে হলো শয়তান। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন—

“নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের শরীরে এমনভাবে চলাচল করে, যেমন রক্ত চলাচল করে। আমি শঙ্কাবোধ করেছি যে, শয়তান তোমাদের দু’জনার অন্তরে খারাপ কিছু উদ্রেক করতে পারে।” {সহিহ বুখারি: ৩২৮১, ২০৩৮; সহিহ মুসলিম: ২১৭৪, ২১৭৫; সুনানু আবি দাউদ: ২৪৭০, ৪৯৯৪}

তেমনি প্রয়োজনীয় আলোচনা ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত পরিচয়, তথ্য আদান-প্রদান করা থেকেও বিরত থাকবে। এরপরও একান্ত যদি একজনের মন অন্যজনের দিকে কোনোভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে বা অচিরেই আকৃষ্ট হয়ে যাবে—এমন সম্ভাবনা বোধ করে, তাহলে তৎক্ষণাৎ পারস্পরিক আলোচনার চির ইতি টেনে আল্লাহর দিকে অভিমুখী হবে এবং তার কাছে সৎকর্ম করার এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে শক্তি ও সাহায্য প্রার্থনা করবে।

পাত্র-পাত্রী নির্বাচন

সমাজে পাত্রী দেখা এবং দেখানোর ক্ষেত্রে এক ধরনের বাড়াবাড়ি রয়েছে। উল্লেখ্য, অতি বুজুর্গ সেজে একেবারে পাত্রী না দেখেই বিয়ে করে ফেলা কোনো আদর্শিক পন্থা নয়; বরং তা রাসুলের নির্দেশনারও পরিপন্থী। উচিত হলো, বিয়ের পূর্বে সরাসরি পাত্রীকে দেখে নেওয়া। আজ এ নিয়ে আমাদের আলোচনা নয়। একইভাবে বিয়েকে অজুহাত বানিয়ে পথেঘাটে সবাইকে দৃষ্টিবাণে জর্জরিত করা যে বৈধ নয় এটাও বা কে না বোঝে! সুতরাং আমাদের আলোচনা তা নিয়েও নয়।

আমাদের আলোচনা হলো, সমাজের কিছু কিছু দীনি পরিবারে প্রচলিত রয়েছে যে, বিয়ের কথা একেবারে পাকাপোক্ত হওয়ার পরই কেবল পাত্রীকে দেখা যাবে; এর পূর্বে নয়। অর্থাৎ, পাত্র তার পাত্রীর চেহারা (এমনকি ছবি) দেখার পূর্বেই অন্যান্য খোঁজখবর নিয়ে প্রথমে বিয়ের ব্যাপারে মনস্থির করবে। এরপর বিয়ের দু-চারদিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রীকে দেখে আসবে। এই দেখে আসার আয়োজনকে এতটাই বিলম্বিত করা হয় যে, এর পূর্বে শুধু খুতবা ছাড়া বিয়ের অন্যান্য ধাপ মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে যায়।

যার কারণে সে সময়ে মেয়ে পছন্দ না হলেও লাজুকস্বভাবের কারণে অনেক পাত্রই আর মুখে না করতে পারে না। এতদূর এগিয়ে এসে এখন পিছিয়ে যাবে, বাবা-মা আত্মীয়-পরিজনই বা কী ভাববে, বন্ধু-বান্ধবরাও এ নিয়ে টিটকারি করবে না তো, মেয়েটার মনও তো ভেঙে যেতে পারে, এই পরিবারকেই বা পরবর্তীতে কীভাবে মুখ দেখাবে এ ধরনের আরও অসংখ্য ভাবনা এসে তার কুমারচিত্তকে অস্থির করে তোলে। ফলে সে এক ধরনের বাধ্য হয়েই অধরে এক চিলতে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে মুখে সম্মতি জ্ঞাপন করে। অথচ তার মন হয়তো এতে পুরোপুরি সম্মত হতে পারেনি। সবার ক্ষেত্রে যে এমনটা ঘটে তা নয়; তবে কারও কারও ক্ষেত্রে যে বিষয়টা এমনই হয়ে থাকে তাও কিন্তু অস্বীকারের জো নেই।

আচ্ছা, এই অতি বুজুর্গির উৎস কী এবং তার সূত্র কী? হাঁ, আনুষ্ঠানিক দেখাদেখির বিষয়টি (যে মজলিসে কথা পাকাপাকি করে আসা হয় এবং বিয়ের দিনকালও ঠিক করা হয়) বিলম্বিত হতে পারে। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে একনজর দেখাকেও এরূপ বিলম্বিত করার উপকারিতা কী?

হ্যাঁ, পাত্রীপক্ষের যুক্তি : আমরা তো আর যাকে-তাকে আমাদের মেয়ে দেখিয়ে বেড়াতে পারি না। মেয়ে শুধু তাকেই দেখাব, যে তার জীবনসঙ্গী হবে এবং বাকি জীবন তার সঙ্গে কাটাবে। সুন্দর যুক্তি।

কিন্তু বেচারা ছেলেটা এখন তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে কিসের ভিত্তিতে? দীনদারির বিষয়টা না হয় খোঁজ নিয়ে জেনে ফেলতে পারবে, কিন্তু দৈহিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে সে কীভাবে অবগত হবে? (বিলেতি নায়িকার মতো হওয়া তো জরুরি নয়; তবে তার হৃদয়রাজ্যের রানী হওয়ার মতো অবস্থা থাকাটা তো জরুরি। কারণ, হালাল স্ত্রীকেই যদি তার মনে না ধরে তাহলে এ আশঙ্কা তো থেকেই যায় যে, সে আজ হোক বা কাল অন্য কোনো অপ্সরীর দিকে লালায়িত হবে এবং এ কারণে তখন সংসারে আগুন জ্বলবে।)

“যদি কোনো ব্যক্তির মনে কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব করার ইচ্ছে হয় তাহলে তার জন্য সে নারীকে দেখার মধ্যে কোনো অসুবিধা নেই।” {ইবনু মাজাহ, আহমাদ, সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহাহ লিল-আলবানি}

“তোমাদের কেউ যখন কোনো নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দাও তখন তার উচিত তাকে দেখে নিতে চেষ্টা করা; যেন তা তাকে বিয়ে করতে আরও আগ্রহী করে তোলে এবং সে বিয়ে করে ফেলে।”

বর্ণনাকারী সাহাবি জাবির রা. বলেন, “এরপর আমি একবার এক নারীকে বিয়ে করার আগ্রহ পোষণ করলাম। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতে থাকলাম, অবশেষে এটা আমাকে বিয়ের দিকে নিয়ে গেল।” {আবু দাউদ, আহমাদ, সিলসিলা সাহিহাহ}

“তোমরা যখন কোনো নারীকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দাও তখন তার দিকে তাকানোতে কোনো গুনাহ নেই; যদি সত্যি সে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করে, এমনকি যদি সে (নারী) বিষয়টি না-ও জানে।” {আহমাদ, তাবারানি, সিলসিলা সাহিহাহ}

উপরিউক্ত বর্ণনাগুলো থেকে কি এটাই প্রমাণিত হচ্ছে না যে, পাত্র মনে মনে কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছা করলে তাকে প্রস্তাব দেওয়ার পূর্বে কিংবা প্রস্তাব দেওয়ার পরে কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই নির্দ্বিধায় তাকে দেখে নিতে পারবে; শরিয়াহর শর্ত এবং সীমা রক্ষা করে? সহিহ হাদিস থেকেই যদি এমনটা প্রমাণিত হয়ে থাকে তাহলে সমাজে কোনো কোনো দীনদার ফ্যামিলিতে প্রচলিত পন্থাটি কি বাড়াবাড়ি এবং কঠোরতা নয়? কেউ কেউ তো সেই কঠোরতা ছাড়া অন্য সকল সুরতকে রীতিমতো অবৈধ বলেও প্রচার করতে থাকে।

একইভাবে বিয়ের আগে পাত্রীর মন-মানসিকতা সম্পর্কে জেনে নেওয়াও সংসার সুখী হওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার পর যখন মাহরামের উপস্থিতিতে এক মজলিসে তারা উভয়ে পরস্পর পরস্পরকে নিরীক্ষণ করার জন্য সমবেত হবে তখন তাদের নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পুরো সময়টা মাহরাম পাত্রীর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকাটা তো জরুরি নয়। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে (যেখান থেকে তাদের উভয়কে দেখা যায় এবং তারাও তাকে দেখতে পারে, তবে কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যায় না) তাদের উভয়কে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ দেওয়াতে তো সমস্যার কিছু নেই।

বি. দ্র.

১. বিয়ের পূর্বে পাত্র ছাড়া অন্যান্য পুরুষদের জন্য (যেমন : পাত্রের বাবা-ভাই) পাত্রীকে দেখা বৈধ নয়।

২. বিয়েতে দৈহিক সৌন্দর্যের বিষয়টি কোনো গৌণ বিষয় নয়। হাঁ, দীনদারি, সতীত্ব, কুমারিত্বের ওপর এর অবস্থান নয় ঠিক; কিন্তু তা পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক। মোটেও অগুরুত্বপূর্ণ বা হালকা বিষয় নয়।

৩. বিয়ের ক্ষেত্রে কুমারী নারীকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “কুমারী নারীদের বিয়ে কোরো। তাদের কথা মধুরতর, গর্ভ উর্বর এবং তারা অল্পতে সন্তুষ্ট হয়।” {তাবারানি}

৪. অধিক সন্তান ধারণে সক্ষম নারীকে বিয়ে করা মুস্তাহাব। আর সন্তান ধারণে অক্ষম নারীকে বিয়ে করা মাকরুহ। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “এমন নারীকে বিয়ে করো, যে প্রেমময়ী এবং অধিক সন্তান ধারণে ক্ষমতা রাখে। কারণ, আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে গর্ব করব।” {আবু দাউদ, নাসায়ি}

মাওলানা আ ব ম সাইফুল ইসলাম (হাফিজাহুল্লাহ) লেখেন :

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা হল-

إذا خطب إليكم من ترضون دينه وخلقه فزوجوه إلا تفعلوا تكن فتنة في الأرض وفساد عريض.

‘যার দ্বীনদারী ও আখলাক-চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, এমন কেউ প্রস্তাব দিলে তার সাথে তোমরা বিবাহ সম্পন্ন কর। তা না করলে পৃথিবীতে ফিৎনা দেখা দেবে ও ব্যাপক ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়বে।’ (তিরমিযী, হাদীস : ১০৮৪)

এবং ইরশাদ হয়েছে

تنكح المرأة لأربع : لمالها ولحسبها ولجمالها ولدينها فاظفر بذات الدين تربت يداك.

 ‘নারীকে বিবাহ করা হয় চারটি জিনিস দেখে। তার সম্পদ দেখে, বংশমর্যাদা দেখে, রূপ দেখে এবং দ্বীনদারী দেখে। হে মুমিন! তুমি দ্বীনদার নারী বিবাহ করে ধন্য হয়ে যাও।’ (বুখারী, হাদীস : ৫০৯০; মুসলিম, হাদীস : ১৪৬৬)

অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা নারীদের (কেবল) রূপ দেখে বিবাহ করো না। অসম্ভব নয় রূপই তাদের বরবাদ করে দেবে। তাদের অর্থ-সম্পদ দেখেও বিবাহ করো না। হতে পারে অর্থ-সম্পদ তাকে উদ্ধত করে তুলবে। বরং দ্বীন দেখেই তাদের বিবাহ কর। একজন নাক-কান-কাটা কালো দাসীও (রূপসী ধনবতী স্বাধীন নারী অপেক্ষা) শ্রেয়, যদি সে দ্বীনদার হয়। (ইবনে মাজাহ)

এসব হাদীসের শিক্ষা হল পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারী ও আখলাক-চরিত্রকেই পয়লা নম্বরে রাখতে হবে। চেহারা-সুরতও অবহেলার নয়। অর্থ-সম্পদ ও বংশীয় সমতাও বিচার্য বটে, কিন্তু সবই দ্বীনদারীর পরবর্তী স্তরে। দ্বীনদারী ও আখলাক-চরিত্র সন্তোষজনক হলে বাকিগুলোতে ছাড় দেওয়া যায়, কিন্তু বাকিগুলো যতই আকর্ষণীয় হোক, তার খাতিরে দ্বীনদারীতে ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। হাঁ দ্বীনদারীর সাথে অন্যগুলোও যদি মিলে যায়, সে অতি সুন্দর মিলন বটে, কিন্তু তা খুব সহজলভ্যও নয়। তাই সে রকম আশার ক্ষেত্রে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া জরুরি। অর্থাৎ পয়লা নম্বরের শর্ত পূরণ হয়ে গেলে অন্যগুলোতে বেশি কড়াকড়ি না করে চলনসই পর্যায়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ বংশ-মর্যাদা সমান-সমান না হলেও কাছাকাছিতেই সন্তুষ্ট থাকা, অর্থ-সম্পদে উনিশ-বিশ বা আরও কিছু বেশি তারতম্য থাকলেও তা উপেক্ষা করা এবং রূপ-সৌন্দর্যেও আকাশ-পাতাল পার্থক্য না হলে তা অগ্রাহ্য করা বাঞ্ছনীয়। আমাদের ফকীহগণ বলেছেন, স্ত্রীর নগদ মাহ্র এবং খোরপোশ ও থাকার স্থান দেওয়ার মতো সামর্থ্য যার আছে, ধনবতী কনের পক্ষে সে অনুপযুক্ত পাত্র নয়। হাঁ যার সেই সামর্থ্যও নেই, সে রকম হতদরিদ্র ধনবতীর পক্ষে অনুপযুক্তই বটে। এমনিভাবে বনূ হাশিম ও কুরায়শের বাইরে আর যত গোত্র-বংশ আছে, তারা বনূ হাশিম ও কুরায়শের সমমানের না হলেও তারা পরস্পরে সমমানেরই গণ্য হবে।

সুতরাং শেখ, চৌধুরী, তালুকদার, মল্লিক, হাওলাদার ইত্যাদি বংশসমূহের মধ্যে কৌলীন্যগত বিশেষ পার্থক্য নেই, তাতে তারা নিজেদেরকে নিজেদের দৃষ্টিতে অন্যদের অপেক্ষা যত অভিজাতই মনে করুক না কেন। যতটুকু পার্থক্য আছে, দ্বীনদারীর শর্ত পূরণ হওয়ার পর তার জন্য বিবাহকে আটকে রাখা সমীচীন নয়। আমাদের ফকীহগণ এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এ স্থলে আমাদের বলার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকুই যে, দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দেওয়ার পর অন্যসব শর্তকে শিথিল পর্যায়েই বিবেচনা করা উচিত। একদম অগ্রাহ্য করাও নয়, যেমনটা কেউ কেউ বেহুঁশ জোশের কারণে করে থাকে। এবং মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়াও হয়। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার পরিণতিও অনেক সময় ভালো হয় না। কেননা কৌলীন্যে বেশি তফাৎ থাকলে বনিবনাও কঠিন হয়ে যায়। হযরত যায়নাব বিনতে জাহ্শ রা. ও হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা রা.-এর বিবাহ থেকে আমরা সে শিক্ষা পাই। অভিজাত কুরায়শী নারীর পক্ষে একজন আযাদকৃত গোলামের সাথে মধুর দাম্পত্য রচনা কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে বিবাহ টিকতে পারেনি। সব সমাজেই এটা একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

অনুরূপ ধনী-নির্ধনের জোড়ও অনেক সময় টেকসই হয় না। রূপ ও সৌন্দর্যও হৃদয় কাড়ে বৈকি। এর মধ্যে দুস্তর ব্যবধানও শয়তান বা প্রবৃত্তির ছলনায় মদদ যোগাতে পারে। এ কারণেই তো শরীআত বিয়ের আগে দেখে নেওয়ার হুকুম দিয়েছে। মোদ্দাকথা, ইসলাম এসব ব্যাপারকে অবজ্ঞা করেনি; বরং গুরুত্বের মাত্রা অনুযায়ী এরও মূল্যায়ন করেছে। সুতরাং পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে এসবও বিবেচনায় রাখা চাই। তবে মাত্রাজ্ঞানের সাথে। অর্থাৎ এসব নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি সংগত নয়, যদ্দরুন আসল শর্ত দ্বীনদারীটাই চাপা পড়ে যায় এবং বিবাহের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যায়।

কুরআন-হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী মানব প্রজন্ম রক্ষার সাথে সাথে চরিত্র রক্ষা ও মনের প্রশান্তিলাভও বিবাহের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। যে কোনও পক্ষে দ্বীনদারীর অভাব থাকলে এসব উদ্দেশ্যের সবটাই ঝুকিতে পড়ে যায়। মানব প্রজন্ম হতে পারে কলুষিত, চরিত্র হতে পারে কলঙ্কিত আর মনের শান্তি থেকে যেতে পারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

এ কেবল আশংকাই নয়। অকাট্য বাস্তবতা। আজকের মানবসমাজ অশান্তির আগুনে পুড়ছে। মানুষের দাম্পত্য জীবন বড় যন্ত্রণাময়। মানুষ ঘরের বাইরে সুখ খুঁজছে। যুগলসমূহ তাদের ভক্তি-বিশ্বাসের শিকল ছিন্ন করে অন্ধকার পথে ছুটছে। পিপাসা নিবারণের জন্য মরিচিকার দ্বারস্থ হচ্ছে। দেহমনের অতৃপ্তি ঘোচানোর ব্যর্থ প্রয়াস কোথায় না চোখে পড়ছে? কেন আজ এ পরিস্থিতি? যে দাম্পত্যের ব্যবস্থাই দেওয়া হয়েছে বহির্জীবনের সংগ্রাম-সংঘাতে জর্জরিত, কঠোর-কঠিন মেহনতে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহমনে শান্তির পরশ বুলানোর জন্য, মানুষের অমূল্য চরিত্রের হেফাযতের জন্য, তা কেন অশান্তির কাঁটা হয়ে

শান্তিকামী জুটিকে নিত্যদিন বিঁধছে? কারণ আর কিছুই নয়। বাছাইপর্বের ভুল। সেই ভুল-ই এ অনর্থের মূল। মানুষ দ্বীনের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পয়লা নম্বরের শর্তকে হয় উপেক্ষা, নয়ত সবশেষে নিয়ে গেছে। এসব তারই খেসারত। এ খেসারত যে দিতেই হবে সে কথাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসে পরিষ্কার। তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে (কেবল) তার ক্ষমতার কারণে আল্লাহ তাআলা তার অসহায়ত্বই বৃদ্ধি করবেন। যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে তার সম্পদের লোভে, আল্লাহ তাআলা তার দারিদ্র্যই বৃদ্ধি করবেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে তার বংশমর্যাদার কারণে আল্লাহ তাআলা তার হীনতাই বৃদ্ধি করবেন আর যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে নিজ দৃষ্টি সংযতকরণ, চরিত্রের হেফাযত ও আত্মীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রীর জন্য তাকে কল্যাণময় করবেন। (তবারানী, আলআওসাত, হাদীস : ২৩৪২)

অপর এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি চরিত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, আল্লাহ তাআলা তার সাহায্য করাকে নিজের প্রতি অবধারিত করে নিয়েছেন। (তিরমিযী, হাদীস : ১৬৫৫; নাসায়ী, হাদীস : ৩২১৮)

এসব হাদীস আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয় যে, পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারীকেই সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হওয়াটা তারই উপর নির্ভরশীল। এর অন্যথা করলে উপরে বর্ণিত অনর্থ অবশ্যম্ভাবী। বরং অনর্থ তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান সমাজে যে যৌবনোত্তীর্ণ বা প্রায়োত্তীর্ণ অবিবাহিতদের ক্রমবৃদ্ধি ঘটছে তাও ওই অন্যথাকরনেরই কুফল।

দেখা যায় অর্থ-বংশ ও রূপ নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি- খোড়াখুড়ির কারণে ছেলেমেয়ের বিয়েতে অনেক দেরিও হয়ে যায়। অর্থ আছে তো বংশ মেলে না, বংশ মেলে তো দেখতে-শুনতে সেরকম নয়। অর্থাৎ সব মেলানোর সোনার হরিণ খুঁজতে গিয়ে বছরের পর বছর পার হতে থাকে, ওদিকে ছেলেমেয়ের বয়সও বাড়তে থাকে। তো বয়স বাড়ুক, তাই বলে সামাজিক স্ট্যাটাচে তো ছাড় দেওয়া যায় না। কিন্তু সেই নাছোড় স্ট্যাটাচ তো কেবল বয়সই শেষ করে না, ঘুণের মত রূপ-লাবণ্যও তিলে তিলে নিঃশেষ করে। ফলে যেই ছাড় প্রথমেই স্বেচ্ছায় দেওয়া উচিত ছিল, শেষ পর্যন্ত নাচার তা দিতে বাধ্য হতে হয়। তাতেও সবক্ষেত্রে শেষরক্ষা হয় না। কারও কারও চিরটাকাল আইবুড়োই কাটিয়ে দিতে হয় আর অতটা দুর্গতি যার বরাতে লেখা হয়নি, তাকেও অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। সুতরাং অভিভাবককে ভাবতে হবে, সে অপেক্ষাকৃত লঘুকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কিংবা বলা যায় নিজের অপরিমিত খাহেশ পূরণের পাকচক্রে ফেলে ছেলেমেয়ের জীবনকে এভাবে বিপর্যস্ত করবে, না নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা অনুযায়ী পরিমিত চিন্তার সাথে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের বৈতরনী পার হবে এবং প্রিয় সন্তানদের মধুর দাম্পত্য রচনায় অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

প্রেম ও বিয়ে

শাইখ আলি তানতাবি রহ. লেখেন :

‘আল্লাহ মানুষকে দুটি সহজাত বাসনা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। একটি হলো, নিজেকে টিকিয়ে রাখার বাসনা। আরেকটি হলো, স্বজাতিকে টিকিয়ে রাখার বাসনা। প্রথমটির দরুন ক্ষুধার তাড়না খাবার অনুসন্ধানে বাধ্য করে, যেন তৃপ্তিভরে আহারের মাধ্যমে নিজের মৃত্যু ঠেকাতে পারে। দ্বিতীয়টির দরুন কামনার দহন তাকে নারীর সান্নিধ্যে টেনে নিয়ে যায়। যেন বংশ বিস্তারের মাধ্যমে আপন প্রজাতির নির্মূল রোধ করতে পারে।

কখনো এমন হয়—রেস্তোরায় তোমার সামনে খাবার আছে, পকেটে পয়সা-কড়ি আছে। অর্ডার করতেই খাবার হাজির তোমার সামনে। এর বিনিময়ও আছে তোমার কাছে। তোমার সাধ্যের মধ্যে যত অর্ডার করো সবই তোমার জন্য বৈধ। এর কল্পনা করতে গিয়ে মাথা খাটাও না। এর জন্য অপেক্ষা করে নিজের দেহ-মন ক্লান্তও করো না।

কখনো ক্ষুধা থাকে, খাবার থাকে না। যতই ক্ষুধার তিক্ততা ভোগ করো ততই তোমার কল্পনায় খাবারের স্বাদ বাড়তে থাকে। এভাবে দীর্ঘ সময় গেলে এ কল্পনা স্থায়ী হয়ে যায় (যেমনটি বলেন মনোবিজ্ঞানীরা)। তোমার কল্পনা তাতেই নিমজ্জিত, তোমার ঝোঁক শুধু সে দিকেই।

যখন যৌনক্ষুধা থাকে আর বিপরীতলিঙ্গ অনুপস্থিত তখন তা নিয়ে তোমার কল্পনা খাবার নিয়ে ক্ষুধার্তের কল্পনারই মতো। এ জিনিসটিকে আমরা বলি ভালোবাসা। এটা ক্ষুধার্তের খাবার নিয়ে কল্পনার চেয়েও কঠিন। ক্ষুধার্ত যখন খাবার খোঁজে, তখন খাবারের রঙ আর ধরন নিয়ে ভাবে না। যৌন ক্ষুধায় আক্রান্ত ব্যক্তির আগ্রহ কখনো নির্দিষ্ট কোনো নারীর ওপর স্থির হয়ে গেলে সারা পৃথিবী তখন সেই নারীর মাঝে সীমিত হয়ে যায়। সে তাকে দেখতে চায়, কথা বলতে চায়। সে কি নারীটিকে দেখে তৃপ্ত হবে? তোমরা কি মনে হয়, সে কথা বলে তুষ্ট হবে? সে তো ক্ষুধার্তের মতোই। ক্ষুধার্তের জন্য কি খাবার দেখলে, ঘ্রাণ নিলে, খাবার নিয়ে কবিতা আর ছন্দ গাঁথলে যথেষ্ট হয়।

হে আমার ছেলেরা, না। আল্লাহর শপথ কখনোই না। সে শুধু সৌন্দর্য চায় না। কান আন্দোলিত করা কথা চায় না। সে তার চাবির জন্য চায় তালা। এ হলো আপন প্রজাতির প্রতি সহজাত বাসনা। এ বাসনা তৃপ্ত হবে না বংশ বিস্তার ছাড়া।

অনন্যোপায় হলে প্রেম শুধু যৌন সম্পর্কের আগ্রহেরই নাম (কবিরা যতই প্রেমকে সুসজ্জিত করে, অলঙ্কৃত করে উপস্থাপন করুক)। ভদ্র ও নিষ্কাম প্রেম হলো ফালতু কথা। এর সমাদর শুধু পাগল আর যুবকদের কাছে। এটাই বাস্তবতা—কেউ অস্বীকার করলে প্রতিউত্তর সে নিজের কাছেই পেয়ে যাবে। এর বাস্তবতার প্রমাণ সব মনেই আছে। অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। এরপরও কি শুধু প্রেম বিবাহের ভিত্তি হতে পারে?

প্রেম হলো মন-সংশ্লিষ্ট ক্ষুধা, ক্ষুধার্তরা কি খাবার ভালো-মন্দের বাছ-বিচার করতে পারে? ক্ষুধা কি তার সামনে গুটি বসন্তে আক্রান্তকে সুসজ্জিত করে তোলে না? ফলে গুটি বসন্তে আক্রান্তকেই মুখে দিয়ে খাসা বকরির স্বাদ পায়। যখন ক্ষুধার তাড়না শেষ গুটি বসন্ত ফিরে আসে গুটি বসন্ত হয়ে। সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়—সে তো ছিল ক্ষুধার কল্পনায় সৃষ্ট খাসা বকরি। প্রেমিকার বিষয়টিও এমনই। প্রেমের দরুন প্রেয়সীর গায়ে সে চড়ায় ঝলমলে পোশাক। ফলে প্রেয়সীকে দেখে সবচেয়ে সুন্দর মানবীরূপে। প্রলুব্ধ করা সেই পোশাকে মেয়েটিকে বিয়ে করার পর একপর্যায়ে পোশাকটি যখন খুলে যায় তখন আর বিবাহ বন্ধন থাকে না। কারণ, সে তো মেয়েটিকে বিয়ে করেনি। বিয়ে করেছে পোশাকটিকে, তার কল্পনা যে পোশাকটি মেয়ের গায়ে পরিয়েছিল। বাস্তবে প্রেম হলো, যৌনমিলনের আকাঙ্ক্ষা। এ আকাঙ্ক্ষা শেষ হলে শেষ হয়ে যায় প্রেমও। এবং মজনুর হুঁশ ফিরে আসে, লায়লা তার চোখে অন্যান্য নারীর মতোই ধরা দেয়, তখন আর কোনো আগ্রহ থাকে না। যেমন পেট ভরে গেলে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাবারের প্রতি আগ্রহ থাকে না। এ এক সাময়িক বন্ধন, প্রথম স্পর্শেই ছিন্ন হয়ে যায়। স্পর্শ বলে কী বুঝাচ্ছি আশা করি বুঝতে পারছ! বিবাহ হলো স্থায়ী সম্পর্ক, এর জন্য প্রয়োজন স্থায়ী বন্ধনের, যা স্পর্শের চেয়ে শক্ত ও দৃঢ়, দিন দিন তা আরও সুদৃঢ় ও মজবুত হবে।

আমি সব দেশের সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি। ‘প্রেমনির্ভর বিবাহ’ বিষয়ে বড় বড় সাহিত্যিকের অসংখ্য গল্প পড়েছি। এর সবগুলোর পরিণতি হলো, বিবাদ ও বিচ্ছেদ। ওয়ার্দার, রাফায়েল, মাজদুলীন, বোল, ফারজিনী, ক্রাজিলা, জোসলান ও ভাঙ্গা ডানাদের বিরহ বেদনায় প্রতারিত হোয়ো না। এসবই পূর্বে আলোচনা করা আগ্রহের একটি পর্যায়ের চিত্র। এসবের নায়করা যদি প্রেয়সীকে শুধু প্রেমের কারণে বিয়ে করত, তাহলে গল্পের সমাপ্তি ঘটত তালাক দিয়ে।

না। বিয়ের ভিত্তি শুধু প্রেমের ওপর হতে পারে না। হ্যাঁ, হতে পারে। যদি বিশাল প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করা যায় পানির প্রবাহে লবণের ওপর।

বিবাহের ভিত্তি হলো, ভাবনা ও আচরণের মিলন এবং সামাজিক নিয়ম ও আর্থিক অবস্থার ওপর। এসবের পরে আসে আবেগ। বর কনে দেখবে, কনে বর দেখবে। অর্থাৎ মেয়ের অভিভাবক বা মাহরামের উপস্থিতিতে ছেলে শুধু মেয়ের চেহারা আর হাত দেখবে। তালগোল পাকিয়ে ফেলা শায়খ বাকুরীর ফতোয়ার মতো নয়। এরপর যদি আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে দেন তাহলে বিবাহের সঙ্গে সঙ্গে এ আকর্ষণ পরিণত হয় স্থির ও স্থায়ী ভালোবাসায়। যদি তাদের মাঝে অনাগ্রহ ও অনিচ্ছা জন্ম নেয় তাহলে একজনের কাছে আরেকজনের প্রয়োজন আর রাখবেন না।

বিয়ের উপযুক্ত বয়স

অপর প্রশ্নটির উত্তর হলো, যদি উত্তরদাতার মনে আসা প্রথম সংখ্যাটি বললেই হয় আর এ জন্য কোনো প্রমাণ কিংবা কারণ দর্শাতে না হয়, তাহলে একজন বলবে, তিরিশ। আরেকজন বলবে চল্লিশ। যদি উত্তর হতে হয় আল্লাহর প্রকৃতি ও জগতের প্রকৃতির মতো, যে প্রকৃতির ওপর আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন, যে প্রকৃতির ওপর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, তাহলে উত্তর দেওয়ার আগে অবশ্যই আমাকে একটি ভূমিকা দিতে হবে।

আমি পূর্বে বলেছি, আল্লাহ তাআলা মানুষের মনে দুটি সহজাত বাসনা সৃষ্টি করেছেন। একটি হল আত্মসুরক্ষার বাসনা, যা তাকে আহার গ্রহণে বাধ্য করে। আরেকটি হল, স্বজাতিকে টিকিয়ে রাখার বাসনা, যার মাধ্যমে বংশধারা বাকি থাকে।

আমাকে বলো মানুষ কখন আহার করে তাহলে আমি বলব মানুষ কখন বিয়ে করে।

কখন খায়? তোমরা বলবে, যখন ক্ষুধা লাগে। তাহলে বিয়েও করুক যখন বাসনা জাগ্রত হয়। অর্থাৎ যখন পৌরুষে পৌঁছে—১৮ বছর বয়সে উপনীত হয়। তোমরা বলবে, এই বয়সে বিয়ের উপকরণ সব না পেলে কী করবে?

আমি বলব, ক্ষুধার্ত খাবার না পেলে যা করে তা-ই করবে—খাবার জোগাড় করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরবে।

প্রেমিকরা বলবে, ক্ষুধার্ত যদি অপেক্ষা করতে না পারে। খাবার সামনে পেলে চুরি করে খেয়ে ফেলে, এ জন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে আমরা কী করব?

আমি বলব, সমাজের দায়িত্ব হলো সব ক্ষুধার্তের জন্য অন্নসংস্থানের উপায় সৃষ্টি করে দেওয়া। যেন চুরি না করে, অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে। আবশ্যিক কোনো বাধা যদি তাকে আহার করতে না দেয়, ফলে আশঙ্কা হয় সে চুরি করবে তখন সবার কর্তব্য হলো নিজ নিজ সম্পদ তার কাছ থেকে রক্ষা করা। এক হিসেবে সে সঠিক পথেই আছে। কারণ, সমাজ তাকে খাবার থেকে বঞ্চিত করেছে। আরেক দিক দিয়ে সে অন্যায় করছে। কারণ, সে অন্যের জিনিসে হাত দিচ্ছে।

বিবাহের ব্যাপারে আসল কথা হলো, বিবাহের সময় হলো সাবালকের মুহূর্ত। কিন্তু যুবক এ বয়সে থাকে বিদ্যালয়ে। তার কোনো ঠিকানা নেই। হাতে নেই কোনো অর্থ-কড়ি। কমপক্ষে ২৫ বছর পর্যন্ত ধারাবাহিক পড়াশোনা করতে হয়। অর্থাৎ মানুষের অভ্যস্ত হওয়া সমাজের পরিস্থিতি প্রকৃতি ও বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিরোধী। তাহলে আমরা কী করব? যুবক কী করবে? তার তো এই দশ বছর বিবাহবিহীন থাকতে হবে। অথচ এই দশটি বছরই জীবনের সবচেয়ে কঠিন কামনা ও কামনা-সংক্রান্ত অনুভূতির বছর।

আল্লাহ তাআলা যুবকের দুপাশে রেখেছেন প্রজ্জ্বলিত আগুন। বিবাহের মাধ্যমে এ আগুন নির্বাপিত না করলে ব্যথায় সে নিজিকেই জ্বালিয়ে দেবে কিংবা ব্যভিচারের মাধ্যমে অন্যের ঘর জ্বালিয়ে দেবে। এখানেই বাসা বাঁধে জটিলতা, এ নিয়েই আলোচনা জরুরি। এ বিষয় নিয়ে যে লেখে, তার জন্য সহজ হলো, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা, গভীর দীর্ঘশ্বাস নেওয়া এবং ধীরস্থিরে বলা—আমার মতামত হলো, বিবাহের উপযুক্ত বয়স তিরিশ বছর।

এটা আপনার মত হতে পারে, কিন্তু এতে জটিলতা দূর হবে না।

মুফত কথা বলা ব্যক্তি আর মৃত্যুদণ্ডের আদেশদাতা বিচারকের কষ্ট শুধু এটুকুই, মুখ খোলা আর জিহ্বা নড়ানো। কিন্তু মুসিবত তো নেমে আসে বিবাদীর মাথায়। এখানে বিবাদী হলো, যুবক … যুবতীও।

যুবকের প্রকৃতি, মনের বাসনা যদি তার মাঝে পনেরো বছর বয়সে যৌনক্ষুধা জাগিয়ে তোলে আর আমাদের সম্মানিত চিন্তাবিদরা যদি আদেশ দেন, যুবক বিয়ে করবে তিরিশ বছর বয়সে, তাহলে এ পনেরো বছর সে কী করবে? বিশেষ করে বিবাহে বাধা দেওয়া এ সমাজে, যে সমাজ তার এ বাড়-বাড়ন্ত আগুনকে আরও উস্কে দেয়। যখনই এ হতভাগা এ বাসনা ভোলার উপক্রম হয় তখন আমরা তাকে স্মরণ করিয়ে দিই—নগ্ন ছবি, অশ্লীল সিনেমা, নগ্নতা ও অবাধ মেলা-মেশার মাধ্যমে। পথ চলতে সে সুরসুরি দেওয়ার জিনিস পায়। কলেজে প্রবেশ করেও সুরসুরি দেওয়ার বস্তু পায়। সবখানে পায় যৌন সুরসুরি দেওয়ার সরঞ্জাম। আমরা পনেরো বছরের জন্য এ বোঝা তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। এ সবের পর আমরা তাকে বলি—যাও ক্লাসে যাও। পড়তে যাও! সাবধান অশ্লীল কিছু নিয়ে ভাববে না কিংবা এর কাছেও যাবে না।

আল্লাহর শপথ! পনেরো বছর জেলের সাজা পাওয়া ব্যক্তির অবস্থা এতো সব বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যুবকের চেয়ে বেশি কঠিন নয়।

করণীয় কী?

করণীয় হলো, প্রকৃতির নিয়মে ফিরে যাওয়া এবং প্রকৃতির বিধান মেনে চলা। কারণ, কোনো মানুষের পক্ষে মানুষ ও বস্তুর প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।

করণীয় হলো, পূর্বপুরুষদের প্রথায় প্রত্যাবর্তন করা। আমরা যুবকদের আঠারো বছর বয়সে বিয়ে করিয়ে দেব। মেয়েদের বিয়ে দেব ষোল বছর বয়সে। সম্ভব না হলে কমপক্ষে সন্তানদেরকে আল্লাহর ভয় ও চারিত্রিক দৃঢ়তা শিক্ষা দেব। আমাদের সমাজকে পরিচ্ছন্ন রাখব সেসব জিনিস থেকে যা যুবককে (যাকে আমরা জোরপূর্বক অবিবাহিত থাকতে বাধ্য করছি) ভুলে যাওয়া বাসনা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেসব জিনিস পাপে উৎসাহিত করে পাপের পথে পরিচালিত করে সেসব জিনিস তাদের থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখব। আর বাবারা মেয়েদের রক্ষা করবেন যেন কেউই তাদের সম্ভ্রম চুরি করতে না পারে। যেমনিভাবে চোরের হাত থেকে সম্পদ রক্ষা করে।

এ হলো উত্তর। আমার বিশ্বাস যারাই এ উত্তর পড়বে তারাই বলবে, এ উত্তরই সঠিক। কিন্তু আফসোস কেউই এর ওপর আমল করবে না।’

একটি সংশয় ও তার নিরসন

এক ভাইয়ের মুখে শুনলাম, ২৪ বছর পার হওয়ার পরে ছেলে যতো গুনাহ করে তার দায় নাকি তার বাবার কাঁধে চাপে। আল্লাহর দরবারে এই বাবা দায়ি থাকবে। হাদিসে নাকি এমন আছে। বিষয়টা আমার কাছে খটকা লাগলো। এতো বছর থাকতে ২৪ কে কেন বিশেষিত করা হবে! মনে হলো না হাদিসে এমন কিছু থাকতে পারে। বিষয়টা নিয়ে সামান্য দেখলাম। থানবি রহ.ও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন- ইমদাদুল ফাতাওয়া গ্রন্থে। বিয়ের বয়সের ব্যাপারে যা পাওয়া গেলো- তার সারকথা এই:

আদেশসূচক শব্দ ব্যবহৃত হয় বিষয়টা ওয়াজিব বোঝানোর জন্য। তো আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন-

و أنكحوا الايامى منكم.

তোমরা অবিবাহিতদেরকে বিয়ে করিয়ে দাও। সুরা নুর। এখানে কোরআনে ব্যবহৃত শব্দ হলো “আ-ইয়ামা”। এ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-

و قد اتفق أهل اللغة على أنها تطلق على امرأة لا زوج لها صغيرة كانت أو كبيرة ، بكرا كانت أو ثيبا ، قاله إبراهيم الحربي وإسماعيل القاضي وغيرهما ، و كذلك تطلق على الرجال.

সুতরাং এ আয়াতের দ্বারা বালিগ সন্তানদেরকে বিয়ে করানোর বিষয়টা অপরিহার্য হওয়া অনুমিত হয়। নাবালিগ যেহেতু মুকাল্লাফই নয়, তাছাড়া তাকে বিয়ে দেয়া হলে অপকারিতার দিকটাই ভারি- তাই এ আয়াতে অবিবাহিত দ্বারা নাবালিগ উদ্দেশ্য নয়। এটা তো স্পষ্ট বিষয়। আলোচনারই দাবি রাখে না।

আলী রা. থেকে বর্ণিত হাদিস-

عن علي رضي الله عنه ، أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ” يا علي ! ثلاث لا تؤخرها : الصلاة إذا أتت ، والجنازة إذا حضرت ، والأيم إذا وجدت لها كفؤا . رواه الترمذي

নবীজী সা. বলেন, হে আলী, তিন কাজে বিলম্ব করো না- সময় হলে নামাজ আদায়ে, লাশ উপস্থিত করা হলে জানাযা পড়াতে, অবিবাহিত মেয়ের উপযুক্ত ঘর পাওয়া গেলে বিয়ে দিতে। সুনানে তিরমিযি।

عن أبي سعيدو ابن عباس قال : : ( قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : من ولد له ولد فليحسن اسمه و أدبه فإذا بلغ فليزوجه فإن بلغ و لم يزوجه فأصاب إثماً فإنما إثمه على أبيه .).

রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, যার সন্তান জন্মলাভ করে, সে যেনো তার সুন্দর নাম রাখে, তাকে উত্তম শিষ্টাচার শেখায়, বালিগ হলে বিয়ে দিয়ে দেয়। বালিগ হওয়ার পরেও সে যদি তাকে বিয়ে না করায়, আর সেই সন্তান গুনাহ করে, তবে এ গুনাহের দায় তার বাবার কাঁধেই যাবে। শু’আবুল ইমান।

উল্লেখ্য, এখানে গুনাহ দ্বারা শুধুই ব্যভিচার উদ্দেশ্য নয়, বরং চোখের গুনাহ, কানের গুনাহ ইত্যাদিও শামিল।

وعن عمر بن الخطاب وأنس بن مالك عن رسول الله – صلى الله عليه وسلم – قال : في التوراة مكتوب : من بلغت ابنته اثنتي عشرة سنة ولم يزوجها فأصابت إثما فإثم ذلك عليه . رواه البيهقي في شعب الإيمان .

রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, তাওরাতে আছে- যার মেয়ে বারো বছরে উপনীত হয় আর সে তাকে বিয়ে না দেয়, আর এ মেয়ে কোনো গুনাহে আক্রান্ত হয়, তবে তার গুনাহ তার বাবার কাঁধে আরোপিত হবে। শু’আবুল ইমান।

উল্লেখ্য, এর দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তার কোনো গুনাহ হবে না। বরং তারও গুনাহ হবে আর দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে বাবাও কঠিন গুনাহগার সাব্যস্ত হবেন।

খোলাছা: সন্তান বালিগ হলে তাকে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করা বাবার দায়িত্ব। তিনি যদি তা না করেন তবে তিনি দায়মুক্ত হবেন না। এখানে এর জন্য চব্বিশ বছরকে নির্ধারণ করা দলিলসম্মত নয়। হাদিসের সুস্পষ্ট ভাষ্য অনুযায়ী- চব্বিশের আগের গুনাহের দায়ও বাবার কাঁধেই আপতিত হবে।

তবে থানবি রহ. বলেছেন, “কোনো সন্তান যদি নিবিড়ভাবে লেখাপড়ায় রত থাকে, তবে তাকে শিক্ষা সমাপনের পরেই বিয়ে দেয়া উচিত। অন্যথায় তার লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

تعلموا قبل أن تسودوا

জাতির নেতৃত্ব লাভের পূর্বেই ইলম শিখে নাও। কেউ কেউ এর ব্যাখ্যা করেন, নেতৃত্ব লাভ- এর মধ্যে বিয়েও অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ বিয়ে করার পূর্বে ইলম শিখে নাও। তুহফাতুল আলমায়ি গ্রন্থে আল্লামা সাইদ আহমদ পালনপুরি (হাফিজাহুল্লাহ)-ও এ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করেছেন।

বিষয়টা আপেক্ষিক বলা যায়। এখানে সবার ক্ষেত্রে এক বিধান আরোপ না করে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

পরকীয়া

পরনারীর মাঝে যা আছে, নিজ স্ত্রীর মাঝেও তো ঠিক তা-ই আছে। এরপরও কেনো পরনারীর ওপর এতো আকর্ষণ? একই কথা নিজ পুরুষ এবং পরপুরুষের ক্ষেত্রেও।

স্বামী এবং স্ত্রীর গাফিলতিই এক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। বিয়ের পূর্বে যুবক এবং যুবতী একে অন্যের প্রতি ভীষণ আকর্ষণ বোধ করে। আবরণ উন্মুক্ত করার পূর্বে এই আকর্ষণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। এজন্য তো সহবাসের ক্ষেত্রেও প্রকাশ্যে একে অন্যের সামনে পুরোপুরি উন্মোচিত হয়ে যাওয়া কাম্য নয়।

আয়িশা রা. বলেন, আমি কখনো রাসুলুল্লাহ সা. এর লজ্জাস্থান দেখিনি এবং তিনিও কখনো আমার লজ্জাস্থান দেখেন নি। প্রকাশ্যে একজন আরেকজনের সামনে উলঙ্গ হয়ে গেলে এর পরিণতিতে ধীরে ধীরে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আকর্ষণ কমে যেতে থাকে। এ যুগে এসে তো স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণের ক্ষেত্রেও নতুন সব পন্থা আবিষ্কার হয়েছে, যেগুলোকে বিকৃত যৌনচর্চা নামে নামকরণ করা যেতে পারে, আকর্ষণ লোপ পাওয়ার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

বিয়ের পূর্বে আপনার প্রতি আপনার স্বামী প্রচণ্ড আকর্ষণ অনুভব করতো, আপনাকে ছাড়া আর কারো দিকে দৃষ্টি মেলেও তাকাতো না। এখন কেনো দিনকেদিন তার অবস্থায় পরিবর্তন আসছে? কেনো সে পরনারীর প্রতি অধিক আকর্ষিত হয়ে পড়ছে?

আপনার স্বামীও একজন মানুষ। নারীরা বাইরে বের হলে সাধারণত খুব সেজেগুজে পরীর রূপ ধারণ করে বের হয়। পক্ষান্তরে ঘরে থাকলে সাজগোজ খুব কমই করে। কখনো তো অশুচি অবস্থায়ও থাকে। আপনার স্বামীর মানসপটে যখন আপনার ছবি ভেসে ওঠে, তখন আপনি যে অবস্থাগুলোতে থাকেন, সেই চিত্রগুলোও ভেসে ওঠে। বিয়ের পর স্বামীর সামনে আপনি তো আর পরীর বেশে আবির্ভূত হন না। লোকাল নারীর মতো হয়ে যায় আপনার ঘরের ভেতরকার চিত্র। তাই যখন স্বামীর সামনে পরীর বেশে কেউ আবির্ভূত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। স্বামী যদি মুত্তাকি হয়, তাহলে তাকওয়ার কারণে হয়তো সে গুনাহ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু তার মানসপটে এগুলো তো ক্রমান্বয়ে রেখাপাত করতেই থাকে। একপর্যায়ে যা আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভার মতো বিস্ফোরণ ঘটে।

স্বামীর সাথে আপনি প্রেম করেন না, মিষ্টি আলাপচারিতা ও রোমান্টিক কথাবার্তা বলেন না, অন্যরা কিন্তু সৌজন্য হিসেবে হলেও এই কাজটি খুব গুরুত্বের সঙ্গেই করে। এ বিষয়গুলোও কিন্তু স্বামী বেচারার মনে ঝড় তোলে। এরপর আপনি যখন অন্য পুরুষের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলেন, হোক তা সরাসরি কিংবা মেসেজে, তখন এ বিষয়টিও ক্রমশ স্বামীকে আপনার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।

স্বামী হিসেবে আপনি আপনার স্ত্রীকে যেভাবে পেতে চান, স্ত্রী হিসেবে সেও কিন্তু আপনাকে একইভাবে পেতে চায়। ঘরের কর্তা হিসেবে আপনি হয়তো তার ত্রুটিগুলো বলে ফেলেন, কিন্তু সে কিন্তু লজ্জার কারণে আপনার ত্রুটিগুলো আপনার সামনে তুলে ধরে না। পুরুষরা বাইরে খুব ফিটফাট থাকলেও ঘরে গেলে অনেকটা বন মানুষের রূপ ধারণ করে। অনেক সময়ই উদোম গায়ে বসে থাকে, এছাড়াও আরো বিভিন্ন সাধারণ (অসুন্দর) হালতে থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে আপনি তা করতেই পারেন। কিন্তু এ বিষয়গুলোও কিন্তু আপনার স্ত্রীর অন্তরে রেখাপাত করে।

আপনার মধ্যে বিয়ের পর আর কোনো রোমান্টিকতা নেই, আপনার বাহ্যিক হালত আকর্ষণীয় ও কামনাময় থাকে না—এই বিষয়গুলোই কিন্তু আপনার স্ত্রীকে ক্রমশ পরকীয়ার দিকে ঠেলে দেয়। মানুষের মন কাঁচের মতো। তাছাড়া মনের ওপর মানুষ চাইলেও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। এটা সৃষ্টিগত দুর্বলতা। এই প্রোজ্জ্বল বাস্তবতা ভুলে যাওয়ার পরিণতি সুখকর নয়। এসব কারণেই সংসার ভাঙার ঘটনা এখন এতো ব্যাপক। পরকীয়ায় ভাসছে গোটা দেশ।

মনে রাখবেন, আপনার মধ্য থেকে ‘সচেতন প্রেমিক সত্তা’র মৃত্যু ঘটলেই আপনার জীবনসঙ্গী অন্য কোনো ‘সচেতন প্রেমিক সত্তা’র প্রতি ঝুঁকে পড়বে; যে তাকে বুঝবে, যে তাকে ভালোবাসবে, যে প্রতিমুহূর্তে তাকে ফিল করবে। একই কথা স্ত্রীদের ক্ষেত্রেও।

আমরা যেমনিভাবে আমাদের বাইরের জীবনাচারকে সুশোভিত করে উপস্থাপন করি, পারিবারিক জীবনেও আমাদের প্রয়োজন একইভাবে নিজেকে সুশোভিত রাখা এবং সচেতন প্রেমিক সত্তার নিভু নিভু জীবনকে শক্ত হাতে ধরে রাখার প্রচেষ্টা করা। একজনের কাছে অপরজনের প্রয়োজন কিংবা আকর্ষণ কখনো যেনো না ফুরোয়, আর কখনো যেনো তাতে ভাটা না পড়ে। আমাদের অসতর্কতাগুলোই আমাদের সংসারের সুখহীনতার মূল কারণ। আমাদের সকল ভালোবাসা হৃদয়ের মধ্যে তালাবদ্ধ করে রাখলে চলবে না। মানুষ গায়েব জানে না। তাই হৃদয়ের জানালা খুলে রাখতে হবে। ভেতরে সুপ্ত ভালোবাসাকে অপরজনের সামনে প্রকাশ করতে হবে। বৈবাহিক জীবনে যেহেতু সার্বক্ষণিক সহাবস্থান হয়ে থাকে, তাই সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমে একটু ঝক্কি মনে হলেও এটাকে অভ্যাসে পরিণত করে নিলে মোটেও কঠিন হবে না।

আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার প্রদানের ব্যাপারে সচেষ্ট হই। নববি যিন্দেগি থেকে ভালোবাসা বিনিময়ের দীক্ষা অর্জন করি। বিকৃত যৌনচর্চা পরিহার করে সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ি। আমি অন্যের থেকে যেমনটা প্রত্যাশা করি, প্রথমে আমি নিজেকে তার সামনে সেভাবে উপস্থাপন করি। আল্লাহ সহায় হন।

ছেলেদের বিয়ের বয়স

শাইখ আলি তানতাবি রহ. লেখেন :

‘ছেলেদের বিয়ের বয়সের ব্যাপারে যদি কোন ধরণের চিন্তা-ভাবনা ছাড়া চোখ বন্ধ করে উত্তর দিতে বলা হয়, তাহলে সাধারণত আমাদের উত্তর হবে- ৩০ বছর বয়স। অর্থাৎ ৩০ হলো ছেলেদের বিয়ের উপযুক্ত বয়স।

কিন্তু যদি বলা হয় যে, উত্তরটা দিতে হবে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে যে ফিতরত দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহ তাআলা পৃথিবী নামের এ গ্রহটির প্রকৃতিতে যে মূলনীতি রেখে দিয়েছেন, উত্তরটা দিতে হবে সেই ফিতরত ও মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, তাহলে এর ভূমিকাস্বরূপ কিছু কথা আমাকে বলতেই হবে।

আগেই বলেছি আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে দু’টি মৌলিক চাহিদা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এ চাহিদা দু’টি পূরণ করতে সে সৃষ্টিগতভাবে বাধ্য। এগুলোর মাধ্যমে সে পর্যায়ক্রমে তার অস্তিত্ব ও বংশের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখবে পৃথিবীর বুকে।

এ দু’টি চাহিদাই মানুষের মৌলিক ও অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি যদি বলি যে, এ দু’টি বিষয়ে যাবতীয় আলোচনা ও পর্যালোচনার পদ্ধতি ও পন্থাও অনেকটা একই রকম, তাহলে মনে হয়না আমার সাথ কেউ দ্বিমত পোষণ করবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে কখন? স্বভাবতই উত্তর আসবে- যখন তার ক্ষুধা অনুভূত হয়। সুতরাং একইভাবে ছেলেদের বিয়ের ব্যাপারটাও এমনই হওয়া উচিত। অর্থাৎ যখন সে শারিরীক চাহিদা অনুভবের স্তরে উপনিত হবে, তখনই তার বিয়ে করা উচিত। অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সে। আর এটাই প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এখন যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা সামনে আসবে সেটা হলো, এ সময় যদি ছেলেটির বিয়ের আসবাব বা অর্থনৈতিক প্রস্তুতি না থাকে, তখন সে কী করবে?

উত্তর ঐ একই পদ্ধতিতে দেয়া যায়। অর্থাৎ একজন ক্ষুধার্ত মানুষ যদি খাবার না পায়, তাহলে সে ধৈর্য ধারণ করবে। খাবারের কোন একটা হালাল ব্যবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখবে। তেমনিভাবে ঐ যুবকও বিয়ের সামর্থ লাভ করার আগ পর্যন্ত সংযমী হবে। সবর করবে।

কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষটি যদি ধৈর্য রাখতে না পারে? যদি সে খাবারের জন্য কোন ক্ষতিকর এবং অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে বসে? যদি এ জন্য কোন অপরাধ করে ফেলে? তখন আমাদের কি করা!

আমি এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজব্যবস্থার দিকে আঙ্গুল তাক করবো। সমাজের দায়িত্ব হলো একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাবারের ব্যবস্থা করা, যেন সে ক্ষুধার তাড়নায় কোন অপরাধ সংঘটিত করতে বাধ্য না হয়। সমাজ যদি তার খাদ্যের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই সমাজের মানুষ যেন তার ব্যাপারে সাবধান থাকে। মানুষ যেন তাদের সম্পদ সামলে রাখে এই ক্ষুধার্ত মানুষ থেকে। একদিক থেকে সে অধিকারহারা, কারণ এই সমাজ তাকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয়নি। অপরদিকে সে অপরাধী, কারণ সে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদের দিকে হাত বাড়িয়েছে।

আর একইভাবে ছেলেদের বিয়ের ব্যাপারটিকেও ব্যাখ্যা করা যায়।

বিয়ের স্বাভাবিক ও প্রকৃত সময় হলো প্রাপ্তঃবয়ষ্ক হবার পরপর। কিন্তু এখনকার ছেলেদের জন্য এ সময়টা হলো —ছাত্রজীবন’। এ সময় তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে কিছুই থাকে না এবং উপার্জনেরও কোন রাস্তা থাকে না। তাদের এই ছাত্রজীবনটা হয়ে থাকে কমপক্ষে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত। তো দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমানে আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, সেটা পুরোপুরি প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং মানুষের স্বাভাবিক চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই যদি হয় আমাদের সমাজব্যবস্থা, তাহলে এর সমাধান কী? একটি প্রাপ্তঃবয়স্ক সুস্থ-সবল যুবক এই আট/দশ বছর বিয়ে-শাদী ছাড়া কীভাবে কাটাবে? অথচ এই সময়টাই হলো ছেলেদের শারিরীক চাহিদার সবচে’ বিপদজনক ও স্পর্শকাতর সময়।১

আল্লাহ তাআলা তার মাঝে একটি স্বাভাবিক চাহিদা রেখে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অবহেলার কারণে সেটা জ্বলন্ত এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। এ আগুনে হয়ত সে নিজেই জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যায় কিংবা ব্যাভিচারের করে মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আর এটাই সবচে’ আশঙ্কা ও ভয়াবহ ব্যাপার। যত আলোচনা-পর্যালোচনা এবং গবেষণা রয়েছে, সব একেই কেন্দ্র করে হওয়া উচিত। ইজি চেয়ারে বসে ধূমায়িত কফির কাপে একটা চুমুক দিলাম, সিগেরেটে লম্বা একটা টান দিলাম, তারপর খুব একটা ভাব নিয়ে বললাম, ছেলেদের বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স আসলে ৩০। কিন্তু এই ভাবের বক্তব্য দ্বারা তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এ ধরণের বক্তব্য তো বিনামূল্যেই দেয়া যায়। যে বিচারক ফাঁসির আদেশ দেন, তিনি তো স্রেফ তার মুখটা খুলে জিহ্বটা একটু নাড়েন; ব্যাস, হয়ে গেল ফাঁসির রায়। আসল বিপদটা তো আসে বিচারাধিন ব্যক্তিটির উপর। আর আমাদের আলোচনায় বিচারাধিন ব্যাক্তিটি হলো যুবক, এবং যুবতীও।

অনেক সময় এমনও হয় যে, শারিরীক গঠন ভাল হলে এবং দ্রুত বৃদ্ধি পেলে অনেক ছেলেরা ১৫ বছর বয়সেই প্রাপ্তঃবয়ষ্ক হয়ে যায়। তখন শারিরীক চাহিদাও সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবিরা যদি এই দণ্ডাদেশ জারি করেন যে, ত্রিশের আগে ছেলেরা যেন বিয়ে না করে, তাহলে ঐ উঠতি বয়সী যুবক ছেলেটা বাকি ১৫টা বছর কীভাবে কাটাবে?

অথচ যে সমাজ তাকে এই সভ্যতা(!) শেখায়, যে সমাজ তাকে প্রকৃত সময়ে বিয়ে করতে বাধা দেয়, সে সমাজই তার সামনে অশ্লীলতা ও অবৈধ সম্পর্কের এমন শৈল্পিক পসরা সাজিয়ে রাখে, যা প্রতিনিয়ত তার কামনার আগুনকে আরও উসকে দিতে থাকে। সে বেচারা হয়ত নিজেকে সংযমী করার জন্য এসব থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু এই সমাজ তাকে কখনই এটা ভুলে থাকতে দেয় না। অশ্লীল মুভি, ড্রামাসিরিজ, পোস্টার, উপন্যাস, মুক্তমনা আর সভ্যতার নামে মেয়েদের খোলামেলা কাপড়ে চলাফেরা। রাস্তায়, বাসে, কলেজে, ভার্সিটিতে যেখানেই সে যায়, চারপাশে থাকে কামনাকে উসকে দেয়ার উপকরণ। আর আমরা ১০/১৫ বছরের জন্য তার উপর এই বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বলি, এখন তোমার পড়ালেখার সময়। এসব অশ্লীল চিন্তাভাবনা এখন তোমার জন্য নয়। ভুলেও এগুলো নিয়ে ভাববে না, ধারে কাছেও যাবে না কখনও।

আল্লাহর কসম করে বলছি, সভ্যতার মোড়কে ১৫ বছরের যে শাস্তি আমরা তাকে দিচ্ছি, তারচে’ ১৫ বছরের স্বশ্রম কারাদণ্ড তার জন্য অনেক ভাল।

তো এখন সমাধান কী?

সমাধান হলো প্রকৃতির মাঝে, প্রকৃতির কাছে ফিরে আসার মাঝে। যে প্রকৃতি দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে প্রকৃতিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার মাঝেই সমাধান। সৃষ্টিকর্তা এই গ্রহের প্রকৃতিকে যে মৌলিক নীতিতে পরিচালনা করেন, যে ফিতরত দিয়ে তিনি মানসজাতিকে সৃষ্টি করেছেন, সেই প্রকৃতি ও ফিতরতের বিরুদ্ধাচরণ করে মানবজাতি কখনই শান্তির জীবন পেতে পারে না।

আমাদের পূর্বপুরুষরা যেভাবে তাদের ছেলেদের ১৮ বছর বয়সে এবং মেয়েদের ১৬ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিতেন, সেটাই ছিল প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের জীবন ছিল স্বচ্ছ পানির শান্ত দিঘির মত নির্মল সুখের। কিন্তু আমাদের দ্বারা যদি এটা সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা অন্তত আমাদের সন্তানদের চারিত্র-গঠনের ব্যাপারে যেন আরও সাবধানী ও সচেতন হই। উন্নত ও চরিত্র ও সভ্যতার সঠিক অর্থ যেন আমরা তাদেরকে শিক্ষা দিই। ছোট থেকেই যেন আমরা তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার ভয় ও ভালাবাসার বীজ বপন করি, যেন বয়সের সাথে সাথে তা একটি মযবুত ও ছায়াদার মহীরুহে পরিণত হয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই যেন তারা এর শীতল ছায়ার পরশ লাভ করে তাদের অন্তরে।

আমরা আমাদের সমাজের রাস্তার আবর্জনা যেমন করে পরিষ্কার করি, তেমনিভাবে চরিত্রকে নোংড়া করে, এমন সকল আবর্জনা থেকেও যেন আমরা আমাদের সমাজকে পবিত্র রাখি। সবচে’ দামী সম্পদটিকে আমরা যেভাবে হেফাজত করি, তারচেয়ে আরও বহুগুণ বেশি সতর্কতার সাথে যেন আমরা আমাদের নারীদের হেফাজতের কথা চিন্তা করি।

ছেলেদের বিয়ের বয়স-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আমার এইটুকুই বলার ছিল। আমি জানি যে, সবাই আমার সাথে একমত হবে, বলবে, শায়খ তো ঠিকই বলেছেন।

কিন্তু আমি এও জানি যে, কেউই আমার কথাগুলো তাদের জীবনে বাস্তবে রূপান্তরিত করবে না। আমার সাথে একমত হওয়া পর্যন্তই শেষ।’

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রা. জিজ্ঞেস করছেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, কোন মানুষটি আপনার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয়?’ (কাকে আপনি সবচে বেশি ভালোবাসেন?) রাসুলুল্লাহ সা. জবাব দিলেন, ‘আয়িশা’। (অর্থাৎ, প্রিয়তমা আয়িশাকে আমি সবচে বেশি ভালোবাসি।) {সহিহ বুখারি : ৩৬৬২, ৪৩৫৮; সহিহ মুসলিম : ২৩৮৪}

১. একজন মানুষ তার জীবনে অনেককেই ভালোবাসে। ভালোবাসে সে নিজ সত্তাকে, ভালোবাসে আল্লাহ এবং তার রাসুলকে, ভালোবাসে নিজ বাবা-মা’কে, ভালোবাসে শ্বশুর-শাশুড়িকে, ভালোবাসে সন্তান-সন্ততিকে; বন্ধুদের জন্যও অন্তর থাকে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। সবগুলো ভালোবাসার ধরন এক নয়। এ কারণে এ সকল ভালোবাসার মাঝে তুলনা চলে না। মা যদি সন্তানকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই আমাকে বেশি ভালোবাসিস, না তোর স্ত্রীকে?’ তাহলে এ প্রশ্নটি হবে অবান্তর। কারণ, উভয় ভালোবাসার স্বরূপ এক নয়। হাঁ, এখানে ভালোবাসা শব্দের দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয়, ‘দুজনার হক রক্ষার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তুই কাকে প্রাধান্য দিবি তাহলে ভিন্ন কথা।’

এ কারণে আরবি ভাষায় ভালোবাসা বোঝানোর জন্য অনেকগুলো শব্দও রয়েছে; যেগুলো পারস্পরিক ভিন্নতার প্রতি ইঙ্গিত করে। ইবরাহিম আ. ছিলেন আল্লাহর খলিল; আমাদের রাসুল সা. ছিলেন আল্লাহর হাবিব। বাংলায় উভয়টির অর্থই করা হয় : ‘প্রিয়’, ‘সুহৃদ’, ‘বন্ধু’। ইশক, উলফত, মহব্বত, মাওয়াদ্দাত থেকে শুরু করে আছে আরও অনেক শব্দ। আশিকে রাসুল নামটি অধিক প্রচলিত হলেও শব্দটি কেমন যেন আপত্তিকরই বোধ হয়। কারণ, ইশক’র মধ্যে একধরনের কামনা-বাসনা রয়েছে। এটা স্ত্রীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলে পুরোপুরি পারফেক্ট। কিন্তু আল্লাহর রাসুলের প্রতি আমাদের অন্তরে থাকবে মহব্বত; কামনা-বাসনার প্রেম নয়। আরববিশ্বে এ নামের কাউকে পাওয়া যাবে বলে বোধ হয় না।

যেহেতু ভালোবাসাগুলোর ধরনে ভিন্নতা রয়েছে তাই তো রাসুলের উপরিউক্ত কথার ওপর এই আপত্তি করা যাবে না যে, ‘তবে কি বাবা-মা’র প্রতি রাসুল সা.’র ভালোবাসা কম ছিল?’ যেহেতু ভালোবাসার ধরনগুলো ভিন্ন, তাই এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক তুলনা চলে না। হাঁ, এরপরও বিশেষ কোনো বিবেচনায় কারও নাম সবিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়; তার স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা এবং সবিশেষ মর্যাদা বোঝানোর জন্য। আমাকেও যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কাকে সবচে বেশি ভালোবাসো?’ আমিও নির্দ্বিধ রাসুলুল্লাহ সা.’র মতো নিজের স্ত্রীর নামই উল্লেখ করব। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, ‘আল্লাহ এবং তার রাসুলের ভালোবাসার ওপর আমি এ ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিচ্ছি’ কিংবা ‘বাবা-মা’র ওপর স্ত্রীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি’। কারণ, বিষয়গুলো সম্পূর্ণ আপেক্ষিক।

২. স্ত্রীর প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্বভাবজাত। আল্লাহ তাআলাই এ ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এ ভালোবাসার মাঝে সাওয়াব রেখেছেন। এ ভালোবাসার প্রতি কেউ যদি অনীহা প্রকাশ করে এর থেকে বিমুখ হয়, তাহলে সে এক হতভাগা হিসেবেই বিবেচিত হয়। স্ত্রীর প্রতি অন্তরে লালিত ভালোবাসার কথা প্রকাশ করাও কোনো নিন্দনীয় বিষয় নয়; বরং তা-ই তো গৌরবের বিষয়।

বর্তমানে তো জাহেলি সমাজের অবস্থা এমন, মুরুব্বিদের সামনে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ কোনো আচরণ প্রকাশ করলে (যেমন : সোহাগভরে ডাকা, বা কোনো কিছু মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া) অনেকেই একে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। কখনো-বা কটু কোনো মন্তব্যও করে বসে; সামনে না হলেও পেছনে। অথচ একই আচরণ যদি কোনো গাইরে মাহরাম নারীর সঙ্গে করা হয় (যেমন : প্রকাশ্যে শালী বা ভাবীর সঙ্গে দুষ্টুমিপূর্ণ আচরণ) তাহলে একে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং এর দ্বারা সকলে বুঝে নেয় যে, ছেলে মা-শা-আল্লাহ (!) সামাজিক।

৩. স্বামী-স্ত্রীর গোপন বিষয় বাইরে প্রকাশ করা কোনো অবস্থায়ই অনুমোদিত নয়; হোক তা বন্ধুদের মজলিসে কিংবা অন্য কারও কাছে। কিন্তু অন্তরে লালিত প্রাকৃতিক ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে দোষের কিছু নেই। বরং যদি এ সম্ভাবনা থাকে যে, এর দ্বারা শ্রোতা অনুপ্রাণিত হবে তাহলে এটা বরং উত্তম বিষয়। হাঁ, পরের সামনে বিশদভাবে নিজ স্ত্রীর রূপের বর্ণনা দেওয়া সংগত নয়। কারণ, তা ফিতনার দরজা খুলে দেয়। আর মানুষ তার রূপের দ্বারা বিবেচ্য নয়; বরং বিবেচ্য তার গুণের দ্বারা। তাই গুণের আলোচনাই প্রণিধানযোগ্য; যেন তা অন্যদের উৎসাহ-উদ্দীপনা, উদ্যম-অনুপ্রেরণা জাগাতে সহায়ক হয় এবং হয় অসংখ্য অপরিচিতা নারীর জন্য পথনির্দেশিকা।

৪. স্ত্রীর নাম পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়। অনেক দীনদার নারীও নামের ব্যাপারটিতে অধিক বাড়াবাড়ি করে থাকে। হাঁ, কেউ যদি লজ্জাশীলতার কারণে তা করে থাকে তাহলে তা নিন্দনীয় নয়। কিন্তু কাউকে তো দেখা যায়, একান্ত প্রয়োজনীয় স্থানেও নিজের/নিজ স্ত্রীর নাম প্রকাশ করার ব্যাপারে সীমাহীন কঠোরতার পরিচয় দিয়ে থাকে।

অথচ রাসুলুল্লাহ সা.’র পবিত্র স্ত্রীগণের নাম সাহাবিদের অজানা ছিল না। উপরিউক্ত হাদিসে রাসুল সা. নিজেই তো প্রিয়তমার নাম মুখে উচ্চারণ করছেন। যদি এই নাম গোপন করাই উত্তম হতো তাহলে নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সা. এভাবে না বলে অন্য কোনোভাবে বলতেন।

কারণ, আল্লাহ তাআলা তো তাকে পাঠিয়েছেনই উম্মাহকে হাতে-কলমে সব শিখিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমাদের মুহতারাম উস্তাদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (কুমিল্লার হুজুর) হাফিজাহুল্লাহ’র সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা প্রথম দিকে মাদরাসার ফরমে নিজের মা’র নামের জায়গায় উম্মে শব্দ যোগ করে লিখতাম; যেমন : ‘উম্মে উসামা’। এতে হুজুর খুব রাগ করতেন। তিনি বলতেন, এটা কি তোমার মা’র নাম? এই নামে সমাজে-এলাকায় তাকে কি অন্যরা চেনে? তাহলে কেন তুমি এটা লিখছ? এর দ্বারা কী উপকার হচ্ছে? তাহলে এরচে তো এই জায়গাটা খালি রাখাই ভালো ছিল। কারণ, তোমার মা যে ‘উম্মে উসামা’ হবে এটা তুমি না লিখলেও তো মক্তবের বাচ্চাও বুঝবে। তাই অযথা এর কী প্রয়োজন? এ জন্য হয়তো এই ঘর খালি রাখবে, নতুবা আসল নামই লিখবে। কারণ, এই গোপনীয়তার মাঝে কোনো বুজুর্গি নেই। আর এটা পর্দার অন্তর্ভুক্ত কোনো বিষয়ও নয়।

পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করার জন্য বাবা-মা’র অবাধ্য হওয়া

বাবা-মা’র আনুগত্য ফরজসমূহের মধ্য থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ। এমনকি হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে— “রবের সন্তুষ্টি বাবার সন্তুষ্টির মাঝে এবং রবের অসন্তুষ্টি বাবার অসন্তুষ্টির মাঝে।” {জামিউত তিরমিযি: ১৮২১} তাবারানিতে হাদিসটি এভাবে এসেছে— “রবের সন্তুষ্টি বাবা-মা’র সন্তুষ্টির মাঝে এবং রবের অসন্তুষ্টি বাবা-মা’র অসন্তুষ্টির মাঝে।”

উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে স্থিরীকৃত সিদ্ধান্ত হলো— বাবা-মা’র আনুগত্য করা ফরজ। পক্ষান্তরে নির্দিষ্ট কোনো পাত্রীকে বিয়ে করা ফরজ নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই উভয়টির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাবা-মা’র আনুগত্যের দিকটি প্রণিধানযোগ্য হবে এবং প্রাধ্যন্য পাবে।

ইবনু মুফলিহ রহ. ‘আলআদাবুশ শারইয়্যাহ’ গ্রন্থে বলেন— “ইমাম তাকিয়্যুদ্দিন রহ. এর বক্তব্যের সারমর্ম হলো, যখন সে নিজের ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ না করবে, তখন সে বিয়ে পরিহারের ব্যাপারে মা’র আনুগত্য করবে।” অর্থাৎ এখানে তিনি গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে মা’র নির্দেশে বিয়ে পরিহারের ব্যাপারে বিধান বর্ণনা করছেন।

আল্লামা আলাওয়ি শানকিতি রহ. তার ‘আননাওয়াযিল’ গ্রন্থে বলেন— “সন্তানের জন্য অপরিহার্য হলো বাবার আনুগত্য করা, যদি বাবা তাকে সেই পাত্রীকে বিয়ে করতে নিষেধ করে, সে যার পাণিপ্রার্থী হয়েছে। হাঁ, তবে যদি সে প্রতিপালকের অবাধ্যতার আশঙ্কা করে, তাহলে প্রতিপালকের আনুগত্যই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হবে।”

‘জামিউত তিরমিযি’ গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন— “আমার স্ত্রী হিসেবে এক নারী ছিলো, যাকে আমি ভালোবাসতাম, আর আমার বাবা তাকে অপছন্দ করতেন। একপর্যায়ে আমার বাবা আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, আমি যেনো তাকে তালাক দিয়ে দিই। অনন্তর আমি তার নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমি রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করলে তিনি আমাকে বললেন, ‘হে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার, তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও।’

হাঁ, বাবা-মা’র জন্য কোনো যৌক্তিক কারণ —শরিয়াহর দৃষ্টিতে যা বিবেচ্য হতে পারে— ছাড়া অযথাই সন্তানকে এরূপ নির্দেশ প্রদান করা সঙ্গত নয়। এরপরও যদি তারা এমনটা করেন, তাহলে এর দায়ও তারা সম্পূর্ণ এড়াতে পারবেন না। (শায়খ ইবনু উসাইমিন রহ. এ ব্যাপারে কঠোর কথা বলেছেন। দেখুন— ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ: ৪/১৯৩-১৯৪)

তবে সর্বাবস্থায় সন্তানের জন্য অপরিহার্য হলো, বাবা-মা’র আনুগত্য করা, তাদের অন্তরে কোনোধরনের কষ্ট না দেয়া। এজন্য পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে যদি কোনোভাবে তাদেরকে রাজি করানো যায়, তা হলে তা-ই করা উচিত। আর বাবা-মা’রা সন্তানের ভালোই চান। এজন্য পাত্রী যদি বাস্তবেই দ্বীনদার এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে, তাহলে অযথাই তারা অমত করার কথা নয়। হাঁ, পাত্রীর মধ্যে যদি দ্বীনদারি বা চরিত্রের কোনো সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে তো তাকে বিয়ে করা শরিয়াহর নির্দেশিত পন্থাই নয়। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন— “তুমি দ্বীনদার নারীকে বিয়ে করে সফলকাম হয়ে যাও। তোমার দু’হাত মাটিমাখা হোক।” (অর্থাৎ বোকামি না করে বুদ্ধির পরিচয় দাও।)

পাত্রীর মধ্যে দ্বীনদারি পাওয়া গেলে পাত্রীকে বিয়ে করার পরামর্শ খোদ শরিয়াহই দিয়েছে। পাত্রের ব্যাপারেও একই কথা এসেছে— “যখন তোমাদের কাছে এমন পাত্র বিয়ের প্রস্তাব দেয়, যার দ্বীনদারি এবং চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট, তখন তার কাছে বিয়ে দিয়ে দাও। যদি তোমরা তা না করো, তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা এবং ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা হবে।”

যদি সবদিক ঠিক থাকার পরও বাবা-মা পছন্দের পাত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে অসম্মতি প্রকাশ করে থাকেন, আর তাদেরকে সম্মত করার সকল প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, অপরদিকে ছেলে-মেয়ে গুনাহে লিপ্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা (স্রেফ ধারণা-ওয়াসওয়াসা নয়) বোধ করে, তাহলে সেক্ষেত্রে বাবা-মা’র সম্মতি ছাড়াই তারা পারস্পরিক বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। কারণ, “স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোনো আনুগত্য চলে না।”

আর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য বাবা-মা’র অনুমতি কোনো শর্তই নয়। এটা নৈতিকতার মধ্যে পড়লেও এর সাথে বিয়ে জায়িয-নাজায়িয হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। মেয়েদের ব্যাপারে অন্য মাযহাবে দ্বিমত থাকলেও হানাফি মাযহাবের স্বীকৃত মত হলো, তারা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সাক্ষীর উপস্থিতিতে ইজাব-কবুল করে নিলেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাবে। কাজির কাছে যাওয়া, কাবিননামা পূরণ করা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। এর সাথে বিয়ের কোনোই সম্পর্ক নেই। আর খুতবা পড়া, ওলিমার আয়োজন করা, সকলের সামনে ঘোষণা দেয়া ইত্যাদি বিষয় সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত; একান্ত অপরিহার্য কিছু নয়। এক্ষেত্রে একমাত্র অপরিহার্য বিষয় হলো ছেলে-মেয়ের পারস্পরিক সম্মতি এবং দু’জন সাক্ষীর সামনে প্রস্তাব (ইজাব) ও গ্রহণ (কবুল)।

আল্লামা আলাওয়ি শানকিতি রহ. এর কথায়ও এ বিষয়টি বিবৃত হয়েছে— “হাঁ, তবে যদি সে প্রতিপালকের অবাধ্যতার আশঙ্কা করে, তাহলে প্রতিপালকের আনুগত্যই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হবে।” কারণ, বাবা-মা’র আনুগত্য এজন্যই অপরিহার্য যে, মহান রব তার নির্দেশ দিয়েছেন। তো যেক্ষেত্রে বাবা-মা’র আনুগত্য রক্ষা করতে গেলে রবের অবাধ্যতার আশঙ্কা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে রবের আনুগত্যই প্রাধান্য পাবে। উল্লেখ্য যে, বাবা-মা’র জন্য সর্বাবস্থায় কর্তব্য হলো, সন্তানের দ্বীন পালনে সহযোগী হওয়া; তার দ্বীনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানো তাদের জন্য কোনো অবস্থায়ই সমীচীন নয়।

ইবনুস সালাহ রহ. তার ‘আলফাতাওয়া’য় বলেন— “নিষিদ্ধ অবাধ্যতা হলো প্রত্যেক এমন কাজ, যার দ্বারা বাবা-মা এমন কষ্ট পায়, যা সাধারণ নয়, এ অবস্থায় যে, সেই কাজটি ওয়াজিব কাজসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়। কখনো বিষয়টিকে এভাবে বলা হয় যে, বাবা-মা’র আনুগত্য ওয়াজিব প্রত্যেক এমন বিষয়ে, যা গুনাহ নয়। আর এসকল ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধাচারণ করাটাই অবাধ্যতা।” উল্লেখ্য, গুনাহ থেকে বাঁচা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই যদি বাবা-মা’র মন রক্ষার্থে গুনাহে লিপ্ত হতে হয়, তাহলে এক্ষেত্রে তাদের মন রক্ষা করার অনুমতি শরিয়াহ দেয় নি। বাবা-মা’র থেকে শরিয়াহ বড়। তাদের মন রক্ষার্থে যদি কেউ গুনাহে লিপ্ত হয়, তাহলে সেদিন তারা তার কোনোই উপকারে আসবে না, যেদিন মহান আল্লাহ ছাড়া আর কোনো বিচারক থাকবে না।

কেউ যদি একান্ত বাবা-মা’র অনুমতি না নিয়েই বিয়ে করে ফেলে, তাহলে তার এই বিয়ে ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে নাজায়িয বা ফাসিদ হবে না। হাঁ, জীবনের এ ধরনের বড় একটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের দুয়া নেয়া, তাদের নির্দেশ পালন করা যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং তা সুখ ও বরকত লাভেরও অনন্য মাধ্যম— তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে অনুমতি নিতে গিয়ে যদি তাদের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখিন হয়, তাহলে তখন তাদের নিষেধাজ্ঞা মান্য করে সেই বিয়ে থেকে বিরত থাকা জরুরি হবে। হাঁ, একান্ত যদি পরস্পরে গুনাহে লিপ্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আকাঙ্ক্ষিত পাত্রীকে বিয়ে করা বৈধ, বরং কর্তব্য হবে। তবে এটা বিশেষ সুরতের মাসআলা, স্বাভাবিক অবস্থার ওপর প্রয়োগযোগ্য নয়।

কেউ যদি স্বাভাবিক হালতেই বাবা-মা’র নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এই কর্ম সম্পাদন করে, তাহলে এজন্য সে অপরাধী থেকে যাবে। তার উচিত হবে, যেকোনোভাবে বাবা-মা’র মন সন্তুষ্ট করা এবং দুনিয়াতেই তাদের সাথে সকল সমস্যা মিটিয়ে নেয়া। অন্যথায় তারা যদি এই কষ্ট বুকে চেপেই কবরের পথ ধরেন, তাহলে তা অবাধ্য সন্তানের জীবনে বয়ে আনবে দুর্ভাগ্য এবং চরম অশান্তি।

মেয়েদের জন্য অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে

ইমাম আবু হানিফা, ইমাম সুফয়ান সাওরি, ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (তার শেষ ফায়সালা অনুসারে) বলেন, স্বাধীন ও সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন কোনো প্রাপ্তবয়স্কা নারী—চাই সে কুমারী হোক কিংবা বিবাহিত হোক, তালাকপ্রাপ্তা হোক বা বিধবা হোক—অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া সমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করতে পারবে। তবে অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে এবং সম্মতিতে বিয়ে হওয়া সুন্নত এবং উত্তম। কিন্তু কোনো কারণবশত যদি অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে বিয়ে সম্ভাবিত না হয় তাহলে জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্কা নারী তাদের অনুমতি ব্যতীত ইহকালীন ও পরকালীন কোনো কল্যাণের বিবেচনায় একাকী বিয়ে করে নিতে পারে। তার এ বিয়ে শরিয়াহর দৃষ্টিতে বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

এ ধরনের বিয়ের দুটো দিক রয়েছে।

১. বিয়ে যদি সমকক্ষ কোনো পরিবারে হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের উচিত, উক্ত বিয়ের বিরোধিতা না করে সম্মতি প্রকাশ করার মাধ্যমে তার অনুমোদন দেওয়া। মেয়ের ভুলের কারণে বিষয়টি ঘোলাটে করা সমীচীন নয়। কারণ, এসব ক্ষেত্রে অভিভাবকের আপত্তি করার কোনো অধিকার নেই। অধিকন্তু এ ক্ষেত্রে আপত্তি করার দ্বারা কোনো উপকার তো নেই-ই, বরং দেখা যায়, বিয়ে বিচ্ছেদ করতে গেলে দুটো পরিবারের মাঝে বৈবাহিক যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে, তাতে শরয়ি কোনো কারণ ছাড়াই অহেতুক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়ে নানাবিধ বিপর্যয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। এরপরও কোনো পরিবার যদি এ বিয়ে ভাঙতে চায় তাহলে তার পন্থা হলো তিনটি : স্বামী কর্তৃক তালাক, খোলা কিংবা আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ। এর বাইরে দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ করার কোনো পন্থা নেই।

২. সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন নারী যদি অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত সমকক্ষ কোনো পরিবারে বিয়ে না করে নিম্নবর্তী কোনো পরিবারে বিয়ে করে তাহলে এ পরিস্থিতিতে হানাফি মাযহাবের স্পষ্ট মতানুসারে তাদের এ বিয়ে শরয়ি দৃষ্টিতে বৈধ এবং সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে অভিভাবক এতে আপত্তি করতে পারবে এবং চাইলে আদালতের মাধ্যমে এ বিয়ে বিচ্ছেদ করাতে পারবে। তবে এ প্রকারের বিয়েতে সেই মেয়ে দুটো অপরাধ করেছে :

এক. বিয়ের জন্য অভিভাবকের মধ্যস্থতা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে শরয়ি এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অপছন্দনীয় পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।

দুই. অসমকক্ষ পরিবারে বিয়ে করে অভিভাবকের মানহানি করেছে।

তবে বিশেষ কোনো সমস্যা না মনে হলে অভিভাবকের জন্য এ ধরনের বিয়েকেও বহাল রাখাই উত্তম হবে।

শরিয়াহর পরিভাষায় সমকক্ষতা বলা হয় নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পাত্র-পাত্রী সমস্তরের হওয়া। উল্লেখ্য, সমকক্ষতার বিষয়টি শুধু পুরুষের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়; নারীর বেলায় সমকক্ষতা বিবেচনা করা হয় না। উল্লেখ্য, সমকক্ষতার বিষয়টি বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার শর্তসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা বিয়ের কল্যাণ ও মঙ্গলজনক দিকসমূহের একটি দিক। মেয়ে এবং তার অভিভাবকের কল্যাণার্থে এ বিষয়টিকে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই তারা যদি কোনো কারণে নিজেদের হক এবং বাহ্যিক কল্যাণকে উপেক্ষা করে, তবে শরিয়াহ এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। এ কারণে কোনো মেয়ে যদি পাত্রের অসমকক্ষতার বিষয়টি জেনেও ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ সম্মতিতে তাকে বিয়ে করে নেয় তাহলে এ বিয়ে নিঃসন্দেহে শুদ্ধ এবং কার্যকর হবে।

যেসব বিষয়ে সমকক্ষতা বিবেচনা করতে হয় :

১. বংশগত সমকক্ষতা। তবে অনারবদের বেলায় বংশগত সমকক্ষতার বিষয়টি প্রযোজ্য নয়।

২. সম্ভ্রান্তে সমকক্ষতা। উল্লেখ্য, সম্ভ্রান্তের ভিত্তি হলো ধার্মিকতা, স্বভাব-চরিত্রের মাধুর্য, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি।

৩. দীনদারির মধ্যে সমকক্ষতা। এ জন্য ফাসিক, বদদীন পুরুষ নেককার নারীর সমকক্ষ নয়। পাত্রীর নিজের মাঝে এবং তার বংশের মাঝে যে পরিমাণ দীনদারি থাকবে, বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের মাঝে এবং তার বংশের মাঝে সে পরিমাণ দীনদারি লাগবে। অন্যথায় দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হবে এবং বিভিন্ন ফিতনা দেখা দেবে।

৪. পেশাগত সমকক্ষতা। নারী যদি উচ্চ পর্যায়ের পেশাজীবী পরিবারের সন্তান হয় তাহলে তার জন্য সে ধরনের বা কাছাকাছি ধরনের উচ্চ পর্যায়ের পেশাজীবী ছেলেকে বিয়ে করাই সংগত। এ ক্ষেত্রে সামাজিক বিবেচনাবোধকে আমলে নেওয়া হবে।

৫. অর্থ-সম্পদে সমকক্ষতা। অর্থাৎ নারী যদি বিত্তশালী পরিবারের হয় তাহলে ছেলেকেও বিত্তশালী পরিবারের হতে হবে। উল্লেখ্য, এ কথার অর্থ হলো, স্বামী এই পরিমাণ সচ্ছল হওয়া, যেন সে স্ত্রীর মর্যাদানুসারে তার ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করতে পারে; যাতে করে উভয়ের সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকে এবং আর্থিক অসংগতির কারণে যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। ছেলের পরিবার যদি অর্থনৈতিকভাবে মেয়ের ভরণ-পোষণ এবং মোহর আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে সে অসমকক্ষ বলে গণ্য হবে।

এককথায়, ছেলে যদি মেয়ের মোহর এবং তার মর্যাদানুসারে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার সক্ষমতা রাখে তাহলেই সে সমকক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে। মেয়ে যদি কোটিপতি হয় তাহলে ছেলেও কোটিপতি হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়; বরং ছেলের শুধু এ পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকতে হবে, যা দ্বারা সে স্ত্রীর মাপের ভরণ-পোষণ দিতে সমর্থ হয়। তেমনি মেয়ের বাবা যদি কোটিপতি হয় তাহলে ছেলেকেও কোটিপতি হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়; বরং শুধু এ পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকতে হবে, যা দ্বারা সে কোটিপতির মেয়েকে তার অবস্থানুযায়ী ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে পারে এবং তার মোহর আদায়ে সক্ষম হয়; যদিও সে স্ত্রীর মতো কোটিপতি নয়। এই তারতম্য হয়তো স্বামী-স্ত্রীর মাঝে হতে পারে, আবার তাদের পরিবারের মাঝেও হতে পারে। উভয় অবস্থায় যদি স্বামী তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং মোহর আদায় করতে সক্ষম হয় তাহলেই সে উক্ত নারীর সমকক্ষ বলে বিবেচিত হবে।

উল্লেখ্য, এ সক্ষমতা কেবল বিয়ের সময় লক্ষণীয়। বিয়ের পর যে অবস্থা এবং যে ধরনের পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হোক না কেন, উভয়ের দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যেতে হবে।

৬. স্বাধীন হওয়ার মাঝে সমকক্ষতা। অর্থাৎ স্বামী কারও অধিকারভুক্ত দাস না হওয়া।

সমকক্ষতা যাচাইয়ের অর্থ এ নয় যে, যেখানে সমতার দিকগুলো পাওয়া যাবে, একমাত্র সেখানেই বিয়ে শুদ্ধ হবে। আর যেখানে পাওয়া যাবে না, সেখানে বিয়ে শুদ্ধ হবে না। যেমন : সাধারণত অনেকে ধারণা করে যে, নিজ বংশ ও আত্মীয়-স্বজন ব্যতীত অন্য কোথাও বিয়ে করলে তা বোধ হয় শুদ্ধ হয় না। এসব ভ্রান্ত ধারণা আর সংশয়ের কোনো ভিত্তি নেই। এ কারণেই অভিভাবক এবং প্রাপ্তবয়স্কা সুস্থ নারীর সম্মতিতে যদি অসমকক্ষ পরিবারেও বিয়ে হয় তাহলে তা সম্পন্ন হয়ে যায়। সমতা যদি ফরজ বা ওয়াজিব পর্যায়ের কিছু হতো বা অন্তত শর্তও হতো তাহলে বিয়ে সংঘটিত হতো না। কমপক্ষে তা অসম্পূর্ণ থাকত। অথচ এমনটি হয় না, বরং এমন বিয়ে শরয়ি দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। তাই এ বিয়ে মাকরুহও হবে না।

রাসুলুল্লাহ সা.-এর মেয়েদের মধ্যে রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুম রা.-এর বিয়ে হয়েছে পর্যায়ক্রমে উসমান রা.-এর সাথে। অথচ তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-এর মেয়েদের সমকক্ষ ছিলেন না। কারণ, রাসুলুল্লাহ সা.-এর মেয়েরা হলেন সায়্যিদ। পক্ষান্তরে উসমান রা. হলেন উমাওয়ি। আর সায়্যিদ নয় এমন ছেলেরা বংশগত বিচারে সায়্যিদ মেয়ের সমকক্ষ নয়। এ ছাড়াও রাসুলুল্লাহ সা. সায়্যিদ পরিবারের আরও কয়েকজন মেয়েকে উমাইয়া পরিবারের ছেলেদের কাছে বিয়ে দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ সা. ফাতিমা বিনতে কায়স রা.-এর জন্য ঋণের ওপর বিয়ে করতে উসামা বিন যায়দ রা.-এর কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। অথচ উসামা রা. বংশগত দিক থেকে ফাতিমা বিনতে কায়স কুরাইশি রা.-এর সমকক্ষ ছিলেন না।

সাহাবি আব্দুর রহমান ইবনু আউফ রা. নিজ বোনকে বিলাল রা.-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ বংশগতভাবে উভয়ের মাঝে সমতা ছিল না। একইভাবে আবু হুজাইফা রা. নিজ ভাতিজিকে তার আজাদকৃত গোলামের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন।

এ ধরনের অনেক বিয়ে খোদ রাসুলুল্লাহ সা.-এর হাতে, কোনোটি সাহাবিদের হাতে সম্পন্ন হয়েছিল। সমকক্ষতার বিষয়টি যে ফরজ বা ওয়াজিব কিছু নয়, এর পক্ষে আরও প্রমাণ হলো, ইমাম মালিক, ইমাম সুফয়ান সাওরি এবং হানাফি মাযহাবের ইমাম কারখিসহ অনেক ইমাম বিয়েতে সমকক্ষতার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, আরবের অনারবের ওপর কোনো মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ইসলামে যদি কারও অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব থাকত তাহলে কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী তা হতো কেবল তাকওয়া, পরহেজগারি ও দীনদারির ভিত্তিতে। আর কে কত বেশি মুত্তাকি-পরহেজগার, তার সঠিক ফায়সালা হবে আখিরাতে।

স্বামী-স্ত্রীর সমতার বিষয়টি সুন্নত (গাইরে মুয়াক্কাদা) এবং মুস্তাহাব পর্যায়ের, যা উম্মাহর কল্যাণার্থে শরিয়তে গৃহীত হয়েছে। সুতরাং সমকক্ষতার সবগুলো বিষয় ভাগ্যক্রমে কারও মধ্যে পাওয়া গেলে তো খুবই ভালো। এমন পরিস্থিতিতে বিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আর একান্ত যদি না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে যতটুকু না হলেই নয়, তা যদি ছেলের মধ্যে পাওয়া যায় এবং সে দীন-ধর্মে মেয়ের সমকক্ষ বা তার চেয়ে উচ্চস্তরের হয় তাহলেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—

‘মেয়ে পাত্রস্থ করার জন্য যদি এমন পাত্র পাওয়া যায়, যার দীন-ধর্ম এবং স্বভাব-চরিত্র তোমাদের পছন্দসই হয়, তাহলে তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়ো। যদি তা না করো, তাহলে পৃথিবীতে ফিতনা হবে এবং বড় বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।’[8]

পাত্রী দেখা

সে যুগে মানুষ সাধারণত চার জিনিস দেখে পাত্রী নির্বাচন করতো- ধন-সম্পদ, বংশকৌলীন্য, রূপ-লাবণ্য, দীনদারী। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে উৎসাহিত করেছে, তোমরা দীনদার নারী অর্জনে প্রয়াসী হও। এখানে দীনদারীকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাই হবে মানদণ্ড। অন্য সব বিষয়কেও একেবারে বাদ দেয়া হয়নি। তাই তো পাত্র যেনো পাত্রীর তুলনায় চার জিনিসের ক্ষেত্রে (দিনদারী, বংশ, স্বাধীন হওয়া, পেশা) নিম্নমর্যাদার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে; যা “কুফু ফিন নিকাহ” নামে পরিচিত। সৌন্দর্যের বিষয়টিকেও একেবারে অবজ্ঞা করা হয়নি। তাই তো বিয়ের আগে পাত্রী দেখে নেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। পাত্রী ‘পর্দানশীন আনুস্কা-ক্যাটরিনা’ হতে হবে- এমন নয়, বরং পাত্রের চোখে তাকে ভালো লাগে- এতোটুকু হলেই চলবে। পাত্রী দেখে নেয়া শরিয়তেরই নির্দেশ। পরবর্তী জীবনে যেনো সমস্যা না হয়।

জরুরতের কারণে পাত্রী দেখা পাত্রের জন্য জায়েয করা হয়েছে, অন্যান্য পরপুরুষের জন্য নয়। বর্তমানে তো পাত্রী দেখায় বরের চেয়েও তার বাবা, ভাই, বন্ধুরা এগিয়ে থাকে। তাদের আমলনামায় কুদৃষ্টির গুনাহ লেখা হবে। বরের চোখে বিয়ের আগে প্রত্যকে পাত্রীকে জান্নাতের হুর মনে হয়ে থাকে। এজন্য তার দেখার ওপরই নির্ভর না করে মা-বোনেরাও ভালো করে দেখে নিতে পারে। ভাবীরা সাধারণত এক্ষেত্রে ইনছাফ করে না। তাই নির্বাচনের ভার তাদের ওপর না ছাড়াটাই সঙ্গত। পাত্রী দেখার ক্ষেত্রে আগে সমাজে অনেক কুপ্রথারও প্রচলন ছিলো। “মা, একটু হাঁটো তো। হাতটা দেখি তো। কী কী রান্না করতে পারো। একটা হাসি দাও, দাঁতগুলো দেখি। চুলও তো দেখা দরকার।” এসব এখন অবশ্য কমেছে। আগে ভাবসাবে মনে হতো, যেনো কোনো পণ্য কিনতে এসেছে। নারীস্বাধীনতার ওপরই এক ধরনের আঘাত।

শুধু রূপ আর গুণ দেখাই যথেষ্ট নয়। পাত্রীর মন-মানসিকতা, রুচি-প্রকৃতির প্রতিও বেশ গুরুত্বারোপ করা উচিত। যার সাথে কাটবে সারাটা জীবন, তার সাথে মানসিকতার মিল না থাকলে হয়তো সংসার ভেঙ্গে যাবে কিবা ‘ভাঙ্গি ভাঙ্গি’ করেও শেষ অবধি একখণ্ড নরক হয়ে টিকে থাকবে। সাধারণত এ বিষয়টার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করা হয় না। অথচ সংসারের শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্না গুণবতী দীনদার নারী পেলে এদিক-সেদিকের ত্রুটি বের করে বিয়ে করা থেকে পিছিয়ে থাকার ফলাফল শুভ হয় না। বাস্তবসম্মত ত্রুটি থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু শত গুণের আধার, পাত্রেরও পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এক বোন দেখা যায় আপত্তি করে বসে আছে, তার চেহারাটা একটু কেমন যেনো! জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তো না। আমার ভাইটাকে চাঁদের কণার সাথেই বিয়ে দেবো। আহা! সবাই যদি চাঁদের কণাই খুঁজে ফিরে, তাহলে তো পৃথিবীটা আঁধারে ছেয়ে যাবে। তাছাড়া রূপ পাওয়া গেলে গুণে ত্রুটি আর শত গুণ পাওয়া গেলে রূপে সামান্য লাবণ্যহীনতা- এই বোধহয় জগতসংসারের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি। তাই এক্ষেত্রে কী করা উচিত! ওপরে বর্ণিত হাদিসে তো সে নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে।

পাত্রীপক্ষের প্রতি শরিয়তের নির্দেশ, মেয়ের জন্য যোগ্য দীনদার পাত্র পেলে তোমরা বিয়েতে অমত করবে না। চার জিনিসে বিলম্ব করা অসমীচীন। তার মধ্যে মেয়ের বয়স হলে (এখানে বালিগা হওয়া উদ্দেশ্য, আঠারো পূর্ণ হওয়া নয়- আঠারোকে মানদণ্ড বানানো জাহিলিয়্যাত। একে অপরিহার্য সাব্যস্ত করা সুস্পষ্ট কুফুর। ওদের ওপর আল্লাহর লানত) তাকে যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দেয়ার বিষয়টাও অন্যতম। এখানে যোগ্যতার মানদণ্ডও শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাকে তাবলিগে এক সাল লাগাতে হবে, অমুক পীরের মুরিদ হতে হবে- এ জাতীয় শর্তারোপ করা মেযাজে শরিয়তের খেলাফ। এ বড় উগ্রতা, কট্টরতা ও একগুঁয়েমি! দীনদারীর সাইনবোর্ডধারী হলেও এরা আদতে অথর্ব ও অর্বাচীন, দীন সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। রাসুল সা. বলেছেন, “তোমাদের কাছে এমন পাত্র যখন প্রস্তাব প্রেরণ করে, যার দীনদারী ও চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট, তার সাথে আবশ্যিকভাবে তোমরা তোমাদের কন্যাদেরকে বিবাহ দাও। যদি তা না করো, পৃথিবীতে ফেতনা হবে ও ব্যাপক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়বে।”

মনে পড়ে, আমার নিজের বিয়ের আগে এ স্বপ্নগুলো ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আল্লাহ তাআলা বান্দার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করেন।

‘যার হাসি মন জুড়াবে। যার চাহনি হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। যার রূপ-লাবণ্য বিভা ছড়াবে অমাবস্যার রাতেও। আবেগী। পূর্ণ তিমিনাথ যখন থাকবে আকাশে- খোলা মাঠে সবুজ ঘাসের বিছানায় হবে দুজনার জম্পেশ আড্ডা- পিঠে-পিঠে ভর করে হবে চাঁদ দেখা। যার প্রতিটি আচরণ-উচ্চারণে ঝরে পড়বে ভালোবাসা। আন্তরিকতাপূর্ণ হবে তার প্রতিটি উদ্যোগ-পদক্ষেপ। দীনী চেতনাধারী; তবে মাত্রাতিরিক্ত ছুফি নয়। বর্তমান পৃথিবীটাকে বোঝে, তবে এসবে মন নেই। লেখালেখির প্রাথমিক যোগ্যতা ও আগ্রহ আছে। আছে ইলমে ব্যুৎপত্তি অর্জনের স্বপ্ন। মুসলিম উম্মাহর খেদমতে সেও চায় ভূমিকা রাখতে, চায় নিজের সাধ্যমতো ইলমি খেদমত করে অমর হয়ে থেকে যেতে। আল্লাহ যা দিয়েছেন ও দিচ্ছেন- তাতেই তার পূর্ণ সন্তুষ্টি। কাড়ি কাড়ি অর্থ-সম্পদ সংগ্রহের প্রতি নেই কোনো আকর্ষণ-চাহিদা। শুধুই জীবনসঙ্গিনী নয়, হবে আমার দীনী সফরের একনিষ্ঠ সাথি। তার প্রত্যয় ও উৎসাহ আমাকে এগিয়ে নেবে। আলস্য আমাকে পেয়ে বসলে সে আবার জাগিয়ে দেবে। সন্তানের জন্যও হবে আলোকিত মাদরাসা। সেই চৌদ্দশ বছর আগের আদর্শ নারী সাহাবিদের মূর্ত প্রতীক। মুখের কথাও হবে শুদ্ধ ও সুন্দর, মার্জিত ও পরিশীলিত। হয়তো সে স্কুলে পড়েছে কিবা মাদরাসায়- কিন্তু তার তলবই তাকে এগিয়ে নেবে, আলোকিত পথের দিশা দেবে। নিবিড় অধ্যয়ন আর স্বামীর সাথে মুযাকারা করে নিজেই গড়ে নিবে নিজ ক্যারিয়ার। পরচর্চা বা অহংবোধে আক্রান্ত হবে না কখনো। আমি বিশ্বাস করি- সেই নারীই হবে পৃথিবীতে আমার স্বর্গ, যেমন বলেছিলেন সায়্যিদুনা আব্দুল মজিদ নাদিম রহ.। হবে হাদিসের বাণীরও বাস্তব রূপায়ন- خير متاع الدنيا المرأة الصالحة. পৃথিবীর সর্বোত্তম আসবাব হলো সতী নারী।

তার কলমে রচিত হবে উম্মাহর আগামী দিনের ভবিষ্যত। তার কোলে বেড়ে উঠবে যুগের ইমাম মুহাম্মাদ ও হাজ্জাজ-ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মাদ বিন কাসিমের মতো আরেক মুহাম্মাদ বিন উসামা।

অনাগত কারো স্মরণে আমার এ লেখা। তার জন্য যদি প্রয়োজন হয় সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা- তাও বা মন্দ কী! আমি বিশ্বাস করি, প্রভু আমাকে ব্যর্থ মনোরথে ফিরাবেন না। অবশ্যই কবুল করবেন আমার তামান্না। দান করবেন চোখের শীতলতা-“আখোউ কি ঠানডাক”।’

অবাধ্য নারী

নাশিজা নারীর বিধান সম্পর্কে সুরা নিসা’র ৩৪-৩৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা এসেছে। নাশিজা মানে হলো অবাধ্য স্ত্রী। এই আয়াত দুটোর অধীনে তাফসিরগ্রন্থগুলোতে নাশিজা’র পরিচয় ও বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নাশিজাকে সংশোধন করার ব্যাপারে প্রথম আয়াতে তিনটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো ধাপে ধাপে প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। যদি এই তিনটি পরামর্শের কোনোটা কাজে লেগে যায় তাহলে আর তালাকের দিকে না যেতে নাসিহাহ দেওয়া হয়েছে। আর একান্ত যদি এর কোনোটিই কার্যকর না হয় তাহলে পরবর্তী আয়াতে নেক্সট করণীয় সম্পর্কে বলে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে হয়তো মিটমাট হবে কিংবা সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতায় রূপ নেবে।

ইসলামে নারীদের জন্য বাবা-মা’র চেয়ে স্বামীর কথা মান্য করার গুরুত্ব বেশি। যদিও সমাজে এর চর্চা অনেক ফ্যামিলিতেই নেই। বরং স্বামীকে উল্টো বানানো হয় বাবা-মা’র হুকুমের বলির পাঠা। অথচ রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমি যদি কোনো মানুষকে অপর কাউকে সিজদা করার আদেশ দিতাম, তাহলে অবশ্যই নারীদের এই আদেশ দিতাম যে, তারা যেন তাদের স্বামীদের সিজদা করে। কোনো নারী তার ওপর থাকা আল্লাহর সকল হক আদায় করতে পারে না, যতক্ষণ না তার ওপর থাকা স্বামীর সকল হক আদায় করে।’ পুরো হাদিস এই –

لو كنتُ آمِرًا أحدًا أن يسجد لأحد، لأمرتُ المرأةَ أن تسجد لزوجها، ولا تؤدِّي المرأة حقَّ الله – عزَّ وجلَّ – عليها كلَّه، حتَّى تؤدِّي حق زوجها عليها كله، حتى لو سألها نفسها وهي على ظَهْر قتب، لأعطَتْها إياه

ইমাম আহমাদ রহ. বলেন,

المرأة إذا تزوَّجَت، كان زوجها أملك بها من أبويها، وطاعة زوجها عليها أوجب

কোনো নারী যখন বিয়ে করে তখন বাবা-মা’র চাইতে স্বামী তার ব্যাপারে অধিক কর্তৃত্ববান হয়ে যায়। এবং তার জন্য স্বামীর আনুগত্য করা অধিক অপরিহার্য।

অধিকাংশ আলিমের মতানুসারে শরয়ি কোনো ওজর না থাকলে কোনো স্ত্রীলোকের জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। তাদের এই মতের পক্ষে অনেক দলিল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ : ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত বুখারি-মুসলিমের এই হাদিস –

إذا استأذنَكم نساؤكم باللَّيل إلى المسجد، فأْذَنوا لهن

রাতের বেলায় তোমাদের নারীরা তোমাদের কাছে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তোমরা অনুমতি দিয়ো।

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববি রহ. বলেন,

واستُدِلَّ به على أنَّ المرأة لا تخرج من بيت زوجها إلاَّ بإذنه؛ لِتَوجُّهِ الأمر إلى الأزواج بالإذن

এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীলোক স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হবে না। কারণ, এখানে অনুমতি প্রদানের বিষয়টি স্বামীদের দিকে ফেরানো হয়েছে। (অর্থাৎ তাদের অনুমতিসাপেক্ষেই কেবল নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারবে।)

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,

لا يحلُّ للزوجة أن تخرج من بيتها إلاَّ بإذنه… وإذا خرجَتْ من بيت زوجها بغير إذنه كانت ناشزةً عاصية لله ورسوله، مستحِقَّة العقوبة

স্ত্রীর জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হওয়া বৈধ নয়।… যদি সে স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হয় তাহলে সে হবে নাশিজা, আল্লাহ এবং তার রাসুলের অবাধ্যতাকারিনী, শাস্তির উপযুক্ত।

ইমাম আহমাদ রহ.-এর এ কথাও উল্লেখ হয়েছে ‘শারহু মুনতাহাল ইরাদাহ’ গ্রন্থে (৩/৪৭),

طاعة زوجها أوجب عليها من أمها ، إلا أن يأذن لها

স্ত্রীলোকের জন্য মায়ের আনুগত্যের থেকে স্বামীর আনুগত্য অধিক আবশ্যক। হ্যাঁ, স্বামী যদি তাকে অনুমতি দেয় তাহলে ভিন্ন কথা।

উল্লেখ্য, একটা হলো অনুমতি দেওয়া, আর আরেকটা হলো জোর করে কিংবা ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে অনুমতি আদায় করা। অন্তরের সন্তুষ্টির সঙ্গে অনুমতি দিলে তো ঠিক আছে। আর অনুমতির পরোয়া না করলে বা জোরপূর্বক অনুমতি আদায় করলে তা হয় জুলুম। জুলুম কিয়ামতের দিন ঘুটঘুটে অন্ধকারে রূপ নেবে।

‘আলইনসাফ’-এ (৮/৩৬২) এসেছে,

لا يلزمها طاعة أبويها في فراق زوجها , ولا زيارةٍ ونحوها . بل طاعة زوجها أحق

স্বামীকে ছেড়ে থাকা কিংবা তাকে দেখতে না যাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে বাবা-মা’র কথা মান্য করা নারীর জন্য অপরিহার্য নয়। বরং স্বামীর আনুগত্য তার ওপর সবচে বড় হক।

আললাজনাতুদ দায়িমার ফতোয়ায় এসেছে,

لا يجوز للمرأة الخروج من بيت زوجها إلا بإذنه ، لا لوالديها ولا لغيرهم ؛ لأن ذلك من حقوقه عليها ، إلا إذا كان هناك مسوغ شرعي يضطرها للخروج

নারীর জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হওয়া জায়িয নয়; বাবা-মা’র উদ্দেশ্যেও নয়, অন্য কারও উদ্দেশ্যেও নয়। কারণ, এটা তার ওপর স্বামীর হকের অন্তর্ভুক্ত। হ্যাঁ, যদি কোনো শরয়ি ব্যাপার থাকে, যা তাকে বের হতে বাধ্য করে, তাহলে ভিন্ন কথা।

সহিহ বুখারি এবং সহিহ মুসলিমের হাদিসে আয়িশা রা.-এর যে বাক্যটি এসেছে,

أتأذن لي أن آتي أبوي

আপনি কি আমাকে আব্বু-আম্মুর কাছে যাওয়ার অনুমতি দেবেন?

এর ব্যাখ্যায় ‘তারহুত তাসরিবে’ (৮/৫৮) ইরাকি রহ.-ও এ কথাই বলেন,

وقولها : أتأذن لي أن آتي أبوي : فيه أن الزوجة لا تذهب إلى بيت أبويها إلا بإذن زوجها ، بخلاف ذهابها لحاجة الإنسان فلا تحتاج فيه إلى إذنه ، كما وقع في هذا الحديث

স্ত্রী সে-ই হয়, যার মধ্যে মান্য করার যোগ্যতা থাকে। যে স্বামীর সিদ্ধান্তের সামনে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে না, সে রোগী। তার ইসলাহ প্রয়োজন। সে বাহ্যত অনেক জ্ঞানী বা নেককার হলেও আদতে সে অপরাধী, চরম অপরাধী। নারীদের জন্য স্বামীর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকালকার নারীরা এসব থোরাই কেয়ার করে। এগুলো যে দীনের অংশ, তা-ই বা কজন জানে!

ভালোবাসার সাগরে ডুব দিয়ে শরিয়তের বিধিবিধান আর কিছুই স্মরণ থাকে না। তখন সংসার চলে শরয়ি সীমারেখার ঊর্ধ্বে আরোহণ করে; মানবিক ভালোবাসার ভেলায় চড়ে। এমনও তো দেখা যায়, স্বামীর অনুমতির পরোয়া না করে, বরং স্বামীর সঙ্গে বিবাদ করে স্ত্রী কোনো ‘দীনি’ মেহনতে সময় দিতে শুরু করে। হিজবুত তাওহিদ নামক ভ্রান্ত দলের নারীদের অতীত-সমাচার জানলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। স্বামীদের কথা মান্য করলে তাদের অধিকাংশেরই হয়তো আজ এভাবে দীন-দুনিয়া উভয়টাই হারাতে হতো না।

একমাত্র গোনাহের কাজে স্বামীর কথা মান্য করা যাবে না। এ ছাড়া সব ব্যাপারে তাকে মান্য করা অপরিহার্য; চাই তা মনমতো হোক বা না হোক। আজকাল মেয়েদের মধ্যে মানার গুণের থেকে মানানোর গুণটাই প্রবল। ফলে বাহ্যত যদিও পুরুষ সংসারের কর্তা; কিন্তু সেই পুরুষকেই বানিয়ে ফেলা হয় নিজের সেবকদাস; যার ওপর ভালোবাসার ছরি ঘুরিয়ে অবলীলায় শাসন চালিয়ে যায় কৌশলী নারীরা।

শয়তানের কৌশলের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘ইন্না কাইদাশ শাইতানি কানা দায়িফা।’ নিশ্চয়ই শয়তানের চক্রান্ত-কৌশল দুর্বল। আর নারীদের ব্যাপারে ইউসুফ আ.-এর বর্ণনা প্রসঙ্গে কুরআনে এসেছে, ‘ইন্না কাইদাকুন্না মাতিন।’ নিশ্চয়ই তোমাদের (নারীদের) চক্রান্ত-কৌশল শক্তিশালী।

রাসুলুল্লাহ সা. এক নারীকে বলেন,

فانظري أين أنت منه، فإنما هو جنتك ونارك

দেখো, স্বামীর কাছে তোমার অবস্থান কোথায়। নিশ্চয়ই স্বামীই তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম। (মুসনাদে আহমাদ)

অপর এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. তিন শ্রেণির হতভাগার কথা উল্লেখ করেন, যাদের সালাত তাদের শ্রবণেন্দ্রিয় অতিক্রম করে না; কবুল হওয়া তো দূরের কথা।

ثلاثة لا تجاوز صلاتهم آذانهم، العبد الآبق حتى يرجع، وامرأة باتت وزوجها عليها ساخط، وإمام قوم وهم له كارهون

এই তিন শ্রেণির হতভাগার মধ্যে এক শ্রেণি হলো এমন নারী, যে এমতাবস্থায় রাতযাপন করেছে যে, তার স্বামী তার ওপর অসন্তুষ্ট। (তিরমিজি)

আরেক হাদিসে এ-ও এসেছে,

إذا الرجل دعا زوجته لحاجته فلتأته، وإن كانت على التنور

স্বামী তার কোনো প্রয়োজনে স্ত্রীকে ডাকলে সে যেন তার কাছে চলে আসে; যদিও সে চুলায় থাকে। (তিরমিজি)

মুআজ রা.-এর হাদিসে এ কথা এসেছে,

لا تؤذي امرأة زوجها في الدنيا، إلا قالت زوجته من الحور العين: لا تؤذيه قاتلك الله، فإنما هو عندك دخيل، يوشك أن يفارقك إلينا.

কোনো নারী দুনিয়াতে তার স্বামীকে কষ্ট দিলে সেই স্বামীর জান্নাতি হুরে ঈন স্ত্রী তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই তাঁকে কষ্ট দিস না। আল্লাহ তোকে ধ্বংস করুন। তিনি তো তোর কাছে সাময়িক আগমনকারী। শীঘ্রই তিনি তোকে ছেড়ে আমাদের উদ্দেশ্য চলে আসবেন। (মুসনাদু আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকিম, ইবনু মাজাহ, তাবারানি)

রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,

أيما امرأة ماتت وزوجها راض عنها دخلت الجنة

যেকোনো নারী যদি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, তার স্বামী তার ওপর সন্তুষ্ট, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিজি)

বিয়ের পর একজন নারীর ওপর তার স্বামীর হক সবচে বেশি। এমনকি মায়ের হকের ওপরও স্বামীর হক তখন অগ্রগণ্য হয়ে যায়। বাবা-মা’র সিদ্ধান্ত আর স্বামীর সিদ্ধান্ত বিরোধপূর্ণ হলে স্ত্রীর জন্য স্বামীর সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া অপরিহার্য হয়ে যায়। স্বামীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় একজন নারীর জাহান্নাম এবং জান্নাত। স্বামীর গুরুত্ব এত বলেই তো রাসুল বলেছেন, ‘আমি কোনো মানুষকে যদি অন্য কাউকে সিজদা করার আদেশ দিতাম, তাহলে নারীদের আদেশ দিতাম, তারা যেন নিজ স্বামীদের সিজদা করে। কারণ, যেহেতু আল্লাহ তাদের ওপর স্বামীদের জন্য অসংখ্য হক রেখেছেন।’ অর্থাৎ আল্লাহ এবং তার রাসুলের পর সকল বৈধ বিষয়ে স্বামীর সিদ্ধান্তের চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কোনো নারীর জন্য হতে পারে না। সিজদা-সংক্রান্ত এমন কথা কিন্তু কোনো হাদিসে মায়ের ব্যাপারেও বলা হয়নি।

তিরমিজি এবং আবু দাউদের উপরিউক্ত বর্ণনাটি মুসনাদু আহমাদ গ্রন্থেও এসেছে। সেখানে শেষে এই অংশটি বর্ধিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. এ-ও বলেছেন,

والذي نفسي بيده لو كان من قدمه إلى مفرق رأسه قرحه تجري بالقيح والصديد ثم استقبله فلحسته ما أدت حقه

ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, যদি স্বামীর পা থেকে মাথার সিঁথি পর্যন্ত জখম থাকে, যেখান থেকে রক্ত-পূঁজ ঝড়তে থাকে, তারপর সে তার সামনে আসে, অনন্তর স্ত্রী তার এসব চেটে ফেলে, তবুও স্ত্রী তার হক আদায় করতে পারবে না।

সাহাবি জায়দ বিন সাবিত রা. সুরা ইউসুফের একটি আয়াতের আলোকে বলেন, স্বামী আল্লাহর কিতাবের বিধান অনুযায়ী নেতা।

الزوج سيِّدٌ في كتاب الله ، وقرأ قوله تعالى : ( وألفيا سيدها لدى الباب )

উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন,

النكاح رق ، فلينظر أحدكم عند من يرق كريمته

বিয়ে হলো দাসত্ব। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন ভালো করে দেখে নেয়, কার কাছে নিজেদের সম্মানিত মেয়েকে দাসী বানাচ্ছে।

এখানে স্পষ্ট, উমর রা. মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে ভেবেচিন্তে নিতে বলেছেন। কারণ, যেইমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে তখন থেকে তার সবকিছু হয়ে যাবে তার স্বামী। স্বামীই তার নেতা। স্বামীই তার দুনিয়া, স্বামীই তার আখিরাত। এমনকি বাবা-মা’র ধাপও চলে যাবে দ্বিতীয় স্তরে। স্বামীর হক ঠিক রাখার পর তাকে অন্যান্য হক সামাল দিতে হবে। এমনকি নারীর জান্নাতকেও স্বামীর আনুগত্যের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বিয়ে না করলে তা আলাদা কথা। কিন্তু বিয়ে করে ফেললে সকল বৈধ বিষয়ে স্বামীর সিদ্ধান্তের নিজেকে সঁপে দিতে হবে। এমনকি বাবা-মা’কে পর্যন্ত স্বামীর ওপর প্রাধান্য দিতে গেলে তা হবে জুলুম এবং হতভাগ্যের কারণ। পাশাপাশি এ নারীর নসিবে জুটবে নিষ্পাপ জান্নাতি হুরে ঈনদের বদদুয়া।

ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,

فالمرأة عند زوجها تشبه الرقيق ، والأسير ، فليس لها أن تخرج من منزله إلا بإذنه ، سواء أمرها أبوها ، أو أمها ، أو غير أبويها ، باتفاق الأئمة .

নারী তার স্বামীর কাছ দাসী এবং বন্দীসদৃশ। সুতরাং স্ত্রীর জন্য স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার ঘর থেকে বের হওয়া বৈধ নয়; এমনকি যদি তার বাবা কিংবা মা কিংবা এ ছাড়া অন্য কেউ তাকে বের হতে আদেশ করে, তবুও। এটা ইমামগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।

এমনকি কোনো স্বামী যদি সঠিকভাবে স্ত্রীর ভরণপোষণ দেয় এবং আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা ঠিক রাখে, আর কোনো কারণে সে স্ত্রীকে নিয়ে অন্য কোনো এলাকায় চলে যেতে চায়; কিন্তু স্ত্রীর বাবা-মা এতে বাধ সাধে, তাহলে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী বাবা-মা জালিম। স্ত্রীর জন্য এ ব্যাপারে বাবা-মা’র নির্দেশ মান্য করা বৈধ নয়। বরং তার ওপর তা-ই অপরিহার্য, যা তার স্বামীর সিদ্ধান্ত। হ্যাঁ, স্বামী যদি স্বেচ্ছায় তাকে এখানে থাকার অনুমতি দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা।

আজকাল তো অনেক বাবা-মা এসব ব্যাপারে বেশ বাড়াবাড়ি করে। বিয়ের পরও মেয়ের ওপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে রাখে, যেখানে জামাইয়ের মতামত হয়ে যায় গৌণ। এসব বাবা-মা বাহ্যত দীনদার হলেও আদতে তারা জালিম। আর জুলুম কিয়ামতের দিন গভীর অন্ধকারে রূপ নেবে।

সাধারণত এ ধরনের বাবা-মা’র সঙ্গে জামাইদের অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে। সর্বাবস্থায় তা প্রকাশিত হয় না। কোথাও বা প্রকাশিত হলে সংসার ভাঙন পর্যন্ত গড়ায়। এ ক্ষেত্রে কখনো-বা স্ত্রীরা বাবা-মা’র পক্ষ নিয়ে স্বামীর কাছে তালাক পর্যন্ত চেয়ে বসে; যেহেতু স্বামী বেচারা তার বাবা-মা’র নির্দেশমতো বা মনমতো চলে না। এমন নারীর ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে,

أيما امرأة سألت زوجها الطلاق غير ما بأس فحرام عليها رائحة الجنة

যে নারী কোনো (শরয়ি) সমস্যা ছাড়া স্বামীর কাছে তালাক চাবে, তার ওপর জান্নাতের ঘ্রাণও হারাম।

এমনকি এ ধরনের নারীদের মুনাফিক আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে,

المختلعات والمتبرعات هن المنافقات

এ ব্যাপারগুলো নিয়ে ইমাম ইবনু তাইমিয়া তার ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে (৩২/২৬১-২৬৪) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।

ইমাম ইবনু হাজার হাইতামি নারীদের আনুগত্যের বয়ান প্রসঙ্গে হামাওয়ির হাওয়ালায় এ-ও বলেছেন,

لا لعيادة مريض وإن كان أباها، ولا لموته وشهود جنازته، قاله الحموي.

কোনো অসুস্থ রোগীকে দেখার জন্যও নারী তার স্বামীর অনুমতি ছাড়া বের হতে পারবে না; যদিও অসুস্থ রোগী যদি হয় তার বাবা। অনুরূপ বাবার মৃত্যু উপলক্ষে বা তার জানাযায় উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্যেও স্বামীর অনুমতি ছাড়া বেরোতে পারবে না।

ইবনু কুদামা রহ. ‘আলমুগনি’ গ্রন্থেও অনুরূপ কথা বলেছেন,

وللزوج منعها من الخروج من منزله، إلى ما لها منه بد، سواء أرادت زيارة والديها، أو عيادتهما، أو حضور جنازة أحدهما

আজকালকার নারীরা এবং তাদের বাবা-মা’রা এসবের থোরাই কেয়ার করে। স্বামীরা বিয়ের পরও খুব স্বল্প পরিমাণেই স্বাধীনতা ভোগ করে। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর ঐকমত্য থাকার পরও শ্বশুর-শাশুড়ির চাপে অনেক উপকারী এবং বৈধ কাজ থেকে পর্যন্ত তাদের দূরে থাকতে হয়। এমন বাবা-মা’রা মেয়েদের বিয়ে না দিলেই পারে। কিন্তু বিয়ে দেওয়ার পর এভাবে নেক সুরতে জালিমরূপে আবির্ভূত হয়ে নিজেদের আখেরাত বরবাদ করা অর্থহীন। জান্নাতি হুররা দুনিয়ার স্ত্রীদের কার্যাবলি খুব ভালো করে ফলো করে। তাদের গাফিলতি এবং অনাচার দেখলে অভিসম্পাতও করে। স্ত্রীর ক্ষেত্রেই যদি এই কথা হয়; তাহলে থার্ড পারসন, অর্থাৎ স্ত্রীর বাবা-মা’র বিষয়টি কেমন হবে।

দুনিয়ার মধ্যে একজন মানুষ যতকিছু পায় এবং ভোগ করে, হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী তার মধ্যে সবচে উত্তম হলো সৎ নারী। একজন ভালো স্ত্রীর সংজ্ঞা যদি নির্ধারণ করা হয়, তাহলে প্রথমেই যে বিষয়টি আসবে, তা হলো স্বামীর আনুগত্য। নারীর যদি এতে কমতি থাকে, তাহলে প্রথম ধাপেই সে তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে। ইহকাল এবং পরকাল উভয় জগতেই সে হতভাগা। যদি এমন হয়, তারা বাবা-মা তার ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট; কিন্তু তার বেপরোয়া ভাব বা অবাধ্যতার কারণে স্বামী তার ওপর অসন্তুষ্ট, তাহলে বাবা-মা’র সন্তুষ্টি থাকার পরও সে চির হতভাগা। এই বৈবাহিক জীবনের ব্যর্থতা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে; এমনি সে যতই নামাজ-রোজা করুক না কেন।

কোনো নারী যদি অবাধ্য হয়, পরিভাষা অনুসারে তাকে নাশিজা বলা হয়। অবাধ্যতার অনেক সুরত রয়েছে। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোথাও চলে যাওয়াও অবাধ্যতার মধ্যে পড়ে। স্বামীর অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও বাবার বাড়িতে পড়ে থাকাও অবাধ্যতার মধ্যে পড়ে। কোন বিষয়টি কতটুকু পর্যায়ে গেলে শরিয়তের দৃষ্টিতে অবাধ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তার ভিত্তিতে কোনো নারীকে নাশিজা বলা যায়, তা দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ। স্বামীর জন্য নাশিজা নারীর ভরণপোষণ দেওয়াও অপরিহার্য নয়। তার ব্যাপারে স্বামীর করণীয় সম্পর্কে সুরা নিসা’র ৩৪-৩৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা এসেছে।

আজ আমাদের আলোচ্যবিষয় হলো, বিয়েতে স্ত্রী বা তার ফ্যামিলির পক্ষ থেকে স্বামীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া শর্ত সম্পর্কে। স্বামীর জন্য সেই শর্তগুলো মান্য করা অপরিহার্য কি না, যেকোনো শর্ত বিয়ের সময় উল্লেখ করলেই কি তা অবধারিত হয়ে যায় ইত্যাদি। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে হানাফি মাজহাবের আলোকে আলোচনা করব। তবে এর অনেকগুলো বিষয়ই এমন, যে ক্ষেত্রে অন্যান্য মাজহাবও একমত। বিয়েতে করা শর্তের ব্যাপারে হাম্বলি মাজহাবে শুধু তুলনামূলক বেশিই ভিন্ন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে; যা আমাদের মাজহাবের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বিয়েতে করা শর্ত প্রসঙ্গে প্রথমে কয়েকটি কথা স্মরণ রাখতে হবে।

১. বিয়েতে করা শর্তগুলো মৌলিকভাবে দুপ্রকার : (ক.) সহিহ শর্ত এবং (খ.) বাতিল বা ফাসিদ শর্ত।

২. ক্রয়-বিক্রয়ে শর্ত বাতিল হলে মূল চুক্তিই বাতিল হয়ে যায়। এরপরও বিকিকিনি করতে চাইলে সেই শর্তকে বাদ দিয়ে নতুন করে চুক্তি নবায়ন করতে হয়। পক্ষান্তরে বিয়েতে বাতিল বা ফাসিদ শর্ত যোগ করা হলে বিয়ে বাতিল হয়ে যায় না। বরং সেই শর্তগুলো আপনাআপনি বাতিল হয়ে যায়।

একটি বাতিল শর্তের আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম মুহাম্মাদ রহ. তার ‘কিতাবুল হুজ্জাহ’ গ্রন্থে বলেন,

النِّكَاح فِي ذَلِك جَائِز وَالشّرط بَاطِل

এ ক্ষেত্রে বিয়ে বৈধ আর শর্ত বাতিল।

৩. যে ক্ষেত্রে শর্ত মান্য করা অপরিহার্য থাকে, সে ক্ষেত্রেও যদি স্বামী তা মান্য না করে, তবে এ কারণে সে গোনাহগার হবে; কিন্তু হানাফি মাজহাবের সিদ্ধান্তমতে এই অমান্যতার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিয়ে ভেঙে যাবে না বা স্ত্রী চাইলেই বিয়ে ভেঙে দিতে পারবে না। এর দায়ভার স্বামীর কাঁধে থাকবে। আল্লাহর কাছে সে অপরাধী থাকবে। তবে এ কারণে সংসার ভাঙার পর্যায়ে যাবে না।

فوات الشرط يوجب فوات الرضا، وفوات الرضا لا اثر له في النكاح.

হ্যাঁ, যদি এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সাংসারিক হকগুলো অনাদায়ী থাকে বা স্ত্রী তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে স্ত্রী প্রমাণসাপেক্ষে ইসলামি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে বা সালিসের মাধ্যমে মিটমাট করে নিতে পারে।

এবার আসি মূলকথায়।

বিয়েতে যে শর্তগুলো করা হয়, সেগুলো প্রধানত দুপ্রকার; যেমনটা আমরা ওপরে বলে এসেছি। (১) সহিহ শর্ত; (২) বাতিল বা ফাসিদ শর্ত। প্রথম প্রকারটি তথা সহিহ হলো চার ধরনের শর্ত। এর বাইরে যা কিছু আছে, সবই ফাসিদ এবং বাতিল। সুতরাং যদি বিয়েতে করা শর্তগুলো, তা যে পক্ষের থেকেই হোক না কেন, এই চার প্রকারের কোনোটির মধ্যে পড়ে, তাহলে তা মান্য করা ওয়াজিব। আর যদি এই চারওটির কোনোটির মধ্যে না পড়ে, তাহলে তা মান্য করার কোনো অপরিহার্যতা নেই; এমনকি নিজে নিজের ওপর অপরিহার্য করে নিলেও অপরিহার্য হবে না।

সহিহ শর্তের প্রকার :

১. এমন সব শর্ত, যা বৈবাহিক চুক্তির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যদি তা উল্লেখ না-ও করা হয়, তবুও বৈবাহিক চুক্তির দাবিতেই তা অপরিহার্য থাকে। উদাহরণস্বরূপ : মেয়েপক্ষ শর্ত করল, মেয়েকে ঠিকমতো ভরণপোষণ দিতে হবে, তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে, তার মোহর পরিশোধ করতে হবে ইত্যাদি। কিংবা স্বামী শর্ত করল যে, তার ঘরে থাকতে হবে, তার সেবা করতে হবে, তার কথা শুনতে হবে, তার অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বেরোবে না, তার উপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া নফল রোজা রাখবে না ইত্যাদি। তো এসব শর্ত যদি আলাদাভাবে উল্লেখ না-ও করা হতো, তবুও বৈবাহিক চুক্তির দাবি হিসেবেই এগুলো তাদের ওপর অপরিহার্য থাকত।

সকল মাযহাবের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হলো, এ প্রকারের শর্ত মান্য করা অপরিহার্য। কারণ, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,

أَحَقُّ الشُّرُوطِ أَنْ تُوفُوا بِهِ : مَا اسْتَحْلَلْتُمْ بِهِ الْفُرُوج

শর্তসমূহের মধ্যে যা পূর্ণ করার সর্বাধিক দাবি রাখে, তা হলো সেই শর্ত, যার মাধ্যমে তোমরা স্ত্রীদের হালাল করেছ। (বুখারি : ২৭২১; মুসলিম : ১৪১৮)

২. বৈবাহিক চুক্তির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক শর্তসমূহ, যেগুলো মূলত বৈবাহিক চুক্তিকে সুদৃঢ় করে এবং বিয়ের দাবিসমূহকে শক্তিশালী করে। তো এ প্রকারের শর্ত বৈবাহিক চুক্তির মাধ্যমেই অবধারিত হয়ে যাওয়ার ছিল না, আবার এগুলো আরোপ করা বৈবাহিক সম্পর্কের খেলাফ কোনো কিছুও অপরিহার্য করে না; তবে এগুলোকে অতিরিক্তভাবে আরোপ করার দ্বারা যেকোনো পক্ষ বিয়ের কোনো দাবি পূরণের ব্যাপারে অধিক আশ্বস্ত হতে পারে এবং যার ফলে এতে উভয় পক্ষেরই কল্যাণ নিহিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ : স্ত্রী শর্তারোপ করল, একান্ত স্বামী যদি মোহর পরিশোধ না করে, তবুও যেন মোহর অনাদায়ী না থেকে যায়, এ জন্য তৃতীয় কাউকে এই আর্থিক দায়ের দায়িত্ব নিতে হবে কিংবা এমন শর্ত আরোপ করল যে, স্বামীর বিকল্প হিসেবে শ্বশুরকে তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে ইত্যাদি।

সকল মাজহাবের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ প্রকার শর্তও সহিহ এবং গ্রহণীয়। এ ধরনের শর্ত মান্য করাও অপরিহার্য।

৩. এমন শর্ত, বৈবাহিক জীবনে শরিয়ত যার বৈধতা দিয়েছে এবং তার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপকে অপরিহার্য করেছে; যদিও তা সরাসরি বৈবাহিক চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিংবা বিয়ের দাবিকে সুদৃঢ়কারী না হয়। উদাহরণস্বরূপ : স্বামী শর্তারোপ করল, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে কিংবা অন্য যেকোনো কারণে আমি এখনই মোহর পরিশোধ না করে অমুক সময়ে করব।

এ প্রকার শর্তের ব্যাপারে পূর্বের মতোই সকল মাযহাবের ঐকমত্য রয়েছে।

৪. বিয়ে-সংক্রান্ত এমন সব শর্ত, যেগুলো মুসলিম সমাজে প্রচলিত; যদিও তা সরাসরি বৈবাহিক চুক্তির দাবি কিংবা তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়, আবার তার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর নুসুসে কোনো নির্দেশও আসেনি। তবে তা শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।

হানাফি মাজহাবের স্বকীয়তা হলো, তারা এ ধরনের শর্তকেও বিবেচনায় নেন এবং এটাকেও সহিহ শর্তের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের উসুল হলো একটা ফিকহি মূলনীতি,

الثابت بالعرف كالثابت بالنص.

এই চার প্রকার শর্ত হলো সহিহ শর্ত। উপরিউক্ত হাদিসের কারণে এ চারও প্রকারের শর্ত মান্য করা অপরিহার্য।

কোনো শর্ত যদি এমন হয় যে, তা বৈবাহিক চুক্তির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক কিংবা সে ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে, তা হলে এমন শর্ত সব মাজহাবের ফতোয়ামতেই বাতিল।

উদাহরণস্বরূপ : স্বামী বিয়েতে শর্তারোপ করল,

* আমি তোমাকে বিয়ে করছি এ জন্য যে, তোমার আগের স্বামী, যে তোমাকে তিন তালাক দিয়েছে, তার জন্য যেন তুমি হালাল হয়ে যাও।

* আমি তোমাকে বিয়ে করেছি এ জন্য যে, যেন তুমি তোমার নিজের ওপর তালাক প্রয়োগ করো কিংবা তালাকের অধিকার তোমার হাতে থাকে। (উল্লেখ্য, এই শর্ত যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে হয়, তাহলে তা অপরিহার্য হয়ে যায়। কিন্তু স্বামী নিজের পক্ষ থেকে বিয়ের সঙ্গে এই শর্ত যোগ করতে পারে না। প্রকাশ থাকে যে, একটা হলো চুক্তির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে শর্তারোপ আর আরেকটা হলো অধিকার প্রদান, দুটো কিন্তু এক কথা নয়। তাই ভুল বোঝার কারণ নেই।)

* তোমাকে বিয়ে করলাম এই শর্তে যে, তোমাকে কোনো মোহর দেবো না বা তোমার ভরণপোষণ দেবো না কিংবা স্ত্রী বলল, শর্ত হলো, তুমি আমাকে কোনো ভরণপোষণ দেবে না ইত্যাদি।

* স্বামী শর্তারোপ করল, তুমি উপার্জন করে আমাকে খাওয়াতে হবে।

* কিংবা শর্ত হলো, আমি তোমার সতিনের সঙ্গে অধিক রাত থাকব আরর তোমার সঙ্গে কম রাত থাকব, তোমাকে এটা মেনে নিতে হবে।

* স্ত্রী শর্ত করল, আমি তোমার কথা মানব না কিংবা অনুমতি ছাড়াই যখনতখন তোমার ঘর থেকে বেরোব অথবা আমার আগের ঘরের বাচ্চাকাচ্চার দেখভাল তোমাকে করতে হবে ইত্যাদি।

* স্বামী এই শর্ত আরোপ করল যে, আমি তিনদিন বা একদিন তার সঙ্গে থাকব। ভালো লাগলে বিয়ে কার্যকর হবে। অন্যথায় বাতিল হয়ে যাবে। অথবা বলল, আমি তো তার দেহ দেখিনি। তাই দেখার শর্ত থাকল। কুমারী হলে বিয়ে কার্যকর থাকবে; অন্যথায় নয়। কিংবা বলল, মেয়ে নিখুঁত থাকতে হবে। যদি কোনো খুঁত পাই, তাহলে হবে না ইত্যাদি। ইমাম সারাখসি রহ. তার ‘আলমাবসুত’ গ্রন্থে বলেন,

وكذلك إن اشترط أحدهما على صاحبه السلامة من العمى والشلل ، والزمانة فوجد بخلاف ذلك لا يثبت له الخيار ، وكذلك لو شرط الجمال والبكارة ، فوجدها بخلاف ذلك لا يثبت له الخيار ; لأن فوت زيادة مشروطة بمنزلة العيب في إثبات الخيار كما في البيع ، وبهذا تبين أنه لا معتبر لتمام الرضا في باب النكاح فإنه لو تزوجها بشرط أنها بكر شابة جميلة فوجدها ثيبا عجوزا شوهاء لها شق مائل وعقل زائل ولعاب سائل ، فإنه لا يثبت له الخيار ، وقد انعدم الرضا منه بهذه الصفة .

* স্ত্রী শর্ত দিলো, আমাকে বিয়ে করার জন্য তোমার আগের স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। এর নিষিদ্ধতা তো সহিহ বুখারির ২৭২৩ নম্বর হাদিসেই বর্ণিত হয়েছে।

এবার আমরা আসি হানাফি মাজহাবের দৃষ্টিতে বাতিল ও ফাসিদ শর্তের আলোচনায়। আমরা আগেই বলেছি, উপরিউক্ত চারও প্রকারের বাইরে যত শর্ত হতে পারে, হানাফি মাজহাবের দৃষ্টিতে তা সবই বাতিল। অর্থাৎ বিয়ে হয়ে যাবে ঠিকই; কিন্তু শর্তগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই রহিত হয়ে যাবে। এর দুটোর আলোচনাও আবার ওপরে চলে গেছে। অর্থাৎ

* যা বৈবাহিক চুক্তির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক।

* কুরআন-সুন্নাহর নুসুসেই যে সকল শর্তকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ ছাড়াও যে সকল শর্ত না বৈবাহিক চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, আর না তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, না শরিয়ত তার বৈধতা দিয়েছে, আর না মুসলিম সমাজে তার সাধারণ প্রচলন রয়েছে এবং এর পাশাপাশি তাতে স্বামী-স্ত্রী কিংবা তৃতীয় কোনো হকদার ব্যক্তির উপকার রয়েছে এমন সব শর্তই বাতিল।

কেন?

কারণ, বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,

مَنْ اشْتَرَطَ شَرْطًا لَيْسَ فِي كِتَابِ اللَّهِ : فَلَيْسَ لَهُ ، وَإِنْ اشْتَرَطَ مِائَةَ شَرْطٍ

যে ব্যক্তি এমন কোনো শর্ত করল, যা আল্লাহর কিতাবে নেই, তা তার জন্য সাব্যস্ত হবে না; যদিও সে এক শ শর্ত করে।

হাফিজ ইবনু হাজার রহ. ‘ফাতহুল বারি’ গ্রন্থে (৫/১৮৮) বলেন,

المراد بما ليس في كتاب الله : ما خالف كتاب الله

‘আল্লাহর কিতাবে নেই’ হাদিসের এই কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যা আল্লাহর কিতাবের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ।

রাসুলুল্লাহ সা. আরও বলেন,

الْمُسْلِمُونَ عَلَى شُرُوطِهِمْ ، إِلَّا شَرْطًا حَرَّمَ حَلَالًا ، أَوْ أَحَلَّ حَرَامًا

মুসলমানরা তাদের শর্তের ওপর থাকবে; তবে এমন শর্ত বাদে, যা কোনো বৈধ কাজকে নিষিদ্ধ করে দেয়, কিংবা কোনো নিষিদ্ধ কাজকে বৈধ করে দেয়। (তিরমিজি : ১৩৫২; আবু দাউদ : ৩৫৯৪)

সুতরাং কোনো নারী যদি বিয়েতে শর্তারোপ করে,

* আমাকে আমার বাবার বাড়িতেই রাখতে হবে;

* আমাকে আমার জেলাশহরেই রাখতে হবে;

* আমি জীবিত থাকাকালে আর কোনো মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না;

* বিয়ের পর আমাকে ডাক্তারি শেষ করাতে হবে কিংবা দীনি অথবা দুনিয়াবি অমুক পড়ালেখা করাতে হবে

এসব শর্ত বাতিল হয়ে যাবে এবং বিয়ে তার স্বাভাবিক অবস্থায় কার্যকর থাকবে। তো যেহেতু এই শর্তগুলো কার্যকরই হয়নি, তাই স্ত্রীপক্ষও স্বামীর ওপর এসব ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। স্ত্রী যদি এখন স্বামীর স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি না নেয়, এমনকি তার তোয়াক্কা না করে স্বউদ্যোগে কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ির পরামর্শে তার শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে কিংবা বাবা-মা’র ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বা অন্য কোনো কারণে স্বামীর স্বতস্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি ব্যতিরেকেই বাবার বাড়িতে থাকতে থাকে তাহলে সে-ও হবে (নাশিজা) অবাধ্য। নাশিজার বিধান তার ওপর পুরোপুরিই প্রযোজ্য হবে। এমন নারীর দুনিয়া-আখিরাত উভয়টাই ধ্বংসের মুখে।

অন্য কোনো নারীকে বিয়ে না করার শর্ত প্রসঙ্গে ইমাম সারাখসি রহ. তার ‘আলমাবসুত’ গ্রন্থে বলেন,

والوفاء بهذا الشرط لا يلزمه, كما لو التزمه بنفسه

এই শর্ত মান্য করা তার ওপর আবশ্যক নয়। এমনকি সে নিজে নিজের ওপর আবশ্যক করে নিলেও তা আবশ্যক হবে না।

সুতরাং বিয়ের সময় যদি স্ত্রীকে পড়ানোর শর্ত থেকেও থাকে, (আর তা এমন শর্ত, যা বৈবাহিক চুক্তির অন্তর্ভুক্ত কিংবা তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু নয়, আবার তার সঙ্গে বিরোধপূর্ণও নয়, এটা হলো সাধারণ উপকারী শর্ত, যাতে খোদ স্ত্রীরই উপকার রয়েছে।) তবুও হানাফি মাজহাবের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বামীর জন্য তা মান্য করা অপরিহার্য নয়। এমনকি যদি নিজের ওপর সেই শর্তকে অপরিহার্য করে নেয়, তবুও তা অপরিহার্য হবে না। তবে যদি শর্ত পালন হিসেবে নয়; বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বামী এর অনুমতি দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা। অন্যথায় স্ত্রী যদি নতুন করে তার স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি না নিয়ে এ পথে পা বাড়ায়, তাহলে সে-ও নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ততার মধ্যে ফেলল। এখানে শুধু বাবা-মা কেন, পুরো পৃথিবী অনুমতি দিয়ে দিলেও তার কাজে আসবে না। তার নাম চলে যাবে নাশিজার তালিকায়।

যেকোনো মানুষ কোনো অন্যায় কর্মে দুভাবে লিপ্ত হয় : কখনো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তাতে লিপ্ত হয়। আর কখনো কারও পরামর্শে বা প্ররোচনায় তাতে লিপ্ত হয়। একজন নারী অবাধ্যতা করার পেছনেও এ দুটোর কোনো একটি কারণ কার্যকর থাকতে পারে। আমরা সমাজবাসীরা অবাধ্যতাকে যত সীমিত অর্থে বুঝে থাকি, এই সিরিজের পূর্বের লেখাগুলো যারা পড়েছেন, তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা, শরিয়তে অবাধ্যতার অর্থ ততটা সীমিয় নয়; বরং তারচে বেশ ব্যাপক।

নারীরা স্বভাবগতভাবে বাবাকে বেশি ভালোবাসলেও সাধারণত মা’র সঙ্গেই অধিক ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে। বিষয়টা যৌক্তিকও বটে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে সন্তান হওয়া পর্যন্ত জীবনের অনেক কঠিন কঠিন ধাপে মা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। মেয়েরা তাই খুব সহজেই মা’র আদর্শে প্রভাবিত হয়। মা’র দীনদারি কিংবা দুনিয়াদারি সবকিছুর ছোঁয়া মেয়েদের ওপর ভালোই পড়ে। মা’রা নামাজি-রোজাদার হলেও সাংসারিক অবাধ্যতার বিস্তর পরিধি সম্পর্কে তাদের অনেকেই থাকে বেখবর। হয়তো ফাজায়েল আমাল, হেকায়াতে সাহাবা বা এ ধরনের কোনো গ্রন্থ আদ্যোপান্ত মুখস্থ থাকলেও সংসারজীবনের অভ্যন্তরীণ মাসায়িল সম্পর্কে সাধারণভাবে খুব কম মা’রাই জ্ঞানী থাকেন। যারা জ্ঞানী থাকেন, তাদের সবার মধ্যেও মানার বৈশিষ্ট্য সমান থাকে না। তাই মা যদি সচেতন না হন, তাহলে এই পরম মমতাময়ী এক মা’ই অজ্ঞাতসারে বিষিয়ে তুলতে পারে মেয়ের সাংসারিক জীবন, তাকে করে তুলতে পারে স্বামীর অবাধ্য। আর যারা দীনদার না, তাদের ক্ষেত্রে এমনটা তো অনেকই ঘটে থাকে।

মেয়েরা অবাধ্য হয়ে ওঠার পেছনে কখনো নিজস্ব তৎপরতা থাকে, কখনো থাকে দুষ্ট মা’দের প্ররোচনা বা দীনদার মা’র ভুল সিদ্ধান্ত/পরামর্শ, কখনো থাকে ভাই-বোন কিংবা ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ওয়াসওয়াসা। এককথায় একজন নারীর অবাধ্য হয়ে ওঠার পেছনে কিংবা কোনো ক্ষেত্রে অবাধ্যতা করার পেছনে অনেক ধরনের কার্যকারণই বিদ্যমান থাকতে পারে। সবসময়ই তা শুধু নফস ও শয়তানের ধোঁকায় হয় না; কখনো তা কোনো আত্মীয় বা অনাত্মীয়, ঘনিষ্ঠ মানব-মানবীর প্ররোচনায় কিংবা ভুল পরামর্শেও হতে পারে। আর এ কারণেই তো বলা হয়েছে,

اطلبوا الجار قبل الدار.

ঘর খোঁজার আগে প্রতিবেশী খোঁজো।

সুতরাং সংসার সুখের হওয়ার জন্য শুধু স্ত্রী মনমতো হলেই হয় না; তার ফ্যামিলি এবং সার্কেলও প্রকৃত অর্থে ভালো হতে হয়। নইলে সব ঠিক থাকার পরও অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়।

আরবিতে একটা প্রবাদবাক্য আছে,

اطلبوا الجار قبل الدار، واطلبوا الرفيق قبل الطريق.

ঘর খোঁজার আগে প্রতিবেশী খোঁজো। পথ খোঁজার আগে সঙ্গী খোঁজো।

ভালো প্রতিবেশী/সহপাঠী/সঙ্গী/সহকর্মী না পেলে ভালো ঘর/বিদ্যালয়/যেকোনো অঙ্গন/চাকরিক্ষেত্র সব হয়ে যায় নিরানন্দ এবং বিস্বাদ। বাহ্যিক চাকচিক্য তখন বাহিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে; বাহ্যিকতা ছাড়িয়ে ভেতর ছুঁতে পারে না। একইভাবে অনেক সুন্দর কোনো পর্যটনকেন্দ্রের ভ্রমণও পুরোই মাটি হয়ে যেতে পারে অনুপযুক্ত সঙ্গীর সঙ্গে এবং উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে। এক্ষেত্রে অনক সময় সফরের আনন্দ নষ্ট করার জন্য ‘এক হি উল্লুও কাফি’ হয়ে যায়।

মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোতে দুটো বিষয়ের অনেক প্রভাব থাকে : (১) পরিবেশ এবং (২) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। যেমন মনে করুন, আপনি অনেক ভালো একজন মেয়েকে বিয়ে করলেন, যে তার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যে মর্তের মানবী হয়েও কেমন যেন স্বর্গের অপ্সরী। তো বাহ্যিক অবস্থার দাবি হলো, আপনার সংসারে অনেক সুখ এবং প্রশান্তি বিরাজ করবে; আপনি সুখের সাগরে ভাসবেন। কিন্তু অবস্থা যদি এমন হয় যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং পরিবেশ আপনাদের প্রতিকূল হয়ে যায়। ফলে আপনাদের দীনি কিংবা দুনিয়াবি সুখ-শান্তির ধারা ব্যাহত হতে শুরু করে। কিংবা আপনার স্ত্রী এতসব বৈশিষ্ট্যের আধার হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, অর্থাৎ তার পরিবারের সঙ্গে আপনার কোনোভাবেই মিলছে না তাহলে কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আপনি ভালো থাকতে পারবেন না। সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলতেই থাকবে প্রতিনিয়ত।

শুধু দুজন মানুষ মিলেই সংসার হয় না। সংসার হয় দুটো পরিবারের সংমিশ্রণে। এখন এই দুপরিবারই যদি অনুকূল না হয় বা আপনাদের রুচি-মানসিকতার সঙ্গে তাদের বৈরিতা থাকে তাহলে এ সমস্যা বাধাটা একেবারে যেন অনিবার্য একটা বিষয়; যা থেকে মুক্ত বোধ হয় খুব কম পরিবার।

এ জন্য বিয়ের ক্ষেত্রে শুধু মনমতো পাত্রী পেলেই তৃপ্তির ঢেকুর তোলা ঠিক নয়। কারণ, সাধারণভাবে কোনো পাত্রীকেই আপনি পরিবার থেকে আলাদা করে বিচার-বিবেচনা করতে পারবেন না। তাই বিয়েবাড়িতে ঢুকে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে শুধু পাত্রীকেই নয়; বরং পাত্রীর ঘরবাড়ির পরিবেশ এবং তার পরিবার-পরিজন সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নেয়া এবং নিজের অনুরূপ রুচি-মানসিকতা লালনকারী আত্মীয়স্বজন বাছাই করে নেওয়াটাই বুদ্ধির পরিচায়ক। একই সমীকরণ উল্টো পাশেও। তবে পাত্র যদি আত্মমর্যাদাবান, স্বনির্ভর এবং স্বাবলম্বী হয় তাহলে তার দিকে এর কিছুটা ব্যত্যয় থাকলেও সাধারণত তেমন সমস্যা হয় না।

এসব অনিষ্টের একটা সূত্র হলো, মেয়েরা সাংসারিক অনেক অভ্যন্তরীণ ব্যাপারও মা, বোন কিংবা বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করে। দুজনার সংসারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো দুজনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এগুলো বাইরে আলোচনা করার বিষয় নয়। আজকালকার মেয়েরা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিষয় তো আলোচনা করেই, অনেকে তো সেক্সের বিষয়গুলোও স্পষ্টভাবে বা আকার-ইঙ্গিতে অন্যদের সামনে তুলে ধরে। ফলে কখনো এমনও হয় যে, তার মুখে তার স্বামীর বিভিন্ন বর্ণনা শুনে পরনারী তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। যেগুলো কখনো জাদু করা, কখনো নজর দেওয়া আর কখনো-বা পরকীয়া পর্যন্তও গড়ায়। আর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আত্মীয়-অনাত্মীয় বহিরাগতদের পরামর্শ ঢালাওভাবে গ্রহণের ধারা তো অব্যাহত থাকেই।

মায়ের জন্যও কোনো অবস্থায় উচিত নয় মেয়ের সংসারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো। মেয়েকে এই-সেই পরামর্শ দিয়ে নাশিজায় পরিণত করা তো চরম পর্যায়ের গোনাহ। স্বামীর অজান্তে বা অনুমতি ছাড়াও মেয়েকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসা, তার সন্তুষ্টি ছাড়া মেয়েকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাড়িতে রেখে দেওয়া, মেয়ের সংসারজীবনে বিভিন্ন বাতিল বা ফাসিদ শর্ত জুড়ে দেওয়া, স্বামীকে না জানিয়েই মেয়েকে কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া, উদাহরণস্বরূপ : তার অজ্ঞাতসারেই তাকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা কিংবা তাকে কোনো জবে লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। মা তিনি মা হতে পারেন, তবে তার খেয়াল রাখা উচিত উমর রা.-এর সেই ঐতিহাসিক বাণী :

النكاح رق ، فلينظر أحدكم عند من يرق كريمته

বিয়ে হলো দাসত্ব। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন ভালো করে দেখে নেয়, কার কাছে নিজেদের সম্মানিত মেয়েক্র দাসী বানাচ্ছে।

সুতরাং মেয়ে যার কাছে দাসীসদৃশ রয়েছে, তার অনুমতি ছাড়া কিংবা তার থেকে আগ বেড়ে নিজের থেকে কোনো পণ্ডিতি করা মা’দের জন্য কখনোই শোভনীয় নয়। মেয়ের সংসার মেয়েকেই করতে দেওয়া উচিত। মেয়ে তো ছোট মানুষ, এ অজুহাত দেখিয়ে তার সংসারে নিজের নাক গলানো উভয়ের জন্যই ধ্বংসের কারণ। মুসনাদু আহমাদ গ্রন্থে এক সহিহ হাদিসে এসেছে,

من أفسد امرأة على زوجها فليس منا

যে কোনো নারীকে তার স্বামীর ওপর বিশৃঙ্খল করে দেয়, সে আমাদের (অর্থাৎ মুসলিমদের) অন্তর্ভুক্ত নয়।

‘যে’ কথাটা ব্যাপক। এই ‘যে’ হতে পারে মা-বাবা, হতে পারে ভাই-বোন, আবার হতে পারে কোনো অনাত্মীয় বান্ধবী বা ঘনিষ্ঠজন। যে-কেউই এমনটা করুক না কেন, সে নিজেকে মুসলিম পরিচয় দেওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে। এটা কত ভয়াবহ গোনাহ হলে রাসুল সা. এত বড় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে পারেন! মানুষ অবাধ্য নারীদের চেনে; কিন্তু তাদের অনেকেরই অবাধ্যতার পেছনের গল্প জানে না। অবাধ্যতার কারণে সে-ও অবশ্যই পাপী; সাধারণ পাপী নয়, বরং মহাপাপী। কিন্তু যে তাকে জোরপূর্বক অবাধ্য করে তুলেছে কিংবা নাটের গুরুর মতো পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে, সে যে-ই হোক না কেন, সে আরও বড় পাপী।

এখন যে মা-বাবারা বিয়ের পরও মেয়েকে ছোট ভেবে কিংবা ভালোবাসার আতিশয্যে তার ওপর পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করে রাখে, এবং আবেগের শিরোনামে মেয়েকে অবাধ্যতায় আক্রান্ত করে তোলে, তাদের নিজেদের আখিরাত সম্পর্কে ভাবা উচিত। তারা যদি নামাজি-রোজাদারও হয়, এরপরও এসব হাক্কুল ইবাদ নষ্ট করার কারণে আল্লাহর আদালতে কিছুতেই পার পাওয়ার কথা নয়; যদি না বান্দার ক্ষমা নসিবে জোটে।

আর যে নারীরা কারও কথা শুনে স্বামীর সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে স্বাধীনচেতা হয়ে থাকতে চায়, তাদের আল্লাহর রাসুলের হাদিস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত :

لا تجد امرأة حلاوة الإيمان حتى تؤدي حق زوجها ولو سألها نفسها وهي على ظهر قَتَب

কোনো নারী ইমানের মিষ্টতা আস্বাদন করবে না, যতক্ষণ না সে স্বামীর হক আদায় করবে; যদিও স্বামী তাকে এমতাবস্থায় কামনা করে, যখন সে উটের হাওদার ওপর। (ইমাম হাইসামি ‘মাজমাউজ জাওয়ায়িদ’ গ্রন্থে (৪/৩০৯) বলেন, এই হাদিসের বর্ণনাকারী সকলে সহিহ’র বর্ণনাকারী।)

সুতরাং রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়লেই ইমানের মিষ্টতা অর্জিত হয়ে যায় না, দিনভর কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকলে বা রাতদিন মিলিয়ে ১০/২০ হাজারবার তাসবিহ পাঠ করলেও ইমানের স্বাদ অর্জিত হবে না, যতক্ষণ না স্বামীর হক আদায় করে। এর আগে যদি ভেতরে কোনো স্বাদ অনুভব করেও, তবে স্মরণ রাখা উচিত, তা আসলে ইমানের স্বাদ নয়; বরং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। শয়তানে এভাবে ধোঁকায় রেখে তার আখিরাত বরবাদ করতে চায়। হাদিসে তো স্পষ্ট বলাই হলো, নারী যদি প্রচণ্ড ব্যস্তও থাকে, এমনকি উটের হাওদার ওপরও থাকে, আর সে অবস্থায় স্বামী তাকে শুধু ডাকেইনি, বরং বিছানায়ও আহ্বান করেছে, এরপরও স্ত্রীর জন্য তৎক্ষণাতই তার আহ্বানে সাড়া দেওয়া অপরিহার্য। অন্যথায় সে হবে ইমানের স্বাদ থেকে বঞ্চিত এবং ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। আজকাল তো মেয়েরা রান্নাঘরে কিছুসময় আগুনের সামনে থাকলেই আর স্বামীর ডাক শুনেও শুনতে চায় না, স্বামী কিছু বললে বা কোনো কিছু চাইলে উল্টো আরও বিরক্ত হয়। হায়, তারা যদি জানত, এই ছোট ছোট বিষয়গুলো আখিরাতের সফরে তাদের কতটা পেছনে ফেলে দিচ্ছে!

উল্লেখ্য, সমাজে এমন জিনিসের সংখ্যাও কম নয়, বাহ্যত যেগুলোকে নারীদের অবাধ্যতা মনে করা হয়, অথচ তা অবাধ্যতা নয়; বরং তার প্রাপ্য অধিকার। একইভাবে এমন জিনিসের তো কোনো শেষই নেই, যেগুলোকে অবাধ্যতা মনে করা হয় না, অথচ তা নিখাদ অবাধ্যতা। ‘নুশুজ’ বা অবাধ্যতা শুধু নারীদের থেকেই নয়; বরং পুরুষের থেকেও হয়। এ জন্য নারী যেমন ‘নাশিজা’ হয়; পুরুষও তেমনি ‘নাশিজ’ হতে পারে। আমরা আশা করি, আমাদের এ ধারাবাহিক আলোচনা প্রসঙ্গে ধীরে ধীরে সে বিষয়গুলোও উল্লেখিত হবে।

একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা আল্লাহর বিধান মানার মধ্যে; যুক্তি কিংবা প্রবৃত্তির পূজা করার মধ্যে নয়। আল্লাহ যা হালাল করেছেন, মুমিন দ্বিধাহীন চিত্তে তা হালাল হিসেবে মেনে নেয়। আল্লাহ যা হারাম করেছেন, মুমিন নির্দ্বিধায় তা হারাম হিসেবে মেনে নেয়। এসব তার যুক্তিকে ধরুক কিংবা না ধরুক। এসব তার প্রবৃত্তির অনুকূল হোক কিংবা না হোক

একদিন আয়িশা রা. রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসুল,

نرى الجهاد أفضل الأعمال. أفلا نجاهد؟

আমরা তো দেখছি, জিহাদ হলো সর্বোত্তম আমল। তবে আমরা কি জিহাদ করব না?

রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,

لا، ولكن جهادكن الحج.

না, তবে তোমাদের জিহাদ হলো হজ।

পুরুষের জন্য কিতাল কত কষ্টের! আল্লাহ নিজেই বলছেন, ‘তোমাদের ওপর কিতালকে ফরজ করা হয়েছে। অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়।’

কিতাল যে মানুষের কাছে কতটা অপছন্দনীয় এবং এ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ যে কতটা প্রচেষ্টারত, তা শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই নয়; বড় সংখ্যক মৌলবিদের ক্ষেত্রেও যথার্থ এবং দিবালোকের মতো স্পষ্ট। জিহাদের যে এত অপব্যাখ্যা, এর মূল কারণও এটাই। ভীতু এবং মুনাফিকরা চিরকালই তাই এতে অপব্যাখ্যার ধারা অব্যাহত রেখেছে।

যুক্তির দাবি হলো, জিহাদ যখন এত ফজিলতের বিষয়; নারীরা তবে কেন এর থেকে পিছিয়ে থাকবে? কিন্তু শরিয়ত তো যুক্তিপূজার নাম নয়। আল্লাহ এবং তার রাসুলের বিধান নারীদের ব্যাপারে ভিন্ন কিছু নির্দেশ করেছে, তাই তারা সাধারণভাবে রণাঙ্গনে নেমে সশস্ত্র লড়াই থেকে বিরত থাকবে। অন্যান্য সেক্টরের দীনি খেদমত আঞ্জাম দেবে।

ইবাদত মানেই হলো আল্লাহর জন্য চূড়ান্ত আনুগত্য এবং বিনয়। আল্লাহ যা বলেছেন, বিনা বাক্যব্যয়ে তার সামনে নির্দ্বিধ আত্মসমর্পণ। আল্লাহ নারীদের অন্যতম ইবাদত বানিয়েছেন স্বামীর আনুগত্যকে। এটা কঠিন হলেও কিতালের চাইতে কষ্টকর নয়। কারণ, এখানে সময় এবং শ্রম ব্যয় হলেও সম্পদ এবং জীবনোৎসর্গ হয় না। কিতালকেই যখন বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে হয়, আল্লাহর ডাকে সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে রৌদ্রময় দিনে মরুর দেশে হজ করতে হয়, স্বামীর আনুগত্যের ক্ষেত্রে তা তো আরও বেশি প্রযোজ্য হওয়ারই কথা।

শুধু নারীরাই যে পুরুষের খেদমত করে, বিষয়টা তা নয়। পুরুষরা দিনভর কায়িক পরিশ্রম করে নারীদের আর্থিক খেদমত করে, আর নারীরা তাদের জন্য ঘরোয়া খেদমত আঞ্জাম দেয়। একজন সামলায় ঘর, একজন সামলায় বাহির। নারীর তুলনায় পুরুষের শ্রম, মেধা ও সময় ব্যয়িত হয় অনেক বেশি। একজন নারীর জন্য পুরুষ তার জীবনটাকে উৎসর্গ করে রাখে, তার উপস্থিতিতে নারীকে আর আলাদা করে কোনো কিছু ভাবতে হয় না। তো এসব কারণে নারী তার ঘরটুকু অন্তত সামলে রাখবে এবং তার বাবুদের যত্ন নেবে, এটা খুব বড় কোনো বিষয় নয়। তা ছাড়া বাবুরা তো শুধু স্বামীর নয়; তারও। এগুলো কোনোটা কোনোটার বিনিময় নয়। উভয়ের যৌথ সাধনায় পূর্ণতা পায় একটা সংসার। এর কোথাও ত্রুটি থাকলে সংসারও ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়।

আল্লাহ নারীর ওপর স্বামীর একান্ত আনুগত্য অপরিহার্য করেছেন, এটা নারীদের জন্য স্বামীর দাসত্ব নয়; বরং এটা তাদের জন্য আল্লাহরই দাসত্ব। তারা তাদের স্বামীদের ওপর কোনো করুণাও করছে না; বরং তারা সেরেফ আল্লাহর বিধান পালন করছে। আল্লাহ যার ওপর যা অবধারিত করেন, সে তা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিলেই কেবল পাবে ইহকাল এবং পরকালে শান্তি ও মুক্তি।

মুসা আ.-এর উম্মতের ওপর আল্লাহ কিসাস ফরজ করেছিলেন। ইসা আ.-এর উম্মতের ওপর তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করাকে অপরিহার্য করেছিলেন। তো এগুলো মৌলিকভাবে কোনো কিছুই নয়। মুসলমানের সফলতা সেরেফ আল্লাহর বিধান মানার মধ্যে। বিধান যে সময়ে যা-ই হোক এবং যেমনই হোক। এ জন্য রাসুলের হিজরতের পর যখন মুসলমানদের কিবলা মসজিদে হারামের পরিবর্তে মসজিদে আকসাকে নির্ধারণ করা হয় তখন অনেক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করে কাফির হয়ে গিয়েছিল। তারা কিবলা পরিবর্তনের বিষয়টা মেনে নিতে পারছিল না। আল্লাহ বলেন, ‘আমি এই বিধান দিয়েছিলাম, যেন আমি যারা উল্টো পায়ে পেছনে ফিরে যায় তাদের থেকে আলাদা করে জানতে পারি, কারা রাসুলের অনুসরণ করে।’

জিহাদের বিধানের ব্যাপারেও তিনি বলেন, ‘এ বিধান তিনি দিয়েছেন, যাতে তিনি মুমিনদের জানতে পারেন এবং জানতে পারেন ওই সব লোকদের, যারা নিফাকে আক্রান্ত হয়েছে।’

নারীদের জন্য স্বামীর আনুগত্যের বিষয়টিও এমন। তারা স্বামীর একান্ত অনুগত থাকবে। কেন? কারণ, আল্লাহ এবং তার রাসুল নির্দেশ দিয়েছেন। এখন এর ওপর কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা, এই বিধানের ব্যাপারে অভিযুগের সুর তোলা কিংবা আল্লাহর ব্যাপারে একধরনের অসন্তুষ্টি জাহির করা বড় খতরনাক; যা ইমানের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।

আজকাল দীনদার নারীরাও নিজেদের অজান্তে অনেক সময় অনুযোগের সুরে কথা বলে। বোঝা যায়, তারা আল্লাহর এই বিধানকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই সময়ে সময়ে ভেতরে বেদনার অনুরণন বাজে। তাকদিরের প্রতি মনোবেদনা প্রকাশ করে আনুগত্য তো করে যায়; কিন্তু ভেতরে একধরনের অনুতাপ, অনুশোচনা ও অনুযোগ থেকেই যায়। এ বিষয়গুলো যে সূক্ষ্ম নিফাক, তা খুব কম মানুষই জানে।

আল্লাহ এবং তার রাসুলের প্রতিটা বিধানকে মনোতুষ্টির সঙ্গে, আন্তরিক সন্তুষ্টি ও ভালোবাসার সঙ্গে, নিঃসঙ্কোচে নির্দ্বিধায় এবং কোনোপ্রকার অনুযোগ-অনুতাপ ছাড়াই যারা গ্রহণ করে, একমাত্র তারাই মুমিন, তারাই আল্লাহ এবং তার রাসুলের একনিষ্ঠ অনুসারী। আমি অনেক দীনদার নারীকেও ‘নারী হওয়ার অনুতাপ’ করতে দেখেছি। তাকদিরের প্রতি অস্পষ্ট অনুযোগ করে ‘বাধ্যতাপূর্বক (অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত নয়) ‘স্বামীর আনুগত্য’ করতে দেখেছি। এ বিষয়গুলো নারীদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের বরবাদির কারণ।


[1] সুরা রাদ : ৩৮

[2] সহিহ বুখারি : ৫০৬৩; সহিহ মুসলিম : ১৪০১

[3] হাদীসে ‘যুব সম্প্রদায়’ কাদের বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে ইমাম নাবাবী লিখেছেন-

আমাদের লোকদের মতে যুবক-যুবতী বলতে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে যারা বালেগ [পূর্ণ বয়স্ক] হয়েছে এবং ত্রিশ বছর বয়স পার হয়ে যায়নি।

আর এ যুবক-যুবতীদের বিয়ের জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকীদ করলেন কেন, তার কারণ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তার বিশ্ববিখ্যাত বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থ “উমদাতুল ক্বারী” গ্রন্থে লিখেছেনঃ

“হাদীসে কেবলমাত্র যুবক-যুবতীদের বিয়ে করতে বলার কারণ এই যে, বুড়োদের অপেক্ষা এ বয়সের লোকদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা ও দাবী অনেক বেশী বর্তমান দেখা যায়। যুবক-যুবতীদের বিয়ে যৌন সম্ভোগের পক্ষে খুবই স্বাদপূর্ণ হয়। মুখের গন্ধ খুবই মিষ্টি হয়, দাম্পত্য জীবন যাপন খুবই সুখকর হয়, পারস্পরিক কথাবার্তা খুবই আনন্দদায়ক হয়, দেখতে খুবই সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, স্পর্শ খুব আরামদায়ক হয় এবং স্বামী বা স্ত্রী তার জুড়ির চরিত্রে এমন কতগুলো গুণ সৃষ্টি করতে পারে যা খুবই পছন্দনীয় হয়, আর এ বয়সের দাম্পত্য ব্যাপার প্রায়ই গোপন রাখা ভাল লাগে। যুবক বয়স যেহেতু যৌন সম্ভোগের জন্য মানুষকে উন্মুখ করে দেয়। এ কারণে তার দৃষ্টি যে কোন মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে এবং সে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতায় পড়ে যেতে পারে। এজন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বয়সের ছেলেমেয়েকে বিয়ে করতে তাকীদ করেছেন এবং বলেছেনঃ বিয়ে করলে চোখ যৌন সুখের সন্ধানে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে না এবং বাহ্যত তার কোন ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এ কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যদিও কথা শুরু করেছেন যুবক মাত্রকেই সম্বোধন করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের এ তাকীদকে নির্দিষ্ট করেছেন কেবল এমন সব যুবক-যুবতীদের জন্য যাদের বিয়ের সামর্থ্য আছে। আর যারা বিয়ের ব্যয় বহনের সঙ্গতি রাখে না তারা সওম পালন করবে। সওম পালন তাদের যৌন উত্তেজনা দমন করবে। কারণ পানাহারের মাত্রা কম হলে যৌন চাহিদা প্রশমিত হয়।

[4] সহিহ বুখারি : ৫০৬৬; সহিহ মুসলিম : ১৪০০

[5] মুসান্নাফ, আবদুর রাজ্জাক : ৬/১৭০

[6] প্রাগুক্ত।

[7] শুআবুল ইমান, বায়হাকি : ৫৪৮৬

[8] মুফতিয়ে আজম বাংলাদেশ মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (হাফিজাহুল্লাহ)-এর ফতোয়ার আলোকে রচিত। বিস্তারিত জানতে দ্রষ্টব্য : মাকালাতে চাটগামী

Share This