আরজ আলী সমীপে বইটা আরিফ আজাদ ভাইয়ের প্রশংসনীয় একটা উদ্যোগ। এমন উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল আরও আগেই। যাক, দেরিতে হলেও আল্লাহ তাআলা প্রিয় ভাইটির দ্বারা এই গুরুত্বপূর্ণ খেদমতটি আঞ্জাম দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা লেখককে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

বইটা পড়ে ভালোই লাগছে। লেখক যে এর পেছনে যথেষ্ট শ্রম ব্যয় করেছেন, এর প্রমাণ পাওয়া যায় পাতায় পাতায়। তবে কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য তাড়াহুড়োরও একটা ছাপ রয়েছে। তবে সবমিলিয়ে বইটা মুগ্ধ করার মতো। বইটি নিয়ে সার্বিক মূল্যায়ন করার জন্য এ পোস্ট নয়। মূলত বইটি পড়তে গিয়ে কয়েকটা পয়েন্টে দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল। আমার অজ্ঞানতা বা সীমাবদ্ধতার কারণে কিছুটা খটকা লেগে গিয়েছিল। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই পয়েন্টগুলো ফোকাস করা; যাতে বিষয়টা আদতেই আপত্তিজনক হলে লেখক শুধরে নিতে পারেন আর আদতে আপত্তিজনক না হলে আমার খটকা কেটে যেতে পারে। এ জন্য পুরো বইয়ের সবগুলো পয়েন্ট একসাথে তুলে না এনে একটা-দুটো করে আলোচনা করাই আমার কাছে অধিক উপকারী মনে হয়েছে। তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত দীর্ঘ পোস্ট পড়াটা অনেকের জন্যই কষ্টকর। নিয়মিত পাঠকরাও দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে বুরিং ফিল করেন। এ ক্ষেত্রে আমরা ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে বিক্ষিপ্তভাবে পয়েন্টগুলোকে আলোচনায় আনব।

১. কুরআন, হাদীস এবং মাযহাবের ইমামদের মতামত থেকে জানা গেল যে, আল্লাহ আরশেই আছেন, কিন্তু তাঁর জ্ঞান সর্বব্যাপী। {ঈশ্বর-সংক্রান্ত আলোচনার তৃতীয় পয়েন্ট}

মন্তব্য : লেখক এর পূর্বে বলে এসেছেন,

মূলত আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের ওপরে রয়েছেন। তিনি সকল বস্তুর মধ্যে বিরাজমান নন; বরং তাঁর জ্ঞান ও দৃষ্টিই সকল বস্তুকে ঘিরে আছে। এটাই হলো আল্লাহর সর্বব্যাপিতা।

লেখকের এই অভিমত নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর ইমামগণও সাধারণভাবে এভাবে বলে থাকেন। তবে এই অভিমত এবং উপরিউক্ত অভিমত দুটো বাহ্যত কেউ এক ভেবে থাকলেও আদতে এক নয়। মূলত আল্লাহ আরশের ওপর রয়েছেন কথাটির একাধিক অর্থ রয়েছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর ইমামগণ এটাকে এক অর্থে বলে থাকেন আর দেহবাদী (মুজাসসিমা)-রা এটাকে আরেক অর্থে বলে থাকে। প্রথম অর্থে এটা সহিহ হলেও দ্বিতীয় অর্থে এটা নেহাত গলদ।

আমরা আগেই বলেছি, আল্লাহ তাআলা আরশের ওপর রয়েছেন এই বাক্য নিয়ে আমাদের আপত্তি নয়। আমাদের আপত্তি হলো আল্লাহ আরশেই আছেন নিয়ে। প্রথম বাক্যটা যেহেতু একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে আর এটাকে এক অর্থে আহলুস সুন্নাহর ইমামগণও বলে থাকেন, তাই প্রথমত সেই বাক্য দেখলে আমরা সেই অর্থই বুঝব, যা তাঁরা বুঝেছেন। কিন্তু দুপৃষ্ঠা পরই যখন দ্বিতীয় বাক্যের প্রয়োগ দেখা যায় তখন কেন যেন মনে হয়, প্রথম বাক্যটির দ্বারা লেখক সে অর্থ বুঝেননি বা বোঝাননি, যা আহলুস সুন্নাহর ইমামগণ বুঝিয়েছেন; বরং এ ক্ষেত্রে তিনি বিষয়টা বুঝতে ভুল করেছেন বা উপস্থাপন করতে ভুল হয়েছে, যার ফলস্বরূপ উপসংহারও এসেছে ভুল।

আল্লাহ আরশে রয়েছেন এই কথাটা আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। কারণ, সালাফে সালেহিনের আকিদা হলো, আল্লাহ তাআলা আরশের ওপর/ঊর্ধ্বে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার মর্যাদা আরশের চাইতেও ঊর্ধ্বে কিংবা আল্লাহ তাআলা আরশের থেকে অমুখাপেক্ষী। এমন নয় যে, আরশ হলো কোনো আধার বা রাজসিংহাসন আর আল্লাহ তাআলা তার ওপর অধিষ্ঠিত/উপবিষ্ট রয়েছেন। এগুলো তো দেহবিশিষ্ট মাখলুকের সিফাত। আর আল্লাহ তাআলা তো দেহ থেকে, মাখলুকের গুণাবলি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। যার কারণে আল্লাহ তাআলা আরশের ওপরে/ঊর্ধ্বে রয়েছেন আর আল্লাহ তাআলা আরশে রয়েছেন দুটো কথাকে আমার কাছে সমার্থক মনে হয় না। কারণ, প্রথম কথার দ্বারা আল্লাহ তাআলার মর্যাদাগত উচ্চতা বোঝানো হচ্ছে; সত্তাগত কিংবা দৈহিক অবস্থান নয় কিংবা এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার অমুখাপেক্ষিতা বোঝানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় কথার মধ্যে আল্লাহ তাআলাকে কেমন যেন দেহবিশিষ্ট কল্পনা করে আরশকে আল্লাহ তাআলার জায়গা বা রাজসিংহাসন বলে আখ্যা দেওয়ার ভাব রয়েছে।

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,

“السلف ، والأئمة ، وسائر علماء السنَّة إذا قالوا : ” إنه فوق العرش ” ، و ” إنه في السماء فوق كل شيء ” : لا يقولون إن هناك شيئاً يحويه ، أو يحصره ، أو يكون محلاًّ له ، أو ظرفاً ، ووعاءً ، سبحانه وتعالى عن ذلك ، بل هو فوق كل شيء ، وهو مستغنٍ عن كل شيءٍ ، وكل شيءٍ مفتقرٌ إليه ، وهو عالٍ على كل شيءٍ ، وهو الحامل للعرش ، ولحملة العرش ، بقوته ، وقدرته ، وكل مخلوق مفتقرٌ إليه ، وهو غنيٌّ عن العرش ، وعن كل مخلوق .

সালাফ ও ইমামগণ এবং আহলুস সুন্নাহর অন্য সকল আলিমগণ যখন বলেন, ‘আল্লাহ আরশে’ অথবা ‘তিনি আকাশে সকল কিছুর ওপরে’ তখন তারা এর দ্বারা এ উদ্দেশ্য নেন না যে, সেখানে এমন কিছু রয়েছে, যা আল্লাহকে বেষ্টন করে রাখে কিংবা তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে অথবা তা হলো তার স্থান, আধার কিংবা পাত্র। আল্লাহ তাআলা এসব কিছু থেকে পবিত্র। বরং তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী। সকল কিছু তার মুখাপেক্ষী। তিনি সকল কিছুর ওপর সুউচ্চ। তিনিই আরশের ধারক, আরশ বহনকারী ফেরেশতাদেরও ধারক; তার শক্তির মাধ্যমে, তার ক্ষমতার মাধ্যমে। গোটা সৃষ্টি তার দিকে মুখাপেক্ষী। তিনি আরশ থেকে এবং সকল মাখলুক থেকে অমুখাপেক্ষী। {মাজমুউল ফাতাওয়া : ১৬/১০০-১০১}

আল্লাহ্‌ তাআলা কোথাও অবস্থিত এটা তো একটা অবান্তর ধারণা। স্থান এবং দিক, স্থানের ধারণা, দিকের ধারণা, এটা তো আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি।

আল্লাহ তাআলা মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন, আল্লাহ তাআলা তেমনই আছেন। স্থান, কাল, দিক ইত্যাকার বিষয়সমূহ আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। আল্লাহ্‌ তা’আলা এসব থেকে পবিত্র। এসব আল্লাহ তাআলার জন্য কিছু বৃদ্ধিও করে না, সংকোচনও করে না। আল্লাহ তাআলা তার সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী। ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর কথা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য—‘যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়?’ ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর উত্তরে বলেন—‘তাকে বলা হবে , সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোনো স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তাআলা ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিল না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা।’ [আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৫৭]

‘আল্লাহ তা’আলা আরশের ঊর্ধ্বে আছেন’—এই কথা দিয়ে কী বোঝানো হয়?

১. আল্লাহ্‌ তা’আলা আরশ থেকে অমুখাপেক্ষী।
২. আল্লাহ্‌ তা’আলা মর্যাদা আরশের চেয়ে বেশি।

তৃতীয় আরেকটি জিনিস বোঝানো হয় এই কথা দিয়ে। আর তা হলো আল্লাহ তাআলা দিক হিসেবে আরশের ওপরে।

وهو ما فوق العرش
وليس هناك غيره
এটা একটা ভ্রান্ত কথা। এমন কথা বলে আল্লাহ তাআলার মর্যাদা বর্ণনা করা হলো, যা না আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন, আর না হাদিসে এসেছে এই কথা।

লেখক একই আলোচনার অধীনে আয়াতের অনুবাদে ‘ইসতাওয়া’ অর্থ করেছেন—//দয়াময় আল্লাহ আরশের ওপর উঠেছেন//, //তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের ওপর উঠেছেন//।

‘ইসতাওয়া’কে আমরা মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত মনে করি। তাই সতর্কতার দাবি হিসেবে আমরা এর তরজমা করা থেকেও বিরত থাকি। যেমন আল্লামা তাকি উসমানি (হাফিজাহুল্লাহ) বলেন,

‘ইসতিওয়া আরবি শব্দ। এর অর্থ সোজা হওয়া, কায়েম হওয়া, আয়ত্তাধীন করা ইত্যাদি। কখনো এ শব্দটি বসা ও সমাসীন হওয়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা যেহেতু শরীর ও স্থান থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তাই তাঁর ক্ষেত্রে শব্দটি দ্বারা এরূপ অর্থ গ্রহণ সঠিক নয় যে, মানুষ যেভাবে কোনো আসনে সমাসীন হয়, তেমনিভাবে (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ তাআলাও আরশে উপবিষ্ট ও সমাসীন হন। প্রকৃতপক্ষে “ইসতিওয়া” আল্লাহ তাআলার একটি গুণ। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মতে এর প্রকৃত ধরন-ধারণ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তাদের মতে এটা মুতাশাবিহাত (দ্ব্যর্থবোধক) বিষয়াবলির অন্তর্ভুক্ত, যার খোড়াখুড়িতে লিপ্ত হওয়া ঠিক নয়। সুরা আলে ইমরানের শুরুভাগে আল্লাহ তাআলা এরূপ মুতাশাবিহ বিষয়ের অনুসন্ধানে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। এ হিসেবে এর কোনো তরজমা করা সমীচীন মনে হয় না। কেননা এর যেকোনো তরজমাতেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ আছে। এ কারণেই আমরা এ স্থলে তরজমা করিনি। তা ছাড়া এর ওপর কর্মগত কোনো মাসআলা নির্ভরশীল নয়। এতটুকু বিশ্বাস রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা নিজ শান অনুযায়ী ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেছেন, যার স্বরূপ ও প্রকৃতি উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি মানুষের নেই।’ {তাফসিরে তাওজিহুল কুরআন : ১/৪২৯}

মাওলানা আবদুল মালেক (হাফিজাহুল্লাহ)-কেও দুমজলিসে হুবহু এ মত প্রদান করতে দেখেছি।

তবে এ ক্ষেত্রে সালাফি ঘরানার আলিমগণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। যেমন এ বইয়ের শরয়ি সম্পাদক শাইখ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া (হাফিজাহুল্লাহ)-কে এ মাসআলার ব্যাপারে যে অভিমত প্রদান করতে দেখেছি, তা হলো—

‘১- ইস্তেওয়া শব্দটির অর্থ করতে হবে।
২- ইস্তেওয়া শব্দটির চারটি অর্থ সালাফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয়েছে: صعد (উপরে উঠেছেন) বা علا (উপরে উঠেছেন) বা ارتفع (উপরে উঠেছেন) বা استقر (উপরে রইলেন)
৩- সিফাতের অনুবাদ করা হবে। কিন্তু ধরন নির্ধারণ করা যাবে না।
৪- কোনোক্রমেই সৃষ্টিকুলের কারো সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যের ধারণা মাথায় আসতে পারবে না।
৫- এগুলো সাব্যস্ত করতে গিয়ে তাহলে তো/ কথার দাবী/ পরিণাম ফল/ ইত্যাদি কিছু একেবারেই অচল।’

যেহেতু এ ক্ষেত্রে সালাফি ঘরানার আলিমদের ভিন্ন মতামত রয়েছে, শুধু শাইখ যাকারিয়াই নন, আরবের আরও অনেকের মতামতই এ ব্যাপারে উদ্ধৃত করা যাবে, যদিও তা দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ, তাই এ ব্যাপারটিকে আমরা না হয় এভোয়েড করে গেলাম।

একই আলোচনার অধীনে লেখক একটা আয়াতের অনুবাদ এভাবে করেছেন—

তোমরা কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছ যে, যিনি আরশের ওপরে আছেন তিনি ভূমিসহ তোমাদের ধ্বসিয়ে দেবেন না। {সুরা মুলক : ১৬}

এখানে কুরআনের শব্দ হলো ‘ফিস সামা’, যার শাব্দিক অর্থ হতে পারে আকাশে/আসমানে। ‘ফিস সামা’র অনুবাদ //আরশের ওপরে আছেন// বলাটা নিতান্ত অযৌক্তিক। কুরআনের অনুবাদে এ ধরনের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ আছে বলে আমার জানা নেই। এর পরবর্তী হাদিসে তিনি আবার //সে বলল, আসমানে// অনুবাদ করেছেন। এ হিসেবে বোধ হয়, লেখক আয়াতের অনুবাদে অসতর্কতাবশত ভুল করেছেন।

একইভাবে ইমাম আবু হানিফার বক্তব্য অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি লেখেন //কেননা, ওপরে থাকার জন্যই আল্লাহকে ডাকা হয়। নিচে থাকার জন্য নয়। আর নিচে থাকাটা আল্লাহর রুবুবিয়্যাত এবং উলুহিয়্যাতের গুণের কিছুই নয়। {আল-ফিকহুল আবসাত : ৫১}//

এখানে ওপরে থাকা ও নিচে থাকা কথা দুটো আল্লাহ তাআলা কোথাও অবস্থান করেন—এ ধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে। কারণ, এখানে ওপরে থাকা ও নিচে না থাকা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ এই শব্দের দ্বারা অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়।

ইমাম আবু হানিফার ইবারত হলো,

والله تعالى يدعى من أعلى لا من أسفل لأن الأسفل ليس من وصف الربوبية والألوهية في شيء

‘মিন আ‘লা; লা মিন আসফাল। লি আন্নাল আসফাল লাইসা…।’ এখানে মিন আ‘লা এবং মিন আসফাল শব্দদ্বয়ের মধ্যে থাকার অর্থ কোথা থেকে আসল, তা বোধগম্য নয়।

লেখক ইমামদের অভিমত অনুবাদ করতে গিয়ে যে কাজটি করেছেন, তিনি ‘ফিস সামা’ (আকাশে) শব্দটি যতবারই এসেছে প্রতিবারই এর অনুবাদ করেছেন, আকাশের ওপর। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়তো ইমাম ইবনু আবদিল বার বা শাইখ উসাইমিনের একটা মন্তব্যের অনুসরণ করেছেন। যেহেতু এ ক্ষেত্রে আকাশে বললে আল্লাহ তাআলার জন্য একটা জায়গায় অবস্থান করার বিভ্রম হয়, তাই হয়তো তিনি এমনটা করেছেন।

আমাদের কথা হলো, আকাশে আছেন বললে যদি এ বিভ্রম সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে আরশে আছেন বললেও তো একই বিভ্রম সৃষ্টি হয়। নসের অনুবাদ করতে গিয়ে দুজায়গায় কেন দুনীতির অনুসরণ করা হলো? আকাশের ওপর বলার দ্বারা যদি বিভ্রম কেটে যায় তাহলে আরশের ওপর বলার মাধ্যমে কেন তিনি বিভ্রম না কাটিয়ে আরশে আছেন বলে এমন বিভ্রম সৃষ্টি করলেন, প্রাথমিক পাঠককে যা মারাত্মক বিভ্রান্তিতে ফেলতে পারে! আর হাদিসের অনুবাদে আসমানে শব্দটিকেই কেনই-বা বহাল রাখলেন! সেটাকে কেন আসমানের ওপর লেখলেন না!

আল্লাহ তাআলা আকাশে আছেন’ আর ‘আল্লাহ তাআলা আরশে আছেন’, এ দুটোর মধ্যে থেকে দ্বিতীয় বাক্যটি অধিক বিভ্রান্তিমূলক। যেমন ইমাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,

ولا حاجة إلى هذا ، بل ” السماء ” اسم جنس للعالي ، لا يخص شيئاً ، فقوله : (في السماء) أي : في العلو دون السفل

অর্থাৎ ‘আল্লাহ আকাশে আছেন’ না বলে আল্লাহ ‘আকাশের ওপর আছেন’ বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, আকাশ শব্দটা উচ্চতা বোঝায়; এই শব্দটি কোনো বস্তুকে বিশিষ্ট করে না। সুতরাং আকাশে কথার অর্থ হলো উচ্চে; নিম্নে নয়। অর্থাৎ সেই স্রষ্টা, যিনি (মর্যাদাগত) উচ্চতায় রয়েছেন; যিনি সকল নিচুতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। {মাজমুউল ফাতাওয়া : ১৬/১০০-১০১}

আমরা ‘মর্যাদাগত’ কথাটা এ জন্য যোগ করলাম, কারণ আল্লাহ তাআলা দিক থেকে পবিত্র। দিক তো আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি, মাখলুক। আর স্রষ্টা তার সৃষ্টি থেকে আলাদা। তিনি তার সৃষ্টির মধ্যে একীভূত নন।

পুরো আলোচনার সারকথা হলো, এ বইয়ের সেসকল পাঠক, আকিদা সম্পর্কে পূর্বে যাদের বিস্তর পড়াশোনা নেই, তারা এই আলোচনা থেকে ভুল মেসেজ নেওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আগেই বলেছি, এটা নিছক আমার খটকা। আদতে বিষয়টা আপত্তিজনক মনে হলে লেখক মহোদয় এ ব্যাপারে মতামত জানাবেন এবং কিছু একটা উদ্যোগ নেবেন। আর বিষয়টা যদি আমার বোঝার ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমিও বুঝকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাব এবং এর মাধ্যমে অন্তর প্রশান্ত হতে পারবে।

Share This