প্রকৃত মুসলিম হলে যা আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে—‘কালিমাতুশ শাহাদাহ’ [ব্যাখ্যাসহ]। বইটি রচনা করেছেন গাজী মুহাম্মাদ তানজিল। সম্পাদনা করেছেন শাইখ মুনীরুল ইসলাম আয-যাকির। প্রকাশনায় : ইমাম পাবলিকেশন্স লি., ঢাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৯৬। শুভেচ্ছা মূল্য : ৬০ টাকা মাত্র। বইয়ের শুরুতে ছোট করে সংযুক্ত রয়েছে শাইখ মুরাদ বিন আমজাদ এবং শাইখ আব্দুর রহমান বিন মুবারক আলী’র অভিমত। আমার কাছে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ রয়েছে, যা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে। 

বইয়ের শুরুতে লেখক নিজেই সংক্ষেপে বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরছেন : “কালিমা সম্পর্কে বর্তমানে অধিকাংশ লোকের অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। অধিকাংশ মানুষ এ ‘কালিমাতুশ শাহাদাহ’ বা সাক্ষ্যদানের বাক্য সম্পর্কে অজ্ঞ। একমাত্র আল্লাহ যার প্রতি করুণা করেছেন, আর শিরক থেকে রক্ষা করেছেন, সে ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবাই তাদের অজান্তেই শিরক নামক মহামারিতে আক্রান্ত হচ্ছে। অধিকাংশ লোকের অবস্থা হচ্ছে তারা জানে না এ কালিমার অর্থ কী, কী এর গুরুত্ব ও মর্যাদা। জানে না কালিমার দাবিই বা কী। এ কালিমার সাক্ষ্য দানের মাধ্যমে কী তারা স্বীকার করে নিচ্ছে, আর কী অস্বীকার করছে। দাবি করছে আমরা মুসলিম, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য করো ইবাদাত করি না। অথচ বাস্তবিকভাবে তারা আল্লাহর পাশাপাশি আরো বহু রবের/ইলাহের ইবাদাত করছে। এভাবে তারা শিরকের স্রোতে ঈমানকে বিলিয়ে দিচ্ছে।

আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلَّا وَهُمْ مُّشْرِكُوْنَ﴾

অধিকাংশ মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে । [সূরা ইউসুফ ১২ : ১০৬]

অধিকাংশ মুসলিমই এ ভুল ধারণা পোষণ করে যে, কালিমা মুখে উচ্চারণ করলে অথবা মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহণ করলে বা লালিত পালিত হলে কিংবা সুন্দর একটা আরবি নামধারণ করলেই মুসলিম হওয়া যায়। তার কাজ-র্কম জীবনযাপন পদ্ধতি যাই হোক না কেন। অথচ সাহাবীদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাদের এবং আমাদের কালিমা বুঝার ক্ষেত্রে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের পতাকাতলে নিজেকে দাখিলের জন্য প্রত্যেকেরই কালিমাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে তাওহীদ ও রিসালাতের এ কালিমাকে সহজভাবে বুঝতে পারে তাই এই ছোট বইটির সংকলনের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র।”

বইটিতে মূলত তিনটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা এসেছে ‘ইসলামের কতিপয় মৌলিক প্রশ্নোত্তর’র। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা এসেছে ‘কালিমাতুশ শাহাদাহ’র প্রথম অংশের। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা এসেছে ‘কালিমাতুশ শাহাদাহ’র দ্বিতীয় অংশের। এ ছাড়াও এ বইয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আরও রয়েছে তাওহিদ ও শিরকের পরিচয়, আল্লাহ এবং তাগুতের পরিচয়, ঈমান এবং কুফরের পরিচয়, সুন্নাহ এবং বিদআতের পরিচয়, কবীরা গুনাহ এবং কুসংস্কারের পরিচয়, মুক্তিপ্রাপ্ত দল এবং আত-তায়িফাতুল মানসুরার পরিচয়, এ ছাড়াও প্রতিটা বিষয়ের ওপর রয়েছে তাত্ত্বিক আলোকপাত, রয়েছে প্রাসঙ্গিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং সবশেষে যুক্ত হয়েছে ‘উদাত্ত আহ্বান’।

বইটি তার সংক্ষিপ্ততা সত্ত্বেও সার্বিক বিচারে অত্যন্ত সুন্দর এবং উপকারী। ভাষাও অনেকটা সাবলীল। তবে বানানগত দুর্বলতা রয়েছে চোখে পড়ার মতো। সম্ভবত বইটার প্রুফ সম্পাদনা করানো হয়নি। এ ছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ‘/’ চিহ্ন ব্যবহার করার কারণে কিছুটা দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। তবে সবমিলিয়ে বইটা মুগ্ধ করার মতো। বইয়ের সর্বশেষ পৃষ্ঠায় বইটি সম্পর্কে কয়েকজন পাঠকের প্রশংসাধর্মী মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে। এতে করে বইটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়।

তবে বইটার অল্প কয়েকটা পয়েন্ট আমার কাছে একটু বেখাপ্পা লেগেছে, মনে সংশয়ের উদ্রেক করেছে। আপাতত সে পয়েন্টগুলোকে কোট করছি ইন শা আল্লাহ। এতে করে বিষয়টা হয়তো আমার সংশয় কাটাতে সহায়ক হবে। আর বিষয়গুলো যদি আদতেই আপত্তিজনক হয়ে থাকে তাহলে মূল বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে এই পয়েন্টগুলোতে খানিকটা পরিবর্তন বা পরিমার্জন আসবে। এখানে ধারাবাহিকভাবে সেই পয়েন্টগুলো কোট করছি। প্রতিটা পয়েন্টের সঙ্গে বন্ধনীর ভেতর ছোট মন্তব্যও সংযুক্ত করে দিচ্ছি।

১. প্রশ্ন : আমাদের রব কোথায় আছেন? উত্তর : আমাদের রব আরশে আযীমে আছেন। যেমন তিনি বলেছেন : দয়াময় আরশে সমুন্নত আছেন। [সুরা তহা ২০ : ৫] {পৃ. ৯}

(মন্তব্য : //আমাদের রব আরশে আযীমে আছেন// এই কথাটা আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। কারণ, সালাফে সালেহিনের আকিদা হলো, আল্লাহ তাআলা আরশের ওপর/ঊর্ধ্বে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার মর্যাদা আরশের চাইতেও ঊর্ধ্বে কিংবা আল্লাহ তাআলা আরশের থেকে অমুখাপেক্ষী। এমন নয় যে, আরশ হলো কোনো আধার বা রাজসিংহাসন আর আল্লাহ তাআলা তার ওপর অধিষ্ঠিত/উপবিষ্ট রয়েছেন। এগুলো তো দেহবিশিষ্ট মাখলুকের সিফাত। আর আল্লাহ তাআলা তো দেহ থেকে, মাখলুকের গুণাবলি থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। যার কারণে ‘আল্লাহ তাআলা আরশের ওপরে/ঊর্ধ্বে রয়েছেন’ আর ‘আল্লাহ তাআলা আরশে আযীমে আছেন’ দুটো কথাকে আমার কাছে সমার্থক মনে হয় না। কারণ, প্রথম কথার দ্বারা আল্লাহ তাআলার মর্যাদাগত উচ্চতা বোঝানো হচ্ছে; সত্তাগত কিংবা দৈহিক অবস্থান নয় কিংবা এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার অমুখাপেক্ষিতা বোঝানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় কথার মধ্যে আল্লাহ তাআলাকে কেমন যেন দেহবিশিষ্ট কল্পনা করে আরশকে আল্লাহ তাআলার জায়গা বা রাজসিংহাসন বলে আখ্যা দেওয়ার ভাব রয়েছে।

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন,

“السلف ، والأئمة ، وسائر علماء السنَّة إذا قالوا : ” إنه فوق العرش ” ، و ” إنه في السماء فوق كل شيء ” : لا يقولون إن هناك شيئاً يحويه ، أو يحصره ، أو يكون محلاًّ له ، أو ظرفاً ، ووعاءً ، سبحانه وتعالى عن ذلك ، بل هو فوق كل شيء ، وهو مستغنٍ عن كل شيءٍ ، وكل شيءٍ مفتقرٌ إليه ، وهو عالٍ على كل شيءٍ ، وهو الحامل للعرش ، ولحملة العرش ، بقوته ، وقدرته ، وكل مخلوق مفتقرٌ إليه ، وهو غنيٌّ عن العرش ، وعن كل مخلوق .

সালাফ ও ইমামগণ এবং আহলুস সুন্নাহর অন্য সকল আলিমগণ যখন বলেন, ‘আল্লাহ আরশে’ অথবা ‘তিনি আকাশে সকল কিছুর ওপরে’ তখন তারা এর দ্বারা এ উদ্দেশ্য নেন না যে, সেখানে এমন কিছু রয়েছে, যা আল্লাহকে বেষ্টন করে রাখে কিংবা তাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে অথবা তা হলো তার স্থান, আধার কিংবা পাত্র। আল্লাহ তাআলা এসব কিছু থেকে পবিত্র। বরং তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী। সকল কিছু তার মুখাপেক্ষী। তিনি সকল কিছুর ওপর সুউচ্চ। তিনিই আরশের ধারক, আরশ বহনকারী ফেরেশতাদেরও ধারক; তার শক্তির মাধ্যমে, তার ক্ষমতার মাধ্যমে। গোটা সৃষ্টি তার দিকে মুখাপেক্ষী। তিনি আরশ থেকে এবং সকল মাখলুক থেকে অমুখাপেক্ষী। {মাজমুউল ফাতাওয়া : ১৬/১০০-১০১}

আল্লাহ্‌ তাআলা কোথাও অবস্থিত এটা তো একটা অবান্তর ধারণা। স্থান এবং দিক, স্থানের ধারণা – দিকের ধারণা, এটা তো আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি।

আল্লাহ তা’আলা মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন, আল্লাহ তা’আলা তেমনই আছেন। স্থান, কাল, দিক ইত্যাকার বিষয়সমূহ আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। আল্লাহ্‌ তা’আলা এসব থেকে পবিত্র। এসব আল্লাহ তাআলার জন্য কিছু বৃদ্ধিও করে না, সংকোচনও করে না। আল্লাহ তাআলা তার সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী। ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর কথা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য—‘যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়?’ ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর উত্তরে বলেন—‘তাকে বলা হবে , সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোনো স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তাআলা ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিল না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা” [আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ.৫৭]

‘আল্লাহ তা’আলা আরশের ঊর্ধ্বে আছেন’—এই কথা দিয়ে কী বোঝানো হয়?
১. আল্লাহ্‌ তা’আলা আরশ থেকে অমুখাপেক্ষী।
২. আল্লাহ্‌ তা’আলা মর্যাদা আরশের চেয়ে বেশি।

তৃতীয় আরেকটি জিনিস বোঝানো হয় এই কথা দিয়ে। আর তা হলো আল্লাহ তাআলা দিক হিসেবে আরশের ওপরে।
وهو ما فوق العرش
وليس هناك غيره
এটা একটা ভ্রান্ত কথা। এমন কথা বলে আল্লাহ তাআলার মর্যাদা বর্ণনা করা হলো, যা না আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন, আর না হাদিসে এসেছে এই কথা।

লেখক বইয়ের ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘আল্লাহর অবস্থান-সম্পর্কিত শিরক’ শিরোনামে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন, আল্লাহ মুমিনের অন্তরে বিরাজমান কিংবা তিনি সবার অন্তরে বিরাজমান—এ ধারণা লালন করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি সুরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন এবং তার অনুবাদ এভাবে করেন, ‘অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন।’ লেখক মহোদয় এখানে আল্লাহ তাআলার অবস্থান দেখাচ্ছেন যে, আল্লাহ তাআলা আরশে অবস্থান করেন; তিনি মুমিনের অন্তরে বা সবার অন্তরে অবস্থান করেন না। আল্লাহ তাআলাকে অবস্থানের বিশেষণে বিশেষায়িত করা এক ধরনের বিচ্যুতিই মনে হয়েছে আমার কাছে।)

২. পীর-ছুফিগণ মনগড়া ইবাদত তৈরি করে। মনগড়া বহু তরীকা নিজেরা তৈরি করে। আবার এক এক তরীকার এক এক যিকির। এ সবকিছুই আল্লাহর শরীয়ত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বাতিল/ভ্রান্ত একটি শরীয়ত, যা পরিত্যাজ্য, যা পীর-পুরোহিতরা নিজেরা তৈরি করেছেন। অথচ এ জাতীয় শরীয়ত তৈরি করার অধিকার আল্লাহ তাআলা কাউকে দেননি। সুতরাং এরাও তাগুতের অন্তর্ভুক্ত। {পৃ. ২৬}

(মন্তব্য : এ কথাটাকে আমার কাছে বেশ আপত্তিজনক মনে হয়েছে। পীর-ছুফিরা যদি মনগড়া ইবাদত তৈরি করে তাহলে তা তো নিঃসন্দেহে বাতিল। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে পীর-ছুফিরা আদৌ কখনো এমনটা করেছে, এর প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে বলে আমার বোধ হয় না। হাঁ, পীর নামধারী কোনো ভণ্ড যদি এমনটা করে তাহলে তার দায় তো পীর-ছুফিদের কাঁধে চাপবে না। মুসলিম নামধারী সেক্যুলাররা বর্তমান দুনিয়ায় যা করছে, মুজাহিদ নামধারী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যেসব কাজ সম্পাদন করছে এসবের দায় কি মুসলিম এবং মুজাহিদদের কাঁধে চাপবে? এরপর কথা হলো, // মনগড়া বহু তরীকা নিজেরা তৈরি করে। আবার এক এক তরীকার এক এক যিকির।// শরিয়াহ কি জিকিরের কোনো তরিকাকে উম্মাহর ওপর অবধারিত করে দিয়েছে? যতক্ষণ পর্যন্ত জিকির শরিয়াহর সীমারেখার মধ্যে থাকছে ততক্ষণ তার তরিকা নিয়ে কী আপত্তি? আমি নামাজ পড়ব, কোন সুরা দিয়ে পড়ব, তা কি আমাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমি জিহাদ করব, তরবারি দিয়ে করব নাকি ক্লাশিনকভ দিয়ে করব, এর কোনোটি কি আমার ওপর অবধারিত করে দেওয়া হয়েছে? জিকিরের তরিকা শরিয়াহ যেহেতু মুকাইয়াদ (সীমাবদ্ধ) করেনি, তাই এর সকল তরিকাই অনুমোদিত থাকবে, যদি না সেই তরিকায় প্রাসঙ্গিক কোনো সমস্যা থাকে। একজন দুরুদ পড়ছে এক শ বার করে, আরেকজন পড়ছে পাঁচ শ বার করে। আর তারা এর কোনোটাকেই আল্লাহ এবং তার রাসুল নির্দেশিত মনে করছে না; বরং শাইখের অভিজ্ঞতালব্ধ ওজিফা হিসেবেই এমনটা করছে। তো এতে কী বাধানিষেধ রয়েছে?

// এ সবকিছুই আল্লাহর শরীয়ত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বাতিল/ভ্রান্ত একটি শরীয়ত, যা পরিত্যাজ্য, যা পীর-পুরোহিতরা নিজেরা তৈরি করেছেন। অথচ এ জাতীয় শরীয়ত তৈরি করার অধিকার আল্লাহ তাআলা কাউকে দেননি। সুতরাং এরাও তাগুতের অন্তর্ভুক্ত।// আমার মনে হয়, শরিয়াহর অর্থ গ্রন্থাকারের সামনে স্পষ্ট নয়। কোনো হক্কানি পীর-ছুফির জিকিরের তরিকাকে আলাদা শরিয়াহ আখ্যা দেওয়ার আজগুবি সিদ্ধান্ত এর আগে কোথাও আমার চোখে পড়েনি। জিকিরের কোনো তরিকার ওজিফা দেওয়া হলে তা যে কীভাবে আলাদা শরিয়াহ হয়ে যায় এবং এর কারণে পীর-ছুফিরা তাগুতে পরিণত হয়ে যায়, তা কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

৩. শিরকে আকবার হলো… কোনো মৃত ব্যক্তি কিংবা জিন অথবা শয়তান কারও ক্ষতি করতে পারে কিংবা কাউকে অসুস্থ করতে পারে, এ ধরনের ভয় পাওয়া। {পৃ. ৪৬}

ভয়ের শিরক : ‘ভয়ের শিরক’ বলতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে প্রকাশ্যভাবে দুনিয়া বা আখিরাত-সংক্রান্ত যেকোনো ক্ষতি সংঘটন করতে পারে বলে বিশ্বাস করে তাকে ভয় পাওয়াকে বোঝানো হয়। মানুষ, মূর্তি, জিন ইত্যাদির অনিষ্টতা থেকে ভয় পাওয়া শিরক। {পৃ. ৫৩}

(মন্তব্য : মৃত ব্যক্তি কারও ক্ষতি করতে পারে—এটা তো একটা অমূলক ধারণা। তবে জিন এবং শয়তান তো মানুষের ক্ষতি করতেই পারে এবং বিভিন্নভাবে তারা তা করেও থাকে। এটা তো একটা স্পষ্ট বিষয়। আল্লাহ তাআলাই তাদের সে ক্ষমতা দিয়েছেন। আল্লাহ যেমন আগুনকে পোড়ানোর ক্ষমতা দিয়েছেন, পানিকে ডোবানোর ক্ষমতা দিয়েছেন, একইভাবে তিনি জিন-শয়তানকেও মানুষের কিছু অনিষ্ট করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এ বিষয়গুলো আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছাড়া হয় না এবং এ বিষয়গুলো তাকদির-পরিপন্থীও নয়। পৃথিবীর নেজামই আল্লাহ এভাবে রেখেছেন। এখন কেউ যদি এই ভয় পায় যে, আমি পানিতে পড়লে যেহেতু সাঁতার পারি না, তাই ডুবে যাব; আগুনের সঙ্গে আমার দেহের স্পর্শ হলে আমি জ্বলে যাব তাহলে এটাকে কি শিরকে আকবার বলা হবে, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়? জিন-শয়তানের বিষয়টাও তো এমনই। যদিও এসবের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, কিন্তু আল্লাহ তাআলাই তো তাদের এ ক্ষমতা দিয়েছেন। আর পৃথিবীতে ক’জনই বা জিন-শয়তানের ব্যাপারে ভয় পায় না! হাঁ, লেখকের উদ্দেশ্য হয়তো এটা যে, তারা আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতার প্রয়োগ ব্যতিরেকে এবং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বাইরে কারও ক্ষতি করতে পারে না। তবে উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে বাহ্যত কেউ কেউ, বিশেষত প্রাথমিক পাঠকরা ভুল মেসেজ নিতে পারে। এমনিই তো জিন-শয়তান নিয়ে কলাবিজ্ঞানীদের অপপ্রচারের কারণে অনেকে এখন এ বিষয়গুলোকে অস্বীকারই করে।

// মানুষ, মূর্তি, জিন ইত্যাদির অনিষ্টতা থেকে ভয় পাওয়া শিরক।// সুরা ফালাক এবং সুরা নাসে আল্লাহ তাআলা কিছু জিনিসের অনিষ্টতা থেকে আল্লাহ তাআলার আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলেছেন। সেই জিনিসগুলো এমন, যার ব্যাপারে মানুষের অন্তরে ভয় কাজ করে, যা মানুষের অনিষ্ট করে। এমনকি খোদ রাসুলুল্লাহ সা.-এরই অনিষ্ট করা হয়েছে, তার ওপর জাদু করা হয়েছে; যার প্রভাব তার দেহে ছিল শেষ জীবন পর্যন্ত। তবে আগেই বলেছি, লেখকের উদ্দেশ্য হয়তো তা নয়, বক্তব্য পড়ে যা অনেকের বাহ্যত মনে হবে। তবে বিষয়টা কিছুটা অস্পষ্ট থাকায় এতে কেউ-বা ভুলও বুঝতে পারে।

৪. সওয়াবের উদ্দেশ্যে মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় (যেমন : কোনো মাজার বা পীরের খানকায়) সফর করা বা খাদেম হওয়া শিরকের অন্তর্ভুক্ত। {পৃ. ৫৭}

(মন্তব্য : সওয়াবের উদ্দেশ্যে কারও খাদেম হওয়া কীভাবে শিরকের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে? বান্দার খেদমতে/উপকারে যে অসংখ্য সওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে, অসংখ্য হাদিসেই তো বিষয়টা স্পষ্টভাবে এসেছে। এখানেও হয়তো লেখক অন্যকিছু বুঝিয়েছেন। তবে সাধারণ পাঠক এ থেকে ভুল কিছু বোঝার আশঙ্কা বোধ হয় ভালো পরিমাণেই রয়েছে।)

৫. জাহেলী যুগের লোকেরা দেবতাদের নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানাদির নাম রাখত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম কোনো ওলির নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানাদির নাম রাখে। {পৃ. ৬৪}

(মন্তব্য : এখানে কী মন্তব্য করব, বুঝতে পারছি না। এ বিষয়টাও কীভাবে নিন্দনীয় বিষয়ের তালিকায় স্থান পেতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়। খোদ রাসুলুল্লাহ সা.-ই বিভিন্ন নেককার লোকের নামে সাহাবিদের সন্তানদের নাম রেখেছেন। যেমন : এক সাহাবি ছিলেন বীর মুজাহিদ। তার শাহাদাতের পর রাসুলুল্লাহ সা. তার নামে পরবর্তীতে জন্ম নেওয়া তার ভাতিজার নাম রাখেন। এমনটা তো সবযুগে, সবদেশে, সবমহলেই হয়ে থাকে বলে জানি। হাফেজ্জি হুজুরের নামে কেউ ছেলের নাম রাখে মুহাম্মাদুল্লাহ, থানবি রহ.-এর নামে কেউ নিজ ছেলের নাম রাখে আশরাফ আলি, আর কেউ-বা মহান খলিফা আলি, পঞ্চম খলিফা হাসান এবং সাহাবি উসামা ও শাইখ উসামার নামে নিজ ছেলের নাম রাখে আলী হাসান উসামা। এতে দোষণীয় কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। অবশ্য লেখকের কাছে ওলির আলাদা কোনো সংজ্ঞা আছে কি না বা এ কথার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা আছে কি না, তা আল্লাহই ভালো জানেন।)

৬. একমাত্র রাসূলকেই উত্তম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা। …[সুরা আহযাব : ৩৩ : ২১] {পৃ. ৬৬}

(মন্তব্য : অবশ্যই রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনিই তো একমাত্র নন। কুরআনে বারবার আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম আ.-এর মিল্লাতকে অনুসরণ করতে বলেছেন, ইবরাহিম আ.-কে আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কাউকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে চায়, সে যেন ওই সকল ব্যক্তিদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে, যারা মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তারা হলেন মুহাম্মাদ সা.-এর সাহাবিরা।’ এসব থেকে প্রতীয়মান হয়, রাসুলুল্লাহ সা. যেমনিভাবে আমাদের জন্য আদর্শ, একইভাবে যাদের জীবন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি, তারাও আমাদের জন্য আদর্শ। সুতরাং উপরিউক্ত বক্তব্য এ ব্যাপারে এ বইয়ের পাঠকদের অসম্পূর্ণ বা অস্পষ্ট মেজে দিচ্ছে।)

৭. আমাদের সমাজে প্রচলিত বিদআত : …ফরজ নামাজের পর ইমাম-মুক্তাদি সম্মিলিতভাবে হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা। …ঈসালে সওয়াবের জন্য হাফেজ ডেকে কুরআন খতম করা। …প্রচলিত খতমে ইউনুস ও বুখারী খতমের অনুষ্ঠান গুরুত্বের সাথে পালন করা। …ঈদের নামাজ ও খুতবার পর সম্মিলিতভাবে দুয়া করা। …তারাবীহ’র প্রত্যেক চার রাকাতে অথবা সর্বশেষে সম্মিলিতভাবে দুয়া করা। …খতনার অনুষ্ঠান করা। {পৃ. ৭০-৭১}

(মন্তব্য : ঢালাওভাবে যেভাবে বিদআতের তালিকাকে সমৃদ্ধ করা হলো, তা কতটা ইনসাফসম্মত হয়েছে, আল্লাহই ভালো জানেন। এই তালিকার কিছু বিষয় নিয়ে আহলে হাদিস ভাইয়েরা পূর্ব থেকেই বিতর্ক করে আসছেন। তাই সেগুলোর প্রসঙ্গ আপাতত না হয় থাক। তাওহিদ শিখতে হলেই কেমন যেন আহলে হাদিস মতবাদে দীক্ষিত হতে হয় বলে কেউ কেউ হয়তো মনে করেন। এ ধরনের বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে দাওয়াহ করলে কী ক্ষতি হয়, আল্লাহই ভালো জানেন। খতনার অনুষ্ঠানের বিষয়টাই ধরি। বাইরের দলিল পেশ করে লাভ নেই বিধায় ইসলাম কিউ এ এবং ইসলাম ওয়েবের লিংকই এখানে সংযুক্ত করে দিচ্ছে। উভয় পোর্টালের ফতোয়া হলো, খতনার অনুষ্ঠানের দাওয়াত হলো মুস্তাহাব।

ক. https://islamqa.info/ar/203192

খ. http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php…

পোর্টাল দুটোতে সালাফগণের রেফারেন্সসহ এ মাসআলা সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আগ্রহী পাঠকগণ দেখে নিতে পারেন। এ ছাড়াও সহিহ বুখারির টীকা থেকে শুরু করে মুফতিয়ে আজম বাংলাদেশের ফতোয়ার কথা আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি এক লেখায়। যাহোক, তাওহিদের দাওয়াহকে বিতর্কিত বিষয় থেকে মুক্ত রেখে উপস্থাপন করাই আমার কাছে উপকারী মনে হয়। ওয়াল্লাহু আ‘লাম।)

৮. জাহেলী যুগের লোকেরা ধর্ম যাজকদেরকে হারাম ও হালাল নির্ধারণকারী বানিয়ে নিত। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম শরীয়ত পালনের ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের উপর পীর ও নিজস্ব মাযহাবের মতামতকে প্রাধান্য দেয়। {পৃ. ৬৪}

(মন্তব্য : এ ব্যাপারে নতুন করে মন্তব্য করে ফায়দা নেই। অনেক পুরোনো বিষয়। সহিহ হাদিসের অনুসারী হওয়ার দাবিদার ভাইয়েরা এ নিয়ে জল কম ঘোলা করেননি। মাযহাব-সম্বন্ধে ব্যাপকভাবে অজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়। বইয়ের শেষের দিকেও লেখক ভিন্ন সুরে মাযহাবের ব্যাপারে নব্য সালাফি ভাইদের মতো মত উপস্থাপন করেছেন। তার বক্তব্য :

//এ দল (অর্থাৎ মুক্তিপ্রাপ্ত দল) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.-এর কথার বাইরে অন্য কারও অন্ধ অনুসরণ করে না। আর তারা চার মাযহাবের সম্মানিত মুজতাহিদ ইমামগণকে সম্মান করে এবং তাদের সকলের কথা/মত হতেই মাসআলা গ্রহণ করে যদি সেই কথা/মত আল-কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ’র সাথে মিলে যায়। যার মত অধিক বিশুদ্ধ তার কথা/মত গ্রহণ করে এবং তাদের অন্ধ অনুসরণ করে না।// {পৃ. ৯০}

এ নিয়ে কথা বললে রিভিউ অনেক বেশি লম্বা হয়ে যাবে। এ কথার মাধ্যমে মূলত ফিল্টার ধরা হয়েছে হাদিসকে। এরপর নির্দিষ্ট কোনো মাযহাবে সীমাবদ্ধ না থেকে চার মাযহাবের ইমামগণের ফিকহকেই সেই ফিল্টারে ফেলে সেখান থেকে যেটা যেটা সিলগালা হয়ে বেরোবে, তা অনুসরণের দাওয়াহ দেওয়া হয়েছে। লেখক মহোদয় এখানে কেমন যেন আহলে হাদিস সম্প্রদায়কেই একমাত্র মুক্তিপ্রাপ্ত সম্প্রদায়, গুরাবা এবং আত-তায়িফাতুল মানসুরা আখ্যা দিতে চান। আর মাযহাবিদের কৌশলে মুক্তিপ্রাপ্ত দল থেকে খারিজ করে দিতে চান। ওয়াল্লাহু আ‘লাম।

Share This