তত্ত্ব ছেড়ে জীবনে। লেখক : শরীফ আবু হায়াত অপু। শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণ করে ভুল সংশোধন করেছেন : শাইখ আকরামুযযামান এবং ড. মানজুরে ইলাহী। বইটি প্রকাশ করেছে সিয়ান পাবলিকেশন। বইয়ের রিভিউ লেখা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলাম, তাই এ বই নিয়েও কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু অপবাদের তীরগুলো যখন গায়ে এসে বিঁধে, তখন দু-চার কথা বলারও বোধ হয় কোনো বিকল্প থাকে না।

এ বইটি নিয়ে আমি আপাতত কোনো পর্যালোচনা লিখব না। লিখলেও সবিশেষ লাভ হবে না। বলা হবে, এত বড় বড় সালাফি শাইখ এ বইটাকে সম্পাদনা করে দিলেন, সিয়ানের মতো আন্তর্জাতিক মানের দাবিকারী পাবলিকেশন বইটা প্রকাশ করল, সেই ২০১১ থেকে আজ সাত বছর ধরে এত এত পাঠক বইটা পড়ল, কারও চোখে কিছু ধরা পড়ল না। সব ধরা পড়ল এরই চোখে! আসলে সবই বিদ্বেষ! লেখকের খ্যাতি, সম্পাদকের গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রকাশনীর সুনামকে নষ্ট করার জন্য সব ষড়যন্ত্র! ব্লা ব্লা…।

যাহোক, এসব কারণে আপাতত শুধু কিছু পয়েন্ট কোট করব। দু-এক জায়গার বন্ধনীর মধ্যে এদিক-ওদিক সামান্য আলোকপাত করব। আর এ ছোট্ট পোস্টে সবগুলো আপত্তিকর পয়েন্ট কোট করা সম্ভবও নয়। কারণ, সব পয়েন্ট কোট করা হলে আর প্রতিটার সঙ্গে অল্পস্বল্প পর্যালোচনা যোগ করা হলে এটা আর পোস্ট থাকবে না; হয়ে যাবে স্বতন্ত্র পুস্তিকা। কেউ বলতে পারেন, কোটকৃত পয়েন্ট থেকে অনেক সময় ভুল বোঝা যায়; কিন্তু আগপাছ দেখলে মনে আর খটকা থাকে না। তাদের জন্য প্রতিটা পয়েন্টের শেষে পৃষ্ঠা নম্বর সংযুক্ত করে দিয়েছি। এবার চাইলে মূল বই খুলে এই পয়েন্টগুলোকে মিলিয়ে নিন, আমাদের কোনো জালিয়াতি আছে কি না তাও চেক করে নিন। আর সাথে আগপাছ মিলিয়েও কয়েকবার করে পড়ে নিজের মতো করে বিচার করুন।

এটা কোনো জরুরি বিষয় নয় যে, এই পয়েন্টগুলো সবাই একভাবে মূল্যায়ন করবে। আর এটা কখনো হওয়ারও নয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, খারেজি, মুরজিয়া, জাহমি, মুতাজিলা, শিয়া, কাদিয়ানি থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থী; আলিম, অ-আলিম, সচেতন, অচেতন, সূক্ষ্মদর্শী, আঁতেল, হেকমতি, চাটুকার, সত্যান্বেষী, অকুতোভয়—একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি হবে একেক রকম। যার কাছে এগুলো সমস্যাজনক মনে হবে তাকেও সালাম। আর যার কাছে এগুলোকেই যথার্থ মনে হবে তাকেও সালাম। সকলের জন্যই শুভকামনা। যে বলবে, এগুলো মৌলিক কোনো বিষয় না, এর দ্বারা পাঠকের মন-মননও প্রভাবিত হবে না, কুরআন ছাড়া সব গ্রন্থে এমনটা ঘটতেই পারে, এরপরও বইটা তো কত সুন্দর, আপনারা কি চান দুনিয়ার সবাই আপনাদের মানহাজের ওপর উঠে আসুক আর আহলুস সুন্নাহর বাইরের মানহাজগুলোকে পরিত্যাগ করুক, তার প্রতিও জ্ঞাপন করছি আন্তরিক অভিনন্দন। ইন্নামা আলাইনাল বালাগ। লাসনা আলাইহিম বি মুসাইতির।

বইয়ের কিছু পয়েন্ট রয়েছে, যেগুলো হানাফি- সালাফি, আশআরি-আসারি দ্বন্দ্বের পর্যায়ে। এমন পয়েন্ট রয়েছে বড় বড় কয়েকটা। এগুলোকে আমরা আমাদের লেখায় উদ্ধৃত করব না। কারণ, সালাফি ধারার প্রকাশনী সালাফি বারতা প্রচার করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য তাদের আলাদাভাবে নিন্দা করারও কিছু নেই। একই কাজ তো অন্যরাও করে থাকে। যাহোক, আল্লাহর নামে শুরু করছি। এটা অজানা নয় যে, এই লেখার পরিণতি কী হবে। তবে পরিণতি যা-ই হোক না কেন, যা বলার তা বলতেই হবে। ‘কখনোই পরোয়া করিনি যে, আমার ব্যাপারে কী বলা হচ্ছে; তবে সর্বদা তা-ই বলেছি, যা বলা আমার ওপর অপরিহার্য।’ প্রিয় শাইখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির রহ.-এর এই বক্তব্য ভেতরে সাহস এবং অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে।

১. ইসলাম পুরোটা না বুঝে খণ্ডিত বুঝ নিয়ে অনেক মানুষ নিজে বিভ্রান্ত হয়, অন্যদের বিভ্রান্ত করে ও সমস্ত মুসলিমদের বিপদে ফেলে। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জিহাদের আয়াতের ব্যাখ্যার চোটে আফগানিস্তান আর ইরাক এক সাথে কাত হয়ে গেছে! হতে পারে উনাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল আল্লাহকে খুশি করা; কিন্তু মুসলিম শাসকদের কাফের ঘোষণা দিয়ে, বিন বাযের মতো আলিমদের পরামর্শ না শুনে, নিজের খেয়াল খুশি মতো জিহাদ করে তারা মুসলিম উম্মাহর অপরিমাণ ক্ষতি করেছেন। আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত উপেক্ষা করে কিছু নিরীহ মানুষের উপর হামলা করে আরও কত নিরীহ মুসলিমের চোখের জলের যে কারণ হয়েছেন তা আল্লাহই জানেন। (পৃ. ২০৪)

২. যারা বলেন খিলাফাহ চাই, যারা বলে বেড়ান ইসলাম কায়েম করব, যারা বলেন বয়ান হবে বহুত ফায়দা হবে, তাঁদের কেউই সলাতে আল্লাহর সামনে ভেদাভেদ ভুলে, বিশ্বাসীদের অনুসৃত পথ অনুসরণ করতে পারেন না। এই লোকগুলোকে দিয়ে মাসজিদের বাইরে কীভাবে ইসলাম কায়েম হবে? রাসুলুল্লাহ সা.-এর কথার সত্যতা প্রমাণ করে আমরা ইসলামের দিকে ডাকা মানুষদের মধ্যে খালি বিভেদ আর হিংসা দেখি। দেওয়ানবাগি পীরের ভক্তরা বলে চরমোনাইরা কাফের আর চরমোনাই পীরের মুরিদরা বলে দেওয়ানবাগিরা কাফের। জামাতিরা তাবলিগিদের দেখতে পারে না, তাবলিগিরা জামাতিদের সহ্য করতে পারে না। রাজারবাগী পীরের দলের কাজ দেয়ালে চিকা মারা আর সব কাজকে হারাম ঘোষণা করা। একই ইসলামের নামে কত দল আছে আল্লাহই জানেন। সবাই নাকি ইসলাম চায় কিন্তু কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না! তাইতো আল্লাহ মুসলিমদের দলে দলে বিভক্ত হওয়াকে নিষিদ্ধ করেছেন। (পৃ. ১৮১-১৮২)

(মন্তব্য : বাতিলপন্থী বা বিদআতি মুসলিমদের সঙ্গে আল-বারা’র কতটুকু নির্দেশিত ও অনুমোদিত, সেই মাসআলা বোধ হয় লেখকের জানা নেই। আর কার সঙ্গে কাকে মেলান, হকপন্থী-বাতিলপন্থীকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে যেভাবে সমীকরণ টানেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।)

৩. সরকারের মাথাদের একশ বার গালি দিচ্ছি কাফের বলে। কখনো খোঁজ নিয়েছি—তাকে কেউ কখনো বলেছে কি না যে, আল্লাহর আইন দিয়ে শাসন না করার পরিণাম কী হতে পারে? শাসক যদি আল্লাহর আইন অনুসারে দেশ শাসন না করে তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কেন করেনি; আমাকে উনার হয়ে জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু কোনোভাবে যদি উনি আল্লাহর কাছে মুসলিম হিসেবে গণ্য হন, তবে উনাকে কাফের বলার কারণে আমি নিশ্চিত কাফের হয়ে যাব। কারণ স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘যেকোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে কাফের আখ্যা দিলে তাদের দুজনের যেকোনো একজন কাফের হিসেবে গণ্য হবে।’ অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ইসলামের দাবিদারকে কাফের বলতে নিষেধ করলেন, ‘যে তোমাদেরকে সালাম করে, তাকে বলো না যে, তুমি মুমিন নও।’ (পৃ. ১৪৮)

(মন্তব্য : ‘উনাকে কাফের বলার কারণে আমি নিশ্চিত কাফের হয়ে যাব’— কী আজিব নিশ্চয়তা! আর হাদিসের অনুবাদের কী অবস্থা! ইন্নালিল্লাহ। জাহেরি ছাড়া আর কেউ এভাবে চরম অভিনব ফিকহ উদগীরণ করে কি না, তা আল্লাহই ভালো জানেন। ‘আল্লাহ সুবহানাহু ইসলামের দাবিদারকে কাফের বলতে নিষেধ করলেন’—হায়রে, উপমহাদেশীয় কোনো আলিমই মাসআলাটা বুঝলেন না, আরব আলিমরাও কিনা বোকার মতো তাদের সমর্থন করে বসলেন, তারা কিনা কাদিয়ানিদের সদলবলে কাফির ফতোয়া দিয়ে ছাড়লেন, অথচ কাদিয়ানিরা নিজেদের নিখাদ মুসলিম দাবি করে! একইভাবে শিয়াদেরও কাফির বলা ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে, অথচ তারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে। সালাফের জামানা থেকে যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে। একেক যুগে একেক গোষ্ঠীকে তাকফির করা হয়েছে। ‘উসুলুত তাকফির’ এবং সালাফের মানহাজ সম্পর্কে কারও শতভাগ অজ্ঞতা থাকলেই বোধ হয় তার পক্ষে এমন মন্তব্য করা সম্ভব।)

৪. আমরা আজ বাংলাদেশকে দারুল কুফর বলছি! আল্লাহু আকবার! রাসুলুল্লাহ সা. কোনো জনপদে আক্রমণ করার আগে ভোরবেলায় কান পেতে রাখতেন আজান শুনতে। আজান শুনলে তিনি আক্রমণ না করে ফিরে যেতেন। আর আজ আমরা এমন শক্ত মুসলিম হলাম যে, আল্লাহর আইনের শাসন নেই বলে আমরা এ দেশকে দারুল কুফর তকমা লাগিয়ে দিলাম, ভোরবেলায় যে দশবার আজান শোনা গেল সেটার প্রতি ভ্রূক্ষেপও করলাম না। সৌদি আরবে খলিফার বদলে বাদশাহ কেন? এরা কাফের। সৌদি আলিমরা তাদের পা-চাটা দালাল! এরা জিহাদ করে না কেন? এরা কাফের। (পৃ. ১৪৮)

(মন্তব্য : ইমামগণের সুস্পষ্ট বক্তব্যের আলোকে প্রমাণিত, কোনো দেশ দারুল ইসলাম হতে পারে; যদিও তার সকল নাগরিক অমুসলিম হয়; যেহেতু তাতে ইসলামের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। নাগরিকরা অমুসলিম হলেও রাষ্ট্র ইসলামি শাসনক্ষমতার অধীন রয়েছে। একইভাবে কোনো দেশ দারুল কুফর হতে পারে; যদিও তার অধিকাংশ নাগরিক মুসলিম হয়ে থাকে। কারণ, তাতে কুফরের শাসন ও বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। নাগরিকরা মুসলিম হলেও রাষ্ট্র কুফরি শাসনক্ষমতার অধীন রয়েছে। ‘যেসব দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা নেই, যদিও তাতে মুসলমানরা ওয়াজ-মাহফিল, ইদ-জামাআত ইত্যাদি আদায় করতে পারে, তা দারুল ইসলাম হিসেবে পরিগণিত হবে না।’ (মাজাল্লাতুল কানুন ওয়াল ইকতিছাদ, যিলহজ সংখ্যা, ১৩৫৪ হিজরি, পৃ. ২০৩, তা‘লিক : ১) এ জন্যই সারাখসি রহ. বলেন, ‘দারকে আমাদের দিকে বা তাদের দিকে নিসবত করাটা মূলত ক্ষমতা এবং প্রাধান্যতার বিচারে।’ (আলমাবসুত, সারাখসি : ১০/১১৪) এ বিষয়টাকেই আল্লামা কাসানি রহ. আরও স্পষ্ট করে এভাবে বলেছেন, ‘কোনো রাষ্ট্রে কুফরের আহকাম-বিধিবিধান প্রকাশিত হলে তা দারুল কুফর হয়ে যায়। …রাষ্ট্র শুধু কুফরের বিধানাবলী প্রকাশিত হওয়ার দ্বারাই দারুল কুফর বলে গণ্য হয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৯/৪৩৭৫; আরও দেখুন—আহকামুদ দিয়ার, আবিদ সুফয়ানি : ১৫)। এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা ‘দ্রোহের তপ্ত লাভা’য় দ্রষ্টব্য।

আর সৌদি-সংক্রান্ত বিষয়টা নিয়ে কিছুই বলার নেই। কারণ, ব্যাপকভাবে মাদখালিরা সৌদি শাসকদের বিরোধিতাকে এভাবেই মূল্যায়ন করে। তারা সৌদি পূজার মধ্যেই সার্বিক কল্যাণ দেখতে পায়। এখান থেকেই তো কেউ কেউ মুহাম্মাদ বিন সালমান নিয়েও ইয়া বড় বড় লেখা লেখে, এমনকি তার মধ্যে নাকি মাহদির প্রতিচ্ছবিও দেখতে পায়। যারা সৌদি শাসক এবং দরবারি আলিমদের বিরোধী, তাদের ওপর কী সুন্দর অপবাদ চাপানো হলো এবং বিরোধিতার কার্যকারণকে নিজের মনমতো বিশ্লেষণ করে দেওয়া হলো! সুবহানাকা হাজা বুহতানুন আজিম!)

৫. ইমাম মালিক বলেন, ‘নিরানব্বই দিক থেকে যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তিকে কাফের আখ্যাদানের সম্ভাবনা থাকে আর এক দিক থেকে তার ঈমানদার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে; তাহলে মুসলিমের উপর ভালো ধারণা পোষণ করার লক্ষ্যে আমি তাকে ঈমানদার হিসেবেই গণ্য করব।’ (পৃ. ১৪৯)

(মন্তব্য : অনুবাদ এবং অপপ্রয়োগের কী আজিব দৃষ্টান্ত! অবশ্য ভালোই হলো। এ ব্যাখ্যা মেনে নিলে পৃথিবীতে কখনো কোনো মুসলিম আর কাফির হবে না। কাদিয়ানিরাও তো হওয়ার কথা নয়। কারণ, শুধু একদিক কেন, তাদের প্রতি সুধারণা রাখার দিক রয়েছে অসংখ্য।)

৬. কালের পরিক্রমায় মুসলিম খিলাফাত লুপ্ত হলো। পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিম উম্মাহর চিন্তাশীলরা ভাবতে শুরু করলেন যে, সমাজের মঙ্গল করতে হলে আগে দখল করতে হবে ক্ষমতা, শাসনতন্ত্র/হুকুমাত/খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গদিতে বসে জনগণকে হুকুম করলেই জনগণ সুরসুর করে তাওহীদ মেনে নেবে, কবর-মূর্তি-ব্যক্তি পূজা ছেড়ে দেবে। …ধর্ম কখনো মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ইসলামি শরীয়াতে কখনোই ‘টপ টু বটম’ অ্যাপ্রোচ কার্যকর হবে না, হবে ‘বটম টু টপ’ অ্যাপ্রোচে। এ জন্য ক্ষমতার হাতছানিকে উপেক্ষা করে রাসুলুল্লাহ সা. ১৩ বছর ধরে জনে জনে তাওহীদের শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন। মদিনার মানুষরা তাওহীদ উপলব্ধি করার পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে শাসনভার অর্পণ করেছিলেন। আগে ক্ষমতা পরে ইসলাম—এটা কখনোই হওয়ার নয়। ইসলাম না বুঝিয়েই জোর এর আইন জোর করে মানানোর পরিণতি : তালিবানদের পতনের সাথে সাথে কাবুলের সেলুনে দাড়ি শেভ করার লাইন। তথাকথিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে বিশুদ্ধ তাওহীদ প্রচারকারী আলিমদের সুন্নী ‘অপবাদ’ দিয়ে হত্যা করা হয়। এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে মানুষ ইসলাম রক্ষা করে! (পৃ. ২৬-২৮)

(মন্তব্য : মদিনার মানুষরা তো স্বতংপ্রণোদিত হয়ে শাসনভার অর্পণ করেছিল, কিন্তু মক্কাবাসীরা করেনি, উলটো বরং চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বিধায় তাদের থেকে সশস্ত্র অপারেশন চালিয়ে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হলো। খোলাফায়ে রাশেদিন থেকে শুরু করে উসমানি সালতানাত পর্যন্ত চলল নতুন নতুন দেশ দখল করে তাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ধারা। এমনকি ফিকহের গ্রন্থাদিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের নতি স্বীকার করেনি, এমন সব পার্শ্ববর্তী কুফরি রাষ্ট্রগুলোতে বছরে অন্তত দুবার হামলা করার বিধান শাসকের ওপর চাপানো হলো। এসব কিছুর পর এখানে বটম টু টপ অ্যাপ্রোচের নয়া সবক শেখানো হচ্ছে।

তালিবানদের ভুল অ্যাপ্রোচের কারণে তাদের পতনের পর দেখা গেল, সেই ভূমির সব আসলে এতদিনে ফেরেশতা হয়ে যায়নি, বরং এতগুলো বছর ইমারাহ থাকার পরও তাদের মধ্যে কিনা শয়তান ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করতে সমর্থ হলো, মানুষেরা দাড়ি শেভ করে বসল। হায় হায়! তবে তারা এই পাঁচটি বছর কী শাসন করল! সবগুলো মানুষকে পাঁচ বছরেও ফেরেশতা বানাতে পারল না! অথচ পুরো বিশ্বে, বিশেষ করে আমাদের মতো শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রগুলোতে অ্যাপ্রোচ ঠিক হওয়ার কারণে এখানকার সেলুনগুলোতে কাউকে দাড়ি শেভ করতে দেখা যায় না। কেন যে তালিবানরা এ সহজ জিনিসটা বুঝল না! কেন যে তারা আমাদের মতো গলা ফাটিয়ে আর কালির সাগর ভাসিয়ে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা না করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিল!)

৭. প্রসঙ্গত জ্ঞাতব্য যে, জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ইসলাম পছন্দ করে না। যদি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামের শাসন চায় তবেই আমাদের বর্তমান সংবিধান বদলে কুরআন এবং হাদীসভিত্তিক সংবিধান আসবে। বোমা ফুটিয়ে, মানুষ মেরে বামদের বিপ্লব হয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। কল্যাণ কখনো অকল্যাণের পথ বেয়ে আসবে না। ইসলাম চে গুয়েভারার দর্শনে চলে না, মুহাম্মাদ সা.-এর অনুসরণে চলে। (পৃ. ৩৬)

(মন্তব্য : বাহ্যত চকচকে গণতান্ত্রিক মডারেট ইসলামের বুলি!)

৮. ইসলামের একটি মূলনীতি হলো, যে নিজেকে মুসলিম দাবি করবে তাকে মুসলিম হিসেবেই গণ্য করতে হবে। তার কাজ-কর্ম যদি চরম ইসলাম বিরোধীও হয় তবু তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করেই উপদেশ দিতে হবে, বোঝাতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ যে ধর্ম পালন করে তা ইসলাম নয়; হিন্দু, খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধধর্ম নয়—এ ধর্মের নাম অধর্ম। কিন্তু তাদের আমরা গণ্য করি তাদের কাজ দিয়ে নয়, তারা নিজেদের কী দাবি করছে তা দিয়ে। ব্যক্তির কাজের বিচার আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা‘আলা করবেন, আমরা নই। একই মূলনীতি কিছুটা বড় পরিসরে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। (পৃ. ৩৮)

(মন্তব্য : ঠিক মুরজিয়াদের মতো আমলি কুফরকে কিংবা খোদ নাওয়াকিজুল ইমানকেই অস্বীকার!)

৯. যারা তাওহীদ বোঝা, বোঝানো বাদ দিয়ে মানুষকে খিলাফাহ-হুকুমাতের দিকে ডাকে, লম্বা লম্বা ফযিলাতের দিকে ডাকে—তারা বোঝে না যে, এভাবে ইসলাম আসে না। রাসুলুল্লাহ সা.-এর তাওহীদের দাওয়াতের মাত্র তেরো বছরে ইসলামি সমাজ দাঁড়িয়ে গেল। আর আমাদের আন্দোলনে আন্দোলনে অর্ধশতক পার হওয়ার পরেও সমাজে ক্লেদ কেবল বেড়েছেই। তাওহীদ প্রতিষ্ঠাকে দূরে ফেলে ব্যানারে ব্যানারে ‘ইসলামি ব্যাংক’-এর নাম প্রতিষ্ঠাতে গিয়ে ঠেকেছে আজ মুসলিমদের আন্দোলন। (পৃ. ৭৩)

(এসকল তাওহিদপন্থীরা বোধ হয় তাওহিদ বলতে শুধু আল্লাহর হাত-পা, আল্লাহ কোথায়, তিনি সাকার না নিরাকার—এগুলোই বোঝে। আর এসব বিতর্ক প্রতিষ্ঠাকেই জীবনের পরম লক্ষ্য মনে করে। তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ বলতেও যে কিছু আছে, আমার মনে হয় না, এ ব্যাপারটি এরা জানে বা মানে। আর দু-চার পৃষ্ঠা তাওহিদ পড়ে, এক-দু চামচ তাওহিদ গিলেই এরা ভাবে যে, গোটা তাওহিদ বোধ হয় এদেরই অধিকারে চলে এসেছে। অথচ যারা নিজেদের জীবনকেই ওয়াকফ করেছে তাওহিদের জন্য, যারা তাওহিদকে তত্ত্ব ছেড়ে জীবনে বাস্তবায়িত করেছে, তাত্ত্বিক তাওহিদের পাশাপাশি তাওহিদে আমালির ওপর আজীবন চলেছে, নিজেদের দাওয়াত এবং সংগ্রামের ভিত্তিও তাওহিদের ওপর রেখেছে, আজ তাদেরই নতুন করে মোডারেট তাওহিদ শেখানো হচ্ছে! তার এই অসার যুক্তির সুদীর্ঘ খণ্ডন ‘মিল্লাতে ইবরাহিমের জাগরণ’-এর পাতায় পাতায় রয়েছে। তবে এসব বই তো আবার অস্পৃশ্য। এগুলো শুধু মানহাজপন্থীরাই পড়বে; মাদখালি, মুরজিয়া, হেকমতি শান্তিপ্রিয় বা মোডারেটরা নয়।)

১০. ইসলামের বিষয়গুলোর একটিকে নিয়ে অত্যুৎসাহের অর্থ ইসলামের অন্য বিষয়গুলোকে অবহেলা করা। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. কুরআন এবং ও সহীহ সুন্নাহতে সামগ্রিকভাবে যেটার গুরুত্ব বেশি দিয়েছেন, তাকে গুরুত্ব না দিলে প্রকারান্তরে আল্লাহর প্রজ্ঞা ও রাসুলুল্লাহ সা.-এর শিক্ষকতাকে অবজ্ঞা করা হয়। একটা জিহাদি সাইট থেকে এক খামচা, মকসুদুল মোমেনিন থেকে আরেক খামচি—এভাবে পড়লে ‘অনেক জানি’—এই মিথ্যা অহংকার ছাড়া আর কোনো প্রাপ্তি হবে না। (পৃ. ১০১)

১১. প্রথমত বলে নিই, আমি সকল ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীল। জ্ঞানত, অমুসলিম কারও প্রতি আমি অসৌজন্যমূলক কোনো ব্যবহার কোনোদিনও করিনি। শুধু সাদা-কালো কেন, পৃথিবীর তাবৎ রেসিস্ট হয় মুখে, নয় মনে মনে নিজের রেস ছাড়া অন্য রেসের মানুষদের ঘৃণা করে। কিন্তু আমি আমার মন থেকে বলছি, আমি খ্রিষ্টানদের ঘৃণা করি না, তাদের ধর্মকে হেয় করি না, যিশুকে অসম্মান করি না। করি না, কারণ ইসলাম আমাকে ঘৃণার সীমারেখাটা শিখিয়েছে। আল-কুরআন আমাকে শিখিয়েছে যে, আমি যাকে ইসলামের পথে আহ্বান করছি সে যদি আমার সাথে শত্রুভাবও পোষণ করে, তবুও তাকে উষ্ণ বন্ধুত্ব উপহার দিতে। তবে এটা ঠিক যে, আমাকে ইসলাম ঘৃণা করতে শিখিয়েছে নষ্ট ধর্মব্যবসায়ীদের বানানো রীতি-নীতিকে, রূপকথাকে, কুসংস্কারকে, মিথ্যা কথার ব্যবসাকে, যা ধর্মের নামে সমাজে চলে। মানুষের বানোয়াট ধর্মকে আমি ঘৃণা করি—সেটা ইসলামের নামে পালন করা হোক বা হোক খ্রিষ্টান ধর্মের নামে। তবে সমাজের দশ জন মানুষ, যারা চোখ-কান বুঁজে অন্ধের মরো ধর্ম পালন করে চলছে তাদের প্রতি আমার ক্ষোভ আছে, বিরক্তি আছে। তবে ঘৃণা নেই। (পৃ. ১০৯)

(মন্তব্য : সহিহ হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহর কাছে সবচে পছন্দনীয় আমল হলো তাঁর জন্য ভালোবাসা এবং তাঁর জন্য ঘৃণা করা। আল-ওয়ালার ভিত্তিও আল-হুব্বু ফিল্লাহর ওপর। একইভাবে আল-বারার ভিত্তিও হলো আল-বুগজু ফিল্লাহর ওপর। যাহোক, আমরা অসহষ্ণুতার কথা বলে উগ্র ইসলাম প্রচার করে লাভ নেই। পৃথিবীতে প্রচারিত হোক মোডারেটদের শান্তিপূর্ণ ইসলাম, আল-বুগজু ফিল্লাহ এবং আল-বারা মুক্ত নির্মল ও সুন্দর অসহিংস ধর্ম ইসলাম। আর দাওয়াত হিকমাহ এবং সুন্দর কথার অনুমোদন দিলেও কখনোই ‘উষ্ণ বন্ধুত্বে’র অনুমোদন দেয় না। এসব হলো পশ্চিমা দাওয়াতের নীতি, ইসলামের দাওয়াতের নয়।)

পুনশ্চ : আজ এতটুকুই থাক। আশা করি, এর আলোকে লেখকের মানসিকতা, প্রকাশনীর রুচি, সম্পাদকদ্বয়ের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সুন্দর উপস্থাপনা ও মনোরম সাহিত্য-সংবলিত জনপ্রিয় বইয়ের কনসেপ্ট সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। হাঁ, আমি বলছি না, বইয়ে ভালো কোনো দিক নেই। ভালো দিক অসংখ্য রয়েছে। তবে ভালো দিক থাকলেই কোনো জিনিস বোধ হয় ভালো হয়ে যায় না। যদিও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তবে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সালুল কিন্তু মসজিদে নামাজ আদায় করত, ইসলামের অসংখ্য বিধান মানত, মুসলিমদের সঙ্গে মিলে যুদ্ধের ময়দানের উদ্দেশে ঘোড়া পর্যন্ত হাঁকাত আর মাঝপথ থেকে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যেত। এতকিছুর পরও সে কিন্তু মুনাফিক; মুনাফিকই নয় শুধু, বরং তাদের সর্দার। আর মুনাফিকরা অবস্থান করবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। তাদের নামাজ, রোজা, হজ, ইবাদত কোনো কিছুই কোনো কাজে আসবে না। একইভাবে মক্কার মুশরিকরা, আবু জাহল থেকে শুরু করে কুরাইশের অন্যান্য সর্দাররা তো হজ করত, আরও অনেক ইবাদত করত। এতকিছুর পরও তারা মুশরিক। আর আল্লাহ মুশরিকের শিরককে কখনোই ক্ষমা করবেন না, এ ছাড়া অন্যান্য গুনাহ, যার জন্য চান ক্ষমা করবেন। তাই কিছু ভালো জিনিস থাকলে, বরং অধিকাংশ জিনিস ভালো হলেও, শুধু মৌলিক কনসেপ্টে বিষ মেশানো থাকলে তা আর ভালো থাকে না। তা হয়ে যায় ঘৃণিত, গর্হিত এবং পরিত্যাজ্য। ওয়া মা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।

Share This