পর্যালোচনা: ১
“তাঁর নবুওয়াতি জীবনের তেইশ বছরই কি কেবল অনুসরণীয় মডেল? পৃথিবীর সেরা সেরা মানুষটির জমিনে পা রাখার পর থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত সময়কাল কি ‘উসওয়াতুন হাসানা’ নয়? নিশ্চয়। প্রিয় নবিজির পুরো তেষট্টি বছরের জীবনই পৃথিবীবাসির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।” {—প্রকাশকের কথা}
“বইটিতে তাঁর নবী হওয়ার আগের জীবন বেশি গুরুত্ব পাবে। আমরা দেখব শিশুকাল থেকে কিভাবে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে গড়ে তুলেছেন। টিনএজ বয়সের চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে মোকাবিলা করেছেন। তরুণ বয়সেই কিভাবে সমাজে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। …ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে রাসূল সা.
এর ব্যাপারে যেসব জীবনী লেখা হয়, সেগুলোর বেশিরভাগে দুটো জিনিস হামেশা পাওয়া যায়ল রাসূল সা.-এর ৪০ বছরের পরের জীবন আর পাঠকদের মধ্যে তাঁর ব্যাপারে সম্ভ্রম জাগানো। কিন্তু এ ধরনের লেখনীতে তরুণ পাঠকেরা নিজেদের কমই খুঁজে পায়। বইগুলোতে তাঁকে এতটাই নিখুঁত পুরুষ হিসেবে তুলে ধরা হয় যে, অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করতে বেগ পেতে হয়। তরুণরা অনেক সময়ই তাদের জীবন ঘনিষ্ঠ সংকটের সাথে রাসূল সা.-এর জীবনী মিলিয়ে নিতে পারে না। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন খুব স্পষ্ট করে বলেন—‘আল্লাহর রাসূলের মাঝে তোমাদের জন্য আছে ভালো ভালো উদাহরণ’। (৩৩:২১)” {—লেখকের কথা}
পর্যালোচনা
রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনীতে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা রাসুলগণকে পাঠিয়েছেনই শিক্ষকরূপে। তারা আল্লাহ তাআলার বাণীকে মানবজাতির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ইসলামি শরিয়াহকে নিজেদের জীবনে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। তাদের হাতে এক কাফেলা গড়ে উঠেছে। যারা তাদের সাহাবি (সঙ্গী) নামে পরিচিত। তাদের জীবন আদতে রাসুলগণের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। মৌলিকভাবে আমাদের জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তি হলেন রাসুলুল্লাহ সা.। আর সাহাবিগণের জীবন যেহেতু তাদের জীবনেরই প্রতিনিধিত্ব করে, তাই সাহাবিগণকেও অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলছেন—“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে চায়, সে যেনো মুহাম্মাদ সা.-এর সাহাবিদেরকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে।”[1]
রাসুলগণকে আল্লাহ তাআলা যেহেতু পাঠিয়েছেনই মানবতার মুক্তির জন্য, তাই রাসুলগণ এসে হাতে-কলমে উম্মাহকে শরিয়াহর শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে রাসুল হিসেবে না পাঠিয়ে রক্ত-মাংসের মানুষকে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করার অন্তর্নিহিত রহস্য এটাই যে, মানুষ যেনো তাদেরই অনুরূপ একজন ব্যক্তির থেকে সহজেই শিক্ষা লাভ করতে পারে এবং এই ভেবে প্রতারিত না হয় যে, তিনি তো আমাদের মতো মানুষ নন। তার তো আমাদের মতো চাহিদা-প্রয়োজন নেই। এজন্য আল্লাহ বলছেন—“আপনি বলে দিন, আমি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। (তবে) আমার প্রতি এই ওহি আসে যে, তোমাদের ইলাহ কেব্ল এক ইলাহ। সুতরাং যে-কেউ নিজ প্রতিপালকের সাথে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, সে যেনো সৎকর্ম করে এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।”[2]
আল্লাহ তাআলা শুধু আমাদের নবি মুহাম্মাদে আরাবি সা.-কেই আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঘোষণা করেন নি, বরং অন্যান্য রাসুলগণের ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন। “তোমাদের জন্য তো তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ—প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে।”[3]
আমাদের রাসুলের ব্যাপারে বলেছেন—“বস্তুত তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ—প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ এবং শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে।”[4]
উপরিউক্ত উভয় আয়াত বিশেষ প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রথমটি অবতীর্ণ হয়েছে মিল্লাতে ইবরাহিমের বয়ান প্রসঙ্গে। দ্বিতীয়টি অবতীর্ন হয়েছে খন্দকের যুদ্ধের (গাযওয়াতুল আহযাবে) বয়ান প্রসঙ্গে। এই আয়াতের পূর্বের আয়াতগুলো দেখলে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। যারা যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকতো, অন্যদেরকেও যুদ্ধে যেতে বারণ করতো—সেসকল ভীরু স্বার্থপরদেরকে বলা হচ্ছে—তোমাদের জন্য তো আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তিনি কতো কষ্ট করছেন, ক্ষুধার তাড়নায় পেটে পাথর বাঁধছেন, জঙ্গে নিজের জান-মাল ব্যয় করছেন, আর তোমরা কিনা এর থেকে পিছিয়ে থাকছো? তোমাদের রাসুলের এই আদর্শ নিজেদের মধ্যে আনয়ন করছো না?
আল্লাহর রাসুলের ‘রাসুল-সত্তা’কে উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় বলা হয়েছে। এজন্য শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘মুহাম্মাদ’ শব্দ নয়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহর ব্যক্তিগত পছন্দ-অভিরুচিকে উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় বলা হয় নি, এমনকি তা অনুসরণের মধ্যে আলাদা সাওয়াবও রাখা হয় নি। রাসুলুল্লাহ সা. রুটি খেতেন না ভাত, ঝাল খেতেন না মিষ্টি, সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতেন নাকি সবচে বয়োজ্যেষ্ঠকে ইত্যাদি বিষয়কে কোথাও অনুসরণীয় বলা হয় নি। ইমাম কারাফি রহ. ‘আলইহকাম’ গ্রন্থে রাসুলুল্লাহ সা. এর অবস্থাগুলো সবিস্তারে তুলে ধরছেন। কোন অবস্থার কী বিধান, কোনটার কী অবস্থান ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ বিস্তারিত জানতে চাইলে সেখানে দেখে নিতে পারেন।
রাসুলগণকে আল্লাহ তাআলা পাঠিয়েছেনই আদর্শরূপে; যেনো তাদেরকে দেখে দেখে মানুষ জীবনের সবক্ষেত্রে শরিয়াহ পরিপালন করতে পারে। সারকথা, রাসুলের ‘রাসুল-সত্তা’ই হলো উম্মাহর জন্য একমাত্র অনুসরণীয়। হাঁ, তার ব্যক্তিসত্তার যে বিষয়গুলো রাসুল-সত্তার দ্বারা সমর্থিত—তাও অনুসরণীয়। বিষয়টি অনেকটা এমন—আমাদের জন্য একমাত্র অনুসরণীয় হলো আলকুরআন, পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলো নয়। হাঁ, পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর যেসব বিষয় আলকুরআন দ্বারা সমর্থিত, তাও পালন করা যাবে; কিন্তু তা এজন্য নয় যে, পূর্বের কোনো ধর্মগ্রন্থে তা বিবৃত হয়েছে, বরং এজন্য যে, আলকুরআন তা সমর্থন করেছে। সুতরাং তা আর পূর্বের শরিয়াহর বিধান রয় নি, বরং আমাদের শরিয়াহর বিধানরূপে সাব্যস্ত হয়েছে, যার অনুরূপ বিধান পূর্ববর্তী শরিয়াহয়ও ছিলো। এর সাধারণ দৃষ্টান্ত হলো, সালাত, সিয়াম এবং কিসাস প্রভৃতি।
সুতরাং রাসুলের ব্যক্তিসত্তা দেখে ‘তিনি কতো বছর বয়সে বিয়ে করেছেন’, ‘নবুওয়াতের পূর্বে ইবাদত করার ক্ষেত্রে কী পন্থা গ্রহণ করেছেন’, ‘ব্যবসা করেছেন নাকি চাকরি করেছেন’, ‘নারীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন নাকি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নারীদের থেকে দূরে থেকেছেন’—এসকল বিষয় বের করে এনে উম্মাহর জন্য তাকে অনুসরণীয় বলা এবং এসকল বিষয় থেকে শিক্ষা বের করে উম্মাহকে সেই কর্মপন্থা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান করা কোনো বিচক্ষণ মুসলিমের কাজ হতে পারে না।
নইলে তো কেউ এ কথাও বলে বসবে যে, পঁচিশ বছর হলে বিয়ে করা সুন্নাহ, নিজের বয়সের থেকে অধিক বয়সী নারীকে বিয়ে করা সুন্নাহ, গুহায় গিয়ে ইবাদত করা সুন্নাহ, ছাগল চরানো সুন্নাহ। কেউ তো এ কথাও বলতে পারে যে, ফিরাউনরূপী শাসকের মহলে বাস করা ইবাদত, সমকামীদের সমাজে বাস করা ইবাদত, ঝগড়া হলে বিপরীত পক্ষের ব্যক্তিকে আঘাত করা, প্রয়োজনে প্রচণ্ড আঘাত করে মেরে ফেলা ইবাদত। এ ধরনের আরো যতো বিষয় রয়েছে, সবগুলোকেই ইবাদত বানিয়ে ফেলা হবে।
রাসুলগণের নবুওয়াত-প্রাপ্তির পরবর্তী জীবন যে মাসুম তথা নিষ্পাপ ছিলো—এ ব্যাপারে তো গোটা উম্মাহর ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু তাদের নবুওয়াত-প্রাপ্তির পূর্বের জীবন সার্বিকভাবে মাসুম ছিলো কি না—এ নিয়ে কোনো কোনো আলিম ইখতিলাফ করেছেন। মানবজাতির জন্য যেই সত্তাকে আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হবে, তা তো আবশ্যকিভাবেই মাসুম হবে, সগিরা এবং কবিরা উভয় প্রকারের গুনাহ থেকে মুক্ত হবে। অন্যথায় কীভাবে তা আদর্শ ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণীয় হবে? এটা তো একটা স্পষ্ট বিষয়। এতোদসত্ত্বেও তাদের নবুওয়াত-প্রাপ্তির পূর্বের জীবনের বিধান নিয়ে কেউ কেউ ভিন্নমত কেনো পোষণ করলেন? এর কারণ এটাই ছিলো যে, তারা তো আদর্শ পুরুষ হবেন নবুওয়াত-প্রাপ্তির পরে। গোটা উম্মাহকে তাদের সেই ‘নবি-সত্তা’ অনুসরণ করতে বলা হবে। নবুওয়াত-প্রাপ্তির পূর্বের জীবন অনুসরণ করতে বলা হবে না।
আল্লাহর রাসুলকে আল্লাহ তাআলা যেহেতু আদর্শ পুরুষ হিসেবে পাঠিয়েছেন, তাই তার ‘রাসুল-সত্তা’র মধ্যেই প্রত্যেকে নিজের জীবনের সকল সামাধান খুঁজে পাবে। সমস্ত উত্তম বৈশিষ্ট্যের আধার ছিলেন রাসুল। আচ্ছা, তিনি নিজে তো কোনো অপরাধ করেন নি, তাহলে অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে উম্মাহ কীভাবে তার জীবনে আদর্শ খুঁজে পাবে? তিন্নি তো শিশু কিশোর তরুণ যুবক অবস্থায় নবি ছিলেন না। তাহলে জীবনের এসকল সময়ে মানুষ কীভাবে ‘রাসুল-সত্তা’কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে?
হাঁ, এজন্যই আল্লাহ তাআলা সাহাবিদের জামাআতকে প্রস্তুত করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা.-এর ভাষায়—“আল্লাহ তাআলা তার রাসুলের সুহবাতের জন্য এবং তার দ্বীনের প্রতিষ্ঠার জন্য তাদেরকে নির্বাচিত করেছেন।” সাহাবিদের দ্বারা সবকিছুই হয়েছে। তাদের দ্বারা গুনাহও হয়েছে। কিন্তু তারা গুনাহের ওপর স্থির থাকেন নি। তাওবা করেছেন, গুনাহের পথ থেকে ফিরে এসেছেন। কারো ওপর নেমে এসেছে হদ-কিসাস। একটি সমাজ তার ধারা পরিচালনার জন্য যা-কিছুর মুখাপেক্ষী তার সবকিছুই খুঁজে পাবে সাহাবাসমাজে। রাসুল সা. শিশু অবস্থায় নবি ছিলেন না ঠিক, কিন্তু তার নবুওয়াতের সময়কালে অসংখ্য শিশু এই পৃথিবীতে ছিলো। রাসুলের ঘরে ছিলো, সাহাবিদের ঘরে ছিলো। শিশু সাহাবি, কিশোর সাহাবি, তরুণ সাহাবি, যুবক সাহাবি। তাদের দৈনন্দিন জীবনাচার, তাদের সাথে রাসুলের আচরণ ইত্যাদি বিষয়ের মাঝে রয়েছে আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য উত্তম শিক্ষা। যা নিখুঁত, মহান এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে স্বীকৃত। এমনকি কখনো কোনো ইজতিহাদি ভুল হলেও আল্লাহ তাআলা ওহি মারফত সে ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
তথাপি রাসুলুল্লাহ সা.-এর শৈশব-কৈশোরের সবগুলো বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিতও হয় নি। তখন তো তার পাশে তার সাহাবিরা ছিলেন না, যারা তার প্রতিটি আচরণ-উচ্চারণকে সংরক্ষণ করবেন। যার কারণে সেই সময়ের অনেক বিষয়ই অজানা। উম্মাহর সেই বিষয়গুলোর দিকে মুখাপেক্ষী না বিধায়ই আল্লাহ তাআলা সেগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন নি। যদি উম্মাহর জন্য তা একান্ত প্রয়োজনীয় হতো, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা সংরক্ষণ করতেন।
পর্যালোচনা: ২
“রাসূল সা. একবার বলেন—‘আমি একবার কুরাইশ ছেলেদের সাথে ছিলাম। একটা শিকারের জন্য পাথর বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা সবাই নগ্ন ছিলাম। কারণ, সবাই তাদের কটিবস্ত্র ঘাড়ে করে নিয়ে পাথর বহন করছিল। আমিও তাই করছিলাম। ওভাবে যখন হাঁটছিলাম, তখন কে যেন আমাকে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মেরে বলল, ‘কটিবস্ত্র পরো’। আমি তখন পরে নিলাম। খালি ঘাড়েই পাথর নিয়ে নিলাম। সেই গ্রুপে কেবল আমিই ছিলাম যে কটিবস্ত্র পরেছিল’।” {পৃ. ৭৪}
পর্যালোচনা
এমন কিম্ভূতকিমাকার বর্ণনা, যা অনেকগুলো বিষয়কে আক্রান্ত করছে। বইয়ের বিজ্ঞ অনুবাদক এবং প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদের লেখকের সাথে চরম জালিয়াতিকারী অসৎ প্রকাশকের কাছে এর তথ্যসূত্র ও বিশুদ্ধতা জানার ইচ্ছে হয়। আশা করি, বিষয়টি তারা জানাবেন। আর এই বর্ণনাটিতে কী কী সমস্যা—তা ইন শা আল্লাহ তাদের রিপ্লাইয়ের পরই আলোচনায় আসবে।
পর্যালোচনা: ৩
“নবি সা. নিজে এ ব্যাপারে বলেন, ‘ইসলামপূর্ব যুগে মানুষরা যেভাবে নারীদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলো, আমি তেমন ছিলাম না। তবে দু’রাত বাদে। সেই দু’রাতে আল্লাহ আমাকে সুরক্ষা করেছিলেন।” {পৃ. ৭৫}
পর্যালোচনা
উপরিউক্ত উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সা. দু’রাতে নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আচ্ছা, প্রথমে বি স্মার্টের লেখক ড. হিশাম আল-আওয়াদির বক্তব্য লক্ষ করুন—“তাঁর ব্যাপারে আমি যেসব কাহিনি উল্লেখ করেছই, সেগুলো অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণিত দলিল থেকে নিয়েছি। অন্যান্য কিছু বইয়েরও সাহায্য নিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—১. আকরাম উমারী। আস-সীরাহ আন-নাবাউইয়্যাহ আস-সাহীহাহ, ২য় খণ্ড।…”
উপরিউক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করার পর শায়খ আকরাম উমারী কিন্তু এর ‘যয়িফ’ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তার বক্তব্য দেখুন—
وقد وردت روايات ضعيفة تفيد أن الله تعالى عصمه من سماع ومشاهدة الأعراس فى صباه يوم أن كان يرعى الغنم. (السيرة النبوية الصحيحة (1/114))
অনুবাদক এবং প্রকাশক ভাইরা যাকে মহান ইমাম হিসেবে একবাক্যে স্বীকার করেন, সেই শায়খ আলবানি রহ.ও ফিকহুস সিরাহর তাখরিজে এবং দিফা‘ আনিল হাদিসিন নাবাবিতে বর্ণনাটিকে ‘যয়িফ’ বলেছনে। ইবনু কাসির রহ. আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (১/৭২৫)-এ বলেন—
و هذا حديث غريب جدا و قد يكون عن على نفسه و يكون قوله في آخره مقحما
فما رأيكم ؟
মূল লেখক, অনুবাদক এবং প্রকাশক যে চিন্তাধারার মানুষ এবং বইটি সম্পর্কে মুখেও তারা যে দাবি করেছেন, তাতে এ ধরনের বর্ণনার উল্লেখ যে-কোনো পাঠককে বিস্মিত করবে।
তারচে’ও বড় কথা হলো, এই বর্ণনাটিকে উনারা যেভাবে অনুবাদ করেছেন, তাতে তো আরো বিস্মিত হতে হয়। মূল বর্ণনার সাথে অনুবাদটিকে একবার মিলিয়ে দেখতে পারেন, এরপর সাধুদের কথিত বিজ্ঞতার ব্যাপারে ধারণা নিতে পারেন—
ما هممت بقبيح مما كان أهل الجاهلية يهمون به ، إلا مرتين من الدهر ، كلتيهما يعصمني الله منهما
কোথায় নারীর কথা আর কোথায় দু’রাতে সেক্স জাগ্রত হওয়ার কথা?
পর্যালোচনা: ৪
“আমি জানি না এই সফরে সফরকারীরা কীভাবে সময় কাটিয়েছেন। কী কী দর্শনীয় স্থান তারা দেখেছিলেন, তবে নিচের জিনিসগুলো দেখার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে: ……বিভিন্ন সমাজ ও ধর্ম: হিজাজের মূর্তিপূজারি, মদিনার ইহুদি গোষ্ঠী, লাখমিদ, বনু জুদহাম ও গাস্সানিদ গোত্রের খ্রিষ্টান আরব ও সন্ন্যাসীরা, যার মধ্যে একজন ছিল বাহিরা। ……সিরিয়া সফরের মাধ্যমে রাসূল সা. নিজে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানগুলো দেখেছেন। তাঁর চাচার সাথে বিভিন্ন বাজারে ঘুরে ঘুরে নানান সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রথার মুখোমুখী হয়েছেন। বাহিরা সন্ন্যাসীর সাথে দেখা হয়েছে। নিজের থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের মেশা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিশোর-কিশোরীদের উন্মুখ হয়ে থাকা দরকার। যেগুলো তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে সবসময় সেসব খুঁজা উচিত তাদের।” {পৃ. ৭৯-৮০}
পর্যালোচনা
বিজ্ঞ লেখক যদিও প্রথমে ধারণামূলক বাক্য ব্যবহার করে এ দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, এ বিষয়ে তার সুনিশ্চিত জ্ঞান নেই। ‘আমি জানি না এই সফরে সফরকারীরা কীভাবে সময় কাটিয়েছেন। কী কী দর্শনীয় স্থান তারা দেখেছিলেন, তবে নিচের জিনিসগুলো দেখার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।’ কিন্তু দু-চার ছত্র পরেই কীভাবে যেনো স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, দ্ব্যর্থহীন শব্দে ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং এর থেকে টিনএজদের জন্য শিক্ষা বের করে আনলেন। “সিরিয়া সফরের মাধ্যমে রাসূল সা. নিজে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানগুলো দেখেছেন। তাঁর চাচার সাথে বিভিন্ন বাজারে ঘুরে ঘুরে নানান সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রথার মুখোমুখী হয়েছেন। বাহিরা সন্ন্যাসীর সাথে দেখা হয়েছে। নিজের থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের মেশা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিশোর-কিশোরীদের উন্মুখ হয়ে থাকা দরকার। যেগুলো তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে সবসময় সেসব খুঁজা উচিত তাদের।”
রাসুলুল্লাহ সা.-এর নবুওয়াতপূর্ব এ বিষয়টি উল্লেখ করার দ্বারা তিনি আমাদের উঠতি প্রজন্মকে বিভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষদের সাথে মেশার জন্য এবং তাদের সান্নিধ্য থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য দাওয়াত দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে শরিয়াহর ভিন্ন কোনো শিক্ষা আছে কি না—এ বিষয়টি দেখার কোনো প্রয়োজনীয়তা আদৌ তিনি অনুভব করলেন না। মুক্তমনা মুসলিম অনুবাদক হয়তো এর জন্য রেডিমেড অজুহাত দেবেন—“এটা ফিকহের বই নয়। এটাকে ফিকহ থেকে বেরিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পড়তে হবে।” আমরা আমাদের জীবনকে কীভাবে গড়বো, কোন কোন জিনিস করবো আর কোন কোন জিনিস ছাড়বো—তাও ফিকহ ছাড়া আলাদা কিছু থেকে আমাদেরকে জানতে হবে বুঝি! আচ্ছা, সেই জিনিসটা কী? পাশ্চাত্যনীতি? হায়রে উর্বর মস্তিষ্ক! কাকে বলে ফিকহ আর ফিকহুস সিরাহ, কী তার প্রয়োগক্ষেত্র—এ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা না নিয়েই এসব স্পর্শকাতর ইস্যুতে নাক গলালে তার পরিণতি এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিংবা অভূতপূর্ব নয়!
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন—
“তুমি মুমিন ছাড়া অন্য কারো সঙ্গী হোয়ো না।”
কারো সাথে মেশা, তার সঙ্গ ও সান্নিধ্য গ্রহণের মাপকাঠি হলো সে মুমিন হওয়া। আবু দাউদের বুখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আওনুল মা‘বুদ’ থেকে এর ব্যাখ্যা লক্ষ করুন—“উদ্দেশ্য হলো কুফফার এবং মুনাফিকদের সঙ্গ গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। কারণ তাদের সঙ্গ দ্বীনের জন্য ক্ষতিকারক। সুতরাং হাদিস ‘মুমিন’ শব্দের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সমগ্র মুমিনজাতি।” একই ব্যাখ্যা ‘তুহফাতুল আহওয়াযি’তেও উল্লিখিত হয়েছে। এজন্যই শায়খ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ (ফাক্কাল্লাহু আসরাহু) বলেন—
وأما مخالطته للكفار ، فليست العلة في منع مخالطة الكفار هي الخوف من الوقوع في الكفر فقط ، بل مِنْ أظهرِ عِلَلِ هذا الحكم : عداوتُهم لله ورسوله والمؤمنين ، وقد أشار الله تعالى إلى هذه العلة بقوله : ( يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُمْ مِنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ ) الممتحنة/1
فكيف يليق بمسلم أن يصاحب عدو الله وعدوه ويصادقه ؟!
ثم مِنْ أين يأمَنُ هذا مِنِ استحسانِ طريقتهم ومذهبهم ؟ وقد وقع كثير من المسلمين في الكفر والإلحاد وارتدوا عن الإسلام بسبب مصاحبتهم للكفار ، وإقامتهم في بلدانهم . فبعضهم تَهَوَّدَ ، وبعضهم تَنَصَّر ، وبعضهم اعتنق مذاهب فلسفية ملحدة
“কাফিরদের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ করার কারণ এ নয় যে, কুফরে লিপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা; বরং এই বিধানের অন্যতম সুস্পষ্ট কারণ হলো, আল্লাহ, তার রাসুল এবং মুমিনদের জন্য তাদের শত্রুতা। আল্লাহ তাআলা নিজেই এই কারণের দিকে এ আয়াতের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন—
“হে মুমিনরা, তোমরা আমার শত্রু এবং তোমাদের শত্রুকে বন্ধু বানিও যে, তাদের কাছে ভালোবাসার বার্তা পৌঁছাতে শুরু করবে, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তারা তা এমনই প্রত্যাখ্যান করেছে যে, রাসুলকে এবং তোমাদেরকেও কেবল এই কারণেই বের করে দিচ্ছে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছো।” (সুরা মুমতাহিনা : ১)
সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য কীভাবে সঙ্গত হবে আল্লাহ এবং তার শত্রুর সঙ্গ গ্রহণ করা এবং তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়া?
এরপর কথা হলো, সে কীভাবে এ ব্যাপারে নির্ভয় হবে যে, সে তাদের মতাদর্শ এবং ধর্মকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে না? অনেক মুসলমান কাফিরদের সঙ্গ গ্রহণ করার কারণে এবং তাদের দেশে অবস্থানের কারণে কুফর এবং নাস্তিকতায় পতিত হয়েছে এবং ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে। তাদের কেউ ইহুদি হয়েছে, কেউ খ্রিষ্টান হয়েছে আর কেউ নাস্তিকতামূলক দার্শনিক মতাদর্শ গ্রহণ করেছে।”[5]
বি স্মার্টের লেখকের উদ্দেশ্য আরো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তার পরবর্তী পৃষ্ঠার ‘টেবিলের’ বক্তব্য থেকে—
“রাসূল সা. সিরিয়ায় সফর করেছিলেন। সেই কাফেলায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে কমবয়স্ক।—নিজেকে নতুন রোমাঞ্চের সামনে উন্মোচিত করুন যা দেখেন তা দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করুন।” {পৃ. ৮১}
রাসুলুল্লাহ সা.-এর সিরিয়া সফর থেকে বিজ্ঞ লেখক যে শিক্ষা বের করলেন, তা অনেক মুসলিমের বিপথগামিতার পথ খুলে দিচ্ছে—তার জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে। আর প্রত্যেক মুসলিমই ভালো-মন্দ গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়। প্রত্যেকের বিবেকও তাকে সৎ এবং উপযুক্ত নির্দেশনা দেয় না। এর জন্য প্রয়োজন ইলম এবং ফিকহের। প্রয়োজন আরো অনেক কিছু। লেখক বলেন—
“আপনার অভ্যন্তরীন ভয়েস ও বিবেক আপনাকে বলে দিক কোনটা খারাপ কোনটা ভালো। আথাভাজন থাকুন। এমনকি যদি বাবা-মা বা অন্য জ্ঞানী কারও তত্ত্বাবধান থেকে দূরে থাকুন তবুও।” {পৃ. ৮১}
পর্যালোচনা: ৫
“বন্ধুবান্ধব: খুব সতর্কতার সাথে রাসূল সা. তাঁর বন্ধুদের বাছাই করেছেন। সুশিক্ষিত শ্রদ্ধাবান লোকদের বন্ধু হয়েছেন। আমরা এখন রাসূল সা.-এর কিছু বন্ধুবান্ধবদের নিচে তুলে ধরব—
……জাব্রা আর-রুমি: সুশিক্ষিত, বহুভাষী খ্রিষ্টান, ধর্মগ্রন্থের প্রতি জ্ঞানের ব্যাপারে যিনি জ্ঞানী ছিলেন। আগেই বলেছি, আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে বলেন, ‘তারা বলে, নবিকে তো কেবল একটা লোক এসব শেখায়’। আন নাহল : ১০৩। রাসূল সা. আরব, বিদেশি, মূর্তিপূজারি ও খ্রিষ্টানদের সাথে মিশেছেন। বিভিন্ন বয়সী বন্ধু ছিল তাঁর।” {পৃ. ৯১}
পর্যালোচনা
আয়িশা i বলেন, ‘রাসুল সা.-এর চরিত্র ছিলো আল-কুরআন’। আল-কুরআন তো মিল্লাতে ইবয়ারহিমের শিক্ষা দেয়, আলওয়ালা ওয়াল বারার শিক্ষা দেয়; কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করার শিক্ষা দেয় না। তাহলে কি রাসুলুল্লাহ সা.-এর সিরাত এবং আল-কুরআনের মাঝে বৈপরীত্য বিদ্যমান? এমনই যদি হয়, তাহলে আল্লাহ কেনো তার জীবনকে উম্মাহর জন্য আদর্শ তথা মডেল হিসেবে ঘোষণা করলেন?
বিজ্ঞ লেখক কতোটা সুকৌশলে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকিদা ‘আলওয়ালা ওয়াল বারা’র গলায় ছুড়ি চালিয়েছেন এবং প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর মিথ্যাচার করেছেন? যে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একটা বইয়ে বারবার রাসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর মিথ্যাচার করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না, তার বই পড়ে উম্মাহকে স্মার্ট হতে হবে? হায়, এসব উর্বর মস্তিষ্কের জন্য একরাশ সমবেদনা জ্ঞাপন ছাড়া আর কীইবা করার আছে?
এই পয়েন্টটা নিয়ে ইলমিভাবে পর্যালোচনা করা হলে তা-ই স্বতন্ত্র পুস্তকে পরিণত হবে। কিন্তু এরপরও দেখা যাবে, যে মানার সেই মানবে, আর যে অহংবোধে আক্রান্ত হয়ে সত্যকে নেভাতে তেড়ে আসার সে তখনও আসবে।
পর্যালোচনা: ৬
“আসলে, তাঁর ধর্মবিশ্বাস সেসব সংখ্যালঘু ধার্মিকদের কাছাকাছি ছিল যারা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করত। আবার এটাও কিন্তু অন্ধনুকরণের কারণে না। যেমন কিছু মানুষ কৌতূহলবশে অন্যান্য ধর্ম পরখ করে দেখে; বরং কিশোর বয়সে বাহিরা সন্ন্যাসীর সাথে তাঁর সেই কথোপকথন থেকে বুঝা যায়, তখনকার সেই বিশ্বাস বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় এসেছে।
ধর্মচর্চা: নবি হওয়ার আগে রাসূল সা. কোনো ধরনের ইবাদত করতেন কিনা সে ব্যাপারে তেমন জানা যায় না। মক্কার একেশ্বারবাদী ও বহুঈশ্বরবাদীরা যেসব উপাসনা করত, তার মধ্যে কিছু ছিল এক। যুগ যুগ ধরে নবি ইবরাহীম (আ) যেসব উপাসনা করতেন সেগুলোরই কিছু রূপ অবশিষ্ট ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল—
প্রার্থনা: হাঁটুগেড়ে বসা এবং সিজদা করা। একেশ্বরবাদী যাইদ ইব্ন্ আমর এ ধরনের সিজদা করতেন বলে জানা যায়। সিজদায় তিনি বলতেন, ‘ইবরাহীম যার কাছে আশ্রয় চাইতেন, আমিও তাঁর কাছে আশ্রয় চাই’।
উপবাস: কুরাইশরা মুহাররাম মাসের দশ তারিখ উপবাস থাকত।
হজ্জ: রাসূল সা. কাবা তাওয়াফ করেছেন। সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে হেঁটেছেন। আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়েছেন। এগুলো সবই হজ্জের অংশ। তবে যেসব ধর্মীয় রীতিগুলো স্পষ্টভাবে কুরাইশদের ছিল, তিনি সেগুলো করেননি।
নির্জন সময় কাটানো: কুরাইশরা কখনো কখনো নির্জনতায় যেত প্রার্থনা করার জন্য। ইসলামে আসার আগে ওমর ইবনুল খাত্তাব কাবায় যেয়ে নির্জনে সময় কাটাতেন।
যেগুলোকে তিনি ইবরাহীম (আ)-এর ধর্মের অংশ দেখেছেন, সেগুলো নিয়েছেন। এগুলো পরে ইসলামে নিয়ে নেওয়া হয়।” {পৃ. ৯৬}
পর্যালোচনা
বিজ্ঞ লেখক প্রথমে বললেন, “নবি হওয়ার আগে রাসূল সা. কোনো ধরনের ইবাদত করতেন কিনা সে ব্যাপারে তেমন জানা যায় না।” ভালো কথা। কিন্তু তিনিই কীভাবে দু’লাইন পরেই এ ব্যাপারে জেনে ফেললেন, যে ব্যাপারে মাত্রই বললেন যে, কোনো ধরনের ইবাদত আদৌ করতেন কিনা তা-ই নাকি জানা যায় না। তিনি নিজেই বলছেন, রাসূল সা. হজ্জ করতেন, নির্জনে সময় কাটাতেন। আর পূর্বেই বলে এসেছেন, এগুলো ছিলো ইবরাহিম n-এর শরিয়াহর অবশিষ্ট রূপ। জানি না, এ লাইনগুলো লেখার সময় তার মতিভ্রম হয়েছিলো কি না।
লেখক বলছেন, “কিশোর বয়সে বাহিরা সন্ন্যাসীর সাথে তাঁর সেই কথোপকথন থেকে বুঝা যায়, তখনকার সেই বিশ্বাস বাড়তে বাড়তে এই অবস্থায় এসেছে।” কিশোর বয়সের মুহাম্মাদের যে বিশ্বাস ছিলো, তা-ই নাকি বাড়তে বাড়তে ইসলামে পরিণত হলো। বিধর্মীরা তো এমনটাই দাবি করে থাকে। তারা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতে চায় না। তারা সবকিছুকে বাহ্যিকভাবে ব্যাখ্যা করে। মু‘জিযাকে বিশ্বাস করে কি করে না তা অবশ্য তাদের অনেকেই পরিষ্কার করে না। তারা রাসুলুল্লাহ সা.-এর যুদ্ধজয়ের বিষয়গুলোর পেছনেও আল্লাহ তাআলার নুসরত ও মদদকে হাইলাইট না করে কারণ হিসেবে বাহ্যিক বিভিন্ন প্রস্তুতি ও কৌশলকে চিহ্নিত করে থাকে। এক্ষেত্রে পুরো লেখায় অলৌকিকতার কথা ভুলেও মুখে আনে না। এটা প্রাচ্যবিদদের পুরোনো কৌশল। সূক্ষ্ম বিষ। যুদ্ধজয়ের কারণ বর্ণনার ক্ষেত্রে আমাদের এই লেখকও অনেকটা একই পথে হেঁটেছেন। জানি না, বুঝে করেছেন নাকি না বুঝেই এতে লিপ্ত হয়েছেন।
যেগুলোকে তিনি ইবরাহীম (আ)-এর ধর্মের অংশ দেখেছেন, সেগুলো নিয়েছেন। এগুলো পরে ইসলামে নিয়ে নেওয়া হয়। এ তো এমন এক জঘন্য কথা, যে ব্যাপারে কিছু লিখতেও প্রবৃত্তি হয় না। তিনি কি স্মার্ট পাঠকদের কাছে এই মেসেজ দিতে চাচ্ছেন যে, সে যুগের কতক সত্যপন্থীদের মতো কিশোর মুহাম্মাদের সরল বিশ্বাস উন্নতি লাভ করে ধীরে ধীরে চল্লিশোর্ধ্ব মুহাম্মাদের বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় এবং ইসলামি বিশ্বাস মূলত সেই বিশ্বাসেরই নাম। আর শরিয়াহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রোফেট মুহাম্মাদ সেসময়ে মক্কায় প্রচলিত এবং ইবরাহিম n-এর শরিয়াহর অংশ হিসেবে পরিচিত বিধানগুলোকে নিয়ে এগুলোকে ইসলামি বিধান বলে অভিহিত করেন। হাঁ, এর সাথে আরো কিছু যুক্ত করেছেন—তা তো স্পষ্ট।
প্রাচ্যবিদদের ধারাও এমন। এজন্যই প্রাচ্যবিদদের ব্যাপারে উম্মাহর বিদগ্ধগণ কুফফার গোষ্ঠীর থেকেও অধিক সতর্ক করেন। কারণ, সূক্ষ্ম বিষগুলোকে ধরতে না পেরে অনেক সরলমনা পাঠকই অজান্তে হারিয়ে যায় এবং তার আদর্শ মুমিন-সত্তা মরে যায়।
পর্যালোচনা: ৭
শান্তি: মুসলিম-অমুসলিমদের লেখা কিছু জীবনীতে রাসূল সা.-এর জীবনের জিহাদগুলোতে বেশি নজর দেওয়া হয়। কিন্তু রাসূল সা.-এর গোটা জীবনে খুব কম অংশ জুড়েই ছিল জিহাদ। তিনি সন্তানসন্ততি আর নাতিদের নিয়ে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন কাটিয়েছেন। তার সরল-সিধা জীবন ও আড়ম্বরহীনতার কারণে সবাই তাকে ভালোবাসতেন। জিহাদ ছিল তাঁর সর্বশেষ পন্থা। যখন কোনো উপায় ছিল না, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুদ্ধে নামতেন। {পৃ. ১৩০}
পর্যালোচনা
বিজ্ঞ লেখক তো রাসূলুল্লাহ সা.-এর জন্মদিন থেকে শুরু করে মৃত্যুদিবস পর্যন্ত গোটা সুয়কে আদর্শ হিসেবে বিশ্বাস করেনে বং প্রচার করেন, রাসুলুল্লাহ সা.-এর নবুওয়াতপূর্ব জীবন থেকে এমন সব ভয়াবহ বিধান সাব্যস্ত করেন, যা কিনা খোদ কুরআনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক, তাই তিনি রাসুলুল্লাহ সা.-এর অনুসরণীয় জীবনের বড় অংশেই জিহাদ খুঁজে পান না। অথচ ন্যায়নিষ্ঠ যে-কোনো সিরাতপাঠক রাসুলুল্লাহ সা.-এর অনুকরণীয় জীবনের বড় অংশেই জিহাদ খুঁজে পাবেন। কারণ, রাসুলুল্লাহ সা.-এর নবুওয়াতি জীবনের মোত সময় হলো তেইশ বছর। প্রথম তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরই তিনি নবি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে রাসুল হন এবং প্রকাশ্যে দাওয়াত দিতে শুরু করেন। মক্কায় রাসুলুল্লাহ সা.-এর দশ বছরের জীবনে জিহাদ ছিলো না ঠিক, কিন্তু মদিনার পুরো সময়টিই তো জিহাদপূর্ণ ছিলো; যার সময়সীমা হলো দশ বছর। রিসালাহর বিশ বছরের দশটা বছরই যদি কেউ জিহাদের মহান খেদমত আঞ্জাম দেয়ার কাজে রত থাকেন, এমনকি তার তিরোধানের সময়ও এক বাহিনী যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এরপরও কি কেউ তার জীবনের বড় অংশ জিহাদশূন্য দেখতে পায়? “মুসলিম-অমুসলিমদের লেখা কিছু জীবনীতে রাসূল সা.-এর জীবনের জিহাদগুলোতে বেশি নজর দেওয়া হয়। কিন্তু রাসূল সা.-এর গোটা জীবনে খুব কম অংশ জুড়েই ছিল জিহাদ। তিনি সন্তানসন্ততি আর নাতিদের নিয়ে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন কাটিয়েছেন।” হায়!
“জিহাদ ছিল তাঁর সর্বশেষ পন্থা। যখন কোনো উপায় ছিল না, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুদ্ধে নামতেন।” প্রতিরোধমূলক জিহাদের ক্ষেত্রে এই কথাটি প্রযোজ্য হলেও আক্রমণাত্মক জিহাদের ক্ষেত্রে তা কি আদৌ বাস্তব? কে তাদেরকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র এবং গোত্রগুলোর ওপর আক্রমণ করতে বাধ্য করেছিলো যে, এ কথা বলা হবে যে, কোনো উপায় ছিল না।
ফিকহুল জিহাদ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে নীরব থাকাটাই সঙ্গত। কিন্তু এভাবে ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার তো কোনো অর্থ নেই। জিহাদ অবশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু বিষয়টাকে তিনি যে আঙ্গিকে চিত্রিত করেছেন, তা তো শুধু তাদের পক্ষেই মানা সম্ভব, যারা ইসলামের আক্রমণাত্মক জিহাদকে অস্বীকার করে।
পর্যালোচনা: ৮
“সন্তানের জন্য বাঁচা: মা আমিনার স্বামী মারা যান ৫৭১ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ। তারপররো তিনি কিন্তু আর বিয়ে করেননি। তখনকার সমাজ অবশ্য বিধবাদের খাটো চোখে দেখত না। যাদের বংশ ভালো ছিলো, তাদেরকে উঁচু নজরে দেখত। আমিনার রূপ আর কবিতা আবৃত্তির গুণে চাইলেই তিনি আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারতেন। সমাজ যে তাঁকে এ ব্যাপারে পীরাপীড়ি করেনি, তা কী করে বলি? কিন্তু তিনি বিধবাই থেকে গেলেন। সেই সমাজে বড় পরিবারের আলাদা মর্যাদা ছিল। আমিনার মনেও হয়ত অমন বড় পরিবারের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর ছেলে মুহাম্মাদের জন্য নিজেকে কোরবান করেছিলেন। শিশু মুহাম্মাদের জীবনকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করতে নিজের জীবনের সাথে আপোষ করেছিলেন। তাঁর এই সিদ্ধান্ত মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। ছিল প্রথাবিরোধী। বিশ বছর বয়সী এক বিধবা তরুণীর জন্য এই সিদ্ধান্ত যে অনেক কষ্টের ছিল, তা বলাই বাহুল্য।” {পৃ. ২১}
“স্বামী মারা যাবার সময় তার বয়স হবে বড়জোর বিশের কোঠায়। চাইলে তিনি আবার বিয়ের পিড়িতে পিঁড়িতে বসতে পারতেন। সেটা না করে তিনি বিশেষ গুণের পরিচয় দিয়েছিলেন। এটা অনেকের জন্যই অনেক বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে।” {পৃ. ৪০}
পর্যালোচনা
সন্তানদেরকে প্রোফেট মুহাম্মাদের মতো স্মার্ট করে গড়ে তোলার জন্য তবে কি যুবতী বয়সে বিধবা হলেও বাকিজীবন বিয়ে না করে থাকাটা সঙ্গত? এতে সন্তান স্মার্ট হয়ে গড়ে উঠলেও মা কি নিশ্চিতভাবে পারবে তার চারিত্রিক পবিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে? ইসলাম এমন মা’কে কি নির্দেশনা দেয়? ইসলামের রুচি-প্রকৃতি এবং আদর্শ-ভাবধারা সঙ্গে কোনটা খাপ খায়? আমরা কি ইসলামের নির্দেশনার ওপর ইসলামপূর্ব যুগের কারো অবস্থাকে প্রাধান্য দেয়ার অধিকার রাখি? উপরন্তু তিনি যে পুনরায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন নি—এর প্রকৃত কারণ কি কোনো বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে? তাহলে কিসের ভিত্তিতে উম্মাহকে স্মার্ট হওয়ার ডোজ হিসেবে এই বারতা দেয়া হচ্ছে?
পর্যালোচনা: ৯
“খেলাধুলার গুরুত্ব: ছোট বয়সে তাদের খেলার সময়সীমা কেটে দিবেন না। এমন ভাবার দরকার নেই যে, তারা বড় হয়ে গেছে, এখন আর বেশি খেলার দরকার নেই। আবার সে কোন ধরনের খেলা খেলবে, সেটাও চাপিয়ে দিতে যাবেন না। ওকে ওর মতো খেলতে দিন। মনের মতো। শিশু মুহাম্মাদ সা. যখন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, তখন বক্ষবিদারণের সেই বিখ্যাত অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কাজেই খেলাধুলার সময়কে অবমূল্যায়ন করবেন না। শিশুদের বেড়ে ওঠা ও শেখার জন্য এটা পারফেক্ট অপরচুনিটি।” {পৃ. ২৭}
পর্যালোচনা
“আবার সে কোন ধরনের খেলা খেলবে, সেটাও চাপিয়ে দিতে যাবেন না। ওকে ওর মতো খেলতে দিন। মনের মতো।” ইসলাম কি এ কথা বলে? ইসলামে কি সবধরনের খেলাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে? খোদ রাসুলুল্লাহ সা. পর্যন্ত কোনো কোনো খেলা থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি নিজ স্ত্রী আয়িশা i-কেও একধরনের খেলা খেলতে দেখে বারণ করেছেন। খেলাধুলা বিষয়ক অন্যান্য হাদিসও বর্ণিত হয়েছে, যাতে বিশেষ ধরনের কতক খেলাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাহাবিদের থেকে এমন অনেক আসারও বর্ণিত হয়েছে, যাতে এক সাহাবি অপর সাহাবিকে বিশেষ ধরনের খেলা থেকে নিষেধ করেছেন; যেমন উমর রা. নিজ সন্তানকে একধরনের খেলা খেলতে দেখে নিষেধ করেন।
যদি অবাধে যেকোনো খেলায় মেতে ওঠার সুযোগ থাকতো, তাহলে মুসলিমদের খেলা কী হবে—এ নিয়ে এতো এতো লেখালেখির কি কোনো প্রয়োজন ছিলো? খেলাধুলা যেভাবে শিশুদের সুন্দর মানসিকতা গড়ে তোলে, বর্তমানে প্রচলিত অধিকাংশ খেলা তাদের মানসিকতাকে কালিমালিপ্ত করে। এ বইয়ের সম্বোধিত পাঠক যারা, তারা সাধারণত ডিভাইসের সামনে বা মাঠে-ময়দানে কোন ধরনের খেলায় অভ্যস্ত—তা তো কারো অজানা নয়। এমতাবস্থায় প্রোফেট মুহাম্মাদের মতো সন্তানকে স্মার্ট করে গরে তুলতে হলে কি খেলাধুলার লাগাম অবুঝ শিশুদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে? আচ্ছা, এর পরিণতি কী হবে?
দ্বিতীয় বিষয় হলো, “শিশু মুহাম্মাদ সা. যখন অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, তখন বক্ষবিদারণের সেই বিখ্যাত অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কাজেই খেলাধুলার সময়কে অবমূল্যায়ন করবেন না।” রাসুলুল্লাহর বক্ষবিদারণের জন্য সেই সময়কে নির্বাচনের দ্বারা যদি অবাধে খেলাধুলার গুরত্ব অনুমিত হয়, তাহলে তো কেউ স্মার্ট হওয়ার জন্য এর থেকে নিজের মা’কে ছেড়ে সুদূরে থেকে অন্য কারো দুধ খাওয়া, শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা ইত্যাদির গুরুত্বও প্রমাণিত করার চেষ্টা চালাতে পারে। বক্ষবিদারণের ঘটনা থেকে খেলাধুলার গুরুত্ব আদৌ অনুমিত হয় কি? পুরো বইয়েই লেখক ধারণা-অনুমানের পথে হেঁটেছেন। একটা বইয়ের বেশিরভাগ কথাই যদি দ্রেফ অনুমানভিত্তিক হয়, তখন তার মান এমনিতেই ক্ষুণ্ণ হয়। উদাহরণ হিসেবে তার অনুমাননির্ভর বাক্যের একটি নমুনা উল্লেখ করছি—“সুতরাং রাসূল সা.-ও যে এসব ঘটনা (আদিপুরুষের কীর্তি) শুনে থাকবেন সেটা আশ্চর্যের না। হয়ত এসব ঘটনা থেকে তিনি অনুপ্রেরণাও নিয়ে থাকবেন।” অথচ প্রায় সকল বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যের পন্ডিতদের উদ্ধৃতি উল্লেখ করলেও অনুসরণীয় সিরাতের উল্লেখযোগ্য কিছু বইয়ে উল্লিখিত হয় নি।
এখানে আরেকটি বিষয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, লেখক বইয়ের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে আলোচনা করেছেন, তাতে এ কথাই স্পষ্ট হচ্ছে না যে, তিনি আসলে কার জীবনকে আদর্শ মানছেন? রাসুলের ব্যক্তিজীবনকে? তার মা চাচা দাদী? জাহেলি যুগের লোকেরা? ঘটনা যা-কিছু পেয়েছেন, সবগুলো থেকেই কোনো না কোনো মেসেজ বের করে এনেছেন। এরকম মেসেজ বের করতে তো সেই জাহেলি যুগ পর্যন্ত যাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের সমাজেও তো ভালো মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকল ভালো মানুষকে নিয়েই তো তাহলে বই লিখতে হয়। আর তাদের সবার জীবনকে আদর্শ এবং স্মার্ট হওয়ার মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা দিতে হয়।
আরেকটি বিষয় হলো, লেখক তার আলোচনাপ্রসঙ্গে কখনো জাহেলি যুগের বিভিন্ন আচাররীতি তুলে এনেছেন। সেখান থেকে অনেক শিক্ষাও বের করে এনেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি জাহেলি যুগের জাহিলিয়াত চিহ্নিত করার জন্য কোনো শব্দই ব্যবহার করেন নি। ফলে বইয়ের পাঠকরা যে স্তরের, তাতে তারা সেই বিষয়টিকে অন্যায় হিসেবে নাও চিনে থাকতে পারে; বরং আরো দশটি বিষয়ের মতো সেটাকেও একটা সাধারণ বিষয় হিসেবেই নিতে পারে। যেমন একটি উদ্ধৃতি—“তো তার কিছু বন্ধু তাকে বললেন, গণকের কাছে যেতে হবে। সে হয়ত তাকে মানসম্মন বাঁচিয়ে কোনো বিকল্প বলে দেবে। তিনি গেলেন। গণক বলল ছেলের বদলে ১০০ উট কুরবানী দিতে। তিনি তা-ই করলেন।”
আর তাছাড়া ইতিহাস বলে, গণক ১০০ উট কুরবানি দিতে বলেছে—বিষয়টি ঠিক এমন নয়। আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া থেকে ঘটনার এই অংশটি দ্রষ্টব্য—
أشارت قريش على عبد المطلب أن يذهب إلى الحجاز فإن بها عرافة لها تابع، فيسألها عن ذلك، ثم أنت على رأس أمرك إن أمرتك بذبحه فاذبحه، وإن أمرتك بأمر لك وله فيه مخرج قبلته، فانطلقوا حتى أتوا المدينة فوجدوا العرافة – وهي سجاح – فيما ذكره يونس بن بكير عن ابن إسحاق بخيبر، فركبوا حتى جاؤها فسألوها وقص عليها عبد المطلب خبره وخبر ابنه.
فقالت لهم: ارجعوا عني اليوم حتى يأتيني تابعي فأسأله، فرجعوا من عندها، فلما خرجوا قام عبد المطلب يدعو الله، ثم غدوا عليها.
فقالت لهم: قد جاءني الخبر، كم الدية فيكم؟ قالوا: عشر من الإبل، وكانت كذلك.
قالت: فارجعوا إلى بلادكم، ثم قربوا صاحبكم، وقربوا عشرا من الإبل، ثم اضربوا عليها وعليه بالقداح، فإن خرجت على صاحبكم فزيدوا من الإبل حتى يرضى ربكم، وإن خرجت على الإبل فانحروها عنه فقد رضي ربكم، ونجا صاحبكم، فخرجوا حتى قدموا مكة، فلما أجمعوا على ذلك الأمر قام عبد المطلب يدعو الله، ثم قربوا عبد الله وعشرا من الإبل.
ثم ضربوا فخرج القدح على عبد الله فزادوا عشرا، ثم ضربوا فخرج القدح على عبد الله فزادوا عشرا، فلم يزالوا يزيدون عشرا عشرا، ويخرج القدح على عبد الله حتى بلغت الإبل مائة، ثم ضربوا فخرج القدح على الإبل، فقالت عند ذلك قريش لعبد المطلب وهو قائم عند هبل يدعو الله: قد انتهى رضي ربك يا عبد المطلب.
পর্যালোচনা: ১০
“রাসূল সা. যে বিশেষ কিছু সেটা শিশু বয়সেই তাঁর মা ঠাহর করেছিলেন। মা’র ধারণা কখনো ভুল হয় না।” {পৃ. ৭২}
পর্যালোচনা
নবির ধারণাই যদি ভুল প্রমাণিত হতে পারে, সেখানে মা’র ধারণা কখনো ভুল না হয়ে কী উপায়? তা’বিরুন নাখল এবং বদরযুদ্ধের বন্দিদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা.-এর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিলো। মা’র ধারণা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ হয়—এটা ঠিক হলেও তার ধারণা কখনো ভুল নয়—এটা বাস্তবসম্মত নয়। এটা হয়তো লেখকের ভুল কিংবা অসতর্কতা। তবে বিষয়টা যেহেতু বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত, তাই অবশ্যই সতর্কতা কাম্য।
[1] জামিউ বায়ানিল ইলম: ১০৯৭
[2] সুরা কাহাফ: ১১০
[3] সুরা মুমতাহিনা: ৬
[4] সুরা আহযাব: ২১
[5] https://islamqa.info/ar/59879
জাযাকাল্লাহু খাইরান! প্রিয় শাইখ! আমি তো আমার পরিবারে এই বইটির তালিম শুরু করে দিয়েছিলাম। আপনার এই লেখাটি আমার চোখ খুলে দিয়েছে। জাযাকাল্লাহু খাইরান!!