‘বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি’র নামের অসারতা
১. শরয়ি পরিভাষাগুলোর সংরক্ষণ উম্মাহর ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। পরিভাষার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। এ জন্য তার যথাযথ সংরক্ষণ না হলে কালের বিবর্তনে এর দ্বারা উম্মাহর বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়।
২. মাওলানা মওদুদি রাসুলুল্লাহ সা.-কে চেনাতে গিয়ে ‘লিডার’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। উম্মাহর বিদগ্ধ আলিমগণ এর ওপর কড়া আপত্তি জানিয়েছেন। কারণ, রাসুল রাসুলই, নবি নবিই। তাকে এই পরিভাষার সঙ্গেই স্মরণ করা উচিত। অন্যথায় ট্রাম্পও তো একজন লিডার আর রাসুলও হয়ে যাচ্ছেন লিডার। লিডার ভালোও হতে পারে, মন্দও হতে পারে। এতে রাসুলের মর্যাদাহানিই হচ্ছে।
৩. রাসুল অর্থ দূত, নবি অর্থ সংবাদদাতা। এখন ডাকপিয়নদের নাম রাসুল রেখে দেওয়া, সাংবাদিকদের নাম নবি রেখে দেওয়া কি সংগত হবে? মুসল্লি’র অর্থ হয় দুয়াকারী। তার অর্থ আরও হয় নিতম্ব দুলিয়ে নৃত্যকারী। এখন যেকোনো দুয়াকারীকে বা ড্যান্সার পার্টিকে কি মুসল্লি বলা যাবে? হাজি অর্থ ইচ্ছাকারী। ব্যভিচারের ইচ্ছাকারীকে কি হাজি বলা যাবে? সায়িম অর্থ শুধু সওম পালনকারীই নয়, বরং যে নিজেকে কোনো কিছু থেকে ধরে রাখে তাকেই শাব্দিক অর্থের বিচারে সায়িম বলা যায়। এখন যে নিজেকে চুরি করা থেকে ধরে রাখল, তাকে সওম পালনকারী বলা কি সংগত হবে? যাকাত অর্থ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। যার শরীরের মেদ বেড়ে গেল, তাকে কি যাকাতদাতা বলা যাবে? কোনো শব্দ যখন পরিভাষা হয়ে যায়, তখন ব্যাপকভাবে অন্য অর্থে তার ব্যবহার সমর্থনযোগ্য থাকে না।
৪. আমাদের দেশের মানুষদের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন : তারা প্রথমে কোনো পরিভাষাকে শাব্দিক অর্থে ধরে তাকে ব্যাপক করে ফেলে। এরপর পারিভাষিক বিষয়টির ব্যাপারে বর্ণিত ফজিলতসমূহকে সেই পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের ওপর প্রয়োগ করে। যেমন : প্রথমে জিহাদকে শাব্দিক অর্থের বিবেচনায় ব্যাপক করবে। এরপর দাওয়াত ও তাবলিগের মোবারক মেহনত কিংবা ইসলামের নামে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত করবে। তারপর পারিভাষিক জিহাদের ব্যাপারে বর্ণিত সকল ফজিলতকে এ সকল বিষয়ের ওপর প্রয়োগ করবে। একইভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের আমিরের বিধানকে তাবলিগ জামাতের আমিরের ওপর প্রয়োগ করা হয়।
আচ্ছা, আমাদের দেশে তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে দর্জিকে খলিফা বলা হয়। তবে কি সেই খলিফার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত খলিফার বিধান-মর্যাদা প্রয়োগ করা উচিত নয়? আহলে হাদিসদের বড় আলিম মুহতারাম আসাদুল্লাহ গালিব পুরোনো কিতাব ঘেটে মুহাদ্দিস অর্থে যতগুলো আহলে হাদিস শব্দ পেয়েছেন, সেগুলোকে এনে প্রয়োগ করেছেন বর্তমান আহলে হাদিস নামক ফেরকার ওপর। অথচ এ দুয়ের মধ্যে কী মিল? বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির আমির যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে জিহাদ বলে থাকেন, তাও বোধ হয় এ নামের কারণেই বলে থাকেন। দেশের দর্জিরা এ বিষয়টি বুঝলে সেই কবেই কাপড় সেলাইকে খেলাফত নামে নামকরণ করত এবং পুরো উম্মাহকে কাপড় সেলাইয়ের মহান ব্রতের দিকে আহ্বান করত।
৫. ব্যতিক্রম প্রয়োগ এবং ব্যাপক প্রয়োগ এক বিষয় নয়। কুরআন-সুন্নাহয় জিহাদের ব্যাপক প্রয়োগ পারিভাষিক অর্থে, ব্যতিক্রম প্রয়োগ রয়েছে শাব্দিক অর্থেও। কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। সাহাবা-তাবেয়িন কেউ জিহাদ শব্দ শুনলে শাব্দিক অর্থ বুঝতেন না এবং জিহাদের ডাক এলে নফসের সঙ্গে ঢিসুম-ঢিসুম শুরু করতেন না। কোনো পরিভাষাকে কখনো কোনো অবস্থায় শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করা যাবে না, এ কথা আমরা বলি না। বিষয়টা তখনই নিন্দনীয় হয়, যখন ব্যাপকভাবে তাকে পারিভাষিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য অর্থে ব্যবহার করা হয়। কারণ, এতে উম্মাহর বিভ্রান্তির পথ খোলে। আজ নয়তো কাল, এ বিষয়গুলো বিরাট ফিতনার রূপ পরিগ্রহ করে। পরভাষাকেন্দ্রিক কেউ যেন বিভ্রান্তিতে না পড়ে, এ ব্যাপারে মহান সালাফে সালেহিনও বেশ সোচ্চার ছিলেন। এ জন্য ‘রব’ অর্থ অধিকারী, কর্তা হওয়া সত্ত্বেও কাউকে ‘রব’ বলে ডাকাকে তারা নাজায়িয বলেছেন। হাঁ, যদি বিভ্রান্তির পথ বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। এ জন্যই গৃহকর্তাকে ইজাফতের সঙ্গে ‘রাব্বুল বাইত’ বলা যায়; কিন্তু শুধু ‘রব’ বলার অবকাশ নেই। আবার গোলাম তার মনিবকে ‘রাব্বি’ বলে ডাকাকে নিষেধ করা হয়েছে; অথচ এখানে কিন্তু ইজাফত রয়েছে। এরপরও জিনিসটা নিষিদ্ধ।
শাব্দিক অর্থ সব কিছুকে বৈধতা দিলে ‘আনাল হক’ই-বা কী সমস্যা? শাব্দিক অর্থের বিচারে যে-কেউই তো নিজেকে ‘আনাল হক’ বলতে পারে। অনেকের নাম রয়েছে ‘মুজাহিদ’, কারও কারও নাম রয়েছে ‘শহিদ’। এর ওপর কিন্তু কেউ আপত্তি তুলেনি। তোলার কথাও নয়। কারণ, এগুলো হচ্ছে সীমিত প্রয়োগ। এতে ফিতনার আশঙ্কা নেই। তাই তো ‘মুজাহিদ’ নামের কাউকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি, কীরে ভাই, তোমার অস্ত্র কই? তুমি দেখি, দিনরাত কিবোর্ড চাপাচাপি করো আর কম্বলের নিচে শুয়ে থাকো। তবে কেমন মুজাহিদ তুমি? কিংবা ‘শহিদ’কে বলেনি, হে শহিদ, কবে তুমি কবর চিড়ে বেরিয়ে এলে?
৬. তারা যে নিজেদের মুজাহিদ মনে করে, এর হাজারো প্রমাণ তাদের আমিরদের বয়ানেই পাওয়া যাবে। এমনি এমনিই তো নির্বাচনকেও জিহাদ বলে ঘোষণা দেয় না। নির্বাচন যদি জিহাদ হয়, তাহলে যে নির্বাচনে দাঁড়াবে সে তো মুজাহিদ হবেই।
৭. তাদের অন্যতম দলিল হচ্ছে সেই হাদিস—‘মুজাহিদ তো সে, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ করল।’ প্রথম কথা হলো, আল্লাহর আনুগত্য কোনটা? গণতান্ত্রিক রাজনীতি নাকি ইসলামি খিলাফাতব্যবস্থা? তো কুফরি তন্ত্রের ধারক হয়ে কীভাবে নিজেদের আল্লাহর আনুগত্যপরায়ণ দাবি করা হয়? দ্বিতীয় কথা হলো, এটা তো ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য; দলের নয়। যে নফসের সঙ্গে জিহাদ করবে, সে মুজাহিদ হবে। যে ইআবা’র ফরম পূরণ করবে, সে কীভাবে মুজাহিদ হয়? তাকে এই সার্টিফিকেট কে দিলো? বিষয়টির সম্পর্ক তো কাজের সাথে; দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সাথে নয়। তৃতীয় কথা হলো, ‘নফসের সঙ্গে জিহাদ’ বিষয়টি অদৃশ্য। এর ফায়সালা আল্লাহই করতে পারেন। কারও বাহ্যিক অবস্থা দেখে অন্তরের ব্যাপারে ফায়সালা করে দেওয়া সমীচীন নয়। তাহলে কে মুজাহিদ আর কে মুজাহিদ না, সে তাযকিয়া আল্লাহ দিতে পারেন, তুমি কীভাবে দাও? চতুর্থ কথা হলো, নফসের জিহাদ একটা ব্যক্তিগত কাজ। এতে তো কোনো আমিরের প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকেই নিজের আমির। তাহলে ‘আমিরুল মুজাহিদিন’ আবার কাহাঁ সে আয়া? বিষয়টি তো বোধগম্য নয়।
৮. যারা বাস্তবিক মুজাহিদ নয়, তারাও যখন নিজেদের নাম রাখে মুজাহিদ তখন তাদের কি ধোঁকাবাজ বা বিভ্রান্ত আখ্যা দেওয়া উচিত নয়? নিজেরা না বুঝে করে থাকলে বিভ্রান্ত আর বুঝেশুনে করে থাকলে ধোঁকাবাজ। এখানে ব্যতিক্রম প্রয়োগের সেই দৃষ্টান্তগুলো টেনে কোনো লাভ নেই। কারণ, মুজাহিদ নামধারী ব্যক্তি আর মুজাহিদ নামধারী কমিটি এক কথা নয়। জিহাদ ব্যক্তিগত কাজ নয়, বরং সামগ্রিক কাজ। জিহাদ হয়ই দলীয়ভাবে। তো কোনো দল নিজেদের মুজাহিদ নামে নামকরণ করলে এর অর্থ এটাই হয় যে, তারা জিহাদে লিপ্ত। তো কোথায় সেই জিহাদ? কম্বলের নিচে নাকি কিবোর্ড বা বাঁশ হাতে?
৯. কোনো হাদিসের কিতাবে কিংবা ফিকহের কোনো কিতাবে জিহাদ অধ্যায়ে কেন নফসের জিহাদের আলোচনা আসল না? জিহাদের এত বড় প্রকার সম্পর্কে তবে তারা কেন এতটা উদাসীন? সবাই মিলে কীভাবে এত বড় ভুলটা করলেন? নাকি নফসের জিহাদ যে আদতে কোনো জিহাদ না, এটা তারা ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন? ‘মুহাজির তো সে, যে গুনাহ ত্যাগ করে।’ এটাও তো হাদিস। তো সকল পীর সাহেবকেই তো মুহাজির নামে নামকরণ করা দরকার। কিন্তু বাস্তবে হিজরত করেনি, এমন কারও ব্যাপারে মুহাজির শব্দের প্রয়োগ কখনো দেখানো যাবে কি?
১০. প্রতিটা মানুষই এমন, যে জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নফসের সঙ্গে জিহাদ করেছে। তাহলে তো সবাই মুজাহিদ হওয়া উচিত। আচ্ছা, সবাই যদি মুজাহিদ হয় তাহলে নির্দিষ্ট এক দলের নাম এটা কীভাবে হতে পারে? ‘বাংলাদেশ মানুষ কমিটি’ নামটা যেমন অসার, এ নামটাও তো তখন তেমনই অসার হয়ে যাবে। তা ছাড়া নফসের সঙ্গে কয়দিন এবং কতটুকু জিহাদ করলে মুজাহিদ নামধারণ করা শুদ্ধ হয়, এ সম্পর্কেও স্বচ্ছ আলোচনা দরকার। আর এ গোপন বিষয়ের ফায়সালা করার যোগ্যতা আল্লাহ কোন কোন অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত (!) ব্যক্তিকে দিয়েছেন, তাদের বিস্তারিত পরিচয়ও জানা দরকার।
প্রসঙ্গ : দলান্ধতা
১. দলান্ধতা মানে কী? দলান্ধতা মানে সত্যের ওপর দলকে প্রাধান্য দেওয়া। সত্য যদি দলের মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তাহলে সত্যকে মেনে নেওয়া, অন্যথায় দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা। আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র ব্যাপারে আমরাও খুব বয়ান করি যে, তাদের কর্মীরা সত্যের ওপর নিজেদের নেতা-নেত্রীদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অথচ বাস্তবতা হলো, এ কাজ শুধু তারাই নয়; বরং আমরাও করি। আরও বেশি পরিমাণে করি।
২. কেউ যখন কুরআন-সুন্নাহ থেকে, সালাফে সালেহিনের বক্তব্য-আমল থেকে কোনো বিষয়ের পক্ষে প্রমাণ পেশ করে তখন আমরা বলি, আমাদের নেতা কি কম বোঝেন নাকি। যেমন : শরিয়াহর দলিল বলে, জিহাদ সর্বকালের জন্য। এই বিধান দাজ্জালের সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকবে। আর আমার দলের নেতা বলেন, ‘এ যুগে অস্ত্রের জিহাদ সম্ভব না। কারণ, আমি এইখানে বইসা কী বলতেআছি সিআইএ তা শুনতেআছে, সব দেখতেআছে। তাই আমরা নির্বাচনের জিহাদ করি। আত্মশুদ্ধির জিহাদ করি। হালকায়ে জিকিরের জিহাদ করি। শান্তিপূর্ণ জিহাদ করি।’ আমরাও নির্দ্বিধায় সবকিছু মেনে নিই। এটাই হলো সত্যের ওপর ব্যক্তিকে প্রাধান্যদান।
৩. দলিল বলে, ‘বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি’ নামটি অসার। আমরা এবার দলকে বাঁচানোর জন্য বিকল্প পথ ধরি। আমরা বলি, আরে, কোন যুগে, কোন প্রেক্ষাপটে আমাদের দাদাপীর এ নামটি রেখেছেন, তা কি আপত্তিকারী জানেন? এরপর কথা হলো, নামটি যদি ভুলই হতো তাহলে দেশের দারুল ইফতাগুলো আমাদের ডেকে কেন সংশোধন করে দিলো না? সেই যে পিঠ বাঁচানোর কুযুক্তি! দেশের দারুল ইফতাগুলো তো গণতন্ত্রকে হারাম বলে না, তাই বলে কি তা হালাল হয়ে গেল? দেশের দারুল ইফতাগুলোর এক লক্ষ পাঁচ হাজার সদস্য মিলে তো জিহাদবিরোধী ফতোয়াও প্রসব করে, তাই বলে তা কি দলিল হয়ে গেল? আচ্ছা, দেশের হকপন্থী একাধিক দারুল ইফতাওয়ালা তো আপনাদের ডেকে এই আসমান-জমিন প্রকম্পিতকারী ‘ইল্লাল্লাহ’র জিকির পরিত্যাগ করতে আদেশ করেছেন, আদৌ তা করেছেন কি? দেশের হকপন্থী দারুল ইফতাগুলো তো আপনাদের ডেকে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করে উম্মাহর সিংহপুরুষদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে বলেছেন, আজও তা করতে পেরেছেন কি? দলপ্রীতি থেকে যারা আলিমকুল শিরোমণি আল্লামা শাহ আহমদ শফি (হাফিজাহুল্লাহ)-এর সঙ্গে প্রকাশ্য বেয়াদবি করে অভিশাপও কুড়াতে পারে, তাদের মুখ থেকে এসব বুলি নিতান্তই হাস্যকর।
৪. দারুল ইফতাগুলোর সীমাবদ্ধতা কে না জানে? তিন তালাকের ফতোয়া, ফারায়িজের কিছু মাসআলার ফতোয়া, ইসলামি ব্যাংকিংবিরোধী ফতোয়া দেওয়াও অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য মুশকিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এটা তাদের ভ্রান্তি নয়; বরং সীমাবদ্ধতা। এ কথা তারাও নির্দ্বিধ স্বীকার করেন। তো এটাকে দলিল বানানো কি কোনো অবস্থায় সংগত? আসলে আমরা দলিলের আলোকে দলকে ঢেলে সাজাতে চাই নাকি দলের আদলে দলিল বের করে আনতে চাই, তা বোঝা মুশকিল।
৫. সত্যের ওপর সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দিলে তা হয় কাওমিয়্যাহ। সত্যের ওপর দেশকে প্রাধান্য দিলে তা হয় ওয়াতানিয়্যাহ (জাতীয়তাবাদ)। একইভাবে সত্যের ওপর দলকে প্রাধান্য দিলে তা হয় হিযবিয়্যাহ। এসবই আসাবিয়্যাহ। সবগুলোই নিন্দনীয়। আমার দল আমাকে বাঁচাবে না। শরিয়াহর দলিলই পারে আমাকে বাঁচাতে, আমার জিন্দেগির সুষ্ঠু সমাধান দিতে।
৬. যারা শরিয়াহ-বিকৃতির রোগে আক্রান্ত, তারা আর যা-ই হোক, হকের আইডল হতে পারে না। এমন পীরের থেকে নিজে সংশোধন হওয়া তো দূর কি বাত; খোদ এমন পীরেরই তো সংশোধন প্রয়োজন এবং তা জরুরি ভিত্তিতে। ইতিহাস পড়ে দেখুন, এই উপমহাদেশে সংস্কারধর্মী কাজ যারা করেছেন, তাদের সবচে বড় শত্রু ছিল এসব পীররা। মুজাদ্দিদে আলফে সানির কথাই বলুন আর শাহ ইসমাইল শহিদের কথাই বলনু। পীরের তো আগে আত্মশুদ্ধি হতে হবে, এরপর না মুরিদের আত্মশুদ্ধি। শরিয়াহবৃক্ষের ডালপালা নিয়ে যে লোকগুলো বসে রয়েছে, তারা যে নিজেরাই বৃক্ষের শেকড় কেটে দিয়ে এসেছে, সে বিচার কে করবে? এমন পীররা হয়তো নিরেট অজ্ঞ কিংবা ভ্রান্ত। দাদাপীর রহ. নিজেই তো কিতাব লিখেছেন, ‘পীর হয়েও আবার কাফের হয় কেন’। এ ধরনের কিতাব আরও বেশি বেশি লেখা হওয়া দরকার। এ ছাড়াও তাদের বইপত্রে স্পষ্ট কুফরি কথাবার্তার অভাব নেই। সেগুলোর কারণে ব্যক্তিকে তাকফির না করা হলেও তাদের অজ্ঞতা তো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এরপরও দেখেও যে দেখে না, শুনেও যে শোনে না, তাকে তো কোনোদিনই শোনানো যাবে না।
৭. অমুক আলিম নির্বাচনে অংশগ্রহণকে জরুরি বলেছেন, তমুক আলিম ভোট দেওয়াকে ওয়াজিব বলেছেন। বেশ ভালো কথা। আমরাও বলি। নির্বাচন করা, ভোট দেওয়া শুধু মানবিক দায়িত্বই নয়; বরং এক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। কিন্তু ফতোয়ার এ অংশ নিয়েই তো লাফ দেওয়ার কিছু দেখি না। কারণ, নির্বাচন ওয়াজিব, কিন্তু তা কোন নির্বাচন? ভোট দেওয়া জরুরি, কিন্তু তা কোন ভোট? শহিদরা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে—এ কথা শুনে নিজের নাম শহিদ রেখে দিলেই কি বিনা হিসেবে জান্নাতে যাওয়া যাবে? মুজাহিদ নামের ব্যক্তিরা কি নিজেদের ওপর মুজাহিদদের বিধান এবং ফজিলত প্রয়োগ করতে পারবে? নামের সাদৃশ্য দেখেই যে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই।
৮. কেউ হকপন্থী না হওয়ার অন্যতম প্রমাণ হলো, হক গ্রহণের মানসিকতা না থাকা। শত শত প্রকাশ্য ভুল উম্মাহর বিদগ্ধ আলিমগণ চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়ার পরও সেসব ভুলের ওপর অটল থাকা, উল্টো ভুলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য শরিয়াহর ওপর অপারেশন চালানো এবং প্রবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দলিল সন্ধান, ভুল চিহ্নিতকারীর বিরুদ্ধে জবানদারাজি, এমনকি তার ক্ষতি করার ব্যাপারেও ঘৃণ্য প্রয়াস—এসব কি কারও হক এবং হক্কানিয়াতের দলিল, নাকি এগুলো হিজবিয়্যাহর পক্ষে উজ্জ্বল প্রমাণ?
৯. কোনো দল এবং ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত শত্রুতা-বিদ্বেষ নেই। কেউ যদি হাজারো ভুল করার পরও নিজেকে শুধরে নেয় তবে সে আমাদেরই ভাই, পরমপ্রিয় ভাই। তবে কারও যদি শুধরে নেওয়ার মানসিকতা না থাকে, উল্টো বরং সতর্ককারীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মানসিকতা থাকে তবে তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং তার ভুলগুলো উম্মাহর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আলিম হিসেবে একজন দায়ীর, একজন আন-নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব।
১০. নেক সুরতে ধোঁকা সবচে বড় ধোঁকা। অভ্যন্তরীণ বিচ্যুতি সবচে বড় বিচ্যুতি। কাফির-বেদীনরা আমাদের সম্মিলিত শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উম্মাহর গুরুদায়িত্ব। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, দেহের বিষফোঁড়ার প্রতি নজরই দেওয়া হবে না। এটা বরং সর্বাগ্রে প্রয়োজন। এখানে কাউকে বিষফোঁড়া বলা উদ্দেশ্য নয়। বিষয়টি পরিষ্কার করা উদ্দেশ্য। নজরুল বড় সুন্দর বলেছেন :
‘আপনার ঘরে আছে যে শত্রু, তারে আগে করো জয়।
ভাঙো সে দেয়াল, প্রদীপের আলো যাহা আগুলিয়া রয়।’
প্রসঙ্গ : অপ্রিয় সত্য
১. পবিত্র কুরআন আমাদের জানাচ্ছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কাওমের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে নেয়।’ ব্যক্তি এবং সমাজ উভয় ক্ষেত্রে একই কথা। নিজেকে শুধরে নেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলা জোর করে কারও অবস্থা পরিবর্তন করেন না। নামাজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও আপনি যদি নামাজ না পড়েন এবং নামাজের ব্যাপারে গাফিলতি পরিহার করতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে উদ্যোগী না হোন তাহলে আল্লাহ তাআলা আপনাকে জোর করে নামাজি বানিয়ে দেবেন না। এমন হবে না যে, আজান হলে কোনো ফেরেশতা বেত নিয়ে তাড়া করে আপনাকে মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।
২. যারা সমাজে ইসলাম কায়েম করতে চায়, ইসলামি শাসন এবং বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে চায়, তারা নিজেরা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী না হয় তাহলে আল্লাহ তাআলা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাস্তবায়িত করে দেবেন না। কোনো এলাকায় কাফিররা আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করছে। এখন সেই এলাকার মানুষরা যদি প্রতিরোধ গড়ে না তুলে শুধুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে ধ্বংস হওয়া ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর থাকবে না। দুয়া সহায়ক এবং দুয়া মগজ। দেহ এবং মস্তক থাকলে মগজ কাজে দেবে। অন্যথায় শুধু মগজ দিয়ে কী হবে?
৩. ইসলামের সূচনা হয়েছে ‘গুরাবা’র অবস্থায়। রাসুল সা. বলেছেন, শীঘ্রই ইসলাম তার সূচনালগ্নের অবস্থায়ই ফিরে যাবে। এ কারণে তিনি ‘গুরাবাদের’ সুসংবাদও শুনিয়ে গেছেন। এ যুগে মুসলিমরা পৃথিবীর সর্বত্র চরমভাবে লাঞ্ছিত। কিন্তু এর কী কারণ? সাহাবিরা রাসুলুল্লাহ সা.-কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাদের প্রশ্ন ছিল, ‘সেদিন কি আমাদের পরিমাণে স্বল্পতার কারণে এমনটা হবে, হে আল্লাহর রাসুল?’ রাসুলুল্লাহ সা. প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘না, সে সময়ে সংখ্যার বিচারে তোমরা হবে অনেক। কিন্তু তোমরা হবে বানের খড়কুটোর মতো নিরেট খরকুটো। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের ভীতি উঠিয়ে নেবেন আর তিনি তোমাদের অন্তরে শাহাদাতের অনাকাঙ্ক্ষা এবং দুনিয়ার লোভ ছুড়ে দেবেন।’
৪. যে-কেউ পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে নামবে, তাগুত এবং খোদাদ্রোহীরা কোনোদিনও তাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখবে না। অবশ্যই অবশ্যই তাগুতের সঙ্গে তার এবং তাদের সংঘর্ষ বাধবে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের দুশমনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা না দিয়ে কখনো ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী, অমুসলিমরা কখনোই মুসলিমদের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না মুসলিমরা তাদের মতাদর্শের অনুসরণ করে। এ যুগে যারা নিজেরা ইসলামি শাসন, ইসলামি বিচার কায়েমের জিগির তুলছে, তাদের ব্যাপারেও কুফফার গোষ্ঠী সন্তুষ্ট। শুধু সন্তুষ্টই নয়, বরং তাদের সঙ্গে রীতিমতো হৃদ্যতা-সখ্যতা গড়ে তুলছে। কিন্তু কেন? কারণ একটাই। তারা মুখে ইসলাম কায়েমের জিগির তুলছে ঠিক, কিন্তু পথ এবং পন্থা হিসেবে কুফফার গোষ্ঠীর মতাদর্শকে আঁকড়ে ধরেছে। অবস্থা তো এমন যে, দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদকে সমার্থক বানিয়ে ফেলছে, গণতন্ত্র এবং ইসলামি শুরাব্যবস্থাকে অভিন্ন মনে করছে। আর যে-কেউ কুফফার গোষ্ঠীর পথ এবং পন্থাকে অনুসরণ করবে, কুরআনের আয়াত থেকেই অনুমেয় যে, তার প্রতি বিশ্ব তাগুত গোষ্ঠী নাখোশ থাকবে না।
৫. আমাদের দেশে ‘খেলাফত’ নামের দলও রয়েছে। ‘খেলাফত’ কমিটির প্রধানকে নির্বাচিত হওয়ার পর ‘খলিফা’ বলা হলে সেটাও অযৌক্তিক হবে না। তবে তারা বোধ হয় সেই নামকে ‘খেলাফত প্রতিষ্ঠার জামাত’ অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। তাই এ কারণে তাদের ওপর এখনো কাউকে আপত্তি করতে দেখা যায়নি। খেলাফত এবং খলিফা এক কথা নয়। ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী খলিফা হতে পারলেও খেলাফত হতে পারে না। এ থেকেই বোঝা যায় যে, খেলাফত কমিটি মানে হলো খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে পরিশ্রম ব্যয়কারী কমিটি। তাই এ শব্দ নিয়ে কারও বিভ্রান্তিরও আশঙ্কা নেই। একইভাবে দেশে ‘মুজাহিদ কমিটি’ আছে। এমনকি সেই কমিটির চিফ ইন কমান্ডার বা আমিরুল মুজাহিদিনও রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে আমিরুল মুজাহিদিন হবেন খলিফার অনুগত একজন ব্যক্তি। যাহোক, সবগুলো পদই পরিপূর্ণ রয়েছে।
তারা সবাই-ই দেশে ইসলামি শাসন এবং ইসলামি বিচার কায়েম করতে চান। আজ থেকে চান না, বরং সেই বহুকাল ধরে চেয়েই যাচ্ছেন। তবে তারা ইসলাম কায়েম করতে চান কুফরি ব্যবস্থার মাধ্যমে। অবস্থাটা ঠিক সেই ব্যক্তির মতো, পৃথিবীতে মুজাহিদ সৃষ্টির স্বপ্ন নিয়ে যে অহর্নিশ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তার উদ্দেশ্য তো ভালো, তবে গৃহীত কর্মপন্থা নিশ্চয় মন্দ। এ উদাহরণটাও পুরো খাপ খায় না। কারণ, ব্যভিচার হারাম হলেও কুফর না। পক্ষান্তরে তাদের অনুসৃত পথ ও পদ্ধতি যে অনৈসলামিক, এটা অস্বীকারের বোধ হয় কোনো জো নেই।
৬. পুঁজিবাদি ধারার ব্যাংকগুলোকেও যেমনিভাবে চেষ্টা-মেহনত করে ‘গাইরে সুদি ব্যাংকারি’ বা সুদমুক্ত ব্যাংক বানানো যায়, একইভাবে গণতন্ত্রের মাধ্যমেও হয়তো রাষ্ট্রীয় অনেক জুলুম-অনাচারকে রোধ করা যাবে। এটা অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু এ পন্থায় যে ইসলাম কায়েম হবে না এবং এ পন্থায় ইসলাম কায়েমের কোনো দৃষ্টান্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পৃথিবীর সামনে উপস্থাপনও করতে পারবে না, এ কথা নিশ্চয় তারাও নির্দ্বিধ স্বীকার করবেন। আল্লামা তাকি উসমানি (হাফিজাহুল্লাহ) ‘হাকিমুল উম্মত কে সিয়াসি আফকার’ গ্রন্থে বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। তিনি এমনটাও দেখিয়েছেন যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে যদি পূর্ণ ইসলামও কায়েম হয়ে যায়, তবুও গণতন্ত্র পুরোপুরি হারামই থাকবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ইসলাম এ জন্য কায়েম হয়নি যে, মহান আল্লাহ এমনটা আদেশ করেছেন। বরং এ জন্য হয়েছে যে, অধিকাংশ জনগণ তা চেয়েছে। দুদিন পর তারা যখন এর বিলুপ্তি চাইবে তখন এটা বিল্যপ্ত হতেও বাধ্য।
তা ছাড়া এমনটা তো হওয়ার নয় যে, আমিরুল মুজাহিদিন নির্বাচনে পাশ করে গণভবনে বসে বা অ্যাসেম্বলিতে মন্ত্রী পরিষদকে নিয়ে দেশ থেকে গণতন্ত্রকে নিষিদ্ধ করে দেবেন, নারীর ক্ষমতায়নকে হারাম ঘোষণা করবেন, সংবিধানের মূল চার ধারা বাতিল করবেন, খোল্লমখোলা মুজাহিদ বাহিনি গঠন করে মাজলুম মানবতাকে রক্ষা করবেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, সমাজনীতি, সমরনীতি সবক্ষেত্রে ইসলাম বাস্তবায়ন করার পন্থা কোনোকালেই গণতন্ত্র নয়। বিষয়টা আমরা না বুঝলেও বামরা ঠিকই বোঝে। নইলে সশস্ত্র বিপ্লব না করে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় গিয়ে ওরা তো সহজেই দেশে সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারত। সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম মূলনীতি হলো সমাজতন্ত্র। এরপরও সমাজতান্ত্রিকরা কেন বিপ্লবে বিশ্বাসী? হাঁ, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সীমিত পরিসরে তারাও অংশগ্রহণ করে; এটা গণতন্ত্রকে সঠিক মনে করার কারণে নয়, বরং নিজেদের পা’কে আরেকটু মজবুত করার জন্য। আর ওদের সামনে তো ধর্মের বাধা-নিষেধও নেই যে, কোনটা কুফর আর কোনটা ইসলাম তা যাচাইবাছাই করে কৌশল গ্রহণ করতে হবে। দেড় শ কোটি মুসলিমদের সবাই-ই যখন কুফরি তন্ত্র-মন্ত্রের পেছনে ছোটে তখন এ কথা বললে কি ভুল হবে যে, তারা আসলে সঠিক পথকে ভুলে গেছে এবং উপলক্ষ্য(!)-কেই লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে?
৭. পৃথিবীর পরিস্থিতি যদি প্রতিকূল না হয়ে অনুকূলই হতো, (এ যুক্তি দেখিয়েই তো তারা সবকিছুকে বৈধ করে ফেলতে চায়) তাহলে জিহাদ-খিলাফাতেরই বা কী প্রয়োজন ছিল? সবই যদি অনুকূল হয় তাহলে তো সবাই সবার ভাই। ভাইয়ে-ভাইয়ে আবার কিসের সংগ্রাম, আন্দোলন? শত্রু আছে বলেই তো এ সবকিছু। মক্কায় যদি দীন থাকতই তাহলে তো রাসুলকে সেখানে প্রেরণের প্রয়োজন ছিল না। দীন ছিল না, জাহিলিয়াত ছিল, তাই তো তাকে সেখানে প্রেরণ করা হয়েছে। আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করতে গেলে বাধা তো আসবেই। বাধার সম্মুখীন কি আমার রাসুল হননি? বাধা দেখেই যদি থমকে দাঁড়াতে হয় তাহলে এ পথ বাবা, তোমার জন্য নয়। তুমি দীনের অন্যান্য শাখার মেহনত করো। এ পথ তো শুধুই তাদের জন্য, যারা তিক্ততাকে অম্লানবদনে মিষ্টি হিসেবে বরণ করে নিয়েছে, যারা সহজতাকে নয় বরং কঠিনতাকে ভালোবেসেছে, যারা ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ প্রতিকূল সমুদ্রের মাঝেই জীবনের নৌকা ছেড়েছে।
৮. দীনি মেহনত কোনো এক ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দীনি মেহনত হতে পারে অনেকভাবেই। কুরআনে আল্লাহ তাআলা ‘সুবুলানা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। মাদরাসাও দীন, তাবলিগও দীন, তাসাওউফও দীন, কিতালও দীন, সিয়াসাতও দীন প্রভৃতি। প্রত্যেকটি দীনের স্বতন্ত্র শাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আপনি দীনের যেকোনো শাখায় মেহনত করুন, পারলে অন্য শাখায় মেহনতকারীদের সাহায্য করুন বা অন্তত তাদের জন্য দুয়া করুন। তবে বিরোধিতা করে নিজের ধ্বংস ডেকে আনবেন না। এটা তো কোনোভাবেই বৈধ নয় যে, প্রত্যেকে একমাত্র নিজেকেই হকপন্থী বলে বিশ্বাস করবে আর অন্য সবাইকে বাতিল মনে করবে। তাসাওউফ আলাদা বিষয়। এটাকে জিহাদ বলার তো অবকাশ নেই। তাবলিগ আলাদা বিষয়। এটাকে তাসাওউফ-মাদরাসা-জিহাদের বিকল্প ভাবার সুযোগ নেই। এভাবে প্রতিটা বিষয়ই আলাদা। যারা গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে এবং সুফিবাদের সঠিক-ভুল কিছু মেহনত করে, তারা নিজেদের নাম ‘মুজাহিদ কমিটি’ রেখে দেওয়া যে স্পষ্ট জালিয়াতি, এটা বোধ হয় কোলের বাচ্চাও বুঝবে। তবে দুঃখের বিষয়, সেই দলের কেউই এটা বুঝবে না। আর বুঝলেও মানবে না। বাহ্যত মনে হয়, পুরো উম্মাহ একসাথে মিলে বললেও মানবে না। হাঁ, তাদের আমির এক শব্দে বললেও তারা নির্দ্বিধায় তা মেনে নেবে। কারণ, হয়তো তারা বিশ্বাস করে, তাদের দলের বাইরে হক থাকতে পারে না। তাই বাইরে থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করা সংগত হবে না।
৯. শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার মেহনত যারা করবে তাদের নিজেদের মধ্যে সর্বাগ্রে শরিয়াহ থাকতে হবে। যারা নিজেরাই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে হরহামেশা শরিয়াহর মধ্যে বিকৃতি সাধন করে, এমনকি চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেও অপব্যাখ্যা এবং বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করে নিতে নারাজ থাকে, তাদের থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা অনেকটা নর গাধার পেট থেকে বাচ্চা লাভের আশা করার নামান্তর।
১০. আমরা কারও শত্রু নই এবং কাউকে শত্রু বানাতেও প্রয়াসী নই। তবে শরিয়াহ নিয়ে হোলিখেলায় যদি কেউ মেতে ওঠে, তবে তিনি আমার বাবা হলেও আমার দুশমন। বাবা বাবার জায়গায়। তাওহিদের ওপর, দীনের ওপর কখনো তিনি যেতে পারবেন না। পক্ষান্তরে যে সত্য দীন এবং সরল পথের ওপর রয়েছে, একান্ত অপরিচিত হলেও তিনি আমার ভাই, পরমপ্রিয় ভাই। প্রয়োজনে তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেও ইন শা আল্লাহ কোনোপ্রকার কুণ্ঠাবোধ করব না। আমাদের হৃদ্যতা-বৈরিতার একমাত্র মাপকাঠি মিল্লাতে ইবরাহিম; অন্য কিছু নয়।
পুনশ্চ
বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি নিয়ে আমরা দু-পর্বে দুটো লেখা লিখেছি। লেখা দুটোতে আমরা দালিলিকভাবে আলোচনা করতে চেয়েছি। কোনো ধরনের ট্রল করার আগ্রহ বা সদিচ্ছা কোনো কিছুই পোস্ট দুটোতে ছিল না। সাধারণ কোনো পাঠকেরও আশা করি, এ কথা বুঝতে বেগ পেতে হবে না।
প্রথম পর্বের লেখার শিরোনাম—প্রসঙ্গ : ‘বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি’র নামের অসারতা
লিংক : https://goo.gl/USMZGg
এ লেখার কোনো দালিলিক জবাব আমরা পাইনি। হাঁ, কমেন্টে পর্যাপ্ত তিরস্কার, নিন্দা, কটুক্তি, উপহাস, তীর্যক কথা রয়েছে। পাঠক চাইলে একনজর দেখে নিতে পারেন। বাঁশের জবাব আমরা বাঁশ দিয়ে দিইনি। হাঁ, এটা ঠিক যে, কাঁটার বিপরীতে আমরা ফুলও ছিটাতে পারিনি। নীরব থেকেছি। নীরবতাকেই শ্রেয় মনে করেছি।
এ লেখার জবাবে তাদের একজন নিচের লেখাটি লিখেছে। লিংক : https://goo.gl/VENrVV । লেখককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তার সম্পর্কে জানিও না। তবে ধারণা করি, তিনি একজন আলিম। তাই তার ব্যাপারে শ্রদ্ধাবোধ লালন করি। সেই জবাবি পোস্টের কমেন্টগুলোও ছিল দেখার মতো। কমেন্টের দোষ পোস্টকারীর কাঁধে চাপে না। তবে পোস্টকারী নিজেই যখন স্পষ্ট ভাষায় কমেন্টের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন তখন এর দায়ও নিশ্চয় তিনি এড়াতে পারেন না।
দালিলিক লেখার জবাব কী ধরনের দলিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা পাঠক উভয় পোস্টের পয়েন্টগুলোতে এক নজর দিলে সহজেই বুঝে ফেলার কথা। যাহোক, সবকিছু থেকে স্পষ্ট, তারা পরিবর্তনে বিশ্বাসী নয়। দলিলের ওপর দলকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা সুস্পষ্টভাবে তাদের মধ্যে দৃশ্যমান।
কোনো দলের সবাই কখনো খারাপ হয় না। প্রত্যেক দলেই হিউজ পরিমাণ মানুষ এমন থাকে, যারা সত্যান্বেষী। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের ইসলাহের প্রত্যাশা খুব একটা করতে পারি না। তবে সাধারণ মানুষরা যেন বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য দলের এবং দলীয় নেতৃবর্গের ভ্রান্তি-বিচ্যুতিগুলো জনসমক্ষে সুস্পষ্টভাবে বয়ান করতে পারি। এতে করে যে সত্যকে মানার সে সত্যকে গ্রহণ করে নেবে আর যে সত্যের ওপর দলকে প্রাধান্য দিতে চায়, সে তা-ই করবে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা এ বিষয়ক দ্বিতীয় পর্ব লিখি।
দ্বিতীয় পর্বের লেখার শিরোনাম—প্রসঙ্গ : দলান্ধতা
লিংক : https://goo.gl/Uc7weJ
এ লেখাটি পড়ার পর তাদের জবাবি লেখাটিও দেখা যেতে পারে। লিংক : https://goo.gl/AHXsm9 । দলান্ধতা নিয়ে আলোচনা করা আর কাউকে দলান্ধ বলে গালি দেওয়া নিশ্চয় এক কথা নয়। চুরি নিয়ে আলোচনা করা আর কাউকে চোর বলা এক কথা নয়। চুরি নিয়ে আলোচনা করলে তো চোর নয়, এমন ব্যক্তিদের গায়ে লাগার কথা নয়। একইভাবে দলান্ধতা নিয়ে আলোচনা করলে দলান্ধ নয়, এমন ব্যক্তিদের তো গায়ে লাগার কথা নয়। আমি বুঝি না, এ যুগে কেন যে মানুষ বিবেককে কাজে লাগায় না! কমনসেন্সের অভাব অনেক কিছুতেই লক্ষ করা যায়।
সবগুলো পোস্ট কমেন্টসহ পড়লে সাধারণ পাঠকও খুব সহজেই উভয় বিষয়ের মধ্যে তুলনা করতে পারবে। সত্য তো স্পষ্ট হবেই; আজ বা কাল। সত্যেক তো আড়াল করে রাখা যাবে না। মিথ্যা তো দূর হবেই। কারণ, মিথ্যা যে দূর হওয়ারই ছিল!
ব্যক্তিগত আক্রমণ আমার পছন্দ নয়। আমি দলিলে বিশ্বাসী; কটুক্তি-উপহাসে নয়। যে দলের ভ্রান্তিগুলো নিয়ে এত কিছু, তারা কিন্তু কোনো কিছুই মানতে প্রস্তুত নয় বা অন্তত আমার নজরে এমন কিছু পড়েনি। আমরা তাদের থেকে মানার প্রত্যাশা যে করতে পারি না, তা কিন্তু এমনিই নয়। আমি আলী হাসান উসামা আর কী! তারা তো এমন গোষ্ঠী যে, খোদ আলিমকুল শিরোমণি আল্লামা শাহ আহমদ শফি (হাফিজাহুল্লাহ) তাদের সংশোধন করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন! এমনকি এ সকল মুজাহিদ নামধারী, খোল্লমখোলা শরিয়াহ বিকৃতিকারীদের জনৈক সাংগঠনিক নেতা আমাদের প্রাণের স্পন্দন মহান শায়খকে (অভিশপ্ত) ‘বালআম ইবনে বাউর’ বলে গালি দিয়ে এবং তার শানে গোস্তাখি করে ইয়া বড় পোস্ট পর্যন্ত করেছে। আমার কাছে সেই পোস্টের স্ক্রিনশটও সংরক্ষিত রয়েছে।
এসব কারণে এখন সংশোধন প্রত্যাশার চাইতে সত্যসন্ধানী জনমানুষকে সতর্ক করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব দলীয় নেতাকর্মীদেরও যদি কোনোদিন বোধোদয় হয় এবং অন্তরে সত্য গ্রহণের মানসিকতা জাগে তাহলে তারাও বা তাদের কেউ কেউ আশা করা যায়, এসব কিছু থেকে উপকৃত হতে পারবে। কে বলল আর কীভাবে বলল, তা তো মুখ্য নয় প্রিয় ভাই। আপনি হকের ওপর আছেন নাকি বাতিলের ওপর, তা-ই হলো মুখ্য। চোর চুরি করেছে বলে ডাকাতের ডাকাতি কিন্তু বৈধতা পেয়ে যায় না। আমরা আশা করি, আল্লাহ তাআলা আপনাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনবেন এবং আপনারা তাওবা করে সরল পথে উঠে আসবেন।
এ পোস্টের পর তারা হয়তো আরও লিখবে; কোনোটা জবাবমূলক আর কোনোটা-বা ট্রলমূলক। আমরা যা বলার বলে দিয়েছি। নতুন করে আপাতত বলার কিছু নেই। মানা না মানা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া। কাউকে মানানোর ঠিকাদারি আল্লাহ আমাদের দেননি। প্রত্যেক ফেবু ব্যবহারকারীই তার নিজ প্রোফাইলের একচ্ছত্র অধিকারী। প্রত্যেকেই নিজের টাইমলাইনে যা ইচ্ছা, তা-ই লিখতে পারে। আমরা কখনোই এ কথা বলতে পারি না যে, ‘এই খবরদার, লিখবেন না কিন্তু!’ তবে পাঠককে এ দাওয়াতটুকু দিতে পারি যে, তারা কী লেখে এবং কীভাবে লেখে, দু-চোখ থেকে দলীয় রঙিন চশমা খুলে, নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে, কিছুটা মনোযোগের সাথে তা একটু পড়ে দেখবেন। এরপর বাকিটা নিজেই বিচার করবেন।
Assalamu Alaikum. zazakallah.I am very grateful to u. bcause ur article makes me clear about so many wrongs of this big so-called islamic party. But it was better to make ur approach more polite. may Allah help all of us to follow the real islam completely without any misunderstanding. Allah Hafiz.
Assalamu Alaikum. zazakallah.I am very grateful to u. bcause ur article makes me clear about so many wrongs of this big so-called islamic party. But it was better to make ur approach more cordial, more polite.Because they are undoubtedly our brother in islam. Moreover they r active 4 the cause of islam.We should not neglect them,rather we need to rectify them. May Allah help all of us to follow the real islam completely without any misunderstanding. Allah Hafiz.
আপনার লেখাগুলি থেকে অনেক কিছু জানতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ।লেখাগুলি ভাল লাগে। তবে একটা বিশয় মনে হয়েছে, আপনার কথায় আবেগ চলে আসে। এটা কথার গুরুত্ব এবং গ্রহনযোগ্যতা কে কমিয়ে দেয় বলে আমার কাছে মনে হয়। এক্ষেত্রে মাওলানা আব্দুল মালিক সাহেব দামাতবারাকাতুহুম যে রকম লেখেন, ঐ রকম হলে অনেক সুন্দর হয়। উনার লেখাতে আবেগ খুজে পাওয়া যায় না। আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন
আসসালামু আলাইকুম ভাই, ভালোই লাগে আপনার লিখা, তাই ফলোও করি আপনাকে। আমার একটা প্রশ্ন হল অনেকেই বলে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ বড় জিহাদ, কথাটা কতটুকু হাদিস সম্মত? আর হাদিস সম্মত হলে এর ব্যাখ্যা কি?
দলান্ধতা
Link ta kaj Kore na
Please ashol link ta din