ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়; নিখাদ বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে একটা বিষয় নিয়ে হালকা বিশ্লেষণ করা যাক।

ঘানা, নাইজেরিয়া ও আলজেরিয়া। আফ্রিকার তিনটি দেশ। ঘানায় নক্রুমার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাই তিনি জাতির পিতা হিসেবে গৃহীত হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে যার হাতে দেশ স্বাধীন হয়, স্বাভাবিকভাবে তিনিই এই অভিধায় অভিহিত হন। নক্রুমার প্রতি সকলের শ্রদ্ধা ছিল, ভালোবাসা ছিল। স্বাধীনতালাভের পর জনগণ তাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার নক্রুমা দেশকে চরম বিশৃঙ্খলার পথে ঠেলে দেন। তখন তাকে সরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. কুফি বসিয়া ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ভালো মানুষের কপালে সুখ জোটে না। তারা হিংসুকদের হিংসা ও ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েন। ড. কুফি বসিয়া’র ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। ‘অতি ভালো মানুষ অধ্যাপক’ বলে তাকে ক্ষমতার গদি থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো এবং সে জায়গায় এলো সেনাবাহিনী।

নাইজেরিয়ায়ও অবিকল তা-ই হলো। স্বাধীন হবার পর সে দেশের প্রধানমন্ত্রী আবু বকর তোফয়ো বেলাওয়া বেশি দিন রাজ্য শাসন করতে পারেনি। একটি জাতিগত বিদ্বেষে বেচারার প্রাণই ঝরে গেল। সেই নাইজেরিয়াবাসীর কপালে আর সুখ জোটেনি। তারা কখনোই যথার্থ মুক্তির আস্বাদন পায়নি। সে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিলুপ্ত হয়েছে। সাধারণ মানুষ ব্যক্তি স্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার থেকেই বঞ্চিত রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। আলজেরিয়াতেও একই চিত্রের দেখা মিলেছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বদাই কাজ করে তিনটি শক্তি। সেনাবাহিনীর উচ্চাশা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ক্ষমতা দখলের জন্য দলগত কূটচাল।

বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা জন্য লড়েছিল। রক্ত দিয়ে তারা পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল। যদিও স্বাধীনতার পরপরই তাদের সামনে ভারত থেকে আসা আদর্শ উপস্থাপন করে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছিল, তারা দেশ স্বাধীন করেছে চার কুফরি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এরপর গত অর্ধশতাব্দীতে এই চার লক্ষ্যের দুই লক্ষ্যে একাধিকবার পরিবর্তন এসেছে। তবে দুটো সর্বদাই অক্ষত থেকেছে। আর তা হলো গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কাগজেকলমে এগুলো থাকলেও এর আস্বাদন বাঙালি কোনোকালে পায়নি। গণতন্ত্র কী, এর মুখস্থ সংজ্ঞা ছাড়া আদর্শিক কোনো নমুনা বাপের জনমেও তাদের দেখার কপাল হয়নি।

জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গেও একই কথা। বাঙালি কখনোই জাতিগতভাবে যূথবদ্ধ হতে অভ্যস্ত না; সর্বদাই তারা রাজনৈতিক ও দলগতভাবে যূথবদ্ধ হতে অভ্যস্ত। তাদের কাছে দেশ গৌণ; দল ও রাজনীতি মুখ্য। দলগত রাজনীতির পরিচর্যায় প্রধান লক্ষ্য থাকে ক্ষমতা দখল করার এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার। সুতরাং সর্বক্ষণ চেষ্টা চলে তৃণমূল পর্যায় থেকে দলগত কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়া। স্বাধীনতার পর থেকে এ মাটি সর্বদাই এই ইতিহাস প্রত্যক্ষ করে আসছে। এখানকার রাজনীতিবিদদের আচরণে কখনোই দলের ঊর্ধ্বে দেশ আসেনি, আসতে পারেনি।

বাঙালির কখনোই বাংলাদেশকে চেনার সুযোগ হয়নি। বাঙালি চিনেছে বিভিন্ন বিভাজনে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলকে। এখানে সর্বদা দেশ চালিত হয় দলগত অভিপ্রায়ে; রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়ে নয়। রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়টা তৈরি হয় দলগত অভিপ্রায়ের কলুষ থেকে। নাম দেওয়া হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ চিরপরাধীন। আর এখানে সার্বভৌমত্ব থাকে ক্ষমতাসীন দলের; রাষ্ট্রের নয়।

এগুলো ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে করা বিশ্লেষণ নয়। নিখাদ জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে করা বিশ্লেষণ।

Share This