বাইতুল মালের পরিচয় 

শরিয়তের নির্দেশনার আলোকে যে বিভাগটি ইসলামি রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের খাতসমূহের নির্বাহ ও পরিচালনার গুরুদায়িত্ব পালন করে, পরিভাষায় তাকেই বাইতুল মাল বলা হয়। বাইতুল মাল মূলত এমন এক সক্ষম কর্তৃপক্ষ, যা মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার পূরণার্থে রাষ্ট্রের সকল আয় ও ব্যয়ের জন্য দায়িত্বশীল। অন্য অর্থে, বাইতুল মাল বলতে এমন স্থানকে বোঝানো হয়, যেখানে রাষ্ট্রের আয়সমূহ সংরক্ষণ করা হয় এবং যেখান থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য সেই আয়সমূহকে কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা হয়। অর্থাৎ বাইতুল মাল শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়; কখনো এর দ্বারা বিভাগ উদ্দেশ্য হয় আর কখনো শুধু স্থান (কোষাগার) উদ্দেশ্য হয়।

ছয়টি জিনিসের সমন্বয়ে বাইতুল মাল গঠিত হয়— সাধারণ কোষাগার এবং তার ব্রাঞ্চসমূহ, প্রশাসনিক পরিচালনা, রাজস্ব, ব্যয়ের খাত, সাধারণ অর্থনৈতিক সম্পদ এবং পরিচালনার বিধি ও নীতিমালা। নিচে আমরা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ এই ছয়টি বিষয়ের পরিচিতি তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।

 

সাধারণ কোষাগার

যখন বাইতুল মাল শব্দ প্রয়োগ করার দ্বারা এমন স্থান উদ্দেশ্য হয়, যেখানে রাষ্ট্রের আয়সমূহ সংরক্ষণ করা হয় এবং যেখান থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য সেই আয়সমূহকে কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা হয়, তখন এর দ্বারা মূলত রাষ্ট্রের সাধারণ কোষাগার (Public Treasury) এবং তার ব্রাঞ্চসমূহই উদ্দেশ্য হয়। রাসুলুল্লাহ সা. এর মাদানি যিন্দেগিতে এই ট্রেজারি বিলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অবশ্য সেসময়ে যুগের চাহিদা অনুসারে এর পরিধি সুবিস্তৃত ছিলো না। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ সা. এর ঘরে বা উম্মুল মুমিনিনদের কারো কামরায় মুসলমানদের বাইতুল মাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইমাম বুখারি উকবা রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি মদিনায় রাসুলুল্লাহ সা. এর পেছনে আসরের সালাত আদায় করলাম। তিনি সালাম ফেরালেন। সালাম শেষে তিনি দ্রুতবেগে উঠে মুসল্লিদের কাঁধ ডিঙিয়ে তাঁর এক স্ত্রীর কামরায় চলে যান। সাহাবিগণ তাঁর দ্রুততা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। অনন্তর তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বেরিয়ে আসেন। এসে দেখতে পান, তাঁর দ্রুততা দেখে সাহাবিগণ বিস্মিত হয়েছেন। তখন তিনি বলেন, আমার স্মরণে আসে যে, আমার কাছে একটি স্বর্ণের পাত রয়ে গিয়েছিলো। আমি এটা অপছন্দ করলাম যে, এই একটি পাত আমাকে আটকে রাখবে। তাই আমি তা বন্টন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে এলাম।[1]

এরপর বাইতুল মাল মসজিদে স্থানান্তর করা হয়। ইমাম বুখারি রহ. আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে বাহরাইন থেকে কিছু সম্পদ আসলো। তখন তিনি বললেন, তোমরা এগুলো মসজিদে রেখে দাও। রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে এ যাবত যতো সম্পদ এসেছে, তার মধ্যে পরিমাণে তা-ই ছিলো সবচে বেশি। এরপর রাসুলুল্লাহ সা. সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে সালাতে চলে গেলেন। সালাত শেষ করে তিনি সম্পদের কাছে গিয়ে বসলেন। তখন তিনি যাকে যাকে দেখলেন, সবাইকেই কিছু সম্পদ দিলেন। …রাসুলুল্লাহ সা. সেখানে একটি দিরহাম অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত উঠলেন না।[2]

আবু বকর রা. এর খেলাফতের যামানায় বাইতুল মালের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করা হয়। ইবনু সাদ প্রণীত আততাবাকাতুল কুবরা গ্রন্থে রয়েছে, ‘সুনহে’ আবু বকর রা. এর একটি বাইতুল মাল ছিলো, যার প্রহরায় কেউ থাকতো না। তাকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আপনি কি বাইতুল মালের জন্য কোনো লোক নির্ধারণ করবেন না, যে তার প্রহরার কাজ করবে। তিনি বললেন, এর ব্যাপারে শঙ্কাবোধ হয় না। বলা হলো, কেনো? তিনি বললেন, তাতে তালা রয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি বাইতুল মালের সকল সম্পদ দিয়ে দিতেন, অবশেষে তাতে আর কিছুই বাকি থাকতো না। আবু বকর রা. যখন মদিনায় ফিরলেন, তখন তিনি বাইতুল মালের স্থান পরিবর্তন করে তার অবস্থানের ঘরেই বাইতুল মাল স্থাপন করলেন।

পরবর্তীকালে অন্যান্য শহরেও বাইতুল মালের ব্রাঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, উমর রা. আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. কে বিচারবিভাগ এবং বাইতুল মালের দায়িত্বে নিয়োজিত করে কুফা নগরে প্রেরণ করেন।

 

প্রশাসনিক পরিচালনা

বাইতুল মালের পরিচালনাকে স্বতন্ত্র একটি বিভাগ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা সাধারণত খলিফার অধীনে থাকে। এর প্রধান পরিচালক সাধারণত খলিফা নিজেই হয়ে থাকেন। তবে কখনো খলিফার অধীনে এই বিভাগ পরিচালনার জন্য বিশেষ একজন ব্যক্তিকেও নির্ধারণ করা হয়, যাকে ‘সাহিবু বাইতিল মাল’ বলা হয়। যেমন ওপরে উমর রা. কর্তৃক ইবনু মাসউদ রা. কে নিয়োগের কথা বিবৃত হলো। তেমনি এই বিভাগের অধীনে বিশেষ কিছু কাজের জন্য আরো কিছু লোক নিয়োগ দেয়া হয়। যেমন উমর রা. ইবনু মাসউদ রা. এর সাথে উসমান ইবনু হানিফ রা. কে সাওয়াদের ভূমির দায়িত্ব— তার পরিমাপ করা এবং সে অনুযায়ী তার ওপর খারাজ ধার্য করার দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন।[3]

তেমনি উমর রা. বাইতুল মালে থাকা সদকার উট এবং জিহাদের ঘোড়া চরানোর যে ‘হিমা’, তার দেখাশোনার দায়িত্বে হুনাইয়্যা নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করেন।[4]

এর আরো দৃষ্টান্ত হলো, রাসুলুল্লাহ সা. মাহমিয়্যা ইবনু জুযকে ‘খুমুসে’র দায়িত্বে, বিলাল রা.কে ফলফলাদির যাকাতের দায়িত্বে এবং ইবনু আওফ রা.কে উট ও মেষের যাকাত উশুলের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।[5]

 

রাজস্ব বা আয়ের উৎস 

ইসলামি রাষ্ট্রে রাজস্বকে বাইতুল মালের সবচে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান মনে করা হয়। রাজস্বের প্রকার অনেক। আলিমগণের কেউ কেউ সর্বমোট এর বারো প্রকার উল্লেখ করেছেন।[6] আমরা এখানে রাজস্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রকারগুলোর প্রতি সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো।

  1. ফাই: লড়াই ছাড়া অমুসলিমদের থেকে অর্জিত সম্পদকে ফাই বলা হয়। ফাই পুরোটাই বাইতুল মালের হিস্‌সা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহ তার রাসুলকে তাদের যে সম্পদ ‘ফাই’ হিসেবে দান করেছেন, তার জন্য তোমরা না ঘোড়া হাঁকিয়েছো, না উট, কিন্তু আল্লাহ নিজ রাসুলগণকে যার ওপর ইচ্ছা আধিপত্য দান করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান। আল্লাহ তার রাসুলকে অন্যান্য জনপদবাসীদের থেকে ‘ফাই’ হিসেবে যে সম্পদ দিয়েছেন, তা আল্লাহর, তার রাসুলের, রাসুলের আত্মীয়বর্গের, এতিমদের, অভাবগ্রস্তদের ও মুসাফিরদের প্রাপ্য, যাতে সে সম্পদ তোমাদের মধ্যকার বিত্তবানদের মধ্যেই শুধু আবর্তন না করে। রাসুল তোমাদেরকে যা দেয়, তা গ্রহণ করো আর তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।”[7] আয়াতে উল্লেখিত বিষয়সমূহ ‘ফাই’য়ের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোকে আর এক-পঞ্চমাংশে ভাগ করা হবে না। বরং এর পুরোটাই বাইতুল মালে প্রদান করা হবে।
  2. জিযয়া: জিযয়া বলা হয় সেই সম্পদকে, যা ইসলামে রাষ্ট্রে চুক্তিসাপেক্ষে অবস্থানকারী যিম্মিদের থেকে বাৎসরিক উশুল করা হয়। জিযয়া প্রত্যেক বালিগ অমুসলিমের ওপর আলাদা-আলাদাভাবেও ধার্য করা হতে পারে আবার পুরো এক শহরের ওপর একত্রেও ধার্য করা হতে পারে।
  3. খারাজ: মুসলমানরা গনিমত সূত্রে যিম্মিদের যে ফসলি যমিনের মালিক হয়েছে, ইমামুল মুসলিমিন যদি মুসলমানদের নিজেদের মালিকানা লাভের পর চুক্তিসাপেক্ষে যিম্মিদেরকে সেই যমিনগুলো ব্যবহার করতে দেয়, তবে এর জন্য যিম্মিরা বাৎসরিক ট্যাক্স দিতে বাধ্য থাকে, পরিভাষায় যাকে ‘খারাজ’ বলা হয়। খারাজি যমিনের অন্তর্ভুক্ত আরেকটি প্রকার হলো এমন যমিন, যার ব্যাপারে তার অধিবাসীদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি হয়েছে এবং তারা সেই যমিন ব্যবহারের বিনিময়ে চুক্তিকৃত পরিমাণ অর্থ বাইতুল মালে প্রদান করে।
  4. যিম্মিদের থেকে আদায়কৃত ‘উশুর’: ইসলামি রাষ্ট্রে অবস্থানকারী যিম্মিদের থেকে যা গ্রহণ করা হয়— যখন তারা ব্যবসার উদ্দেশ্যে দারুল ইসলাম থেকে দারুল হারবের উদ্দেশে অথবা দারুল হারব থেকে দারুল ইসলামের উদ্দেশে কিবা দারুল ইসলামের এক শহর থেকে অন্য শহরে সফর করে। প্রতিবছর মাত্র একবার তাদের থেকে এই ‘উশুর’ গ্রহণ করা হয়। তেমনি দারুল হারবের নাগরিকরা যদি আমান গ্রহণ করে ইসলামি রাষ্ট্রে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করে, তবে তাদের আদায়কৃত করকেও ‘উশুর’ নামেই নামকরণ হয়।
  5. পরিত্যাক্ত সম্পদ: মুরতাদ এবং যিন্দিককে যদি হত্যা করা হয় অথবা তারা মারা যায়, তাহলে তাদের সম্পদ বাইতুল মালের অন্তর্ভুক্ত হয়। তেমনি যিম্মিও যদি কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে দুনিয়াত্যাগ করে, তাহলে তার সম্পদও বাইতুল মালে চলে যায়। উল্লেখ্য, মুরতাদের রেখে যাওয়া সম্পদের ব্যাপারে হানাফি মাযহাবে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে এবং তা একাধিক প্রকারে ভাগ করা হয়েছে।
  6. জিহাদ বা অন্যান্য জনস্বার্থে ব্যয়ের জন্য বাইতুল মালে প্রদত্ত উপহার ওসিয়ত সাধারণ দান ও অন্যান্য। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম প্রকার পর্যন্ত বিষয়গুলোও ‘ফাই’য়ের অন্তর্ভুক্ত। সহজতার জন্য আমরা বিষয়গুলোকে আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করেছি। ‘ফাই’য়ের আরো কিছু প্রকার রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা ফিকহের কিতাবাদিতে দ্রষ্টব্য।
  7. গনিমতের এক-পঞ্চমাংশ: গনিমত বলা হয় অমুসলিমদের থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে। তবে তাদের থেকে লব্ধ যমিন ও স্থাবর সম্পত্তির হিসাব আলাদা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “জেনে রাখো, তোমরা যা-কিছু গনিমত অর্জন করো, তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তার রাসুল, রাসুলের আত্মীয়বর্গ, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের প্রাপ্য (যা আদায় করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য)— যদি তোমরা আল্লাহ প্রতি ও সেই বিষয়ের প্রতি ইমান রাখো, যা আমি আমার বান্দার ওপর মীমাগসার দিন অবতীর্ণ করেছি, যে দিন দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলো।”[8]
  8. যাকাত: মুসলমানদের যাকাতও বাইতুল মালে প্রদান করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আপনি তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করুন। এর মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন।” সুরা তাওবার ৬০ নাম্বার আয়াতে যাকাতের যে আটটি খাত বর্ণনা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো, যারা সদকা উশুলের কাজে নিয়োজিত। এর থেকেও উপরিউক্ত বিষয়টির প্রতি আলোকপাত হয়।[9]
  9. গুপ্তধনের এক পঞ্চমাংশ: আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, “আর গুপ্তধনে এক পঞ্চমাংশ।”[10]
  10. যে কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে মারা যায়, তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি: রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যার কোনো উত্তরাধিকারী নেই, আমি তার উত্তরাধিকারী। আমি তার থেকে দিয়ত আদায় করবো এবং তার উত্তরাধিকারী হবো।”
  11. রাষ্ট্রের মালিকানাভুক্ত বিভিন্ন সাধারণ খাত থেকে লব্ধ আয়।
  12. কর: রাষ্ট্রের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় তার নাগরিকদের ওপর কর ধার্য করা জায়িয নেই। যতোক্ষণ পর্যন্ত বাইতুল মালের আয়ের উৎস থাকবে, সে অবধি ইমামুল মুসলিমিনের জন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর করের বোঝা আরোপ করার অধিকার নেই। ইসলামি রাষ্ট্রে কর কিছুতেই স্থায়ী আয়ের উৎস হতে পারে না। একান্ত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে, যখন রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য থাকবে আর নগদ কোনো কাজ সম্পাদন করা অপরিহার্য হয়ে পড়বে— যেমন অনতিবিলম্বে কোথাও মুজাহিদ বাহিনীকে যাত্রা করাতে হবে, সেক্ষেত্রে মুসলমানদের ইমাম রাষ্ট্রের ধনী নাগরিকদের ওপর প্রয়োজন পরিমাণ কর ধার্য করতে পারেন। স্মতর্ব্য যে, এটা হলো বিশেষ প্রেক্ষাপটের বিধান; স্বাভাবিক অবস্থার বিধান নয়। আর রাষ্ট্রের গরিব নাগরিকদের ওপর কর ধার্য করার কোনো অধিকার ইমামুল মুসলিমিনের নেই। তবে হাঁ, অবস্থা যদি বাস্তবেই এমন করুণ হয় যে, তা ছাড়া আর কোনো উপায় বা বিকল্প না থাকে, তখন সামান্য কিছু কর গরিবদের ওপরও ধার্য করা যেতে পারে।

 

ব্যয়ের খাত

এই বিষয়টিকে বাইতুল মালের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জ্ঞান করা হয়। ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও এ এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর প্রতিটি বিষয় সবিস্তারে স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। আমরা এখানে সংক্ষিপ্তসারে খাতগুলোর প্রতি আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো।

  1. যাকাতের খাতসমূহ: সুরা তাওবার ষাট নাম্বার আয়াতে যার বর্ণনা এসেছে। ফিকহের কিতাবাদিতে এ প্রসঙ্গে সবিস্তারে আলোচনা রয়েছে।
  2. মুসলিম জনসাধারণের জন্য বাইতুল মালের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ভাতা: আল্লাহ তাআলা বাইতুল মালে ‘ফাই’ হিসেবে যে সকল সম্পদ দান করেন, তাতে সকল মুসলমানের হক রয়েছে। উমর রা. সুরা হাশরের আয়াতসমূহকে এর স্বপক্ষে প্রমাস্বরূপ উল্লেখ করে বলেন, “এই সম্পদে প্রতিটি মুসলমানের হক রয়েছে; তাকে দেয়া হোক কিবা বঞ্চিত করা হোক সর্বাবস্থায়।”[11] সুরা হাশরের দশ নাম্বার আয়াতের আলোকে তিনি এই বিধানকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মুসলমানের ক্ষেত্রে কার্যকর মনে করেন। কতেক ফকিহ বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত একটি মারফু হাদিস থেকেই এই বিধান আহরণ করেছেন— “এরপর তুমি তাদেরকে দারুল হারব ছেড়ে দারুল ইসলামে চলে আসার নির্দেশ দিবে। এবং তাদেরকে অবগত করবে যে, যদি তারা তা করে, তাহলে তাদের জন্য তা তা থাকবে, যা মুহাজিরদের জন্য রয়েছে, আর মুহাজিরদের ওপর যে সকল বিধান আরোপিত হয়, সেগুলোও তাদের ওপর আরোপিত হবে। যদি তারা দারুল হারব ছেড়ে আসতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তাদেরকে অবগত করবে যে, তারা গেঁয়ো মুসলমানদের মতো থাকবে। তাদের ওপর আল্লাহর বিধান কার্যকর হবে, যা মুমিনদের ওপর কার্যকর হয়ে থাকে। গনিমত এবং ‘ফাই’য়ে তাদের কোনো হিস্‌সা থাকবে না, তবে তারা যদি মুসলমানদের সঙ্গ জিহাদে শরিক থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা।”[12]
  3. জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর ও উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয়। 
  4. বিশেষ অবস্থার বিবেচনা: যেমন মুসলিম বন্দিদের মুক্তিপণ, ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ, অসহায়দের সহায়তা ও পুনর্বাসন, যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদি। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বলেন, “উমর রা. যখন আহত হন, তখন আমি তাকে বলতে শুনেছি, তোমরা জেনে রাখো, বাইতুল মালের সম্পদ থেকে প্রতিটি মুসলিম বন্দির মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে।”[13] জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. এমন মৃত ব্যক্তির জানাযা পরতেন না, যে ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করেছে। একদা তার কাছে এক মৃত ব্যক্তিকে আনা হলো। তিনি বললেন, এই লোকটির কি ঋণ রয়েছে? সাহাবিগণ বললেন, জি হাঁ, দুই দিনার। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জানাযা পড়ে নাও। আবু কাতাদা আনসারি রা. বললেন, এই দুই দিনার আমার দায়িত্বে নিয়ে নিলাম। তখন রাসুলুল্লাহ সা. তার জানাযা পড়লেন। যখন আল্লাহ তার রাসুলকে বিজয় দান করলেন, তখন রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আমি মুমিনদের জন্য তাদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ট। সুতরাং যে ঋণ রেখে যাবে, তা পরিশোধের দায়িত্ব আমার যিম্মায়। আর যে সম্পদ রেখে যাবে, তা তার উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য।”[14]
  5. সরকারি চাকুরেদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ: রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তার স্ত্রী না থাকলে সে যেনো কোনো নারীকে বিয়ে করে নেয়, ঘর না থাকলে সে যেনো একটি ঘর গ্রহণ করে, যার বাহন নেই সে যেনো বাহন নেয়, যার খাদিম নেই সে যেনো একজন খাদিম গ্রহণ করে…।”[15]

 

{চলবে ইনশাআল্লাহ}

[1] সহিহ বুখারি: ৮৫১

[2] সহিহ বুখারি: ৪২১

[3] কিতাবুল খারাজ, ইমাম আবু ইউসুফ: ৩৬

[4] আলমুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বা: ৬/৪৬১

[5] সহিহ মুসলিম: ২/৭৫৪

[6] দ্রষ্টব্য— আলফাতহুল মুবিন ফি বায়ানিয যাকাতি ওয়া বাতি মালিল মুসলিমিন, শায়খ আব্দুর রহমান ইবনু ইদরিস আলহাসানি; ইসলাম কা ইকতেসাদি নেযাম

[7] সুরা হাশর: ৬-৭ (এর পরবর্তী আয়াতসমূহও দ্রষ্টব্য)

[8] সুরা আনফাল: ৪১

[9] আরো দ্রষ্টব্য— কিতাবুল আমওয়াল: ৬৭৮

[10] সহিহ বুখারি: ৬৯১২; সহিহ মুসলিম: 1710

[11] কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবাইদ: ২৭৩

[12] সহিহ মুসলিম: ১৭৩১

[13] কিতাবুল আমওয়াল, ইবনু যানজুওয়াহ: ১/৩৩৩; আলমুসান্নাফ, ইবনু আবি শায়বা: ৭/৬৭৩

[14] সহিহ বুখারি: ২২৯৮; সহিহ মুসলিম: ১৬১৯

[15] মুসনাদু আহমাদ: ১৮০১৫; আলআমওয়াল, ইবনু যানজুওয়াহ: ২/৫৯৩

Share This