এই যে মানুষজন কিতালের বিরোধিতা করে, এর অন্যতম কারণ হলো কিতালপন্থীরা তাদের পরিকল্পিত কিতালকে জনসমক্ষে যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পারেনি। মানুষ যেকোনো নতুন জিনিস গ্রহণ করতে খানিকটা সংকোচ ও ইতস্তত বোধ করে। চিন্তাশীল মানুষরা চিন্তাশক্তি খাটাতে কিছুটা সময় নেয়। এর ওপর বিষয়টা যদি হয় ধোঁয়াশায় আচ্ছাদিত, তাহলে তা গ্রহণ করা তো কিছুটা দুষ্করই হয়ে যায়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই অঞ্চলের মানুষদের কিতাল সম্পর্কে জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ বিষয় নিয়ে স্বতন্ত্র পড়াশোনা করেছে, এমন মানুষ খুবই কম। মাদরাসাগুলোতেও সাধারণভাবে এই অধ্যায় পড়ানো হয় না। ইফতা বিভাগগুলোতেও এ অধ্যায়ের ফাতওয়ার অনুশীলন করানো হয় না। এমনকি যারা এখন শিক্ষকতা করছেন, তাদের অধিকাংশজনও তাদের শিক্ষকদের থেকে এই বিষয়ের জ্ঞান অর্জন না করেই শিক্ষক হয়ে বসেছেন। ফলত এখানে অজ্ঞতা অনেক ব্যাপক। এই বিষয়ে গঠনমূলক বইপত্রও তেমন প্রকাশিত হয় না। কিছু কাজ এত হয় যে, একপর্যায়ে তা চর্বিতচর্বণ হয়ে যায়। কিন্তু আরও কিছু কাজ সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তার দিকে কেউ ভ্রূক্ষেপই করে না।
এই অঞ্চলে যারা কিতালের কথা বলে, তাদের পরিকল্পনা ও কাজের রূপরেখা জাতির কর্ণধারদের সামনে নেই। অনলাইনে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে তারা এগুলো প্রকাশ করলেও কর্ণধাররা যেহেতু অনলাইনে থাকেন না, তাই সাধারণত এগুলো তাদের কাছে পৌঁছায় না। ইতিবাচক বিষয়গুলো আড়ালেই থেকে যায় আর কিছু অসৎ লোকের ভায়া হয়ে তাদের কাছে দোষ, ত্রুটি ও নেতিবাচক দিকগুলোই পৌঁছায়। যার ফলে কিতালপন্থীদের ব্যাপারে তাদের ভেতরে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হয়। এর দায়ভার কিছুটা কিতালপন্থীরাও এড়াতে পারবে না। তারা জাতির কর্ণধারদের কাছে গিয়ে তাদের সামনে নিজেদের পরিকল্পনা ও কাজের রূপরেখা যে একেবারেই উপস্থাপন করেননি তা নয়। কিন্তু এই কাজটা পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়নি। সবার ক্ষেত্রে হয়নি। এমনকি যেভাবে হওয়া দরকার ছিল, সবক্ষেত্রে সেভাবেও হয়নি।
তো আপনি যখন তাদের সমালোচনা করছেন, ধরে নিচ্ছেন, বিষয়গুলো তাদের সামনে স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা বিরোধিতা করছেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই এরকম নয়। অধিকাংশের সামনে বিষয়গুলো স্পষ্টই নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, কিছু বক্র অন্তরের অধিকারী, ইমানবিক্রেতা ও চাটুকার সব সমাজেই থাকে। তাদের সামনে হাজারবার স্পষ্ট করা হলেও তারা তাদের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে। মূলত তাদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দিয়েছেন। বস্তুত তারা দুনিয়াকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর পথের মৃত্যুকে অপছন্দ করে।
দায়ির উচিত, তার দাওয়াতের বিষয়বস্তু জনসমক্ষে সুস্পষ্ট করা। সাধারণদের বোঝানোর পাশাপাশি বিশেষ ব্যক্তিদের বোঝানো বা নিদেনপক্ষে অবগত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা। পারতপক্ষে কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানো। সবরের দ্বারা উত্তম আখলাকের পরিচয় দেওয়া। মানুষ যে যেভাবে বোঝে, তাকে সেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা। প্রত্যেকের স্তর বুঝে তদনুযায়ী আচরণ করা। যার সঙ্গে কথা বলবে, তার বিবেকবুদ্ধির দৌড় মাথায় রেখে কথা বলা। যাতে করে সে অবচেতনেই শরিয়াহর বিধানকে উপেক্ষা করে না বসে। যাতে করে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ ও নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে নিজের ইমান বরবাদ না করে।
আরেকটা বিষয় স্মর্তব্য, অন্যকে সংশোধন করার কাজে তৎপর হলেও নিজের সংশোধনের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। অন্যরা যেসব বিষয়ে সমালোচনা করে, সেগুলোর প্রতি ভালোভাবে লক্ষ করা উচিত। এরপর এরমধ্যে যেগুলো অসার সেগুলোকে উপেক্ষা করে যৌক্তিক সমালোচনাগুলোকে আমলে নিয়ে নিজেদের শুধরে ফেলা উত্তম বৈশিষ্ট্য। আর কখনোই নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করা সমীচীন নয়। নিজের দুর্বলতাগুলো সর্বদা স্মরণে রাখা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, কেউ এক ভূমিতে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টারত। নিঃসন্দেহে এটা ভালো গুণ। কিন্তু তাকে এ কথা ভুলে গেলে হবে না, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে নির্যাতিত মানবতার সাহায্যে না এগিয়ে সে বড় ত্রুটিতে নিপতিত রয়েছে। সুতরাং নিজের এই দুর্বলতা স্বীকার করা, তা সংশোধনের ফিকির করাও গুরুত্বপূর্ণ।
এমন যেন না হয় যে, শরিয়াহর কোনো এক অংশের ওপর আমল করেই নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করা শুরু করব। অধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজে আইন পরিত্যাগ করে তারচে কম গুরুত্বপূর্ণ ফরজে আইন/কিফায়া পালন করেই নিজেকে কামেল মুকাম্মাল ভাবতে শুরু করব। কারণ, মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা ও আল্লাহর বান্দাদেরকে মাজলুমের হাত থেকে উদ্ধার করা সর্বাগ্রে ফরজ। আর আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর দীন কায়েম করাও গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। কিন্তু আমরা কবরস্থানে ইসলাম কায়েম করব না। চারিদিক যদি রক্তের সাগরে পরিণত হয় আর আমরা তা রোধে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মধ্যেই একাগ্রদৃষ্টি দিয়ে রাখি, তাহলে আমাদের স্বপ্ন কোনোদিনও বাস্তবায়িত হবে না। আর মানুষ নিজের বিপদে যাকে পাশে পাবে না, স্বভাবতই সে তার ভালো ডাকেও সাড়া দেবে না।
যুগে যুগে দাওয়াত ব্যর্থ হয় তিন কারণে :
১. দায়ির বাসিরাত (সুগভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) না থাকার কারণে,
২. দাওয়াত হিকমাহর সঙ্গে না হওয়ার কারণে,
৩. দাওয়াতের ভাষা ও উপস্থাপনা সুন্দর ও যথোচিত না হওয়ার কারণে।
আজকাল অনলাইনে অনেক বাচ্চাকাচ্চাকেও স্পর্শকাতর সব বিষয়ে দৃঢ় ও অকাট্য ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা যায়। অথচ যে বিষয়ে সে কথা বলছে বা বিতর্ক করছে, সে বিষয়ে তার স্বচ্ছ ধারণা নেই। তার সুগভীর, যথার্থ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নেই।
যারা নিজেদেরকে দায়ির অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে, তাদের হিকমাহর অভাবে ইতিপূর্বেও অনেক সময়েই পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। কোন ভূমিতে কীভাবে দাওয়াতের কাজ করতে হবে, এটা শেখার বিষয়, চর্চার বিষয়। এক্ষেত্রে কেবল জযবা ও হুজুগেপনাই যথেষ্ট নয়। রাসুলুল্লাহ সা. হিকমাহর অংশ হিসেবে মুনাফিকদেরও সঙ্গে রেখেছেন। কোনো কোনো কাফির গোত্রের সঙ্গেও মিত্রতা গড়েছেন। সেখানে আমরা হকপন্থী সবাইকেও যদি প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলি, সবার সঙ্গে যদি একসঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হই, তাহলে দাওয়াত ব্যর্থ হতে বাধ্য।
অনেক ভালো ও যথার্থ কথাও উপস্থাপনার ত্রুটির কারণে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। দাওয়াতের ভাষা ও উপস্থাপনা হতে হবে স্থান-কাল-পাত্র উপযোগী। মুকতাজাল হালের দাবি বুঝে দায়িকে এগোতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, মানুষ স্রেফ তত্ত্বকে সহজে গ্রহণ করে নেয় না। হ্যাঁ, তত্ত্ব যখন প্রয়োগ হয় ও বাস্তবায়িত হয়, তখন তা দেখে অনেকের ‘শারহে সাদার’ হয়। কাল্পনিক জিনিসের ওপর মানুষ সহজে বিশ্বাসের ভিত্তি গাড়তে পারে না। কোনো জিনিস দাঁড়িয়ে গেলে মানুষকে তা বোঝানো সহজ হয়; এর পূর্বে নয়।
আরেকটা উসুল স্মরণ রাখতে হবে :
السيف يعين على فهم الحق.
আর মানুষ বিজয়ী শক্তির অনুগামী হয়। সমাজে যারা শক্তিশালী থাকবে, মানুষ তাদেরই সাপোর্ট দেবে। সুতরাং শক্তি সঞ্চয়ের ভূমিকা অপরিসীম।