জিহাদ প্রসঙ্গে সবার অবস্থা এক নয়। এমনকি এই ব্যাপারে কোনো এক ঘরানার সবাইকেও এক পাল্লায় মাপার সুযোগ নেই। অধিকাংশ মানুষের অবস্থা হলো এমন, তারা এ প্রসঙ্গে নিজেদের ব্যাপারে সুধারণা লালন করে; কিন্তু আদতে তাদের মধ্যে সুধারণা সৃষ্টি হওয়ার উপাদান নেই। এখানে আমরা সংক্ষিপ্তসারে এ প্রসঙ্গে মানুষের অবস্থা তুলে ধরব।

১. যারা জিহাদের ওপর ইমান রাখে। এই ইমান রাখার আবার কয়েকটা দিক। এক হলো, জিহাদকে ইসলামের বিধান হিসেবে স্বীকার করা। দুই হলো, রাসুলুল্লাহ সা. এবং তার সাহাবিগণের জিহাদি জীবনকে আদর্শ হিসেবে মেনে নেওয়া। তিন হলো, দাজ্জাল ধ্বংস হওয়া অবধি সাহায্যপ্রাপ্ত একটি দল সংখ্যায় নিতান্ত স্বল্প হলেও সর্বদা জিহাদ অব্যাহত রাখবে, এ বিষয়টিকে একিনের সঙ্গে মেনে নেওয়া। চার হলো, সর্বযুগে প্রযোজ্য জিহাদের সেই অর্থের ব্যাপারে ইমান আনা, যা তার প্রকৃত অর্থ এবং যা কুরআন, সুন্নাহ এবং সিয়ারুর রাসুল ওয়াস সাহাবাহ দ্বারা প্রমাণিত। এই চারটি দিকের প্রথম দুই দিকে সব মুসলমানকে পাওয়া গেলেও পরের দুটো দিকে অধিকাংশ মুসলমানের পদস্খলন হয়েছে।

২. জিহাদের তাত্ত্বিক দিককে কোনোপ্রকার তাহরিফ (অপব্যাখ্যা) বা গলদ তাবিল (ভুলব্যাখ্যা) ছাড়াই মেনে নেওয়া। গোলাম আহমদ কাদিয়ানি, তার অনুসারী ও প্রেতাত্মারা, একইভাবে ফউমা থেকে শুরু করে এ দেশের কিছু পির, দায়ি ও হুজুগে মৌলবি এ ক্ষেত্রে এসে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। তারা জিহাদের তত্ত্বকেই বিকৃত করে এমন কিছু উপস্থাপন করেছে, যা কিছু ক্ষেত্রে ইসলামসম্মতই নয় (যেমন, জাতীয়তাবাদী লড়াই), আর কিছু ক্ষেত্রে ইসলামসম্মত হলেও জিহাদের বাস্তবিক সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়।

৩. সর্বযুগে জিহাদের প্রায়োগিক দিককে মেনে নেওয়া। যারা তার প্রয়োগে রত রয়েছে, তাদের সমর্থন দেওয়া। একান্ত তাদেরকে সমর্থনযোগ্য মনে না হলে আর নিজে জ্ঞানের অধিকারী হলে প্রয়োগের যথাযথ রূপরেখা উপস্থাপন করা। অনেক হক্কানি ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান উপরিউক্ত দুটো ধাপ নিরাপদে পাড়ি দিয়ে এলেও এখানে এসে ঝামেলা করে ফেলেছে। তারা না আল্লাহর দুনিয়ায় চলমান জিহাদের কোনো মানহাজের সঙ্গে একমত হতে পেরেছে আর না নিজেরা বিকল্প হিসেবে কোনো কার্যকর রূপরেখা উপস্থাপন করতে পেরেছে বা আদৌ তার জন্য চেষ্টা করেছে। তারা নিজেদের কাজকর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট আর জিহাদের সকল মানহাজের সমালোচনা করে পরিতৃপ্ত। মুফতির দায়িত্ব হলো উম্মাহর মধ্যে প্রসারিত কোনো বিষয়কে হারাম বলেই ক্ষান্তি দেওয়া নয়; বরং উম্মাহকে যথাসম্ভব তার বিকল্পের সন্ধান দেওয়া। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা এ মূলনীতি অনুসরণ করলেও এই সামরিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা এটা অনুসরণ করার কোনোই প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেনি। তারা আল্লাহর জমিনে জিহাদকে অকার্যকর, অপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলে রাখতে চায়। তারা সব ব্যাপারে নিজেদের জিম্মাদারির ব্যাপারে সচেতন হলেও আল্লাহর দেওয়া এই জিম্মাদারি স্বীকারই করতে চায় না। ফলত তাদের মানহাজে সবই আছে একমাত্র প্রায়োগিক জিহাদ ছাড়া।

এই সবগুলো দিক কারও মাথায় না থাকলে সে তখন অযথাই নিজেকে মুজাহিদ ভাবতে শুরু করে। কেউ গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে কিছু মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সমাবেশ করে নিজেকে মুজাহিদ ভাবে। কেউ খানকাহে পড়ে থেকে নিজেকে মুজাহিদ ভাবে। কেউ তাবলিগে সময় লাগিয়ে নিজেকে মুজাহিদ ভাবে। কেউ মাদরাসায় পড়ে ও পড়িয়ে নিজেকে মুজাহিদ ভাবে। কেউ চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিজেকে মুজাহিদ ভাবে। এমনকি কেউ-বা শ্রমনির্ভর বৈধ সব কাজকে, যার মধ্যে স্ত্রী সহবাসও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, জিহাদ মনে করে। এভাবে নকল জিহাদের চাপে আসল জিহাদ আজ ক্লিষ্ট, পদপিষ্ট।

তত্ত্ব বিকৃতি ঘটালে আবেগের ডিব্বা হয়ে বসে থাকলেও তা দ্বারা না নিজে উপকৃত হওয়া যায় আর না ইসলামকে সমুন্নত করা যায়। কিতালের আবেগ নেই এমন মুমিনের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না। সবাই আবেগে টইটম্বুর। কিন্তু বিকৃত তত্ত্বের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার কারণে আবেগগুলো জায়গামতো প্রবাহিত না হয়ে অজায়গায় প্রবাহিত হয়। এ জন্য তত্ত্ব ও পরিভাষাকে অবিকৃতরূপে সংরক্ষণ করাকে সর্বযুগের জন্য ফরজ করা হয়েছে।

মাদরাসাওয়ালারা সফল। কারণ, বর্তমানে তাগুতও দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকার করে নিয়েছে যে, এসব দেশে মাদরাসা থেকে এখন আর কোনো মুজাহিদ তৈরি হয় না। বিশ্ব শান্তি ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সৃষ্টির এই বিরল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আরেকটা শোকরানা মাহফিলের আয়োজন করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

আর আমি যুগের স্বঘোষিত রব্বে আ’লাদের সমীপে আবেদন করছি, তারা যেন আমাদের শাইখ ও মুরশিদ পিরানে পির দস্তেগির গাউসে আজম কুতবে বাঙাল ও আবদালে কাঙাল আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়ে আমাদের স্বজাতির মুখকে আলোকিত করেন; যেন তারা এ নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী গর্ব করে যেতে পারে।

যাদের ভেতরে মাজলুম মানবতাকে মুক্ত করার চেতনা নেই, যাদের কাছে তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর রূপরেখা নেই, তাদের মুখে মায়াকান্না এবং তাদের চোখে মেকি অশ্রুকণা বড়ই বেমানান।

তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবী চলে না। তত্ত্ব যখন জীবনে উঠে আসে, তখনই পৃথিবীতে কোনো পরিবর্তন আসে। তত্ত্ব যদি তত্ত্বই থেকে যায়, তত্ত্ব যদি কখনো প্রয়োগ না হয় তাহলে বেকার, সবই বেকার।

তোমাদের কাছে তত্ত্ব আছে। যদিও তোমাদের অনেকে খোদ তত্ত্বকেই বিকৃত করে ফেলেছে। কিন্তু কেবলই তত্ত্ব দিয়ে কিছু হবে না। তোমরা কারও প্রয়োগকে সমর্থন দাও না, নিজেরাও প্রয়োগ করার রূপরেখা নির্দেশ করো না তাহলে এভাবে আর কতকাল! পৃথিবী তো এভাবে চলতে পারে না।

ইতিহাসের ব্যাপারে সবচে বড় বাস্তবতা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। হাফিজ মুরসির ইতিহাস থেকেও কেউ শিক্ষা গ্রহণ করবে না। জামাআতে ইসলামি এ দেশে রাজনীতির যে ধারা শুরু করেছিল, তাদেরই পথ ধরে এগিয়ে চলছে ইসলামিক (!) ডেমোক্রেটিক দলগুলো। তারা এগিয়ে চলছে ইসলামের বিজয়ের পথে নয়; বরং ধ্বংসের পথে। হ্যাঁ, এর দ্বারা আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কিছু আঙুল ফুলে কলাগাছ হাতে পারে, তা ভিন্ন কথা। যে মৃত্যুকে এড়ানোর জন্য তারা নববি আদর্শ ত্যাগ করে কুফরি আদর্শ আঁকড়ে ধরেছে, দিনশেষে সেই মৃত্যু থেকে তারা পালাতে পারবে না। মৃত্যু তাদেরকে আক্রান্ত করবে; যেখানেই তারা থাকুক না কেন। খালেদা জিয়ার মতো নেত্রীরই আজ যে অবস্থা, এসব মৌলোভীর অবস্থা তো অন্তত তারচে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবুও সময় থাকতে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।

হওয়া উচিত ছিল, রাজনীতিকে ইসলামিকরণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। ইসলামকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে।

আমরা চাই না, এ অঞ্চলেও পুনরায় কেউ হাফিজ মুরসির পরিণতি ভোগ করুক। হ্যাঁ, মৃত্যুকে যদি এরা ভয়ই না পায় তাহলে অযথা হিকমাহর নামে বাতিলের সঙ্গে আপসকামিতার কী প্রয়োজন। নববি আদর্শ যাদের ফার্স্ট চয়েজ নয়, লাস্টেও তো তাদেরকে সেই সুযোগ আর দেওয়া হয় না। এরা হকপন্থীদের মৃত্যু নিয়ে ট্রল করে, তাচ্ছিল্য করে; বাতিলের সঙ্গে চিরকাল আপস করে চলার পর তারাই আবার কোন মুখে সেই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার কথা বলে! আমি হাফিজ মুরসির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করি এবং আর কেউ যেন এই ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেই দুয়া করি।

এই যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে যারা সবচে বড় অন্তরায়, তাদের মধ্যে উলামায়ে সু এবং বাতিলপন্থী হেকমতিয়ারদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। দাজ্জালের আবির্ভাব হলে এদের অধিকাংশই হবে তার সহচর, সৈনিক ও মদদদাতা।

Share This