উলামায়ে দেওবন্দের সর্বজনস্বীকৃত আকাবির শাইখুত তাফসির আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি রহ. তার কালজয়ী রচনা আকায়িদুল ইসলাম গ্রন্থে লেখেন :

‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলিমগণ বলেন, অকাট্য দলিল ও আকলি প্রমাণের আলোকে এ কথা তো প্রমাণিত যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সাদৃশ্য ও অনুরূপ হওয়া থেকে, পরিমাণবিশিষ্ট ও আকৃতিবান হওয়া থেকে এবং দিক ও স্থান থেকে পূত ও পবিত্র। এ কারণে যেসব আয়াত ও হাদিসে আল্লাহ তাআলার সত্তাকে আকাশ অথবা আরশের দিকে নিসবত (সম্পর্কিত) করা হয়েছে, এগুলোর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, আকাশ ও আরশ আল্লাহ তাআলার স্থান বা অধিষ্ঠানের জায়গা। বরং এগুলোর দ্বারা আল্লাহ তাআলার উচ্চ মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব ও অহংকার বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। কারণ, সৃষ্টিজীবের মধ্যে সবচে সমুন্নত হলো আরশে আজিম। আল্লাহ তাআলার সামনে আরশ থেকে নিয়ে ফরশ পর্যন্ত গোটা বিশ্বজগৎ যেখানে অণু পরিমাণ অবস্থানও রাখে না, সেখানে তিনি কীভাবে এর মধ্যে অধিষ্ঠিত হতে পারেন? সবকিছু আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। যা কিছু সৃষ্টি ও অনিত্য, তা কীভাবে অবিনশ্বর সত্তার স্থান ও অধিষ্ঠানের জায়গা হতে পারে!

আল্লাহ তাআলা এ থেকে পূত যে, তিনি আরশের ওপর কিংবা দেহবিশিষ্ট কোনো বস্তুর ওপর স্থান বা স্থিতি গ্রহণ করবেন। যেভাবে রাজা-বাদশাহর ব্যাপারে বলা হয়, রাজা সিংহাসনে সমাসীন হয়েছেন, আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে এরূপ বলা জায়িয নয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা পরিমাণবিশিষ্ট কোনো সত্তা নয়। দেহবিশিষ্ট কোনো বস্তুর ওপর সেই জিনিসই আসন গ্রহণ করতে পারে, যা পরিমাণবিশিষ্ট হয়; তা থেকে বড় হয়, ছোট হয় কিংবা তার বরাবর হয়। এই হ্রাস-বৃদ্ধির ধারণা আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে অসম্ভব ব্যাপার। বিবেকের বিবেচনায়ও এটা অসম্ভব যে, কোনো দেহবিশিষ্ট সৃষ্টি—যেমন, আরশ—নিজ স্রষ্টাকে নিজের ওপরে বহন করবে, এরপর ফেরেশতা সেই দেহবিশিষ্ট সৃষ্টি (আরশ)-কে নিজেদের কাঁধে ওঠাবে; যেমন, আল্লাহ বলেছেন :

وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ

সেদিন আটজন ফেরেশতা নিজেদের ওপরে আরশ বহন করবে।[1]

বিবেকের বিবেচনায়ই এটা অসম্ভব যে, কোনো সৃষ্টি—তা ফেরেশতা হোক কিংবা কোনো দেহবিশিষ্ট বস্তু—নিজ স্রষ্টাকে নিজেদের কাঁধে বহন করবে। স্রষ্টার কুদরত সৃষ্টিজগৎকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে। সৃষ্টিজীবের এই শক্তি নেই যে, তারা স্রষ্টাকে বহন করবে বা তাঁকে ধারণ করবে। যেসব আয়াতে আল্লাহ তাআলার সমুন্নত হওয়া ও ঊর্ধ্বে অবস্থানের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তার দ্বারা তাঁর মর্যাদাগত উচ্চতা এবং শক্তি ও ক্ষমতার প্রবলতা উদ্দেশ্য; ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা স্থানিক উচ্চতা ও ঊর্ধ্বতা উদ্দেশ্য নয়। যেমন, আল্লাহ বলেন :

وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ

তিনি তাঁর বান্দাদের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।[2]

وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

নিশ্চয়ই আল্লাহ সমুচ্চ, সুমহান।[3]

وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই জন্য।[4]

নিচের দুটো আয়াত দ্রষ্টব্য :

وَفَوْقَ كُلِّ ذِي عِلْمٍ عَلِيمٌ

প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপর রয়েছে মহাজ্ঞানী।[5]

وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ

আমরা তো তাদের ওপর প্রতাপশালী।[6]

কুরআন মাজিদের উক্ত দুই আয়াতে ‘ওপর’ দ্বারা মর্যাদাগত উচ্চতা এবং শক্তি ও ক্ষমতার উচ্চতা উদ্দেশ্য, উপরিউক্ত বিষয়টিও অনুরূপ। যেসব আয়াতে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও দূরত্বের কথা এসেছে, সেগুলোতেও রূপক নৈকট্য ও দূরত্ব উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলার অবতরণ দ্বারাও রহমত অবতণ বা তিনি বান্দাদের দিকে অভিমুখী হওয়া উদ্দেশ্য; নাউযুবিল্লাহ, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা ঊর্ধ্ব থেকে নিচের দিকে নেমে আসা উদ্দেশ্য নয়। আমরা দুয়ার সময় আকাশের দিকে হাত এ জন্য ওঠাই না যে, আকাশ আল্লাহ তাআলার জায়গা। বরং এর কারণ হলো, আকাশ হলো দুয়ার কেবলা, যেমন কাবা নামাজের কিবলা। কাবাকে যে বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) বলা হয়, তা এই অর্থ যে, কাবা হলো ইবাদতের ঘর। এর অর্থ নাউযুবিল্লাহ কখনোই এটা নয় যে, কাবা আল্লাহর স্থান এবং তার অবস্থানের জায়গা। কিবলার দিক স্থির করা হয়েছে ইবাদতকারীদের ইবাদতের জন্য; নাউযুবিল্লাহ, তা কখনোই মাবুদের দিক নয়। সুতরাং কাবা যেমন নামাজের কেবলা, একইভাবে আকাশও দুয়ার কেবলা। উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ তাআলা এ থেকে পবিত্র যে, তিনি কাবার ভেতরে বা আকাশের অভ্যন্তরে স্থান গ্রহণ করে আছেন।

সারকথা হলো, এসকল সিফাত (গুণ)-কে ‘সিফাতে তাসবিহি’, ‘সিফাতে তানজিহি’ ও ‘সিফাতে জালাল’ বলা হয়। ইলম, কুদরত, শ্রবণ ও দর্শন ইত্যাদি সিফাতকে ‘সিফাতে তাহমিদি’ ও ‘সিফাতে জামাল’ বলা হয়।  

মুজাসসিমা (দেহবাদী) ও মুশাববিহা (সাদৃশ্য নিরূপণকারী) গোষ্ঠী বলে, আরশ এক ধরনের সিংহাসন। আল্লাহ তাআলা এর ওপর সমাসীন। অর্থাৎ তিনি আরশের ওপর স্থিতি ও স্থান গ্রহণ করে আছেন। ফেরেশতা এই আরশকেই বহন করে। ‘রহমান আরশের ওপর ইসতিওয়া করেছেন’[7]—এই আয়াতের বাহ্যিক শব্দ থেকে তারা এর পক্ষে দলিল দেয়। তাদের বক্তব্য হলো, ‘আরশের ওপর ইসতিওয়া’ দ্বারা আরশের ওপর উপবিষ্ট হওয়া উদ্দেশ্য।

কিছু লোক আবার এ কথা বলে যে, আল্লাহ তাআলা সব জায়গায় আছেন। তিনি প্রতিটি স্থানে বিরাজমান রয়েছেন। তারা কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকে দলিল দেয় :

مَا يَكُونُ مِنْ نَجْوَى ثَلَاثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَمْسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا أَدْنَى مِنْ ذَلِكَ وَلَا أَكْثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمْ أَيْنَ مَا كَانُوا

তিন ব্যক্তির এমন কোনো পরামর্শ হয় না, যাতে তিনি চতুর্থ না থাকেন এবং পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে তিনি ষষ্ঠ না থাকেন। তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশি হোক, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তিনি তাদের সাথে আছেন।[8]

وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ

আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।[9]

وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لَا تُبْصِرُونَ

আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখো না।[10]

وَهُوَ الَّذِي فِي السَّمَاءِ إِلَهٌ وَفِي الْأَرْضِ إِلَهٌ

তিনিই ওই সত্তা, যিনি আকাশেও উপাস্য এবং পৃথিবীতেও উপাস্য।[11]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বক্তব্য হলো, এ ধরনের যত আয়াত বিবৃত হয়েছে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ উচ্চমর্যাদা ও সমুন্নত মর্যাদা এবং তার ইলম ও কুদরতের ব্যাপ্তি বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলার ইলম ও কুদরত সমগ্র সৃষ্টিজগৎকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। যেমন, এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন :

إِنَّ الْقُلُوبَ بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ عَزَّ وَجَلَّ يُقَلِّبُهَا

অন্তরসমূহ মহামহিমান্বিত করুণাময়ের দু-আঙুলের মাঝে অবস্থিত। তিনি সেগুলোকে ওলট-পালট করেন।[12]

সর্বসম্মতভাবে এই হাদিসে স্বাভাবিক, বাহ্যিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অর্থ উদ্দেশ্য নয়। বরং এর দ্বারা ওলট-পালট করার ক্ষমতা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। অন্তরসমূহ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন, তিনি যেভাবে চান তা পরিবর্তন করেন। (আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে) বর্ণিত হয়েছে :

الْحَجَرُ الْأَسْوَدُ يَمِينُ اللَّهِ فِي الْأَرْضِ ، فَمَنْ صَافَحَهُ وَقَبَّلَهُ فَكَأَنَّمَا صَافَحَ اللَّهَ وَقَبَّلَ يَمِينَهُ

হাজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার ডান হাত। যে তার সঙ্গে মুসাফাহা করল এবং তাকে চুমু দিলো, সে যেন আল্লাহর সঙ্গে মুসাফাহা করল ও তার ডান হাতে চুমু দিলো।

সর্বসম্মতিক্রমে এখানে বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়; বরং রূপক অর্থ উদ্দেশ্য। কুরআন মাজিদে এসেছে :

إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ

নিশ্চয়ই যারা আপনাকে বাইয়াত দিচ্ছে, তারা তো আল্লাহকে বাইয়াত দিচ্ছে।[13]

এখানেও সর্বসম্মতিক্রমে রূপক অর্থ উদ্দেশ্য। নাউযুবিল্লাহ, এর অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল উভয়ে এক ও অভিন্ন সত্তা। এভাবেই বিষয়টা বোঝো, ‘আরশের ওপর ইসতিওয়া করা’ দ্বারা বাহ্যিক ও ইন্দ্রিগ্রাহ্য অর্থ উদ্দেশ্য নয় যে, তিনি আরশের ওপর সমাসীন হয়ে আছেন। বরং এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা সুউচ্চ মর্যাদা এবং সমুন্নত মহত্ত্ব বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। যেমন, তিনি বলেন :

رَفِيعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ

তিনিই সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আরশের অধিপতি।[14]

একইভাবে যে হাদিসে আল্লাহ তাআলা প্রতিরাতে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসার কথা বর্ণিত হয়েছে, নাউযুবিল্লাহ তা দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তিনি কোনো দেহবান সত্তা; যা আরশ থেকে নেমে নিচের আকাশে আসে। বরং সেই বিশেষ সময়ে তার রহমত অবতরণ করা বা রহমতের কোনো ফেরেশতা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসা উদ্দেশ্য।’

লেখক রহ. এরপর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় আলোচনা করেছেন, যা আলিমগণের জন্য উপযোগী। সাধারণ পাঠকদের জন্য তা কোনো আলিমের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া বোঝা কিছুটা দুরূহই বটে। এ জন্য আমরা হুবহু সেই আলোচনার স্ক্রিনশট এখানে সংযুক্ত করে দিচ্ছি। আগ্রহীরা নিকটবর্তী আকিদা বিষয়ে প্রাজ্ঞ কোনো আলিম থেকে তা বুঝে নিতে পারেন। আর সাধারণ পাঠকদের জন্য উপরিউক্ত আলোচনাই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।

উপরিউক্ত পুরো আলোচনার সারনির্যাস আমরা এক প্যারায় তুলে ধরছি  উলামায়ে দেওবন্দের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বিখ্যাত তাফসির ও হাদিস-বিশারদ আল্লামা আবদুল হক দেহলবি রহ.-এর ভাষায় :

‘আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ও অবস্থানের জন্য কোনো স্থানের প্রয়োজন নেই। কেননা, দেহবিশিষ্ট ও স্থানিক বস্তুর জন্যই কেবল অবস্থানের জায়গার প্রয়োজন হয়। মহান আল্লাহ তাআলা দেহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। সুতরাং তিনি আকাশে থাকেন না। তিনি জমিনেও অবস্থান করেন না। পূর্ব-পশ্চিম কোথাও তিনি থাকেন না। বরং সমগ্র মহাবিশ্ব তাঁর নিকটি অণু-পরমাণুতুল্য। সুতরাং তিনি এই ক্ষুদ্র সৃষ্টির মধ্যে কেন অবস্থান করবেন? তবে সৃষ্টির সবকিছুই আল্লাহর সামনে পূর্ণ উদ্ভাসিত। কোনো কিছুই তাঁর থেকে সুপ্ত বা অজ্ঞাত নয়। সকল স্থান ও জায়গা আল্লাহর নিকট সমান।’[15]

আরও পড়ুন : আল্লাহ কোথায়?

স্ক্রিনশট দ্রষ্টব্য

আকায়িদুল ইসলাম : ২/৩৩০
আকায়িদুল ইসলাম : ২/৩৩১

[1] সুরা হাক্কাহ : ১৭

[2] সুরা আনআম : ১৮

[3] সুরা হজ : ৬২

[4] সুরা রুম : ২৭

[5] সুরা ইউসুফ : ৭৬

[6] সুরা আরাফ : ১২৭

[7] সুরা তোয়াহা : ৫

[8] সুরা মুজাদালা : ৭

[9] সুরা কাফ : ১৬

[10] সুরা ওয়াকিয়া : ৮৫

[11] সুরা জুখরুফ : ৮৪

[12] সুনানু ইবনি মাজাহ : ৩৮৩৪

[13] সুরা ফাতহ : ১০

[14] সুরা মুমিন/গাফির : ১৫

[15] আকায়িদুল ইসলাম : ৩২

Share This