আকাবিরের ‘নকশে কদম’ তথা পদাঙ্ক থেকে দূরে সরে যাওয়া ঠিক নয়। যে অঞ্চলে যাদের মাধ্যমে দীনের প্রচার-প্রসার হয়েছে, তারাই সে অঞ্চলের আকাবির। তবে শর্ত হলো তাদেরকে হতে হবে ‘মুনিব ইলাল্লাহ’ তথা আল্লাহর প্রতি অভিমুখী। কুরআন কারিমে আছে :
وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيّ
তুমি তার পথের অনুসরণ করো, যে আমার প্রতি অভিমুখী হয়েছে।
আরও রয়েছে :
أُولَئِك الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
তারাই সে সকল লোক, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তাদের হিদায়াতের অনুসরণ করো।
অর্থাৎ তাদেরকে হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এরপর কারও অনুসরণের জন্য যে শরয়ি মি‘য়ার তথা মাপকাঠি আছে, তার উপস্থিতির পর নতুন কোনো শর্ত আরোপ করা ঠিক নয়।
এই উপমহাদেশে ‘মুনিব ইলাল্লাহ’ তথা আল্লাহর প্রতি অভিমুখী হলেন আকাবিরে দেওবন্দ। শুধুই তাঁরা নন; বরং আরও অনেকেই। তবে তাঁদের কুরবানি ও মুজাহাদা এ অঞ্চলে অনেক বেশি এবং তাঁদের সময়ে তাঁদের খেদমতই বেশি স্মরণীয়-বরণীয়। তা ছাড়া আমাদের ওপর তাঁদের ইহসান-অনুগ্রহ অনেক। একদিকে তাঁদের ইহসান, অন্যদিকে এই এলাকায় তাদের তালিম-তারবিয়তের চর্চা—এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাঁদের অনুসরণ করি। তবে এসবের আগে আমরা দেখে নিয়েছি যে, তাঁদের মাঝে শরয়ি মি‘য়ার বা মানদণ্ড আছে কি না। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণে তার উপস্থিতি পেয়েছি। কারণ, যেমনিভাবে তাঁরা মুনিব ইলাল্লাহ, তেমনিভাবে তাঁরা রব্বানি হিদায়াতের ওপরও প্রতিষ্ঠিত।
আর ইত্তিবার ক্ষেত্রে তো ‘যাল্লাত’ তথা স্খলন-বিচ্যুতি সবসময়ই ‘মুসতাসনা’ তথা বর্জিত। অতএব যখন শরয়ি মি‘য়ার-মানদণ্ড উপস্থিত, আবার ‘যাল্লাত’-বিচ্যুতি ‘মুসতাসনা’-বর্জিত তখন কেউ নজদের নাকি অন্য কোনো অঞ্চলের, সে বিষয় নিয়ে পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। নজদওয়ালারা নজদি শায়খের ইত্তিবা করুক। আমাদের এখানে যাঁদের তালিম-তারবিয়াত মারূফ ও মুরাওয়াজ (পরিচিত ও সুপ্রচলিত) এবং মায়ের কোল থেকেই যাদের দীনি তত্ত্বাবধান পেয়ে এসেছি, আমরা তাঁদের ইত্তিবা করি। এটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা থেকে আমরা সরে আসতাম, যদি তাঁদের মাঝে শরয়ি মিয়ার-মানদন্ড না থাকতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুতরাং কেউ যদি বিশেষ কোনো কারণে শরিয়াহর দাবিতেই ইলমের বিশেষ কোনো অধ্যায়ে নজদি বা অন্য যেকোনো হকপন্থী ধারার শায়খদের ইত্তেবা করে, আর সে বিষয়ে আকাবিরে দেওবন্দ থেকে কিছু বর্ণিত না থাকে অথবা যা কিছু বর্ণিত, ইলমের মানদণ্ডে তার কাছে তা অনুসরণীয় বলে মনে না হয়ে থাকে তাহলে এ জন্য তাকে পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করার কোনোই সুযোগ নেই। হ্যাঁ, একান্ত ও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এমনটা করা অর্থহীন। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি খিলাফাহব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে চায়, আর এ ক্ষেত্রে সে বাধ্য হয়েই অন্য কোনো অঞ্চলের শায়খদের রোডম্যাপ অনুসরণ করাকেই সংগত ও উপকারী বলে মনে করে তাহলে তাকে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলার কোনোই অধিকার নেই। কারণ, উদ্দেশ্য তো হকের অনুসরণ ও তার প্রতিষ্ঠা। তার জন্য এগুলো তো সব মাধ্যম বা উপলক্ষ্য। উপলক্ষ্যের পেছনে পড়ে লক্ষ্যকে তো বর্জন করার সুযোগ নেই। যদিও স্বাভাবিকভাবে উপলক্ষ্য অবলম্বন করা ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানো দুরূহ। কিন্তু মূলকথা তো এই যে, অঞ্চলভিত্তিক আলিম ভাগ করাটা কুরআন-সুন্নাহ্র কোনো বিধান নয়। হিকমাহ এবং মাসলাহার দাবিতেই এ কথা বলা হয়ে থাকে। এখন কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত হিকমাহ এবং মাসলাহাতই যদি ভিন্ন কিছু দাবি করে আর তখনও কেউ সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে সত্যানুসরণের সকল পথ রুদ্ধ করে দিতে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই তা চরম গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব ছাড়া কিছু নয়।
কোনো অমুসলিম যদি ‘মুহাররাফ’ তথা বিকৃত ইসলামওয়ালা কারও কাছে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে কি পরেও সেই ইসলামের উপরই তাকে বহাল থাকতে হবে? যেমন, কেউ যদি কোনো বেরেলবির হাতে ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের মধ্যে ‘ইনাবাত’ নেই, হিদায়াতের সঠিক তালিম নেই, সুন্নাতের ইত্তিবা নেই, এমনকি ফরজ পর্যায়ের অনেক আকিদায় যাদের গড়বড়ি আছে তাহলে তাকে অবশ্যই সহিহ ও সঠিক দীনের পথে ফিরে আসতে হবে। আকিদা দুরস্ত করতে হবে। হিদায়াতের সঠিক তালিম নিতে হবে এবং সুন্নাহর পূর্ণ ইত্তিবা তাকে করতে হবে। তবে ইসলাম গ্রহণে সেই বেরেলবির মধ্যস্থতার জন্য তার শোকরগুজার সে হবে, তার ইহসান সে স্বীকার করবে। সেটা ঠিক আছে; বরং তাকেও সুন্নতের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাবে।
তো আমরা যে আকাবিরে দেওবন্দের ইত্তিবাকে গ্রহণ করেছি, সেটা এ জন্য নয় যে, তাঁরা আমাদের অঞ্চলের এবং তাদের মানহাজ ও মাশরাবে আমাদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা, এককথায় তাঁদের অনেক ইহসান আমাদের উপর, এসব বিষয় ওজহে তারজিহ বা প্রাধান্য প্রদানের একটি দিক মাত্র, তবে তাঁদের ইত্তিবাকে ইখতিয়ার বা গ্রহণ করার মূল কারণ হল, তাঁদের ‘ইনাবাত ইলাল্লাহ’ তথা আল্লাহর প্রতি অভিমুখিতা এবং ‘ইহতিদা’ তথা হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়ার মিয়ার বা মানদণ্ডে তাঁদের উত্তীর্ণ হওয়া।
এ কারণে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা ও আমল এবং মাসলাক-মাশরাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত যেকোনো আকাবিরের ইত্তিবাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। আর সেই গ্রহণ করার দ্বারা আমাদের মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে। তবে আকাবিরে দেওবন্দকে আমরা প্রাধান্য দেবো এই জন্য যে, এই দেশে তাঁদের তালিম-তারবিয়তের চর্চা হয়েছে এবং তাঁদের মাধ্যমে অনেক ইহসান আমাদের ওপর আছে।
দেওবান্দিয়াত কী? দেওবান্দিয়াত মূলত তিন জিনিসের সমষ্টির নাম : (১) সুন্নাহর পুনরুজ্জীবন, (২) শিরক, কুফর ও বিদআতের মূলোৎপাটন, (৩) সালাফে সালেহিনের আদর্শ গ্রহণ। এ কারণে দেওবন্দি মতাদর্শে আকাবিররা দলিলের সঙ্গে অনুসৃত। দলিল-প্রমাণ ব্যতিরেকে বড়দের অনুসরণ করা বেরেলবিদের আদর্শ। অতীতে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতার সূচনাও এই অন্ধ অনুসরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এর সবচে বড় দৃষ্টান্ত হলো, হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরি মাক্কি রহ. যখন ফায়সালায়ে হাফতে মাসআলা বইটি লেখেন আর সে বইটি ইমামে রব্বানি রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.-এর কাছে পৌঁছায় তখন তিনি বইটি ছুড়ে ফেলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমরা হাজি সাহেবের হাতে তাসাওউফের ব্যাপারে বাইয়াতবদ্ধ হয়েছি। শরিয়তের ব্যাপারে কোনো বাইয়াত করিনি।’
দেওবান্দিয়াত একটি ধারার নাম, নির্দিষ্ট আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির নাম, দারুল উলুমের কোনো ছাত্র-শিক্ষকের ব্যক্তিগত মতামত বা সিদ্ধান্তের নাম নয়। যদি এমনই হতো, তাহলে নিশ্চয়ই মাজাহিরুল উলুম বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আলিমদেরকে দেওবন্দি বলে গণ্য করা হতো না। এত এত মাসআলায় ভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রদানের পর দারুল উলুম করাচিকে নিশ্চয়ই এত দিনে আলাদা করে দেওয়া হতো। তদুপরি শিক্ষা সিলেবাসে ভিন্নতা থাকার কারণে কত শত প্রতিষ্ঠানকে দেওবন্দি ধারা থেকে বহিষ্কৃত করা হতো। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, দেওবান্দিয়াত কোনো শাখাগত বিষয়ের নাম নয়, প্রাসঙ্গিক এই-সেই বিষয়ের ওপর এর ভিত্তিও নয়; বরং দেওবান্দিয়াত হলো এক আদর্শের নাম, একটি ধারার নাম, সুনির্দিষ্ট উসুলের নাম। সেই উসুলে সামঞ্জস্য থাকলে শাখাগত বিষয়ে প্রমাণসিদ্ধ মতভিন্নতা থাকার কারণে কেউ দেওবান্দিয়াত থেকে বেরিয়ে যায় না।
ভুল কোনো কিছুকে দেওবান্দিয়াত বলে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। দেওবন্দের পরিচালনায় রয়েছেন বা কেয়ামতের আগে থাকবেন–এমন যে কারও ভুল বা বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত-মতামতকে দেওবন্দিয়াতের মোড়ক লাগিয়ে চালিয়ে দেওয়া অনেক বড় অসততা। দেশীয় বা বিদেশী কোনো অসৎ চাটুকার জ্ঞানী লোক যদি দেওবন্দের অনেক বড় সার্টিফিকেটধারীও হয়, তবুও এটা জরুরি নয় যে, তিনি নবিদের মতো একজন নিষ্পাপ মানবরূপে তার দেশে বা তার সমাজে আবির্ভূত হবেন এবং তার সকল গোমরাহিকেও শুধু সার্টিফিকেটের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করে নিতে হবে।
অনেক বিদআতি বা গোমরাহ ফেরকার পৃষ্ঠপোষকরাও এককালে দেওবন্দ মাদরাসায় সুনামের সাথে লেখাপড়া করেছে। এ জন্য তাদের সকল কুকীর্তি বৈধতা পায়নি। সাহাবিদের মধ্যেও কেউ কেউ যদি মুরতাদ হয়ে যেতে পারে, আর তা সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্যও হয়ে থাকে তাহলে এই ফিতনার যুগে এসে এটা তো নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। মনে রাখতে হবে, দেওবন্দের সার্টিফিকেট জান্নাতি হয়ে যাওয়ার বা ভুলের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়ার সনদ নয়। দেওবন্দিয়াত হক। যা কিছু বাতিল, তা যার থেকেই উৎসারিত হোক না কেনো, তা কখনোই এবং কিছুতেই দেওবান্দিয়াতের অংশ হতে পারে না।
দেওবন্দি আলিমদের পারস্পরিক মতভিন্নতা ছিল, আছে এবং থাকবে। প্রত্যেক ফুলের ঘ্রাণ আলাদা। তবে সর্বদা শুধু তা-ই গ্রহণীয় হবে, যা নিরেট হক। আর এ অঞ্চলে হকের অপর নামই দেওবান্দিয়াত। বাতিল কখনো দেওবান্দিয়াতের অংশ ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ না করুন, দেওবন্দি ধারার সকল প্রতিষ্ঠানও যদি কোনোদিন লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যায় তবুও মহান দেওবান্দিয়াতের গায়ে একটুও দাগ বা কালিমা লাগবে না, লাগতে পারে না। চিরকাল চেতনার ফেরিওয়ালা একদল জানবাজ এমন থাকবে, যারা সর্বদা হকের পতাকাবাহী হবে; যদিও শেষ যুগে এসে তারা হয়ে যাবে গুরাবা। আর হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী শেষ জামানায় সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা গুরাবা। তাওহিদের পুনর্জাগরণ, দীন প্রতিষ্ঠা, আল্লাহর কালিমা সমুন্নত করা, বাতিলের শুধু অস্তিত্বই নয়, বরং চিহ্নও মিটিয়ে ফেলা এবং সঠিক নববি ইলমের ধারা কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত ও অক্ষত রাখা উলামায়ে দেওবন্দের অনন্য বৈশিষ্ট্য আর দীনের এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রই তাদের কর্মক্ষেত্র।