هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ ۚ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا ۖ وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

তিনি ওই সত্তা, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, এরপর তিনি আরশের ওপর ‘ইসতিওয়া’ করেছেন। জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু উদগত হয়, আসমান থেকে যা কিছু অবতরণ করে এবং যা কিছু তাতে ঊর্ধ্বগমন করে, তিনি এর সবই জানেন। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন। তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা সবকিছুর দ্রষ্টা। [সুরা হাদিদ : ৪]


আল্লাহ তাআলা অবিনশ্বর। তাঁর সত্তা ও গুণাবলিও অবিনশ্বর। আল্লাহ তাআলার গুণাবলির মধ্যে ক্রমবিন্যাস নেই। তাতে কোনো সংযোজন-বিয়োজনও ঘটে না। তাঁর সত্তার যেমন কোনো সূচনা ও সমাপ্তি নেই, তাঁর গুণাবলিরও তেমন সূচনা ও সমাপ্তি নেই। আল্লাহ তাআলার সকল গুণ অনাদি ও অনন্ত।

এই আয়াতে জানানো হয়েছে, আল্লাহ তাআলা ছয় দিনে আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করার পর আরশের ওপর ‘ইসতিওয়া’ করেছেন। আল্লাহ তাআলার গুণাবলি দুই প্রকার : সত্তাগত গুণাবলি ও কর্মগত গুণাবলি। যেমন, ইলম, হায়াত, কুদরত ইত্যাদি তাঁর সত্তাগত গুণ। সৃষ্টি, পরিচালনা প্রভৃতি তাঁর কর্মগত গুণ। আয়াতে প্রথমে একটি কর্মগত গুণের বিবরণ দেওয়া হলো যে, আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এরপর আরেকটি কর্মগত গুণের বিবরণ আসল যে, তিনি আরশের ওপর ইসতিওয়া করেছেন।

আরশ মাখলুক। আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। কুরআনে এসেছে, ‘তিনি মহান আরশের রব’। আল্লাহ রব, আরশ মারবুব। আল্লাহ খালিক, আরশ মাখলুক। আল্লাহ যেমন ছিলেন, তেমন আছেন, চিরকাল তেমনই থাকবেন। যখন আরশ ছিল না, তখনো আল্লাহ ছিলেন। আরশ সৃষ্টির পরও তাঁর গুণাবলিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। নতুন করে কোনো কিছু সংযোজিত হয়নি। আল্লাহ কোনো দেহবিশিষ্ট সত্তা নন। তাই তিনি আরশের ওপর বসা, শোয়া বা দাঁড়ানোর কোনো চিন্তাও কল্পনায় আনা যাবে না।

আল্লাহ আরশের ওপর ইসতিওয়া করেছেন। এই ইসতিওয়ার ধরন আমরা জানি না। ইসতিওয়া মানে কী, তাও বুঝি না। মানবীয় ইসতিওয়া আল্লাহর শানে প্রযোজ্য নয়। ইসতিওয়ার এক অর্থ হলো, সমুন্নত হওয়া। সমুন্নত দুভাবে হয় : স্থানিকভাবে, মর্যাদাগতভাবে। প্রথমটা আল্লাহর ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কারণ, আল্লাহর কোনো স্থান নেই। বরং স্থান তার সৃষ্টি। স্থান সৃষ্টির অনাদিকাল আগে থেকেই তিনি অস্তিত্ববান। আল্লাহর কোনো দিক নেই। কারণ, দিকও স্থানের মতোই একটি সৃষ্টি। আকিদায়ে তহাবিতেও এসেছে, ‘সকল সৃষ্ট বস্তুর মতো ছয় দিক আল্লাহকে পরিব্যাপ্ত করে না।’ তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘স্থানিক উচ্চতা’ ধরা সম্ভব নয়। এককথায়, ইসতিওয়া হলো আল্লাহ তাআলার একটি কর্মবাচক গুণ; যা তিনি আরশের ওপর প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ জানাচ্ছেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকো, তিনি তোমাদের সাথে আছেন।’ সবাই এটাকে তাবিল (ব্যাখ্যা) করে। এককথায় বলে দেয়, অর্থাৎ জ্ঞান ও কুদরত দ্বারা তোমাদেরকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, আচ্ছা, এখানে আপনারা তাবিল করছেন কেন? স্বাভাবিকভাবে ‘তিনি’ শব্দ দ্বারা সত্তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়। যার অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ সত্তাগতভাবে সবার সাথে আছেন। তারা বলবে, এই অর্থ আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে বেমানান। এখন তাদেরকে বলা উচিত, তাহলে আপনারা যখন বলেন, আল্লাহ সত্তাগতভাবে আরশের ওপর সমাসীন, এটা কি তাঁর ক্ষেত্রে মানানসই? অথচ আল্লাহ কুরআনে জানালেন, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পরে তিনি আরশে ইসতিওয়া করেছেন। তাহলে কি এর দ্বারা তার আগের অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে? নতুন একটি গুণ সংযুক্ত হয়েছে? কর্মবাচক গুণকে আপনারা যখন সত্তাগত গুণ বানিয়ে ফেললেন, তখন এর দ্বারা তো অনুমিত হয়, আল্লাহর সত্তার মধ্যেই পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে; যা কখনোই সম্ভব নয়। এছাড়াও ইসতিওয়ার স্বরূপ ও ধরন তো অজ্ঞাত। যখন বলে দেওয়া হলো, ইসতিওয়ার তাফসির হচ্ছে, বসা বা সমাসীন হওয়া; তখন আর অজ্ঞাত থাকল কোথায়? আমরা তো শব্দের ব্যাখ্যা জেনেই ফেললাম।

এককথায়, ইসতিওয়া শব্দের ব্যাপারে যদি তাফউইদ করতেন, অর্থাৎ এই অস্পষ্ট শব্দের সম্পূর্ণ জ্ঞান আল্লাহর ইলমে ন্যস্ত করতেন, তাহলে তো আপত্তি ছিল না। একইভাবে আয়াতের শেষাংশে যেভাবে তাবিল করেছেন, তার মতো এখানেও তাবিল করলে কোনোরকম চলে যেত। কিন্তু এই দুই পন্থার বাইরে গিয়ে তৃতীয় পন্থা আবিষ্কার করতে গেলেই তো সমস্যা বাঁধে। এক আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা আরও অসংখ্য আয়াতের সুস্পষ্ট মর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। আর তাবিল তো একটা প্রাকৃতিক বিষয়। কোথাও না কোথাও তাবিল না করে উপায় কোথায়! যেমন, আয়াতের শেষাংশে আপনারাই তাবিল করলেন। এছাড়াও কুরআনের আয়াত : ‘আমি আদমের মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিলাম’ – সেখানেও সকলেই তাবিল করে। কেউ বলে না, রুহ আল্লাহর একটি সিফাত। আল্লাহ রুহবিশিষ্ট সত্তা আর তাঁর রুহের অংশবিশেষ আদমের মধ্যে ফুঁকে দেওয়া হয়েছে। বরং এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করে। আর এটাকেই তাবিল বলা হয়। সুতরাং তাবিল যখন কোথাও না কোথাও করতেই হয়, তাহলে এর পুরো অস্তিত্ব অস্বীকার করার যুক্তি কী! সালাফগণ এই আয়াতের তাফউইদ করেছেন। অনেকে আবার অর্থও বলেছেন। যারা অর্থ বলেছেন, তারা তাবিলের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন। যেমন, সমুন্নত হওয়ার অর্থ করেছেন। কিন্তু এর দ্বারা স্থানিক সমুন্নতি উদ্দেশ্য নেননি; ভিন্ন কিছু উদ্দেশ্য নিয়েছেন। আল্লাহু আ’লাম। তবে তাফউইদই সতর্কতা। কারণ, এতে জনসাধারণের মানসপটেও কোনো সাদৃশ্যের কল্পনা আসে না। তাদের আকিদা এর দ্বারা নিরাপদ থাকে।

Share This