ত-সিন-মিম। এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত। মুমিনদের কল্যাণার্থে আমি আপনার কাছে মুসা ও ফেরাউনের কিছু বৃত্তান্ত যথাযথভাবে বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে ফেরাউন পৃথিবীর বুকে চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিলো এবং সে তার অধিবাসীদেরকে বহু দলে বিভক্ত করে রেখেছিলো। তাদের একটি শ্রেণিকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিলো, যাদের পুত্রদেরকে সে জবাই করতো এবং তাদের নারীদেরকে জীবন্ত দাসী বানিয়ে রাখতো। প্রকৃতপক্ষে সে ছিলো ফ্যাসাদ বিস্তারকারীদের একজন। আর আমি চাচ্ছিলাম, সে-দেশে যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিলো, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা বানাতে এবং তাদেরকেই (সে-দেশের ভূমি ও সম্পদের) উত্তরাধিকারী বানাতে এবং সে-দেশে তাদেরকে ক্ষমতাসীন করে ফেরাউন হামান ও তাদের সৈন্যদেরকে সেই জিনিস দেখাতে, যার ব্যাপারে তারা শঙ্কাবোধ করছিলো (অথবা— যা থেকে বাঁচার জন্য তারা কলাকৌশল করছিলো)। আমি মুসার মায়ের কাছে এই প্রত্যাদেশ পাঠালাম যে, তুমি তোমার সন্তানকে দুধ পান করাতে থাকো। যখন তার ব্যাপারে কোনো আশঙ্কা বোধ করবে, তখন তাকে নদীতে ফেলে দিও। আর ভয় পেও না ও দুঃখিত হয়ো না। অবশ্যই আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসুলগণের অন্তর্ভুক্ত করবো। এরপর ফেরাউনের পরিবার তাকে তুলে নিলো। এর পরিণাম তো এই ছিলো যে, সে হবে তাদের শত্রু ও তাদের দুঃখের কারণ। নিশ্চয়ই ফেরাউন হামান এবং তাদের সৈন্যরা বড় ভুলের ওপর ছিলো। ফেরাউনের স্ত্রী বললো, এ শিশু আমার ও তোমার চোখের শীতলতা। তোমরা তাকে হত্যা করো না। হয়তো সে আমাদের উপকারে আসবে কিবা আমরা তাকে পুত্র বানিয়ে নেবো। (এ সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে) তারা এর পরিণতি অনুধাবন করতে পারেনি। এদিকে মুসার মায়ের মন ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো। সে তো রহস্য ফাঁসই করে দিচ্ছিলো— যদি না আমি তাকে মনোবল দান করতাম, যাতে সে আশ্বস্ত হতে পারে। এসময় (মুসার মা) মুসার বোনকে বললো, শিশুটির খোঁজ নাও (অথবা— তার পিছু নাও)। মুসার বোন তাদের অজ্ঞাতসারে নিরাপদ দূরত্বে থেকে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলো। আমি পূর্বেই মুসার ওপর অন্য ধাত্রী নিষিদ্ধ করে রেখেছিলাম। মুসার বোন বললো, আমি কি আপনাদেরকে এমন পরিবারের সন্ধান দেবো, যারা নিষ্ঠার সঙ্গে এ শিশুর লালনপালন করবে, আর তারা তার কল্যাণকামী। এভাবেই আমি মুসাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চোখ শীতল হয়, সে চিন্তিত না থাকে এবং যাতে সে ভালোভাবে জানতে পারে যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। যখন মুসা পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো ও পরিণত বয়স্ক হলো, তখন আমি তাকে দান করলাম হেকমত এবং ইলম (অথবা— প্রজ্ঞা ও জ্ঞান)। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে নগরবাসীর উদাসীনতার মুহূর্তে নগরে প্রবেশ করলো। তখন সে নগরের দু’লোককে মারামারিরত অবস্থায় পেলো। একজন তার স্বগোত্রীয়, অপরজন তার শত্রুপক্ষীয়। স্বগোত্রীয় লোকটি শত্রুপক্ষীয় লোকটির বিপক্ষে তার সাহায্য চাইলো। তখন মুসা তাকে ঘুষি মারলো এবং (এক ঘুষিতেই) তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো। মুসা (আক্ষেপ করে) বললো, এ তো শয়তানের কাণ্ড। নিঃসন্দেহে সে ভ্রষ্টকারী ও সুস্পষ্ট শত্রু। তখন মুসা (প্রার্থনা করে) বললো, হে আমার প্রতিপালক! আমি নিজের ওপর অবিচার করে ফেলেছি। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। অনন্তর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। নিশ্চয়ই তিনি চিরক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। মুসা বললো, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে যে নেয়ামত দান করেছেন, তা লাভ করে আমি কিছুতেই অপরাধীদের সাহায্যকারী হবো না। এরপর সে সকাল বেলা ভীতস্বন্ত্রস্ত অবস্থায় নগরে বের হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। হঠাৎ সে দেখতে পেলো, যে লোকটি গতকাল তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলো, সেই ব্যক্তিই ফের চিৎকার করে সাহায্যের জন্য তাকে ডাকছে। তখন মুসা তাকে বললো, তুমি তো প্রকাশ্য পাজি লোক। এরপর মুসা যখন তাদের উভয়ের শত্রুকে শায়েস্তা করতে অগ্রসর হলো, তখন স্বগোত্রীয় লোকটি বলে উঠলো, তুমি কি আমাকে হত্যা করতে চাচ্ছো, যেমন গতকাল একজনকে হত্যা করেছো? তুমি তো দেখছি পৃথিবীর বুকে স্বেচ্ছাচারী হতে চাও আর শান্তি প্রতিষ্ঠাকারীদের একজন হতে চাও না। নগরের শেষ প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি ছুটে এসে বললো, মুসা! নেতৃবর্গ তোমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। সুতরাং তুমি এখান থেকে বেরিয়ে পড়ো। নিশ্চয়ই আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষীদের একজন। মুসা বিপদ-শঙ্কায় নগর থেকে বেরিয়ে পড়লো। সে বললো, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জালিম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করো। যখন তিনি মাদয়ান অভিমুখে যাত্রা করলেন, তখন বললেন, আমার পূর্ণ আশা রয়েছে যে, আমার প্রতিপালক আমাকে সঠিক পথে পৌছাবেন। সে মাদয়ানের কুয়ার কাছে পৌছে দেখলো, সেখানে একদল মানুষ গবাদিপশুকে পানি পান করাচ্ছে। আর তাদের পেছনে দু’টি মেয়ে নিজ নিজ মেষপালকে আগলে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মুসা u বললো, তোমাদের কী হয়েছে? রাখালরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাতে পারবো না আর আমাদের বাবা অতি বৃদ্ধ। তখন মুসা তাদের পশুগুলোকে পানি পান করালো। এরপর একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে এই বলে প্রার্থনা করলো, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার প্রতি যে কল্যাণ বর্ষণ করবেন, আমি তার মুখাপেক্ষী। কিছুক্ষণ পর সেই দুই নারীর একজন লাজুক ভঙ্গিমায় হেঁটে হেঁতে তার কাছে আসলো। সে বললো, আমার বাবা আপনাকে ডাকছেন, আপনি যে আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে দিয়েছেন, তার প্রতিদান দেয়ার জন্য। অনন্তর যখন সে তার কাছে এসে পুরো বৃত্তান্ত বললো, তখন সে বললো, কোনো ভয় করো না। তুমি জালিম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি পেয়ে গেছো। নারীদ্বয়ের একজন বললো, বাবা, আপনি তাকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজে নিয়ে নিন। আপনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কারো থেকে কাজ নিতে চাইলে সেজন্য এমন ব্যক্তিই উত্তম, যে শক্তিশালী এবং আমানতদার। (তার বাবা) বললো, আমি আমার এই দুই মেয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই— এই শর্তে যে, তুমি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আট বছর আমার এখানে কাজ করবে। আর যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটা তোমার নিজ এখতিয়ার। আমি তোমাকে কষ্টে ফেলতে চাই না। আল্লাহ যদি চান, তুমি আমাকে সৎলোকদের অন্তর্ভুক্ত পাবে। মুসা বললো, এই বিষয়টি আমার ও আপনার মধ্যে স্থির হলো। আমি দুই মেয়াদের যেটিই পূর্ণ করি, আমার ওপর কোনো বাড়াবাড়ি-জোড়াজোড়ি চলবে না। আর আমরা যে কথা বলছি, আল্লাহই তার রক্ষাকর্তা।

 

{সুরা কাসাস: ১-২৮}

Share This