আজকের দিনটার সঙ্গে বালাকোটের রক্তমাখা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে হিন্দুস্তানের ইতিহাসের এক আলোকিত অধ্যায়। দিনটা নিয়ে তেমন কথাবার্তা চোখে পড়ছে না। অবশ্য বিশেষ দিনেই বিশেষ ঘটনা স্মরণ করতে হবে, এমনও কোনো আবশ্যকতা নেই।

আমিরুল মুমিনিন আওলাদে রাসুল সায়্যিদ আহমদ শহিদ রাহ.-কে বাদ দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামি ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব না। আমাদের শিকড় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর ও তাঁর আন্দোলনের সাথে। তাঁর জীবনীর সর্বশেষ অধ্যায় হলো এই বালাকোট। যার কারণে শুধু বালাকোট জানলেই তাঁকে জানা হয় না। এই মহান মুজাদ্দিদকে জানতে হলে তাঁর গোটা জীবনী জানতে হবে। তখন কেবল এক যুদ্ধের ব্যর্থতাকে তেমন কোনো গুরুতর বিষয় মনে হবে না।

শাহ ইসমাইল শহিদ এবং মাওলানা আবদুল হাই রাহ.-কে বাদ দিয়েও আমিরুল মুমিনিনকে বোঝা সম্ভব নয়। উপমহাদেশীয় বিদআতিরা অনেক বেশি জুলুম করেছে মহান ইমাম শাহ ইসমাইল শহিদ রাহ.-এর ওপর। এমনকি ‘সিরাতে মুসতাকিম‘ নামে তিনি আমিরুল মুমিনিনের যে বাণীসংকলন রচনা করেছেন, তা নিয়েও চলেছে কত প্রোপাগান্ডা। যারা শাহ ইসমাইল শহিদকে অস্বীকার করতে চায়, তাদের কোনোই অধিকার নেই সায়্যিদ আহমদ শহিদ নিয়ে মিথ্যা আবেগ ঝাড়ার, সত্যকে চেপে গিয়ে চেতনাব্যবসা করার৷ আবার যারা ‘সায়্যিদ বাদশাহ’র পূর্ণাঙ্গ জীবনী ও আদর্শ জানে না, তাদেরও বালাকোট নিয়ে সস্তা অনুভূতি প্রকাশ করা মানায় না।

বালাকোটকে জানতে হলে শাহ ওয়ালিউল্লাহর খান্দানদের জানতে হবে। দারুল হারব ফাতওয়ার তাৎপর্য বুঝতে হবে। সহিহ তাসাওউফের নিগূঢ় তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। সুলুকে রাহে বেলায়েতের সাথে সুলুকে রাহে নবুওয়াতের অনুপম সংমিশ্রণকে অন্তরের মণিকোঠায় গেঁথে নিতে হবে। অন্যথায় বিভ্রম ও বিভ্রান্তি তৈরি হবে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে, জেএমবি। তারা নিজেদের দলের নাম নিয়েছে সায়্যিদ আহমদ শহিদ রাহ.-এর ‘জামাআতুল মুjahiদিন’ থেকে। এ ইতিহাস তারা নিজেরাই নিজেদের দলিল-দস্তাবেজে বর্ণনা করে। অথচ বিষয়টা নিখাদ প্রতারণা ছাড়াও নিরেট হাস্যকরও। কারণ, এরা হচ্ছে শতভাগ নজদি, লা মাজহাবি ও তাসাওউফবিরোধী। অপরদিকে সায়্যিদ বাদশাহর জামাআতের অন্যতম মূলভিত্তিই হচ্ছে তাসাওউফ। সেখানকার অধিকাংশ লোকও ছিল মুকাল্লিদ হানাফি। এই বাঙালি জামাআত কৌশল বা প্রতারণা হিসাবে অথবা আরেকটু সহজ করে বললে মূর্খতা ও অজ্ঞতার কারণে শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও সায়্যিদ আহমদ শহিদকে প্রমোট করে; কিন্তু তাদের সামনে শাহ ওয়ালিউল্লাহর ‘ফুয়ুজুল হারামাইন‘ বা সায়্যিদ আহমদ শহিদের ‘সিরাতে মুসতাকিম‘ উপস্থাপন করে এ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন জানতে চাইলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান বেরিয়ে আসবে। যাহোক, এখানে তাদের ভালো বা মন্দ কোনোটা বলাই উদ্দেশ্য নয়। তারা এ আলোচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিকও না। আমি শুধু ইতিহাসের স্বার্থপূর্ণ অপব্যবহার এবং নাম ও হাকিকতের অসামঞ্জস্যের ওপর সামান্য আলোকপাত করলাম।

ভারতীয় উপমহাদেশের আহলে হাদিসদের ইতিহাস ঘাঁটলেও দুটো শাখার সন্ধান পাওয়া যায়। একটা শাখা হলো ব্রিটিশ বেনিয়াদের তাবেদার দালাল গোষ্ঠী। সংখ্যায় এরাই ম্যাক্সিমাম। এদেরকেই এখানকার তৎকালীন আহলে হাদিসদের মূলধারা বললে সম্ভবত অবাস্তব হবে না। এখনকার বাঙালি মাদখালি গোষ্ঠী মূলত তাদেরই রুহানি সন্তান বা আপডেট ভার্সন। আরেকটা শাখা হলো সায়্যিদ আহমদ শহিদের মুরিদান শ্রেণি, যারা তার সঙ্গে যুদ্ধেও শরিক থেকেছে। তবে এরা সংখ্যালঘু। অনেকটা বর্তমানের মতোই বলা যায়।

কিন্তু দুঃখ ও অনুতাপের বিষয় যেটা, সায়্যিদ আহমদ শহিদ রাহ.-এর প্রধান মুফতি ও উপদেষ্টা, তাঁর চিরকালীন সঙ্গী ও জামাআতের স্যরপুরুস্ত মহান ইমাম শাহ ইসমাইল শহিদ রাহ.-এর ওপর ভারতীয় উপমহাদেশে শত বছরের অধিক সময় ধরে যে অবর্ণনীয় জুলুম ও গোস্তাখি হয়েছে, তা নিয়ে খুব কমই প্রতিবাদ হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষদের ওপর তার যে বিরাট অনুগ্রহ, তার সামান্য প্রতিদান দেওয়ার বা হক আদায় করার সামান্য গরজও অধিকাংশ জ্ঞানীগুণী অনুভব করেনি। আজও ফেসবুকে এসে দেখা যায়, কিছু মানুষ তাঁকে পুরোদস্তুর খারেজি বলছে। আহ, কিয়ামতের দিন এরা কী জবাব দেবে রবের সামনে! রেজবি, বেরেলবি ও তাদের সমমনারা দাজ্জালকে যতটা অপছন্দ করে, এর চাইতেও মনে হয় অধিক ঘৃণা করে শাহ ইসমাইল শহিদকে। আল্লাহ তাঁর কবরকে নুরে নুরান্বিত করে দিন।

আমিরুল মুমিনিন মারিফাতের ইমাম ও সুলুকের শায়খ হলেও শরিয়াহ নিয়ে তার লেখাপড়া অনেক কম ছিল; যেটাকে কোনোভাবেই পর্যাপ্ত বলা যায় না। এত পরিমাণ ইলমি শূন্যতা থাকার পরও তিনি যে এই বিশাল বিপ্লব দাঁড় করিয়েছেন, লাখ লাখ মুরিদানকে সহিহ তারবিয়াত করতে সমর্থ হয়েছেন, এর পেছনে সবচে বড় অবদানই তো ছিল অল্প কয়েকজন মনীষীর। যাদের মধ্যে শাহ ইসমাইল শহিদ ও মাওলানা আবদুল হাইয়ের নাম সবচে বেশি প্রণিধানযোগ্য। একমাত্র দলান্ধ বা অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কেউ এটাকে অস্বীকার করতে পারে না।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের পেছনে মাশায়েখে চিশতিয়ার অবদান সবচে পুরোনো হলেও তিনজন নকশবন্দি শায়খের অবদানকেও মোটেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুজাদ্দিদে আলফে সানি শায়খ আহমদ সেরহিন্দি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি এবং সায়্যিদ আহমদ শহিদ বেরেলবি রাহ.। এটা ঠিক যে, তারা অনেক ধারার সমন্বয়কারী ছিলেন। কিন্তু এ কথাই বা অস্বীকারের সুযোগ কোথায় যে, তাদের ওপর নকশবন্দিয়া সিলসিলার প্রভাবই ছিল সবচে বেশি। তবে শেষোক্তজনকে যদি স্বতন্ত্র সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, তবে সেটাও মিথ্যা হবে না। মুজাদ্দিদে আলফে সানি রাহ. যেমন খাজা বাকি বিল্লাহ থেকে নকশবন্দিয়া সিলসিলার যে ফয়েজ লাভ করেছিলেন, তার ওপর ইজতিহাদ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ও পরিমার্জন করেছিলেন; যেটাকে ইজতিহিদ ফিল মাসলাক বলা যেতে পারে, যার ওপর ভিত্তি করে মুজাদ্দিদিয়া মাসুমিয়া নামক সংস্করণের উদ্ভব ঘটে, সায়্যিদ বাদশাহর বিষয়টাকে এভাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

তবে একটা মজার বিষয় হলো, উপরিউক্ত তিনওজন হানাফি মাজহাবের হলেও হানাফিদের সঙ্গে কিছু মাসআলা নিয়ে তাদের দ্বিমত ছিল। এমনকি এ কারণে তাদের বিভিন্ন ট্যাগও দেওয়া হয়েছিল। আমিরুল মুমিনিনের আন্দোলন তো ওয়াহাবি আন্দোলন নামেই প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে; যদিও মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নজদির সঙ্গে তাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। গোঁড়া হানাফিরা কেউ দলিলের সঙ্গে দু-চার মাসআলায় দ্বিমত করলেও তাকে ওয়াহাবি বা লা মাজহাবি ট্যাগ দিয়ে বসে। এটা চরম অন্যায়, হঠকারিতা, একগুঁয়েমি ও বক্রতা ছাড়া কিছু নয়।

দেওবন্দিরা ধারাগতভাবে চিশতি সুফি। (এ যুগের নামধারী দেওবন্দিদের কথা বাদ) হ্যাঁ, তারা চার তরিকাকে জমা করেছে। তবে প্রাধান্য সিলসিলা চিশতিয়াকেই দিয়েছে। তাদের পির হলেন সায়্যিদুত তায়িফা (দেওবান্দিয়া) হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কি রাহ.। তিনি মিয়াজি সায়্যিদ নুর মুহাম্মাদ ঝানঝানবি সূত্রে আমিরুল মুমিনিনের সঙ্গে যুক্ত। এরপর তার থেকে এসেছে গাঙ্গুহি ও থানবি ধারা। গাঙ্গুহি থেকে এসেছে মাদানি ধারা। সুতরাং দেওবন্দিদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন সায়্যিদ বাদশাহ।

নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে একটা বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই, সায়্যিদ বাদশাহ একজন ঘোষিত আমিরুল মুমিনিন হিসাবে নিজের জামাআতকে রুহানিভাবে যে অবস্থানে পৌঁছিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও তাঁর কিছু কঠোর নীতির কারণে অধিকাংশ মুরিদই ঝড়ে গেছে, যেগুলোর ব্যাপারে শাহ সাহেবসহ অনেকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তিনি অনড় থেকেছেন, কিন্তু যারা টিকে গেছে, তারা একেকজন সোনার মানুষে পরিণত হয়েছে। এই যুগের অনেক নামীদামী সুফির তুলনায় তার বহু সাধারণ মুরিদের মান ছিল অনেক উচ্চাঙ্গে। তবে যুদ্ধ যেহেতু চলে যুদ্ধের নীতিতে। এখানে জয়-পরাজয় নির্ণীত হয় ট্যাকটিক ও স্ট্রাটেজির ওপর নির্ভর করে। সুতরাং তিক্ত হলেও এ সত্য অস্বীকারের জো নেই যে, স্ট্রাটেজিকভাবে সায়্যিদ বাদশাহর জামাআতের অবস্থান খুব আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে ছিল না। তাদের রুহ ও রুহানিয়্যাতে ঘাটতি ছিল না; কিন্তু রাসুলুল্লাহ সা., উমর বা খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর মতো ট্যাকটিক ও স্ট্রাটেজি তারা সাজাতে পারেননি।

এটা আল্লাহরই সুন্নাহ যে, তিনি এক ব্যক্তির মধ্যে সব যোগ্যতা জমা করেন না। এ যে আল্লাহর অনুগ্রহ, আল্লাহ যাকে চান তাকে দান করেন। তবে এসব বাহ্যিক কলাকৌশলের সঙ্গে রুহানিয়্যাত বা মাকবুলিয়্যাতের কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহ সবাইকে ইখলাসের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত প্রতিদানই দেবেন। আর আল্লাহর ফায়সালা তো বাস্তবায়িত হওয়ারই ছিল। বালাকোটের বাহ্যিক পরাজয়ের ফায়সালা তো আমাদের সৃষ্টিরও বহুকাল আগেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। নিঃসন্দেহে তার ফায়সালাই চূড়ান্ত ফায়সালা। তাঁর সমীপে নির্দ্বিধ সমর্পণই আমাদের বন্দেগির একমাত্র নিশানা।

Share This