বইয়ের নাম : ফাহমুস সালাফ : দীন বোঝার কষ্টিপাথর

লেখক : ইফতেখার সিফাত

সম্পাদক : মাওলানা আফসারুদ্দীন ও মাওলানা মাসরুর

প্রকাশনী : সিজদাহ পাবলিকেশন

পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৬০ (১০ ফর্মা)

মুদ্রিত মূল্য : ২৩০৳ (পেপারব্যাক)

রেটিং : ৮/১০

সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন ­:

যারা দীনের মৌলিক ইলম রাখে এবং যুগের ফিতনা সম্পর্কেও কিছুটা অবগত, তাদের জন্য এ উসুলি গ্রন্থটি অত্যন্ত উপকারী। যারা উসুলি গ্রন্থাবলি অধ্যয়নে অভ্যস্ত নয়, তাদের জন্য বইটা পড়তে ও বুঝতে খানিকটা বেগ পেতে হতে পারে। তবে সময় নিয়ে পড়লে, পারলে গ্রুপ স্টাডির ব্যবস্থা করলে অনেক ফায়দা হবে। এ বইয়ের ভাষা হয়েছে অনেকটা মাসিক আল-কাউসারের মতো। সুতরাং যারা শুধু সৃজনশীল সাহিত্য ও মোটিভেশনাল বইপত্র পড়তে অভ্যস্ত, এ বই তাদের জন্য ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতে পারে। তবে যারা প্রকৃত অর্থেই ইলম ও হিদায়াতের তলব (অন্বেষণ) রাখে, তাদের জন্য এটা অনেক মূল্যবান একটা বই।

বইটিতে যা কিছু রয়েছে :

শুরুতে উভয় সম্পাদকের ভূমিকা রয়েছে (পৃ. ৭-১২)। সূচিপত্রের পরে লেখকের কথা রয়েছে ছয় পৃষ্ঠাব্যাপী (পৃ. ১৫-২০)। এ বইটি পড়ার আগে লেখকের কথা পড়ে নেয়া অত্যন্ত উপকারী হবে। এরপর মৌলিক আটটা শিরোনামে পুরো বইয়ের আলোচনা বিন্যস্ত করা হয়েছে। (১) সর্বপ্রথম এসেছে ‘ফাহমুস সালাফ’ পরিচিতি। এতে শাব্দিক ও পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ওপর আলোচনা করা হয়েছে। এ বইয়ে শব্দ দুটো দ্বারা কী উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে, তা-ও পরিষ্কার করে তুলে ধরা হয়েছে। (২) এরপর এসেছে ‘ফাহমুস সালাফ’র প্রতি গুরুত্বারোপের কারণ। এ শিরোনামের অধীনে ছয়টি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। (৩) ফাহমুস সালাফ সংরক্ষণ করার ব্যাপারে সর্বযুগে আলিমদের গুরুত্ব ও মনোযোগ। (৪) ফাহমুস সালাফের ওপর নির্ভরতার দলিল। (৫) ফাহমুস সালাফ আঁকড়ে ধরার উপকারিতা। (৬) ফাহমুস সালাফ থেকে বিচ্যুতির কারণ (৭) ফাহমুস সালাফ নিয়ে উত্থাপিত ১৪টি সংশয়ের নিরসন। (৮) উপসংহার। সর্বশেষে সংক্ষিপ্তভাবে রয়েছে বইয়ে ব্যবহৃত কিছু পরিভাষার অর্থ।

বইটির উৎস :

বইটির মূল কাঠামো নেওয়া হয়েছে ড. আবদুল্লাহ বিন উমর রচিত ‘ফাহমুস সালাফিস সালিহি লিন-নুসুসিস শারইয়্যাহ ওয়ার রাদ্দু আলাশ শুবুহাতি হাওলাহু’ গ্রন্থ থেকে। লেখক বইটি হুবহু অনুবাদ না করে তার আলোকে এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে হাকিমুল উম্মাহ থানবি রাহ.-এর ‘আল-ইনতিবাহাতুল মুফিদাহ আনিল ইশতিবাহাতিল জাদিদাহ’ এবং আল্লামা তাকি উসমানি হাফি.-এর ‘ইসলাম আওর জিদ্দাত পছন্দি’সহ এ বিষয়ক বিভিন্ন আর্টিকেল থেকে অনেক খোরাক সংগ্রহ করেছেন। পাশাপাশি শায়খ ফাহাদ আজলানের কিছু নিবন্ধের ছাপও এতে পাওয়া যাবে। সর্বোপরি বইয়ের আলোচনাগুলো লেখকের নিজস্ব চিন্তা নয়; বরং তা বিদগ্ধ মনীষীগণের এ-সংক্রান্ত আলোচনার সারনির্যাস। যার কারণে স্বীকৃত ও বরিত বিষয়গুলোই লেখকের কলমে উঠে এসেছে নিজস্ব শৈলীতে, উত্তম উপস্থাপনায় ও যুগোপযোগী বাক্যচয়নে। পাশাপাশি এতে ফুটে উঠেছে তার কর্মময় জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ছাপ।

বইটির প্রয়োজনীয়তা :

বর্তমান যুগে ইসলামের অনেক ভার্সন বেরিয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমাবান্ধব ও প্রবৃত্তির অনুকূল কাঠামোটাকেই বিপুল সংখ্যক আত্মপ্রবঞ্চিত মুসলিম লুফে নিচ্ছে। সর্বযুগে ইসলামের সহিহ কাঠামো ও গলদ কাঠামোর মধ্যে পার্থক্য করার এক গুরুত্বপূর্ণ কষ্টিপাথর হলো ফাহমুস সালাফ। অতীতেও যত বাতিল ফেরকার জন্ম হয়েছে, সব ফাহমুস সালাফ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণেই ভ্রান্তির পথে পা বাড়িয়েছে। বর্তমানে সেক্যুলারিজমের অবাধ রাজত্বের কারণে ইসলামের ওপর প্রবৃত্তিপূজারীদের হামলা চলছে অহর্নিশ। মার্টিন লুথারের রিফরমেশন আন্দোলনের প্রভাব খ্রিষ্টধর্মকে ছাপিয়ে এখন ইসলামের ওপর পড়তে শুরু করেছে। ইসলামের মৌলিক কাঠামোকে বিনষ্ট করার জন্য সেক্যুলারিজমের ধ্বজাধারীদের সাধনার অন্ত নেই। মুসলিম দেশগুলোতে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসন এবং শাসনোত্তর সময়েও এসব দেশের বিক্রীত পুতুল শাসকগোষ্ঠীর কারণে মডারেট ইসলাম কেমন যেন জেঁকে বসেছে হাজারো নয়, বরং লক্ষ-কোটি মানুষের অন্তরে। এর মধ্যে একশ্রেণির অজ্ঞ দাঈর প্রভাবে ফাহমুস সালাফের ব্যাপারে মানুষের অন্তরে অনাস্থা ও বীতশ্রদ্ধা সৃষ্টি করা ইবলিসের দোসরদের জন্য সহজ হয়েছে। এছাড়াও অনলাইনের সুবাদে ওরিয়েন্টালিস্ট তথা প্রাচ্যবিদদের বিষাক্ত গবেষণা উম্মাহর নিকট পৌঁছে যাচ্ছে খুব সহজে। যার কারণে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মানুষ ক্রমশ দলে দলে সরে যাচ্ছে ইসলামের সহিহ ও প্রকৃত কাঠামো থেকে। উপরন্তু এসব ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ট্রাডিশনাল আলিমদের তারা বলতে শুরু করেছে গোঁড়া, সেকেলে ও মৌলবাদী ইত্যাদি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উম্মাহকে ধ্বংসের অতল গহ্বর থেকে বাঁচাতে হলে তাদেরকে সালাফের সর্বসম্মত মানহাজে ফেরানোর কোনো বিকল্প নেই। এ মুহূর্তে এ ছাড়া গত্যন্তরও নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সালাফের মানহাজ শব্দটিকেও আজ বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। একশ্রেণির লোক সালাফ ও সালাফি শব্দগুলোকে নিজেদের পৈতৃক উত্তরাধিকারে পরিণত করেছে; যদিও এ দেশে এ পরিচয়ের দাবিদার শায়খদের বড় একটা অংশের মধ্যেই সহিহ ইসলাম নেই। তারা নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ বলে দাবি করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা মাদখালি ও মুরজিয়া নামক ভ্রান্ত গোষ্ঠীর সীমার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে এ বইটি সত্যকে চিনতে এবং তা হৃদয়ঙ্গম করতে বেশ সাহায্য করবে।

ফাহমুস সালাফ কী?

ফাহমুস সালাফ মানে পূর্বসূরিদের বুঝ ও উপলব্ধি। এখানে সালাফ দ্বারা উদ্দেশ্য খাইরুল কুরুন তথা শ্রেষ্ঠ তিন প্রজন্ম—সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবে তাবেয়ি। এর পরের প্রজন্মগুলোর মধ্যেও যারা হুবহু খাইরুল কুরুনের পথে চলেছেন, তারাও তাদের পরবর্তীদের জন্য সালাফ। তবে সব সালাফের বুঝ গ্রহণীয় নয়; তাদের মধ্যে যারা ন্যায়নিষ্ঠ ও সত্যের অনুসারী, কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানী—একমাত্র তাদের বুঝই গ্রহণীয়। এ কারণে সালাফ শব্দের সঙ্গে ‘সালেহিন’ যোগ করে সালাফে সালেহিন বলাটাই যৌক্তিক ও সংগত। আবার সালাফে সালেহিনের প্রত্যেকের বুঝ এককভাবে শরিয়াহর দলিল নয়; বরং তাদের সর্বসম্মত মত ও পথই শরিয়াহর দলিল। কারণ, এককভাবে কেউ ভুল করতে; কিন্তু শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের সব মনীষী কোনো ভুলের ব্যাপারে একমত হবেন, এটা অসম্ভব। হাদিসে এসেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মাহকে গোমরাহির ওপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। এছাড়াও একাধিক আয়াত ও হাদিস দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। সুতরাং আমরা বলতে পারি, বইয়ে ফাহমুস সালাফ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সালাফে সালেহিন তথা খাইরুল কুরুনের সর্বসম্মত মত ও পথ। সর্বসম্মত হওয়ার দুই অর্থ। এক হলো, সকলে এ মত দিয়েছেন বা এই পথ অবলম্বন করেছেন। আরেক হলো, এককভাবে কেউ এ মত দিলেও সমসাময়িক ও পরবর্তীরা সুস্পষ্টভাবে জানা সত্ত্বেও তার বিরোধিতা করেননি; বরং তারা মৌনতা অবলম্বন করেছেন। আর বলা বাহুল্য, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। ফিকহের মূলনীতি রয়েছে,

السكوت في معرض البيان بيان.

বইয়ের অনন্যতা :

বইয়ে শুধু সালাফে সালেহিনের মানহাজ গ্রহণ করার গুরুত্ব ও উপকারিতাই তুলে ধরা হয়নি; বরং হালজামানার বিভিন্ন ফিতনার স্বরূপও উন্মোচন করা হয়েছে। যারা গোমরাহির প্রচারক, যারা উম্মাহকে ইসলামের মৌলিক কাঠামো থেকে বিচ্যুত করতে চায়, তাদের পথে সবচে বড় কাঁটা হলো ফাহমুস সালাফ। এ কারণে তারা বিভিন্ন সংশয় ছড়িয়ে উম্মাহকে প্রথমে ফাহমুস সালাফ থেকে সরাতে চায়। এরপর তাদেরকে দলছুট ছাগলে পরিণত করে নেকড়ের মতো ঘাড় কামড়ে দেয়। তবে নেকড়ে তো জীবন নষ্ট করে আর তারা নষ্ট করে ইমান, যা পৃথিবীর সবকিছুর চাইতেই অধিক মূল্যবান। সালাফের মানহাজ গ্রহণে যেসব সংশয় প্রচার করা হয়, তার কয়েকটি নিম্নরূপ :

১. সালাফরাও মানুষ। আর মানুষমাত্রই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সুতরাং মানুষ হয়ে মানুষের অনুসরণ করার কোনো যুক্তি নেই।

২. সালাফের মধ্যেও অসংখ্য মতবিরোধ হয়েছে। তাদেরও অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে। সুতরাং আমরা কীভাবে তাদের কথা মানতে পারি?

৩. ইজতিহাদের (বিধান উদ্ঘাটন) দুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে। আমরা উম্মাহকে স্থবিরতা ও অন্ধ অনুকরণের দিকে ঠেলে দিতে পারি না।

৪. কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে রিসার্চ করতে হবে। সালাফের বুঝ নিয়ে পড়ে থাকলে আমাদের সামনে নিত্যনতুন গবেষণা ও রহস্যের দুয়ার খুলবে না। সুতরাং এটা উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্তরায়।

৫. আল্লাহ মানুষকে বিবেকবুদ্ধি দিয়েছেন। একে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। মৃত মানুষদের কাছ থেকে কেন জীবিতদের সমাধান নিতে হবে?

৬. আমাদেরকে সৃজনশীল হতে হবে। চর্বিতচর্বণ জিনিস পরিহার করে নতুনত্বের পথে হাঁটতে হবে। তাহলেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পৃথিবীর উন্নতি ও উত্‌কর্ষের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাবে।

৭. ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রামাণ্যতা সুনিশ্চিত নয়। তা সংশয়-সন্দেহ থেকেও মুক্ত নয়। সুতরাং ফাহমুস সালাফকে সমালোচনার দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। একমাত্র কুরআন-সুন্নাহকেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।

৮. যুগ পাল্টেছে। মানুষের আচার-সভ্যতায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং যুগের সঙ্গে সঙ্গে কুরআন-সুন্নাহর বুঝও যদি আপগ্রেড না হয়, তাহলে শরিয়াহর গতিশীলতা ও সর্বযুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা ব্যাহত হবে।

৯. সালাফের পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে নতুন করে কুরআন-সুন্নাহর নারীবাদী ব্যাখ্যা প্রস্তুত করতে হবে। এতেই কেবল নারীজাতির অধিকার রক্ষা হবে।

১০. ইসলামে পোপতন্ত্র নেই। ইসলাম সবার জন্য। কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রজন্ম কিংবা নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতির ওপর একে নির্ভরশীল বানানো যাবে না। ইসলামকে কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে দেওয়া হবে।

১১. মাকাসিদে শরিয়াহর আলোকে সালাফের সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। ইসলাম এসেছে কেবল দীন, প্রাণ, সম্ভ্রম, বিবেকবুদ্ধি ও সম্পদ হেফাজতের জন্য। সুতরাং মানুষের কল্যাণচিন্তাকে অগ্রে রাখতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে পূর্ববর্তীদের বুঝ উপেক্ষা করে ইসলামি বিধিবিধান নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যুগের আলোকে পূর্ব থেকে চলে আসা কাঠামোকে সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে।  

১২. ফাহমুস সালাফ গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের কারও বিচ্ছিন্ন মত অনুসরণ করতেই বা দোষ কোথায়! সুতরাং বিচ্ছিন্ন কোনো মত অনুসরণ করে যদি ইসলামকে যুগোপযোগী ও প্রবৃত্তির অনুকূল করা যায়, এতেই বা দোষ কী!

১৩. হাদিসে প্রতি শতাব্দীতে ইসলামের তাজদিদের (সংস্কার) কথা এসেছে। সুতরাং ইসলামের সংস্কারকে গতিশীল রাখতে হবে। স্থবিরতা ছাড়তে হবে।

১৪. বর্তমানে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ উত্‌কর্ষ হয়েছে, যা পূর্বেকার শতাব্দীগুলোতে ছিল না। এ কারণে আমাদেরকে বিজ্ঞানের আলোকে ইসলাম নিয়ে ভাবতে হবে। অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা আঁকড়ে ধরে রাখলে চলবে না।

উপরের ১৪টা সংশয়ের অনেকগুলোই কাছাকাছি। কলেবর সংক্ষিপ্ত করতে চাইলে মৌলিক সংশয় অর্ধেকে নামিয়ে আনা যাবে। এগুলোর নিরসনে যেসব আলোচনা এসেছে, তাতেও কিছু পুনরাবৃত্তি ও পুনরুক্তি ঘটেছে। তবে যারা গভীর মনোযোগের সাথে বই পড়ে না অথবা কিছুটা গভীরে ঢুকে চিন্তাফিকির করে না, তাদের জন্য এভাবে ভেঙে ভেঙে বললে উপকার হয়। লেখক হয়তো এই শ্রেণির পাঠকের কথা বিবেচনা করেই ১৬০ পৃষ্ঠার বইয়ে ৮১ পৃষ্ঠা (পৃ. ৭৩-১৫৪) জুড়েই এসব আপত্তির অপনোদন করেছেন।

লেখক তার নিজের জায়গা থেকে আলোচনাগুলোকে সহজ ও সাবলীল করে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে আমার মূল্যায়ন হলো, সম্পাদকদ্বয় আরেকটু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে বইটা আরও খানিকটা সহজ ও সাবলীল করা যেত। বিশেষ করে কিছু জায়গা এমন রয়ে গেছে, যেখানে আরবি শব্দ ও ইলমি পরিভাষার অর্থ দেওয়া হয়নি। অধিকাংশ জায়গায় টীকায় বা বন্ধনীর ভেতর অর্থ দেওয়া হলেও কিছু জায়গায় অসতর্কভাবে বাদ পড়ে গেছে। এজাতীয় বই প্রকাশের আগে শুধু আলিমরাই যদি সম্পাদনা ও নিরীক্ষণ করেন, তাহলে এ সমস্যাটা থাকবেই। কারণ, অনেক বিষয় এমন আছে, যেটা আলিমদের কাছে পানির মতো সহজ; কিন্তু সাধারণ পাঠককে তা বুঝতে গলদঘর্ম হতে হয়। এ কারণে এজাতীয় বই প্রকাশের পূর্বে জেনারেল অঙ্গন থেকে একাধিক সচেতন পাঠককে খসড়া কপি পড়িয়ে তাদের মতামত ও মূল্যায়ন নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। আমার একাধিক বইয়ে এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ভালো ফল পেয়েছি। তাদের পরামর্শের আলোকে অনেক কঠিন বিষয়কে তুলনামূলক সহজ করে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। এ বইটা আলহামদুলিল্লাহ আলিমদের জন্য কঠিন হবে না; কিন্তু জেনারেল ভাইদের জন্য আরও খানিকটা সহজ ও সাবলীল করা গেলে ফায়দা ব্যাপক হবে ইনশাআল্লাহ।

পরিশেষে একটা অনধিকারচর্চা করি। এ বইয়ের উত্‌সগ্রন্থের নাম ‘ফাহমুস সালাফ’ হলেও তা আরবি ভাষাভাষীদের নিকট সহজেই বোধগম্য; কিন্তু বাঙালি পাঠকদের নিকট এ ধরনের নাম সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। যার কারণে এর নাম ‘মানহাজুস সালাফ’, ‘সালাফের পথ’ বা এ ধরনের সহজবোধ্য অন্য কোনো নাম দিলে সম্ভবত ভালো হতো। যারা অনলাইনে ঘুরে ঘুরে বই অর্ডার করে, তাদের জন্যও নাম দেখে বিষয়বস্তু ধারণা করে বই অর্ডার করা সহজ হতো।

  • সমালোচনা

‘সমালোচনা’ অংশে আমরা কয়েকটা বিষয় নিয়ে সমালোচনা করবে। যার কিছু বিষয় তথ্যগত, কিছু ভাষাগত এবং কিছু মুদ্রণগত। আলোচনা করতে গিয়ে এর বাইরেও কোনো বিষয় আসলে আসতে পারে। তবে বইটির মূল কাঠামো নিয়ে সমালোচনা করার কিছু নেই। এখানে যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করা হবে, তা নিরেট প্রাসঙ্গিক ও শাখাগত বিষয়। যার কারণে এতে বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো সংশয় তৈরি হবে না। শুধু কিছু বিষয়ে সংশোধনী আনার অনুরোধ করা হবে; যাতে করে চাঁদের গায়ে আর দাগ না থাকে।

তথ্যগত সমালোচনা :

১. প্রথম তিন প্রজন্মের জমানাতেও ভ্রান্ত চিন্তার লোক ছিল। যেমন… ১০৫ হিজরিতে গাইলান আদ দিমাশকির হাতে ইরজার ফিতনা… এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। (টীকায় এসেছে,) ইরজায়ি চিন্তাধারা বলতে বোঝানো হয়, কেউ মুখে মুসলিম দাবি করার পর কোনো কর্ম বা বিশ্বাস তার ঈমানকে নাকচ করে না বলে ধারণা রাখা। এই চিন্তাধারার অধিকারী দলটি মুরজিয়া নামে পরিচিত। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ঐকমত্যে, এটি একটি ভ্রান্ত দল। {পৃ. ২৮}

সমালোচনা (ক) : এখানে ইরজা ও মুরজিয়ার যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, এর কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। ইতিহাসে যে মুরজিয়া ফেরকা আমরা দেখতে পাই এবং যাদের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে উক্ত সংজ্ঞার ভিন্নতা রয়েছে। মুরজিয়াদের অনেক উপদল রয়েছে; কিন্তু তাদের সবার সাথে আহলুস সুন্নাহর মূল বিরোধ ইমানের পরিচয়ে। যেমন, কাররামিয়ারা বলে, ইমান শুধু স্বীকারোক্তির নাম। জাহমিয়ারা বলে, ইমান শুধু পরিচয় লাভের নাম। এই উভয় গোষ্ঠী মুরজিয়াতুল মুতাকাল্লিমিন। অপরদিকে মুরজিয়াতুল ফুকাহা যাদের বলা হয়ে থাকে তারা বলে, ইমান অন্তরের সত্যায়ন ও মুখের স্বীকারোক্তির নাম। এছাড়াও গাইলান দিমাশকির দিকে সম্বন্ধ করে গাইলানিয়া, বিশর মুরাইসরি দিকে সম্বন্ধ করে মুরাইসিয়া ইত্যাদি নামেও তাদের উপদল রয়েছে।

এটা ঠিক, মুরজিয়া ফেরকার উদ্ভব হয়েছিল খারেজিদের অবাধ তাকফিরের বিপরীতে। একদল যেখানে সাধারণ বিষয়ের কারণেও তাকফির করে বসত, অপরদলের অভিধানে সেখানে তাকফিরই খুঁজে পাওয়া যেত না। তারা আমলকে ইমান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করার কারণে কবিরা গুনাহের কারণে ইমানের কোনো ক্ষতি হয় না—এমন মতই পোষণ করত। তবে কোনো বিশ্বাসও ইমান ভঙের কারণ হয় না, বিষয়টা সম্ভবত এরূপ ছিল না। তাদের মধ্যে যারা অন্তরের সত্যায়ন বা পরিচয় লাভকে ইমানের সংজ্ঞা বলে অভিহিত করেছে, তারা অবশ্যই এ দুই বৈশিষ্ট্য না পেলে কুফরের হুকুম আরোপ করবে। যেমন, একজন ব্যক্তি একসময় অন্তরে সত্যায়ন রাখত; কিন্তু এখন সে সুস্পষ্টভাবে অন্তরের সত্যায়ন ত্যাগ করেছে, তাকেও কি তারা মুমিন বলবে? যদি বিষয়টা এমনই হয়ে থাকে, তাহলে তারা তো ইবলিসকেও মুমিনই বলত। কারণ, ইবলিসের অন্তরে যে নিখাদ সত্যায়ন ছিল, তা তো অকাট্যভাবেই প্রমাণিত। সুতরাং মুরজিয়াদের নিকট ইমান ভঙ্গকারী কোনো বিশ্বাস নেই—আমার ধারণা, এ মন্তব্যটা ধারণাপ্রসূত অথবা ভুল। এমনকি কর্মকে তারা সরাসরি ইমান ভঙ্গকারী না মানলেও তাদের গোঁড়া ইমামরাও এটা মানে যে, অনেক কর্ম কুফরের নিদর্শন বহন করে। অর্থাৎ, এসব কর্মের অস্তিত্ব এই প্রমাণ বহন করে যে, ব্যক্তির ভেতরে রবের প্রতি সত্যায়ন নেই। এ কারণেই তারা ইবলিসকে কাফির বলে। কারণ, ইবলিসের কুফর তো কর্মগতই ছিল। তার কর্ম সুনিশ্চিতভাবে এ প্রমাণ বহন করেছিল যে, তার ভেতরে রবের প্রতি এবং তার শরিয়াহর প্রতি নিরঙ্কুশ সত্যায়ন নেই। বিশর আল-মুরাইসির বক্তব্য রয়েছে,

إن السجود للشمس والقمر ليس بكفر، وإنما هو علامة للكفر

সূর্য ও চাঁদকে সিজদা করা সরাসরি কুফর নয়; তবে নিশ্চয়ই তা কুফরের নিদর্শন। (অর্থাৎ, আসল কুফর অন্তরে থাকে। আর অন্তর যেহেতু চিড়ে দেখা যায় না, তাই এর বাহ্যিক কিছু নিদর্শনও রয়েছে। গাইরুল্লাহকে সিজদা করা হলো এমন একটি নিদর্শন।)

সমালোচনা (খ) : ১০৫ হিজরিতে গাইলান দিমাশকির হাতে ইরজার ফিতনা প্রতিষ্ঠিত হয়—এ দাবির পক্ষেও কোনো রেফারেন্স দেয়া হয়নি। মুরজিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা কে, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হিজরি প্রথম শতকের শেষের দিকে দুটো মুরজিয়া বললে দুই ফেরকার কথা বোঝাত। ইমাম সুফয়ান ইবনু উয়ায়না রাহ. বলেন,

الْإِرْجَاءُ عَلَى وَجْهَيْنِ: قَوْمٌ أَرْجَوْا أَمْرَ عَلِيٍّ وَعُثْمَانَ ، فَقَدْ مَضَى أُولَئِكَ ، فَأَمَّا الْمُرْجِئَةُ الْيَوْمَ فَهُمْ قَوْمٌ يَقُولُونَ: الْإِيمَانُ قَوْلٌ بِلَا عَمِلٍ

ইরজার দুটো প্রকার রয়েছে : (১) যারা আলি ও উসমান রা.-এর ইমামাতকে বিলম্বিত করেছিল। এই সম্প্রদায় বিগত হয়ে গেছে। বর্তমানে মুরজিয়া হলো তারা, যারা বলে, ইমান হলো আমল ছাড়া শুধু কথার না। [তাহযিবুল আসার : ২/৬৫৯]

ইমাম তাবারি রাহ.-ও একই কথা বলেন,

وَالصَّوَابُ مِنَ الْقَوْلِ فِي الْمَعْنَى الَّذِي مِنْ أَجْلِهِ سُمِّيَتِ الْمُرْجِئَةُ مُرْجِئَةً أَنْ يُقَالَ: إِنَّ الْإِرْجَاءَ مَعْنَاهُ مَا بَيَّنَّا قَبْلُ مِنْ تَأْخِيرِ الشَّيْءِ ، فَمُؤَخِّرُ أَمْرَ عَلِيٍّ وَعُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا إِلَى رَبِّهِمَا، وَتَارِكُ وَلَايَتهُمَا وَالْبَرَاءَةُ مِنْهُمَا، مُرْجِئًا أَمْرَهُمَا، فَهُوَ مُرْجِئٌ.

وَمُؤَخِّرُ الْعَمَلَ وَالطَّاعَةَ عَنِ الْإِيمَانِ مُرْجِئُهُمَا عَنْهُ ، فَهُوَ مُرْجِئٌ، غَيْرَ أَنَّ الْأَغْلَبَ مِنَ اسْتِعْمَالِ أَهْلِ الْمَعْرِفَةِ بِمَذَاهِبَ الْمُتَخَلِّفِينَ فِي الدِّيَانَاتِ فِي دَهْرِنَا هَذَا، هَذَا الِاسْمَ فِيمَنْ كَانَ مِنْ قَوْلِهِ : الْإِيمَانُ قَوْلٌ بِلَا عَمَلٍ ، وَفِيمَنْ كَانَ مِنْ مَذْهَبِهِ أَنَّ الشَّرَائِعَ لَيْسَتْ مِنَ الْإِيمَانِ ، وَأَنَّ الْإِيمَانَ إِنَّمَا هُوَ التَّصْدِيقُ بِالْقَوْلِ دُونَ الْعَمَلِ الْمُصَدِّقِ بِوُجُوبِهِ

মুরজিয়াকে যে কারণে মুরজিয়া বলা হয়, এর সঠিক ব্যাখ্যা হলো, ইরজা অর্থ হচ্ছে কোনো বিষয়কে বিলম্বিত করা। যারা আলি ও উসমান রা.-এর ইমামতকে বিলম্বিত করে তাদের রবের দিকে ন্যাস্ত করেছে, তাদের আনুগত্য পরিহার করেছে এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তারা মুরজিয়া। কারণ, তারা তাদের উভয়ের বিষয়কে বিলম্বিত করেছে।

আর যারা আমল ও আনুগত্যকে ইমান থেকে বিলম্বিত করে, তারাও এক্ষেত্রে মুরজিয়া। তবে আমাদের সময়ে যারা দীনের বিভিন্ন ফেরকার জ্ঞান রাখেন—সে সমস্ত ব্যক্তিত্বের ব্যবহারে এই নামটা তাদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয় যারা বলে, ইমান হলো আমল ছাড়া শুধু কথার নাম এবং যাদের মত হলো, শরিয়াহ ইমানের অংশ নয়; ইমান হলো শুধু কথার দ্বারা অন্তরের সত্যায়ন প্রকাশ করা, আমল করা নয়—যা কিনা ইমানের আবশ্যিক অস্তিত্বেরই সত্যায়ন করে। [প্রাগুক্ত ­ ২/৬৬১]

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সাহাবিযুগ সমাপ্ত হওয়ার আগেই ইরজার ফিতনার প্রাদুর্ভাব ঘটে। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহ. বলেন,

ثُمَّ فِي أَوَاخِرِ عَصْرِ الصَّحَابَةِ حَدَثَتْ الْقَدَرِيَّةُ فِي آخِرِ عَصْرِ ابْنِ عُمَرَ وَابْنِ عَبَّاسٍ؛ وَجَابِرٍ؛ وَأَمْثَالِهِمْ مِنْ الصَّحَابَةِ ، وَحَدَثَتْ الْمُرْجِئَةُ قَرِيبًا مِنْ ذَلِكَ

সাহাবিযুগের শেষের দিকে ইবনু উমর, ইবনু আব্বাস, জাবির রা. প্রমুখ সাহাবিদের সময়কালে কাদারিয়া ফেরকার উদ্ভব হয়। এর কাছাকাছি সময়ই মুরজিয়াদের প্রাদুর্ভাব ঘটে। [মাজমুউল ফাতাওয়া : ২/৩০১]

কাতাদা রাহ. বলেন,

إِنَّمَا أُحْدِثَ الْإِرْجَاءُ بَعْدَ هَزِيمَةِ ابْنِ الْأَشْعَث

ইরজার উদ্ভব হয় ইবনুল আশআসের ব্যর্থতার পরে। [আস-সুন্নাহ, আবদুল্লাহ বিন আহমদ : ১/৩১৯]

উল্লেখ্য, ইবনুল আশআসের ঘটনা ছিল ৮১-৮৩ হিজরির মাঝামাঝি সময়ে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এর পরপরই মুরজিয়াদের প্রকাশ ঘটে।

কিন্তু কার হাত ধরে ইরজার ফিতনার সূচনা হয়? এ নিয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। যেমন, ইমাম আহমদ রাহ.-এর বক্তব্য রয়েছে, সর্বপ্রথম ইরজার ফিতনার সূচনা করেছে তাবেয়ি যার ইবনু আবদিল্লাহ হামদানি। [আস-সুন্নাহ : ৮১; মাসায়িলুল ইমাম আহমাদ : ২/১৬২] ইমাম যাহাবি রাহ. ‘মিযানুল ইতিদাল’ গ্রন্থেও ইমাম আহমদের সংক্রান্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। এছাড়াও সালামা বিন কুহাইল, ইবরাহিম নাখয়ি এবং সাঈদ ইবনু জুবায়র থেকেও তার ইরজার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়। হিজরি প্রথম শতক সমাপ্ত হওয়ার আগেই (৯০ হিজরির আগেই) তার মৃত্যু হয়ে যায়।

বাতিল ফেরকা চেনার জন্য ইমাম আবুল হাসান আশআরি রাহ. প্রণীত ‘মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন’ গ্রন্থটি গবেষক আলিমগণের মধ্যে বিশেষভাবে বরিত ও সমাদৃত। এতে মুরজিয়া ফেরকার সপ্তম উপদল হিসাবে গাইলান দিমাশকির গাইলানিয়া উপদলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারণে তাকে মুরজিয়া ফেরকার উদ্ভাবক ও প্রতিষ্ঠাতা মানতে খানিকটা খটকা লাগছে। আশা করছি, লেখক ও সম্পাদকদ্বয় বিষয়টা নিয়ে আরেকটু ভাববেন।

সমালোচনা (গ) : বইয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনা হিসাবে সংক্ষেপে ইরজা ও মুরজিয়ার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, সংক্ষেপনের সাথেই তাদের উদ্ভবের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপরও যদি দুই-চার বাক্যে সামান্য আলোকপাত করা হতো, তাহলে আরও ভালো হতো। কারণ, শুধু ইলমি ইখতিলাফকে কেন্দ্র করেই মুরজিয়া ফিতনার বিকাশ ঘটেনি; বরং এর পেছনে ছিল গভীর রাজনৈতিক স্বার্থ। ইরজার দুটো ধারা ছিল। একটা সরকারি ধারা, যেটাকে ‘উমাইয়া ইরজা’ বলা হয়। আরেকটা ছিল বিপ্লবী ধারা, যারা উমাইয়া শাসকদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিল। সরকারপন্থি ধারা তাকফিরের বিরোধী ছিল, সরকারের নিরঙ্কুশ আনুগত্যের প্রবক্তা ছিল, ইসলামের শুরাব্যবস্থাকে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিণত করাকে বৈধতা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিল। এ প্রকার ইরজা ছিল শাসকগোষ্ঠী ও তাদের পক্ষাবলম্বীদের মাজহাব। এদের অবস্থাটা ছিল বর্তমান সময়ের মাদখালি আহলে হাদিসদের মতো।

ইমাম ইবনু কাসির রাহ. নাজর ইবনু শুমায়ল রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করেন,

سألني المأمون: ما الإرجاء؟ فقلت: “دين يوافق الملوك، يصيبون به من دنياهم، وينقصون به من دينهم”

খলিফা মামুন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ইরজা কী? আমি বললাম, রাজা-বাদশাহর অনুকূল ধর্ম—যা দ্বারা আলিমরা শাসকদের দুনিয়া থেকে কিছু অংশ লাভ করে আর শাসকরা এর বিনিময়ে আলিমদের দীন কেড়ে নেয়। [আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ১৪/২২১]

সহিহ বুখারির একজন বর্ণনাকারী রাকাবাহ ইবনু মাছকালাহ রাহ. বলেন,

وأما المرجئة فعلى دين الملوك!

মুরজিয়ারা থাকে শাসকদের ধর্মের ওপর। [আল-ইবানাতুস সুগরা, ইবনু বাত্তাহ : ১৬৩]

মুরজিয়ারা ইমান থেকে আমলকে আলাদা করার একটা কারণ শাসকদের মনোতুষ্টিও ছিল। অধিকাংশ শাসক দিনরাত আল্লাহর অবাধ্যতায় ডুবে থাকার পরও তারা তাদেরকে প্রকৃত ইমানদার বলে সত্যায়ন করত। আবদুর রহমান ইবনু ইয়াজিদ রাহ. বর্ণনা করেন,

لما توفي عمر بن عبد العزيز، قال يزيد بن عبد الملك: سيروا بسيرته، فأتي بأربعين شيخًا شهدوا أن الخلفاء ليس عليهم حساب ولا عقاب.

যখন উমর ইবনু আবদুল আজিজ রাহ. মৃত্যুবরণ করলেন তখন ইয়াজিদ ইবনু আবদুল মালিক বললেন, তোমরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথ চলো। তখন তার নিকট ৪০ জন শায়খকে উপস্থিত করা হলো, যারা সকলে সাক্ষ্য দিয়েছে, খলিফাগণের ওপর কোনো হিসাব-কিতাব বা আজাব-গজব নেই। [সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবি : ৫/৬০২]

ইমাম ইবনু তাইমিয়া রাহ.-এর বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেন,

المرجئة وأمثالهم ممن يسلك مسلك طاعة الأمراء مطلقاً وإن لم يكونوا أبراراً

মুরজিয়া এবং তাদের মতো যারা আছে, তারা নিরঙ্কুশভাবে শাসকদের আনুগত্যের পথে হাঁটে, যদিও শাসকরা নেককার না হয়। [মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৮/৫০৮]

তিনি তাদের ভ্রান্ত ধারণা স্পষ্ট করতে গিয়ে আরও বলেন,

أن الإمام تجب طاعته في كل شيء، وأن الله إذا استخلف إماما تقبل منه الحسنات وتجاوز له عن السيئات.. ولهذا سأل الوليد بن عبد الملك عن ذلك بعض العلماء، فقالوا له: يا أمير المؤمنين، أنت أكرم على الله أم داود، وقد قال له: “يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ” ( سورة ص: 26 ).. وغلط من غلط منهم من جهتين: من جهة أنهم كانوا يطيعون الولاة طاعة مطلقة، ويقولون إن الله أمرنا بطاعتهم، الثانية: قول من قال منهم: إن الله إذا استخلف خليفة تقبل منه الحسنات وتجاوز له عن السيئات”.

তারা বিশ্বাস করে, সব ব্যাপারেই শাসকের আনুগত্য করা আবশ্যক। আল্লাহ যখন কাউকে শাসক বানান, তখন তার সৎকর্মগুলোই গৃহীত হয় আর কুকর্মগুলো মার্জনা করা হয়।… এ কারণেই ওয়ালিদ ইবনু আবদুল মালিক যখন এ ব্যাপারে জনৈক আলিমকে প্রশ্ন করলেন, তিনি জবাবে বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন, আল্লাহর নিকট আপনি সম্মানিত নাকি নবি দাউদ আ.? অথচ আল্লাহ তাঁকে বলেছেন, হে দাউদ, আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলিফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে হকের সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করো। প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না; অন্যথায় প্রবৃত্তি তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিপথে যায়, তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আজাব; যেহেতু তারা হিসাবের দিনকে ভুলে গিয়েছিল। (সুরা ছোয়াদ : ২৬)… তাদের ভুলের উৎস দুটো ­: (ক) তারা ক্ষমতাধরদের নিঃশর্ত আনুগত্য করে এবং বলে, আল্লাহ আমাদেরকে তাদের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। (খ) তারা বলে, আল্লাহ যখন কাউকে শাসক বানান, তখন তার সৎকর্মগুলোই গৃহীত হয় আর কুকর্মগুলো মার্জনা করা হয়। [মিনহাজুস সুন্নাহ : ৬/২০০]

তিনি আরও বলেন,

كثير من أتباع بني أمية -أو أكثرهم- كانوا يعتقدون أنّ الإمام لا حساب عليه ولا عذاب، وأن الله لا يؤاخذهم على ما يطيعون فيه الإمام، بل تجب عليهم طاعة الإمام في كل شيء، والله أمرهم بذلك. وكلامهم في ذلك معروف كثير. وقد أراد يزيد بن عبد الملك أن يسير بسيرة عمر بن عبد العزيز، فجاء إليه جماعة من شيوخهم، فحلفوا له بالله الذي لا إله إلا هو، أنه إذا ولّى الله على الناس إماما تقبل الله منه الحسنات وتجاوز عنه السيئات، ولهذا تجد في كلام كثير من كبارهم الأمر بطاعة وليّ الأمر مطلقاً، وأنّ من أطاعه فقد أطاع الله. ولهذا كان يضرب بهم المثل، يقال: “طاعةٌ شاميّة”. وحينئذ فهؤلاء يقولون: إنّ إمامهم لا يأمرهم إلا بما أمرهم الله به

বনু উমাইয়ার অনেক সাপোর্টার বিশ্বাস করত, শাসকের কোনো হিসাব নেই, কোনো আজাব নেই। তারা শাসকের আনুগত্য করতে গিয়ে যা কিছু করে, এর কারণে আল্লাহ তাদের পাকড়াও করবেন না। বরং সর্ববিষয়ে তাদের ওপর অপরিহার্য হলো শাসকের আনুগত্য করা। স্বয়ং আল্লাহ তাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য বেশ প্রসিদ্ধ। ইয়াজিদ বিন আবদুল মালিক চেয়েছিলেন উমর ইবনু আবদুল আজিজ রাহ.-এর আদর্শের ওপর চলবেন। তখন তার নিকট একদল মুরজিয়া শায়খ এসে শপথ করে বলল, ওই সত্তার শপথ যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তিনি যখন মানুষের ওপর কাউকে শাসক নিযুক্ত করেন, তখন তিনি কেবল তার থেকে সৎকর্মগুলোই গ্রহণ করেন আর অসৎকর্মগুলো মার্জনা করেন। এ কারণে আপনি তাদের অনেক বড় ব্যক্তিত্বদের আলোচনায় দেখবেন, তারা শাসকের নিরঙ্কুশ আনুগত্যের কথা বলে। এ-ও বলে, যে শাসকের আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহর আনুগত্য করল। এ কারণে লোকজন তাদের নাম নিয়ে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে বলে, ‘শামের আনুগত্য’। তারা বলে, শাসক তাদেরকে সেসব আদেশই করে, যে আদেশ তাদেরকে করেছেন আল্লাহ। [প্রাগুক্ত : ৬/৪৩০-৪৩১]

আর সরকারবিরোধী ধারার বক্তব্য ছিল, রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে শুরাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমান সরকার ও বাহিনীপ্রধানদের বরখাস্ত করতে হবে। শাসক-প্রশাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণকেও শরিক রাখতে হবে। উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা এ ধারার নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে জাহম ইবনু সাফওয়ানের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য—যাকে ইলমুল কালামের অন্যতম জনক হিসাবে গণ্য করা হয়। মুরজিয়াদের এই ধারাকে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের শত্রু মনে করত। এ কারণে বইয়ে যে গাইলান দিমাশকিকে মুরজিয়া ফিতনার জনক বলা হয়েছে, ক্ষমতায় বসার পর উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আবদুল মালিক তার দুই হাত ও দুই পা কেটে কিছুদিন পর দামেশকের একটি ফটকে শূলে চড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। [তারিখু দিমাশক, ইবনু আসাকির : ৪৮/১৮৬-২১২]

মোদ্দাকথা, বক্ষ্যমাণ বইয়ে ইরজা ও মুরজিয়া-সংক্রান্ত পুরো আলোচনাটা আবার নতুনভাবে সাজালে ইনশাআল্লাহ ভালো হবে। যদিও এটা বইয়ের মূল আলোচ্য নয়; কিন্তু এর উপকারিতাও কোনো অংশে কম হবে না। অনেক সময় প্রাসঙ্গিক কিছু কথার গুরুত্ব মূল কথাকেও ছাপিয়ে যায়। মুনাসিব মনে করলে লেখক ও সম্পাদকদ্বয় এ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে পারেন।

আমাদের হাতে পয়েন্ট রয়েছে অনেকগুলো। তবে লেখা বেশি বড় হয়ে গেলে অনেকে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ কারণে দ্বিতীয় পর্বটাকে একসঙ্গে পোস্ট না করে ধারাবাহিকভাবে কয়েক ধাপে পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ।

২.

“যে হাদিসের বর্ণনা মুতাওয়াতিরের শর্তে উন্নীত নয়, সেগুলো খবরে ওয়াহেদ। মুতাওয়াতির হাদিস কতইয়্যাত বা দৃঢ়তার ফায়দা দেয়। আর খবরে ওয়াহেদ জন্নিয়্যাত তথা প্রবল বিশ্বাসের ফায়দা দেয়। তবে শরিয়তের বিধান দুই প্রকার হাদিস থেকেই প্রমাণিত ও আবশ্যক হয়।” [পৃ. ৮৫]

“ইসলামি বিধানসমূহের দুটি স্তর আছে। একটি স্তর হলো, তাওয়াতুর সূত্রে প্রমাণিত আহকাম, যেগুলোকে কতইয়্যাত (তথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত) বলে। আরেকটি স্তর হলো, জন্নিসূত্রে প্রমাণিত আহকাম, যাকে জন্নিয়্যাত বলা হয়। আমলের দিক থেকে উভয় প্রকার বিধানই এক। বিশ্বাসের দিক থেকে সামান্য পার্থক্য আছে। একটা দৃঢ় বিশ্বাস, আরেকটা প্রবল বিশ্বাস। উভয় প্রকার বিধানই শরয়ি নস দ্বারা প্রমাণিত। এখানে সন্দেহ কিংবা ইজতিহাদের সুযোগ নেই। কতইয়্যাতের মতো জন্নিয়্যাতও প্রতিষ্ঠিত শরয়ি বিধান, যা মানা ও অনুসরণ করা আবশ্যক।” [প্রাগুক্ত]

“ইসলামি শরিয়াহর অধিকাংশ বিধান খবরে ওয়াহিদ সূত্রে প্রমাণিত।” [পৃ. ৮৬] “ফিকহ হলো ইসলামি শরিয়াহর বিধানের সমষ্টির নাম। যার মাঝে অধিকাংশই হলো আল্লাহর ওহি। এগুলো জিবরাইল আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কাছে নিয়ে এসেছেন কুরআন ও সুন্নাহ আকারে। এখানে কোনো মানুষের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। এগুলোকে প্রত্যাখ্যান, পরিবর্তন কিংবা সংস্কার করার অধিকারও কারও নেই।” [পৃ. ১১৩]

সমালোচনা (ক) : কোনো হাদিস মুতাওয়াতির না হলেই কি সেটা খবরে ওয়াহিদ হয়ে যায়? এ দুয়ের মধ্যে মাশহুর নামক আলাদা প্রকার রয়েছে। মুতাওয়াতির হাদিস তো খুবই কম। মাশহুর হাদিস কিছু পাওয়া যায়। কেউ কেউ এটাকে আলাদা প্রকার হিসাবে দেখেন না। তবে এতে বিভিন্ন আপত্তির অবকাশ থাকে। তাই মাশহুরকে আলাদা প্রকার হিসাবে বিবেচনা করাই নিরাপদ।

(খ) দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রবল বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য কী? দুটোর আরবি প্রতিশব্দই তো ‘কাতয়ি’, ‘ইয়াকিনি’, ‘জরুরি’। আরবি ‘জন্নি’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ প্রবল ধারণা বললে সেটা যুক্তিযুক্ত। ধারণা ও বিশ্বাস তো এক নয়। সাধারণ ধারণাকে আরবিতে ‘জন’ বলে না। কিন্তু ধারণা যখন প্রবল হয়, তখন সেটাকে ‘জন’ বলা হয়। আমার ধারণা, এখানে প্রবল বিশ্বাস কথাটা অসতর্কভাবে চলে এসেছে।

(গ) ফিকহ ও শরিয়াহর পার্থক্য কী? আমরা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর শরিয়াহ মানি; চার ইমামের ফিকহ অনুসরণ করি। যদি ফিকহ ও শরিয়াহকে সমার্থক বলা হয় অথবা ইসলামি শরিয়াহর বিধানসমষ্টিকে ফিকহ নামে অভিহিত করা হয়, তাহলে সেটাকেও অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন বলা অবধারিত হয়ে যায়। কারণ, শরিয়াহ পূর্ণাঙ্গ, কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য অপরিবর্তনযোগ্য। শরিয়াহ নিয়ে ভিন্নমত পোষণেরও সুযোগ নেই। কিন্তু ফিকহের বিষয়টি কি এমন? শরিয়াহর দলিল চতুষ্টয় থেকে উদ্ঘাটিত শাখাগত বিধানসমূহকে সাধারণত ফিকহ বলা হয়। চার মাজহাবের অনুসারীদের নিকটই ফিকহের এ সংজ্ঞা গৃহীত ও আদৃত। এ কারণে ফিকহশাস্ত্রকে জন্নি বলা হয়। প্রসঙ্গক্রমে শরিয়াহর দু-চারটা অকাট্য বিধানও ফিকহের গ্রন্থাদিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সাধারণভাবে এর আলোচ্য হলো শাখাগত মাসআলাসমূহ। শরিয়াহর বিধান সব তো শাখাগত নয়; মৌলিকও রয়েছে। এ বিবেচনায় দেখলে আকিদাকেও ফিকহ বলতে হবে। এক যুগে অবশ্য ফিকহে আকবার বলতে আকিদা বোঝানোও হতো। কিন্তু এখন এটা একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্রের নাম হিসাবে পরিচিত হয়ে গেছে। এ কারণে ফিকহ ও শরিয়াহকে সমার্থক বিবেচনা করলে বিভিন্ন আপত্তির অবকাশ থাকে। আজকাল তো অনেক আহলে হাদিস ভাই বলে বেড়ায়, আমরা ফিকহ মানি না। এখন ফিকহকে শরিয়াহর সমার্থক ধরলে তাদেরকে তো তাকফির করতে হবে। কারণ, কেউ শরিয়াহ না মানার ঘোষণা দিলে নিঃসন্দেহে সে কাফির।

সারকথা হলো, ফিকহ বলতে ইজতিহাদি বিষয় বোঝালে ভালো, যাতে গ্রহণযোগ্য দলিলসাপেক্ষে মতভিন্নতার সুযোগ থাকে। কারণ, প্রতিটা মাজহাবেরই দাবি হলো, আমার মাজহাব সঠিক, যা ভুলের সম্ভাবনা রাখে আর অন্যদের মাজহাব ভুল, যা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। এভাবে বলার তাৎপর্যই হলো ইজতিহাদকে ইজতিহাদের পর্যায়ে রাখা। প্রবল ধারণাভিত্তিক ফিকহকে সুনিশ্চিত, অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন শরিয়াহ পর্যায়ে না নেওয়া।

(ঘ) জন্নির বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। কোনোটা প্রামাণিকতার বিচারে জন্নি, কোনোটা অর্থ নির্দেশের বিচারে জন্নি, কোনোটা উভয় ক্ষেত্রে জন্নি। লেখকের বক্তব্যে এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। জানার বিষয় হলো, আমলের বিচারে কাতয়ি ও সব জন্নি কি এক? যদি পার্থক্য থাকে, তাহলে সেটা কী? উসুলি গ্রন্থ থেকে পাঠক নিশ্চয়ই এসব উসুলও শেখার চেষ্টা করবে। এ কারণে বিষয়টা আরও পরিষ্কারভাবে আলোচনা করলে সবার জন্য উপকারী ও সুবিধাজনক হবে।

৩.

“খারেজিদের মূল ভ্রান্তি হলো, তারা কবিরা গুনাহকারীকে কাফের মনে করে।” [পৃ. ২৯]

সমালোচনা : মূল ভ্রান্তি সেটাকেই বলা যায়, যেটা কোনো গোষ্ঠীর সব শাখা ও উপদলের মধ্যে কমন পাওয়া যায়। পুরোনো যুগের খারেজি, যারা হারুরিয়া নামেও পরিচিত ছিল, তাদের ক্ষেত্রে কবিরা গুনাহের কারণে তাকফিরের বিষয়টি অবশ্যই প্রযোজ্য। কিন্তু পরবর্তীতে খারেজিদের যত উপদল বেরিয়েছে, তাদের সবার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য কমন নয়। যেমন, বর্তমানে সিরিয়ার এক যোদ্ধা দলকেও ব্যাপকভাবে খারেজি বলা হচ্ছে। আমার ধারণা, লেখক ও সম্পাদকদ্বয়ও সেই গোষ্ঠীকে নব্য খারেজি বা খারেজিদের বৈশিষ্ট্যধারীই মনে করেন। কিন্তু এ প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না, সেই গোষ্ঠীটি কবিরা গুনাহ করলেই কাউকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে। খারেজিরা অবশ্যই ব্যাপক তাকফির করে। ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এছাড়াও আরও অনেক বিভ্রান্তি তাদের রয়েছে। এখন এতসব ভ্রান্তির মধ্যে মূল ভ্রান্তি হিসাবে সেটাকেই চিহ্নিত করা সংগত, যেটা নতুন ও পুরোনো সব দলের মধ্যে কমন পাওয়া যায়। যেমন, অনেক ইমাম ইমামের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করে মুসলমানদের জামাআত থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এবং নিজেদের ছাড়া অন্যদের তাকফির করাকে তাদের মূল ভ্রান্তি বলে উল্লেখ করেছেন। গত বছর দুয়েক আগে শায়খ মাকদিসির এ সংক্রান্ত একটা সুন্দর লেখাও চোখে পড়েছিল। সেখানেও তিনি গতানুগতিক এই কথাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

৪.

“রাফেজি শিয়াদেরই আরেক নাম। যারা হজরত আবু বকর ও উমর রা.-এর খেলাফতকে অস্বীকার করে এবং আম্মাজান আয়েশা রা.-সহ অধিকাংশ সাহাবিদের গালমন্দ করে ও কাফের বলে।” [প্রাগুক্ত]

সমালোচনা : আমার জানামতে শিয়াদের সব গোষ্ঠী রাফেজি নয়। তাদের সবাই অধিকাংশ সাহাবিকে গালমন্দ করে না, তাকফিরও করে না। এসব কারণে সব শিয়াকে একবাক্যে কাফির বলা হয় না; বরং তাদের অনেককে কাফির ও কতককে গোমরাহ বলা হয়। সুতরাং বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে, সব রাফেজি শিয়া; তবে সব শিয়া রাফেজি নয়। যেমন, যায়দি শিয়া যারা, তারা রাফেজি নয়। তারা আলি রা.-কে যদিও আবু বকর ও উমর রা.-এর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়, কিন্তু তারা তাদের গালমন্দ করে না। তাদের নিয়ে কটু কথাও বলে না।

৫.

“কাররামিয়া গোষ্ঠীকে মুশাব্বিহাও বলা হয়। এই দলের মূল ভ্রান্ত বিশ্বাস হলো, তারা আল্লাহর গুণাবলিকে মানুষের গুণাবলির সদৃশ বলে দাবি করে।” [পৃ. ৩০]

সমালোচনা : কাররামিয়া হলো মুতাজিলাদের একটি উপদল। তাদের মূল ভ্রান্তি সাদৃশ্যদান নয়; বরং আহলুস সুন্নাহর সাথে তাদের সবচে বড় বিরোধ ইমানের হাকিকত নিয়ে। কাররামিয়াদের মধ্যে শুধু তাশবিহই (সাদৃশ্যদান) নয়; বরং তাজসিমও (দেহ বা দৈহিক বৈশিষ্ট্য সাব্যস্তকরণ) পাওয়া যায়। তাদেরকে হাশাওয়িও বলা হয়। তবে মুশাব্বিহা শুধু নির্দিষ্টভাবে এদেরই বলা হয় না; বরং ইহুদি, প্রাচীন রাফেজি, সাবায়ি, হিশামি, ইউনুসি, বায়ানি, মুগিরি, মানসুরি ও খাত্তাবিসহ আরও অনেক দলকেই বলা হয়। অর্থাৎ, মুশাব্বিহাদের অনেকগুলো প্রকারের মধ্যে কাররামিয়াও একটা প্রকার। সুতরাং পরিচয়টা আরেকটু স্পষ্ট করলে যথোপযুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ।

৬.

“যানদাকা : যানদাকার কয়েকটি মর্ম আছে—(১) আল্লাহ ও আখিরাতে অবিশ্বাস করা। (২) ভেতরে কুফর গোপন রেখে বাহ্যিকভাবে ইমান প্রকাশ করা তথা নিফাককেও যানদাকা বলা হয়। আর এই ধরনের ব্যক্তিকে বলা হয় যিন্দিক।” [পৃ. ১৫৬]

সমালোচনা : যানদাকার সবচে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ মর্মটিই বাদ পড়ে গেছে। আর তা হলো, জরুরিয়্যাতে দীন তথা দীনের সর্বজনবিদিত কোনো বিষয়ের অপব্যাখ্যা করা। কুরআনের ভাষায় এর নাম ইলহাদ আর হাদিসের ভাষায় যানদাকা। ইলহাদ ও যানদাকা কুফরেরই একটি প্রকার।

ভাষাগত সমালোচনা

১.

বইয়ের ব্যাককাভারসহ অসংখ্য জায়গায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বোঝাতে ‘মুতাওয়ারিস’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, ‘মুতাওয়ারিস ফাহম’। আমার জানামতে শব্দটা ‘মুতাওয়ারাস’ হবে। কারণ, তাওয়ারুস শব্দটা মুতাআদ্দি। এর অর্থ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করা। মুতাওয়ারিস বললে অর্থ দাঁড়ায়, যে ব্যক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হলো, যা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গেছে। সুতরাং মুতাওয়ারাস বলাটাই যৌক্তিক।

২.

‘মুতাওয়ারিস’ শব্দটা যেমন কয়েক ডজন জায়গায় এসেছে, একইভাবে বইয়ের প্রচুর জায়গায় নির্ভরযোগ্য বোঝাতে আরবি ‘মুসতানিদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আমার দৃষ্টিতে এখানেও একই ভুল হয়েছে। শব্দটা ‘মুসতানাদ’ হওয়া উচিত। মুসতানিদ অর্থ নির্ভরকারী আর মুসতানাদ অর্থ নির্ভরযোগ্য।

৩.

বইয়ের উৎসগ্রন্থের পরিচয়েও সম্ভবত দুটো ভুল রয়েছে। ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় কথাটা এভাবে আছে, “বইটির মৌলিক কাঠামো গ্রহণ করেছি ফাহমুস সালাফ লিন নুসুসিশ শরইয়্যাহ ওয়ার রদ্দু আলাশ শুবহাতি হাওলাহু নামক গ্রন্থ থেকে।” আমার জানামতে, বইয়ের নামে সালাফ শব্দের পরে আস-সালিহ শব্দটাও রয়েছে। অর্থাৎ, ফাহমুস সালাফিস সালিহি…। আর শেষের দিকের ‘শুবহাতি’ শব্দটা আমার জানামতে ‘শুবুহাতি’ হবে। উৎসগ্রন্থের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু বইয়ের নাম উল্লেখের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সঙ্গে লেখকের নামটাও উল্লেখ করে দিলে বোধ করি ভালো হতো।

৪.

“৮০ হিজরিতে মাবাদ জুহানির হাতে কাদিরিয়া ফিতনার সূচনা হয়।” [পৃ. ২৮] কাদিরিয়া বলা হয় শায়খ আবদুল কাদির জিলানির সুফি ধারাকে। এখানে যে ফিতনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাদের নাম ‘কাদারিয়া’; ‘কাদিরিয়া’ নয়। এটা সম্ভবত মুদ্রণপ্রমাদ।

৫.

“ইমাম সাফফারিনি রাহ. বলেন”। [পৃ. ২৯] ‘সাফফারিনি’ না হয়ে ‘সাফারিনি’ হবে।

৬.

“প্রথম জমানার লোকদের থেকে বিশুদ্ধভাষী এবং শক্তিশালী বাগ্মী ব্যক্তি পরবর্তী জমানার কেউ না।” [পৃ. ৪৭] কথাটা আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। শরিয়াহর জ্ঞান আলাদা বিষয়। কিন্তু ভাষা ও সাহিত্যজ্ঞানে পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের ছাড়াতে পারবে না, এটা আমার কাছে অযৌক্তিক ও অবাস্তব মনে হয়। লেখক এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি।

মুদ্রণগত সমালোচনা

বইটিতে বানান ও মুদ্রণগত বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সম্ভবত গ্রন্থনা শেষ করে ভালো করে প্রুফ রিডিং করা হয়নি। কিছু জায়গায় দুর্বোধ্যতাও রয়ে গেছে। এখানে শুধু কয়েকটি নমুনা উপস্থাপন করছি। বানানভুলগুলো আপাতত এড়িয়েই যাচ্ছি।

১.

‘যাদের কথা খালাফরা সালাফ হিসাবে গ্রহণ করেছেন’ [পৃ. ২৯] বাক্যটা বুঝতে অনেকের সমস্যা হতে পারে।

২.

“অন্যতম একটি বাধা” [পৃ. ৪১] অন্যতম শব্দের অর্থই হলো, বহুর মধ্যে একটি। One of them. সুতরাং এর সাথে আলাদা করে ‘একটি’ শব্দ যোগ করা ভুল।

৩.

“তাই মাঝে মাঝে যদি সাহাবিদের কারও থেকে যদি কোনা ভুল হয়ে যেত, তখন অবশ্যই অবশ্যই অন্যান্য সাহাবিরা…”। [পৃ. ৭৪] ভালো প্রুফ রিডিং হলে এজাতীয় ত্রুটি থাকার কথা নয়।

৪.

“ইজমার প্রামাণ্যতা এবং তা সংগঠিত সম্ভব হওয়ার ওপরও”… “শুদ্ধ দলিলবিহীন ভিন্ন দলিল প্রদানকারী আলেম” [পৃ. ৭৬] বাক্য দুটো যেন একটু কেমন হয়ে গেছে।

৫.

“নব্য ও উদ্ভব কোনো পরিস্থিতির ওপর”… “উদ্ভব পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করে”। [পৃ. ১১১] এখানে উদ্ভব শব্দের ব্যবহার কতটুকু সঠিক বা মানানসই?

৬.

“মানসুস মাসায়েলকেও বলির পাঠা বানানো হচ্ছে।” [পৃ. ১২৭] এখানে কুরআন-সুন্নাহর মাসায়েলের সাথে ‘বলির পাঠা’ কথাটা কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগছে।

৭.

“কোনো হুকুম নির্ভর করে তার নিজস্ব ইল্লতের (কারণের) ওপর, নিছক হিকমত বা প্রজ্ঞার ওপর নয়।” [পৃ. ১২৯] ‘হিকমত’ শব্দের অনেক অর্থ হয়। এর মধ্যে একটা অর্থ আছে প্রজ্ঞা। বাংলায় প্রজ্ঞা বলতে বোঝায় প্রগাঢ় জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞানকে। এখানে আসরার, ফাওয়ায়িদ, রুমুজ ও নুকাত বোঝানোর জন্য যে হিকমত শব্দের ব্যবহার, তার প্রতিশব্দ হিসাবে আরও উপযুক্ত কোনো শব্দ নির্বাচন করলে আশা করি সুন্দর হবে।

৮.

“তুরাস থেকে বেছে বেছে শুজুজ মতসমূহের চর্চা বিস্তার”। [পৃ. ১৩৪] শুজুজ মানে বিচ্ছিন্নতা। এখানে উদ্দেশ্য বিচ্ছিন্ন। সুতরাং শুজুজ না লিখে শাজ লেখাই সংগত ছিল।

৯.

“আলেমদের জাল্লাত অনুসরণকারীদের জন্য দুর্ভোগ।” [প্রাগুক্ত] বইয়ের কোথাও জাল্লাত শব্দের অর্থ সম্ভবত লেখা নেই। বাঙলাভাষী পাঠক এ শব্দের সাথে পরিচিত না থাকায় বাক্যটা বোঝা তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে।

১০.

“প্রত্যেক শতকে মহান আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য একজন মুজাদ্দিদ পাঠাবেন”। [পৃ. ১৩৭] ‘মহান’ বললে আবার ‘তাআলা’ বলার কী প্রয়োজন? উভয়টি একই ধরনের অর্থ বোঝায়। একজন মুজাদ্দিদ বললে হাদিসটা সীমিত হয়ে আসে। মুহাদ্দিসগণ আরবি ‘মান’ শব্দকে ‘জিনস’ বা ব্যাপক হিসাবে নিয়েছেন। যার কারণে এক শতাব্দীতে মুজাদ্দিদ মাত্র একজনই থাকবেন—এই ধারণাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেন। এ ব্যাপারে অনেক ইমামের বক্তব্য পাওয়া যাবে। মাওলানা মনজুর নুমানি রাহ. ‘তাযকিরায়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানি’ গ্রন্থের শুরুতে এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। একনজর দেখে নেওয়া যেতে পারে।

রিভিউ দুই পর্বে শেষ করতে চাওয়ার পরও ইতিমধ্যে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাই আর দীর্ঘ করে পাঠকের বিরক্তির কারণ হব না। আপাতত এ বই নিয়ে কথা শেষ। আগামীতে অন্য কোনো বইয়ের রিভিউ নিয়ে উপস্থিত হব ইনশাআল্লাহ।

Share This