দাজ্জাল অস্বাভাবিক শক্তি ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। সে আল্লাহপ্রদত্ত সেই ক্ষমতার দ্বারা বাহ্যত অসম্ভব এমন অনেক কিছুকে সম্ভব করে দেখাবে। যেমন, তার চলার গতি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে; নাওয়াস ইবনু সামআন রা. বর্ণনা করেন,

قُلْنَا: فَمَا إِسْرَاعُهُ فِي الْأَرْضِ؟ قَالَ: «كَالْغَيْثِ اسْتَدْبَرَتْهُ الرِّيحُ»

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দ্রুত গতিতে বিচরণ করবে? রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, বায়ুচালিত মেঘমালার গতিতে।[1]

দাজ্জাল-সম্পর্কিত তামিম দারি রা.-এর প্রসিদ্ধ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

قَالَ: أَخْبِرُونِي عَنْ نَبِيِّ الْأُمِّيِّينَ مَا فَعَلَ؟ قَالُوا: قَدْ خَرَجَ مِنْ مَكَّةَ وَنَزَلَ يَثْرِبَ، قَالَ: أَقَاتَلَهُ الْعَرَبُ؟ قُلْنَا: نَعَمْ، قَالَ: كَيْفَ صَنَعَ بِهِمْ؟ فَأَخْبَرْنَاهُ أَنَّهُ قَدْ ظَهَرَ عَلَى مَنْ يَلِيهِ مِنَ الْعَرَبِ وَأَطَاعُوهُ، قَالَ لَهُمْ: قَدْ كَانَ ذَلِكَ؟ قُلْنَا: نَعَمْ، قَالَ: أَمَا إِنَّ ذَاكَ خَيْرٌ لَهُمْ أَنْ يُطِيعُوهُ، وَإِنِّي مُخْبِرُكُمْ عَنِّي، إِنِّي أَنَا الْمَسِيحُ، وَإِنِّي أُوشِكُ أَنْ يُؤْذَنَ لِي فِي الْخُرُوجِ، فَأَخْرُجَ فَأَسِيرَ فِي الْأَرْضِ فَلَا أَدَعَ قَرْيَةً إِلَّا هَبَطْتُهَا فِي أَرْبَعِينَ لَيْلَةً غَيْرَ مَكَّةَ وَطَيْبَةَ، فَهُمَا مُحَرَّمَتَانِ عَلَيَّ كِلْتَاهُمَا، كُلَّمَا أَرَدْتُ أَنْ أَدْخُلَ وَاحِدَةً – أَوْ وَاحِدًا – مِنْهُمَا اسْتَقْبَلَنِي مَلَكٌ بِيَدِهِ السَّيْفُ صَلْتًا، يَصُدُّنِي عَنْهَا، وَإِنَّ عَلَى كُلِّ نَقْبٍ مِنْهَا مَلَائِكَةً يَحْرُسُونَهَا

দাজ্জাল বলল, তোমরা আমাকে উম্মিদের নবি সম্পর্কে সংবাদ দাও। তিনি অদ্যাবধি কী করেছেন? তারা বলল, তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় চলে এসেছেন। সে জিজ্ঞেস করল, আরবের লোকেরা তার সাথে যুদ্ধ করেছে কি? আমরা বললাম, হ্যাঁ, করেছে। সে বলল, তিনি তাদের সাথে কীরূপ আচরণ করেছেন। আমরা তাকে সংবাদ দিলাম, তিনি আরবের পার্শ্ববর্তী এলাকায় জয়ী হয়েছেন এবং তারা তার বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। সে বলল, এটা কি হয়ে গেছে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। সে বলল, বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়াই জনগণের জন্য মঙ্গলজনক ছিল।

এখন আমি নিজের সম্পর্কে তোমাদের বলছি। আমিই মাসিহ দাজ্জাল। অতিসত্ত্বরই আমি এখান থেকে বাইরে যাবার অনুমতি পেয়ে যাব। বাইরে গিয়ে আমি সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ প্রদক্ষিণ করব। চল্লিশ দিনের ভেতর এমন কোন জনপদ থাকবে না, যেখানে আমি প্রবেশ করব না। তবে মক্কা ও তায়বা এ দুটি স্থানে আমি প্রবেশ করতে পারব না। যখন আমি এ দুটোর কোনো একটিতে প্রবেশের ইচ্ছা করব, তখন এক ফেরেশতা উন্মুক্ত তরবারি হাতে সামনে এসে আমাকে বাধা দেবে। এ দুটি স্থানের সকল রাস্তায় ফেরেশতাদের পাহারা থাকবে।[2]

তাবারানির এক হাদিসে এসেছে,

كَيْفَ بِكُمْ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِعَبْدٍ قَدْ سُخِّرَتْ لَهُ أَنْهَارُ الْأَرْضِ وَثِمارُهَا فَمَنِ اتَّبَعَهُ أَطْعَمَهُ وَأَكْفَرَهُ، وَمَنْ عَصَاهُ حَرَمَهُ وَمَنَعَهُ

সে সময় তোমাদের কেমন অবস্থা হবে, যখন তোমরা এমন এক বান্দার দ্বারা পরীক্ষিত হবে, পৃথিবীর নদীনালা ও ফলফলাদি যার অধীন করে দেওয়া হবে; যে তার অনুসরণ করবে, সে তাকে খাওয়াবে এবং কাফির বানিয়ে ফেলবে। আর যে তার অবাধ্যতা করবে, সে তাকে বঞ্চিত করবে এবং বাধা দেবে।[3]

জাবির রা. বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

يَخْرُجُ الدَّجَّالُ فِي خَفْقَةٍ مِنَ الدِّينِ، وَإِدْبَارٍ مِنَ الْعِلْمِ، فَلَهُ أَرْبَعُونَ لَيْلَةً يَسِيحُهَا فِي الْأَرْضِ، الْيَوْمُ مِنْهَا كَالسَّنَةِ، وَالْيَوْمُ مِنْهَا كَالشَّهْرِ، وَالْيَوْمُ مِنْهَا كَالْجُمُعَةِ، ثُمَّ سَائِرُ أَيَّامِهِ كَأَيَّامِكُمْ هَذِهِ، وَلَهُ حِمَارٌ يَرْكَبُهُ، عَرْضُ مَا بَيْنَ أُذُنَيْهِ أَرْبَعُونَ ذِرَاعًا، فَيَقُولُ لِلنَّاسِ: أَنَا رَبُّكُمْ، وَهُوَ أَعْوَرُ، وَرَبُّكُمْ لَيْسَ بِأَعْوَرَ، مَكْتُوبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ: كَافِرٌ، يَقْرَؤُهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ: مِنْ كَاتِبٍ، وَغَيْرِ كَاتِبٍ، يَرِدُ كُلَّ مَاءٍ وَمَنْهَلٍ إِلَّا الْمَدِينَةَ وَمَكَّةَ، حَرَّمَهُمَا اللهُ تَعَالَى عَلَيْهِ، وَقَامَتِ الْمَلَائِكَةُ بِأَبْوَابِهَا، وَمَعَهُ جِبَالٌ مِنْ خُبْزٍ وَخُضْرَةٍ يَسِيرُ بِهَا فِي النَّاسِ، وَالنَّاسُ فِي جَهْدٍ، إِلَّا مَنِ اتَّبَعَهُ، وَمَعَهُ نَهْرَانِ , أَنَا أَعْلَمُ بِهِمَا مِنْهُ: نَهَرٌ يَقُولُ: الْجَنَّةُ، وَنَهَرٌ يَقُولُ: النَّارُ، مَنْ أُدْخِلَ الَّذِي يُسَمِّيهِ الْجَنَّةَ فَهُوَ النَّارُ، وَمَنْ أُدْخِلَ الَّذِي يُسَمِّيهِ النَّارَ فَهُوَ الْجَنَّةُ، وَيُبْعَثُ مَعَهُ شَيَاطِينُ تُكَلِّمُ النَّاسَ، وَمَعَهُ فِتْنَةٌ عَظِيمَةٌ، يَأْمُرُ السَّمَاءَ فَتُمْطِرُ فِيمَا يَرَى النَّاسُ، وَيَقْتُلُ نَفْسًا فَيُحْيِيهَا فِيمَا يَرَى النَّاسُ، فَيَقُولُ لِلنَّاسِ: هَلْ يَفْعَلُ هَذَا إِلَّا الرَّبُّ؟ فَيَفِرُّ الْمُسْلِمُونَ إِلَى جَبَلِ النَّارِ بِالشَّامِ، فَيَأْتِيهِمْ، فَيُحَاصِرُهُمْ، فَيَشْتَدُّ حِصَارُهُمْ، وَيُجْهِدُهُمْ جَهْدًا شَدِيدًا، ثُمَّ يَنْزِلُ عِيسَى، فَيُنَادِي مِنَ السَّحَرِ، فَيَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، مَا يَمْنَعُكُمْ أَنْ تَخْرُجُوا إِلَى الْكَذَّابِ الْخَبِيثِ؟ فَيَقُولُونَ: هَذَا رَجُلٌ جِنِّيٌّ، فَيَطَّلِعُونَ فَإِذَا هُمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ صَلَوَاتُ اللهِ عَلَيْهِ، فَتُقَامُ الصَّلَاةُ، فَيُقَالَ: تَقَدَّمْ يَا رُوحَ اللهِ، فَيَقُولُ: لِيَتَقَدَّمْ إِمَامُكُمْ فَيُصَلِّي بِكُمْ، فَإِذَا صَلَّى صَلَاةَ الصُّبْحِ، خَرَجُوا إِلَيْهِ، فَحِينَ رَآهُ الْكَذَّابُ يَنْمَاثُ كَمَا يَنْمَاثُ الْمِلْحُ فِي الْمَاءِ، فَيَمْشِي إِلَيْهِ، فَيَقْتُلُهُ، وَمَنْ كَانَ مَعَهُ عَلَى الْيَهُودِيَّةِ، حَتَّى إِنَّ الشَّجَرُ وَالْحَجَرُ يُنَادِي

দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে সে সময়, যখন দীন অস্তমিত হবে এবং ইলম হারিয়ে যাবে। দাজ্জাল চল্লিশ দিন অবস্থান করবে, এর মধ্যে সে সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করবে। এর এক দিন হবে বছরের মতো, এক দিন হবে মাসের মতো, এক দিন হবে সপ্তাহের মতো আর বাকি দিনগুলো হবে তোমাদের এসব দিনের মতো। তার একটি গাধা থাকবে, যাতে সে আরোহণ করবে। সেই গাধার দুই কানের মধ্যবর্তী জায়গার প্রস্থ হবে চল্লিশ গজ। সে মানুষকে বলবে, আমি তোমাদের রব; অথচ সে হবে কানা, কিন্তু তোমাদের রব কানা নন। তার দুই চোখের মধ্যে লেখা থাকবে ‘কাফির’, যা প্রত্যেক মুমিন পড়তে পারবে—লেখা পড়তে জানুক বা না জানুক। মদিনা ও মক্কা ছাড়া সে সকল পানি এবং পানির ঘাটে এসে পৌঁছাবে। আল্লাহ তাআলা তার ওপর মক্কা এবং মদিনা হারাম করে দেবেন। এর ফটকগুলোতে ফেরেশতারা দাঁড়িয়ে থাকবে। দাজ্জালের সঙ্গে পাহাড় পাহাড় রুটি এবং শাক-সবজি থাকবে; যা নিয়ে সে মানুষের মধ্যে বিচরণ করবে। সে সময় মানুষ অনেক কষ্টের মধ্যে থাকবে। তবে যে তার অনুসরণ করবে, তারা সুখে-শান্তিতে থাকবে। দাজ্জালের সঙ্গে দুটো নদী থাকবে; এ দুটোর ব্যাপারে তার চাইতে আমি অধিক অবগত। একটি নদীকে সে বলবে জান্নাত আর অপর নদীকে সে বলবে জাহান্নাম। তার নামকরণ করা জান্নাতে যাকে প্রবেশ করানো হবে, তা হবে জাহান্নাম। আর তার নামকরণ করা জাহান্নামে যাকে প্রবেশ করানো হবে, তা হবে জান্নাত। দাজ্জালের সঙ্গে কিছু শয়তান পাঠানো হবে, যারা মানুষের সাথে কথা বলবে।[4] তার সঙ্গে আরেকটি বড় ফিতনা থাকবে। সে আকাশকে আদেশ করবে, তখন আকাশ মানুষের দৃষ্টিতে বৃষ্টি বর্ষণ করবে। সে একজন জীবন্ত ব্যক্তিকে হত্যা করবে, এরপর মানুষের দৃষ্টিতে তাকে জীবিত করবে। তারপর সে বলবে, এ কাজগুলো কি রব ছাড়া আর কেউ করতে পারে? তখন মুসলমানরা শামের জাবালুন নারে (আগুনের পাহাড়ে) পালিয়ে যাবে। দাজ্জাল তাদের কাছে এসে তাদেরকে অবরুদ্ধ রাখবে। অবরুদ্ধ জীবন তাদের জন্য বড় কঠিন হয়ে যাবে। দাজ্জাল তাদেরকে ভীষণ কষ্ট দেবে। তারপর ইসা আ. অবতরণ করবেন। ঊষালগ্নে মুসলমানদের ডেকে বলবেন, হে মানুষ সকল, তোমরা কেন এই খবিস দাজ্জালের মোকাবিলা করার জন্য বের হচ্ছ না? লোকেরা বলবে, এ তো এক আস্ত জিন (দৈত্য-দানব)। তখন তারা জানতে পারবে, ইনিই হচ্ছেন ইসা ইবনু মারয়াম আ.। তখন নামাজের ইকামত হবে। বলা হবে, হে রুহুল্লাহ, আপনি সামনে যান। তিনি বলবেন, তোমাদের ইমাম অগ্রসর হয়ে তোমাদের নামাজ পড়াক। ফজরের নামাজ শেষে সকলে দাজ্জালের মোকাবিলায় বেরোবে। দাজ্জাল ইসা.-কে দেখামাত্র সেভাবে গলে যাবে, যেভাবে লবণ পানিতে গলে যায়। তিনি দাজ্জালের দিকে হেঁটে গিয়ে তাকে এবং তার সঙ্গে আরও যারা ইহুদিধর্মের ওপর থাকবে সবাইকে হত্যা করে ফেলবেন। এমনকি বৃক্ষ ও প্রস্তর পর্যন্ত ডেকে ডেকে ইহুদিদের সন্ধান জানিয়ে দেবে।[5]

এই হাদিসটি উল্লেখ করার পর এর ব্যাখ্যায় ইমাম তহাবি রহ. লেখেন,

وَذَلِكَ أَنَّ فِيهِ: ” ثُمَّ يَأْمُرُ السَّمَاءَ فَتُمْطِرُ فِيمَا يَرَى النَّاسُ، وَيَقْتُلُ نَفْسًا، ثُمَّ يُحْيِيهَا فِيمَا يَرَى النَّاسُ “، وَفِي ذَلِكَ تَحْقِيقُ مَا قُلْنَا: إِنَّ هَذِهِ الْأَشْيَاءَ إِنَّمَا تَكُونُ مِنْهُ عَلَى جِهَةِ السِّحْرِ الَّذِي يُخَيَّلُ إِلَى مَنْ لَحِقَهُ ذَلِكَ السِّحْرُ أَنَّهَا حَقَائِقُ، وَلَيْسَتْ بِحَقَائِقَ

হাদিসটিতে বলা হয়েছে, ‘সে আকাশকে আদেশ করবে, তখন আকাশ মানুষের দৃষ্টিতে বৃষ্টি বর্ষণ করবে। সে একজন জীবন্ত ব্যক্তিকে হত্যা করবে, এরপর মানুষের দৃষ্টিতে তাকে জীবিত করবে।’ এর দ্বারা বোঝা গেল, দাজ্জালের থেকে এ বিষয়গুলো জাদু হিসেবে প্রকাশ করবে। এ জাদু যার সঙ্গে সংযুক্ত হবে, তার ভেতরে এই কল্পনা জাগবে যে, এগুলো বাস্তব; কিন্তু আসলে এগুলো বাস্তব নয়।

অন্য হাদিসে সেই অবস্থার ভয়াবহতার চিত্র আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

فَيَأْتِي عَلَى الْقَوْمِ فَيَدْعُوهُمْ، فَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَجِيبُونَ لَهُ، فَيَأْمُرُ السَّمَاءَ فَتُمْطِرُ، وَالْأَرْضَ فَتُنْبِتُ، فَتَرُوحُ عَلَيْهِمْ سَارِحَتُهُمْ، أَطْوَلَ مَا كَانَتْ ذُرًا، وَأَسْبَغَهُ ضُرُوعًا، وَأَمَدَّهُ خَوَاصِرَ، ثُمَّ يَأْتِي الْقَوْمَ، فَيَدْعُوهُمْ فَيَرُدُّونَ عَلَيْهِ قَوْلَهُ، فَيَنْصَرِفُ عَنْهُمْ، فَيُصْبِحُونَ مُمْحِلِينَ لَيْسَ بِأَيْدِيهِمْ شَيْءٌ مِنْ أَمْوَالِهِمْ، وَيَمُرُّ بِالْخَرِبَةِ، فَيَقُولُ لَهَا: أَخْرِجِي كُنُوزَكِ، فَتَتْبَعُهُ كُنُوزُهَا كَيَعَاسِيبِ النَّحْلِ، ثُمَّ يَدْعُو رَجُلًا مُمْتَلِئًا شَبَابًا، فَيَضْرِبُهُ بِالسَّيْفِ فَيَقْطَعُهُ جَزْلَتَيْنِ رَمْيَةَ الْغَرَضِ، ثُمَّ يَدْعُوهُ فَيُقْبِلُ وَيَتَهَلَّلُ وَجْهُهُ، يَضْحَكُ ، فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ بَعَثَ اللهُ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ، فَيَنْزِلُ عِنْدَ الْمَنَارَةِ الْبَيْضَاءِ شَرْقِيَّ دِمَشْقَ، بَيْنَ مَهْرُودَتَيْنِ، وَاضِعًا كَفَّيْهِ عَلَى أَجْنِحَةِ مَلَكَيْنِ، إِذَا طَأْطَأَ رَأْسَهُ قَطَرَ، وَإِذَا رَفَعَهُ تَحَدَّرَ مِنْهُ جُمَانٌ كَاللُّؤْلُؤِ، فَلَا يَحِلُّ لِكَافِرٍ يَجِدُ رِيحَ نَفَسِهِ إِلَّا مَاتَ، وَنَفَسُهُ يَنْتَهِي حَيْثُ يَنْتَهِي طَرْفُهُ، فَيَطْلُبُهُ حَتَّى يُدْرِكَهُ بِبَابِ لُدٍّ، فَيَقْتُلُهُ، ثُمَّ يَأْتِي عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ قَوْمٌ قَدْ عَصَمَهُمُ اللهُ مِنْهُ، فَيَمْسَحُ عَنْ وُجُوهِهِمْ وَيُحَدِّثُهُمْ بِدَرَجَاتِهِمْ فِي الْجَنَّةِ

দাজ্জাল এক সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদেরকে কুফরের দিকে আহ্বান করবে। তারা তার ওপর ইমান আনয়ন করবে এবং তার ডাকে সাড়া দেবে। তারপর সে আকাশকে হুকুম করবে। আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে এবং ভূমিকে নির্দেশ দেবে, ভূমি গাছ-পালা ও শষ্য উদগত করবে। বিকেলবেলা তাদের পশুপাল পূর্বের চেয়ে উচুঁ কুঁজবিশিষ্ট, মাংসল নিতম্ববিশিষ্ট ও দুগ্ধপুষ্ট স্তনবিশিষ্ট হয়ে (খোঁয়াড়ে) ফিরে আসবে।  

তারপর দাজ্জাল অপর এক সম্প্রদায়ের নিকট আসবে এবং তাদেরকে কুফরের দিকে আহ্বান করবে। তারা তার কথাকে উপেক্ষা করবে। ফলে সে তাদের নিকট হতে ফিরে চলে যাবে। অমনি তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ ও পানির অনটন দেখা দেবে এবং তাদের হাতে তাদের ধন-সম্পদ থাকবে না। তখন দাজ্জাল এক পতিত স্থান অতিক্রমকালে সেটাকে সম্মোধন করে বলবে, তুমি তোমার গুপ্তধন বের করে দাও। তখন জমিনের ধন-ভাণ্ডার বের হয়ে তার অনুগমন করবে, যেমন মৌমাছি তাদের রাণীর অনুগমন করে।

এরপর দাজ্জাল এক পূর্ণযৌবন যুবককে ডেকে আনবে এবং তাকে তরবারি দ্বারা আঘাত করে তিরের লক্ষ্যস্থলের মতো দু-ফাঁক করে ফেলবে। তারপর সে পুনরায় তাকে ডাকবে। যুবক দীপ্তমান হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় তার দিকে এগিয়ে আসবে। এ সময় আল্লাহ রব্বুল আলামিন মারইয়াম তনয় ইসা আ.-কে প্রেরণ করবেন। তিনি দুই ফিরিশতার কাঁধের উপর ভর করে লাল-গোলাপী (জাফরানী) রঙের জোড়া কাপড় পরিহিত অবস্থায় দামেশক নগরীর পূর্ব দিকের শ্বেত মিনারের উপর অবতরণ করবেন। যখন তিনি তার মাথা ঝোঁকাবেন বা উত্তোলন করবেন, তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর শরীর থেকে  মণি-মুক্তার মতো গড়িয়ে পড়বে। তিনি যেকোনো কাফিরের নিকট যাবেন সে-ই তাঁর শ্বাসের বাতাসে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁর দৃষ্টি যতদুর পর্যন্ত যাবে তাঁর শ্বাসও ততদূর পর্যন্ত পৌঁছাবে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করতে থাকবেন। অবশেষে তাকে লুদ নামক স্থানের ফটকের কাছে পেয়ে যাবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। তারপর ইসা আ. তাদের নিকট যাবেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের ফিতনা থেকে হিফাজত করেছেন। তাদের নিকট গিয়ে তিনি তাদের চেহারায় হাত বুলিয়ে জান্নাতে তাদের মর্যাদা সম্পর্কে সংবাদ দেবেন।[6]

দাজ্জাল কেন দাজ্জাল?

অস্বাভাবিক ক্ষমতা এবং অলৌকিক শক্তি এমন কিছু নয়, যা কোনো মানুষকে দাজ্জালে পরিণত করে। মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বানানোই হয়েছে এ জন্য যে, মানুষ পৃথিবীর সবকিছু থেকে উপকৃত হবে এবং প্রতিটা জিনিসের যথাযথ ব্যবহার করবে। এটাই পৃথিবীতে তাদের খিলাফতের সাধারণ দাবি। আল্লাহ বলেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا… وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً.

তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদের (কল্যাণের) জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এরপর… তিনি ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা বানাতে যাচ্ছি।[7]

আল্লাহ স্বয়ং আদম আ.-কে সকল বস্তুর নাম, বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ ও ব্যবহারপদ্ধতি এবং মানুষ যে সকল অবস্থার সম্মুখীন হয়, তার জ্ঞান শিখিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে,

وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا

এবং তিনি (আল্লাহ) আদমকে সকল ‘নাম’ শিক্ষা দিলেন।[8]

এছাড়াও নবিগণের জীবনীতে অলৌকিক শক্তির বহিঃপ্রকাশের অসংখ্য ঘটনা পরিদৃষ্ট হয়। এ ধরনের অনেক মুজিজার কথা খোদ কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সে সকল পুণ্যাত্মা নবিগণের সঙ্গে দাজ্জালের মৌলিক একটি পার্থক্য রয়েছে; আর সে পার্থক্যের কথাই উঠে এসেছে সুরা কাহফের সর্বপ্রথম শব্দে। আল্লাহ তাআলা যখন সুলায়মান আ.-কে অলৌকিক শক্তি ও অস্বাভাবিক ক্ষমতা দান করেছিলেন, তখন সুলায়মান আ.-এর ভাষ্য ছিল,

هَذَا مِنْ فَضْلِ رَبِّي لِيَبْلُوَنِي أَأَشْكُرُ أَمْ أَكْفُرُ وَمَنْ شَكَرَ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّي غَنِيٌّ كَرِيمٌ

এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ; যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, নাকি অকৃতজ্ঞ হই। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের কল্যাণেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, (সে জেনে রাখুক,) নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক অমুখাপেক্ষী, মহানুভব।[9]

অপরদিকে দাজ্জাল এই ক্ষমতা লাভ করে রবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা তো দূরের কথা; উলটো নিজেকেই রব দাবি করবে। উপরন্তু সে নিজের কুফর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে না; পুরো উম্মাহকে কাফির বানানোর প্রচেষ্টায় রত হবে। সে সাধারণ মুসলমানদের ইমানকে সংশয়পূর্ণ করে ফেলবে। রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন,

مَنْ سَمِعَ بِالدَّجَّالِ فَلْيَنْأَ عَنْهُ، فَوَاللَّهِ إِنَّ الرَّجُلَ لَيَأْتِيهِ وَهُوَ يَحْسِبُ أَنَّهُ مُؤْمِنٌ فَيَتَّبِعُهُ، مِمَّا يَبْعَثُ بِهِ مِنَ الشُّبُهَاتِ

কেউ দাজ্জালের আবির্ভাবের কথা শুনলে সে যেন তার থেকে দূরে চলে যায়। আল্লাহর কসম, ব্যক্তি নিজেকে ইমানদার ভেবে তার নিকট যাবে, অনন্তর দাজ্জালের সন্দেহ উদ্রেককারী বিষয়সমূহ প্রত্যক্ষ করে তার অনুসারী হয়ে যাবে।[10]

নারীরা যেহেতু অধিক কৌতূহলী হয়, বিস্ময়কর জিনিস দেখলে সহজে প্রভাবিত হয় এবং নিজেদের আকল কম খাটায়, তাই পুরুষের তুলনায় দাজ্জালের অধিক সংখ্যক অনুসারী হবে নারী। তাছাড়া শেষ জামানায় অসংখ্য যুদ্ধের কারণে পুরুষের মৃত্যুর হাত অনেক বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে এমনিও নারীদের সংখ্যা সমাজে বেশি হবে। ইরশাদ হয়েছে,

يَكُونُ أَكْثَرَ مَنْ يَخْرُجُ إِلَيْهِ النِّسَاءُ، حَتَّى إِنَّ الرَّجُلَ لَيَرْجِعُ إِلَى حَمِيمِهِ وَإِلَى أُمِّهِ وَابْنَتِهِ وَأُخْتِهِ وَعَمَّتِهِ، فَيُوثِقُهَا رِبَاطًا، مَخَافَةَ أَنْ تَخْرُجَ إِلَيْهِ، ثُمَّ يُسَلِّطُ اللهُ الْمُسْلِمِينَ عَلَيْهِ، فَيَقْتُلُونَهُ وَيَقْتُلُونَ شِيعَتَهُ، حَتَّى إِنَّ الْيَهُودِيَّ، لَيَخْتَبِئُ تَحْتَ الشَّجَرَةِ أَوِ الْحَجَرِ فَيَقُولُ الْحَجَرُ أَوِ الشَّجَرَةُ لِلْمُسْلِمِ: هَذَا يَهُودِيٌّ تَحْتِي فَاقْتُلْهُ

দাজ্জালের নিকট সর্বাধিক বের হবে নারীরা। অবশেষে পুরুষ প্রেমাস্পদ, মা, মেয়ে, বোন ও ফুফুদের কাছে গিয়ে তাদেরকে বেঁধে রাখবে—এই আশঙ্কায় যে, তারা দাজ্জালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়বে। এরপর আল্লাহ দাজ্জালের ওপর মুসলমানদের ক্ষমতা প্রদান করবেন। তারা দাজ্জালকেও হত্যা করবে, তার দলকেও হত্যা করবে। কোনো ইহুদি গাছ বা পাথরের পেছনে লুকালে পাথর ও গাছ মুসলমানকে ডেকে ডেকে বলবে, এই যে আমার পেছনে একজন ইহুদি; ওকে হত্যা করে ফেলো।[11]

মোদ্দাকথা, শক্তি ও ক্ষমতা লাভ করে মহান দাতা আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা হচ্ছে এমন ভয়াবহ ফিতনা, যা মানুষকে দাজ্জাল বানিয়ে ছাড়ে। দাজ্জালের ভ্রান্তির মূল উৎসই হচ্ছে এটা। দাজ্জাল যে জাদু ও কৌশলের দ্বারা এই অসম্ভব বিষয়গুলো সম্ভব করে দেখাবে, এর জ্ঞান যদি অন্য কেউ অর্জন করতে পারত, তাহলে সে-ও তার অনুরূপ ক্ষমতার অধিকারী হতো। ইমাম ইবনু হাজম রহ. লেখেন,

إِنَّمَا هُوَ محيل يتحيل بحيل مَعْرُوفَة كل من عرفهَا عمل مثل عمله

দাজ্জাল হচ্ছে একজন কৌশলী। সে বিভিন্ন প্রসিদ্ধ কৌশলের প্রয়োগ ঘটাবে। যে এই কৌশল রপ্ত করবে, সে তার কর্মের অনুরূপ কর্ম ঘটাতে পারবে।[12]

বর্তমান সময়েও পৃথিবী যত উন্নতি ও উৎকর্ষের পথে অগ্রসর হচ্ছে, ততই রব থেকে দূরে সরে ক্রমে নিজেদেরকে রবের আসনে আসীন বলে ঘোষণা করছে। এর দ্বারা মূলত সারা পৃথিবীতে দাজ্জাল আসার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং মানুষ নিজেদেরকে দাজ্জালের যোগ্য অনুসারীর মর্যাদায় উত্তীর্ণ করছে। তাছাড়া হাদিসে এ-ও এসেছে, বড় দাজ্জাল আসার আগে আরও অনেক ‘দাজাজিলা’ (দাজ্জাল শব্দের বহুবচন)-এর উদ্ভব ঘটবে।


[1] সহিহ মুসলিম : ২৯৩৭

[2] সহিহ মুসলিম : ২৯৪২

[3] আল-মু‘জামুল কাবির, তাবারানি : ৪০২।

[4] অন্য বর্ণনায় এই অংশটার বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে,

وَتُبْعَثُ مَعَهُ الشَّيَاطِينُ عَلَى صُورَةِ مَنْ قَدْ مَاتَ مِنَ الْآبَاءِ وَالْإِخْوَانِ وَالْمَعَارِفِ، فَيَأْتِي أَحَدُهُمْ إِلَى أَبِيهِ أَوْ أَخِيهِ أَوْ ذَوِي رَحِمِهِ فَيَقُولُ: أَلَسْتَ فُلَانًا؟ أَلَسْتَ تَعْرِفُنِي؟ هُوَ رَبُّكَ فَاتَّبِعْهُ

দাজ্জালের সঙ্গে কিছু শয়তান পাঠানো হবে। যারা মুসলমানদের মৃত বাবা-মা, ভাই-বোন ও পরিচিতজনের রূপ ধারণ করে আসবে। তাদের একেকজন কারও বাবা, ভাই বা আত্মীয়ের নিকট এসে বলবে, তুমি কি অমুক নন? তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? সে তোমার রব; সুতরাং তুমি তার অনুসরণ করো। [আল-মু‘জামুল কাবির, তাবারানি : ৪৩০] 

[5] শারহু মুশকিলিল আসার : ৫৬৯৪; মুসনাদু আহমাদ : ১৪৯৫৪ । হাদিসটির সনদ সহিহ।

[6] সহিহ মুসলিম : ২৯৩৭

[7] সুরা বাকারাহ : ২৯-৩০

[8] সুরা বাকারাহ : ৩১

[9] সুরা নামল : ৪০

[10] সুনানু আবি দাউদ : ৪২৬৮

[11] মুসনাদু আহমাদ : ৫৩৫৩

[12] আল-ফিসাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল : ২/৪১

Share This