উম্মাহ নেটওয়ার্কের ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ’ শীর্ষক আলোচনায় একটি অসংগতি ও স্ববিরোধিতা : কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ


ক.
মুহতারাম ভাই আলোচনার শুরুতে শায়খ হাফিজ বিন আহমদ আল-হাকিমি রহ.-এর সূত্রে ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ’র পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ হলো এই কথার নিরঙ্কুশ স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনিই সবকিছুর মালিক, গোটা বিশ্বজগতের তিনিই একমাত্র পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক, তিনিই সবকিছুর প্রতিপালক। তাঁর রাজত্বে কেউ শরিক নেই, তাঁর কোনো সহযোগী নেই, তাঁর আদেশকে রহিত করার শক্তি কারও নেই, তাঁর নির্দেশকে অগ্রাহ্য করার কেউ নেই, তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ নেই, সমকক্ষও নেই। রুবুবিয়্যাহ ও প্রভুত্বের কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর বিরোধিতা করার কেউ নেই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলিতেও তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।’

এরপর আরও একটি সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘আল্লাহ তাআলাই একমাত্র এক ও অদ্বিতীয় সত্তা, তাঁর কোনো শরিক নেই এবং তিনিই বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক—এই বিশ্বাসকেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ বলে।’

তারপর তিনি বলেন, ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় আমরা মৌলিকভাবে দুটো পয়েন্ট পাচ্ছি : (ক) আল্লাহর অস্তিত্বে ইমান আনা, (খ) আল্লাহ তাআলাকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করা।’

তারপর তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘কেউ যদি বিশ্বজগতের সৃষ্টি, প্রতিপালন, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করে, তবে সে-ও তাওহিদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে শিরকের গণ্ডিতে প্রবেশ করে। ওলি-বুজুর্গরা পৃথিবী পরিচালনা করেন, তারা মানুষের লাভ-ক্ষতির মালিক, তারা সন্তান দিতে পারেন—এই ধরনের অপবিশ্বাস যদি কেউ লালন করে, তাহলে সে মুশরিক। মোটকথা, আল্লাহর রুবুবিয়্যাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত গুণ ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এগুলোর একটিও যদি গাইরুল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয়, তবে তা শিরক বলে গণ্য হবে।’


খ.
আলোচনার শেষের দিকে তিনি বলেন, ‘কেবল তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর বিশ্বাস মানুষকে শিরকের গণ্ডি থেকে বের করে ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশ করায় না এবং জাহান্নাম থেকে নাজাতও দেয় না।’ এর দ্বারা বোঝা গেল, তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ লালন করা সম্ভব। অর্থাৎ, একটা আরেকটার জন্য তেমন অপরিহার্য নয়, যেমন দেহের জন্য আত্মা অপরিহার্য। পৃথক পৃথকভাবে উভয়টির অস্তিত্ব সাব্যস্ত থাকা সম্ভব। আচ্ছা, তাহলে কবরে তো শুধু তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে ‘তোমার রব কে’। তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ সম্পর্কে কেন প্রশ্ন করা হবে না? শায়খ মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নজদি রহ. নিজেই বলেছেন, সেখানে রব শব্দটি ব্যাপক, যার মধ্যে ইলাহও অন্তর্ভুক্ত। তাহলে একই কথা তো তাওহিদের কালিমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাতে ইলাহ শব্দটি ব্যাপক, যার মধ্যে রবও অন্তর্ভুক্ত। পৃথকভাবে ব্যবহৃত হলে ফকির শব্দের মধ্যে যেমন মিসকিনও অন্তর্ভুক্ত থাকে, ইমান ও ইসলাম প্রতিটির মধ্যে অপরটিও অন্তর্ভুক্ত থাকে, এখানেও বিষয়টি তেমনই। এ জন্য রুহের জগতে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল, ‘আমি কি তোমাদের রব না’? যাইহোক, এটা আমাদের মূল প্রতিপাদ্য নয়।

এরপর তিনি বলেন, ‘আরবের মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজকরাসহ পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মের মানুষই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করে। কেবল নাস্তিক ও বর্তমান জামানার কমিউনিস্টদের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের জন্যই এটি সত্য।’

এবার আলোচনার প্রথমাংশের সাথে শেষাংশ মিলিয়ে দেখি। মুহতারাম ভাই বলেছিলেন, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সংজ্ঞার মধ্যে আমরা মৌলিকভাবে দুটো পয়েন্ট পাই, যার দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘আল্লাহ তাআলাকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করা’। অর্থাৎ রুবুবিয়্যাহর সকল গুণ একমাত্র আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা। তাওহিদ শব্দের মানেই কাউকে এক ও অদ্বিতীয় বলে সাব্যস্ত করা। এখন কথা হলো, আরবের মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজকরাসহ সকলের কি তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর ওপর ইমান রয়েছে? শুধু মুসলমানদের পির ও মাজারপূজারিরাই এই তাওহিদ থেকে বাইরে রয়েছে? সুবহানাল্লাহ! এটা কেমন কথা? হিন্দুরা ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও তারা তো তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাসী নয়। তারা রুবুবিয়্যাহর গুণাবলিতে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় সাব্যস্ত না করে তার সঙ্গে সুস্পষ্ট শিরক করে। একই ধরনের শিরক খ্রিষ্টানরাও করে। আরবের মুশরিকরাও যে এই প্রকারের শিরক করত, কুরআনের পাতায় পাতায় এর বিবরণ রয়েছে। হ্যাঁ, তারা সকলেই আল্লাহর অস্তিত্বে ইমান রাখে; কিন্তু শুধু আল্লাহর অস্তিত্বে ইমান রাখাকে তো তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ বলে না। বরং এটাকে তো তাওহিদই বলে না। তাওহিদ তো সেটাকেই বলা হবে, যেখানে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে, যার কোনো শরিক নেই।

এরপর তিনি কুরআনের দুটো আয়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘মক্কার মুশরিকরা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করত; কিন্তু এই বিশ্বাস তাদেরকে মুমিন বানাতে পারেনি। কারণ, তারা তাওহিদুল উলুহিয়্যাহয় বিশ্বাস করত না।’ অথচ কুরআনের অসংখ্য অগণিত আয়াত উপস্থাপন করে দেখানো যাবে, মক্কার মুশরিকরা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাস করত না। তারা রুবুবিয়্যাহর কয়েকটা বিষয় আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করত বটে, যেমনটা আলোচকের উল্লেখিত আয়াত দুটোতে বিবৃত হয়েছে, তবে তা-ও শিরকমুক্তভাবে নয়। তদুপরি তারা রুবুবিয়্যাহর সব বিষয়ে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করত না। আলোচক শুরুতে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তার সাথে এই অংশের কথাগুলো সাংঘর্ষিক। এখন হয়তো সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হবে অথবা এই অংশের কথাগুলো পাল্টাতে হবে।


এই লেখাটা ‘আদ-দীন আন-নাসিহাহ’ (দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা) হিসেবে শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ মাত্র; দলিলসমৃদ্ধ বিস্তারিত পর্যালোচনা নয়। আশা করি, কর্তৃপক্ষ পুরো আলোচনাটা সামনে রেখে আলোচনার প্রতিটা অংশ নিয়ে ফিকির করবেন এবং নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনা করবেন। তারপর সংশোধনার্থে এই আলোচনাটি সরিয়ে নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ, বিশুদ্ধ ও যথার্থরূপে এটাকে নতুন করে আপলোড করবেন। সংজ্ঞা ও দলিলের আলোকে ফিকির করলে আলোচনার মিসটেকগুলো আপনাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এ কারণে আমরা আর এই লেখাটাকে দীর্ঘ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না। যেহেতু আপনাদের অবগত করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই, তাই এ পন্থায়ই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলো। আফওয়ান।

বি. দ্র. এই পোস্টটা উম্মাহ নেটওয়ার্ক চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে। সুতরাং বিষয়টা তাদের দৃষ্টিগোচর হলেই চলবে। কোনো অবুঝ থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার বিষয়টা নিয়ে নির্বুদ্ধিতাসুলভ মাতামাতি করে হাস্যরসের খোরাক না জোগালেই বিষয়টা সুন্দর হবে।

‘তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ’ শীর্ষক আলোচনায়ও একটি অসংগতি : যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ


মুহতারাম ভাই ‘তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ’ শীর্ষক আলোচনায় প্রথম ১০ মিনিটের পর বলেছেন, ‘কালিমাতুত তাওহিদ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর আসল মর্মই হলো, তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ, কোনোভাবেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ নয়। কারণ, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দাওয়াত দেওয়ার জন্যে রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে পাঠানো হয়নি। আরবের মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টানরা তো আগে থেকেই তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করত। কারণ, আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতিতে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এর জন্য কোনো নবি-রাসুলের দাওয়াতের দরকার নেই, কোনো মেহনতের প্রয়োজন নেই। কাফিরদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহর দ্বন্দ্ব হয়েছিল তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর কারণেই।… তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সঙ্গে তো কোনো কাফিরও দ্বিমত করে না।’


হুবহু একই ধরনের কথা রবি বিন হাদি মাদখালি তার ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’ গ্রন্থে (১/৪) বলেছে। তার ভাষ্য হলো, ‘মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে শুধু তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ নিয়ে দ্বন্দ্ব করত। আর তারা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সামনে নিরঙ্কুশ পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ করত।’

মুহতারাম ভাইও দাবি করেছেন, মুশরিকদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর যুদ্ধ হয়েছে শুধু তাওহিদুল উলুহিয়্যাহকে কেন্দ্র করে। দলিল হিসেবে তিনি যে দুটো হাদিস উপস্থাপন করেছেন, তাতে শুধু ‘ইলাহ’ শব্দ রয়েছে। এর দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, নববি গাজওয়ার মূল বিষয় ছিল তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ প্রতিষ্ঠা; তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ নয়। কারণ, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাআলা নবিগণকে পাঠাননি।


এবার নিচের আয়াতগুলো লক্ষ করুন :

وَمَا لَكُمْ لَا تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ لِتُؤْمِنُوا بِرَبِّكُمْ

তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর ওপর ইমান আনছ না; অথচ রাসুল তোমাদের দাওয়াত দিচ্ছেন, যেন তোমরা তোমাদের রবের ওপর ইমান আনো। {সুরা হাদিদ : ৮}

এই আয়াতে ‘রবের প্রতি ইমান আনয়ন’ বলে কি তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর কথা তুলে ধরা হয়েছে নাকি তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর কথা? হাদিসে ‘ইলাহ’ শব্দ থাকায় তিনি যেহেতু তার দ্বারা শুধু তাওহিদুল উলুহিয়্যাহ উদ্দেশ্য নিয়েছিলেন, তাহলে আলোচ্য আয়াত থেকে কি শুধু তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ উদ্দেশ্য হওয়াই যুক্তির দাবি নয়? এখন এই আয়াতের আলোকে উপরিউক্ত আলোচনাকে কি যথার্থ বলার সুযোগ রয়েছে?

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ ۞ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ

যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে তাদেরকে (আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার) অনুমতি দেওয়া হলো এ কারণে যে, তাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। …তাদেরকে অন্যায়ভাবে ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ। {সুরা হজ : ৩৯-৪০}

তিনি তার উপস্থাপিত দলিল থেকে যেভাবে প্রমাণ উদ্ঘাটন করেছেন, একই প্যাটার্নে এই আয়াত থেকে কী প্রমাণ উদ্ঘাটিত হয়? নিশ্চয়ই এই আয়াতের আলোকে বাহ্যিক শব্দ থেকেই এটাই প্রতীয়মান হয় যে, লড়াইয়ের মূল প্রতিপাদ্য ছিল তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ। আর যদি বলেন, এখানে রুবুবিয়্যাহর মধ্যে উলুহিয়্যাহ অন্তর্ভুক্ত, তাহলে মুহতারাম আলোচকের এই কথাগুলোর কী অর্থ হবে—‘তাবলিগের ভাইয়েরা কালিমাতুত তাওহিদের দাওয়াতের নামে তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর দাওয়াত দিয়ে থাকেন। এটি কীভাবে নবিওয়ালা দাওয়াত হতে পারে? কীভাবে নবিওয়ালা মেহনত হতে পারে? তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সঙ্গে তো কোনো কাফিরও দ্বিমত করে না। তাই তো তাবলিগের এই দাওয়াত ইসলামের সবচে বড় বড় দুশমনদের দেশেও চলতে পারে। …কাফিররা জানে, তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাসী মুসলিম তাদের জন্য মোটেও ভয়ের কারণ নয়। পুরো পৃথিবী এমন মুসলিমে ভরে গেলেও তাদের বিশেষ কোনো সমস্যা নেই।’

আচ্ছা, শেষ দুটো বাক্য নিয়ে আরেকটু ভাবুন। তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাসী মুসলিমের তো আকিদা হলো, সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র তাঁর। সুতরাং এই প্রকার তাওহিদ যার রয়েছে, সে তো কোনো কুফরি মতবাদে বিশ্বাস করবে না। সে তো কোনো বাতিল মতবাদের ধ্বজাধারী বা সমর্থক হবে না। তাহলে কেন কাফিররা তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহয় বিশ্বাসী মুসলমানদের ভয় করবে না? তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ শব্দটার পরিধি যে কত ব্যাপক, এই আলোচনার সময় মুহতারাম আলোচক ভাই হয়তো তা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। প্রচলিত কুফরি মতবাদগুলো শুধু যে তাওহিদুল উলুহিয়্যাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বিষয় হলো, এই মতবাদগুলো তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

কুরআনের শত শত আয়াতে এ কথা উঠে এসেছে, মক্কার মুশরিকরা আল্লাহর রুবুবিয়্যাহয় শিরক করত। তারা তাদের দেবদেবী ও প্রতিমাগুলোকে আল্লাহর অংশীদার, সমকক্ষ ও প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করত। তারা আল্লাহ তাআলা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, এই ধ্যানধারণাও লালন করত। ইহুদিরা আল্লাহ তাআলার রুবুবিয়্যাহর ব্যাপারে সাদৃশ্যবাদে লিপ্ত হয়েছিল। নিচের আয়াতগুলো লক্ষ করুন, এগুলো কোন ধরনের ‘তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ’ :

لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন যারা বলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ দরিদ্র আর আমরা ধনী। {সুরা আলে ইমরান : ১৮১}

فَاسْتَفْتِهِمْ أَلِرَبِّكَ الْبَنَاتُ وَلَهُمُ الْبَنُونَ ۞ أَمْ خَلَقْنَا الْمَلَائِكَةَ إِنَاثًا وَهُمْ شَاهِدُونَ ۞ أَلَا إِنَّهُمْ مِنْ إِفْكِهِمْ لَيَقُولُونَ ۞ وَلَدَ اللَّهُ وَإِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ۞ أَصْطَفَى الْبَنَاتِ عَلَى الْبَنِينَ ۞ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ ۞ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

নাকি আমি ফেরেশতাদেরকে মেয়ে হিসেবে সৃষ্টি করেছিলাম আর তারা (মক্কার মুশরিকরা সেখানে) উপস্থিত ছিল? দেখুন, তারা অবশ্যই তাদের মনগড়া কথা বলে যে, আল্লাহ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী। তিনি কি পুত্রদের চেয়ে কন্যাকেই বেশি পছন্দ করেছেন? তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেমন সিদ্ধান্ত দিচ্ছ? তবে কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? {সুরা সাফফাত : ১৪৯-১৫৫}

নিচের আয়াতটিও লক্ষ করুন :

قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ

আপনি বলুন, আমি কি আল্লাহকে ছেড়ে অন্য রব অন্বেষণ করব? অথচ তিনিই সব কিছুর রব। {সুরা আনআম : ১৬৪}

ইবরাহিম আ. যেই সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন, তারা রব মনে করত আল্লাহকে নাকি নমরুদকে? মুসা আ. যেই সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন, তারা রব মনে করত আল্লাহকে নাকি ফিরআউনকে? নিচের আয়াতটি লক্ষ করুন :

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ
আপনি কি সেই ব্যক্তির (নমরুদের) কথা ভেবে দেখেননি, যে ইবরাহিমের সাথে তার প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল; যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছেন? যখন ইবরাহিম বলল, আমার রব তো তিনি, যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। তখন সে বলল, আমি জীবন দান ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহিম বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেম তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও। তখন সে (নমরুদ) হতবুদ্ধি হয়ে গেল। {সুরা বাকারাহ : ২৫৮}

ফিরআউন বলেছিল, ‘আমি তোমাদের সবচে সুউচ্চ রব’। {সুরা নাজিআত : ২৪} আসহাবুল উখদুদের যে ঘটনা সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, তাতেও এসেছে, ‘বাদশাহ সেই মন্ত্রীকে বলল, কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলো? সে বলল, আমার রব। বাদশাহ বলল, আমি ছাড়া কি তোমার আর কোনো রব আছে নাকি? সে বলল, আমার এবং আপনার রব আল্লাহ।’ {সহিহ মুসলিম : ৩০০৫}

তাওহিদুর রুবুবিয়্যাহ যদি চিরকাল সবার স্বভাব-প্রকৃতির মধ্যেই গেঁথে দেওয়া থাকে, এর জন্য নবি রাসুল প্রেরণের কোনো প্রয়োজন হয় না, তাহলে সহিহ হাদিসে এ কথা কেন বলা হলো যে, ‘প্রত্যেক ভূমিষ্ঠ শিশু ফিতরাতের (স্বভাবজাত ধর্মের) ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদি বানায়, খ্রিষ্টান বানায় এবং অগ্নিপূজক বানায়।’ {সহিহ বুখারি : ১৩৫৮; সহিহ মুসলিম : ২৬৫৮} চিরকাল যদি ফিতরাত অক্ষুণ্নই থাকে, তাহলে হাদিসের শেষাংশের অর্থ কী দাঁড়ায়?


এটা সংক্ষিপ্ত আলোকপাত মাত্র; বিস্তারিত পর্যালোচনা নয়। উম্মাহ নেটওয়ার্ক চ্যানেলের কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, উম্মাহর কল্যাণার্থে আপনারা আকিদা সিরিজের ভিডিওগুলো তৈরি করার জন্য প্রয়োজনে আরও সময় নিন। পর্যাপ্ত অধ্যয়ন করুন। হকপন্থি আকিদাবিশেষজ্ঞ আলিমগণের সঙ্গে পরামর্শ করুন। এতে যদি একটা আলোচনা তৈরিতে এক মাস বা একাধিক মাসও লেগে যায়, তাতেও সমস্যা নেই। সাধারণ দাওয়াহর বিষয়গুলোতে তো আর এত সময় লাগে না। কিন্তু নিরেট ইলমি বিষয়, দীনের মূল বুনিয়াদি বিষয়ে আলোচনা করতে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা সময় নিন। যেহেতু এই আলোচনাগুলোকে ভিত্তি বানিয়ে ভিডিওর শেষে আপনারা মুসলিমদের বিভিন্ন দল, উপদল ও শাখাদলের সমালোচনাও করছেন, সুতরাং ভিত্তি ভুল হলে সমালোচনাও যে তার মান হারাবে—এটাই কিন্তু স্বাভাবিক।

আমি আকিদা সিরিজের দুটো আলোচনাই কেবল শুনেছি। একটা আলোচনার ওপর সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন পূর্বের পোস্টে জানিয়েছি। আরেকটা আলোচনার ওপর খানিকটা দীর্ঘ মূল্যায়ন এই পোস্টে জানালাম। অন্য আলোচনাগুলোও শুনব ইনশাআল্লাহ। আশা করছি, বিষয়গুলোকে ‘আদ-দীন আন-নাসিহাহ’ (দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা) এবং ‘মুমিন মুমিনের আয়না’ হিসেবে নেবেন। আর যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়া তৃতীয় কেউ এ বিষয় নিয়ে অযথা ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে মাতামাতি না করলেই খুশি হব। ওয়াসসালাম।

Share This