১. ইসলামের চিন্তাধারা ও সংবিধান মাধ্যম এবং উপকরণ হিসেবেও এমন প্রভাব রাখে যে, যখনই এগুলো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তখনই এর নিদর্শন ও বরকত প্রত্যেক যুগ ও দেশে প্রকাশ পেতে শুরু করে। আজও যদি কোনো রাষ্ট্রে ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বর্তমান পৃথিবী উন্নতি ও অগ্রগতির জোয়ার বিস্ফারিত চোখে প্রত্যক্ষ করবে।
২. রেনেসাঁ আন্দোলনের জন্য একক কোনো চেষ্টা সফল হতে পারে না। এর জন্য বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
৩. সমাজ ও সামগ্রিক শক্তির আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই যা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় বা জমিন থেকে উদ্গত হয়, বরং প্রতিটি একক ব্যক্তির সমষ্টিরই নাম সমাজ। আর তাদের সম্মিলিত শক্তিই সামগ্রিক ও সামাজিক শক্তি।
৪. সমাজের মাঝে মানুষের অবস্থা এমন, মেশিনের মধ্যে তার ক্ষুদ্র অংশগুলো যেমন। মেশিনের ক্ষুদ্র ক্ষদ্র যন্ত্রগুলো যদি নিখুঁত না হয়, তাহলে মেশিনের সংযুক্তিও মাপসই ও সংগত হতে পারে না। যদি এমন মেশিন স্টার্ট করা হয়, তাহলে তা বেশিক্ষণ চলতে পারে না।
৫. মক্কিজীবনে ব্যক্তি সংশোধনের বিষয়টি মুখ্য ছিলো। ব্যক্তি সংশোধন পূর্ণ হবার পূর্বে সম্মিলিত কোনো কাজ, তা প্রতিরক্ষামূলক হোক কিবা পদক্ষেপ গ্রহণসুলভ, রাজনৈতিক বিবেচনায় তা সঠিক ছিলো না।
৬. আইন ও সংবিধান এমন কোনো স্বয়ংক্রিয় মেশিন নয়, যা নিজে নিজেই চলতে পারে। বরং একে বাস্তবায়নকারী মূলত মানুষই হয়ে থাকে, মানুষ যতোক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে মানুষ না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো আইন নিয়ম রাজত্ব ও প্রশাসন দুর্নীতিদমন অন্যায়ের সংশোধন এবং দুনিয়াতে শান্তি-নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।
৭. আল্লাহর রঙ হলো সেই রঙ, যা অন্য কোনো রঙের নিকট পরাস্ত হয় না। এটিই রাসুলুল্লাহ সা.এর প্রথম কীর্তি এবং ইসলামের প্রথম পুঁজি ও মৌলিক শক্তি, যা বিদ্যুৎ গতিতে সমগ্র দুনিয়াকে আপন রঙে রঙিন করে তুলেছিলো।
৮. অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে, কোনো ব্যক্তি বা জাতির উথান-পতন সুস্থতা-অসুস্থতার মূল ভিত্তি হলো তার পরিবেশ। আর মানুষ স্বভাবতই তার পরিবেশ এবং সমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজের অজান্তেই এর রঙ গ্রহণ করে। যে যাবত মানুষের সমাজ ঠিক না হবে, সে অবধি কোনো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণই কাজে লাগবে না। আর নিজ পরিবেশ ও সমাজের আশপাশে যদি একজন বিজাতীয় ব্যক্তি থাকে, তাহলে সেও পরিবেশ ও সমাজ সংস্কারে বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ফার্সিতে একটি প্রবাদ আছে— “বিজাতীয় সঙ্গী-সাথিদের থেকে সতর্কতা অবলম্বন করো।”
৯. আল্লাহ বলেন— “আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ জগতসমূহের প্রতি অনুগ্রহশীল।” {সুরা বাকারাহ: ২৫১}। আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে রুহুল মাআনিতে বলা হয়েছে— “এ আয়াতে রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। যদি দুনিয়াতে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান না থাকতো, তাহলে পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তা ধ্বংস হয়ে যেতো। এজন্যই বলা হয়েছে, দ্বীন ও রাজত্ব দু’টি যমজ শিশু। আর যেহেতু রাষ্ট্র ও সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, ফেতনা ও বিপর্যয় দূরীভূত করা, তাই হুকুমত ও সালতানাত কিছু সময়ও কুফরির সঙ্গে একত্রিত হয়ে থাকতে পারে না। এ কারণেই যখন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নিকট পরামর্শ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “আমি মানুষকে পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবো”, তখন তারা মূর্তিপূজা ও কুফরির কথা না বলে বলেছিলেন, মানুষ পৃথিবীতে খুন-খারাবি ও বিবাদ-বিসম্বাদ করবে। কেননা মৌলিকভাবে কুফর ও শিরক যদিও গুরুতর অপরাধ, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার বিবেচনায় খুন-খারাবি ও বিবাদ-বিসম্বাদ অধিকতর গুরুতর অপরাধ।
১০. আল্লাহ তাআলা যেসব বিষয়ে সরাসরি বা রাসুলের মাধ্যমে কোনো বিধান অবতীর্ণ করেননি, সেসব বিষয়ে মানুষের আইন প্রণয়ন করার অধিকার রয়েছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে এই অধিকার দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যেসব বিষয়ে কোনো বিধান অবতীর্ণ করেছেন, এর বিপরীতে আইন প্রণয়ন করার অধিকার মানুষের নেই। তবে যেসব বিষয়ে তিনি সরাসরি অথবা রাসুলের মাধ্যমে কোনো বিধান অবতীর্ন করেননি, সেসব বিষয়ে মানুষের এ অধিকার রয়েছে যে, নিজ দেশের সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে পারস্পরিক সলা-পরামর্শের মাধ্যমে প্রয়োজন মোতাবেক আইন প্রণয়ন করবে। বৈধ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার জন্য জনসাধারণকে এমন একটি প্রশস্ত ময়দানে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে সে নিজের ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করতে পারে। (উল্লেখ্য, তবে কিছুতেই তা শরিয়তের কোনো বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না।)