কোনো কোনো এলাকায় লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, চাঁদের বুকে আমরা যে কালো দাগ দেখতে পাই, যাকে কেউ কেউ চাঁদের বুড়িও বলে থাকেন, আমার চোখে যা দেখতে অনেকটা গর্ভস্থ সন্তানের মতো— তা নাকি রাসুলুল্লাহ সা. এর হাতে চাঁদ যে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো, তার চিহ্ন। অর্থাৎ, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর পুনরায় যখন তা জোড়া লেগেছিলো, তখন নিদর্শনস্বরূপ এই দাগটি রয়ে যায়। যেমন সেদিন এক সুহৃদের মুখে শুনলাম, ছোটকালে সে-ও নাকি পাড়ার মুরুব্বিদের মুখে এমন গল্প অনেক শুনেছে। তার বর্ণনা— “আল্লাহর রাসূলের ইশারায় চাঁদ দু’টুকরা হয়ে গিয়েছিলো। তাই পুনরায় জোড়া লেগে যাওয়ার সময় দাগ পড়ে যায়’’। এ কথার তো লোকমুখে প্রচলন ছাড়া আর কোনো ভিত্তিই নেই। তাছাড়া যাদের দাগের দিকে কেউ গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে সে কখনো এ-ধরনের মন্তব্য করারই কথা নয়। আর মুসলমান ভিত্তিহীন কথায় কীভাবে কান দিতে পারে! তা নিজের মুখে আনা তো ‘দূর কি বাত’। তাই এ বিষয় নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করারও কোনো অর্থ নেই।
যে বিষয়ের মাঝে মুসলমানদের দীন বা আখিরাতের কোনো উপকারিতা নিহিত নেই, তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করাটা কাম্য নয়। ফেরাউনের নানীর নাম কী, ইয়াযিদ জান্নাতি না জাহান্নামি— এ ধরনের বিষয়ের আলোচনায় লিপ্ত হওয়া অযথা নিজের মূল্যবান সময় ক্ষেপনের নামান্তর। মুফতি শফি রহ. এর কাছে একবার এই প্রশ্ন করা হলো— ”হযরত, ইয়াযিদ জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে যাবে?” হযরত উত্তর দিলেন— ”ইয়াযিদ কোথায় যাবে তা তো জানি না। তবে আমি তো এ ভেবেই কূল পাই না যে, আখের আমার ঠাঁই জান্নাতে হবে না জাহান্নামে! যে বিষয়ে মুসলমানদের দীনী বা পারলৌকিক কল্যাণ নেই, মুমিনের উচিত তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। [মেরে ওয়ালেদ মেরে শায়খ]
তাফসিরে তাবারিতে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আলী রা. একবার বললেন, তোমাদের যা যা ইচ্ছে আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো। তখন ইবনুল কাওয়া রহ. তাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাঁদের কালো দাগটি আসলে কী? তখন আলী রা. বিরক্ত হয়ে বললেন—
قاتلك الله، هلا سألت عن أمر دينك وآخرتك؟
‘ধ্যাত (শাব্দিক অর্থ— আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন/তোমাকে মেরে ফেলু ইত্যাদি। উল্লেখ্য- এর দ্বারা শাব্দিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এর শাব্দিক অর্থ তো হলো— قاتلك الله معناها: قتلك، أو لعنك، أو عاداك [তুহফাতুল আহওয়াযি]। হাফিজ ইবনে হাজার রহ. “ফাতহুল বারি” গ্রন্থে বলেন— يحتمل أن يقال إن قول عمر ـ رضي الله عنه: قاتل الله سمرة ـ لم يرد به ظاهره، بل هي كلمة تقولها العرب عند إرادة الزجر، فقالها في حقه تغليظا عليه.)
তুমি তোমার দীন বা আখিরাতের কোনো বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারলে না!”
তাহলে আমরা কেনো এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি? হাঁ, প্রথমে প্রসঙ্গটির অবতারণার প্রেক্ষাপট জানিয়ে রাখি। এক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই এবং বিদগ্ধ মাওলানা সাহেব তার এক পোস্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। অনেকেই দেখলাম, তাতে বেশ প্রভাবিতও হয়েছে। তাই বিষয়টির হাকিকতের প্রতি সামান্য আলোকপাত করার জন্যই এই বিনম্র প্রয়াস। প্রচলিত বিষয়ের পর্যালোচনা প্রকাশ্যেই করা নিয়ম।
তার পোস্টের দুটো দিক ছিলোঃ ১. চাঁদের দাগের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কী বলে? ২. সে ব্যাপারে ইসলামের কী ভাষ্য?
দ্বিতীয় অংশের ব্যাপারে হুবহু তার ভাষায় তার বক্তব্যের খোলাসা হলো— //এ তো গেলে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা। এ দাগ সম্পর্কে ইসলাম কী ব্যাখ্যা করে?
হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. ও হযরত আলী রাযি. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তারা বলেন যে, ‘চাঁদে আগে সত্তর ভাগ আলো ছিল। আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল আ.কে হুকুম করলেন চাঁদের আলো কমানোর। জিবরাঈল আ. তার পাখনা দিয়ে ৬৯ ভাগ আলো মুছে নিয়ে সূর্যে স্থাপন করলেন আর চাঁদে রয়ে গেল মাত্র এক অংশ আলো। তো জিবরাঈল আ. ৬৯ ভাগ আলো স্থানান্তর করে নেওয়ার সময় চাঁদে তার পাখনা ফিরানোর কারণে যে আঁচড় লেগেছিল, সে আঁচড়টাই হচ্ছে কালো দাগটা যা এখনো রয়ে গেছে।’’// এরপর তিনি কিছু হাওয়ালাও উল্লেখ করেছেন, যা-র সবগুলো তার বক্তব্য প্রমাণিত করে না আর যে সূত্রগুলো প্রমাণিত করে তা দ্বারাও “বিশুদ্ধ সূত্রে” বলাটা বিশুদ্ধ হয় না।
আমরা এখানে সাধারণ পাঠকদের কথা বিবেচনা করে বিষয়টাকে বেশি তাত্ত্বিক করবো না। সহজবোধ্যভাবেই মূল কথাগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
এ বিষয়ে ইসলামের মনীষীগণের ভাষ্যে কিছুটা বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে আমরা তাদের ইখতিলাফের ভিত্তিটা দেখে নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন—
وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ
আর আমি রাত ও দিনকে দুটি নিদর্শন বানিয়েছি। অনন্তর রাতের নিদর্শনকে অন্ধকার করেছি আর দিনের নিদর্শনকে আলোকিত করেছি; যাতে তোমরা আপন প্রতিপালকের অনুগ্রহ (রিযিক) সন্ধান করতে পারো এবং বছর-সংখ্যা ও (মাসের) হিসাব জানতে পারো। [সুরা বনি ইসরাইলঃ ১২]
এ আয়াতে “রাতের নিদর্শন” এবং “দিনের নিদর্শন” কথা দুটোর অর্থ কী— এ নিয়ে ইখতিলাফের ভিত্তিতে উপরিউক্ত বিষয়ে ইখতিলাফ হয়েছে।
কেউ এর অর্থ এভাবে করেছেন— রাত এবং দিন আল্লাহ তাআলার দুটি নিদর্শন, যেমনটা আয়াতের প্রথম অংশে স্পষ্ট বলা হলো। আল্লাহ তাআলা রাতের এই নিদর্শনকে করেছেন অন্ধকার আর দিনের নিদর্শনকে করেছেন আলোকিত।
আর কেউ “রাতের নিদর্শন” দ্বারা অর্থ নিয়েছেন চাঁদ এবং “দিনের নিদর্শন” দ্বারা অর্থ নিয়েছেন সূর্য। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা চাঁদকে করেছেন অন্ধকার আর সূর্যকে করেছেন আলোকিত।
মুহাক্কিক মুফাসসিরগণের ঝোঁক প্রথম তাফসিরের দিকেই। আয়াত থেকেও তো স্বভাবতঃ এমনটাই অনুমিত হয়। পূর্বের মুফাসসিরগণ তো বটেই, স্মরণকালের বিদগ্ধ মুফাসসিরগণও এ অভিমতকেই গ্রহণ করেছেন। আল্লামা তানতাবি রহ. বলছেন—
والذي نراه: أن الاتجاه الأول أقرب إلى الصواب، لأنه هو الظاهر من معنى الآية الكريمة ولأنه لا يحتاج إلى تقدير، وما كان كذلك أولى مما يحتاج إلى تقدير، ولأن الليل والنهار هما بذاتهما من أظهر العلامات والأدلة على قدرة الله- تعالى- ووحدانيته.
আমরা মনে করি, প্রথম ব্যাখ্যাটাই বিশুদ্ধতার নিকটবর্তী। কেননা—
ক. আয়াতে কারিমার বাহ্যিক অর্থ তা-ই
খ. এক্ষেত্রে উহ্য কিছু ধরারও প্রয়োজন পড়ে না। আর যার অবস্থা এমন, তা তো ঐ ব্যাখ্যার থেকে অধিক উপযুক্ত, যেক্ষেত্রে উহ্য কিছু ধরতে হয়।
গ. রাত-দিন নিজেরাই তো আল্লাহ তাআলার কুদরত এবং একত্ববাদের প্রতি সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলির অন্যতম।
যারা “রাতের নিদর্শন” দ্বারা চাঁদ এবং “দিনের নিদর্শন” দ্বারা সূর্য অর্থ নিয়েছেন, তারাও আবার পরবর্তীতে এসে দু’দলে পরিণত হয়েছেন। একদলের বক্তব্য হলো, চাঁদকে আল্লাহ তাআলা অন্ধকার করেই সৃষ্টি করেছেন। (উল্লেখ্য, চাঁদ অন্ধকার হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য— ক. চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই, খ. চাঁদের বুকের কালো দাগ, গ. পূর্ণিমার রাতের পর চাঁদের অংশগুলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে ছেয়ে যায়)। আরেক দলের বক্তব্য হলো, আল্লাহ তাআলা চাঁদকে প্রথমে আলোকিত করে সৃষ্টি করেছিলেন। পরে তার আলো মিটিয়ে দিয়েছেন। আয়াতের مَحَوْنَا শব্দটিকে তারা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন; যেহেতু এর শাব্দিক অর্থ হলো— মুছে দেয়া, মিটিয়ে দেয়া। (মাস-বছরের হিসাব গণনার বিষয়টিকেও দলিল হিসেবে এনে থাকেন। বিস্তারিত জানতে ইমাম মাতুরিদি রহ. এর তাওয়িলাতু আহলিস সুন্নাহ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)
এই শেষ ফরিকের পক্ষে অনেক ভিত্তিহীন বর্ণনাও রয়েছে। ইমাম সুয়ুতির (শুদ্ধ-ভেজাল তাফসিরের মিশেল গ্রন্থ) আদদুররুল মানসুর এবং এ ধরনের তাফসির গ্রন্থে এমন অনেক কথাই পাওয়া যাবে। অধিকাংশ তাফসির গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যই এটা। তার শুদ্ধ-অশুদ্ধ, সহিহ-গলদ সব মতামতই সংকলন করার চেষ্টা করেন। নিজেরা আর বাছ-বিচার করেন না। দায়িত্বটা পাঠকের কাঁধেই ছেড়ে দেন। পাঠকই যেঁচে নিবে। ইমাম সুয়ুতি তো সনদও উল্লেখ করেন না। বর্ণনার তাহকিক করাটাও অনেক ক্ষেত্রে তাই দুরূহ হয়ে যায়; বিশেষত যে বর্ণনাগুলো প্রসিদ্ধ হাদিসের কিতাবাদিতে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমাদের সেই পোস্টদাতা ভাই যে আজগুবি বর্ণনাটা উদ্ধৃত করেছেন, এ ছাড়াও আরো বেশি আজগুবি টাইপের একাধিক বর্ণনা রয়েছে তাফসিরের গ্রন্থাদিতে; সেগুলো উল্লেখ করে অযথা আমরা পোস্ট দীর্ঘায়িত করবো না। হাদিসের বিষয়গুলো এমন, সেগুলোর বিশুদ্ধতা যদি প্রমাণিত না হয়, তাহলে তার ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করার জন্য আলাদা দলিল দেয়ার প্রয়োজন নেই। কোনো এক মুফাসসির সনদ উল্লেখ না করে, কোনো কিতাবের হাওয়ালা না দিয়ে একটা হাদিস বর্ণনা করে বসবেন আর পরেও বা-সনদ কোনো কিতাবে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না— এমন বর্ণনাসমূহ গ্রহণ করার কোনোই সুযোগ বা অবকাশ নেই। এজন্যই তাফসিরের সব কিতাব সবার জন্য পাঠ্য নয়।
তবে তাদের পক্ষে আয়াতের এই শব্দটি ছাড়াও আরেকটি দলিল আছে। তাফসিরে তাবারির একটি বর্ণনা—
حدثنا القاسم، قال: ثنا الحسين، قال: ثني حجاج، عن ابن جريج، قال: قال ابن عباس: كان القمر يضيء كما تضيء الشمس، والقمر آية الليل، والشمس آية النهار، فمحونا آية الليل: السواد الذي في القمر.
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, সূর্য যেমন আলোকিত, চাঁদও তেমন আলোকিত ছিলো। চাঁদ হলো রাতের নিদর্শন আর সূর্য হলো দিনের নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, আমি রাতের নিদর্শনকে মিটিয়ে দিয়েছে— চাঁদের বুকের কালো রঙ।
বাহ্যত এই বর্ণনাটি কারো কারো স্খলনের কারণ হয়েছে। বর্ণনাকারীরাও ফেলে দেয়ার নন। কিন্তু মুহাক্কিকগণের কাছে এটা গ্রহণীয় হয়নি। কেনো?
ক. রেওয়ায়েতের মাঝে ইনকিতা’-বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। ‘যাইলুস সাওয়ায়িকে’র গ্রন্থকার বলছেন, رواية ابن جريج عن ابن عباس رضي الله عنهما أن القمر كان يضيء كما تضيء الشمس لا يعتمد عليها, لأنها منقطعة.
খ. ইবনু আবি নাজিহ থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত বর্ণনা এর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেই বর্ণনা কী?
حدثنا أبو كريب، قال: ثنا ابن أبي زائدة، قال: ذكر ابن جريج، عن مجاهد، في قوله ( وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ ) قال: الشمس آية النهار، والقمر آية الليل (فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ) قال: السواد الذي في القمر، وكذلك خلقه الله.
এখানে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, চাঁদের বুকে যে কালো দাগ— এভাবেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তা এভাবে আছে। মুজাহিদ রহ. তাফসির শিখেছেন ইবনে আব্বাস রা. এর কাছে। সুনিশ্চিতভাবে তা প্রমাণিত এবং তাফসিরের এই মহান ইমামের বক্তব্য-অভিমতও সমাদৃত, গ্রহণীয়। তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ইবনে আব্বাস রা. এর অভিমত— “রাতের নিদর্শন” হলো চাঁদ। আল্লাহ তা-কে অন্ধকার করেছেন। এটাই চাঁদের বুকের কালো রঙ। আর এভাবেই আল্লাহ চাঁদকে সৃষ্টি করেছেন।
এবার আমরা মূলকথায় ফিরি। তাহলে এই ব্যাপারে সর্বমোট তিন ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেলো। আমাদের মহান ইমাম শাইখুল ইসলাম মাতুরিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে (তাওয়িলাতু আহলিস সুন্নাহ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) পুরোটার খোলাসা দেখি—
১. চাঁদ প্রথমে সূর্যের মতো আলোকিত ছিলো। পরে তার সত্তরভাগের উনসত্তরভাগ মিটিয়ে দেয়া হয়েছে আর এক ভাগ রাখা হয়েছে এবং মিটানোর দাগ হিসেবে চাঁদের বুকে কালো রঙটা রয়ে গেছে। এটা হলো কতেক মানুষের ধারণা। (আর এ বর্ণনাটাকেই পোস্টদাতা ঘটা করে ইসলামের দৃষ্টীভঙ্গি-অভিমত বলে চালিয়ে দিয়েছেন এবং বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিকও প্রমাণিত করেছেন। আমি বলছি না, তিনি খেয়ানত করেছেন। তবে তিনি তাহকিকের হক আদায় করেননি। তাই ইসলামের ওপরই যুলুম করে বসেছেন। তবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরও তার সেই পোস্টের প্রসার উদ্বগ জাগায়। জেনেবুঝে মানুষ কীভাবে ভুল প্রচার করতে পারে?!)
২. আলী রা. এবং ইবনে আব্বাস রা. এর অভিমত হলো, আয়াতে “রাতের নিদর্শন” দ্বারা চাঁদ এবং “দিনের নিদর্শন” দ্বারা সূর্য বোঝানো হয়েছে। আর চাঁদকে অন্ধকার করার অর্থ তার মাঝের সেই কালো রঙ।
৩. আবু বকর, হাসান বসরি, ইমাম মাতুরিদি সহ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মহান ইমামগণের অভিমত হলো, আয়াতে তো চাঁদ-সূর্যের উল্লেখই নেই। এখানে রাত-দিনই উদ্দেশ্য। আর রাত যে অন্ধকার এবং দিন আলোকিত এ বিষয়টাও তো সুস্পষ্ট। এটাই আল্লাহ তাআলার অনন্য নিদর্শন।
চাঁদের কালো দাগের ব্যাপারে তবে তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর বক্তব্য পরিষ্কার হলো না!
কে বলেছে, পরিষ্কার হয়নি? শুনুন তবে—
এ ব্যাপারে দীর্ঘ দীর্ঘ উদ্ভট বর্ণনাগুলো হলো ভিত্তিহীন। কোরআন-সুন্নাহয় এর ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। দু’জন সাহাবি আয়াতের তাফসিরে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করায় তারা অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, আল্লাহ তাআলা বলছেন, তিনি চাঁদকে অন্ধকার করেছেন। তো অন্ধকার কোথায়? ঐ যে চাঁদের বুকের কালো দাগ, সেটাই হলো অন্ধকারের অর্থ। আর আল্লাহ তাকে এভাবে কালো রঙ দিয়ে তথা অন্ধকার করেই সৃষ্টি করেছেন। উনাদের এই ভিন্ন তাফসিরও মহান ইমামগণ গ্রহণ করেননি। তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে, চাঁদের কালো দাগের ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহ আমাদেরকে কিছু জানায়নি। তাহলে তা প্রয়োজনীয় নয় বলেই আল্লাহ এবং তার রাসুল জানাননি। আর সৃষ্টির এসব নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে আল্লাহ ছাড়া কেইবা জানে?! তাই অযাচিত ধারণা-বিশ্বাস লালন করে নিজের আকিদা-বিশ্বাসকে কলুষিত করাটা অর্থহীন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
পোস্টদাতার উদ্দেশ্যে— আকল দ্বারা যা বোধ করা যায় না, এমন বিষয়ে সাহাবিগণের বক্তব্য মারফু হাদিসের হুকুমে ধর্তব্য হয়। ইবনে আব্বাস রা. এর নামে যে বর্ণনাটা উল্লেখ করা হয়েছে, তা-ও এমন বিষয়, যা আকল দ্বারা বোধ করা সম্ভব নয়। তাহলে অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তিনি রাসুলুল্লাহ সা. থেকে তা শুনেছেন। তাহলে সেই বর্ণনা শুধু সাহাবি নয়, বরং রাসুলের ওপরই মিথ্যারোপের মধ্যে শামিল। মিথ্যারোপকারীর পরিণতি তো অজানা নয়। এসব ক্ষেত্রে বর্ণনাকারী ও জালকারী উভয়ই অপরাধী। দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরও ফিরে না আসা কিন্তু স্বভাবতই উদ্বেগ জাগায়। এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে তা কিন্তু ভালো ফলাফল বয়ে আনার কথা নয়। এরপর একটা ভিত্তিহীন বর্ণনা উল্লেখ করে তা নিসবত করা হয়েছে আলী রা. এবং ইবনে আব্বাস রা. এর দিকে। আবার তার ওপর হুকুম আরোপ করা হয়েছে “বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত” এই বলে। ভিত্তিহীন বর্ণনার হাওয়ালায়ও পরিস্ফুট খেয়ানত বা বোধগম্যহীনতা।
স্রেফ ইলমের আমানত হিসেবে এই মুনাকাশা-পর্যালোচনা। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ-উদ্দেশ্য এতে জড়িত নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাফাককুহ ফিদ দীন দান করুন। আমিন।
জাযাকাল্লাহ শায়েখ।
অত্যান্ত উপকারী আলোচনা।
তথ্যপূর্ণ আলোচনা৷
শুকরান৷